

কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ: তাঁর অচেনা ভাষার দেশে অবিরাম ভূ-বাক্যরা
‘… সেই ঘুমের ভেতর হেমাঙ্গিনী জেনে গেলো, কাটা উরঙ্গের মুণ্ডুটা, হেমাঙ্গিনীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক পাক ঘুরে, জাজ্বল্যমান খুপরি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো নিঃশব্দে’౼এমন একটি ম্যাজিক্যাল বাক্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ গল্পটি।
বাংলা সাহিত্যের পথে পথে এমন সব নবধারার গল্পপুষ্প আপন ভঙ্গিতে ঘ্রাণ ছড়িয়ে বাতাশের ভেতর নতুন বাতাশ বুনে আমাদের নড়বড়ে ফুসফুসকে বারংবার তাজা করে দেয়। ভাবা যায়! আর এসব অভাবনার ভেতর ঢুকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ নিজের রক্ত নিজে চুরি করে বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়ে চলেছেন এক একটি উজ্জ্বল শিল্পকর্ম। একবার ভাবুন তো, এমন একজন সেলিম মোরশেদ আছেন অথচ তাঁর লেখা পাঠ করা হয়ে ওঠেনি বা পাঠ করলেও তেমন মনোযোগ দেয়া হয়নি! যদি তাই হয়, তবে পাঠক হিসেবে আমি আরো দরিদ্র থেকে যাব।
প্রায় ১৫/১৬ বছর বাদে ‘কান্নাঘর’ গল্পটি আবার পড়লাম। কবি অনুপ চণ্ডাল যথার্থই বলেছেন౼ ‘কখনো কখনো পুনঃপাঠই প্রথম পাঠ౼ প্রকৃত পাঠ।’ কী বলব! কথাটা এতই সত্যি, সত্যি সত্যি মনে হল আরো কত কত লেখা আমাকে পুনঃপাঠ করতে হবে। যেহেতু পুনঃপাঠ মানে কমপক্ষে দ্বিতীয় পাঠ; আমি আরো আরো অনুভব করলাম ‘কান্নাঘর’ হল সেই জাতের গল্প যা তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বা ততোধিকবার পাঠ করলেও মনে হবে আরো একবার পড়ার পিপাসা র’য়ে যাবে। ‘কান্নাঘর’ গল্পটি শেষ করলে তৎক্ষণাৎ অনুভূত হয় যেন বা জ্যান্ত একটি উপন্যাস পড়লাম। গল্পটি আকারে শুধুমাত্র দীর্ঘ বলে নয়, এর অন্তর্গত ফিল্ড এবং ভাষাশৈলীর অলিগলি এমন একটি অচেনা অন্ধকারের সন্ধান দেয় যা একটুও ভীতি সৃষ্টি করে না বরঞ্চ অন্ধকারের আত্মগত আঁধারে একটু একটু পা ফেলে তারাভরা আত্মার দেশে নিয়ে যায়। সত্যি বলতে কী, সেলিম মোরশেদের ভাষাভঙ্গিতেই রয়েছে তাঁর প্রকৃত সাহিত্য। সেলিমের গদ্য তুমুল অদম্য এবং একই সাথে সমর্পিত। যে সমর্পণে ভাষা আরো আরো জেগে ওঠে। করুণা ও ক্রোধ মিলে করে মাল্যদান। তৎসম শব্দের প্রাবল্য আছে তবু কী দারুণ অসাধু! পরম যত্নশীলতায় চলতি ভাষার আপন বাক্যে বাক্যে ফুলের সৌন্দর্য খুব নীরবে ফুটিয়ে যান তিনি। সেলিম মোরশেদ কানা পাঠকের হাত ধরে ধরে পথ দেখান না, বরঞ্চ চোখ খুলে খুলে দিয়ে তিনি পাঠককে সক্রিয় করে তোলেন।
”অচেনা গন্তব্য আর একাকী ভ্রমণ! প্রকাশ নেই অথচ বিকাশ আছে। প্রলোভন নেই অথচ প্রশস্তি আছে। ভ্রু-র বাঁকদুটো উঁচু হয়ে উঠেছে। এর মাঝখানে জলছাপের মতো তিনটে রেখাও জেগে ওঠে। দূর থেকে সমুদ্রের ফুলে ওঠা অজস্র ফেনাগুলো সূর্যালোকে শুভ্র থেকে গোলাপি হয়ে আসে তারপর যেন হাওয়াই মিঠার মতো ফাঁপাটুকু সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। নিত্যানন্দ দুহাত দুপা ছেড়ে নিজেকে আরও ছোটো করে ছেড়ে দেয়। পথই বলুক পথের ঠিকানা! যে পথিক তার নির্ধারণ ক্ষমতা কতোটুকুই-বা? কাল্পনিক পরিণতিটুকু নিয়ে ভেবে চলা। নিত্যানন্দ বলে, ’আমি ক্ষুদ্র, এই প্রচণ্ড-গম্ভীর-গভীর দূর উথাল-পাথাল সমুদ্রে౼ যার গ্রীবা পাহাড়ের মতো উন্নত অথচ চলমান আর বড়ো বড়ো অজগরের মতো কুণ্ডলী পাকানো স্রোতের পাকের অবিরত গুমগুম গর্জনে আমি সন্ত্রস্ত।౼তবু হে সমুদ্র আমার অভিলাষ౼এই ভক্তের বাসনা পূর্ণ করো। অশেষ পরিশ্রমের পর সে একটা কিনারা দেখে। বিস্তৃত বেলাভূমি౼ধু-ধু বালি। আশ্চর্য, সেখানে একটি ডুমুরের গাছ নিত্যানন্দ লক্ষ্য করে। এই বেলাভূমিতে?
