সিটি কলেজ : জীবনানন্দের প্রথম কর্মস্থল ও চাকরিচ্যুতির সূচনা
বাবা সত্যানন্দ দাশ যে কলেজের ছাত্র ছিলেন, সেই কলকাতা সিটি কলেজে শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন জীবনানন্দ দাশ। এমএ পাস করার পরের বছরই অর্থাৎ ১৯২২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত এই কলেজে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে জীবনানন্দের ব্রাহ্ম পরিচয় এবং তার বাবার একটা প্রভাব ছিল বলে মনে করা হয়। তবে ১৯২৮ সালে কলেজের রামমোহন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সরস্বতী পূজার আয়োজন করলে এ নিয়ে হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজ বিবাদে জড়িয়ে পড়ে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে জীবনানন্দের চাকরিটা চলে যায়।
জীবনানন্দ ১৯২২ সালের কোন মাসের কত তারিখ সিটি কলেজে যোগ দিয়েছিলেন, তা জানা যায় না। তাঁর জীবনীকারগণও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ করতে পারেননি। তবে চাকরিটা যে ১৯২৮ সালের ২৭ জানুয়ারি কলেজে হট্টগোলের পরে চলে যায়, তা নিশ্চিত। তার মানে ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত—অর্থাৎ ছয় বছরের কিছু কমবেশি তিনি এই কলেজে চাকরি করেছেন। যদি ১৯২২ সালের শুরুর দিকে যোগ দেন, তাহলে ৬ বছর। আর যদি মাঝামাঝি বা শেষদিকে যোগ দেন তাহলে সাড়ে পাঁচ বছরের মতো।
কলকাতা শহরের কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা ও প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি থেকে হাঁটাপথ আমহার্স্ট স্ট্রিটে সিটি কলেজের অবস্থান। চার তলা ভবনে তিনটি কলেজের কার্যক্রম চলে। সিটি কলেজ, আন্দন মোহন কলেজ ও রামমোহন কলেজ। এর মধ্যে সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠা ১৮৮১ সালে। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি কথা হয় এই কলেজের অধ্যক্ষ শীতল প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, এখানে জীবনানন্দের কোনো স্মৃতি বা তার স্মরণে কোনো ফলক কিংবা ভাস্কর্য নেই। তবে কলেজের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০০৬ সালে যে স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিল, তার একটি কপি আমাকে খুঁজে দেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তপস্যা ঘোষ, যেখানে তার ‘আত্মগত জীবনানন্দ’ নামে একটি প্রবন্ধ রয়েছে। তাছাড়া ১৯২৮ সালে যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জীবনানন্দের চাকরিটা চলে গিয়েছিল, সেই ঘটনাবলি নিয়ে তৎকালীন পত্র-পত্রিকার কিছু সংবাদও রয়েছে এই স্মরণিকায়।
ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, ফারুক মঈনউদ্দীন সম্পাদিত, প্রথমা, ২০১১, পৃষ্ঠা ৮৪) জানাচ্ছেন, ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি কলেজে সব ধর্মের ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাস ছিল রামমোহন হোস্টেল। অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রর রবিবাসরীয় প্রাত্যুষিক বক্তৃতা ছাড়া হোস্টেল সীমানায় কোনো ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুমোদিত ছিল না। বিশেষ করে ব্রাহ্মসমাজ মূর্তিপূজার বিরোধী ছিল বলে হোস্টেল চত্বরে এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯২৮ সালের ২৭ জানুয়ারি হোস্টেলের হিন্দু শিক্ষার্থীরা সরস্বতী পূজার আয়োজন করে এবং কর্তৃপক্ষের অগোচরে হোস্টেল সরস্বতীর একটি মূর্তি নিয়ে আসে। এ নিয়ে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়। পূজা আয়োজনকারী শিক্ষার্থীদের ক্ষমা চাইতে বললেও তারা তাতে রাজি হননি। কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছু ছাত্রের জরিমানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে গ্রীষ্মের আগাম ছুটি দিয়ে কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। দলে দলে শিক্ষার্থীরা কলেজ ত্যাগ করেন, বিশেষত হিন্দু ছাত্ররা। ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে কলেজ। তখন ব্যয় কমাতে গিয়ে ১১ জন শিক্ষককে অব্যাহতি দেয়া হয়। সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে জীবনানন্দের চাকরিটাও চলে যায়। ব্রাহ্মসমাজের বার্ষিক রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ক্লিন্টন জানাচ্ছেন, At the end of the last session, the service of the eleven members of the staff were dispensed with, And yet a very heavy deficit had to be provided for.
