

ছোটকাগজের সেলিম মোরশেদ: জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পপথের নিঃসঙ্গ কথাকোবিদ
লেখাটির শিরোনামে বিশেষণের প্রয়োগ অকারণে ঘটেনি। বেশ প্রস্তুতি নিয়েই আশির দশকের অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদকে (১৯৬২) নিয়ে লিখতে বসেছি। যখন এটি লিখছি, তখন অন্য কোনো লেখা বা কাজের চাপ মাথায় রাখিনি। আসলে অন্য কাজ থেকে নির্ভার না হলে এই প্রাতিস্বিক শিল্পকারিগরের ব্যাপারে লেখার সাহস পেতাম না। এ অভিজ্ঞতা তো এবারই প্রথম নয়! এ লেখার পরবর্তী পর্যায়ে যে প্রসঙ্গে আলোকপাত করব — ‘কান্নাঘর’ (২০২০, পরানকথা) নামক তাঁর চতুর্থ গল্পসংকলন প্রকাশের অভিজ্ঞতা থেকেই এ উপলব্ধি হয়েছে। সেলিম মোরশেদের লেখা পড়তে হলে পাঠককে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বসতে হয়। নিবিড় মনোনিবেশে পড়তে গিয়ে তিনি ক্রমশ বুঝতে পারেন — তাঁর লেখা, লেখায় প্রতিফলিত বক্তব্য, বক্তব্য অনুধাবনের ভঙ্গি আর লেখাটি পাঠের প্রতিক্রিয়া মোটেই গতানুগতিক নয়। কিছুটা বুঝতে পারা, কিছুটা অস্পষ্টতা, সেইসঙ্গে ভাষাগত প্রকৌশল ক্ষেত্রবিশেষে ভাষিক স্থাপত্য নির্মাণ ও কূটাভাস মিলেমিশে পুরো প্রক্রিয়াটি জটিল ও অভিনব। কাজেই এক টানে এক বসায় তাড়াহুড়ো করে লেখাটিতে চোখ বুলিয়ে যাওয়া আর গড় গড় করে পড়ে ফেলা — এমন ব্যাপার এক্ষেত্রে একেবারেই নেই। ফলে পাঠককে সময় নিতেই হবে। আর এর একাধিক পাঠও জরুরি, নিজের বোধে লেখাটির অনুরণনগত মিথস্ক্রিয়াকে স্পষ্ট করতে। নইলে হয়্তো লেখাটি এক বৈঠকে তিনি পড়ে উঠবেন, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারবেন না, পঠিত গল্পটির বক্তব্য তাঁর বোধে যথার্থই স্পষ্ট হয়েছে কি না। এক বৈঠকে এক টানে পড়ে একবারেই বুঝে ফেলা পাঠকের জন্য সেলিম মোরশেদ লেখেননি কখনো। তার মানে, হরে-দরে লিখিত লেখা পড়তে অভ্যস্ত পাঠকদের থেকে কোটি যোজন দূরে সরিয়ে রাখার মতো লক্ষ্মণরেখা টেনেই তিনি লিখতে বসেন। এর মানে এই নয় যে সেলিম মোরশেদের লেখা দুর্বোধ্য বা দূরান্বয় দোষে দুষ্ট বা পাঠকের কাছে নিজেকে আড়াল করার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রচেষ্টা তিনি বিবিধ কৌশলে লেখায় গ্রন্থিত করেন। এমনকি তাঁর লেখায় বক্তব্য কখনো অতিকথন, পুনরাবৃত্তি, দার্শনিক অর্থারোপের কৃত্রিমতায় কণ্টকিত নয়।
তবে কেন সচেতন পাঠককে বার বার ভাবতে, অধিক সময় নিতে, আগের ভাবনাকে খারিজ করে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুনঃপাঠের সুযোগ তিনি দেন? কারণ তিনি স্পষ্টতই সুনির্দিষ্ট সাহিত্যিক দায়বদ্ধতা থেকে লেখার অনুপ্রেরণা ও বিষয়কে অবলম্বন করে তবেই লিখতে বসেন। আর যখন তিনি একটি লেখা লিখে ওঠেন, তাতে বুনে দেন এর নেপথ্যে ক্রিয়াশীল সামাজিক-রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলভুক্ত নানা প্রসঙ্গ ও তথ্যাদি। ফলে লেখাটিতে কালের ইশারা, শৈল্পিক ব্যঞ্জনা ও অর্থদ্যোতকতার সঞ্চার ঘটে। একে নিছক লেখকের কারুকৌশল বলব না। এ আসলে ভাষা-কারিগরের সঙ্গে জীবনশিল্পীর অদ্বৈত সংযোগের নির্মাণপ্রকৌশলগত প্ল্যাটফর্ম। তাঁর গল্প বা উপন্যাস পড়তে শুরু করলে পাঠককে শুরুতেই মনোযোগ দিতে হয়। এই মনোযোগ আসে, আসতে বাধ্য হয় বক্তব্য অনুধাবনে। কারণ তিনি সরাসরি বক্তব্য উপস্থাপনের রীতিতে বীতশ্রদ্ধ। তাঁর লেখায় তথ্য ও বিবরণ যুক্ত হয় নির্দিষ্ট ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কুশীলব ও তাদের সংলাপে, মনস্তত্ত্বের বয়ানে। সবটা মিলে পাঠক যেটুকু বুঝে উঠতে পারেন, এর সঙ্গে আরেকটি ব্যাপারকে আয়ত্ত করতে হয়। সেটি হল লেখকের গদ্যরীতি। সহজবোধ্য নয় তা, অথচ প্রাঞ্জল ও গভীর অর্থবোধক। ফলে পাঠকের কাছে তা কখনো হয়তো কঠিন মনে হয়। কিন্তু পাঠ না-থামিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে পারলে ধীরে ধীরে লেখার আলোতে বিচ্ছুরিত অর্থ তাকে স্বস্তি দেয়। বাক্যগঠনের বৈচিত্র্য, ঘটনাক্রমের বিন্যাস, চরিত্রের রূপায়ণগত স্বকীয়তা আর লেখাটির অন্তর্গত অভিপ্রায় — গুপ্ত সংকেতের মতো এসব প্রসঙ্গকে পাথেয় করে পাঠযাত্রায় এগিয়ে যেতে পারলে এতে বার বার স্বকীয় অর্থ বুঝে ওঠার যথার্থ সুযোগ থাকে। এ গুণ শুধু জাত লেখকেরই আয়ত্তাধীন। সেলিম মোরশেদ নিঃসন্দেহে সেই গুণে গুণী কথাকোবিদ; যদিও লেখার জগতে এ পথ তাঁরই নির্মিত এবং এক্ষেত্রে তিনি নিঃসঙ্গ স্থপতি। যোগ্যতা, পরিশ্রম, ধৈর্য ও শিল্পসংযমের এমন মণিকাঞ্চনযোগ তাঁর কালে বিরল।
২.
