দি আর্ট অব ব্যাঙ্কসি
‘If you want to say something and have people listen then you have to wear a mask’– Banksy
‘দি আর্ট অব ব্যাঙ্কসি’ শিরোনামে ২০১৮ সালে কানাডাতে শিল্পী ‘ব্যাঙ্কসি’র একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিলো; টরন্টোর ল্যান্ডসডাউন এলাকার পরিত্যক্ত একটি ভবনে। বিতর্কিত এই প্রদর্শনীটি, কিউরেট বা সম্পাদনা করেছিলেন স্টিভ লাজারাইডস। প্রদর্শনীটি শিল্পীর দ্বারা সত্যায়িত বা অনুমতি প্রাপ্ত নয় বলে দাবি করেছেন স্টিভ। এতে ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ব্যাঙ্কসির নির্মিত শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছিলো। আশিটি মূল শিল্পকর্ম এবং বেশ কিছু সংখ্যক মূল শিল্পকর্মের অনুলিপি স্থান পেয়েছিলো প্রদর্শনীতে। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি শিল্পকর্ম ছিলো স্মৃতিস্তম্ভের মতো বিরাটাকার। স্টিভ বলেন, প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলো পৃথিবীর কোনো শহর থেকে তুলে আনা হয়নি। শিল্পকর্মগুলো সংগ্রহ করেছেন সর্বমোট চল্লিশ জন শিল্পসংগ্রাহদের নিকট থেকে। শিল্পকর্ম গুলো বিভিন্ন মাধ্যমে সৃষ্ট; দেয়াল চিত্রের অনুলিপি, স্ক্রিন প্রিন্ট, ক্যানভাসে ছাপা, পরিত্যক্ত বস্তু, কাগজে ছাপা, দৈনন্দিন ব্যবহৃত বস্তুদি, আলোকচিত্র, দেয়াল চিত্রের আলোকচিত্র, দোকানের দরজা, ইস্পাতের পাত, কাঠের পাত, কাঁচ, স্প্রে পেইন্ট, ভাস্কর্য, সিসিটিভি- ইত্যাদি।
যদিও স্টিভ ২০০৮ সালের পর থেকে ব্যাঙ্কসিকে তাঁর কর্ম প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন, তারপরেও তাঁর পক্ষে এই প্রদর্শনীটি আয়োজন করা সম্ভব ছিলো; বিষয়টি খুবই বিস্ময়কর এবং রহস্যময়। স্টিভেরও ব্যাঙ্কসির মতোই ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাঁদের পরিচয়ের শুরু থেকেই তাঁরা নিজেদের মধ্যে অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য খুঁজে পান বলে তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। স্টিভ নিজেও একজন শিল্পী, আলোকচিত্র তাঁর প্রিয় মাধ্যম। পরবর্তীতে স্টিভ ব্যাঙ্কসির আলোকচিত্রী, তথ্য সংরক্ষক, সহযোগী, ব্যবস্থাপক এবং সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রশ্ন হলো ব্যাঙ্কসির অনুমতি ব্যতিত এই প্রদর্শনীগুলো স্টিভ বিশ্বের বিভিন্ন প্রধান শহরগুলোতে আয়োজন করছেন কিভাবে? প্রদর্শনীর খবরগুলো ব্যাঙ্কসির নিজস্ব ওয়েবসাইটেও প্রদর্শিত হচ্ছে; (যদিও ‘ফেইক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে) সেটাও কিভাবে সম্ভব হচ্ছে? তবে ব্যাঙ্কসির বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয় কিছুই। ‘ব্যাঙ্কসি’ মানেই এক রহেস্যের নাম।
মানুষের কৌতুহলী মন সর্বদাই খুঁজে বেড়ায় নতুনত্ব। শিল্পকলার জগতে ‘ব্যাঙ্কসি’ সেই সতেজ তারুণ্যের নাম, শিল্পরসিকদের যা দেয় এক মুঠো উন্মুক্ত আকাশের খোঁজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো; কে এই ব্যাঙ্কসি?
