

সেলিম মোরশেদ: রক্ত যার চরিত্র
এমন কদাচিৎ ঘটে,—হঠাৎ উপলব্ধিতে আসে, রক্ত ক্রমশ একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। আর তা ক্রমাগত ভিজিয়ে চলেছে ব্যক্তি এবং ব্যক্তিচক্রকে। তেমন এক চরিত্রেরই মুখোমুখি হই আমরা ‘সাপলুডু খেলা’র উপান্তে। এরকম ঘটে,— কেননা সুরেন্দ্রনাথ রোডের মাঝামাঝি স্থানে যার অফিস, প্রতিটি ‘কী করিতে হইবে’ ঠিক করতে গিয়ে যে সংখ্যাতত্ত্বের সুলুকসন্ধান করে, কিন্তু ফের অনুসন্ধিৎসুতার ঝড়ো হাওয়ায় মুখ আনত করতে বাধ্য করে সামনে থাকা প্রত্যেককে, পিছু ফিরে তাকাতে তাকাতেই যে ফের বাড়ির পথে হাঁটে, সেই সলোমানের গন্তব্যহীনতার বিষাদে আমাদের ভরিয়ে দিতেই বোধকরি রক্তকে ক্রমশ একটি চরিত্র হয়ে উঠতে হয় এ উপন্যাসে।
সেলিম মোরশেদের এই ‘সাপলুডু খেলা’ আমাদের কাছে আসে প্রথম ২০০১ সালে। এর প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা এ উপন্যাসের দিকে ফিরে তাকাতে পারি সেই প্রথম উৎসুক্য নিয়েই। আশির দশকে লিটল ম্যাগহীন বাংলাদেশে অনেক লিটল ম্যাগের স্রোতে সেলিম মোরশেদদের প্রচেষ্টা ছিল, লিটল ম্যাগকে একটি আন্দোলনের আদল দেয়ার, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যাত্রাপথকে আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার, মূল্যায়ন ও পুনঃমূল্যায়ন করার। হাতেগোণা যে কয়েকজন লেখক বাংলাদেশে এখনও লিটল ম্যাগ ছাড়া অন্য কোনো প্রকাশনায় লেখেন না সেলিম মোরশেদ তাদের অন্যতম। অবশ্য লিটল ম্যাগের সংজ্ঞা নিয়ে যে তপ্ত-উত্তপ্ত আলোচনা ও বিতর্ক ছিল আশির দশকে, নব্বই থেকেই তা ঠাণ্ডা হতে শুরু করে এবং নতুন শতাব্দীতে এসে কোনো ধরনের মীমাংসা কিংবা উপসংহার ছাড়াই লিটল ম্যাগ গোষ্ঠীগুলো শান্তিপূর্ণভাবে বছরে অন্তত একবার সম্মিলিত হতে শুরু করে বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রাঙ্গণে। কোনো কোনোটি পরিণত হয় কার্যত বার্ষিক প্রকাশনাতে। নতুন এই শতাব্দীতে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতার ক্ষেত্র হিসেবে কর্পোরেট মুখপত্রসমূহের চেয়ে যখন লিটল ম্যাগেরই মূল মুখপত্র হয়ে ওঠার কথা ছিল, তখন তা ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্বাদু ও বিজ্ঞাপনজীবী কাগজ হিসেবে উন্মোচিত হতে।