‘কান্নাঘর’ সংকলনভুক্ত আটটি গল্পের মধ্যে ‘অপরাচিত্ত’ ছাড়া অন্য গল্পগুলো ইতঃপূর্বে অন্য গ্রন্থে সংকলিত হলেও সেগুলো বাজারে নেই। ফলে এ সংকলন পাঠকদের গল্পগুলো পাঠের সুযোগ করে দিয়েছে। গল্পগুলোর যে ধরন ও গড়ন সেলিম মোরশেদের লেখার স্বকীয়তাকে চিহ্নিত করে, সে বিষয়ে এখানে সংক্ষেপে কিছু কথা বলব। আসলে, ‘কান্নাঘর’ সম্পর্কে আলাদাভাবে প্রবন্ধ লেখার পরিকল্পনা করেছি বলে এখানে বিশদ আলোচনার সুযোগ নেই। প্রথম গল্প ‘সখিচান’ পড়লে পাঠক বুঝবেন, পৈতৃকসূত্রে ডোম আর সরকারি চাকরিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ঝাড়ুদার সখিচানের ব্যক্তিজীবন ও পরিবারের সদস্যদের যে চালচিত্র এ গল্পে বিধৃত, এটি আসলে এ গল্পের রঙ্গমঞ্চ। এখানে মানবজীবনের যে অনিবার্য সত্যকে লেখক অসামান্যভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা হল ‘মহামুহূর্ত’ সৃষ্টির অভিপ্রায়। কোনটি সেই মহামুহূর্ত, যা বয়ানের জন্য লেখককে পনেরো পৃষ্ঠার গল্পটি লিখতে হল? মৃত্যু কীভাবে ব্যক্তির অন্তিম পথযাত্রার সঙ্গী হয় আর ব্যাপারটি কতটা অনিবার্য অথচ স্বাভাবিকভাবে কারো জীবনপরিক্রমাকে আকস্মিকভাবেই থামিয়ে দেয়౼ সেটিই এ গল্পের কেন্দ্রীয় ভাবসত্য। গল্পের প্রথম লাইনটিতে ‘হাসপাতালের লাইটপোস্টের ওপর একটা রাতজাগা পাখি, শীতে।’ আর শেষ লাইনটি ‘কাল সকালে তাকে মর্গে যেতে হবে — সখিচান ভাবলো। মৃত্যুর নিশ্চিত পাঠে।’ যে সখিচানকে বিদায়-সম্বর্ধনা জানানো হবে সরকারি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পরিণামে, তাকেই পিতার কাছ থেকে হাত-পাকানো ডোমের কাজে আবার হাত লাগাতে হবে। কারণ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যে মৃত্যুবরণ করেছে, সে সখিচানেরই প্রধান শিষ্য গোবিন্দ। সখিচান ও তার স্ত্রী দুলারী এতিম গোবিন্দকে সন্তানস্নেহে প্রতিপালন করেছে। পরিণামে গোবিন্দ অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে সখিচানের সম্পর্কে সুযোগ বুঝে কুৎসা রটিয়ে। কিন্তু গল্পটি প্রতিশোধপরায়ণতা বা ঈর্ষাকাতরতামূলক নয়। বরং বিবিধ অনুষঙ্গে লেখক মানবজীবনের অন্তিম পরিণতি মৃত্যু সম্পর্কে সখিচানের মতো একজন প্রান্তিক মানুষের উপলব্ধি ও সংবেদনশীলতাকেই গল্পটিতে মূর্তময় করেছেন। অবশ্য এ প্রশ্ন পাঠকমনে জাগবে, গল্পটিতে ভারতবর্ষীয় পটভূমিতে মানবজীবন ও মৃত্যু-সম্পর্কিত যে দার্শনিক আবহকে সংযুক্ত করা হয়েছে, এর ফলে সখিচান চরিত্রটি বাস্তবের রক্ত-মাংসের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে লেখকেরই বক্তব্য প্রকাশের বাহন হয়ে ওঠে কি না। নৈর্ব্যক্তিকভাবে লেখকের অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ অবস্থানের জায়গাটিতে সখিচানের প্রতি তাঁর যে একচ্ছত্র মনোযোগ, তা গল্পে বিবিধভাবে বর্ণিত। কিন্তু এ গল্পের অসামান্য শক্তি সখিচান চরিত্রবয়ানে নয়। বরং অমোঘ মৃত্যুর রূপক হিসেবে রাতজাগা পাখিটিকে ধরার জন্য গোবিন্দের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের অনুপুঙ্খ বর্ণনায় লেখক যখন সখিচান, ফাল্গুনী, দুলালী ও স্বয়ং গোবিন্দের সমন্বিত দৃষ্টিকোণকে একটি বিন্দুতে সংহতভাবে উপস্থাপন করেন, সেই মুহূর্তটিই এ গল্পের আর যে কোনো মৌলিক গল্পের ‘মহামুহূর্ত’ সৃষ্টির অসামান্য দৃষ্টান্ত। গল্পটি পাঠের সুযোগ এ মুহূর্তে পাঠকের না-ও থাকতে পারে। তাই পাঠককে সংহত কৌশলময় অসামান্য বিবরণ পড়ার সুযোগ করে দিতে উদ্ধৃতিটি যুক্ত করছি।
‘দুলারী পাখিটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, রামপিয়ারীর এতো রং! ফাল্গুনী পাখিটাকে নিয়ে কল্পনার ঘোরে ছিলো; তার অনুভবে কোনো শাদা-রক্তের অদৃশ্য অতিশয় গন্ধ। … সখিচান দেখলো গোবিন্দ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে : একহাতে-দুপায়ে এবং শরীরটা দিয়ে পিলারটা ধরে ত্বরিত ওপরে এগিয়ে ক্ষিপ্রতায় অন্য হাতে পাখিটাকে ধরতে যাচ্ছে, সখিচান বাঁশিটা কোলের ওপর রেখে জানালাটা বন্ধ করে দিলো। আবার বাঁশিটা ঠোঁটে তুললো— কোনো স্পৃষ্টি-আর্তনাদের আগেই এক সুর উঠে এলো তার বাঁশিতে : পাখির পায়ের মতো তীক্ষ্ণ অথচ কোমল এমন সুর।
লাল আর ছাইরঙা পাখিটার অস্তিত্ব পুড়িয়ে দিচ্ছিলো শীতের সমস্ত নিরপেক্ষতা; পরম্পরায়।’
পাখির অস্তিত্ব পুড়ে গিয়ে লালচে আগুনের দাহে ছাইতে পরিণত হওয়ার ইঙ্গিত প্রকৃতপক্ষে সম্মোহিত গোবিন্দের অপরিণামদর্শিতারই নির্দেশক। সখিচানের প্রতি লেখকের পক্ষপাতের দৃষ্টান্ত এ উদ্ধৃতিতে বাঁশির প্রতীকে আভাসিত। যেন সখিচানের বাঁশির সুর আর রাতজাগা পাখিটির প্রতি গোবিন্দের সম্মোহন মিলেমিশে তার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আবহটিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ দৃষ্টান্তটি বাংলা ছোটগল্পে মহামুহূর্ত সৃষ্টির বিবেচনায় নিঃসন্দেহে প্রতিনিধিস্থানীয় মর্যাদায় উত্তীর্ণ।
‘চিতার অবশিষ্টাংশ’ পড়তে গেলে সচেতন পাঠকের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প ‘মহামায়া’ আর কমলকুমার মজমদারের প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র কথা স্মৃতিপটে জাগবে। এটি প্রকৃতপক্ষে নভেলেট। গল্পগ্রন্থে সংকলিত হলেও উপন্যাসিকার সমুদয় দৃষ্টান্ত এতে বিদ্যমান, আর গল্পের বৈশিষ্ট্যসমূহ এতে প্রায় বিলীয়মান। আঙ্গিকগত এ অভিমত উপস্থাপন বর্তমান আলোচনায় বাহুল্য বিধায় ইঙ্গিতটুকু জানানোর প্রয়োজন ছিল। ফরিদপুরের উলাপুরে রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলে আড়াই বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত চারশ বছরের পুরনো ‘কণিকা হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা স্বগীয় কানাইলাল দাসের মহাপ্রয়াণে স্মৃতিরক্ষার্থে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানের ভিত্তিপ্রস্তর’ গড়ে তোলা হয়েছে। এতে রয়েছে বেশ কিছু স্মৃতিসৌধ ও তিনটি মন্দির। গল্পকথক সাজাদের বিবরণে এতে উপস্থিত কুশীলব, যারা বিপুলা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জীবনপথ পরিক্রমার পরিণতিতে এখানে সমবেত হয়েছে, তাদের জীবনাখ্যান এতে বিধৃত। এরা হল পুরোহিত কার্তিকচন্দ্র হালদার, পিসিমা কালিদাসী, দিলীপকুমার সেন, লিলিরানী, পুষ্পরেনু, সাঈদা ও পারভীন। বিচিত্র জীবনান্বেষা ও অস্তিত্বসংগ্রামের তাগিদে শ্মশানপ্রাঙ্গণে উপস্থিত হলেও জীবনবৈরাগ্য তাদের মনোভূমিতে অনুপস্থিত। প্রিয়জনকে শোকে, কাতরতায়, বেদনার সাগরে ডুবিয়ে বন্ধনছিন্ন মানুষ শ্মশানের আগুনে পুড়ে ছাই হলেও এই মানুষগুলোর অন্তহীন জিজীবিষা ও মানবিক প্রত্যয় তাদের ইহলৌকিক জীবনার্থের পথে ছুটে চলারই ইঙ্গিতবহ।
তবে কেন সচেতন পাঠককে বারবার ভাবতে, অধিক সময় নিতে, আগের ভাবনাকে খারিজ করে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুনঃপাঠের সুযোগ তিনি দেন? কারণ তিনি স্পষ্টতই সুনির্দিষ্ট সাহিত্যিক দায়বদ্ধতা থেকে লেখার অনুপ্রেরণা ও বিষয়কে অবলম্বন করে তবেই লিখতে বসেন।