টরন্টোর স্থানীয় শিল্পী ও শিল্পসমালোচকরা প্রদর্শনীটি সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রতিবাদের ভাষায় উন্নাসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। শহরের অনেকেই প্রদর্শনীটি নিয়ে বিরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন। হতাশার জায়গাটি ছিলো, স্থানীয় শিল্পীরা যেখানে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন, সেখানে ব্যাঙ্কসি বহিরাগত শিল্পী হয়ে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের প্রদর্শনী করছে কিভাবে! ব্যাঙ্কসি পুঁজিবাদ বিরোধী ও প্রাতিষ্ঠানিকতা বিরোধী হবার পরেও এমন বাণিজ্যিকভাবে সফল প্রদর্শনী করতে দিচ্ছেন কিভাবে- ইত্যাদি। তবে কিউরেটর স্টিভ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, এটা তাঁর জন্য নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়, তিনি যেখানেই ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্ম নিয়ে গিয়েছেন এই ধরনের প্রতিবাদ ঘটেছে। এবং এটাই কানাডার ‘টল পপি সিনড্রম’কে প্রতিফলিত করে; যেখানে কোনো ব্যক্তি সফল হতে থাকলে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন এবং তাকে নীচে নামানোর চেষ্টা করেন। তবে আনন্দের বিষয় হলো এই সবের কোনো কিছুই থামাতে পারেনি ব্যাঙ্কসি প্রেমিকদের। প্রদর্শনীটিতে মানুষের ভীড় বলে দেয় ব্যাঙ্কসি কেন অর্থবহ। শেষ পর্যন্ত আয়োজকদের বাড়াতে হয় প্রদর্শনীর সময়সীমাও। জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত সময় থাকলেও সেটা গিয়ে গড়ায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এবং তাতেও কমেনি শিল্পকলা প্রেমিকদের ভিড়। প্রদর্শনীটির শেষদিন পর্যন্তও ছিলো উপচে পড়া মানুষের ভিড়। আমার প্রশ্ন হলো; কেন নয়? টরন্টোতে এমন একটি প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা হওয়া খুবই দুর্লভ। সেখানে শিল্পপ্রেমিকদের কোনো ধরনের অভিযোগ থাকার কথা নয়।
মানুষের কৌতুহলী মন সর্বদাই খুঁজে বেড়ায় নতুনত্ব। শিল্পকলার জগতে ‘ব্যাঙ্কসি’ সেই সতেজ তারুণ্যের নাম, শিল্পরসিকদের যা দেয় এক মুঠো উন্মুক্ত আকাশের খোঁজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো; কে এই ব্যাঙ্কসি?— শিল্পী অ্যন্ডি ওয়ারহলের বিখ্যাত উক্তিটির মতো, আমরা হয়তো সেই ভবিষ্যতের খুব নিকট সময়ে বসবাস করছি, যখন প্রত্যেকটা মানুষ শুধুমাত্র পনেরো মিনিটের জন্য বিখ্যাত হতে পারবে। বর্তমান আধুনিক যান্ত্রিক সময়ে মানুষ সেলফি আক্রান্ত, আত্মপ্রেমে মশগুল। যে সময় মানুষের আত্মরতি মূলক প্রবৃত্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, সেই সময় শিল্পী ব্যাঙ্কসি আত্মপরিচয় গোপন করছেন পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে। সমসাময়িক শিল্পকলার জগতে ‘ব্যাঙ্কসি’ একটি অতি পরিচিত নাম। ব্যাঙ্কসির এই জনপ্রিয়তা শিল্পী ডেমিয়েন হার্স্টের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কিংবা