:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সুহৃদ শহীদুল্লাহ

কবি, অনুবাদক

মাসুমুল আলমের কথাপরিধি: ‘নিজ’-এর সঙ্গে বোঝাপড়া
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগরের প্রচ্ছদ অবলম্বনে

মাসুমুল আলমের কথাপরিধি: ‘নিজ’-এর সঙ্গে বোঝাপড়া

লেখালেখি বিষয়ে মার্গারেট এটউড এর একটি বই আছে। নাম, অন রাইটার্স এন্ড রাইটিং। কিন্তু বইটির আদিনাম এরকম ছিল না। প্রথমে কানাডায় প্রকাশিত বইটির আদিনাম ছিল ‘নেগোশিয়েটিং উইথ দ্য ডেড’। মৃতের সাথে বোঝাপড়া বা সমঝোতা। বইটি যখন যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হবে তখন প্রকাশকরা জানালেন এই আদিনামে বইটি সেদেশের পাঠককে অতটা আকৃষ্ট করবে না। তাই প্রকাশকের সুপারিশে বইটির অমন কাব্যিক নাম পাল্টে একটি কেজো নাম দেয়া হলো- লেখক ও লেখালেখি প্রসঙ্গে। মাঝে মাঝে ভাবি বাংলাদেশে প্রকাশিত হলে এদেশের পাঠক দুটি নাম থেকে কোনটি পছন্দ করতেন? নাকি নতুন কোনো নামের প্রতি তাঁদের পক্ষপাত থাকত? কিন্তু সেসবের আগে যে প্রশ্ন মনে আসে তা হলো আমাদের এখানে এমন বই নেই কেন?

এটউডের বইটির বিষয় অনেকটাই অটোবায়িগ্রাফিক্যাল আবার সাধারণও। লেখক হিসেবে তিনি কিভাবে প্রস্তুত হলেন, কোন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করেছেন সেসব নিয়ে যেমন বলেছেন আবার লেখালেখির বুনিয়াদি বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন। বেশ মৌলিক কিছু কথাবার্তা আছে সেখানে। সে প্রসঙ্গ এখানে নয়। যেটা বলছিলাম যে, এরকম বই বাংলাদেশে কেন বাংলা ভাষাতেও তেমন নেই। অবশ্য আমার মতো ফাকিবাজ পাঠকের অতটা জোর দিয়ে এরকম কথা বলা উচিৎ নয়। হয়তো আছে, আমার চোখে পড়েনি। পড়াশোনার যে বহর আমার!

তবে বইপড়া নিয়ে কিছু হলেও ভালো বই আছে আমাদের। আমরা যখন হাইস্কুল বা কলেজে পড়ি তখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর পাঠাভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়ম করে কলাম লিখতেন ‘অলস দিনের হাওয়া’ নামে। পরে বই হয়েছিল। চিন্ময় গুহ’র ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’, ‘গাঢ় শঙ্খের খোঁজে ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ এবং ‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী’ তো বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে মনে হয়। জয় গোস্বামীর ‘গোঁসাইবাগান’ যেমন। এইসব পাঠকপ্রিয় বইগুলোর বাইরে খুব ভালো কাজ করছেন বর্তমান সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক ও কবি দেবাশিস্ তরফদার। তিনি বড় ক্যানভাসে কাজ করতে ভালোবাসেন; সন্ধানে থাকেন গভীরতার। তাই কমলকুমার মজুমদারের কাজ নিয়ে তাঁর বই ‘কমলকুমার : রেখাবলী’, বঙ্কিমের সাহিত্যকর্ম নিয়ে ‘রূপ লইয়া কী করিব?’, আবার বাংলা ভাষার কম পঠিত সাতজন আধুনিক কবিকে নিয়ে লিখেছেন ‘আলো হাওয়া রৌদ্রের ঋণ’। আমাকে আশ্চর্য করে জেমস জয়েসের উপন্যাস ইউলিসিস নিয়ে তাঁর বই ‘ইউলিসিস-রহস্য’। গত ৩৩ বছরে অমন জটিল এবং ঢাউস উপন্যাসটি মোট ৫ বার পাঠ করেছেন ভদ্রলোক (লোকটা মানুষ না!)।