‘কাজলরেখা’ গল্পটিকে পাঠক অনায়াসেই নারীবাদী গল্পের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন, যদিও লেখক নির্দিষ্ট মতবাদ ও সাহিত্যাদর্শকে অবলম্বন করে গল্পটি লেখেননি বলেই ধারণা করা চলে। এতে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ‘কাজলরেখা’ পালাকে সংযুক্ত করা হয়েছে একালের শিক্ষিত, সচেতন, আপোসহীন নারীর আত্মপ্রত্যয় ও নির্ভীক মানসিকতা রূপায়ণের বিনির্মাণবাদী কৌশল অবলম্বনে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের দুই বোন সীমা ও কাজলের খণ্ডিত জীবনচিত্র এতে যথাক্রমে বিবৃত হয়েছে তাদের প্রেমিক রুম্মান ও আরেফিনের সঙ্গে সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার চালচিত্র বয়ানে। লেখক মধ্যযুগের সামন্ত মূল্যবোধ ও নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কের গড়নটিকে বিশ শতকের পুঁজিনির্ভর সমাজের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক মানসিকতার সঙ্গে প্রতিতুলনার অবকাশ দিয়েছেন পাঠককে, বিনির্মাণের আলোকে। সহোদরা হয়েও সীমা চরিত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত নারীর যে গতানুগতিক মূল্যবোধ, আপোস, নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কিত ভাবনা প্রভৃতি বিশেষভাবে প্রতিফলিত, কাজল তাকে অনায়াসে অতিক্রম করে যায়। রুম্মানের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জেনেও সীমা তাকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। কেননা ইতোমধ্যে তার বাবা মারা গেছে। অথচ তারই বোন হয়েও ঊনত্রিশ বছরের স্বাবলম্বী কাজল তার প্রেমিক, বয়সে চল্লিশের কোটার আরেফিনকে বিয়ে ছাড়াই তার ঔরসজাত সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে। আরেফিনের বহুগামিতা সম্পর্কে সে এক পর্যায়ে জেনেছিল। প্রেমিক হিসেবে বিবেচনা সত্ত্বেও কাজল তাকে স্বামীর মর্যাদা দেয়নি। অবিবাহিতা মা মেরির সন্তান যিশুর মতোই সে-ও দিব্যকে একজন ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে স্থিত হয়। গল্পটিতে নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।
‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পের বিশেষত্ব এখানে যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘চিহ্ন’তে যে গণসংহতি ও শ্রেণি-ব্যবধানমুক্ত সচেতনতার পরিচয় সাতচল্লিশ-পূর্বকালের পটভূমিতে নিপুণভাবে অঙ্কিত হয়েছিল, এ গল্পে সচেতন ও পড়ুয়া পাঠকের সেই স্মৃতি স্মরণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ সংক্ষিপ্ত পরিমণ্ডলে লেখক সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবায়নে দলের সঙ্গে বিরুদ্ধ রাষ্ট্রশক্তির সংঘাতের পরিচয় এতে তুলে ধরেছেন একনিষ্ঠ এক কর্মীর চরিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে। বিশু বিশ্বাস, যার বয়স চল্লিশ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হওয়ার পরিণামে যাকে এক ডজন খুন করতে হয়েছে, কর্মী হিসেবে যে বার বার দলের সম্মুখসারির নেতাদের সমুদয় নির্দেশ মেনে চলেছে এই আশাবাদ অবলম্বনে যে গ্রাম-নগর-রাষ্ট্র থেকে শ্রেণিশত্রু খতম করতে হবে। তবে তা বাস্তবায়নে স্বীয় অভিমত ও অভিজ্ঞতা নেতাদের কাছে উপস্থাপনের সুযোগ সে কখনো পায় না। শুধু সে নয়, তার মতো একনিষ্ঠ কর্মীরা এ কাজ করলে পরিণতিতে যে ‘সংশোধনবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল’ হিসেবে তাদের অভিযুক্ত করা হবে, তা অনুধাবন তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। পুঁজিবাদী সমাজে শেণিশত্রু খতমের কৌশল ও নীতি দলের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের সকলের নিকট মান্যতা না পেলে তা অন্তিমপর্যায়ে যে অস্ত্রবাজিতে পরিণত হয়, এ বীক্ষাই গল্পটির কেন্দ্রীয় ভাবসত্য। তিন দফা রিমান্ডে কাটিয়ে অশেষ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পর একপর্যায়ে সে কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে চাইলেও রাষ্ট্রনিয়োজিত প্রশাসনের প্রতিনিধি কালো পোশাকধারীর গুলিতে বিশুর জীবন মুখ থুবড়ে পড়ে। চার দেয়ালের বাইরে কদমের ডালে কোকিলের ডাকের প্রতীকে জীবনের আহবান বিশুকে তথাকথিত রাজনৈতিক আদর্শ ও সমাজতন্ত্রের মরীচিকা থেকে নিষ্কৃতি দেয়নি। এ উপলব্ধির ভাষ্যনির্মাণে লেখকের সচেতনতা ও শিল্পকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
‘লাবণ্য যেভাবে এগিয়ে’ গল্পটিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের বিনির্মাণবাদী শিল্পরূপ হিসেবে বিবেচনার ইঙ্গিত মেলে। ১৯২৭-১৯২৮ সালে ‘প্রবাসী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উপন্যাসটির সঙ্গে এ গল্পের কালিক পটভূমিগত ব্যবধান শতকের কাছাকাছি। স্বাভাবিকভাবেই দুজন লেখকের জীবনদৃষ্টি, কালিক পটভূমি ও পরিসর, সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পমেজাজ স্বতন্ত্র। প্রতি-তুলনার মাধ্যমে দুটি গল্প-উপন্যাসের বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনা এ লেখায় সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলা চলে, কলেজশিক্ষক লাবণ্যকে সেলিম মোরশেদ এমনভাবে গড়ে তুলেছেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথের গড়ে দোলা লাবণ্যের কায়া দূরের কথা, ছায়াটুক পর্যন্ত নেই। এ গল্পে অমিতের পাশ্চাত্যমুখী রুচি, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক আবহ ও মূল্যবোধকে লেখক রবীন্দ্রনাথের অমিতের সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণভাবেই গড়ে তুলেছেন এবং সেটি সম্ভবত তাঁর পরিকল্পিত ভাবনা। দুটি রচনা বিশ্লেষণ করলে পাঠকের এ অভিমত প্রকাশের পক্ষে বেশকিছু যুক্তি গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তবে লাবণ্য চরিত্রটিকে সেলিম মোরশেদ রবীন্দ্রমানসে নারীভাবনার প্রতিষ্ঠিত মডেল থেকে এক আছাড়ে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে সেই টুকরোগুলোকে নিজের মতো করে বিন্যস্ত করেছেন। সেলিম মোরশেদের গড়া লাবণ্যের ব্যক্তিত্বে, মননে, শরীরী চেতনায় ও যৌনভাবনায় উত্তরাধুনিক নারীভাবনার পরিচয় মেলে। সে ক্রমস্ফীত পুঁজিবাদী সমাজের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নিছক পণ্য ও ভোগের সামগ্রী হিসেবেও জীবনানন্দ দাশের কবিতার চরণ অনুযায়ী ‘স্থূল হাতে ব্যবহৃত, শুধু ব্যবহৃত’ হতে পারে। তার কামতাড়িত দীর্ঘ ফ্যান্টাসিতে একজন পুরুষ, প্রেমিক, স্বামীর প্রথাগত ধারণাকে অতিক্রম করে অজস্র পুরুষের কামনার অবলম্বন হয়ে ওঠার অভীপ্সা রয়েছে। লেসবিয়ান ভাবনা, ফ্যান্টাসিতে যথেচ্ছ যৌনতা ও নগ্নতাসূচক কামতাড়নার প্রাবল্য, নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রতি বিতৃষ্ণা ও আত্মরতি — একুশ শতকের বর্তমান জীবনবাস্তবতায় এসব প্রসঙ্গ পরিপার্শ্বে প্রতিবিম্বিত। এদিক থেকে লাবণ্যের জুড়ি মেলা ভার। অমিতকে ছাড়াও তার জীবনযাত্রা নিত্যদিন নিজস্ব অভিরুচি অনুযায়ী চলমান।