কাছে যেতেই গাছ বলে ওঠে, ‘জন্ম নিয়েছি তারাবৃক্ষ হয়ে।’
নিত্যানন্দ তৎক্ষণাৎ বলে, ‘আমি ওর দ্যুতির তীব্রতা।’
নিত্যানন্দ দেখে౼ ডুমুর গাছে কতো ফুল!
যাহ্, ডুমুরের কখনও ফুল হয়!
যা হয় না তাই তো দেখতে হয়। নিত্যানন্দ দেখে।”
(গল্প: ‘কান্নাঘর’)
কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের উজ্জ্বল বাক্যরা যদি ডালে ডালে থাকে তবে তার ভাষা আছে পাতায় পাতায়। সকল বাক্যের অন্তরালে যে অনিরুদ্ধ ভাষা তা দুর্নিবার গতিতে কড়া নাড়ে; বাঁক উঠে আসে শব্দের বিস্তীর্ণ শব্দে। ভাষার তুঙ্গ পাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে পৌঁছে দেয় কোনো এক মায়াচারী নীরবতায়। একটি অতল নীরবতা। পা ফেলে তল পাওয়া যায় না। না-পাওয়াই যেন আনন্দ। ‘কান্নাঘর’ গল্পের পিছু পিছু ধেয়ে আসে জীবনের গোপনে দূর হারানো অশ্রুর প্রতি নিঃসঙ্গ অনুসন্ধান আর স্বয়ং লেখকের একটা নিজস্ব প্রবণতা। আসলে ওই প্রবণতাটুকুই ভরসা। হঠাৎ করেই অমিয়ভূষণের কথা মনে পড়ছে। আসলেই কি হঠাৎ? হঠাৎ বিষয়টা কিন্তু হঠাৎই না। আমি আগেও ভেবেছি, ভেবে ভেবে দেখেছি সেলিম মোরশেদের কথাসাহিত্য, ঘরানা অর্থে অমিয়ভূষণ মজুমদারের নামটি যতটা মনে পড়ে, প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক সুবিমল মিশ্রকে একদম ততোটি মনে পড়ে না। মনে পড়ার কথাও না। তাঁরা আলাদা। বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের শুরুর কাল থেকে কথাসাহিত্যের একজন শিল্পীরূপে সেলিম মোরশেদ খুব নিবিড় এবং নেরেটিভ ও এন্টি-নেরেটিভ মিলে একজন বহুমাত্রিক লেখক। তাঁর হাতে গল্প, গল্পের অচেনা বিশ্ব এবং বহুতল কাঠামো যেমন উঠে এসেছে তেমনি নিবিষ্ট ধ্যানে পেরিয়ে যেতে চেয়েছেন সকল পরিচিত সীমানা। গত ৩০/৩৫ বছরের চলমান লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রবক্তারূপে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ক সেলিম মোরশেদের ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ’౼বইটি বাংলাদেশের ছোটকাগজ আন্দোলনে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। যদিও এই গ্রন্থের অধিকাংশ লেখা বইটি প্রকাশের প্রায় বছর দশেক আগে থেকেই ‘প্রতিশিল্পে’র বিভিন্ন সংখ্যায় পর্বে পর্বে প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু যে কথাটি আমি অবধারিত বলতে চাই, একজন কথাসাহিত্যিক রূপে সেলিম মোরশেদ আরো আরো অধিক বিস্তারকারী। অধিক দ্বন্দ্বময়। মানে যে দ্বন্দ্ব শিল্পের জড় দেহকে প্রাণ দান করে। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থে যে গদ্যশিল্পীকে আমরা পেলাম౼ তিনি সেই শান্ত ভূমি যেখানে পা রাখলেই পা থেকে মন অব্দি ভূকম্পন ঢুকে যায়। ফলে মনোজগৎ নড়ে ওঠে। সেলিম মোরশেদের কথাসাহিত্য আপামর পাঠকের কাছে পৌঁছায়নি সত্য, তাতে কী-বা করার আছে কারণ౼ পৌঁছানোর দায় তো লেখকের হাতে থাকে না কিন্তু তবু শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে যেসব পাঠকের সাথে সেলিম মোরশেদের গল্প ও সাহিত্যের পরিচয় ঘটেছে তাঁরা একান্তে নিজের কাছে হলেও স্বীকার করবেন কী রকম আশ্চর্য উজ্জ্বলতায় সেলিমের কথাসাহিত্য তাঁদের মানসপটে আন্তরিকভাবে নক করছে।