তা যা হোক, সেসব ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেলিম মোরশেদ লিটল ম্যাগে লিখেছেন, না কোথায় লিখেছেন,— তা-ও শেষ পর্যন্ত বড় প্রসঙ্গ নয়। বড় বিষয় হল তিনি লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন। আশির দশকে যে কয়েকজন হাতেগোণা উজ্জ্বল লেখক আমাদের সঞ্চয়ে রয়েছেন, সেলিম মোরশেদ তাঁদের অন্যতম। একবার এক জাতীয় পত্রিকা তাঁর একটি গল্প পুনর্মুদ্রিত করায় তিনি তাঁর লিটল ম্যাগ-বন্ধুদের কাছে সমালোচিত হয়েছিলেন। এ নিয়ে তিনি নিজেও দীর্ঘদিন গ্লানিবোধে ভুগেছেন,— জানতে পারি তাঁর নিজেরই ভাষ্যে, ‘সাপলুডু খেলা’র দ্বিতীয় সংস্করণের ‘মুকাদ্দিমা’য়। গ্লানিবোধে ভুগলেও এ নিয়ে তাঁর নিজেরই মূল্যায়ন, ‘যারা প্রতিবাদ করেছিলো যত না নীতিসাপেক্ষে তার চেয়ে লেখা সমাদৃত হবার আশংকাও তাদের ছিলো।’ তাদের সেই ‘আশংকা’ যে সত্যি হয়েছে, তা বোধহয় লেখার অপেক্ষা রাখে না। শুধু গল্প আর ‘সাপলুডু খেলা’ উপন্যাস নয়, পরে সেলিম মোরশেদ ত্রয়ী উপন্যাসও লিখেছেন; কিন্তু ‘সাপলুডু খেলা’ এখনও স্বমহিমায় পাঠকের চিন্তার রাজ্যে ভাস্বর হয়ে আছে এবং প্রায় দুই দশক পরেও এ বইটির কথা মনে করতে হয়।
এর একটি কারণ হতে পারে, সেলিম মোরশেদের এ লেখার টেক্সট এবং ন্যারেশন। চিত্রকল্পের রূপায়ণেও সেলিম যে ভিন্ন চিন্তা জাগাতে চান, তেমনটাও মনে হয় হঠাৎ-হঠাৎ করে। এই ভিন্নতা তাঁর সচেতন প্রচেষ্টার ফসল হলেও হতে পারে, কিন্তু আমাদের—পাঠকের দিক থেকে অবচেতনেই তাঁর টেক্সট ও ন্যারেশন তেমন চিত্রকল্প জাগিয়ে তোলে। বৃষ্টির নানারকম চিত্রকল্পই আমাদের জানা হয়েছে, কিন্তু সেলিম মোরশেদ যখন বলেন, ‘বৃষ্টি ছিলো বেশ শক্তসমর্থ’, আমাদের সামনে ঝমঝমানো বৃষ্টির পুরনো চিত্রকল্পটিই নতুন হয়ে দেখা দেয়। যদিও তখন তাতে মনোরম নির্জনতা থাকে না। কিংবা ধরা যাক, তিনি যখন বলেন, ‘বাস্তবতা দাঁতে আটা’, তাতেও বাস্তবতার উদ্ভাসন ঘটে নতুন করে। কিংবা নারীন যখন বলে সলোমানকে ‘ভ্রাম্যমাণ প্রবন্ধ’, তা শুধু গভীর সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন কৌতুকেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বিচিত্র স্যুরিয়ালিস্টিক চিত্রকল্পও সৃষ্টি করে। সেলিমের এমন চিত্রকল্পগুলোকে কখনও বিচ্ছিন্নভাবে উঠে-আসা মনে হয় না, সচেতনভাবে সৃষ্টি-করা বলে মনে হয় না, কষ্টকল্পিতও মনে হয় না; কিন্তু বলতেই হবে, নতুন লাগে। একটি শব্দের একাধিক প্রতিশব্দকে আমরা যেমন নেড়েচেড়ে দেখি, ভালো লাগা না-লাগার সম্ভাব্যতাগুলো যাচাই করি, সেলিম তেমনি অসংখ্য প্রতিচিত্রকল্প তুলে দেন আমাদের পাঠাভ্যাসের জগতে ‘সাপলুডু খেলা’র মধ্য দিয়ে।
সেলিম মোরশেদ লিটল ম্যাগে লিখেছেন, না কোথায় লিখেছেন,— তা-ও শেষ পর্যন্ত বড় প্রসঙ্গ নয়। বড় বিষয় হল তিনি লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন। আশির দশকে যে কয়েকজন হাতেগোণা উজ্জ্বল লেখক আমাদের সঞ্চয়ে রয়েছেন, সেলিম মোরশেদ তাঁদের অন্যতম।