মাসুমুলের এই চকিত বয়ান বা চিন্তাবীজ আয়নার অনেক টুকরো আমাদের সামনে ছড়িয়ে দেয়। সেখানে নিজ নিজ প্রশ্ন, উদ্বেগ, আপোস ও সমঝোতা আবার রিরংসাকে দেখে নিতে পারি আমরা। বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যের অনেক ওস্তাদ, বস্, আর গড়পড়তা চরিত্রদের আকস্মিক ঝলসে উঠতে দেখি। যেন, খুব জরুরি একটা কথা গোপনে বলতে এসে সবিস্তারে বলার ফুরসৎ না পেয়ে একটা ধাঁধাঁ রেখে চলে যায় তারা। বলে, হিম্মত থাকলে খুলে দেখাও।

সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে মাসুমুল আলমের ‘কথাপরিধি : ২২পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য’ নামের একটি বই। বইটি উপরের বইগুলোর উত্তারিধকার হলেও স্বভাবে কিছুটা আলাদা। সমসাময়িক বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের আলোচনা আছে, মাসুমুলের দুটি মৌলিক গল্পের পাশাপাশি আছে ফিলিস্তিনি লেখক ঘাসান কানাফানির একটি গল্পের ও সিরীয় লেখক ওসামা আলোমারের ৬টি অণুগল্পের অনুবাদ।

অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ বইয়ের আলোচনাগুলোতে মাসুমুল বাছাই করেছেন বিভিন্ন ধরনের বই। তাদের মধ্যে ঘাসান কানাফানির উপন্যাস ‘মেন ইন দ্যা সান’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পের বই ‘দোজখের ওম’, সেলিম মোরশেদের নাটক ‘মানুষ উত্তম’, মোশারফ খোকনের কবিতার বই ‘চামড়া পোড়া গন্ধের রান্নাঘর’ যেমন আছে, পাশাপাশি আছে তারেক মাসুদের ‘ত্রয়ী চিত্রনাট্য’। আবার অপেক্ষাকৃত তরুণ কবি ফয়সাল আদনান (চতূর্থ সেলাইয়ের নিচে) এবং নাভিল মানদার (ভূ-বারান্দা) এর বইয়ের আলোচনার পাশাপাশি আছে মারুফুল আলমের ‘ঝরাপাতা, শূন্যতার ঘ্রাণ’ নিয়ে ছোট আলোচনা। আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের আখ্যানবিশ্ব নিয়ে ‘সরলচোখে তাকানোর প্রস্তাব’ শিরোনামে একটি ভাবনা উদ্রেকী প্রবন্ধ। এইসব লেখায় মাসুমুল আমাদের দীক্ষিত ও ঋদ্ধ করেন তাঁর পড়ার স্বতন্ত্র ধরন ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে। কিন্তু আমাকে সবচে’ বেশি আকৃষ্ট করেছে বইটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাসুমুলের অনেকগুলো চিন্তাবীজ। ছোট ছোট নোট বা মন্তব্য। কোনো বই, অথবা লেখক বা বিষয় নিয়ে হয়তো ভাবছেন তিনি। কিন্তু বলছেন কম। ৪/৫ টি বাক্যে নোট রাখার মতো করে কথা বলছেন যেন। কথাসাহিত্যিক বলেই হয়তো এই ছোট ছোট নোটের ভেতরেও দেবী চৌধুরানী আর মি. চৌধুরী নামে দুটো চরিত্র দাঁড় করিয়েছেন তিনি। যেন কথা বলছেন তাদের সাথে সেই ভঙ্গিতে টুকে রেখেছেন তাঁর চিন্তাকে। এই যেমন, ‘অরূপরতন বসু আর রবিশংকর বল’ শিরোনামের ছোট এন্ট্রিতে লিখছেন:

“আমরা সবাই গোগোলের ওভারকোট থেকে বেরিয়ে এসেছি. . . .!

