The Curtain : An Essay in Seven Parts
নগ্ন নির্জন হাত
কিছু বই বিরল গোত্রের। সাহিত্যের কোনো জঁর-এ এদের ফেলা যায় না। মিলান কুন্দেরার ‘দ্য কার্টেন’ এমনই এক মেরুসমুদ্র। উপন্যাসকে কেন্দ্র করে সাতটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ৭৪টি তরঙ্গে মাত্র ১৫০ পৃষ্ঠার বইটি যেন স্মৃতি ও বিস্মৃতির অধিক সান্দ্র।
প্রায় আর সমস্ত বইয়ের মতো সাতটি অধ্যায়ই কেননা কুন্দেরার কাছে সপ্ত-খন্ডের স্থাপত্য ‘গভীর, সংজ্ঞাহীন ও অনধিগম্য’ এক তাড়না। যুগপৎ নিস্ফলতা ও সফলতা যে উপন্যাসের অর্জন, যে কখনো কেন্দ্র আবার কখনো প্রান্তের, জীবনের অনিবার্য পরাজয় থেকে যার যাত্রা শুরু আর চেতনা-প্রবাহ জাদুবাস্তবতা উত্তর-আধুনিকতার ভুবনে যার ডানা মেলা একদিন; তাদের সকল অভিপ্রায়, প্রশ্নমুখিনতা, প্রত্নলেখ, টিপছাপ বইটিতে নথিভুক্ত আছে।
৭৮ বছরের এক যুবক, ৪০ বছর আগেই যাঁর ‘দ্য জোক’ নামের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি লেখা হয়ে গেছে। অ্যাফোরিজম, বিবৃতি, কিসসা, মন্তব্য, গল্পগাছায় এবার তিনি ভিন্ন খেলায় মেতেছেন। ছোটো ভূখন্ড বনাম বড়ো ভূখন্ড, লিরিসিজম বনাম নভেলিস্টিক, মধ্য ইউরোপ বনাম পূর্ব ইউরোপ, প্যারিস বনাম প্রাগ সেখানে ঘূর্ণি তোলে। এক অদৃশ্য রূপোলি সেতু লাতিন আমেরিকা ও মধ্য ইউরোপকে জুড়ে দেয়। প্যারিসের এক প্রাতরাশের টেবিলে বসে কুন্দেরা ও ফুয়েন্তেসের আড্ডার লব্জ আমাদেরকেও যেন ছুঁয়ে যায়। ফুয়েন্তেস কেন ‘দিস আই বিলিভ’ গ্রন্থে কাফকা প্রসঙ্গে কুন্দেরার উল্লেখ করেন, ভিন্ন পথে তা ব্যক্তিগত আবিষ্কার হয়ে থাকে।
বলবার পরিসর খুব বড়ো নয়, বলবার কথাও খুব অল্প। তবু ঘুরে ঘুরে এক কথা বিভিন্ন স্বরে বলে চললে এক অভিঘাত সৃষ্টি হয়। অপরূপ অনুরণন মগজে চারিয়ে যায়। এক মহা সিম্ফনিতে কুন্দেরা আত্মতা বর্ণনা করেছেন।
উপন্যাসকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের ইতিহাসকে অবলম্বন করতে হবে। এই ইতিহাসের প্রথম অক্ষর বড়ো হাতের।
কুন্দেরার মনোযোগ অবশ্য দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী লেখক। কাফকা, মুসিল, ব্রোখ, হাশেক, গমব্রোভেচ। এদের প্রত্যেকের উপন্যাস নিয়ে কুন্দেরা সহজাত ভঙ্গিতে আলোচনা করেছেন। কুন্দেরার সব থেকে বড়ো গুণ কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না পাঠকের ওপর। জীবনের লঘুতার খোঁজে একদিন ঘর ছেড়েছেন যে লেখক তাঁর লেখা তো নির্ভার হবেই।
‘দ্য কার্টেন’ শুরু হচ্ছে উপন্যাস আঙ্গিকের সুঠাম সচলতা ও স্বভাব স্বকীয়তা দিয়ে। সেরভান্তেস প্রথম সেই পর্দা ছিঁড়েছিলেন যা জীবনের গদ্যকে আড়াল করে রেখেছিল। কিংবদন্তি দিয়ে বোনা এক জাদুপর্দা জগতের সামনে টাঙানো ছিল, সেরভান্তেস দন খিখোতেকে পাঠালেন সেই পর্দাকে ছিঁড়ে ফেলতে। নাইটের চোখের সামনে গদ্যের সমস্ত কৌতুকপ্রদ নগ্নতা দৃশ্যমান হ’ল। এই পর্দা পূর্বনির্ধারিত ব্যাখ্যানের পর্দা। ভাবাদর্শ, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাস, মিথ্যা মহিমার এই পর্দা আমাদের প্রত্যহ অভিজ্ঞতার প্রকৃত বুনন ও সৌন্দর্য সম্পর্কে অন্ধ করে রাখে।
লরেন্স স্টার্ন তাঁর ‘ট্রিস্ট্রাম স্যান্ডি’ উপন্যাসে এক ধাপ এগিয়ে গল্পের স্বৈরাচারকে ক্ষমতাচ্যুত করল। বালজাকের উপন্যাসে স্বয়ং ইতিহাস চরিত্র হয়ে উঠল। দস্তয়েভস্কি উপন্যাসকে দিল এক অমোঘ বিধুরতা, তাঁর লেখায় ঘটনাবাহুল্যতা ও সমস্থানিকতা এমন এক সৌন্দর্যবিন্দু স্পর্শ করল যেখানে দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিকতা ম্লান হয়ে যায়। বিপরীতে দাঁড়িয়ে ফ্লব্যের উপন্যাসের নাট্যময়তা ভাঙতে চাইলেন।