‘কান্নাঘর’ গল্পগ্রন্থের নামগ্রন্থ ‘কান্নাঘর’ সম্ভবত লেখকের সাংবাদিক-জীবনের অভিজ্ঞতাপুষ্ট লেখা। প্রান্তিক লোকধর্ম অনুসারী কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অধ্যাত্মভাবনা, জীবনাচার ও মানবিক আচরণ, সম্প্রদায়কেন্দ্রিক কৌমচেতনার রূপায়ণে বাংলা সাহিত্যে এ গল্পটি অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবনার ভিত্তি তথা লোকধর্মের আদর্শকে প্রাত্যহিক জীবনচর্যায় অনুসরণের রূপরেখা গল্পটিতে বিধৃত হয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে এ সম্প্রদায়ের জীবনাচারের স্বাতন্ত্র্য কীভাবে তাদের সংকটের মুখে ঠেলে দেয়, সেটি গল্পের তাৎপর্যবাহী প্রসঙ্গ। মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অনুসন্ধান সদবেনে গোষ্ঠীভুক্ত কর্তাভজাদের ধর্মচিন্তার মূল অবলম্বন। মানবপ্রেমে আস্থা পোষণের ঐকান্তিকতা তাদের সহজ-অনাড়ম্বর-স্বার্থচিন্তামুক্ত-বিভেদহীন দিনযাপনে অভ্যস্ত করে চলেছে কয়েকশো বছর ধরে। কিন্তু গল্পটিতে একপর্যায়ে বাঁক পরিবর্তন ঘটে, যার পরিণতিতে লেখক দেখান, যুগের ধারাবাহিকতায় ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিন্নধর্ম-মতাবলম্বী প্রতিনিধিদের দাপটে ও হঠকারিতায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের লালিত আদর্শ, মূল্যবোধ ও মানবভাবনায় ভাঙন ধরেছে। ভগবেনেদের দলপ্রধান বিজয় ঠাকুরের প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে আসমা দলীয় নির্দেশের বাইরে গিয়ে ডাক্তারের চিকিৎসা গ্রহণ করে। এর পরিণতিতে ছটাকে মোশারফ ও দেড় ব্যাটারির হুমকি প্রদান ও অর্থের বিনিময়ে সমঝোতার একপর্যায়ে নিত্যানন্দের তাদেরকে হত্যার মতো অতিনাটকীয় ঘটনা ঘটে। এ দুই শঠের হত্যাকারী হিসেবে নিত্যানন্দ আইনের বিবেচনায় অপরাধী হলেও পরিণামে সে-ই ভগবেনেদের দলপ্রধানের দায়িত্ব পায়, বিজয় ঠাকুরের স্ত্রী যশোদা’র অনুমোদনক্রমে। সদানন্দেরই এ ভূমিকা পালনের কথা ছিল। কিন্তু তার নিষ্ক্রিয়তার সমান্তরালে নিত্যানন্দের বীরত্ব ও পরিস্থিতিসাপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিণতিতে দল ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা পায়। তবে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অনুসারীদের আদর্শগত বিচ্যুতি ও পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিসরের সঙ্গে অভিযোজনের প্রাসঙ্গিকতাকেও লেখক এ গল্পে ইঙ্গিতবহ করেছেন।
‘আমি, মীরা ও সুশীলদা’ সেলিমের মোরশেদের লেখা গল্পগুলোর মধ্যে স্বকীয় মর্যাদার দাবিদার। এক সাক্ষাৎকারে (এ প্রবন্ধের লেখক গৃহীত) তিনি জানিয়েছেন, তাঁর ব্যক্তিজীবনের ছায়াপাত ঘটেছে, এমন গল্পের প্রতিনিধিত্বকারী হচ্ছে এ গল্পটি। এটি উত্তম পুরুষ নির্বাণের দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে যশোরের কাজিপুরের মুনশিবাড়ির দুই শতকের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান সিরাজুল ইসলামের একমাত্র ছেলে নির্বাণ গুপ্ত পড়ালেখায় ভালো ছাত্র হলেও তরুণ বয়সে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলে তাকে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয়। পাশাপাশি তার স্বভাবে অবদমনও প্রবলভাবেই পরিলক্ষিত হয়। স্বমেহনের পাশাপাশি ইদিপাস কমপ্লেক্সের শিকার নির্বাণ জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি আসক্ত, যা গল্পে বিস্তৃত বর্ণনায় রূপায়িত হয়েছে। পরিণত বয়সে মীরাকে ভালোবেসে সে বিয়ে করে। মীরা তার প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়ে এ সম্পর্ককে বিয়েতে উন্নীত করে। এমনকি দীর্ঘ দশ বছর সংসার যাপনের মাধ্যমে নির্বাণের পাশে থেকে তার মনোবিকারের উপশমে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। কিন্তু তবু নির্বাণের মানসিক বিকার থেকে মুক্তি ঘটেনি। মীরাকে মায়ের মতো বিবেচনা করে নিজেকে তার সন্তান হিসেবে কল্পনা করার পরিণতি নির্বাণের জন্য সুখকর হয়নি। সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা, অসংলগ্ন আচরণ ও সুস্থ-স্বাভাবিক দাম্পত্যসম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে না-পারার অক্ষমতায় মীরা তাকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। মীরা সংসারজীবনে নির্বাণের সুস্থতার জন্য যথাযথ স্ত্রীর দায়িত্ব আন্তরিকভাবে পালন করেছিল। কিন্তু নির্বাণের মানসিক সুস্থতা এতে ত্বরান্বিত হয়নি। জনৈক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে মীরার যমজ সন্তানের মা হওয়ার ব্যাপারটি নির্বাণকে ক্রমশ নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশেও ব্যক্তির অন্তর্গত অস্বাভাবিক প্রত্যাশা, কামনা, চাপ ও সংকটজনিত ভারসাম্যহীনতা পরিণামে তাকে যে মনোরোগীতে পরিণত করে, নির্বাণ চরিত্রটি এর দৃষ্টান্ত। আপাতদৃষ্টিতে সে স্বাভাবিক আচরণ করলেও প্রকৃতপক্ষে তার নৈঃসঙ্গ্য ও বিপর্যস্ত মানসিকতা বিভিন্নভাবেই তার পরিজনের কাছে, এমনকি নিজের কাছেও ধরা পড়ে। হারু ও সুশীলের মতো বন্ধু, পরিচিতজনের বন্ধুত্ব তাকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও ব্যক্তিমানুষের অনিকেত চেতনা তার অন্তর্লোকে রয়েই যায়। সুশীলের মৃত্যুতে তার নিস্তরঙ্গ অন্তর্লোকে জীবনবিমুখতার ইঙ্গিত মেলে। গল্পটিতে গল্পকথক নির্বাণের মাধ্যমে আধুনিক সমাজের শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিতুল্য নিঃসঙ্গ ব্যক্তিমানুষের ক্ষত-বিক্ষত চিত্তরূপকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘অপরাচিত্ত’ গল্পটি সেলিম মোরশেদের ভিন্নধর্মী গল্প, যার অবলম্বন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঢাকায় ২০১৩ সালে সংঘটিত আলোচিত জোড়াখুনের ঘটনা। পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও গৃহবধূ মায়ের একমাত্র মেয়ে, জোড়াখুনের আসামি ঐশীর বৃত্তান্ত এতে রূপায়িত হয়েছে। মূল ঘটনাটি এ গল্পে ভিন্ন নামে ও স্বকীয় অবয়বে প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তব ঘটনার সাহিত্যিক বিনির্মাণের বিবিধ রীতি এতে অনুসৃত হয়েছে। গল্পটিতে মূল ঘটনাকে পরিবর্তন করা হয়নি। এছাড়া সমগ্র ঘটনার অনুপুঙ্খ এ গল্পে তুলে আনার বদলে তিনি কৌশলে আরো কিছু ঘটনাকে সংযুক্ত করেছেন। সমগ্র ঘটনার একটানা বিবরণ বর্জন করে তিনি অনেকটা কোলাজধর্মী ভঙ্গিকে অবলম্বন করেছেন। এতে ‘মহাভারত’-এর গল্প, ‘শ্রীমদভগবৎ গীতা’-র গল্প, জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘হঠাৎ-মৃত’ প্রভৃতি সংযোজনের পাশাপাশি অধীর নামক চরিত্রটি, যে অটোরিকশাচালক হিসেবে পরিবারের চারজনের ব্যয়ভার নির্বাহে বাধ্যগত, তার বয়ানের মাধ্যমে বিপ্রতীপ আবহ লেখক সৃষ্টি করেছেন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তথা খুনি তরুণী সান্দ্রার সমান্তরালে। এই স্বকীয় সংযোজনের ফলে গল্পটির ভাবাবহ বৈচিত্র্যময় ও বিশিষ্ট মাত্রা পেয়েছে। ষড়রিপুর ভয়াবহ রূপায়ণ এ গল্পে যে অনিকেত-চেতনার সাক্ষ্য দেয়, এর সমান্তরালে এসব প্রসঙ্গ যুক্ত হওয়ায় এর সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে। তবে ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য ও আখ্যানের উল্লম্ফনধর্মিতা এ গল্পে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যা লেখকের প্রকৌশলভাবনার দৃষ্টান্ত হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
‘কান্নাঘর’ গল্পগ্রন্থের নামগ্রন্থ ‘কান্নাঘর’ সম্ভবত লেখকের সাংবাদিকজীবনের অভিজ্ঞতাপুষ্ট লেখা। প্রান্তিক লোকধর্ম অনুসারী কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অধ্যাত্মভাবনা, জীবনাচার ও মানবিক আচরণ, সম্প্রদায়কেন্দ্রিক কৌমচেতনার রূপায়ণে বাংলা সাহিত্যে এ গল্পটি অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবনার ভিত্তি তথা লোকধর্মের আদর্শকে প্রাত্যহিক জীবনচর্যায় অনুসরণের রূপরেখা গল্পটিতে বিধৃত হয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে এ সম্প্রদায়ের জীবনাচারের স্বাতন্ত্র্য কীভাবে তাদের সংকটের মুখে ঠেলে দেয়, সেটি গল্পের তাৎপর্যবাহী প্রসঙ্গ।
৩.