শিল্পী জেফ কুনের বিস্তর সস্তা খ্যাতির সঙ্গেও তুলনা যোগ্য নয়। ডেমিয়েন হার্স্টের ডায়মন্ড বসানো মাথার খুলি, কিংবা ‘ভেরিটি’ নামের বিরাটাকার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, জেফ কুনের বেলুন ডগ (বেলুন কুকুর) বা গুগেনহেইম মিউজিয়ামের সামনে বিরাটাকার পাপি (কুকুর ছানা) এই ধরনের শিল্পকর্মগুলো শিল্পকলা এবং দর্শকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে, দর্শকদের দূরে ঠেলে দেয়। ব্যাঙ্কসির শিল্পকলার পরিচিত বিষয়বস্তু এবং সহজ-সরল প্রকাশ ভঙ্গি মানুষ ও শিল্পকলার মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়, কাছে টানে। ব্যাঙ্কসি বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করে নিয়েছেন তাঁর প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। সে অর্থে ‘ব্যাঙ্কসি’ একটি ভিন্নধর্মী নাম; শুধুমাত্র তাঁর বহুল পরিচিত শিল্পকর্মের জন্য নয় বরং তাঁর রহস্যময় ব্যক্তিত্বের জন্যও। তাঁর আত্মপরিচয় গোপন রাখার নেপথ্যে বিশ্বকে যে ইঙ্গিত দেয়, সেটা হলো সাধারণ মাত্রেই সমাজে অদৃশ্য বা অস্তিত্বহীন।
বর্তমান সময়ের শিল্পরসিকদের মধ্যে ব্যাঙ্কসি একটি অতিপ্রিয় নাম। ধারণা করা হয় ১৯৭৪ সালের দিকে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে তাঁর জন্ম। সহজেই অনুমেয় যে, ব্যাঙ্কসি তাঁর আসল নাম নয়, অনেকের ধারণা ব্যাঙ্কসির আসল নাম ‘রবিন গানিংয়াম’ অথবা ‘রবার্ট ব্যাঙ্কস’-তবে কোনোটাই সত্য বলে ব্যাঙ্কসি দ্বারা সত্যায়িত হয়নি। তাঁর প্রতিবাদী আচরণের জন্য ১৪ বছর বয়সে স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়েছেন এবং অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের জন্য (সৃজনশীলতার চর্চার জন্য?) জেলও খেটেছেন। তবে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত না করেই তিনি সৃজনশীলতার চর্চা হিসেবে শিল্পকলাকে বেছে নিয়েছেন। এবং শিল্পকলার এমন একটি শাখাকে বেছে নিয়েছেন যাকে সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ অপরাধ বলে মনে করেন। ব্যঙ্কসি ১৯৯০ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে শিল্পকলার সাথে যুক্ত রয়েছেন। প্রায় এক দশক পর থেকেই ব্যাঙ্কসির খ্যাতির বিস্তারের শুরু। এখন দুই দশক পরে ব্যাঙ্কসি শিল্পকলার বিশাল একটি শাখাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। যদিও ব্যাঙ্কসি শিল্পকলার এমন একটি শাখা থেকে তাঁর সৃজনশীলতার চর্চা শুরু করেছেন যাকে অনেকেই শিল্পকলার মর্যাদা দিতে রাজি নয়। তবে তিনি একা নন, তাঁর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর সহযোগিরাও, যাদের কারো নামই আমরা জানি না, একমাত্র স্টিভ ছাড়া।