হেনরি ফিল্ডিং ‘গার্গান্তুয়া ও পান্তাগ্রুয়েল’ থেকে দু’শো বছর ও ‘দন খিখোতে’ থেকে দেড়শো বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ‘এক নতুন লিখন তল্লাটের পত্তনকারী’ হিসাবে শিহরিত হলেন। তলস্তয় আবিস্কার করলেন আত্মহত্যার গদ্য। চারশো বছরের এই সাহিত্য ইতিহাস একজন নিপুন জলরঙ শিল্পীর মতো প্রমিত আঁচড়ে কুন্দেরা বুনেছেন। এখানে কে কেন কোথায় বাদ পড়ল একবারও মনে হয় না। ভার্জিনিয়া উলফের মতো কালজয়ী লেখকের নামটি পর্যন্ত কেন উল্লেখ হয় না তা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না।
কুন্দেরার উদ্দেশ্য উপন্যাসের ইতিহাস নির্ভর যাত্রাকে শনাক্তকরণ নয়, শুধু দেখানো যে উপন্যাসেরও ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস আর অন্য সমস্ত ইতিহাস থেকে আলাদা। ফরাসি লেখক জুলিয়াঁ গ্রাক মনে করতেন, সাহিত্যের ইতিহাস ঘটনাপ্রবাহের ইতিহাস নয়— মূল্যবোধের ইতিহাস। সেরভান্তেসের আগে উপন্যাসের কোনো ইতিহাস ছিল না।
ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে, শিল্পের ইতিহাস তা করে না। আর একটি ‘হ্যামলেট’ বা ‘ফিফথ্ সিম্ফনি’ রচনা করা সম্ভব নয়। কুন্দেরা আমাদের কমিউনিস্ট বিক্ষুব্ধ চেকোশ্লোভাকিয়ার একজন ভদ্রলোকের গল্প শুনিয়েছেন যার সঙ্গে বালজাকের ‘ওল্ড গোরিও’ উপন্যাসের নায়কের হুবহু মিল কিন্তু তা কখনোই আর একটা ‘ওল্ড গোরিও’নয়। এমনকি গিয়োম আপলিনর যদি ‘কালিগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের পর ‘আলকল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করতেন তবে তিনি অন্য লেখক হয়ে যেতেন। ইতিহাস তার উঁচু-নীচু চলার পথে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কিন্তু শিল্পের ইতিহাস সদা জাগ্রত। মার্কসীয় ঐতিহাসিক পরিণাম-বাদের বিপক্ষে কুন্দেরা বরাবর সরব: শিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। কুন্দেরার কাছে শিল্প এক স্বতন্ত্র রাজত্ব— আবিস্কারের, সম্ভাবনার, নির্বাচনের।
বালজাক থেকে প্রূস্ত অবধি উপন্যাসে ইতিহাস প্রতিফলিত হয়েছে। আয়নার মতো নয়, কালাইডস্কোপের মতো। সময়ের সামাজিক ও মানস বুনোটের এক নির্ভরযোগ্য চরাচর ছিল ইতিহাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তাতে বিঘ্ন ঘটালো। রাতারাতি উপন্যাস হয়ে উঠল এক দুঃস্বপ্ন। ‘দি আর্ট অফ নভেল’-এ কুন্দেরা যে ইতিহাসকে বলেছেন ‘দানব’। অদম্য, অমেয়, অজ্ঞেয় ও অনিবার্য। কুন্দেরার মনোযোগ অবশ্য দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী লেখক। কাফকা, মুসিল, ব্রোখ, হাশেক, গমব্রোভেচ। এদের প্রত্যেকের উপন্যাস নিয়ে কুন্দেরা সহজাত ভঙ্গিতে আলোচনা করেছেন। কুন্দেরার সব থেকে বড়ো গুণ কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না পাঠকের ওপর। জীবনের লঘুতার খোঁজে একদিন ঘর ছেড়েছেন যে লেখক তাঁর লেখা তো নির্ভার হবেই।
কুন্দেরা বারবার প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। একজন নিজের সংস্কৃতিকে প্রশস্ত পরিসরে দেখতে অক্ষম বলেই প্রদেশিক। বড়ো ও ছোটো দেশ উভয়ই এ ব্যাপারে আবেগপ্রবণ। বড়ো দেশের লেখক ভাবেন তিনি এতটাই পরিপূর্ণ যে কোথায় কে কি লিখছে দেখার প্রয়োজন নেই আর ছোটো দেশের লেখক ভাবেন তিনি একা। কুন্দেরার মতে ইউরোপীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বিষয়টি খাপ খায় না। ইউরোপীয় উপন্যাস এক নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ, যৌথ প্রয়াস। ফরাসি লেখক রাবেলেকে রাশিয়ার বাখতিন থেকে বেশি কেউ বোঝেনি। রুশ লেখক দস্তয়েভস্কিকে ফরাসির অঁদ্রে জিদ। ইবসনকে আইরিশ লেখক বার্নার্ড শ বা জয়েসকে অস্ট্রিয়ার ব্রোখ। কুন্দেরা নিজেও দুটি দেশ দুটি ভাষায় জড়িয়ে আছেন।
আমরা সারাজীবন ধরে যা পড়ি তার বেশিরভাগটাই ভুলে যাই, কত জরুরি বই পড়া হয় না। একজন লেখকের গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাদ দিয়ে তাঁর গৌণ রচনা পড়ি। আমরা যারা ‘হ্যাঁ’ বলি অথচ বলতে চাই ‘না’, মিথ্যাকে মিছিমিছি সত্য করে তুলি, প্রতিটি পাঠই যাদের কাছে এক ভ্রমণ, তাদের সকলের আশ্রয় হোক ‘দ্য কার্টেন’।