কিন্তু কত দিক থেকে, কত ভাবে দেখতে পারি আমরা সেলিম মোরশেদের ‘সাপলুডু খেলা’কে? অনেকে যেমন মনে করেন, এই নভেলা’র প্রধান চরিত্র সলোমানে ছাপ পড়েছে আসলে সেলিম মোরশেদেরই, সলোমান আসলে সেমোরই প্রতিকৃতি, তাই বা কতটুকু নির্ভরযোগ্য ভাষ্য? হতে পারে, সলোমানের ওপর হয়তো ছাপ রয়েছে তাঁর, কিন্তু এ-ও তো সত্য, একটি উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই আসলে লেখকের অনুকৃতি, প্রতিটি চরিত্রই আবার লেখকের প্রত্যাখ্যাত চরিতদর্শন। প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এটি সাধারণ সত্য,— চারপাশ থেকেই ব্যক্তি আসলে নানা স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত থাকে, আক্রান্ত হয়ে চলে— এ কোনো নতুন বিষয় নয়; নতুন যা তা হল, নতুন সময়ের নিরিখে ব্যক্তির মধ্যকার সেই স্ববিরোধিতাকে, অসংখ্য স্ববিরোধিতার সহাবস্থানকে এবং বিস্ফোরোন্মুখ দ্বন্দ্বাত্মক প্রকাশকে কিংবা অন্তর্লীন দ্বন্দ্বাত্মক বিলীয়মানতাকে নতুন করে উদ্ঘাটন করা যায় কি না। আসলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের জীবনেই এমন সময় কিংবা ক্ষণ আসে না যে তার স্ববিরোধিতা প্রকাশের সুযোগ পাবে। উপসর্গহীন কোভিড-১৯-এর মতো ব্যক্তির অসংখ্য স্ববিরোধিতা নিজের মধ্যেই জন্ম নেয়, নিজের মধ্যেই মরে যায়, নিজের মধ্যেই শুশ্রূষা খুঁজে পায় একদিন। ব্যক্তির চারপাশ, রাজনীতি, সমাজ, ব্যক্তিক সম্পর্ক, এসবই তাকে বাধ্য করে সেই পথে হাঁটতে। সেলিম মোরশেদ যদি না-থাকতেন, যদি না-লিখতেন, তা হলে সলোমানও তেমনই এক ব্যক্তির মতো কালের অতলে হারিয়ে যেত, সলোমানকেও একজন নির্লিপ্ত, শান্ত, প্রশ্নহীন, দ্বন্দ্বহীন, বৈপরীত্যহীন মানুষই মনে হত আমাদের। কিন্তু সেলিম মোরশেদের প্রবল নিরীক্ষণের চোখই আমাদের সামনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে সলোমানের পরস্পরনির্ভরশীল বৈপরীত্যকে। বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়ে তার একটি বাঁচিয়ে রেখেছে আরেকটিকে। এই সলোমনের আছে প্রবল অনুসন্ধিৎসুতা, আছে প্রবল ভাগ্যনির্ভরতা। আছে টালমাটাল এক নিজস্ব জগৎ, আছে ছুটে যাওয়ার মতো বহির্জগৎ। তার পরস্পরবিরোধী দুই প্রবণতার মধ্যে কোনটা যে কখন তার শক্তি হয়ে ওঠে, কোনটা যে কখন তার দুর্বলতা হয়ে ওঠে, তা আমাদের জানা থাকে না; প্রবল এক আকর্ষণে তাই আমরা এগিয়ে যাই তার দিকে, সেলিম মোরশেদের পিছে পিছে, অনুসরণ করি তাঁর সলোমনকে আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কারের