সেলিম মোরশেদ — নামটির সঙ্গে যে প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে যুক্ত, তা হচ্ছে বাংলাদেশের ছোটকাগজ আন্দোলনের তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব এবং এরই সূত্রযোগে তিনি রীতিমতো খড়গহস্ত — যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা সম্পর্কে। তিনি ‘স্বপ্নের সারসেরা’ (২০১০) নামে বাংলাদেশের ছোটকাগজ আন্দোলনের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে গ্রন্থটি সম্পাদন করেছেন, এতে তাঁর নিজের লেখাসহ বিবিধ লেখাতে ছোটকাগজ চর্চা ও ক্রমবিকাশের রূপরেখার পরিচয় প্রসঙ্গ রয়েছে। এর সঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করব আরো দুটি লেখার কথা। একটি হল ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ’ আর ‘অমায়িক খচ্চর’। বর্তমান প্রবন্ধে বাংলাদেশের ছোটকাগজ আন্দোলনের চারিত্র্য ও সেলিম মোরশেদের অবদান মূল্যায়নে আমি অগ্রসর হব না। অনুসন্ধিৎসু গবেষকের জন্য এটি নিঃসন্দেহে খুব প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। (ভবিষ্যতে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগ্রহ এখানেই জানিয়ে রাখি।) বিশেষ করে বাংলাদেশের আশির দশকের চারজন প্রতিনিধিস্থানীয় লেখক যেমন সেলিম মোরশেদ, শহীদুল জহির, নাসরীন জাহান ও সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ౼ এঁদের মধ্যে তিনিই একমাত্র লেখক, যিনি কখনো ছোটকাগজ ছাড়া অন্যত্র অদ্যাবধি লেখেননি। আর কুড়ি-বাইশের প্রথমযৌবনের উত্তাল দিনগুলোতে বিভিন্ন ছোটকাগজে গল্প লেখার মাধ্যমে যেভাবে সাহিত্যচর্চার পথটিকে নিজস্ব রীতিতে গড়ে তুলতে সোচ্চার হলেন; একটানা দশ বছর ধরে শুধু ছোটকাগজে লিখে হাত পাকিয়ে তবেই প্রথমবার বই প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন, তাঁর কাছে সৃষ্টিশীল লেখালেখি, ছোটকাগজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আর ব্যক্তিগত জীবনযাপনের মধ্যে ব্যবধান থাকেনি। ছোটকাগজ আন্দোলনের ইশতেহার প্রণয়ন, একে অবলম্বনপূর্বক সাহিত্যচর্চার গতিপ্রবাহ বজায় রাখা, তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারার কাগজ ও এর পৃষ্ঠপোষকদের ছায়ানুগ্রহে পরিপুষ্ট, আখের গোছানো লেখকদের রমরমা বাজারি লেখার সমান্তরালে সৃষ্টিশীল লেখা লিখে চলা ও তা টিকিয়ে রাখার সর্বব্যাপী প্রচেষ্টায় তিনি কাণ্ডারীর ভূমিকাই পালন করেছেন। শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক সংকট, লেখালেখির জগতে সমকালের অনেকের কৌলীন্যসূচক উচ্চাসনের পাঁয়তারা ও পকেট ভারী করার মতলবকে এড়িয়ে লেখাকে প্রাতিস্বিক অবস্থানে উন্নীত করার ঐকান্তিক সদিচ্ছা ও কর্মতৎপরতার পরিচয় তিনি বিভিন্ন ধরনের লেখায় দিয়েছেন। সংগঠক হিসেবে বিভিন্ন ছোটকাগজগুলোর সাহিত্যচর্চার অভিমুখকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়া, মুনাফালোভী-পণ্যপ্রচারক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা ও এদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত পত্রিকা-দৈনিকের তালিকাভুক্ত বাজারি লেখকদের বিরুদ্ধে সৃষ্টিশীল লেখার প্রতি আগ্রহী ও সচেষ্ট পরিশ্রমী তরুণ লেখকদের ছোটকাগজের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে তিনি বরাবর সামনের কাতারে থেকেছেন। আশির দশকের শুরু থেকে পরবর্তীকালে নিয়মিতভাবে তিনি লিখেছেন ‘গাণ্ডীব’, ‘অনিন্দ্য’, ‘সংবেদ’, ‘চর্যাপদ’, ‘প্রতিশিল্প’, ‘জংশন’ ও ‘সূর্যঘড়ি’ প্রভৃতি ছোটকাগজে। ছোটকাগজ আন্দোলনের সহযাত্রীদের নিয়ে তিনিই সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ আন্দোলনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সংকলন ‘স্বপ্নের সারসেরা’। দীর্ঘ চার দশক যাবত অজস্র তরুণ লেখকের লেখালেখি ও বই প্রকাশে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। কেননা, ছোটকাগজ আন্দোলনে লেখকমাত্রই কলম হাতে-তোলা সক্রিয় কর্মী। নিজেকে প্রমাণের তাগিদ তার প্রবল। আর লেখার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের সংকল্পে সে বলীয়ান বলেই তাকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়ার কাজটি তিনি স্বীয় সাহিত্যিক অবস্থান ও মতাদর্শ, সাহিত্যচর্চার উপযোগিতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে অনুধাবন করেছেন।
ছোটকাগজের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজের লেখালেখি ক্রমশ এগিয়ে নেবার পাশাপাশি উত্তরপ্রজন্মের তরুণ লিখিয়েদের লেখালেখিকে প্রকাশের সুযোগ করে দেয়াও তাঁর আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। তিনি ছোটকাগজের সাহিত্যচর্চার পথপরিক্রমায় নিঃসঙ্গ পথিক। কেননা, তাঁর সহযাত্রীদের অনেকেই একই পথে চলতে শুরু করেও দীর্ঘ সাহিত্যপথ পরিব্রাজনার নানা পর্যায়ে নানা ভাবে নানা কারণে সেই অবস্থান থেকে সরে গেছেন। একমাত্র তিনিই ছোটকাগজ ছাড়া অন্যত্র লিখলেন না, অটুট রাখলেন কাণ্ডারীর বজ্রকঠিন সংকল্প। কিন্তু এর পরিণাম সার্বিকভাবে তাঁর জন্য সদর্থক হয়নি। কেননা লেখক হিসেবে সেলিম মোরশেদের সততা, আদর্শগত অবস্থান কালের পরম্পরা অনুযায়ী সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে তাঁকে ক্রমশ একপাশে সরিয়ে দিয়েছে। এর ফলে তিনি লেখক হিসেবে ক্রমশ আড়ালে পড়ে গেছেন। বাজারে বইয়ের অনুপস্থিতিজনিত কারণে তাঁর লেখার পাঠকসংখ্যা কমেছে। নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে তাঁর লেখাকে উপস্থাপনের আন্তরিকতা আর তেমনভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং তাঁকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাজারি-মিডিয়ার চক্রান্তে প্রভাবিত পাঠকের মনোরঞ্জনকারী সস্তা ও চটুল ধারার লেখালেখি। কাজেই এবার আমরা ছোটকাগজ চর্চার আশির দশক থেকে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের পরিসরে বদলে যাওয়া সাহিত্যিক আবহ, বাজার, পাঠকের রুচি ও অভ্যাসে পরিবর্তন প্রভৃতি প্রসঙ্গে আলোকপাত করব। এরই সূত্র ধরে অনুধাবন করতে চাইব ‘মেঘচিলে’র এ যথোপযুক্ত উদ্যোগকে এবং ‘পরানকথা সাময়িকী’র সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার ইতিবৃত্ত সম্পর্কেও অবহিত হব।
বিজন অরণ্য সম্পাদিত ‘মেঘচিল’ নামের ওয়েবম্যাগ কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশের আয়োজন করেছে। এটি একটি তথ্য। কিন্তু এ তথ্যের অন্তরালে রয়েছে বিরাট ঘটনা, যা ছোটকাগজের চর্চা ও বিবর্তনের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত। ভেবে দেখা দরকার, একটি অনলাইন পোর্টাল এ আয়োজন করছে কেন? বাংলাদেশে বর্তমানে কি উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজ নেই, যারা এ আয়োজন করতে সমর্থ ও উদ্যোগী হতে পারে? নাকি কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের সঙ্গে ছোটকাগজের সম্পৃক্ততা ও তাঁর নিরীক্ষাধর্মী লেখাকেন্দ্রিক মূল্যায়নের আগ্রহ-অবকাশ নেই? তাঁর লেখাকে ছোটকাগজ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ কি আর তাৎপর্যপূর্ণ ভাবছেন না? নাকি যুগটাই এখন এমন যে কেউ কারো সম্পর্কে এ ধরনের আয়োজনের গরজ করে না! যা খুশি হোক, যে যা করে করুক, না-করে না করুক౼ এরকম দায়সারা, অন্তঃসারশূন্য চিন্তাও কি তাহলে একালে সাহিত্যাঙ্গনে রোপিত হয়েছে? নেতিবাচক জবাবই সম্ভবত মিলবে, এসব প্রশ্নের যুক্তিনিষ্ঠ অন্বেষণে। কেন?