জীবনানন্দের ক্যারিয়ার শুরুর ৬ বছরের মাথায়, অর্থাৎ প্রথম চাকরিতেই বরখাস্ত হওয়ার যে সূচনা হলো, পরবর্তীকালে এই ধারাটি অব্যাহত থাকে। তিনি এরপরেও হয় বরখাস্ত হয়েছেন, অথবা অস্থায়ী চাকরি স্থায়ী হয়নি কিংবা পরিস্থিতি অনুকূলে না দেখে নিজেই বিদায় নিয়েছেন।
জীবনানন্দের ক্যারিয়ার শুরুর ৬ বছরের মাথায়, অর্থাৎ প্রথম চাকরিতেই বরখাস্ত হওয়ার যে সূচনা হলো, পরবর্তীকালে এই ধারাটি অব্যাহত থাকে। তিনি এরপরেও হয় বরখাস্ত হয়েছেন, অথবা অস্থায়ী চাকরি স্থায়ী হয়নি কিংবা পরিস্থিতি অনুকূলে না দেখে নিজেই বিদায় নিয়েছেন।
সিটি কলেজ স্মরণিকার একটি বড় অংশজুড়েই ১৯২৮ সালের ওই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং এসব ঘটনা নিয়ে পত্র-পত্রিকার খবর উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়: রামমোহন রায় হোস্টেলে স্বরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে ছাত্র ও হোস্টেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে গোলমাল ঘটিয়াছিল, সেই সম্পর্কে সিটি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হেরম্বচন্দ্র মৈত্র গত পরশু বৈকাল ৪টার সময় রামমোহন রায় হোস্টেল ও ৮৬ নং মেছুয়াবাজার স্ট্রিটের মেসের ছাত্রদের উপর নিম্নলিখিত আদেশ জারি করিয়াছেন—’রামমোহন রায় হোস্টেল ও ৮৬ নং মেছুয়াবাজার স্ট্রিটের মেসের বোর্ডারগণ শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং প্রিন্সিপ্যাল ও সুপারিনটেনডেন্টের কর্তৃত্বে অবহেলা প্রদর্শন করিয়াছেন। এতদ্বারা তাহাদিগকে সতর্ক করা হইতেছে যে, আগামী ১৬ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে যদি তাহারা তাহাদের আচরণের ওইসকল ত্রুটি যথোচিতভাবে সংশোধন না করে, তাহা হইলে শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হইবে।’ এই নোটিশ সম্পর্কে হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট শ্রীযুক্ত ব্রজসুন্দর রায়; বোর্ডারদিগকে তীব্র তিরস্কার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিতে বলেন। প্রকাশ, তিনি নাকি ছাত্রদের এমন কথাও বলেন যে, তোমরা যদি ভদ্রলোকের ছেলে হও, তবে ক্ষমা প্রার্থনা করো। ব্রজসুন্দরবাবুর এই অভদ্র আচরণের জন্য ছাত্রদের মধ্যে বিষম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। তাহারা সভা করিয়া প্রস্তাব করিয়াছে যে, ব্রজসুন্দরবাবুকে ওই সমস্ত অভদ্র কথা প্রত্যাহার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিতে হইবে এবং তাহা না করা পর্যন্ত তাহারা কলেজে যাইবে না। যদি আগামী সোমবারের মধ্যে ব্রজসুন্দরবাবু ছাত্রদের প্রস্তাবানুযায়ী কাজ না করেন, তবে সিটি কলেজের সমস্ত ছাত্র একযোগে ধর্মঘট করিবে।
এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারির সংবাদে বলা হয়, স্বরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৭ ছাত্রের প্রত্যেককে ১০ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তারা হলেন ১. কানাইলাল মুখার্জী, ২. বলাইচাঁদ মুখার্জী, ৩. ব্রহ্মবল্লভ পাল, ৪. জিতেন্দ্রনাথ দত্ত, ৫. উপেন্দ্রনাথ সাহা, ৬. রাজেন্দ্রকুমার ব্যানার্জী এবং ৭. গুরুদাস আদিত্য। তারা সবাই চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং রামমোহন হোস্টেলের তৃতীয় তলায় থাকতেন। কিন্তু এই জরিমানা নির্ধারণের পরে উত্তেজনা আরও তীব্র হয় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেন অধ্যক্ষ। উল্লেখ্য, কলেজের এই সংকট জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে (স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৫১০)।
