The Poisonwood Bible
লিলিফুলদের বাইবেল
কাহিনিটি শুধু পাঁচজন নারীকন্ঠে বলা হয়েছে। পাঁচজন কথক বইটিতে। বারবারা কিলভারের ‘পয়জনউড বাইবেল’ বা বিষবৃক্ষ বাইবেল। এই পাঁচজন কথক পাদ্রী প্রাইসের স্ত্রী অর্লিয়ানা এবং তার চার কন্যা রাচেল, লিয়া, আডা ও রুথ। ডায়েরি ও স্মৃতিকথার মতো করে পালা করে কাহিনিটি বলা হচ্ছে।
কে এই বারবারা কিলভার? জন্ম ৮ এপ্রিল ১৯৫৫। মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। মেরিল্যান্ডের এনাপোলিসে জন্ম। বেড়ে উঠেছেন কেন্টাকিতে। সাত বছর বয়সে, চিকিৎসক বাবার সাথে কঙ্গোতে চলে যান। পরবর্তীতে, আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যার পাঠ গ্রহণ করেন। বারবারার উপন্যাসগুলো একাধিকবার বেস্ট সেলার হয়েছে। বর্তমানে, ভার্জিনিয়ার একটি গ্রামাঞ্চলে বসবাস করছেন। সাহিত্যের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে চিন্তক। তাছাড়া নারী যে নিছক বাক্সপেটরা বা দখলের সামগ্রী নয়, এই বিষয়ে সারাজীবন ধরে সোচ্চার থেকেছেন। তাঁর একটি কবিতা পড়লে বোঝা যায়:
দখলিস্বত্ব
যা কিছু আমার বাসনা জুড়ে আছে:
একটা রং। একটা বনভূমি।
অপদেবতা এবং আমার মুখস্থিত বরফ।
সবকিছুই
যেগুলোর মালিকানা অর্জন করা যায় না।
একটা চিতাবাঘ, একটা জীবন, একটা চুম্বন।
কখনও চলে যেতে দাও না
তুমি।
তুমিও যে আমাকে চেয়েছো
সেটা জানতে পারা
বিশ্বাসী কাজের মতই সুন্দর।
সময় ১৯৫৯! গল্পের শুরু কঙ্গোর অভ্যন্তরে সভ্যতা থেকে বহুদূরে অরণ্যঘেরা ছোট্ট গ্রাম কিলাঙ্গায়, যেখানে এই মার্কিন পরিবারটি নিক্ষিপ্ত হয়েছে। নিক্ষিপ্তও ঠিক নয়। পাপস্খলনের জন্য স্বইচ্ছায় রেভারেন্ড প্রাইস পাদ্রী হয়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া কঙ্গোতে এসেছেন। আসল উদ্দেশ্য সভ্যতা রপ্তানী করা ও আলোকবিতরণের নামে বাইবেলকে ও খ্রিস্টান ধর্মকে প্রচার করা। সেই দখলিস্বত্বের গল্প।
স্ত্রী আর্লিয়ানাও তো বাক্সপেটরার মতোই। তার ইচ্ছে ও অনিচ্ছার কোনও দাম নেই। সাধ করে আর্লিয়ানা এই আফ্রিকায় আসেনি। পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য করতে এসেছে। কঙ্গোবাসীকে যেমন ব্যাপটাইজ করতে চায় আমাদের পাদ্রী সাহেব তেমন স্ত্রীকে মনে করেন, ‘বিজেতার স্ত্রী, সে তো বিজয়ের বস্তু বই নয়?’