‘উত্তর-দক্ষিণ বরাবর মরা ভৈরব। শ্মশানঘাট সংলগ্ন। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে কচুরি ভাসিয়ে মৃত যৌবনের প্রমাণ দেয়। বড়ো বড়ো মন্দির, মূর্তি আর কিছু সুন্দর ফুল শ্মশানের সামগ্রিক দৈন্য-দুর্দশাকে ঢাকতে পারে নি। মন্দিরের ঘরগুলো আলো-অন্ধকারের মতো এদিক-ওদিক থেকে বেশ কয়েকটি সরু সরু দরোজা মন্দিরগুলোকে রহস্যজনকভাবে দেবদেবীর প্রতি ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের মনের ওপর এই রেখাপাত ইচ্ছাকৃত, না প্রকৃতির অবক্ষয় তা বোঝা দুষ্কর। বিরাট কালীমূর্তির বিশাল শরীরের সুষম স্থাণুত্বে চেষ্টা করা হয়েছে এর ক্ষমতা প্রকাশের। তারপরে চোখ ফেললেও বোঝা যায় সবকিছু উৎরিয়ে প্রকৃত শিল্প গড়ে ওঠে সহজ-সরল আকাশ-মাটি-প্রকৃতি এই সবকিছুরই যেন সম্মেলনে। যা মানুষকে হীন করে না। শিল্প নিজেই হীন হয়ে থাকে।’
(গল্প: ‘চিতার অবশিষ্টাংশ’)
একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে ইমেজ অথবা চিত্রকল্প ব্যবহারের ভেতর দিয়েই একজন লেখকের আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য ও ব্যঞ্জনা স্পর্শ করা যায়। সেলিম মোরশেদের গোটা গল্পে ইমেজ শুধুমাত্র ইমেজের স্থানে অনড় না-থেকে গল্পের বহুমাত্রিক কেন্দ্রে সক্রিয় হয়ে ওঠে। হয়তো এভাবে বলতে পারি, সেলিমের গল্প ও ইমেজের ভেদরেখা লুপ্ত হয়ে যে ভাষাভঙ্গি জেগে ওঠে সেটাই তাঁর অবিরাম কথাসাহিত্য। গোটা গল্পগ্রন্থ౼ অতদূর নয়, এক-একটি আলাদা আলাদা গল্পে সেলিম মোরশেদ আরো বেশি দেহ ডুবিয়ে নিজ পায়ে হেঁটে হেঁটে বাস্তব জগৎ থেকে তুলে এনেছেন আলাদা আলাদা বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ। সেলিম মোরশেদের কান অত্যন্ত শার্প। তার গদ্যে কোথায় যেন একটি লুকায়িত ছন্দ আছে। যদিও ছন্দ নিয়ে তাঁর কারবার নয়, কিন্তু ছন্দ তাঁর পিছু ছাড়ে না। এটা তাঁর সহজাত ভঙ্গি।
কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের উজ্জ্বল বাক্যরা যদি ডালে ডালে থাকে তবে তার ভাষা আছে পাতায় পাতায়। সকল বাক্যের অন্তরালে যে অনিরুদ্ধ ভাষা তা দুর্নিবার গতিতে কড়া নাড়ে; বাঁক উঠে আসে শব্দের বিস্তীর্ণ শব্দে। ভাষার তুঙ্গ পাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে পৌঁছে দেয় কোনো এক মায়াচারী নীরবতায়। একটি অতল নীরবতা। পা ফেলে তল পাওয়া যায় না। না-পাওয়াই যেন আনন্দ।