কলেজের এই পরিস্থিতি উত্তরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়। ওই বছরের মে মাসে দি মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় তিনি The Saraswati puja in the City College Hostel শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। যেখানে তিনি বলেন, ‘ধর্মের স্বাধীনতাই যদি কাম্য হয় তবে সে স্বাধীনতা শুধু রামমোহন হোস্টেলের হিন্দু ছাত্ররা পাইবে এমন তো নহে, মুসলমান ছাত্ররাও পাইবে। মুসলমানদের পক্ষে গো-কোরবানি ধর্মের অঙ্গ, সুতরাং কর্তৃপক্ষ হোস্টেলে তাহাদের তাহাও করিতে দিতে বাধ্য। সুতরাং এভাবে যুক্তি চলে না; একটা প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিধিবদ্ধ কতকগুলি নিয়ম আছে, সেগুলিকে ভাঙিতে চেষ্টা করায় সৌজন্যের অভাব প্রকাশ পায়। সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের, এবং বাহ্মরা প্রতিমাপূজক নহেন, এ কথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৮৮১) পঞ্চাশ বৎসর পরে হঠাৎ সেখানে প্রতিমা পূজা করিবার জন্য জিদ অশোভন।’ দেখা যাচ্ছে সিটি কলেজের এই ইস্যুতে রবীন্দ্রনাথ একজন ব্রাহ্ম হিসেবে কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পক্ষান্তরে হিন্দু ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এ নিয়ে এ দুই বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যেও সম্পর্ক শীতল হয় (স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৩৮৬)।
এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ গবেষক গৌতম মিত্রর ভাবনাটা এরকম: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তাসের দেশ সুভাষচন্দ্র বোসকে উৎসর্গ করেন তখন তা আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু এই প্রিয় সুভাষের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ একবার খুব বাজে রকমের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এবং সেই বিতর্কের বলি হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের মতো কেউ কেউ। সিটি কলেজের ব্রাহ্ম ও হিন্দুদের মধ্যে কলহে এই দুই ব্যক্তি স্বেচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক নিরপেক্ষ থাকতে পরেননি। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছাত্রদের বিরুদ্ধে দুটো প্রবন্ধ লিখে ক্ষান্ত হলেন না। প্রবাসীতে জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫-এ চিঠিতে লিখলেন, যাঁরা ভারতে রাষ্ট্রিক ঐক্য ও মুক্তির সাধনাকে তাঁদের সমস্ত চেষ্টার একমাত্র লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করেছেন, তাঁরও যখন প্রকাশ্যে এই ধর্মবিরোধকে পক্ষপাত দ্বারা উৎসাহই দিচ্ছেন, তাঁরাও যখন ছাত্রদের এই স্বরাজনীতিগর্হিত আচরণে লেশমাত্র আপত্তি প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত, তখন স্পষ্টই দেখছি, আমাদের দেশের পলিটিকস্-সাধনার পদ্ধতি নিজের ভীরুতায়, দুর্বলতায় নিজেকে ব্যর্থ করবার পথেই দাঁড়িয়েছে। কাকে উদ্দেশ করে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ? সুভাষচন্দ্র বসুকে উদ্দেশ করে এই বাক্যবাণ! কিছুদিন আগে ২ মার্চ ১৯২৮-এ সুভাষচন্দ্র বোস সিটি কলেজের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদ সভায় বলেছিলেন, আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণত একটি অভিযোগ আনা হয়। আমরাই নাকি সাধারণত দেশের যুবকদের প্ররোচিত করি।…অভিযোগটি অবান্তর। হিন্দু ছাত্রদের কোমল ধর্মীয় অনুভূতিকে পদদলিত করে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে সিটি কলেজের ছাত্ররা বর্তমানে যে আন্দোলন শুরু করেছে তার প্রতি আমার সাগ্রহ ও অবাধ সমর্থন আছে।…আলোকপ্রাপ্ত এবং অগ্রসর ব্রাহ্মভদ্রলোকেরা হিন্দু ছাত্রদের উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেবার জন্য এত নীচে কী করে নামলেন আমি তা অনুধাবন করতে অক্ষম। সুভাষচন্দ্র বোসের এই ‘ব্রাহ্মভদ্রলোক’ তুলে খোঁচাটা কি রবীন্দ্রনাথের গায়ে লাগবার কথা নয়! সংবাদপত্রও এই রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ বিতর্কে সরগরম হয়। জাতীয়তাবোধ দুজনেরই ছিল। কিন্তু লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। প্রতিমা পূজা করিবার জন্য জিদ রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি আর সুভাষচন্দ্র প্রতিমা পূজার পক্ষে সওয়াল করে ছাত্রদের জাতীয়তাবোকে উদ্দীপনার বিষয় করতে চাইলেন। ফলত দলে দলে হিন্দু ছাত্র সিটি কলেজ ছেড়ে দিতে লাগল। কলেজের অর্থনীতিতে টান পড়ল এবং সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে জীবনানন্দ দাশের সিটি কলেজের টিউটর পদের চাকরিটা গেল।