প্রকল্পকে। জীবিকার জন্যে একটি পত্রিকার ওপর নির্ভরশীল সলোমান, মাঝেমধ্যে হয়তো তা জীবিকার চেয়েও একটু অধিক, প্রতিনিয়ত বাদ-বিসম্বাদের মধ্য দিয়ে নিজেকে সে চালিত করে দূর থেকে দূরতর পথে; অথচ সে কি না কথোপকথন আর বাদানুবাদ-শেষে বন্ধুরা চলে গেলে তাদের সম্পর্কে এমন চিন্তা করে, ‘আবেগ তীব্র-তীক্ষ্ণ, মমতা-ক্ষোভ এতো বেশি, ক্রিয়া এতো বেশি, কারণ কৃষিমন। কৌশল এরা সহ্য করে না। অন্তর্গত পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত চিন্তা নিয়ে যারা বিরোধের সূত্রগুলো ঘাটাঘাটি করে প্রচার করে—এদের কাছে তারা বিশ্বস্ততা হারায়। অবিরত।’ চারপাশকে অবিরত প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে যে মানুষটি এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় খেয়াল করে, সব কিছু সম্পর্কে একধরনের সিদ্ধান্তেও পৌঁছায়, তাকেই দেখি ভবিষ্যতের কম-বেশি সব কার্যক্রমের দিন-তারিখকে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে যাচাই করে নিতে। সলোমানের বিশাল চিন্তার জগৎ এভাবে বার বার সংখ্যাতত্ত্বের ঘেরাটোপে বন্দি হয়, আবার সেই ঘেরাটোপ পেরিয়ে যাত্রা করে বিরাট এক পৃথিবীতে, সে পৃথিবী বড় হোক বা না-হোক, চকিতে বার বার অসহায়ও হয়ে পড়তে দেখি আমরা তাকে। ভয় আর অসহায়তার মধ্যে প্রবল এক দূরত্ব আছে, যা আমরা অনেক সময়ই হারিয়ে ফেলি; কিন্তু সলোমনের এই অসহায়তা সুস্পষ্টভাবেই ভয় থেকে যোজন যোজন দূরের। এই দূরত্ব চোখে পড়ার মতো বলেই যেন হঠাৎ আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কেন সে এত অনুসন্ধিৎসু? অসহায় বলে কি? অসহায়ই-বা কেন সে? তার নিজস্ব ভুবন তো খুব ছোট বলে মনে হয় না। সেখানে টুশি নামের একটি ছোট্ট মেয়ে আছে কিংবা নেই, টুশির মা সালমা আছে কিংবা নেই, বন্ধু বেন কিংবা নারীন আছে অথবা নেই; কেউ থাকুক বা না থাকুক, প্রতিদিন অথবা যেন-বা প্রতিমুহূর্তেই তাদের কথা ভাবতে হয় সলোমনকে। এসবের পাশে আছে তার পত্রিকা— তাকে প্রতিদিন যাচাই করে দেখতে হয়, কোন রিপোর্ট যাবে, সম্পাদকীয়তে ঠিক কী থাকবে, সেই সম্পাদকীয় কে লিখবে কিংবা লেজার প্রিন্টারের নতুন টোনার আনা হল কি না, পিএস প্লেট এসেছে কি না, এসবও তো তাকেই চিন্তা করতে হয়। বেন গ্রেফতার হয়ে গেছে, নিজের অসহায়ত্বটুকুও উপলব্ধি করতে হয় তাকে দাঁত চেপে। বেনের ইন্টারোগেশন যেন তার নিজেরই ইন্টারোগেশন হয়ে ওঠে। সাপকে কল্পিত নিয়তি বানিয়ে তার ভয় আর সৌন্দর্য দেখা থেকে সলোমানও কি তখন বিরত থাকে নিজেকে আত্মস্থ করার প্রচেষ্টায়?
