:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আযাদ নোমান

কবি, সম্পাদক

উপদ্রুত জনভূমিতে লালিমা বিপ্লব কিংবা মার্কসীয় ধারণায় শ্রেণিদ্বন্দ্বের অমীমাংসিত সূত্রে সেলিম মোরশেদের গল্প
শিল্পকর্ম: মোস্তাফিজ কারিগর

উপদ্রুত জনভূমিতে লালিমা বিপ্লব কিংবা মার্কসীয় ধারণায় শ্রেণিদ্বন্দ্বের অমীমাংসিত সূত্রে সেলিম মোরশেদের গল্প

আধুনিক চলচিত্র নির্মাণকলার অন্যতম প্রধান আচার্য সের্গেই আইজেনস্টাইন মহান চিত্রকর এল গ্রেকো’র অঙ্কিত’ ভিউ এন্ড প্লান অব টলেডো’ শিরোনামধেয় চিত্রকর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ছবিটির ক্যানভাসে যে চিত্রকল্প ফুটে আছে তা থেকে অনুধাবন করা যায় শিল্পীর চিন্তারেখা কিভাবে অতিদ্রুত স্থান পরিবর্তন করে, তাই ছবির ক্যানভাসে বিভিন্ন বিষয়কে অতি সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেমন নগরজীবনের দৃশ্যপটে শুধু নগরের বাইরের বিভিন্ন স্থানের আহরিত চিত্রই নয়, নগরের গলিঘুপচির ভেতর দিয়ে চূড়ান্ত দৃশ্যে স্থাপিত হয় কোনো প্রায়ান্ধকার নগরবস্তির সুকঠিন জীবন-বাস্তবের যন্ত্রণাকাতর দৃশ্য। যেখানে বাস করে কয়লা কিংবা পাথরখনির শ্রমিকেরা পরিবার সমেত, যেখানে অন্ন, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা কোনোটারই দায় বহন করেনা রাষ্ট্র-সমাজ। সুতরাং তারা গিনিপিগ এবং সমস্ত দৃশ্য এমন সুচারুভাবে ফুটে আছে যে শিল্পী তাঁর ক্যানভাসের আঙ্গিনায় একটা মানচিত্র এঁকে ছবির গতিপথের নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা করার সংগত কারণ হয়তো ছবিতে অঙ্কিত সেই স্পেনের টলেডো নগরীকে যারা খুব ভালো চেনে তাদের যেন সন্দেহ না হয় যে, এটা কোনো বাম-রাজনীতির অনুষঙ্গী শিল্পীর অঙ্কিত চিত্র। সেই ভূল বোঝাবুঝি এড়ানোর জন্যে চিত্রপটে রয়েছে স্থির নির্দেশনা। ‘ভিউ অ্যান্ড প্ল্যান অব টলেডো’ সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে গ্রেকো’র অঙ্কিত চিত্রকর্মটি যা আজও টলেডো’র গ্রেকো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। এ মহান চিত্রকর্মটির জন্য মনতাজ-তত্ত্বের প্রবক্তাদের মধ্যে চিত্রশিল্পী এল গ্রেকোকে সের্গেই আইজেনস্টাইন অনন্যসাধারণ পথনির্দেশক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। যা মূলত তথ্যমূলক ঐতিহাসিক একটা সময়কে ধারণ করে। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ-এর প্রকাশিত গল্পসম্ভার থেকে উপদ্রুত জনভূমিতে লালিমা বিপ্লব কিংবা মার্কসীয় ধারণায় শ্রেণিদ্বন্দ্বের অমীমাংসিত সূত্রে বিবেচ্য উপস্থাপনা : লেখক চিন্তা-চেতনায় মার্কসীয় ধারণার অনুসারী নন — তবে একটি নিদির্ষ্ট সময়ের পর্যবেক্ষণ তাঁর কিছু লেখায় উপস্থাপিত।

‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পের শুরুটা যেমন—

‘আকস্মিক এক প্রবল ধাক্কায় সামনে ছিটকে পড়ে জানোয়ারের মতো হাঁপাচ্ছিলো বিশু। তার হাতের হাতকড়ায় আর কোমরে বাঁধা দড়ির টানে, এইমুহুর্তে, সে আর নিজেকে একেবারে মানুষ ভাবতে পারছিলো না, এমনকি মৃদু নিশ্বাস নিতে গিয়ে তার জিভ বের হয়ে আসছিলো। বার বার অমানবিক অভিব্যক্তিতে। অবলীলায় বুঝতে পারছিলো তার আসন্ন ভবিতব্যের গতিপ্রকৃতি আর তৃতীয়বারের মতো রিমান্ডে নিয়ে যাবার পর শেষ ইচ্ছাশক্তির পরিণতি কিংবা চোখের পাপড়িতে ধীরে সুচ ফোটানো বা আঙ্গুল থেকে নখ উপড়ানোর মুখোমুখি—এ-সবকিছুই, নিজেকে বিষম এক পরিস্থিতির শঙ্কাযুক্ত ভাবনায় অস্থির করে তুললেও অবিরত স্থৈর্যের ঘোরে মাথা নাড়ছিলো তুলোর পুতুলের মতো; বিশুর সামনে আরও তিনজন আসামি, পেছনেও কয়েকজন—এবং এক দড়িতে সব বাঁধা কিনা সেটা বিশু বুঝতে পারছিলো না, কারণ তার মাথা ঘোরানোর সচেতন শক্তি ছিলো না, আর দুই কাঁধের ভেতর গলা ঢুকে পড়েছিলো ধীরে ধীরে; মণিদুটো নাড়াতে গিয়ে ব্যথায় বুঁজে আসছিলো পাপড়ি দুটো; গলা নাড়িয়ে বিশু কান্নার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ হু-হু করলো যেন-বা সে কোনও স্নেহজনিত পরিপার্শ্বে নিজেকে সামান্যক্ষণের জন্য স্থাপন করতে যাবার কল্পনা করলো।’

তখন তারা গণমানুষের মুক্তির স্বপ্নে চুর চুর। তারা তরুণ, তারা পূর্বাপর সব অসাম্য-বৈষম্য নিরসনে জীবন উৎসর্গে মাতোয়ারা এবং অনিশ্চিত গন্তব্যমুখী। চোখে-মুখে বিদ্যুতের ছটা। শ্রেণিদ্বন্দ্ব, শ্রেণিশক্র নিপাতের এই রাহুচক্রে আপ্লুত বিপ্লবের সারথিরা। গল্পে উপস্থাপিত একাঙ্ক নাটকের দৃশ্যে বিন্দু বিচ্ছুরণ পূর্ণত ইঙ্গিতধর্মী, যা বিস্তৃত বর্ণনায় প্রসারিত না হয় কখনও। ক্ষণে ক্ষণে চেতনার দৃশ্যপটে রূপ-রস-রঙ পাল্টায়, জীবনবিনাশী প্রত্যয়ে বিপ্লবের ডালপালা শাখাকাণ্ড বিস্তারিত হয়ে আসমুদ্রহিমাচলে কম্পন তোলে। বিশ্বাস, অবিশ্বাস ধরাশায়ী হয়—যার অনিবার্য পরিণতি মৃত্যুর আবছায়া প্রতীকী সংশয়ের দোলাচলে রক্তাক্ত ভূমি লাল পতাকায় বিস্তারিত হয়। আবার গোত্র, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদিও লালিমা বিপ্লবের মন্ত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তায় প্রসারিত হয়—ফলত বায়ু কখনও কখনও হিমেল, কখনও তপ্ত এই ক্লেদজ ক্রান্তির বোধিসত্ত্ব নিয়ে যার উল্লম্ফন তাকে রাজনৈতিক স্থির চিন্তার প্রসারণ বলা যায় না বাস্তবতার মানদণ্ডে।