ব্যাঙ্কসির রাজত্ব মূলত স্ট্রিট আর্ট জগতে আমরা যাকে বাংলায় পথশিল্পকলা বা নাগরিক শিল্পকলা বলতে পারি। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে ‘গ্রাফিতি আর্ট’ বা দেয়াল চিত্র- বলা যেতে পারে সেই শাখাটিকে। বর্তমানে শহরের যে স্থানে ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্ম শোভা পায়, সে স্থানটিই একটি মিউজিয়াম হয়ে ওঠে। স্ট্রিট আর্ট বা গ্রাফিটি কি? প্রথমে দেখা যাক স্ট্রিট আর্ট কাকে বলে, যে শিল্পকলাগুলো মানুষের দৃষ্টির গোচরে থাকে সহজেই, যাকে দেখতে দর্শকদেরকে কোনো নির্দিষ্ট প্রদর্শশালাতে যেতে হয় না। শহরের, দেয়াল, ভবনের গায়ে, সেঁতুর গায়ে, মানুষ চলাচলের পথে, মানুষের নজরে আসে এমন কোনো স্থানে নির্মিত বা স্থাপিত শিল্পকলাকে, স্ট্রিট আর্ট বা পথশিল্পকলা বলে, এবং বেশির ভাগ সময় এই শিল্পকলা নির্মিত হয় খুব সহজলভ্য উপাদান দিয়ে এবং সহজ-সরল শৈলী ব্যবহার করে। স্ট্রিট আর্টের একটি শাখা ‘গ্রাফিতি আর্ট’: দেয়ালের গাঁয়ে নির্মিত চিত্রকলা, সাধারণত কয়েক স্তরে রঙের প্রলেপের মাধ্যমে আঁকা হয়। এই শব্দটি ইতালিয়ান শব্দ থেকে প্রাপ্ত, যার অর্থ আঁচড় কাঁটা। কোনো পরিসরের উপরিতলে আঁচড় কেঁটে উপরের স্তরের রঙকে খুঁচিয়ে তুলে নীচের স্তরের রঙকে দৃশ্যমান করার প্রক্রিয়াকে গ্রাফিতি বলে। গ্রীক ভাষায় গ্রাফিয়েন অর্থ– ‘লেখা’, চক বা কয়লা দিয়ে দেয়ালে আঁচড় কেটে লেখা। রোমে, প্রচীন কালে দেয়ালে আঁচড় কেটে গ্রাফিতি আঁকার নমুনা মেলে। এমনকি মৃৎশিল্পে; মাটির পাত্রের রঙের আস্তরণ দেবার প্রক্রিয়াও এক স্তরকে আঁচড় কেটে নীচের স্তরকে উন্মুক্ত করবার মাধ্যমে নকশা আঁকাকেও গ্রাফিতি বলা হতো একসময়।
আধুনিক সময়ে, দেয়ালে নির্মিত চিত্রকলাকে আমরা গ্রাফিতি বলে জানি। তবে এই মাধ্যমটিকে সমাজবিরোধী বা আইন বিরোধী বলে ধরা হয় কারণ, সাধারণত, শিল্পীরা অন্য কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে শিল্পকর্ম নির্মাণ করেন বলে এটাকে অসামাজিক কার্যকলাপ এবং আইনত অন্যায় বলে ধরা হয়। গ্রাফিটি সাধারণত দুই দলের মধ্যে বাহুবলের বা মস্তিষ্কের যুদ্ধ বলা যেতে পারে। দুই পক্ষের মধ্যে দখলদারিত্বের খেলা। তাই নিজের নাম বা নিজেদের কোনো বিশেষ চিহ্ন আঁকার মাধ্যমে এই গ্রাফিটি আর্টের প্রচলন। অনেক সময় একপক্ষের কোনো সদস্যের মৃত্যু হলে, সেই সদস্যের শোকবার্তাও বহন করতো গ্রাফিতি চিত্র। বহুযুগ থেকেই মূলত রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশ করা বা সাধারণ মানুষদের চিন্তাধারা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে মানুষ দেয়ালচিত্র নির্মাণ করে আসছে। শিল্পকলার জগতে সব সময়েই নতুন কোনো শৈলীকে তার অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে, সে আলোকচিত্র হোক বা কনস্পেচুয়াল আর্ট হোক; সেই দিক থেকে গ্রাফিটিও ব্যতিক্রম কোনো শিল্প শৈলী নয়।