আমি মনে করি শুধুমাত্র ভালো গল্প লেখার বাসনা থেকেই তিনি গল্প লেখেন না। অথচ সেলিম মোরশেদ দুর্দান্ত সব অন্যরকম গল্প লিখে চলেছেন। এটা আসলে কীভাবে হয়? এই অন্যরকম গল্প লেখার অন্তর্গত দ্রব্যগুণটা কোথা থেকে আসে? অনেক কিছু হয়তো বলা যায় তাতে আসল বলাটা কি আসলে হয়? লাইফস্টাইল একটা ঘটনা। সেলিম মোরশেদের গোটা জীবনের নিজস্ব উপলব্ধি, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির রিফ্লেকশন তাঁর সকল লেখার ভেতর ছড়িয়ে থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। লেখকের ব্যক্তিজীবনকে না-খুঁচিয়ে সাহিত্যকর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করাই ভালো। প্রতিটি লেখার জন্মবেদনা লেখকের নিজস্ব। বেদনায় রূপান্তরিত হয়ে বার বার পুনর্জন্মের ভেতর দিয়েই সেলিম মোরশেদ এগিয়ে যান। কিন্তু তিনি কোথায় যান? সম্ভবত তিনি বিশ্ব পরিভ্রমণ করে করে নিজের দিকেই অশেষ ধাবিত হন। নিজের ভেতরে যে অতল রস ও রহস্য রয়েছে তাকেই উত্তোলন করতে করতে এই মানবসমাজের পথে পথে দৃশ্যত হেঁটে যান তিনি। সেলিম মোরশেদের প্রতিটি কথাসাহিত্যে আত্ম-উন্মোচনের স্ট্রাগল রয়েছে। রয়েছে সেই স্ট্রাগলের নিবিড় পরম্পরা। তাতে আপাত: কিছু বিশৃঙ্খলা থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু উশৃঙ্খলতা নেই। তাঁর গল্পে যত যত চরিত্ররা যত যত ভাবে নড়াচড়া করে তারা অখণ্ডরূপে পূর্ণতা পায় পারস্পরিক সংযুক্ততায়। গোটা সেলিম মোরশেদের লেখায় বিস্তীর্ণ ছড়িয়ে রয়েছে সেই প্রশ্ন, যে প্রশ্নরা শুধু প্রশ্ন নয়, বিস্ময়ও বটে, যে প্রশ্নরা কখনো মরে যায় না, সেই প্রকৃতি౼ যে প্রকৃতি কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নয়, একটি বস্তুগত আধ্যাত্মিকতার ভেতর দিয়ে লেখক মানবের নাড়ি-নক্ষত্র অবলোকন করেছেন। একই সূর্যের বেলাভিত্তিক আলো যেমন ভিন্ন ভিন্ন হয় তেমনি পাল্টাধারার লেখাও পাল্টাতে থাকে ভিন্ন ভিন্ন বেলায়। তাতে সূর্যের ক্যারেক্টার পাল্টি খায় না। লেখার ক্যারেক্টারও না। অথচ কিন্তু একটাই সূর্য। একটাই সেলিম মোরশেদ। সে-ই ভালো, কেননা সেলিম মোরশেদের ভেতর ঢুকে পড়েছে একটি পূর্ণ আকাশ যেখানে পুব থেকে পশ্চিম অবধি একটি প্রকাণ্ড ডায়ালের ঘড়ি বহমান আছে। টিক্ টিক্ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
‘কতো মৃত্যুই সে নাড়াচাড়া করলো অথচ মরণ কি তা বুঝলো না? সখিচান অদ্ভুত౼ মৃত্যু খোঁজে? কে বলে ঝাড়ুদার? এই চওড়া বুক এই চওড়া দেহ! ইস্পাতের মতো মসৃণ আর শক্ত। দুই হাতের তালু ঘষে ঘষে যেন-বা আগুন তৈরি করতে পারে। সে মৃত্যুকে দেখতে চায়। লোকে বলে সে নাকি রাজার মতো। অথচ রেনুর ফাঁসি নাটকে বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে তাকে যে সিনটায় প্লে করতে দিলো সেটা ছিলো জল্লাদের౼ এক বন্ধু বলেছিলো, ‘সখিচান, জল্লাদ আর রাজা একই জিনিস। একজন হুকুম দেয় অন্যজন নিজ হাতে মারে। দুজনই মৃত্যুদূত। কই, সখিচান ভাবে, মৃত্যুদূত হয়েও সে মৃত্যু বুঝলো না। সখিচান রাত ভালোবাসে। জানে, মৃত্যু রাতের মতোই নিস্তব্ধ আর মৃত্যুভাবনাটা মদের মতো ঝাঁঝালো।’