বিত্তবান সম্পদায়ের রুচিশীল চেতনা, তাদের উচ্চাঙ্গ ন্যায়নীতির জীবনবোধ— এসব থেকে নিতান্ত দূরবর্তী অবস্থানে নিজকে স্থাপন করেন লেখক। হা-ভাতে জীবনজীর্ণ মানুষের ক্ষীণতম চাওয়া-পাওয়াই সেলিম মোরশেদের গল্পভাষ্যের অন্বেষা। বিত্ত-বৈভবের প্রতি নির্মোহ বৈরাগ্য, ব্যক্তিজীবনে প্রাপ্তির প্রতি চরম ঔদাসীন্য, পাশাপাশি চিন্তার প্রাখর্যে জ্বলজ্বলে এই লেখক নিভৃত নিকুঞ্জে প্রচলিত সরলার্থে একজন আত্মবিনাশকারী প্রপঞ্চকও বটে।

বলা সংগত, সেলিমের গল্পের ভাব-ভাষ্যের দুর্গম গিরি-কান্তার-মরু পাড়ি দিয়ে তার চিন্তাময়তার অন্বিষ্টে পাঠককে পৌঁছতে হলে অবশ্যই গভীর অভিনিবেশে স্নাত হওয়া প্রয়োজন।
গল্পকথনের শাণিত প্রস্রবণ উচ্চাঙ্গ মাত্রায় পরিমিত বোধ ধারণ করে থাকে। যা কখনোই কথকের বিশদ বর্ণনাকে প্রশ্রয় দেয় না। নিপাট-নিখুঁত শব্দশৈলীর মৃদু ঝংকারে গল্পের আঙ্গিনা ছায়াপাত করে থাকে কাব্যিক শব্দমালার আবহে। বোধ করি এ কারণেই তাঁকে কখনও কখনও তাঁর সমকালীন কিংবা পূর্বতন লেখকদের কটুক্তিভাজনও হতে হয়।
সেলিম মোরশেদের গল্পে দেখা যায় হা-লক লক- হো-লক লক উন্মাদ আগুনের ঝলসিত হোমে আত্মবিসর্জনে জীবন তামাটে বর্ণপ্রায়। তার পরও কঠিন যন্ত্রণাকাতর জীবনের করুণতম সিম্ফনি কাহিনি’র দৃশ্যচিত্রে ভেসে ওঠে।

বিত্তবান সম্পদায়ের রুচিশীল চেতনা, তাদের উচ্চাঙ্গ ন্যায়নীতির জীবনবোধ— এসব থেকে নিতান্ত দূরবর্তী অবস্থানে নিজকে স্থাপন করেন লেখক। হা-ভাতে জীবনজীর্ণ মানুষের ক্ষীণতম চাওয়া-পাওয়াই সেলিম মোরশেদের গল্পভাষ্যের অন্বেষা।