ব্যাঙ্কসির শিল্পকলা মানুষকে চুম্বকের মতো আর্কষণ করে। শিল্পকলার পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ায় তাঁর পাণ্ডিত্য সীমাহীন, চিন্তাধারা সমসায়িক এবং গভীরভাবে দার্শনিক। ব্যাঙ্কসির শিল্পকলা মূলত চিন্তা উদ্রেককারী এবং উসকানি মূলক। তাঁর শিল্পকলায় রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশ ঘটলেও তাঁর শিল্পকলাকে প্রচারমূলক শিল্পকলা বলা যাবে না। ব্যাঙ্কসির শৈলী অত্যন্ত আধুনিক কিন্তু প্রকাশভঙ্গি সরল। বেশির ভাগ সময় ন্যূনতম রঙের ব্যবহার করে তিনি দ্বিমাত্রিক ভঙ্গিতে শিল্প নির্মাণ করেন। তাঁর শিল্প প্রক্রিয়া অনেকটা ঝুকিপূর্ণ এবং অনিশ্চয়তাপূর্ণ। তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন, দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক। আধুনিক নগর জীবনের যে কোনো বিষয় বা যে কোনো বস্তু তাঁর শিল্পকলার বিষয়বস্তু বা মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে যদি তিনি ইচ্ছা করেন। ব্যাঙ্কসি তাঁর চিন্তার অভিব্যক্তি ঘটাতে শিল্পকর্মে ক্ষুদ্র কবিতা কিংবা কথারও ব্যবহার করেন অনেক ক্ষেত্রে।
ব্যাঙ্কসি ব্রিস্টলে গ্রাফিতি আঁকার মাধ্যমে তাঁর শিল্পী জীবনের উন্মোচন করেন, তবে কখনও তিনি নিজের পরিচয় উন্মোচন করেনি। মনে করা হয় ২০০০ এর শুরুর দিকে ব্যাঙ্কসি ব্রিস্টল লন্ডনে স্থানান্তরিত হন এবং লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে গ্রাফিতি করা শুরু করেন। লন্ডনে বাংলাদেশীরা বসবাস করেন এমন অঞ্চল, ইস্ট লন্ডনের ব্রিক লেনেও ব্যাঙ্কসির আঁকা গ্রাফিতির দেখা মেলে। এই স্থানটি শিল্পকলার বিদগ্ধদের কাছে পরিচিত একটি জায়গা, অনেক গ্রাফিতি চোখে পড়ে। লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে, তাঁর গ্রাফিটির দেখা মিলতে থাকে। তবে এমন শহর গুলোয় গ্রাফিতি শুধু একটি শিল্পকলা নয় দুই পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দের প্রকাশ। ব্যাঙ্কসিকে তাই এমন আরো অনেক গ্রাফিতি শিল্পীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়েছে। এমন একটা সময় আসে যখন ব্রিটিশ পুলিশ অন্যান্য গ্রাফিতি শিল্পীদের শিল্পকর্ম ধ্বংস করে ফেললেও ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্ম রেখে দিতো। তাতে করে অন্য গ্রাফিতি শিল্পীদের রোষানালে পড়ে যান ব্যাঙ্কসি। বর্তমানে ব্যাঙ্কসির শিল্পকলা শুধু ইংল্যান্ড এর মানচিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতি আর্ট বা স্ট্রিট আর্ট ইংল্যান্ড, ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন, আমেরিকা, কানাডা সহ বহু দেশের শহরে দেখা যায়। লন্ডনের নিরিবিলি কোনো সড়কের পাশে তিনি যেমন গ্রাফিটি এঁকেছেন তেমনি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশেও জীবনের ঝুকি নিয়ে গ্রাফিতি এঁকেছেন। এছাড়াও বর্তমানে পৃথিবীর বহু শহরে সুপরিকল্পিত ভাবে ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্মের প্রদর্শনী (?) হচ্ছে। তাঁর শিল্পকলা সমাজের বৈষম্যের, অসংগতির প্রতি বিদ্রুপাত্মক প্রকাশ। সমাজের জটিল বিষয় গুলোকে খুব সরল ভাবে উপস্থাপন করেন তাঁর স্টেনসিল আর স্প্রে পেইন্ট দিয়ে। তিনি বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত স্থানে শিল্পকলা নির্মাণ করেন। সহজেই দৃশ্যমান এমন স্থানে যেমন তিনি পথশিল্প নির্মাণ করেন আবার কিছুটা বিদঘুটে বা দুর্গম স্থানেও তিনি শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন। ব্যাঙ্কসির রাজনৈতিক সচেতনতা মূলক শিল্পকলা আজ পৃথিবী খ্যাত।