প্রথমত, একুশ শতকের পরিবর্তিত বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রভাব, তথ্য-প্রযুক্তিগত অভাবনীয় আবিষ্কার, বিশেষত অন্তর্জালকেন্দ্রিক সুবিধাদিকে অস্বীকারের উপায় নেই বলে। এ নেটওয়ার্কের আওতায় গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক মানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক, ব্লগ, অনলাইন পোর্টাল, ওয়েবসাইট প্রভৃতিতে লেখালেখির ও তা সংরক্ষণের অভাবনীয় সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এছাড়া নিজের লেখা প্রকাশের আগ্রহ, অতি স্বল্প আর্থিক খরচ ও বহু পাঠকের কাছে লেখাকে দ্রুততম সময়ে প্রকাশ করার সুযোগ এতে রয়েছে। কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত এ নেটওয়ার্ক লেখকের বইকে পাণ্ডুলিপি থেকে দ্রুততম সময়ে ছাপিয়ে ফেলছে। এ কারণে কাগুজে বই ও পত্রিকা, ছোটকাগজের ব্যাপারে পাঠকের চাহিদা ও নির্ভরতা কমছে। ফলে আশির দশকে ছোটকাগজ আন্দোলন গড়ে তোলার যে পরিপ্রেক্ষিত, তা নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। কালের নিয়মেই পাঠকের কাছে নতুন যুগের নতুন ধাঁচের লেখা পড়ার আগ্রহ জাগে। ফলে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে লেখা প্রকাশে লেখককেই বরং উদ্যোগী হতে হয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ছোটকাগজের মাধ্যমে লেখা প্রকাশের যে চর্চা সেলিম মোরশেদ ও তাঁর সহযাত্রীরা চল্লিশ বছর আগে থেকে শুরু করেছিলেন, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগে এর বাঁক বিশ্বায়নের প্রভাবে ও চাপে বদলে গেছে।
দ্বিতীয়ত, মিডিয়ার রমরমা অবস্থা, প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য ও এর আগ্রাসনের দিকটি বিবেচনা করা যাক। সংখ্যাগরিষ্ঠ, নুয়ে থাকা গড়পরতা মানের লেখকেরা মিডিয়ার দৌরাত্ম্য, প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়াতে বাড়বাড়ন্ত হওয়ার সুযোগ লুফে নেয়। বৎসরব্যাপী বিভিন্ন সাহিত্যিক আয়োজন, বইমেলার আসর, পুরস্কার প্রদানের ঘটা, সংবর্ধনার বন্দোবস্ত, বিদ্বজ্জনের শংসাবচন শোনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ক্রেস্ট হাতে নিয়ে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক ঝলসানিতে নিজেকে তারা-নক্ষত্রতুল্য লেখক হিসেবে বিবেচনা — এসবই বাংলাদেশের সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের স্থূল উদাহরণ মাত্র। অমুককে দিয়ে বইয়ের ফ্ল্যাপে বা ভূমিকায় কিছু লিখিয়ে নেয়া বা তমুককে বইটি উৎসর্গ করা, এভাবেই চলছে পারস্পরিক তোয়াজ, পিঠ চাপরানি, বাহবা-র ফুলঝুরি, ফেসবুকে ‘অভিনন্দন’, ‘বাহ’ ‘ভালো’র বরমাল্য আর লেখক হিসেবে বিরল সম্মান অর্জনের নামে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা! ফলে সৃষ্টিশীল লেখকের লেখার মূল্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণের চেয়ে বরং বাজারি লেখকদের নিয়ে হইচইতে মেতে থাকতে পারলে কর্পোরেট পুঁজি দ্বারা প্রকাশিত ও প্রচারিত সস্তা, মনোরঞ্জনকারী লেখা সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছানো যায়। প্রচারযন্ত্রের নিত্যনতুন ছলাকলা, চটুল লেখা পাঠকের নিকট পৌঁছাতে একাধিক সংস্করণ প্রকাশ ও বাজারে বইয়ের সরবরাহ নিশ্চিত করা, পরিকল্পিত পাঁয়তারার মাধ্যমে সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকের লেখাকে বাজার থেকে হটিয়ে দেয়া ও কখনো ইঙ্গিতে, কখনো সরাসরি প্রচার করা যে, ওই লেখা বাহুল্য বিধায় পাঠকের কাছে এর কদর নেই — এরূপ প্রবণতাও সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষণীয়। আর এ কথা তো মানতেই হবে— পাঠক একালে বইয়ের দোকানে নানাকারণেই তেমন ঢুঁ মারে না। যদিও বা কালেভদ্রে সৃষ্টিশীল লেখকের কিছু উল্লেখযোগ্য বইয়ের ব্যাপারে তার আগ্রহ থাকে, তবু ছোটকাগজের প্রকাশনা থেকে প্রথম সংস্করণে কিছু বই প্রকাশিত হলেও এর পরবর্তী সংস্করণ আর তো হয়ে ওঠে না! দিন, মাস, বছর, যুগ পেরিয়ে পাঠক বই না পেলে কী করবে? সেই লেখক তো এভাবেই বিস্মৃত হতে থাকেন আর তাঁর পাঠকরাও অবশেষে বাণিজ্যিক ধারার সস্তা, মনমজানো লেখার দিকেই ছোটে! কেননা সাহিত্যবাজারে নতুন রঙে ঢংয়ে মোড়কে মুখোশে বাহারি লেখক ও ফানুসওড়ানো লেখার কমতি তো একালে নেই!
তৃতীয়ত, ছোটকাগজ আন্দোলনের কর্ণধার ও অনুসারীদের ভূমিকা সর্বদাই কি একই রকম থেকেছে? নাকি কোনোভাবে নিজের সামর্থ্যের পরিচয় সচেতন পাঠকের, সমালোচকদের নিকট তুলে ধরার পর তিনি ভোল পাল্টে ফেলেছেন? গা থেকে ঘষে ঘষে ছোটকাগজ সম্পর্কিত গন্ধ তুলে ফেলার প্রয়াস তো তার থাকবেই! বড় প্রকাশনা থেকে বই বের করা, পুরস্কার বগলদাবা করতে বাজারি সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে ওঠা, নিজেই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে লেখক পরিচিতিকে যত দ্রুত সম্ভব ছড়িয়ে দেয়া, বড় কাগজের সাময়িকী পাতায় হপ্তায়, মাসে, উৎসবকেন্দ্রিক বিশেষ আয়োজনে লেখার জন্য লালায়িত হওয়া, (কেননা নিজের নামটি তো এদের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছাতেই হবে) — এসবও কি বাংলাদেশের বর্তমান সাহিত্যিক বলয়ের প্রাসঙ্গিক চালচিত্রভুক্ত নয়! তদুপরি সস্তা অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশে সমাদৃত হবার বালখিল্যপনাকেই কি এড়ানো যায়, চাইলে! গেঁয়ো যোগী দেশে ভিখ পায় না যেহেতু, কাজেই বিদেশের খ্যাতি অর্জনের সুযোগ কেন হাতছাড়া করবে? নিজের লেখার জোরে দেশের পাঠকসমাজে সমাদর দূরের কথা, পরিচিতি না থাকলেই-বা কী! মিডিয়ার বদৌলতে এ ঘটনা প্রচার করিয়ে লাইমলাইটে আসার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা তো সচেতন পাঠকের নজর এড়ায় না। এর সঙ্গে যুক্ত করা যাক জন্মদিন পালনের ন্যাকামি! পঞ্চাশ বা ষাট জন্মদিন পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ তাঁকে কেউ স্মরণ করছে না ভেবে ব্যক্তিগতভাবে বা কাউকে বশীভূত করিয়ে জমকালো জন্মোৎসবের ঘটা, কোনোভাবে কাউকে বাগিয়ে নিজের নামে স্মরণসংখ্যা প্রকাশের জন্য বিভিন্ন জনকে দিয়ে স্তাবকতাতুল্য কিছু ফরমায়েশি লেখা লিখিয়ে নেবার অভিসন্ধিও তো সাম্প্রতিক অতীতে লক্ষ করা গেছে! দুর্বল, অপরিণত লেখককে এসব আয়োজনের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারলে লেখার মাধ্যমে নিজের, সমাজের, পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধ, সৎ লেখককে তো সাহিত্যিক পরিমণ্ডল থেকে হটিয়ে দেবার পথ প্রশস্ত হয়! কেননা তিনি তো নিজেকে অন্যদের থেকে বরাবর স্বতন্ত্র ভেবেই ‘ঝাকের কই’ ট্যাগটিকে অস্বীকার করেন! কাজেই তার জন্য কার মাথাব্যথা থাকবে! কেননা প্রবাদ আছে— ‘যার মাথা, তার ব্যথা’! এভাবেই তাঁকে একঘরে করে ফেলা হয়। আর সেই লেখকের বিরুদ্ধে অন্যদের দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে তাঁর পাঠককেও বিভ্রান্ত করা যায়!