শ্রেণিবিভক্ত সমাজের পাটাতন ভেঙে, গুঁড়িয়ে, চূর্ণ করে কাঙ্ক্ষিত সমাজবিপ্লবের গতিধারায় নবসৃষ্ট এক বৈষম্যহীন সমাজচিত্র নির্মাণে তারুণ্যদীপ্ত ব্রতীজনেরা স্বপ্ন বুনেন আগামীতে লালিমা বিপ্লবে রাঙানো ভোরের কুয়াশা ছিন্ন করে উদয় হবে অনাগত পৃথিবীর নতুন সূর্য। সেই নতুন সূর্য উদয়ের পথে তাঁরা করে যাচ্ছেন জীবন বিসর্জনের অঙ্গীকার। বর্বর, লজ্জাহীন শোষণ-শাসনে ক্লিষ্ট সমাজকাঠামো, ধনী আর গরিবে দুস্তর দুর্গম ব্যবধান, যার ফলে সৃষ্ট মার্কসীয় ধারণায় শ্রেণিদ্বন্দ্বের অমীমাংসীত সূত্র। কদর্মাক্ত ও মৃত্যু-পরিকীর্ণ উপত্যকা, গল্পকার সেলিম মোরশেদের গল্পে দৃশ্যায়িত হয়েছে যে উপত্যকা—যা অনিশ্চিত গন্তব্যমূখী। ’রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পে পুলিশের হাতে আটক শ্রেণিসংগ্রামী বিশু শত নির্যাতনে পিষ্ট তেমনই একটি চরিত্র। ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় পৃথিবীর সকল ভূ-খণ্ডে শ্রমজীবী মানুষের জীবনের চিত্রপট প্রায় একই। নানা অবয়বে। অনাহারক্লিষ্ট হাড়-হাভাতে ক্ষুধার তাড়নায় শুধু বেঁচে থাকার জন্য করে যায় জীবনের নিরন্তর সংগ্রাম যা চির-বহমান এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিনে, সর্বত্র সবখানে।

‘বাঘের ঘরে ঘোগ’ গল্পের সমাচারের প্রবেশপথে দেখা যায়— ‘নিষ্প্রাণ মাটির তালের সাথে মানুষের হাতগুলো লড়াই করে যে অনিবার্য সৃজনে তো তারই ছায়া মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্যে সমুদয় শাসনমুক্ত; অসাধারণ সবলতা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে এই লড়াই নিয়ত বেঁচে থাকে মৃত্যুর ছায়া নিয়ে, ইতি ও নেতিকে ফড়িংয়ের ডানায় রেখে নির্ঘুম জাগরণে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এ দুনিয়ার চাকায় দু হাতই লাল, তবু একা না, হাত বাড়িয়ে, লাল সেই দুই হাত উঠিয়ে সিক্ত আবেগে অস্বাভাবিকভাবে বা অবাস্তবতায় ছোটে স্ব-প্রাণ, কে যেন ঠেলে, গন্তব্য অজানা অথচ গতি অরুদ্ধ, দাঁড়াতে হয় অচেতন গোত্রভঙ্গে হাঁক পাড়ে কে তুমি? আমি; আমি কে? নাম বলে না ! পদশব্দের ক্ষীণ ধ্বনি আশংকা জাগায়।’

বাক্যগঠনে অন্যতর পরিভাষা নির্মিত হয়। যেমন ঢালাই কারখানায় লোহা গলিয়ে নির্মিত ইস্পাতের দেয়াল। বোধগম্য ও অনিবার্য অর্থময়তার প্রয়োজনে একটি বাক্য থেকে কোনো শব্দকে বিভাজন করা যাবে না, টেনে নিতে হবে পুরো বাক্যটি। এই যে, শব্দের সাথে শব্দের নিকটবন্ধন—এটা সেলিম মোরশেদের গদ্যভাষার এক ভিন্নতর উপমান। একই সাথে বলা যায় তাঁর গদ্যের পাটাতন যেন চৈত্রের কাঠফাটা চৌচির মাটির মানচিত্র, যেখানে অসংখ্য আঁকাবাঁকা খোড়ল হাঁ করে আছে আগামী বৃষ্টির অপেক্ষায় এবং সে অপেক্ষা করে জীবনের সহজ-সরল সত্যকে উন্মোচন করে নিয়তি নিষ্ঠুর বাস্তবের নির্মমতায় ভেসে-ওঠা প্রান্তিক সমাজের অবয়ব। গল্পের প্রাসঙ্গিক বর্ণনায় আসে বাম-রাজনীতির অনেক অনেক চরিত্র।

