:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আয়শা ঝর্না

কবি, গল্পকার, অনুবাদক

‘কাজলরেখা’ এবং আমাদের স্বপ্ন
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত

‘কাজলরেখা’ এবং আমাদের স্বপ্ন

সেলিম মোরশেদ মানেই আমাদের সময়ের লিটল ম্যাগাজিনের দ্রোহী উজ্জ্বল এক গল্পকার। তার গল্প আমাদের সময়ের অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্টের সাহিত্য নিয়ে যত দিনরাত্রির কথন। সে এক জীবন আমরা পার করেছি। গল্প কবিতায়, কথায়, আড্ডায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পিজির বটতলায়, কিংবা পাবলিক লাইব্রেরীর চত্বরে। কি এক ঘোর সবার ভেতর! শুধু লেখা আর পত্রিকাকে ঘিরে যত কথকতা। যেন জীবন মরণ এখানেই। খাওয়া দাওয়ার বালাই নেই শুধু চায়ের উপর চলতো কতগুলো ঘন্টা। এভাবে দিনের পর দিন তার গল্পের সাথে আমাদের কবিদের কথা চালাচালি। কখনো তা ঝগড়া কখনো তা অপেক্ষা। আগের দিনের লেখা গল্প সেলিম ভাই নিজের মুখে মুখস্থ বলে যেতেন। সে যে কী রকম উন্মাদনা, নতুন কে কী লিখেছে তা আবার ছোট এক কাগজের টুকরোয় লেখা অথবা মুখস্থ বলা আমাদের প্র্যাকটিস হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু গল্পকারের তুলনায় কবিদের সংখ্যা বেশি তাই সেলিম মোরশেদ কবিদের সাথে পাল্লা দিয়ে গল্প বলে যেতেন। গাণ্ডীবের তপন বড়ুয়ার খোলা গলায় গান ভেসে আসতো অথবা কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের ভরাট গলায় গান এখনো কানে বাজে। পিজির বটতলায় গেলে এখনো সেইসব ভূতুড়ে সন্ধ্যাগুলোকে খুঁজে ফিরি যেন সেসব এক অলৌকিক জীবন ছিল! আর কখনো সেসব দিন ফিরে আসবে না, আসবে না শামীম কবীর কিংবা বিষ্ণু বিশ্বাস অথবা পায়ের শেকল খুলে পালিয়ে আসা শোয়েব শাদাব। জীবন পুড়িয়ে সাহিত্য রচিত হচ্ছিল ভবিষৎ-এর জন্য। কখনো শাহেদ শাফায়েত, কখনো আহমেদ নকীব কখনোবা কফিল আহমেদ গুচ্ছাকারে দাঁড়িয়ে অথবা বটতলায় বসে ছোট ছোট গ্রুপে হয়ে দুই তিনজন মিলে আড্ডা চলতো। সুমন রহমান, মাহবুব পিয়াল জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ বাসে করে বিকেলে এস নেমে আবার আটটার বাসে ফিরে যেত। কখনো কখনো ওর পিছু নিচ্ছে শাহেদ শাফায়েত, দুপুরের দিকে কখনো কখনো আমিও চলে যেতাম ওদের সাথে। সারাদিন আড্ডা শেষে ঢাকায় ফিরে আসা। তার ভেতরই লেখা নিয়ে পড়া, আড্ডা চলতোই।

আমরা গ্রেগর সামসার জীবনে আটকে পড়তে যাচ্ছিলাম। অথবা ক্যামুর আউটসাইডার, সুবিল মিশ্রর বিধবা বউয়ের মড়া অথবা অমিয়ভূষণ মজুমদারের গল্প নিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলা। দিন ফুরিয়ে রাত, রাত গড়িয়ে ভোর আবার আরেকটি দিন শুরু হতো এই লেখার ঘোর নিয়েই।

কিন্তু সামাজিক জীবন; এইসব খ্যাপাটেপনা কতদিন আর পরিবার, সমাজ মানে! বাসা থেকে প্রতিদিনই বাবা-মায়ের চাপ। শেষ অবধি এই খ্যাপাটেপনা থেকে সরে এসে একটা রেগুলার কাজে ঢুকে কিছুটা সরিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে এই আগুনে সাহিত্য জীবন থেকে। পরে ধাতস্থ হই। কিন্তু যার যার লেখা আমরা ঠিকই পড়ি। তা নিয়ে টুকটাক আলোচনা জারি থাকতো।