দেবী চৌধুরানী, আপনি অরূপরতন বসু-র কেবল ‘অবলোকিতেশ’, ‘দৈনন্দিন’ এই গল্প দুটো পড়লেই ব্যাপারটা বুঝে যাবেন।
আর সঙ্গে সবেধন নীলমনি অরূপরতনের ৪টা মাত্র উপন্যাস।
দেখবেন, স্বল্পায়ূ জীবনে রবিশংকরের (বল) গাদাগুচ্ছের উপন্যাস আর গল্পগুলো আসলে স্বল্পপ্রজ অরূপরতনকেই ক্রমশ বিস্তার করে গেছে। ক্রমশ. . . ”

কথাপরিধি : ২২পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য by মাসুমুল আলম
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর। প্রকাশকাল : বইমেলা ২০২০ 
প্রকাশক : প্রতিশিল্প। মূল্য : ২০০ টাকা।

আবার ‘সমকালীন গল্প’ শিরোনামে কিছু না লিখে শুধু কয়েকটি নাম তুলে দিচ্ছেন আমাদের।

“অদিতি ফাল্গুনী,
বর্ণালী সাহা,
সাগুফতা শারমিন তানিয়া,
সালমা বাণী।
ব্যস!!”

ওইযে চারটি নামের শেষে দুটো বিস্ময়চিহ্নে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ‘ব্যস’ ওটুকুই মাসুমুলের বোঝাপড়া। ওটুকুুই বলতে চেয়েছেন তিনি।

অচেনা শিরোনামে লিখছেন, ‘তাহলে কি এটা বলা যাবে, একটু সেন্সুয়াস ডি এইচ লরেন্স বা হেনরী মিলারের ‘শৈলী’ই আপনি পছন্দ করেন— ‘বিষয়’ না। পিউরিটান আপনি(?) বিষয় মানতে না পেরে শুধু আর্টফর্মের ভক্ত হবার ভান ধরেছেন। আর তাই কমলকুমার পড়া বা তারকোভস্কি দেখতে গেলে শুধু ঘুমই আসে! … অথবা, নিজের অবসেশনটাই হয়তো ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেননি এখনো।’

এখানে মি. চৌধুরী বা দেবী চৌধুরানী নেই। তবে এই ‘নিজ’ টা কে? আসলে চৌধুরী বা চৌধুরানী থাকলেও মাসুমুল নেগোশিয়েট করতে চেয়েছেন ওই ‘নিজ’-এর সাথেই। এই ‘নিজ’ পাঠকের ‘নিজ’ হতে পারে’, হতে পারে মাসুমুলের নিজস্ব ‘নিজ’ও।

মাসুমুলের এই চকিত বয়ান বা চিন্তাবীজ আয়নার অনেক টুকরো আমাদের সামনে ছড়িয়ে দেয়। সেখানে নিজ নিজ প্রশ্ন, উদ্বেগ, আপোস ও সমঝোতা আবার রিরংসাকে দেখে নিতে পারি আমরা। বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যের অনেক ওস্তাদ, বস্, আর গড়পড়তা চরিত্রদের আকস্মিক ঝলসে উঠতে দেখি। যেন, খুব জরুরি একটা কথা গোপনে বলতে এসে সবিস্তারে বলার ফুরসৎ না পেয়ে একটা ধাঁধাঁ রেখে চলে যায় তারা। বলে, হিম্মত থাকলে খুলে দেখাও।

মাসুমুলকে আমরা যারা ব্যক্তিগতভাবে চিনি, তারা জানি যে পাঠক হিসেবে তাঁর ব্যাপ্তি বিস্ময়কর। বিশ্বসাহিত্যের রথী-মহারথী থেকে শুরু করে আপনভাষার তরুণতম কবির সাম্প্রতি কবিতার বইটিও মাসুমুলের সংগ্রহে থাকে। এবং ভয়ঙ্কর ব্যাপার, মাসুমুল সেগুলো পড়েনও। পড়তে পড়তে তাঁর মনে যে ভাবনা জমে তা ব্যাক্তি-আলাপেও খুব একটা খোলাসা করেন না তিনি। বরং এরকমই অল্পকথায় একটা আগ্রহ তৈরি করে দেন। কথাপরিধিতেও সেই অভ্যাস ধরে রেখেছেন তিনি।

মাসুমুলের কাছে এখন আমাদের একটাই অনুরোধ পরের কথাপরিধির ব্যাপ্তি বাড়ুক। চিন্তাবীজগুলো ডালপালা মেলুক। আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের কাছে আরেকটু খোলাসা হোক তাঁর মহৎ চিন্তার আকাশপরিধি।
প্রতিশিল্পকে ধন্যবাদ এমন একটি জরুরি বই প্রকাশ করার জন্য।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.