শ্রেণিসংগ্রামের হাতিয়ার নিয়ে ভারতবর্ষের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র যাঁরা পাল্টাতে চেয়েছিলেন, সেই চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, মতিন, আলাউদ্দিন, টিপু বিশ্বাস, হক- তোয়াহা, আমজাদ হোসেন, সিরাজ সিকদার সহ অনেক শ্রেণিবিপ্লবী।

‘শিরদাঁড়ার এ পাশেই একটা আস্ত পিন ঢুকিয়ে দিলো একজন— আর এর পরেই ডান পায়ের দ্বিতীয় নখটা সরু সাঁড়াশি দিয়ে দুইজন উপড়াতে এগিয়ে এলো। বুক-পেট-চিরে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো বিশুর। না, সে বলবে না। অস্ত্রগুলো কোথায় আছে জানাবে না। একজন কমরেডের নামও তার কাছ থেকে শুনতে পারবে না তারা। পাপড়ি উঁচু করে মণিতে আলো ফেলা হলো। গরম পানি নাকের ভেতর দেয়া— সেটা তো প্রথম থেকেই শুরু। এই তিনবার রিমান্ডে এ- হেন নির্যাতন নেই যা তারা করেনি; পায়ুপথে গরম ডিম দেয়া থেকে শুরু করে সিলিংয়ে উল্টো করে ঝুলানো পর্যন্ত। এবার যেগুলো স্রেফ যন্ত্র দিয়ে হাতে-পায়ে ঘাড়ে আর মাথার বিভিন্ন শিরা সনাক্ত করে আঘাত করছে। যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাবার মতো অবস্থা বিশুর। তার মুখ ব্যথায় নীল হয়ে উঠলো! সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না, কুঁজো হয়ে ঝুঁকে গেল সামনে। মাথা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে নড়ছিলো। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বের হচ্ছিলো রক্ত; কখনও গল গল করে কখনও-বা ফোঁটা ফোঁটা! স্রষ্টায় অবিশ্বাসী বিশুর আর্তচিৎকার যে স্রষ্টার উপস্থিতি চাইলো! বিশুর মুখ বিকট চেহারায় ফুলে উঠে ঘাড় মাথা এলিয়ে পড়লো ডান কাঁধের ওপর। না, তবু সে বলবে না।’

(রক্তে যতো চিহ্ন)

শ্রেণিশত্রু খতমের বিপ্লবীদের কথনে উঠে-আসা দৃশ্য পাঁজরে দুটো গুলিতে চাঁদ আলী মারা যায় (বিডি মেম্বার আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেট) ছাপ্পান্ন হাজার একশো ছাব্বিশ বর্গমাইলে ‘৭০-এর আগস্ট, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণিশত্রু খতমের লাইনের প্রথম অ-লোক হলেন চাঁদ।

‘বাবলুর মনে বেশ ক্ষত আছে। সাতষট্টিতে কানু স্যান্নালের নকশালবাড়ি, আটষট্টিতে আমজাদ ভাইয়ের বিপ্লবের লাইন নিয়ে চিন্তা, পিকিং রেডিও বললো ভারতের বুকে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ দেশব্রতী পত্রিকা বড়ো ভূমিকা রাখলো; দম নিলো সে, বিপ্লব কীভাবে শুরু করবো, কেমন হবে, কৃষক বাহিনী গঠন হলো, জোতদার প্রধান আর কিছু সামন্তপ্রভূ খতম হলো ফলাফল কই?’

