ডুয়িনো এলিজিগুলি
উদ্বেগের দশকাহন
গার্সিয়া মার্কেজের ‘আমার বিষাদক্লিষ্ট গণিকার স্মৃতি’ উপন্যাসের নায়ক ‘বিষণ্ণ স্কলার’ দূরভাষে এক গণিকালয়ের মালকিনকে অক্ষতযোনি কুমারী জোগাড় করতে বলেন। বৃদ্ধ নায়কের ইচ্ছা নব্বইতম জন্মদিনে মেয়েটির সঙ্গে রাত কাটাবেন। মালকিন রোসা কাবারকাস অবাক হয়ে উত্তর দেন: ‘হায় আমার বিষণ্ণ স্কলার! তুমি কুড়ি বছর হ’ল হারিয়ে গিয়েছিলে, আর ফিরে এসে এক অসাধ্য কাজের কথা বলছ।’ আমাদের নায়কটির উত্তরটি কিন্তু চমৎকার: ‘প্রেরণা কখনও আগাম জানান দিয়ে আসে না।’ এ তো সৃষ্টিশীল যে-কোনো মানুষের শেষ কথা!
প্রেরণাই তো! প্রায় দু’বছর ধরে কিছু লিখতে পারছিলেন না রাইনার মারিয়া রিলকে। শারীরিক ও মানসিক সমস্যা চলছিল। বোহেমিয়ান রিলকে উদভ্রান্তের মতো শান্তির খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সুহৃদ মারী ফন টুর্ন উন্ড টাক্সিস তাঁদের নিজস্ব ডুয়িনো প্রাসাদে রিলকের থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন। আড্রিয়াটিন সাগরের গায়ে একটি পাহাড়ের ওপর এই দূর্গ। বাঁ দিকে ট্রিস্ট ও ইস্টেরিয়া আর ডান দিকে অ্যাকুইলেয়া ও গ্রাডো পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র।
২১ জানুয়ারি ১৯১২! কেজো চিঠি লিখতে লিখতে একঘেয়েমিতে ক্লান্ত রিলকে একটু বেরিয়েছেন। মাথায় চিঠির বক্তব্যগুলো গিজগিজ করছিল। জোর হাওয়া বইছিল আর সমুদ্রের গর্জন। হঠাৎ-ই কোনও দিব্যকণ্ঠে রিলকে যেন এই কথাগুলো শুনতে পেলেন। যেন নীচের অরণ্য থেকে স্বর ভেসে আসছে। রিলকে লিখতে শুরু করলেন তাঁর ‘ডুয়িনো এলিজিগুলি’-র প্রথম এলিজিটি:
‘যদি বা চেঁচিয়ে উঠি, কে আছে শুনেছে এই কথাটি আমার, দেবদূতদের
ওই সার্বভৌম পরম্পরা থেকে? কে আছে হঠাৎ করে
আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে: লীন হই আমি তার পূর্ণতর অস্তিত্বের
চাপে? কেননা যা সুন্দর সে তো আর কিছু নয় ভয়ঙ্কর, তারই অগ্রদূত।’
প্রেরণাই তো। রিলকে পরবর্তী কালে চিঠিতে এই স্থিতিকে বলেছেন, ‘উদ্দাম ঝড়, আত্মার হারিকেন ঝড়’!
এলিজি মানে তো শোকগাথা! শোক কেন? কার জন্য বিলাপ? আসলে ডুয়োনো এলিজি ‘মানুষের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক নিয়ে একটা প্রামাণ্য ও অর্থপূর্ণ দিকনির্দেশ’! মৃত্যু রিলকের কাছে তখন ‘ভাষার জালে জড়ানো এক কাব্যিক প্রতিমা ও অলঙ্কার’।
এই যে বাস্তব বুদ্ধির লোক নন, এই যে পুরুষেরা তাঁর কাছে খুব অচেনা, এই যে নারীরা তাঁকে স্পর্শ করে — এসবই ভিতর ভিতর হয়তো সুরঙ্গ তৈরিতে সাহায্য করেছিল রিলকেকে। ‘দেখা’ তাঁর কাছে শুধু দেখা নয়, আস্বাদ গ্রহণ, অনুভব, স্পর্শ, গন্ধ, কন্ঠস্বর — এভাবে অনন্তে পৌঁছানো।
‘সফল একটি স্বগতোক্তি’-র খোঁজ করছিলেন রিলকে। একটা আকৃতি খুঁজছিলেন। যার মাধ্যমে দেবদূতদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা যায়। কে এই দেবদূত? খ্রিস্টধর্মের দেবদূত নয়। এই দেবদূতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নৈকট্যের। রিলকের কবিতায় ‘আমি’ ও ‘দেবদূত’-এর দূরত্ব ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে। যতই মানুষ দেবদূতের নিকটবর্তী হয় ততই মানুষের অবস্থান ক্ষীণ হতে থাকে। সৃষ্টি হয় এক ‘আমি-শূন্যতা’। দেখা দেয় উদ্বেগ। ‘ডুয়িনো এলিজিগুলো’ এই উদ্বেগের দশকাহন। নয়তো কীভাবে লিখবেন:
‘এবং হঠাৎ এই ক্লান্তিকর নাস্তিত্বের দেশে, অতর্কিত
ভাষাহীন স্থানে, যেখানে বিশুদ্ধ একটি অতয়ল্পতা
ঘুরে মরে অর্থহীন হয়ে —, এখানে ওখানে লম্ফ দেয়,
ঝাঁপ দেয় শূন্য অত্যধিক-এ,
যেইখানে বহুদিশা হিসাব নিকাশে
সংখ্যাহীনতার ধ্বজা ওড়ে।’
দেবদূত আর নিছক মানুষ ও দেবতার মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী কোনও সত্তা হয়ে থাকল না। এক নতুন ‘ডেজাইন’ বা ‘অবস্থিতি’-র জন্ম হল। মুক্ত, স্বাধীন ও নৈব্যক্তিক। রিলকের দশ বছর ধরে লেখা ‘ডুয়িনো এলিজিগুলি’-র আসল অভিমুখ এটি।
এই যে বাস্তব বুদ্ধির লোক নন, এই যে পুরুষেরা তাঁর কাছে খুব অচেনা, এই যে নারীরা তাঁকে স্পর্শ করে — এসবই ভিতর ভিতর হয়তো সুরঙ্গ তৈরিতে সাহায্য করেছিল রিলকেকে। ‘দেখা’ তাঁর কাছে শুধু দেখা নয়, আস্বাদ গ্রহণ, অনুভব, স্পর্শ, গন্ধ, কন্ঠস্বর — এভাবে অনন্তে পৌঁছানো। একজন বন্ধুকে চিঠিতে লিখছেন, ‘এলিজির দেবদূত এমন এক সৃষ্টি যার ভেতর দেখা থেকে অদেখার মধ্যে গতায়াতের ভরপুর একটা রূপান্তর আমরা ঘটিয়ে তুলি’।
রূপান্তর তো হয়েছেই কবির। নয়তো কীভাবে লেখেন:
‘নিশ্চিতপদ ওই প্রাণী যারা আমাদের
বিপ্রতীপ, তাদের ভিতর যদি আমাদের মতো
থেকে যেত চেতনার স্পষ্ট বিকাশ —, তাহলে বস্তুত
চড়কি ঘোরাত ওরা আমাদের নিয়ে। আসলে ওদের স্থিতি
নিঃসীম বলেই হয়তো অধরা রয়েছে ওরা, নিজেদের অবস্থার
স্বরূপ প্রকৃতি নিয়ে ওদের ভ্রুক্ষেপমাত্র নেই।’
দেবব্রত চক্রবর্তী আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন লেখক। জার্মান ভাষার প্রথম শ্রেণির পণ্ডিত। চিন্তকও বটে। মৌলিক গ্রন্থ রচনা ছাড়াও অনুবাদ করেছেন টোমাস মানের ‘ভেনিসের মৃত্যু’, গুন্টার গ্রাসের ‘জিভ কাটো লজ্জায়’ ও ‘টিন ড্রাম’, মোরিৎস ভিনটারনিৎস-র ‘গান্ধী পরিক্রমা’। এখনও সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি রিলকের রদ্যাঁকে নিয়ে লেখাটির অনুবাদ। চোখ বুজে দেবব্রত বাবুর অনুবাদ কর্মে বিশ্বাস করা যায়।
যখন খবর পেলাম দেবব্রত বাবু রিলকের ‘ডুয়িনো এলিজিগুলি’ অনুবাদ করেছেন, করোনা উপেক্ষা করে একছুটে কলেজস্ট্রিট। দোকানদার তো প্রথমে প্রায় তাড়িয়েই দিচ্ছিলেন, বইটি নেই বলে। আমিও ঘাঁতঘোত জানি। ইনিয়ে বিনিয়ে দেখুন না একটু, বাবা বাছা বলে, ঠিক বইটি সংগ্রহ করলাম।
মুগ্ধতা ফুরোবার নয়। অনেকবার পড়া বইটি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে পড়া বইটি, নির্ভরযোগ্য কোনও বাংলা অনুবাদে পড়বার স্বাদই আলাদা।
এখানে ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলো বলাই বাহুল্য বেশিরভাগটাই দেবব্রত বাবুর ভূমিকা থেকে নেওয়া। আমার ভূমিকা এখানে পরিব্রাজকের। চুপ! আমি বরং রিলকে আওরাই :
গোলাপ, আহা, বিশুদ্ধ স্ববিরোধ
এতগুলো চোখের পাতার নীচে কারও এত ঘুমের আনন্দ নেই।