আসলে এই কাহিনিতে আমরা দেখি তথাকথিত সত্য ও আলোকের ‘মিশন’ কীভাবে মিথ্যা ও অন্ধকারে পরিণত হচ্ছে। উন্নতি, জাতীয় গৌরব ও আলোকপ্রাপ্তির ‘সভ্যতা’ আসলে অন্যায়ের, লুণ্ঠনের ও অরাজকতার। সভ্যতা এক মুখোশ মাত্র। সংবাদমাধ্যম, ধর্ম ও রাষ্ট্র এই সত্যগোপনে সহয়তা করে। এমনও মনে হয় উপন্যাসটি পড়তে পড়তে যে সভ্যতা মানে আসলে কত অদরকারি জিনিস উৎপাদন করা যায় তার প্রতিযোগিতা। বাহুল্যকে নিয়ে কীভাবে চলতে হয় তার দেখনদারি।
মেয়েগুলোও তেমন। বড়োটা ১৬/১৭ বছরের রাচেল, স্বভাবে কিছুটা স্বার্থপর। লিয়া ও আভা যমজ। লিয়া বর্হিমুখী, পিতৃভক্ত। আভা অন্তর্মুখী, বিকলাঙ্গ, স্বেচ্ছা মৌনী। এই চরিত্রটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেন লেখকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। নীরবে সবকিছু লক্ষ করে, বাঁকা ভাবে দেখে (নেতিবাচক নয়), কবিতা পড়ে, শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসে।
বাইবেল এই গ্রন্থটির সর্বাঙ্গে। আমরা দেখব, এই ঘন অরণ্যে বাইবেল কীভাবে হোঁচট খেয়েছে, আছাড় খেয়ে পড়েছে, আবার নতুন আলোকে ডালপালা মেলেছে।
আমরা দেখব কীভাবে অর্থ বিকৃত হচ্ছে বাইবেলের, ভ্রমের শিকার হচ্ছে, লুন্ঠনের ও দর্পের প্রতীক হচ্ছে। আবার মানুষই এর প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করছে, মুক্তির ইশারা পাচ্ছে।
পাদ্রী রেভারেল্ড প্রাইস, কিকোঙ্গো ভাষায় ‘টাটা’ প্রাইস, স্ত্রী ও চার কন্যা সহ কিলাঙ্গা গ্রামে এসেছেন কঙ্গোবাসীকে ব্যাপটাইজ করতে। সুদূর আমেরিকা থেকে পাড়ি দিয়েছেন অথচ সঙ্গে প্রায় কিছুই আনেননি। যুক্তি হিসেবে বাইবেলকে দাঁড় করাচ্ছেন। লিলিফুলদের কি অন্নবস্ত্রের ভাবনা আছে, অ্যাসপিরিনের ভাবনা আছে? Luke-এ আছে: Consider the lilies, how they grow: they neither toil nor spin, yet I tell you, even Solomon in all his glory was not arrayed like one of these.
বড়ো মেয়েটির উত্তরটি কিন্তু চমৎকার! বিড়বিড় করে সে বলে : লিলিফুলদের বাইবেলের দরকার হয় অবশ্যি!
অধ্যায়গুলোর নামও বাইবেলের অনুকরণে। যেমন— ‘জন্মবৃত্তান্ত’ বা ‘উন্মোচন’ বা ‘যাত্রা’। দুটি সভ্যতার সাক্ষাৎকার সবসময়ই কৌতূহলোদ্দীপক। কিকোঙ্গো ভাষায় যে লিঙ্গভেদ তা মার্কিন কিশোরীর কাছে বিস্ময়কর। সেখানে পুরুষ পাথর ও নারী পাথর হতে পারে। আমরা দেখি গ্রামপ্রধান টাটা নডু একটা কাঁচহীন চশমা পরে বসে আছে বা স্থানীয় পুরুষমানুষ মেয়েদের সোয়েটার পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদেশী একটা সভ্যতা এসব তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। যীশু যদি বিষবৃক্ষ হয়, মেয়েদের সোয়েটার তার উল্টোপিঠ নয় কি?