লন্ডনের মতো হাজার বছরের পুরাতন শহরে ইঁদুর একটি দৈনন্দিন সমস্যা। তাই ইঁদুরকে তিনি শিল্পকলার বিষয়বস্তু করেছেন, ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষদের কষ্টকে বুঝিয়েছেন। প্রদর্শনীতে সেই ইঁদুরকে নিয়ে নানা ধরনের স্ক্রিন প্রিন্ট আমরা দেখি। হিপ-হপ কালচারের সাথে সামঞ্জস্যতা রয়েছে তাঁর এই ধরনের কাজগুলোতে। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ইঁদুর, নাদুস নুদুস উইনি দ্য পুহ, বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জি, বিনোদন দানকারী বাদঁর, হাতি-নিষ্পাপতা বোঝাতে এমন বিভিন্ন পশুপ্রাণীর অবয়বকে ব্যবহার করেছেন। প্রদর্শনীতে এই ধরনের বেশ অনেকগুলো শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে, যেগুলোর সবগুলো মূল শিল্পকর্ম না হলেও অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এবং আনন্দদায়ক।
একটি মূল শিল্পকর্ম আমার দৃষ্টি আর্ষণ করে, শিল্পী ব্রিস্টলের কোনো একটি দোকানের দরজায় এঁকেছিলেন। ‘কুইন ভিক’ বা ‘কুইন ভিক্টোরিয়া’ নাম শিল্পকর্মটির। যেখানে দেখানো হয়েছে রাণী ভিক্টোরিয়া আধুনিকা এক নারীর মুখের উপরে দুই পা মেলে বসে আছেন। এক হাতে ধরা তাঁর শাসন দণ্ডটি। এই অবস্থানের নাম ‘কুইনিং’- একটি যৌন ক্রিয়াকলাপের নাম, যেখানে নারী প্রাধান্য পায়, বা প্রাচীন সময়ে রাণীরা এই ধরনের যৌনক্রিয়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। অতীতে মানুষের মনে যৌনতা নিয়ে অনেক ধরনের সামাজিক কুসংস্কার ছিলো। সামাজিক সেই বিধিনিষেধগুলোর অনেকগুলো বর্তমানেও প্রচলিত রয়েছে। একটি সময়, রাণী ভিক্টোরিয়া তাঁর শাসনামলে, নারী সমকামীদের বিরোধিতা করেছিলেন। তেমন একটি ইতিহাসকে বিদ্রুপ করে ব্যাঙ্কসি এই চিত্রটি নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি সব সময় ইতিহাসকে যুক্ত করেন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে। অতীত ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বা ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে টেনে নিয়ে আসেন আমাদের সময়ে। দেখিয়ে দেন দিন বদলায়নি সে কারণে দিন বদলের সময় এসেছে।
‘ডাই ফেসড টেননার’, শিরোনামের শিল্পকর্মটিতে তিনি ব্রিটিশ দশ পাউন্ডের নোটে রাণী দ্বিতীয় এলিযাবেথের প্রতিকৃতির স্থানে প্রিন্সেস ডায়ানার অবয়ব বসিয়ে দেন, এবং শত শত নোট আবার ছাপিয়ে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে’র স্থানে ‘ব্যাঙ্কসি অব ইংল্যান্ড’ লিখে দেন, এমন সৎ সাহসিকতার পরিচয় শিল্পকলার জগতে শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়ার পরে আর কেইবা দেখিয়েছে? ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর ক্ষোভ যেমন প্রকাশ পায় কাজের মাধ্যমে, তেমনি প্রিন্সেস ডায়ানার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন এই অভিনব পন্থায়।