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবাদপ্রতিম কবি উৎপল কুমার বসু বলেছিলেন, পাঠকের আন্তরিক প্রতিক্রিয়া লেখককে সম্মানিত করে। লেখক-পাঠকের এই অন্তর্গত বিনিময় সাহিত্যের অপরিহার্য শর্ত। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের নিজকে নিয়ে, তাঁর সৃজনকর্ম নিয়ে কোনো আন্তরিকতার বাগাড়ম্বর নেই। সমাজের যে অংশটা কেবলই ক্ষুধার্ত আর নিয়ত অনাহার-জর্জর ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আপোসহীন পরিশ্রমী—তাদের ঘামের বিন্দু বিন্দু নোনা ঘ্রাণ লেখকের গল্প আখ্যানের উপজীব্য। কখনো শ্রেণি কিংবা সমাজ বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ-প্রয়াসী অদম্য তরুণেরা যখন অস্ত্র হাতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার উন্মূল মায়াজালে নিবিষ্টতায় তার জীবন উৎসর্গ করে, তখন শ্রেণিদ্বন্দ্বের অন্তর-বাহিরের প্রকট চেহারা, লেখকের গল্পপৃষ্ঠায় উন্মোচিত হয়।

বাক্যগঠনে অন্যতর পরিভাষা নির্মিত হয়। যেমন ঢালাই কারখানায় লোহা গলিয়ে নির্মিত ইস্পাতের দেয়াল। বোধগম্য ও অনিবার্য অর্থময়তার প্রয়োজনে একটি বাক্য থেকে কোনো শব্দকে বিভাজন করা যাবে না, টেনে নিতে হবে পুরো বাক্যটি। এই যে, শব্দের সাথে শব্দের নিকটবন্ধন—এটা সেলিম মোরশেদের গদ্যভাষার এক ভিন্নতর উপমান।

মাখন চায় তরুণী বাঘির উষ্ণতম সান্নিধ্য—যা বাঘি তার পরিবারের শ্রেণিগত অবস্থান বিবেচনায় মেনে নিতে পারে না। গল্পের ধারাভাষ্যে দেখা যায়, যখন বাঘির সাথে সরাসরি শোবার প্রস্তাব করে মাখন, তখন বাঘির সারা গায়ে তারাবাতি জ্বলে। বাঘির জবাব, ‘মা-বুনির সঙ্গে শো-গে’; বাঘির এমন তীব্র কঠিন জবাবে মাখন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং পরের দৃশ্যেই এ-রকম , ‘ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে হাড় ভাঙ্গা আর দাঁত খিচুনির শব্দ। গ্রামবাসীরা জেগে ওঠে। তৈয়ব মিয়ার দুই ডজন মুরগীর অর্ধেক জবাই করা আর অর্ধেক মাথা মোচড়ানো।’ কথক চৌকিদারের বর্ণনায় সংগঠিত এরকম অবিশ্বাস্য কাজের বর্ণনা শুনে গ্রামবাসীরা মৃদু চিৎকারে তাদের বিস্ময় ও আতঙ্ক প্রকাশ করে। দ্বিতীয় ঘটনাটি পূর্বটিকে আরো শক্তিশালী করে সারা গ্রামে উচ্চারিত হতে থাকে। ওবায়েদ মোল্লা—যাকে সবাই রুগ্ণ ফকির বলে, তার ক্ষুদ্র আতরের দোকানের পেছন থেকে চাটাই কেটে ঢুকে শিশিগুলো টুকরো টুকরো করে ভাঙা হয়েছে। ধারণা করা সংগত—তৈয়ব মিয়ার মেয়ে বাঘির তীব্র কটুক্তিতে মাখন ক্ষিপ্ত হয়ে এসব কাণ্ড ঘটিয়েছে, যা গল্পে কথিত হয়নি কিন্তু পাঠককে ধারণায় যেতে হবে। এর পরই দৃশ্য মোচড় নেয় ইতিহাসের ধারাক্রমে, যেমন ‘সাতচল্লিশ বলো একাত্তর বলো যা হবার হয়েছে। প্রেক্ষিত ছাড়া আর অন্য কিছু নেই। প্রেক্ষিতকে গুরুত্ব দিতে হয়। আমরা সেটা কখনো বুঝতে চাই না।’ গল্পকথনে উঠে আসে ‘৪৭ সালে অসমভাবে দেশভাগ, মাইগ্রেটেড জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব-সংকট ইত্যাদি, বহু স্তরের গদ্য-ভাষায় স্থাপনা মাটির উদর হতে ঊর্ধ্বমুখী তুঙ্গে প্রসারিত নির্মাণশৈলী। এমত বিস্তারে ডালপালা বৃক্ষকোটর পত্রালির চিরুনিসদৃশ অবয়ব—যা পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয় সমাজের অসাম্য বৈষম্যের শেকড় কত গভীরে লেখক হাতের রং-তুলিতে এঁকে যাচ্ছেন বহু বর্ণিল আল্পনা সরোদ।