কাহিনির শুরুতেই আমাদের জানা হয়ে যায়, সংখ্যাতত্ত্বের ওপর ভীষণ আস্থা সলোমনের। পিলারের বাল্ব দুটি জ্বালিয়ে দিতে পরের দিন পাওয়ার হাউস থেকে সরকারি লোক আসবে, সহকারীর কাছ থেকে এ কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে হিসাব করে দেখে সে পরদিন ২৬ তারিখ, অর্থাৎ দুই আর ছয় যোগ করবে তার মান দাঁড়ায় আট; কিংবা পরদিন ২৭ তারিখের মান দাঁড়ায় নয়। কিন্তু আট তো পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়ার মতো সংখ্যা, যেমন নয় হল অন্ধকারে উগ্র হয়ে ওঠার সংখ্যা। টুশিকে তার মনে হয় কিঞ্চি দেমা, পরিবার নামক প্রজন্ম নামের শিল্পের প্রয়োজনেও সংখ্যাতত্ত্বের কাছে ফিরতে দেখি সলোমানকে— ‘টুশির জন্মতারিখ ৫ই মার্চ। মীন রাশির জাতিকা টুশির নিয়ন্ত্রিত গ্রহ বুধ। বুধের সংখ্যা ৫। টুশির জন্মতারিখও ৫। পাঁচে পাঁচে পাশাপাশি যুক্ত হয়ে দশ হয়ে এক। এক এবং পাঁচ। একটি এমারেল্ড, সঙ্গে একটি রুবী।’ এমন বিবেচনাবোধ বার বার আক্রান্ত করে সলোমানকে, যে সলোমানকে চিনতে বোধহয় কষ্ট লাগে, তাকে হয়তো অসহায় কৌতুককরও লাগে তখন।
কাহিনির শুরুতেই আমাদের জানা হয়ে যায়, সংখ্যাতত্ত্বের ওপর ভীষণ আস্থা সলোমনের। পিলারের বাল্ব দুটি জ্বালিয়ে দিতে পরের দিন পাওয়ার হাউস থেকে সরকারি লোক আসবে, সহকারীর কাছ থেকে এ কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে হিসাব করে দেখে সে পরদিন ২৬ তারিখ, অর্থাৎ দুই আর ছয় যোগ করবে তার মান দাঁড়ায় আট; কিংবা পরদিন ২৭ তারিখের মান দাঁড়ায় নয়। কিন্তু আট তো পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়ার মতো সংখ্যা, যেমন নয় হল অন্ধকারে উগ্র হয়ে ওঠার সংখ্যা।
এমনসব বিবেচনা করে যে সালমান, তাকেই দেখা যায় আবার এই চিন্তা করতে যে, রাষ্ট্র এখন ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে আর সেক্যুলারিজমের অর্থকে করে তুলছে বিকৃত। সময় এখন রাষ্ট্রের চরিত্রকে ভালো করে, নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করার। বন্ধু ও সহকর্মী বেনের সঙ্গে সে যুক্তি-পরামর্শ করছে, এই নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার হতে পারে, সম্পাদকীয় হতে পারে আগামী পরশুদিন। রাষ্ট্র আর ধর্মতন্ত্রকে নিয়ে ভাবা হচ্ছে বলেই ‘সাপলুডু খেলা’র কালপর্বকে ধর্মবাদী শক্তির উদযাপনপর্ব ভাবার কারণ নেই। আবার ধর্মবাদের আস্ফালনকে একেবারে হালকা করে দেখারও কারণ নেই। বস্তুত সলোমন যখন শৈশবে, তখন থেকেই এই ধর্মবাদ এক অদৃশ্য দুষ্টক্ষত হয়ে উপস্থিত হয় তার জীবনে। শৈশবে পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তার কাছে ‘বিষম আনন্দের’; এই বিষম আনন্দ যে কী, তা সহজেই টের পান পাঠক, সলোমনদের বাড়ির মধ্যে অকস্মাৎ ঢুকে পড়েন মাসুদ ডাক্তার এমএলএফ। সলোমনের বোনের নাম জানতে চান তিনি, নাম ‘শাহানা সুলতানা রত্না’ শুনে প্রশ্ন করেন, রত্না কেন? শাহানা সুলতানা তো সুন্দর নাম।