ব্যাঙ্কসির আরো একটি মূল এবং স্মৃতিস্তম্ভের মাতো বিরাটাকার শিল্পকর্ম- ‘ফ্লাগ ওয়াল’ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে; মিশ্র মাধ্যমে করা, কাঠের পাতের উপরিভাগে স্প্রে পেইন্ট ও মিশ্র মাধ্যম ব্যবহার করে আঁকা। চিত্রটিতে আমরা দেখি পরিত্যক্ত একটি প্রাইভেট কারের উপরে, শহরের সুবিধা বঞ্চিত উঠতি বয়সি ছয়জন ছেলে মেয়ে আমেরিকার পতাকা উত্তোলন করছে। ১৯৪৫ সালের আমেরিকান আলোকচিত্রী জো রোসেনথালের তোলা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সেই বিখ্যাত আলোকচিত্রটি, ‘রেইজিং দ্য ফ্লাগ ইন আইও জিমা’ অবলম্বনে ব্যাঙ্কসি ‘ফ্লাগ ওয়াল’ নির্মাণ করেছেন, যেখানে ছয়জন আমেরিকার নৌবাহিনীর সদস্যকে আমরা দেখি, যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের উপরে আমেরিকার পতাকা উত্তোলন করছেন। আমেরিকার স্বপ্নের একটি বিদ্রুপাত্মক উপস্থাপনা এই শিল্পকর্মটি।
প্রদর্শনীটির প্রথম কামরাতেই অন্ধকার কালো রঙের চার দেয়ালের মধ্যখানে, প্রমাণ আকারের খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের একটি নারী দেবী মূর্তি রাখা; দ্য উইংড ভিক্টোরি অব স্যমোথ্রাসের (মূল: ল্যুভ মিউজিয়াম, প্যারিস) রেপ্লিকা; এই মূর্তিটি যখন উদ্ধার হয়েছিলো, তখন মূর্তিটির মাথা ভাঙ্গা ছিলো। ব্যাঙ্কসি সেই বিখ্যাত, মূর্তিটির অবয়বকে শিল্পকলার ইতিহাস থেকে উদাহরণ স্বরূপ নিয়ে, মাথার সেই শূন্যস্থানে একটি সি. সি. টিভি বসিয়ে দিয়ে ইতিহাসের সাথে আমাদের বর্তমান সময়কে যুক্ত করে দেন। ইতিহাস আমাদেরকে যেনো পর্যবেক্ষণ করছে। পাশের দেয়ালে লেখা ব্যাঙ্কসির একটি উক্তি ‘মাইন্ডলেস ভ্যান্ডালিজম ক্যান টেক এ বিট অব থট’। দেয়ালচিত্র নির্মাণে যেমন কিছুটা হলেও বুদ্ধি বা প্রতিভার প্রয়োজন হয় তেমনি সেই তথ্যটি বুঝতেও কিছুটা বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয় বৈকি। সুতরাং ব্যাঙ্কসির শিল্পকলা পথে অবস্থান করলেও তাঁর গুরুত্ব মোটেও সীমিত নয়।
প্রদর্শনীটির শেষ কামরাতে ছিলো প্রায় আট মিটারের মতো উঁচু একটি শিল্পকর্ম যার নাম- ‘ফরগিভ আস আওয়ার ট্রেসপাসিং’। স্টেইন্ড গ্লাসের বা রঙিন কাঁচের, বা কাঁচের উপরে রঙ করার আদলে নির্মীত এই শিল্পকর্মটি। দেখতে গীর্জার জানালার মতো। সামনে একটি শিশু হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছে, তাঁর অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের জন্য, অর্থাৎ তাঁর গ্রাফিতির জন্য, যেটি সে গীর্জার দেয়ালে এই মাত্র এঁকেছে। সঙ্গবদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে শিল্পীর এই অবস্থান।