লেখকের ধ্যানমগ্ন চিন্তার প্রসারণ হতে ভেসে ওঠে ইতিহাসের নানা ধারা বর্ণপাত, যেমন খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ অব্দে সাইরাস কর্তৃক এশিয়া মাইনর, ব্যাবিলনিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন বিজয়। ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের স্থাপনকর্তা সম্রাট নেবুসাদ নেজার। অলিম্পিয়া পাহাড়ের ত্রিশ ফুট উচুঁতে কিডিয়াস কর্তৃক নির্মিত জিউস-মূর্তি। সম্রাট আলেকজান্ডার, তাঁর পিতা মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপ, বিশ্ব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি হ্যানিবল, মিশরের দ্বাদশ টলেমি’র কন্যা রানি ক্লিওপেট্রা, সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এবং গল্পকথনে দেখা যায় ‘১৮৪৮ সালে দু’জন জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস মিলে রচিত কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো, যার শেষাংশে রয়েছে—শেকল ছাড়া শ্রমিকদের হারাবার কিছু নেই। জয়ের জন্য আছে সারা বিশ্ব। দুনিয়ার মজদুর এক হও!’ ইত্যকার তথ্যবলি।

‘ইতিহাসের চল্লিশ হাজার বছরের খেরো খাতা দিলীপ দেবনাথের পর্যবেক্ষণে।’
শ্রেণিশত্রু খতমের তরুণ বিপ্লবীদের নিজস্ব অভিব্যক্তিতে নিদারুণ সংশয়। কমিউনিস্টদের বিভ্রান্তিতে লেখকের পর্যবেক্ষণ এ রকম ‘একটা ফিউডাল পিউরিটি থেকে সবাই স্যাক্রিফাইস সেল করা শুরু করেছে। তো দরকার শুধু সায়েন্টিফিকেল মরালিটি। তিনি দাঁত চাপলেন। বিড়বিড় করলেন। যেখানে দরকার বিজ্ঞানমনস্ক বাস্তবভিত্তিক নৈতিকতা, সেখানে সামন্ত শুদ্ধতা নিয়ে পুঁজিবাদের সঙ্গে লড়াই করা ভুল, একদম ভুল।’

বিজ্ঞান যেখানে নিরীক্ষিত সত্য ছাড়া কোনো ধারণাকে মেনে নেয় না তেমন জীবনবাস্তবতার জটিল মানদণ্ড পাঠকের সামনে বহমান হয় লেখকের গল্পের স্রোতে।
বিংশ শতকের সেরা চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো বলেছেন, Everyone wants to understand art, why not try to understand the songs of a bird? Why does one love the night, flowers, everything around one, we thought try to understand them?
ছবি বুঝতে চায় সবাই, কেউ কি পাখির কলতানের অর্থ, রাত্রির নীরবতা, গভীর নির্জনতা কিংবা, ফুলের সৌরভের অর্থ খুঁজতে চায়? তাই পিকাসো বলেছেন, আমার চিত্রকলা মোটেই বিমূর্ত নয়। বিমূর্ত বা Abstract Art বলে কিছু নেই। সেলিম মোরশেদ-এর কথাসাহিত্য তাই পরাবাস্তব নয়, বাস্তব শুধুমাত্র তাঁর সৃজনকর্ম অন্বেষণের পথ দেখানোর চেষ্টা।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!