‘ প্রশ্নের পর প্রশ্ন, নাকি রীতিমতো উত্যক্ত করে মাসুদ ডাক্তার সলোমনের বাবার কাছ থেকে তার কলিগদের নিয়ে শেষবার মঞ্চস্থ করা নাটকের লেখকের নাম জানতে চান। পড়তে পড়তে আমরা বুঝতে পারি, লেখকের নাম ‘কল্যাণ মিত্র’ বলতে বলতে সলোমনের বাবা পুণ্য নিশ্চয়ই শঙ্কিত হয়ে উঠছেন। আর সেই শঙ্কার ষোলো আনাই পূর্ণ হয়ে ওঠে যখন মাসুদ ডাক্তার নিজেই বলতে থাকেন, ‘পুণ্য ভাই, সিরাজুল ইসলাম নামে আপনি ততোটা পরিচিত না; আপনার ছোটো ভাইয়ের নাম প্রফুল্ল, আগেই বলি লজ্জা দেবার জন্যে বলছি না, ঈদের নামাজ ছাড়া টুপি মাথায় কেউ আপনাকে দেখেনি।‘ কিন্তু এসব ঘটনা নেহাৎ ‘বিষম আনন্দের’ শৈশবের বলেই কি সলোমন অনেক পরে তার নৈঃসঙ্গের সঙ্গী কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে সংশয়-উৎকণ্ঠা, খুন হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক আর ভারসাম্যহীনতাকে ঠিক ধরতে পারে না? বিষ্ণু’র আতঙ্ককে তার কাছে মনে হয় ‘কাফকা কিংবা জীবনানন্দীয় শিল্প দেখা’, মনে হয় ‘বিষ্ণু জাতীয়তাবাদী এক নেত্রীকে পছন্দ করতে পারছেন না?’ বিষ্ণুর উন্মূল ও নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনা সলোমানের স্মৃতিতে চকিতে ফিরে আসা ছোট কিন্তু নির্বাচিত একটি ঘটনা; ক্ষুদ্র কিন্তু খুবই দাগ কেটে যাওয়া ভয়ঙ্করও বটে। কেননা সলোমান একা-একাই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে, কার্যকারণ খুঁজতে খুঁজতে সে সেগুলোর প্রতিটিকেই পারিপার্শ্বিক নানা সম্পাদ্য ও উপপাদ্য দিয়ে নাকচ করতে থাকে, ‘…বিষ্ণু বিশ্বাস তার চতুষ্পার্শ্ব থেকে যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছিলেন এমনকি ছোটো কাগজের সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ তাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। শিল্পী-লেখকরা ভালোবাসতেন তাকে। সেক্ষেত্রে এই মাইনরিটি কমপ্লেক্স থাকার কথা না, কিন্তু তা সাধারণ সত্য, নির্ধারিত সত্যটা এইরকম, বিষ্ণু বিশ্বাস শোয়েব শাদাবের মতোন ছাপ্পান্ন হাজার একশ’ ছাব্বিশ বর্গমাইলের ভেতর ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকতে পারলেন না। দায়ী তিনি কাকে করবেন? সুলতান মাহমুদকে, বখতিয়ার-ঔরঙ্গজেবকে, সলিমুল্লাহ-জিন্নাহকে, না সুরেন্দ্রনাথ-বা নেহেরুকে— না ব্রাহ্মণ্যবাদকে নাকি নিজেকে দায়ী করবেন?’ সাধারণ সত্য আর নির্ধারিত সত্য,— সত্যের এমন বিভক্তিপঞ্জি থাকার পরও চকিতে আমাদের কারও কারও মনে ফিরে আসতে পারে, সলোমনের বিষম আনন্দের সেই শৈশবের কথা, যখন নিজের ধর্মের মানুষের কাছে থেকেই সিরাজুল ইসলাম পুণ্য মাইনরিটি কমপ্লেক্সের বেদনা আর আতঙ্ক অর্জন করেছিলেন। সেই কমপ্লেক্সকে যদি সলোমানি অবচেতনে ধারণ করতে পারতো, তাহলে হয়ত সলোমানকে ‘ফেনাগুলো বাঁচিয়ে পিঙনারে বিয়ার ঢালতে হত না। অথবা ঢাললেও সেই ফেনায় আর বিয়ারে সে খুঁজে পেত অন্য কোনো আস্বাদ, ভারমুক্ত পবিত্র স্মৃতির আস্বাদ। নাকি তখনও সে চিন্তা করে, ‘মানুষের দুর্ভাগ্যগুলো নানা রঙের আর সব সৌভাগ্যের রঙ একটাই?’