কঙ্গো আগে বেলজিয়ামের দখলে ছিল। এখন মুক্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু আরও এক বড়ো দখলের দিকে চলে যাচ্ছে। একটা কথোপকথনে সুন্দর ধরা পড়েছে এটি:
উদ্ধার না ঘন্টা… আমরা, বেলজিয়ানরা, ওদের ক্রীতদাস বানিয়েছি, রাবার-চাষীদের হাত কেটেছি। এখন আপনারা, আমেরিকানরা, ওদের মজুরীদাস বানাচ্ছেন খনিতে এবং নিজেদের হাত নিজেদেরই কাটতে দিচ্ছেন।
সারা বই জুড়ে কাহিনির ঘনঘটা। এখানে তার বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। আমি শুধু বইটির দর্শনভূমি নিয়ে কিছু কথা বলি। আসলে এই কাহিনিতে আমরা দেখি তথাকথিত সত্য ও আলোকের ‘মিশন’ কীভাবে মিথ্যা ও অন্ধকারে পরিণত হচ্ছে। উন্নতি, জাতীয় গৌরব ও আলোকপ্রাপ্তির ‘সভ্যতা’ আসলে অন্যায়ের, লুণ্ঠনের ও অরাজকতার। সভ্যতা এক মুখোশ মাত্র। সংবাদমাধ্যম, ধর্ম ও রাষ্ট্র এই সত্যগোপনে সহয়তা করে। এমনও মনে হয় উপন্যাসটি পড়তে পড়তে যে সভ্যতা মানে আসলে কত অদরকারি জিনিস উৎপাদন করা যায় তার প্রতিযোগিতা। বাহুল্যকে নিয়ে কীভাবে চলতে হয় তার দেখনদারি।
ছোটো মেয়ে রুথের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। স্বামীকে পেছনে ফেলে জীবিত তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আর্লিয়ানা গৃহত্যাগ করে রওনা দেন আমেরিকা। আসবাব, জামাকাপড় ও বাসনকোসন বিলিয়ে দেয়। সহসা তার মনে হয় বড়ো বেশি আবর্জনায় ভরে ছিল তার জীবন। প্রতিবেশী একটি মেয়ে আর্লিয়ানার হাতে তুলে দিল কমলা ও জল।
কিছু কিছু জায়গা কবিতার মতো মনে হয়। আফ্রিকার স্বদেশি ধর্মে জীবিত ও মৃতকে সমান পুজো করতে শেখায়। আভা ভাবে, ঈশ্বর তবে নিশ্চয় ভাইরাস। খাদ্য ও খাদক উভয়েই ঈশ্বর। ছোটো মেয়ে মৃত্যুর পর কোনও উদ্ভিদ বা বনলতা হয়ে হয়তো জন্ম নিয়েছে। সেই মৃত রুথ তার মা-কে বলছে:
হে জননী, তুমি কিসের অনুশোচনা করছ?মনে আছে তোমরা অরণ্যের একটা পথ দিয়ে চলছিলে, আর ডাল ভেঙে একটা মাকড়সা চিৎ হয়ে পড়েছিল। আর তোমার ছোটো মেয়ে সেই মাকড়সাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছিল। যদি না সেই পথে তোমরা যেতে, ডালটিও ভাঙতো না, মাকড়সাটিও মরত না। কার্যকারণ শৃঙ্খলা এমনই! এইভাবে জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে আমরা ইতিহাসকে স্পর্শ করি। ইতিহাস একটি মহাসত্তা।
মাকে সে মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘Think of the vine that curls from the small square plot that was once my heart.That is the only marker you need.Move on.Walk forward into light’
উপন্যাসটি এখানেই শেষ হচ্ছে। বিষবৃক্ষ আমাদের কাছে আর একটি উপন্যাস মাত্র থাকে না। ইতিহাস সতত রূপন্তরশীল। কীভাবে সে পথ খুঁজে নেয় তা আজও রহস্যময়। কোথাও মায়া রহিয়া যায়। কঙ্গোর দোকানে যে সঙ্গীত বাজছে তা একসময় আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস বাহিত হয়ে আমেরিকা গিয়ে নতুন চেহারায় আবার আফ্রিকাতেই ফিরে এসেছে।
অনুশোচনার ভার বহন করা জীবন নয়, এগিয়ে চলাই জীবন। এই উপন্যাস পাঠে আমাদের এগিয়ে চলবার জ্ঞান অর্জন হয়।