(গল্প: ‘সখিচান’)
কী দারুণ প্রতিধ্বনিময়! তাঁর বাক্যের তলা দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যায় একটি প্রকাণ্ড কচ্ছপ। খরগোশের মতো তড়িঘড়ি নেই, ধাবিত রেলগাড়ির ছন্দময় গতি আছে, তবু ভেতর থেকে একটি নির্ঘুম কচ্ছপ পাঠককে টেনে নেয় গভীর উপলব্ধিতে। যার গন্তব্য আরো দূর, আরো বহুদূর। সখিচান মৃত্যুকে দেখতে চায়। এত এত মৃত্যু নিয়ে নাড়াচাড়া করল তবু মৃত্যুর সাথে দেখা হলো না। সে মৃত্যু খোঁজে। মানে সে জীবন খোঁজে। একটা অপার মৃত্যুবোধ সখিচানকে থৈ থৈ জলের উপর সর্বদা ভাসিয়ে রাখে, আসলে সে তো জল নয়, সে তো জীবন। অফুরন্ত জীবন। সাহিত্য কী, সাহিত্য কেমন হয়, মহাকাল-স্বীকৃত লেখা কীভাবে দাঁড়ায়౼ সেটা তো আগেভাগে বলা যায় না। স্পন্দনটুকু পাওয়া যায়। সেলিম মোরশেদের পাতায় পাতায় সেইসব স্পন্দন এতটাই স্পন্দিত, মনে হয় মহাকাল যেন এইমাত্র এসে সমকালকে ডেকে গেল। কালের সেই পরম ধ্বনি নিয়ে অবিরত হেঁটে চলেছেন কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ। টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস্ শিল্প যাপনে তিনি একজন সাধক। গভীর সাধক। ব্যক্তিগত জীবন বিধ্বস্ত করেও তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে উঠেছে দূর নক্ষত্রের মতো অল্টারনেটিভ আর্ট। গোটা অখণ্ড বাংলাসাহিত্যে জীবিত ও অজীবিত লেখকদের ভিড়ে সেলিম মোরশেদের কথাসাহিত্য স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, দূরগামী…
‘প্রহর পাল্টিয়ে সন্ধ্যা জমাট হতে থাকে। সলোমান আরো দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে একটা সংযুক্তি পাচ্ছিলো। তার হালকা লাগলো। বহুদিন পর। বুক ভরে শ্বাস নিলো সলোমান। সে বুঝলো হাসপাতালে যাওয়া তার অর্থহীন। কতোটুকু রক্তই-বা পড়বে? তিনশত ঊনপঞ্চাশের। বাড়ির পথ ধরলো সলোমান।’
(নভেল: ‘সাপলুডু খেলা’)
হে পাঠক, সাপলুডু খেলা আছে। সাপ ও লুডু। সাপ তো বুঝলাম, কিন্তু লুডু কী? লুডু লুডু লুডু লুডু লুডু লুডু লুডু লুডু লুডু লুডু লুডু….. একদমে কতবার বলা যায়? তিনশো ঊনপঞ্চাশবার? কিম্বা ‘মৃগনাভি’ অথবা সুদীর্ঘ সংলাপের ‘মানুষ উত্তম’ বা ট্রাভেলগ ‘অমায়িক খচ্চর’। কিন্তু সেলিম ভাই, রাতে বাড়ি ফেরার আগে ভাত খেতে হবে। মনে আছে? একটু এগোলেই আপনার চিরচেনা ভাতের হোটেল। টেবিলে আমরা বসে আছি আপনার অপেক্ষায়। হঠাৎ দেখি, কাটা উরঙ্গের মুণ্ডুটা আমাদের চারপাশ দিয়ে এক পাক ঘুরে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। প্রিয় সেলিম মোরশেদ আপনি তো বলেছেনই, লেখা আর কিছুই নয়, লেখা শেষমেষ দেখা…