হ্যাঁ আমি সেলিম মোরশেদের গল্পের সাথে বেশ আগে থেকেই পরিচিত—সেই ১৯৯২ সাল থেকে। বিরানব্বইতে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যার ভেতর দিয়ে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে আমি যুক্ত হই। বাকিটা ইতিহাস। অনেকটা কফিল আহমেদের ইচ্ছেতেই আমার পত্রিকাটির সাথে যুক্ত হওয়া। তার আগে তিনটি সংখ্যা হয়েছিল। শাহেদ শাফায়েত, আহমেদ নকীব, সুমন রহমান, কফিল আহমেদ এই পত্রিকাটির সাথে যুক্ত ছিলেন। আমি এসে তাদের সাথে যোগ দেই। তবে নব্বইয়ের আগে কোথাও কোনো সৃজনশীল লেখা প্রকাশ হয়নি। এমনিতে দৈনিকে কন্ট্রিবিউটার হিসেবে কাজ করতাম, অনুবাদ, ছোটখাটো বই রিভিউ এগুলো লিখতাম। টিএসসিতে ব্রাত্য রাইসুর সাথে পরিচয়। ও আমি সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম, ও তখনি শাহবাগের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন নিয়ে আমাকে পত্রিকাগুলো পড়তে দেয়। আমি ওর সাথে মাঝে মাঝে সিলভানা কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আড্ডা দিতাম। ধীরে ধীরে গাণ্ডীব, পূর্ণদৈর্ঘ্য, দ্রষ্টব্য, পেঁচা এই পত্রিকাগুলোর সাথে পরিচিত হই, লেখকদের সাথেও। তারপর যুক্ত হলাম সরাসরি পূর্ণদৈর্ঘ্য লিটল ম্যাগাজিনের সাথে। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হলো অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্টের সাথে। এবং সহযোদ্ধাদের সাথেও। সেই থেকে যারা আগে থেকে লিখছেন নিয়মিত তাদের সাথে শুরু হলো লেখা নিয়ে যোগাযোগ। তো সেলিম মোরশেদ, শান্তনু চৌধুরী, আহমেদ নকীব ছিলেন গাণ্ডীবের প্রাণ। সাজ্জাদ শরীফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু গাণ্ডীব ছেড়ে দেওয়ায় তাদের চলার পথে একটা ধাক্কা আসে। তারা সেটি সামলে নেয়। তপন বড়ুয়া তাদের কাণ্ডারী। অনেক পড়াশোনা করতেন গাণ্ডীব সম্পাদক তপন বড়ুয়া। আর তার পাগলামি, খেপাটেপনা সবাই চুপচাপ মেনে নিতো। সেখানে সেলিম মোরশেদ নতুন কোন গল্প লিখেছে তো পত্রিকা বেরুনোর তোড়জোড়, নতুন গল্পটা গ্রুপে শোনানো, নিজে আবার এডিট করে তবেই তা পত্রিকাতে আনতেন।

মানুষেরই জয়গান যেন বেজে ওঠে এই গল্পে। সমাজ নারীর উপর যেসব ভার চাপিয়ে দেয় লেখক সেখান থেকে তাকে মুক্ত করে দেন। এখানেই ‘কাজলরেখা’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পাঠকের হৃদয়ে। সে দ্রোহী হয়েও পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেয়।

সেলিম মোরশেদের গল্প বলার ভঙ্গিটা যেন এখনো কানে বাজে। তার গল্পে সব সময় একটা নিরীক্ষা থাকে। এই নিরীক্ষা প্রবণতাই তার গল্পের একটি ধরন সেটি প্লট কিংবা ভাষাগত উভয়দিক থেকেই। এই নিরীক্ষাধর্মী গল্পের কারণেই তিনি অন্য গল্পকারদের চাইতে আলাদা হতে পেরেছেন। বাংলা সাহিত্যে তার একটি নিজস্ব স্থান রচিত হয়েছে। এর জন্য রয়েছে তার গল্পের প্রতি নিবেদন। প্রতিটি বইমেলায় একবার হলেও দেখা হয়। একবার হলেও হ্যালো বলা হয়। কোনো নতুন বই এলো কি না জিজ্ঞেস করা হয়। একটা জীবন তিনি এই লিটল ম্যাগাজিন আর গল্পের ভেতর ঢেলে দিয়েছেন। আর কিছুই ভাবতে পারেন না গল্প লেখা ছাড়া।

কাজলরেখা গল্পটি ঠিক কত সালে প্রকাশিত হয়েছিল মনে নেই কিন্তু কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, পড়েছিলাম। এবার আবার নতুন করে পড়া। তার প্রতিটি গল্পের মতোই এই গল্পটিতে রয়েছে এক্সপেরিমেন্ট। থিমের দিক থেকে এটি একটি আধুনিক চিন্তার গল্প এবং নারী স্বাধীনতার প্রতি তার পক্ষপাত দেখা যায় এখানে। যার কেন্দ্রীয় চরিত্র কাজল একজন স্বাবলম্বী নারী। চাকরিরত কাজল নিজের উপার্জনে ফ্ল্যাট, গাড়ি সবই তার নিজের পছন্দমাফিক কিনেছে। কিন্তু সম্পর্কের দিক থেকে সেখানেও সে মুক্ত থাকতে চায় সমাজের তোয়াক্কা না করেই। বাবা মারা গেলে তাকেই পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। সে এক মুক্ত মনের স্বাবলম্বী নারী। তার প্রেম, অনুরাগ, ভাবনা সব তার নিজের মতোই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির। কাজলের বোন সীমা, সেও স্বাধীনচেতা তবে কাজলের মতো অতটা নয়। তার প্রেমিক রুম্মান। তাদেরও আছে এক ধরনের যৌথ জীবন যা কাজলের থেকে ভ্ন্নি। সীমা কিছুটা ভাবুক প্রকৃতির, রুম্মান তার স্বামী। সীমা স্বাবলম্বী অর্থনৈতিকভাবে, কাজের জন্য জাপানও ঘুরে আসে। রুম্মান আর সীমার রয়েছে অন্যরকম রোমান্টিক কেমিস্ট্রি। রুম্মানের রয়েছে আর্থিক টানাপোড়েন। সীমার ব্যস্ততায় অন্য নারী আসে তার জীবনে। রুম্মান তা অকপটে বলে। সীমা কিছুটা কষ্ট পায়, কান্নাকাটি করে। রুম্মান অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে কিছুটা বিপর্যস্ত থাকে, তাদের দাম্পত্য জীবন ব্যাহত হয়। দারিদ্র্য যেন তার সাথে ব্যঙ্গ করে পানশালায়।