ব্যাঙ্কসির আঁকা সব থেকে জনপ্রিয় চিত্র হলো; ‘গার্ল অ্যন্ড বেলুন’(২০০২); চিত্রটিতে একটি কন্যা শিশু হৃদয়াকৃতির লাল বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি লন্ডনের সাউথ ব্যাংকের একটি সিঁড়ির দেয়ালে চিত্রটি এঁকেছিলেন, যার অনুলিপি আমরা দেখছি প্রদর্শনীটিতে। নানাজনের নানান মত এই চিত্রটি সম্পর্কে। কারণ শিশুটি বেলুনটিকে ধরতে চাচ্ছে নাকি তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে তার প্রিয় বেলুনটি; ঠিক বোঝা সম্ভব নয়। শিল্পী শিশুর উচিয়ে ধরা হাত ও বেলুনের সুতার মধ্যে সামান্য ফাঁকা জায়গা রেখে দর্শকদের মনে চিন্তার সৃষ্টি করেন। ব্যাঙ্কসি হতাশার কথাই বলেন বেশি তবে আশার বাণীও শোনান, যদি কেউ সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখেন। আশাকে চিনতে শেখা যাবে যখন আমরা হতাশাকে সনাক্ত করতে পারবো এবং জয় করতে পারবো।
এমন হাজারো বিষয়বস্তুর মধ্যে শিল্পী সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা অভিব্যক্ত করেছেন তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে। এছাড়াও শিশুশ্রম, যুদ্ধের সৈনিক, পৃথিবীর অন্যান্য সমস্যা, বিশ্ব রাজনীতি, দম্পতিদের সম্পর্কের মধ্যে অসততা, প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যকার সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের সম্পর্ক, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সাথে তাঁর সংঘাত, সমাজে সাধারণ মানুষের সংঘাত, সংঘঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান, কর্পোরেট বা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, ভোগবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান – এই সবই তাঁর প্রিয় বিষয়বস্তু। ইঁদুর থেকে শুরু করে রাণীকে বাঁদরের বেশে, চার্চিলকে পাঙ্ক সাজে, এমনকি হাতিকে রঙ করে তিনি প্রদর্শনীতে ছেড়ে দেন, এই অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় কাজগুলো সৃষ্টিশীলভাবে করতে পারেন তিনিই ব্যাঙ্কসি।
২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিনে একশজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ব্যাঙ্কসির নামও বারাক ওবামা, স্টিভ জবস কিংবা লেডি গাগার পাশে উচ্চারিত হয়েছিলো। ব্যাঙ্কসি, ভিঞ্চি থেকে ভ্যান গো – পৃথিবীর এমন অনেক বিখ্যাত শিল্পীদের মতোই একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী। আমার মতে বর্তমান সময়ের কোনো শিল্পী বা শিল্পকলার প্রেমিকের যদি সুযোগ থাকে ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্ম প্রদর্শন করবার, তবে বিনা দ্বিধায় সেটা তার অবশ্যই করা উচিৎ। ব্যাঙ্কসি আমাদের বর্তমান সময়ে আশা-জাগানিয়া শিল্পী। শিল্পীরা যে এখনও সমাজের অসংগতিকে চিহ্নিত করতে পারছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারছেন, তার প্রমাণ একমাত্র ব্যাঙ্কসি। ব্যাঙ্কসি আমাদের আশার কথা শোনান তাঁর হতাশা ব্যঞ্জক শিল্পকলার মাধ্যমে। নিন্দুকদের উত্তর দেবার মতো যথেষ্ট রসদ তাঁর কাছে আছে। আমার প্রত্যাশা শুধু তাঁর আঁকা আশার সেই লাল বেলুন বা বেলুনের ছদ্মবেশে কোনো শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়ুক সারা বিশ্বে।