যদিও সিটি কলেজ থেকে জীবনানন্দের চাকরিচ্যুতির পেছনে তার কবিতায় অশ্লীলতাকে কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বলা হয়েছে। তবে তার জীবনীকার ও গবেষকরা, বিশেষ করে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক এবং জীবনানন্দের প্রথম জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় (জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ১৬) যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, কবিতায় অশ্লীলতা কোনো কারণ ছিল না। বরং হিন্দু-ব্রাহ্ম বিবাদের ফলে কলেজ যথেষ্ট আর্থিক সংকটে পড়লে তার বলী হন কনিষ্ঠতম শিক্ষক জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দের চাকরিচ্যুতির পেছনে যে কবিতায় অশ্লীলতা এবং এর জেরে তৎকালীন অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রর কোনো ভূমিকা ছিল না, সে কথা জানাচ্ছেন তপস্যা ঘোষ (আত্মগত জীবনানন্দ, সিটি কলেজ স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ২৭৫)। লিখেছেন: ‘চাকরি যাওয়ার পরে অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র জীবনানন্দের বাবাকে জানিয়েছিলেন, আর্থিক কারণে আপাতত আপনার ছেলেকে ছাঁটাই করা হলেও আবার যখন অধ্যাপক নেওয়া হবে, তখন তাঁকে নেব।’ তাছাড়া হেরম্বচন্দ্র মৈত্র যে ধরনের মানুষ ছিলেন, তাতে তিনি কবিতা লেখার কারণে কোনো সহকর্মীকে চাকরিচ্যুত করবেন, এটি স্বাভাবিক ছিল না। মি. মৈত্র সম্পর্কে পার্থপ্রতিম বসু (সিটি কলেজ স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ২৩৯) জানাচ্ছেন, ‘তার জন্ম ১৮৫৭ সালে নদীয়ার যদুবয়রা গ্রামে। ইংরেজিতে এম.এ। প্রথম বিভাগে প্রথম। সিটি কলেজে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে যোগ দেন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ পদে। সেখান থেকে আবার সিটি কলেজে ফিরে আসেন এবং একটানা ৩০ বছর এই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিজীবনে মি. মৈত্র ছিলেন কঠোর বিশুদ্ধতাবাদী; তার নীতিপরায়ণতা ছিল প্রবাদপ্রতিম।’ তপস্যা ঘোষ লিখেছেন, সিটি কলেজ ছিল ব্রাহ্মদের। জীবনানন্দ নিজেও ছিলেন ব্রাহ্মপরিবারের সন্তান। তা সত্ত্বেও তাঁর চাকরিটা গেলো।
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি সুবোধ সরকার বর্তমানে (২০২০) এই সিটি কলেজের ইংরেজিরই অধ্যাপক। জীবনানন্দ যে কক্ষে বসতেন, সেই কক্ষেই তিনি এখন বসেন। ফলে জীবনানন্দের প্রতি তার একটা বিশেষ আবেগ এবং বেদনা—দুই আছে। মাসউদ আহমাদ সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় (জুলাই ২০১৯, পৃষ্ঠা ১১২) সুবোধ সরকার একটি চেয়ার নিয়ে দুটি ব্যক্তিগত ঘটনা উল্লেখ করেছেন:
১. ‘আমি যখন প্রথম সিটি কলেজে যাই, সেই কলেজে যে চেয়ারগুলো রয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটার বয়স প্রায় একশো বছর। সবচেয়ে বয়স্ক অধ্যাপক, আমার তখন ২৮ বা ২৯ বছর বয়স; আর যাকে আমি কথাটি জিজ্ঞেস করি, তিনি ধুতি পরা, পক্ক কেশ, পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক; আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, স্যার তিনি (জীবনানন্দ দাশ) কোন চেয়ারটায় বসতেন? আপনি তো তাঁকে দেখেছেন। স্যার আমাকে বলেছিলেন, তোমার বাঁ দিকের চেয়ারটায় বসতেন। তখন আমার বুকের ভেতরে ছ্যাঁক করে উঠেছিল। হাতটা বাঁ দিকের চেয়ারে লাগানোই ছিল। স্যারের কথাটা শোনামাত্র কেমন ছ্যাঁক করে উঠেছিল, মনে আছে।
২. এই ঘটনার আরও দশ বছর বাদে নাট্যকার ব্রাত্য বসু এসে যখন বসলেন, যে চেয়ারটায় তিনি (জীবনানন্দ) বসেছিলেন, স্যার বলেছিলেন, তুমি কোন চেয়ারে এসে বসলে, জানো? তুমি জীবনানন্দ দাশের চেয়ারে এসে বসলে। তখন ব্রাত্য বসু ও মাগো বলে লাফ মেরে উঠেছিলেন।’