সলোমান এই উপন্যাসে শৈশবেও ফিরে যায়, অবগাহন করে নতুন করে নীতার সঙ্গে কাটানো অপাপবিদ্ধ দিনগুলোয়, যে কোনো শৈশবের মতোই সলোমানের এই শৈশব ঝঞ্ঝামুখর সময়ের হওয়ার পরও মোহনীয় কাব্যিক; সলোমান নিজেই যেমন করে ভাবে, ‘দাঁত মুক্তোর মতো বিচ্ছুরিত, ডালিমদানার নৈপুণ্যে এক, আর দানার রঙ চুনিপাথরের, চুনি ওয়ার্লেস স্টেশনের আলোকবিন্দুসম, আর আমি যেন তার নির্জন প্রতিবিম্ব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সম্পর্কিত এই আমার শনাক্তকৃত মনোজগৎ।’ এমন এক শৈশবময় সলোমানকে পূর্ণরূপে আমরা দেখি এরশাদের সামরিক শাসন-উত্তর কালপর্বে। সলোমান বেশ কয়েকবার ফুরিয়ে যাওয়া ফোনকার্ড ফেলে দেয়, আমাদের জানা হয় না কার বা ঠিক কার কার সঙ্গে কথা বলেছিল সে, তবে অবচেতনে এই কথা মনে হয়, ফোনকার্ড বুথের দেখা পেয়েছিলাম আমরা ওই সময়েই। সলোমান আর বেনের মধ্যে কথা হয় তপ্ত-উত্তপ্ত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল নিয়ে, চকিতে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আরমান সিকদার ওরফে এরশাদ সিকদারের নাম, বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে বেন বলে সলোমনকে, ‘আরমান সিকদারকে এখন বড় অপরাধী করে দেখা হচ্ছে, অথচ এতগুলো খুন একসঙ্গে তো লোকটা করেনি, পুরো দেশটাই তখন নিশ্চুপ ছিলো, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কতটা হলে এরা ধরা পড়তে দেরি করে আর ধরা পড়ে কখন? কুলির ছেলে যখন কোটিপতি হিসেবে স্বীকৃতি চায়।‘ এই দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল, কখনো থেমে-থেমে, কখনো-বা না থেমেই হয়ে ওঠা দেশের অস্থিতিশীল অঞ্চল,— গোপন রাজনীতি, মাদকের ব্যবসা, চিংড়ির ঘের ব্যবসা আবার মানুষের মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে ওঠার নির্ঘুম এক নীরব সাধনা, সব কিছু মিলেমিশে এই এলাকার কি রাজনৈতিক, কি মনস্তাত্ত্বিক, কি ভৌগোলিক— সব বিন্যাসই জটিল। কিন্তু ‘সাপলুডু খেলা’র সমানুপাতে, ব্যক্তি সালমানের চেতনার সমানুপাতে সেই বিন্যাস হয়ে ওঠে জটিল থেকে জটিলতর। ব্যক্তি সালমান এক দূরযাত্রায় ক্রমধাবমান, কিন্তু কী করে সে গন্তব্যের দিকে এগোবে রাজনৈতিকতা, ধর্মবাদিতার সংঘাত, সংখ্যাতত্ত্ব এসবের গূঢ় জটিলতা এড়িয়ে?
সেলিম মোরশেদের সলোমানকে তাই রক্তাক্ত হতে হয়, কি ভেতরে, কি বাইরে। বিংশ শতাব্দীর উপান্তে, সব আদর্শই যখন ক্ষয়ে পড়ছে, কারো মধ্যেই নেই আর মুক্ত হওয়ার জন্যে হৃদয়ের অন্তর্তল থেকে জেগে ওঠা মরিয়া বাসনা, আছে বড়জোর ত্যাগী হয়ে ওঠার স্মৃতিচারণ,— তখনও সলোমান ভাবে, ভাবতে ভাবতে নিজের রুগ্নতা আর অসহায়তাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে, ‘মার্কসের এ-কথা সত্য, … মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে না, মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।