আরেফিন চরিত্রটি আসে কম গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র হিসেবে। সে যেন কাজলকে প্রমিনেন্ট করার জন্যই। আরেফিনও স্বাবলম্বী, সম্পর্কের দিক থেকে সে ভিন্ন নারীতে ভিন্ন রকম অস্তিত্ব অনুভব করে। সম্পর্কের দায়ভার এড়িয়ে যেতে চায়। একাধিক সম্পর্ক থাকে, এ নিয়ে সে বিব্রত নয়। অনেকটা তার ইচ্ছেতেই কাজলের সাথে প্রেম হয় যাতে কাজলেরও সায় আছে। কাজলের সাথে তার প্রেম হয় মানসিক এবং দৈহিক। শহর থেকে দূরে, প্রকৃতির কোলে। এবং সে প্রেগন্যান্ট হয়, অপেক্ষা করে আগামী দিনের জন্য, একজন সুস্থ মানুষ হবে যার নাম হবে দিব্য। যদিও তার বোন সীমার সাথে, মায়ের সাথে সামাজিক দ্বন্দ্ব হয় তবু সে তার স্বাধীন চিন্তায় থাকে অবিচল। কাজল তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার কারণে অনেক হীনম্মন্যতা থেকে থাকে মুক্ত, নির্ভার। কোনো টানাপোড়েন নেই। অন্যদিকে আরেফিন তার প্রেমিক, তাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখা যায়। এটি যেন আধুনিক উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে জীবনের চাপা ক্ষোভ বা বাস্তবতা!

এ সমাজে একজন নারী যখন মুক্ত হয় তখন সে সমাজকে তোয়াক্কা না করতে শেখে। সমাজের সব শৃঙ্খলকে সে ছুড়ে ফেলতে পারে। কেননা তার রয়েছে নিজের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং নিজস্ব চিন্তাধারা, যেখানে সে একটুও দ্বিধাগ্রস্ত নয়। কাজলরেখার বোন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও সেও পরে মত দেয়— অসুবিধা কি একজন মানুষই তো আসবে পৃথিবীতে! এখানে লেখক নির্মোহ হন। তিনি নিজেও যেন হালকা নির্ভার বোধ করেন গল্পটিকে পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়ে। যেন লেখক পাঠককেও সেই দ্বন্দ্বে সামিল করান সমাজ বনাম নারী স্বাধীনতা, তথাকথিত ধর্ম এবং নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষই যেন পরম আরাধ্য হয়ে ওঠে। ফলে মানুষেরই জয়গান যেন বেজে ওঠে এই গল্পে। সমাজ নারীর উপর যেসব ভার চাপিয়ে দেয় লেখক সেখান থেকে তাকে মুক্ত করে দেন। এখানেই কাজলরেখা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পাঠকের হৃদয়ে। সে দ্রোহী হয়েও পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেয়। তথাকথিত সমাজের ভ্যালুসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এ গল্পটি একটি ছোট উপন্যাসের দিকে মোড় নিতে নিতে থেমে যায়। এখানে কাজলরেখা পালা নাম একটি পালা ঘুরেফিরে আসে। আসে শুকপাখি। আসে কাঁকনদাসি আর সওদাগরের কথা। কিন্তু কেন আসে তা পাঠকের কাছে অবোধ্যই থেকে যায়। এই পালাটি শুধু একটি ক্যামোফ্লেজ। গল্পটির আখ্যানকে দীর্ঘায়িত করে। এবং তা বারবার প্রয়োজনহীন মনে হতে থাকে। গল্পটিতে শুধু শুধু বাক্যবিন্যাসের জটিলতা রয়েছে, যা পাঠককে হোঁচট খাওয়ায়। ফলে গল্পটি খুব সাবলিল গতিতে এগুতে যেয়ে থেমে যায়। এখানে গল্পের দূর্বল দিক। অবশ্য সেলিম মোরশেদ বলেন তার গল্প সকল পাঠকের জন্য নয়। কিন্তু গল্প তো পাঠকের জন্যই, পাঠক যাতে কমিনিকেট করতে পারে সহজে সেদিকটাও গল্পকারের মনে রাখতে হবে।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!