মোটামুটি এই বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই ‘মেঘচিল’ এ কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত রয়েছে বলে আমি মনে করি। একজন সেলিম মোরশেদ বাংলা সাহিত্যে অনমনীয়, জেদি, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আপোসহীন ও আত্মসচেতন লেখকের প্রতিকৃতি হিসেবে নিজেকে গত চারটি দশক যাবত অবিচলভাবে ধরে রেখেছেন। তিনি ছোটকাগজে তরুণ প্রজন্মের লেখকদের লেখালেখির প্রচেষ্টাকে বরাবর উৎসাহিত করেছেন নিজের লেখা এতে প্রকাশের বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করে। এমনকি যে ছোটকাগজটি বিশাল আর্থিক দায় ও সাহিত্যিক অঙ্গীকারকে প্রকাশনার অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাকেই তিনি নিজের পাণ্ডুলিপিটি দিয়েছেন বই হিসেবে প্রকাশ করতে। এই যে ছোটকাগজ-কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার অনুশীলন, একে এগিয়ে নেবার সর্বতোমুখী প্রচেষ্টা, এমনকি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে এর সঙ্গে মিলিয়ে নেবার সামর্থ্য ও ঐকান্তিকতা, এমন দৃষ্টান্ত সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আর পাওয়া যায় না! ফলে ‘মেঘচিল’-এর এ আয়োজনকে সেলিম মোরশেদের লেখালেখির পারিতোষিক হিসেবে নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ সৃষ্টিশীল লেখকদের কাছে তাঁর ভূমিকা ও সাহিত্যিক অবস্থান বুঝে ওঠার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা যুক্তিসঙ্গত।
‘কান্নাঘর’ বাংলা ছোটগল্পের ধারায় বিশিষ্ট সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হবে। আশির দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের লেখা ও সাহিত্যচর্চার প্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন গল্প এ সংকলনে গ্রন্থিবদ্ধ হয়েছে।
৪.
আরেকটি বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত সে কারণেই প্রাসঙ্গিক হবে। সেটি হচ্ছে ‘পরানকথা সাময়িকী’ ও এ প্রকাশনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ত হবার আখ্যানটি। এমনকি ‘পরানকথা’ থেকে তাঁর চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘কান্নাঘর’ প্রকাশের ব্যাপারটিও হয়ত খানিকটা অবিশ্বাস্যই শোনাবে। বাংলাদেশে সৃষ্টিশীল সাহিত্যচর্চার জায়গাটি এখন এতটাই একপেশে, ক্লেদাক্ত, পক্ষপাতে দুষ্ট যে এখানে সেলিম মোরশেদের মতো কথাশিল্পীকে অনেকটা একঘরে করে দেয়ার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। অনেকেই তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্য, আন্তরিকতা, বিনয় ও দায়িত্ববোধকে নিছক নিজের স্বার্থোদ্ধারের জন্য হাতিয়ার করেছে। তাঁকে দিয়ে বইয়ের ভূমিকা লিখিয়ে নিয়েছে, বইটি সম্পর্কে আলোচনার জন্য বিভিন্ন আয়োজনের বন্দোবস্ত করেছে। তারা জানে, সেলিম মোরশেদের লেখার শক্তি ও স্বকীয়তা সম্পর্কে। কিন্তু কখনোই তাঁর লেখা মূল্যায়নের আন্তরিক গরজ তাদের হয়নি। এর বিশেষ কারণ এই, তিনিও এমন লেখক, যিনি কখনোই কারো কাছে নিজের লেখা সম্পর্কে শংসাবচন বা স্তুতির কাঙালপনা করেননি। সেই সচেতনতা ও জাত লেখকের অপরিমেয় সংযম না থাকলে তিনি ছোটকাগজ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বের ভূমিকা পালন ও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার জায়গা থেকে নিজের লেখার মান অদ্যাবধি ধরে রাখতে পারতেন না। স্বীকার করতেই হবে, পরিমিত লেখা ও এর অন্তর্গত শিল্পগুণ অটুট রাখতে তিনি অত্যন্ত সচেতন, সংহত ও অভিনিবিষ্ট লেখক। একজন মৌলিক লেখকের লেখায় যে স্বকীয়তা, নিজস্ব ভাবনা ও পরিশীলনের স্বাক্ষর প্রকাশিত হয় এর অন্তর্গত আধার ও আধেয়ের মণিকাঞ্চন-যোগে, তা আশির দশকের এই প্রতিনিধিত্বশীল লেখকের লেখার মূলধন।
‘পরানকথা সাময়িকী’ সম্পর্কে এ লেখায় বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে বলি, এটি বাংলা কথাশিল্প বিষয়ক সাময়িকী। শুরুতে ত্রৈমাসিক হিসেবে, পরবর্তী পর্যায়ে দ্বিমাসিক হিসেবে আমার সম্পাদনায় অদ্যাবধি এর তেরোটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এর ‘উদ্বোধনী সংখ্যা’ পাঠকের হাতে আসে। এ সংখ্যার জন্য সেলিম ভাইয়ের কাছে একটি গল্প চেয়েছিলাম, মোবাইলে ফোন করে। মনে পড়ছে, তিনি তখন পায়ের ব্যথায় অসুস্থ ছিলেন, ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন। আবার দ্রুতই যশোর চলে যাবেন, বলেছিলেন। এর পর অনেকদিন যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যে কথা হয়েছে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু লেখা দিতে পারেননি। নতুন উদ্যোগে তাঁর সঙ্গে আলাপ শুরু হয় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি। কারণ এর ১২তম খণ্ডটি ‘উত্তরাধুনিক গল্প সংখ্যা’ হিসেবে পরিকল্পিত হয়। আড়াই মাসের প্রস্তুতি নিয়ে এ আয়োজনের লেখক তালিকাটি নিজেই করি। এরপর উনার সঙ্গে যোগাযোগ করি, একটি গল্প এ আয়োজনের জন্য লেখার অনুরোধ জানিয়ে। তিনি পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে, বিশেষত আমার মনোনীত লেখকদের তালিকা দেখে বেশ খুশি হন এবং এতে গল্প দিতে সম্মতি জানান। সেলিম ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী আরো কয়েকজন লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁদের নিকট হতে নতুন তিনটি গল্প পেয়েছিলাম। এ সংখ্যাটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং গত বইমেলায় বাংলা একাডেমির ছোটকাগজ চত্বরের ‘পরানকথা সাময়িকী’র স্টল থেকে অনেকেই এটি সংগ্রহ করায় বর্তমানে এর সব কপি নিঃশেষিত।
সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথমবার দেখা হয় ০৬.০৭.২০১৭ তারিখ রাতে, কাঁটাবন মার্কেংটের দোতলায় ‘পুনশ্চ’ নামের দোকানে। উনার সঙ্গে সেদিন ছিলেন ‘সংবেদ’-এর প্রকাশক ও লেখক পারভেজ হোসেন। পারভেজ ভাইয়ের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে এই প্রথমবার দেখা হল। এত বড় লেখক, তাঁর সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে আমি মনে মনে কিছুটা শঙ্কিতই ছিলাম। কিন্তু তিনি স্বভাবসুলভ আন্তরিকতার গুণে লেখালেখি, ‘পরানকথা সাময়িকী’র ব্যাপারে কথাবার্তা বলায় ধীরে ধীরে আলাপের উপযোগী পরিবেশ গড়ে ওঠে। আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে তিনি দুটি বই উপহার দিয়ে বসেন। ‘সাপলুডু খেলা’ ও ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, দুটো বইয়েই শুভেচ্ছাবাণীসহ স্বাক্ষর করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বিনিময়মূল্য দিতে চাইলে একটি কথাই বলেছিলেন, আমি যেন বই দুটি পড়ি। এরপর আর এ নিয়ে কথা বলতে পারিনি। আলাপকালে তাঁকে জানিয়েছিলাম, ‘পরানকথা সাময়িকী’ আকারে বড় হলেও ছোটকাগজের মতোই সৃষ্টিশীল তরণ প্রজন্মের লেখালেখিকে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা এতে রয়েছে। এমনকি তাদের লেখা নিয়ে দুটি আলাদা সংখ্যাও ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কারণ প্রতিষ্ঠিত, পরিচিত, জনপ্রিয় লেখকদের লেখা তো বাজারের প্রায় সব সাহিত্যপত্রিকা ও দৈনিকের সাময়িকীতে, বিশেষ আয়োজনে ছাপা হয়ই। অন্যদিকে তরুণ লেখকদেরই লেখা প্রকাশে সবচেয়ে সংকটে পড়তে হয়। তবে লেখা পাঠালেই যে এতে লেখা ছাপা হয় না; বরং মান বিবেচনাই এক্ষেত্রে লেখা মনোনীত হবার প্রধান ও একমাত্র শর্ত, সেটিও আলাপে জানালাম। এর অর্থের যোগানের ব্যাপারেও তিনি জানতে চাইলেন। বললাম, মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগই প্রধান। তবে কিছু বিজ্ঞাপন নিতে হচ্ছে। কারণ সাময়িকীটিকে মানসম্মতভাবে, সুন্দর, পরিপাটি ও রুচিশীলভাবে বিন্যস্ত করতে যে বিপুল খরচ হয়, তা নির্বাহ করা আমার একার পক্ষে অসম্ভব। ফলে নিয়মিত প্রকাশিত একটি সাময়িকীর জন্য বিজ্ঞাপন গ্রহণ জরুরি। তবে কোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নিচ্ছি, সেটিও সেলিম ভাইকে জানালাম। ব্যাংকিং ও বীমাই মূলত, তবে ক্ষেত্রবিশেষে বই প্রকাশনা সংস্থার ও চা কোম্পানির বিজ্ঞাপন নিচ্ছিলাম, নিয়মিতভাবে এটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। সেই রাতে সরাসরি আলাপের পর থেকে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা ধীরে ধীরে আন্তরিক হয়ে উঠছিল।