‘’ এইভাবে সলোমান যে ফোনের অপরপ্রান্তের কারও সঙ্গে কথায় মেতে ওঠে, মনে হয় সে যেন নিয়ত কেন্দ্র থেকে প্রান্ত অবধি বিস্তৃত এক জটিল বিন্যাসের সংলাপে, সেই দূর অতীতের গ্রিসের ইতিহাসের মতো প্রকাণ্ড অথচ সমসময়ের রাজনীতি-দর্শনের গূঢ় এক বিতর্কে; কিন্তু সে রক্তাক্ত হয় এবং রক্তই একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। ফোনবুথের বাইরের লোকজন দীর্ঘক্ষণ ধরে বুথের মধ্যে সংলাপে-বিতর্কে মগ্ন সলোমানকে অযথাই এত সময় ধরে কথা বলায় উত্তেজিত হয়ে রক্তাক্ত করার পর আবিষ্কার করে, ফোনটি আসলে ডেড, তাতে কোনো ডায়ালটোনই নেই। তখন উত্তেজিত, অপেক্ষারত ব্যক্তিরা আবার নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, তাদের তো জানাই ছিল ফোনটি ডেড, কিন্তু ভেতরে লোকটিকে দেখেই তো তারা কথা বলার জন্যে সার ধরে দাঁড়িয়েছিল! এইভাবে জনপ্রবণতার বিস্ময়কর অথচ এই ভূখণ্ডের নিরিখে স্বাভাবিক একটি আদল আমাদের সামনে নতুন করে নির্মাণ করেন সেমো (ফমা নয়, সেআদী নয়, আমা নয়,— সেমো); যা বার বার আমাদের কত শত নিরীহ ও ভীরু চেহারার দুর্বল প্রকৃতির মানুষকে মৃত্যুর ঘরে-দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে কখনো পকেটমার হিসেবে, কখনো ছেলেধরা হিসেবে, কখনো ডাকাত বা ছিনতাইকারী হিসেবে। রক্তাক্ত সলোমানকে আমরা দেখি টলতে টলতে দুই হাঁটুর ওপর ভর করে কোনোমতে উঠতে উঠতে বলছে, ‘ডায়ালটোন নেই, তাকে কী? প্রতিক্রিয়া চাচ্ছেন কেন প্রথমেই, আপনার কথাটা বলে যান, দেখেন, ঠিক শুনে যাবে, যতদূরেই হোক-না কেন, যার কাছে বলবেন, দেখবেন সে ঠিক জেনে যাবে’ — এই যে একাগ্রতা, কত বৈপরীত্য আর দ্বন্দ্ব থাকার পরও মনের কোনো এক গহনের চিরবিশ্বাস,— আধ্যাত্মবাদ বলে কি সে সম্পর্কে আমরা সংশয়াচ্ছন্নই থেকে যাই!
কিন্তু অর্জন বা উপসংহারের মতো কিছু একটা যদি ভাবতে হয় সলোমানের জীবনের, তা বোধকরি এই-ই এবং সে সম্পর্কে সলোমানকে বেশ সচেতনই মনে হয়। কেননা এতকিছুর পরও সে স্পষ্টভাবে মনে করতে পারে রক্তের কাজ, ভাবতে পারে শরীরের ভেতরকার প্রায় ৭৫ হাজার মাইল রক্তপ্রবাহের নালিপথের যেখানে রক্তপাত সেখানেই ছুটে যায় অনুচক্রিকার দল, স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে অনুপস্থিত ফিব্রিন কণা কোত্থেকে এসে দ্রুত ভরাট করে ফেলে ফাঁক। চারপাশে সে একটা নয়, দুটো নয়, ৩৫০ টি সলোমানকে দেখে— যাদের ৩৪৯ জন একদিকে আর কেবল একজন আরেকদিকে। এভাবেই কেন্দ্র ও প্রান্ত একত্রিত, আবার বিভাজিতও। রিং অব সলোমান এক, তাকে ঘিরে আবর্তিত ৩৪৯—এইভাবে সলোমানকে ছাপিয়ে কিংবা সলোমানের ক্যাটালিস্ট সকল চরিত্রকে ছাপিয়ে, এমনকি লেখককে ছাপিয়েও যেন রক্ত একটি চরিত্র হয়ে ওঠে এবং আশ্বস্ত করে কি সেলিম মোরশেদকে, কি পাঠককে। নারীনের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে সলোমান যে বলেছিল, ‘শিল্প আমার কাছে (কনশাস!) অ্যাফার্ট আর এই সচেতনতার অনেক প্রমাণ, আমি চাই, সারা গা জুড়ে থাক’, মনে হয় সেরকম সব সমূহ সচেতনতা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে চান সেলিম মোরশেদ তাঁর সলোমানকে দিয়ে, ‘সাপলডু খেলা’ খেলে। বোধকরি, এত যে বৈপরীত্য, এত যে দ্বন্দ্ব সবই সারা গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সচেতনতার অনেক প্রমাণ, তবুও যা অন্তঃক্ষরণের রক্ততে ডুবু-ডুবু।
১ আষাঢ় ১৪২৭, ১৫ জুন ২০২০ সোমবার