‘পরানকথা’ থেকে আগামী এক বছরে বই প্রকাশের কোনো ভাবনাই তখন আমার ছিল না। তবে ভবিষ্যতে যে এ কাজে হাত দেব, তা জানতাম। অথচ ২২.১১.২০১৯ তারিখে নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটে সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে প্রথমবার সাহস করে তাঁকে বলেছিলাম, সম্ভব হলে তিনি যেন একটি পাণ্ডুলিপি আমাকে দেন, বই প্রকাশের জন্য। তিনি সেই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হননি। বলেছিলেন, ভেবে দেখবেন। তবে বইমেলা ২০২০-এ নতুন বই প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর তেমন গরজ ছিল না। তিনি বরং পরবর্তী বইমেলায় সেই বই প্রকাশের ব্যাপারে অভিমত জানিয়েছিলেন। আমি তাঁর কথা শুনে ভেবেছিলাম, আমার দিক থেকে যেহেতু তখন আগ্রহ ছিল, কাজেই পরিকল্পনাটি তাঁকে জানানো দরকার। কারণ তখন আমি আমার আলোচিত উপন্যাস এবং একইসঙ্গে ‘পরানকথা’ থেকে প্রকাশিত প্রথম বই ‘ঝড়ের আগে অথবা পরে’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং বইমেলা ২০২০ উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল কয়েকজন লেখকের বই প্রকাশের পরিকল্পনার ব্যাপারেও তাঁকে জানিয়েছিলাম। তিনি সবকিছু জেনে আমাকে বলেছিলেন, আমার পরিকল্পনা সম্পর্কে ভেবে দেখবেন। ব্যাপারটি যেভাবে, যত সহজে লিখছি, ঠিক তত সহজেই ঘটেনি। প্রথমবার আলাপের পর থেকে পরবর্তী ছয় মাসে সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার মোবাইলে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে বেশ কয়েকবার। শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে, কাঁটাবন মার্কেটে, কনকর্ড এম্পোরিয়ামে, আজিজ সুপার মার্কেটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জে, ক্লাবে ও গ্রন্থাগারে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বইমেলায় আমাদের বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে। নিজের লেখালেখি সম্পর্কে কখনো কখনো কিছু কথা তাঁকে বলেছি। পাশাপাশি ফেসবুকে বন্ধু হিসেবে আমার সম্পর্কে তিনি আরো ভালোভাবে জেনেছেন, ভেবেছেন নিশ্চয়ই আমার পরিকল্পনা সম্পর্কে! কখনো কখনো আমার চাকরি, শিক্ষকতা, লেখালেখি, বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা ও সমালোচনা, গবেষণার মতো ব্যাপারে অভিমত জানিয়েছি, তাঁর ভাবনাও জেনেছি। ‘পরানকথা’ ও ‘পরানকথা সাময়িকী’কে নিয়ে আমার ভাবনা, মানসম্মত লেখা প্রকাশের জন্য লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলাপ, এর প্রকাশ সম্পর্কিত বিবিধ ব্যস্ততা প্রভৃতি সম্পর্কে তিনি ক্রমশ জানছিলেন। ০৩.১১.২০১৯ তারিখে বিকেলে শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। এই দিনটির জন্য আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম। কারণ এর আগে কয়েকবারই উনার সঙ্গে দেখা হলেও ‘পরানকথা সাময়িকী’র কপি তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয়নি। এবার ‘উত্তরাধুনিক গল্প সংখ্যা ২০১৯-এর লেখক কপি সেলিম ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে পেরে আনন্দিত হয়েছিলাম। তিনি এ আয়োজনটি দেখে খুশি হয়েছিলেন। বিশেষ করে, উনার কালের ও পরবর্তীকালের বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের গল্প এ সংকলনে ছিল, যা উনাকে সন্তুষ্ট করেছিল। আমার ধারণা, পরবর্তীকালে ‘পরানকথা’ থেকে বই প্রকাশের ব্যাপারে তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাতে এ ঘটনাটির ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল।
২৪.১২.২০১৯ তারিখে তাঁর চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘কান্নাঘর’-এর পাণ্ডুলিপি আমার ই-মেইলে পাই। আমি খুব আনন্দিত ছিলাম। পাশাপাশি বেশ চাপও বোধ করছিলাম এ কারণে, স্বপ্ন যখন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, তখন মানসম্মতভাবে বইটি প্রকাশ করতে পারব তো! একে তো বইয়ের প্রকাশক হিসেবে আমি এ বছরই কাজ শুরু করেছি। তদুপরি বেশকিছু বই ‘পরানকথা’ থেকে প্রকাশের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছিলাম। ফলে আসন্ন বইমেলা উপলক্ষে বই প্রকাশের কাজে ভয়ানক ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু ‘কান্নাঘর’ প্রকাশে সেলিম ভাই খুব সাহায্য করেছেন। এর প্রচ্ছদ করা, সেটি ই-মেইলে আমাকে পাঠানো, বইটির বিভিন্ন ধাপের কাজ এগুলো সেই ব্যাপারে আনুষঙ্গিক নির্দেশনা দেয়া, বিবিধ সংশোধন, এমনকি একপর্যায়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই প্রেসে এসে সবকিছু দেখে-শুনে বুঝিয়ে দেয়ার কাজটিও করেছেন। পাণ্ডুলিপিতে কলম দিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে যুক্ত তথ্যাদি নিজ হাতে লিখে দিয়েছেন। ফলে কাজটি এগিয়েছে যথানিয়মে। বইটি যখন প্রেস থেকে হাতে পেলাম, তখন তিনি যশোরে। প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল, উনার হাতে তখনই এটি তুলে দিই। অবশেষে সেই ইচ্ছা বইমেলাতে পূর্ণতা পেয়েছিল।
একবার সেলিম ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘পরানকথা’র মতো একেবারেই নতুন একটি প্রকাশনা থেকে বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? তিনি জবাবে বলেছিলেন ‘তাশরিকের জন্য’। এটুকুই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য, তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে। বইমেলার মাঝামাঝি সময়ে এটি পাঠকদের হাতে আসে। ‘কান্নাঘর’ গ্রন্থভুক্ত আটটি গল্পের প্রতিটি পড়েই লেখকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। অভিমত জানিয়েছি, এমনকি গল্পগুলো পড়ার ব্যাপারে তাঁর অভিমতকেও প্রাসঙ্গিক নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনায় রেখেছি। কারণ, এ অভিমতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গল্পটি লেখাকালীন তাঁর অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিরাজি। আবার আমার মনে জমে ওঠা কিছু প্রশ্নের জবাবও লেখকের নিকট থেকে জানার সুযোগ পেয়েছি। বইমেলাতে তাঁর লেখার অনুরাগীরা এসে এটি সংগ্রহ করেছেন। অনেকে শুধু এটি নেবার জন্যই যে বইমেলায় এসেছেন, সে-কথাও আলাপের সময় জানাতেন। বইটি রকমারি ডট কমেও পাঠকেরা অর্ডার করেছেন, করোনাকালে অর্ডার করছেন। আমার প্রত্যাশা ছিল, সেলিম মোরশেদের মতো জাত লেখকের যে পরিচয় তাঁর লেখায় পাই, বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের অজস্র কারচুপি, তথাকথিত লোকদেখানো আয়োজন, মেকিত্ব ও প্রতারণাসর্বস্ব মানসিকতার যে উৎকট প্রভাব থেকে তাঁর লেখা আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত, সেই লেখা ‘পরানকথা’র পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে। সেলিম ভাই আমার এ আবেগ ও আগ্রহের কারণ জানতেন। নইলে আমার স্বপ্নপূরণের পথে তিনি হাত বাড়িয়ে দিতেন না।
‘কান্নাঘর’ বাংলা ছোটগল্পের ধারায় বিশিষ্ট সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হবে। আশির দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের লেখা ও সাহিত্যচর্চার প্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন গল্প এ সংকলনে গ্রন্থিবদ্ধ হয়েছে। ‘মেঘচিল’-এর এ আয়োজনে সংযুক্ত হতে পেরে আমি আনন্দিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গল্প পাঠক্রমভুক্ত। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণা ও সাহিত্য-সমালোচনার পরিমণ্ডলে, ছোটকাগজ-কেন্দ্রিক আয়োজনে সেলিম মোরশেদ-বিষয়ক আলোচনা ও মূল্যায়ন এখনো অনুপস্থিত। তাঁর সাহিত্যভাবনা ও সাহিত্যচর্চার জায়গাটিকে জোরালোভাবে অনুধাবন যে সময়ের দাবি, ‘মেঘচিল’-এর বর্তমান উদ্যোগ থেকে তা অনুধাবন করা চলে যাবে। তরুণ প্রজন্মের লেখকদের লেখালেখিতে হাত পাকাতে, সচেতন পাঠকদের ভাবনায় অনুরণন জাগাতে সেলিম মোরশেদের লেখা প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে।