:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আহ্‌মেদ লিপু

প্রাবন্ধিক

পাশ্চাত্যের দর্শনের ইতিহাসনির্ভর এক অসাধারণ উপন্যাস
প্রকাশক : সন্দেশ | Sophie's World-এর প্রচ্ছদ অবলম্বনে; অলংকরণ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

সোফির জগৎ

পাশ্চাত্যের দর্শনের ইতিহাসনির্ভর এক অসাধারণ উপন্যাস

Sophies World একটি Text যা আটচল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, হয়েছে বেস্ট সেলার। ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর মতে, ‘নব্বই দশকের একটি এলিস ইনওয়ান্ডারল্যান্ড… সোফির জগৎ-কে এরইমধ্যে দর্শনের তরফ থেকে স্টিফেন হকিং রচিত ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’-এর উত্তর বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।’

এটি একটি চমৎকার, অপ্রতিরোধ্য বই। সানডে টাইমস-এর মতে, ‘অসাধারণ… । তিন হাজার বছরের চিন্তার ইতিহাসকে ইয়স্তেন গার্ডার চারশ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ করেছেন; সহজ-সরল ভাষায় বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত জটিল সব বিতর্কিত বিষয়কে, অথচ সেগুলোর গুরুত্ব ক্ষুণ্ন হয়নি এতটুকু।… সোফির জগৎ এক অসাধারণ কীর্তি।’

কী বলা যেতে পারে সেই Text নিয়ে!

১.
প্রতীচ্যের দর্শনের ইতিহাসে সোফিস্টরা বলত ‘Man is the Measure of Everything’। আমরা তাদের ‘স্কুল অব থট’-এর অনুসারী না হয়েও তাদের এই সিদ্ধান্তের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আলোচনায় অগ্রসর হতে পারি; কোনো বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে একটি প্রতিষ্ঠানের মতামত নিতান্তই ওই প্রতিষ্ঠানের, ব্যক্তির মতামত নেহায়েত ব্যক্তিক—যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মধ্যে নৈর্ব্যক্তিকতা থাকে। অবশ্য ব্যক্তির বক্তব্যে নৈর্ব্যক্তিকতা থাকলে অন্যথা ভাবার সুযোগ ও সম্ভাবনা দুই-ই তৈরি হয়।

২.
পাঠ সমাপনান্তে দেখা যাচ্ছে, ‘সোফি অ্যামুন্ডসেন’ নামের চৌদ্দ বছর বয়সী নরওয়েজীয় কিশোরীকে ‘অ্যালবার্টো নক্স’ নামের এক দার্শনিকের দর্শন দীক্ষার ঘটনা পরম্পরার বয়ান আমাদের আলোচ্য ‘সোফির জগৎ’। Textটি লিখেছেন নরওয়েজীয় লেখক, দর্শনের অধ্যাপক ইয়স্তেন গার্ডার। বাংলায় অনুবাদ করেছেন ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক-সাংবাদিক জি এইচ হাবীব। অনুবাদ-কর্মটি পাঠক মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছে।

আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, জনপ্রিয় কাজ প্রায়শই গুরত্বপূর্ণ, সঠিক কাজ হয় না। দার্শনিক ভাষায় বললে, ‘জনপ্রিয় কাজে গুণ ও পরিমাণের সমন্বয় প্রায়শই যথার্থ থাকে না।’ গুণ ও পরিমাণের যথার্থ সমন্বয়ের কারণেই অ্যারিস্টটলের অর্গানন, দিঙনাগের প্রমাণ সমুচ্চয়ে কিংবা ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকটেটাস লজিকো ফিলসফিক্যাস গুরত্বপূর্ণ। কিন্তু মোটেই জনপ্রিয় নয়। আধুনিক পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা গড়ে উঠেছে অর্গাননকে ভিত্তি করে। কিন্তু কতজন পাঠক, লেখক কিংবা দার্শনিক অর্গানন পড়েছেন?

পাঠান্তে উপলদ্ধি হয় সোফির জগৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ; বিশেষত পাশ্চাত্য দর্শন চিন্তার প্রেক্ষিতে। Text-টির জনপ্রিয়তার পেছনে সম্ভবত লেখকের অ্যাকাডেমিতে দর্শন পড়ানোর অভিজ্ঞতা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কীভাবে দর্শনকে অধিকতর জনঘনিষ্ঠ করা যায়, একজন অ্যাকাডেমিক দর্শন বিশারদ হিসেবে তিনি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে একে কাজে পরিণত করেছেন সোফির জগৎ-এর মাধ্যমে। তিনি Text-টিতে কৈশোরের মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করে একজন দার্শনিকের মুখ দিয়ে যথাসম্ভব নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রেখে বিবিধ ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন। এখানেই Text-টির অভিনবত্ব। যেখানে, অধিকাংশ দর্শনের ইতিহাস লেখা হয় গতানুগতিকভাবে।

উপরন্তু এই ইতিহাস হয় লেখকের মনের রঙে রাঙানো। তাছাড়া একজন দর্শন বিশারদ হিসেবে তিনি জানতেন ‘দর্শন শুধু সিদ্ধান্ত নয়, দর্শন হচ্ছে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে সিদ্ধান্তের চর্চা।’ তিনি ‘অ্যালবার্টো নক্স’ দার্শনিক চরিত্রের মাধ্যমে সোফিকে (তথা সমগ্র পাঠক সমাজকে) দর্শন বয়ানের সময় এইদিকে বিশেষ লক্ষ রেখেছিলেন। এটি অবশ্যই যে কোনো দর্শন বিষয়ক গ্রন্থের আবশ্যিক গুণাবলি। তবে  গ্রন্থটির জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য কাজ করেছে তা হচ্ছে এর কম্পাইলেশনধর্মিতা। ইনোভেশনধর্মিতা নয়। আমাদের বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা সচারচর নতুনকে চিনে উঠতে পারে না; তাই নতুনকে মেনে নিতে তার এত ভয়-সংকোচ। Text-টিতে এমন কোনো বক্তব্য কিংবা সিদ্ধান্ত নেই যা সামষ্টিক মানব-মন আগে থেকে জানত না। ফলে সামষ্টিক মানব-মন, অভিজ্ঞতা সহজেই একে গ্রহণ করেছে। উপরন্তু উপস্থাপনের চমৎকারিত্ব, অভিনবত্ব ও নির্মোহতা তো ছিলই। খুব সম্ভবত এটাই এই Textটির একই সঙ্গে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দুর্বলতম দিক। শক্তিশালী দিক এই কারণে যে, Textটির পাঠকপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে কার্যকরী নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। দুর্বলতম দিক এই কারণে যে, এই কারণেই Textটি একটি দর্শন বিষয়ক Text হিসেবে পরিগণিত হবে, মৌলিক দার্শনিক Text হিসেবে নয়। লেখক নিজে পরিচিত হবেন দর্শনবিদ হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে নয়।

পাঠান্তে উপলদ্ধি হয় সোফির জগৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ; বিশেষত পাশ্চাত্য দর্শন চিন্তার প্রেক্ষিতে। Text-টির জনপ্রিয়তার পেছনে সম্ভবত লেখকের অ্যাকাডেমিতে দর্শন পড়ানোর অভিজ্ঞতা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কীভাবে দর্শনকে অধিকতর জনঘনিষ্ঠ করা যায়, একজন অ্যাকাডেমিক দর্শন বিশারদ হিসেবে তিনি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে একে কাজে পরিণত করেছেন সোফির জগৎ-এর মাধ্যমে।

৩.
Text একটি সাধারণীকৃত শব্দ। সাধারণত একে লেখক ও পাঠকের সংযোগ মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, সোফির জগৎ একটি সার্থক উপন্যাস। যাতে ফিকশন এবং ফিউশন সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে। উপন্যাসের জমজমাট কাহিনী বলে যাকে আমরা জানি, চিনি—তা এখানে উপস্থিত। বিচিত্র উপাখ্যান নানা দিক থেকে এক বিন্দুতে মিলে জটিল মুহূর্ত তৈরি করেছে। ‘তুমি কে?’ ‘পৃথিবীটা কোথা থেকে এল?’ এক রহস্যময় দার্শনিকের লেখা আশ্চর্য চিরকুট দুটোর সেই কৌতূহল উসকে দেয়া প্রশ্ন দু’খানি-ই সূত্রপাত ঘটিয়ে দিল প্রাক-সক্রেটিস যুগ থেকে সার্ত্র পর্যন্ত পাশ্চাত্য দর্শনরাজ্যে এক অসাধারণ অভিযাত্রার। পরপর বেশ কিছু অসাধারণ চিঠিতে তার পর সশরীরে, পোষা কুকুর হার্মেসকে সঙ্গে নিয়ে অ্যালবার্টো নক্স সোফির কৌতূহলী মনের সামনে দিনের পর দিন একের পর এক তুলে ধরলেন সেই সব মৌলিক প্রশ্ন যার জবাব বিভিন্ন দার্শনিক আর চিন্তাশীল মানুষ খুঁজে ফিরছেন সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে। কিন্তু সোফি যখন এই চোখধাঁধানো আর উত্তেজনায় ভরা আশ্চর্য জগতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই সে আর তার দর্শনের শিক্ষক এমন এক ষড়যন্ত্রের জালে নিজেদের বাঁধা পড়তে দেখল যে খোদ সেটাকেই এক যারপরনাই হতবুদ্ধিকর দর্শনগত প্রহেলিকা ছাড়া আর কিছু বলা সাজে না। বিস্তারে না যেয়েও এটা বলা যায় যে, গঠনগত দিক দিয়ে এটি উপন্যাসের সকল শর্ত পূরণ করেছে। তা ছাড়া বিষয়টি এতটাই স্বতঃস্পষ্ট যে, বিস্তারে যাওয়া কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকও বটে। সেই হতবুদ্ধিকরণ অবস্থা থেকে দর্শনের শিক্ষকসহ সোফির পলায়ন এবং পরবর্তী সময়ে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়েই উপন্যাসটি রচিত।

যাঁরা দর্শনকে Art of Wondering বলতে চান (দর্শনের Epistemological Point of View সম্পর্কে ধারণা না থাকায়) তাঁরাও এর সাহিত্যিক মূল্যকে অস্বীকার করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া উপন্যাসটিতে দর্শনের ইতিহাসের পাশাপাশি মূল্যতালিকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূল্যের অবস্থানও আলোচিত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে দার্শনিক মনোভাবাপন্ন পাঠকের জন্য বাড়তি পাওনা।

8.
যে কোনো রচনাই, বিশেষত দর্শন সংশ্লিষ্ট রচনার আলোচনায় এতে কী বলা হয়েছে (Way of Opinion), কীভাবে বলা হয়েছে (Way of Truth)—ন্যূনতম এই দুটি দিকের ওপর নজর রাখতে হয়।

আমাদের আলোচ্য Textটিতে দর্শন সংক্রান্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে। আলোচনা করা হয়েছে Communicative Methodology-তে অর্থাৎ এখানে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া হয়নি। আগে ব্যাকরণ আলাপ করে পরে মূল প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়নি। দর্শনের ব্যাকরণ—যুক্তিবিদ্যা, অনুমান-সহানুমান, প্রতিভাস-কূটাভাস, জ্ঞানতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, মূল্যতত্ত্ব—আলোচনা করে পরে বিষয় হিসেবে দর্শনের ভেতরে প্রবেশ করা হয়নি। নিঃসন্দেহে বাংলাভাষায় লিখিত অথবা অনূদিত দর্শন সংক্রান্ত Text-এর ক্ষেত্রে এটি একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

কে তুমি? পৃথিবীটা কোথা থেকে এল?—এই দুটি মৌলিক দার্শনিক প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে লেখক ক্রমান্বয়ে বয়ান করেছেন তিন হাজার বছরের পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস। যদিও তিনি অদ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদী (পৃ. ২৬৮), আরব-আরবীয় (পৃ. ১৯৪,২০০,২১৯), আল্লাহ (পৃ. ১৭৪), ইসলাম (পৃ. ১৫৯), বর্ণপ্রথা (পৃ. ১১৩), গৌতমবুদ্ধ (পৃ. ২১৯), বেদশাস্ত্র (পৃ. ১৭১), বৌদ্ধধর্ম (পৃ. ১৫৯,১৭৩,৩৯৭), ব্রহ্ম (পৃ. ৫২৬), মরমীবাদ (পৃ. ১৫৮-৬০), মরমীবাদী (পৃ.৩৬৫), মুহাম্মদ (পৃ. ১৯৪), সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন (পৃ. ১২০), স্বামী বিবেকানন্দ (পৃ. ১৫৯), হিন্দু ধর্ম (পৃ. ১৭৩) ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার ও উল্লেখ করেছেন তথাপি তিনি এইসব শব্দ দ্বারা যে সকল দার্শনিক Idea অথবা Concept নির্মাণ সম্ভব কিংবা মানবচিন্তার ইতিহাসে নির্মিত হয়ে আছে, তাদের বিস্তারে যাননি। তিনি এই সকল শব্দের উপস্থাপন অথবা উল্লেখ করেছেন তথ্য (Information) হিসেবে। এখানে জ্ঞান (Knowledge) ও তথ্যের (Information) পার্থক্য স্মৰ্তব্য৷ এটা একই সঙ্গে আলোচ্য Textটির লেখকের নিজস্ব জ্ঞানতাত্ত্বিক সততা ও সীমাবদ্ধতা। সীমাবদ্ধতা এই কারণে যে এর ফলে Textটির উপস্থাপিত বক্তব্য খণ্ডিত হয়েছে। ‘সমগ্র মানব চিন্তার ইতিহাস’ না উপস্থাপিত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে ‘পাশ্চাত্য মানব চিন্তার ইতিহাস’। সততার জায়গা হচ্ছে অর্জিত মানব-জ্ঞান সম্পর্কে নিজের অবস্থান তিনি অসংকোচে প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া পর্যবেক্ষকের (Observer) চৈতন্যগত ‘আমি, তুমি, সে’-র বিভাজন সাপেক্ষে বলা যায় একজন পাশ্চাত্যের অধিবাসীর তার নিজের দর্শন উপস্থাপন করা আর তাদের (প্রাচ্যের) দর্শন উপস্থাপন করার মাঝে পার্থক্য থাকে বা থাকা সম্ভব। কেননা, দর্শন সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক মানবিক জ্ঞান (Objective Human Knowledge) নয়। এইসব ক্ষেত্রে উপস্থাপন-কৌশল (Technique), উপায় (Way) ও উদ্দেশ্য (Aim) একটি কার্যকর Factor হিসেবে বিবেচিত হয়। অবশ্য পাঠান্তে বোঝা যায় জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে লেখক Textটিতে ‘ব্যক্তিকতায় নৈর্ব্যক্তিক’ উপস্থিতি জারি রেখেছেন।

সোফির জগৎ-এর লেখক ইয়স্তেন গার্ডার ও অনুবাদক জি এইচ হাবীব। 

তা ছাড়া প্রকাশের উপায় এবং উপকরণের সাপেক্ষে বিষয় হিসেবে দর্শনকে পুরোপুরি ব্যক্তিক (Subjective) কিংবা নৈর্ব্যক্তিক (Objective) বলা যায় না। পাশ্চাত্য দর্শনে যুক্তি হিসেবে রয়েছে আরোহী ও অবরোহীর ধারণা। প্রাচ্যে আছে প্রমাণ-প্রমেয়র কথা। অ্যারিস্টটল আরোহী-অবরোহীর বাইরে গিয়ে বলেছিলেন স্বজ্ঞার (Intuition) কথা আর প্রাচ্য দর্শনে আছে শ্রুতির কথা—শুধু শুনেই জ্ঞান অর্জন। এইরকমভাবে উভয় দর্শনেরই আরো অনেক একান্তই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ সম্ভব। হয়তো এই সব অনুধাবন করেই ইয়স্তেন গার্ডার তাঁর নিজস্ব জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান নির্বাচন করেছেন। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ্য যে, বিষয় হিসেবে দর্শন নিজস্ব অন্তর্নিহিত জ্ঞানকাণ্ডের জন্যই কোথাও দর্শন হিসেবেই নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে আবার কোথাও সে হয়ে যায় জীবন-দর্শন। এখানে অবশ্য কেউ কেউ দর্শন চর্চাকারীদের নিজস্ব মূল্যের ধারণার প্রতি অথবা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূল্যতালিকার কেন্দ্রে মূল্যকে স্থাপনের প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করতে পারেন। সেক্ষেত্রে জ্ঞানতাত্ত্বিক প্যারাডক্সের উদ্ভব হলেও অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করা মুশকিল।

[খ]

কিছুটা বিরক্তি উৎপাদন ও পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পঁয়ত্রিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত Textটির বক্তব্যকে একটু নিজেদের মতো করে বুঝে নেয়া প্রয়োজন। কেননা এই কয়টি অধ্যায়ই একজন কিশোরীকে দার্শনিকে রূপান্তরিত করেছে—ক্ষেত্রবিশেষে সে তার দর্শনের শিক্ষককেও অতিক্রম করেছে, হয়েছে দর্শনের (অপ্রাতিষ্ঠানিক) ছাত্রী থেকে দার্শনিকের সহযাত্রী।

বিশটি প্রশ্ন:

→ কে তুমি?
→ পৃথিবীটা কোথা থেকে এল?
→ দর্শন কী?
→ এমন কোনো মৌলিক পদার্থ কি আছে যা দিয়ে বাকি সবকিছু তৈরি হয়েছে?
→ পানি কি মদে পরিণত হতে পারে?
→ মাটি আর পানি কী করে একটি জীবন্ত ব্যাঙ তৈরি করে?
→ লোগো কেন পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ খেলনা?
→ তুমি কি নিয়তিতে বিশ্বাস করো?
→ অসুস্থতা কি দেবতাদের দেয়া শাস্তি?
→ কোন শক্তি ইতিহাসের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে?
→ স্বাভাবিক শালীনতা বলে কি কিছু আছে?
→ কোনটা আগে এসেছে মুরগি না ভাবমুরগি?
→ আমরা কি সহজাত ভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করি?
→ একটি গাছ, প্রাণী আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য কী?
→ বৃষ্টি কেন হয়?
→ একটি সুন্দর জীবন যাপন করার জন্য কী প্রয়োজন?
→ যেসব বিষয় সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তার একটি তালিকা তৈরি কর।
→ তার পর সেসব বিষয়ের একটি তালিকা তৈরি কর যে-সব বিষয়ে আমরা কেবল বিশ্বাসই করতে পারি।
→ একজন মানুষের জীবনদর্শন তৈরিতে যেসব বিষয় অবদান রাখে সেগুলো উল্লেখ কর।
→ বিবেক বলতে কী বোঝায়? তুমি কি মনে কর সবার বিবেক একই রকম?
→ মূল্যের অগ্রাধিকার (Priority of Values) বলতে কী বোঝ?

তিনটি স্বগতোক্তি:

→ যে জানে যে, সে কিছুই জানে না সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী।
→ সত্যিকারের উপলব্ধি ভেতর থেকেই আসে।
→ যে জানে কোন কাজটি সঠিক সে ঠিক কাজটিকেই করবে।

—এর ওপর দাঁড়িয়েই লেখক প্রি-সক্রেটিক যুগ থেকে রেনেসাঁ পর্যন্ত কালসীমায় পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসকে ধরেছেন। পাঠান্তে বলা যায় সার্থকভাবেই ধরেছেন। Textটির এই পরিসরটুকুতে ‘পথিকই পথ তৈরি করেছেন’; বাকিটুকুতে পথিকের তেমন কোনো ক্রিয়াশীলতা নেই। কেননা, সেখানে ‘পথই পথিককে তৈরি করে’ নিদেনপক্ষে টেনে নেয়। পঁয়ত্রিশটি অধ্যায়ের কোনো অধ্যায়ে লেখকের যদি মৌলিক দার্শনিক বক্তব্য থেকে থাকে তাহলে তা আছে প্রথম অধ্যায়ে—‘কোনো এক পর্যায়ে একটা কিছু নিশ্চয়ই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।’

তাঁর এই মত দার্শনিক মত হিসেবে নতুন বা মৌলিক না হলেও প্রকৃতিবাদী দার্শনিক মতের বিপরীত। কিন্তু আমাদের আলোচনার শুরুতে উল্লেখ্য সোফির জগৎ-কে এরইমধ্যে দর্শনের তরফ থেকে স্টিফেন হকিং রচিত এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর উত্তর বলে ধরে নেওয়া হয়েছে—সানডে টাইমস-এর মতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা স্টিফেন হকিং সম্প্রতি বলছেন যে, শূন্য থেকেই একাধিক মহাবিশ্ব তৈরির গাণিতিক সম্ভাবনা জোরালোভাবে বিদ্যমান।

প্রত্যেকটি অধ্যায়ের একটি শিরোনাম থাকায় Textটি সাধারণ পাঠকদের জন্য তো বটেই এমনকি যাদের ইতোমধ্যে দার্শনিক ব্যুৎপত্তি অর্জিত হয়েছে তাদের কাছেও একটি Reference Text হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন দেকার্ত বিষয়ক ১৮তম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘…নির্মাণ স্থান থেকে সব ময়লা আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে চেয়েছেন তিনি…’। যাদের ইতোমধ্যে কিছুটা দার্শনিক ব্যুৎপত্তি অর্জিত হয়েছে তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন এই উক্তির মাধ্যমে লেখক দেকার্তের জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি (Epistemological Point of View) সম্পর্কে ইঙ্গিত করছেন। আর যাঁরা দার্শনিক ব্যুৎপত্তি অর্জন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন তাঁরাও এই শিরোনামের মাধ্যমে দেকার্তের ভাবনাকে প্রাথমিকভাবে ধরতে সক্ষম হবেন।

আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, সোফির জগৎ একটি সার্থক উপন্যাস। যাতে ফিকশন এবং ফিউশন সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে। উপন্যাসের জমজমাট কাহিনী বলে যাকে আমরা জানি, চিনি—তা এখানে উপস্থিত। বিচিত্র উপাখ্যান নানা দিক থেকে এক বিন্দুতে মিলে জটিল মুহূর্ত তৈরি করেছে।

স্পিনোজা সংক্রান্ত ১৯তম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘…ঈশ্বর একজন পুতুল নাচিয়ে নন…’ থেকে তাঁর বুদ্ধিবাদী দার্শনিক অবস্থানকে বুঝে নিতে মোটেই অসুবিধা হয় না। বুদ্ধিবাদী দার্শনিক স্পিনোজা বলতে চান ‘সৃষ্টিকর্তা শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে জগৎ পরিচালনা করলে তাঁর মহিমা ক্ষুণ্ন হয়, তাই তিনি অন্তর্নিহিত ভাবেই জগৎ পরিচালনা করেন।’ লক সংক্রান্ত ২০তম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘…শিক্ষক আসার আগে ব্ল্যাকবোর্ড যে রকম খালি থাকে…’ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক মনোভঙ্গির পরিচয় মেলে। যেমন—’…যা টিকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে সেটাই যৌক্তিক…’ (২৭তম অধ্যায়) থেকে মেলে হেগেলের বুদ্ধিবাদী দার্শনিক অবস্থানের। এইরূপ উদ্ধৃতি আরো অনেক বাড়ানো যায়।

বিশ্বজগৎকে মানবজগতে পরিণত করার ক্ষেত্রে দর্শনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই ‘প্রথমদিককার গ্রীক দার্শনিকদের উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা, অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা নয়’ (পৃ. ৪৯)। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষ ‘পুরাণ এমন সময়ে তৈরি করেছিল যখন বিজ্ঞান নামের কোনো কিছুই ছিল না’ (পৃ. ৫০)। কালের আবর্তনে বিজ্ঞানের আবির্ভাব। বর্তমান মানবজগৎকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বিজ্ঞান দর্শনের বিজ্ঞানাগার (Laboratory) হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। Text হিসেবে সোফির জগৎ এরই ইতিহাস ও তথ্যনির্ভর এক ধরনের প্রামাণ্যকরণের চেষ্টা বৈ অন্য কিছু নয় ।

৫.
যেহেতু Textটি অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের করতলস্থ হয়েছে তাই এর অনুবাদ সম্পর্কে একটু আলোকপাত না করলেই নয়। Textটি নরওয়েজীয় ভাষায় লেখা (Sofies Verden), কিন্তু এর কোন ইংরেজি ভার্সনের কততম সংস্করণ অনুবাদক বাংলায় অনুবাদ করেছেন তার উল্লেখ আবশ্যক ছিল; কিন্তু Textটিতে তার উল্লেখ নেই।

Paulette Moller অনূদিত Berkley Books, Newyork প্রকাশিত Sophie’s World-এর নিরিখে দেখলে নিম্নোক্ত বিচ্যুতি দৃষ্টিগোচর হয়—

[ক] Gloria Patri, et Filio, et Spiritui Sancto. Sicut ercut erat is Principio, et nuc, et semper et in saecula saeculorum, Amen- [মধ্যযুগ পৃ. ১৯০]

অনুবাদক এই ল্যাটিনটুকুর কোনো বাংলান্তরের চেষ্টাই করেননি!

[খ] TRUE ENLLIGHTENMENT IS TO MAN LIKE SUNLIGHT TO THE SOIL
-N.F.S. Grundtving

—এর বঙ্গানুবাদ

মাটির কাছে সূর্যের আলো যেমন
সত্যিকারের আলোকসম্পাতও মানুষের কাছে তেমন।
—এন.এফ.এস. গ্রুন্ডভিগ [বিয়র্কেলে, পৃ. ১০৯]

করলেও

What matters our creative endless toil,
When at a snatch, oblivion ends the Coil

এর বঙ্গানুবাদ করেছেন—

হোয়াট ম্যাটারস্ আওয়ার ক্রিয়েটিভ এন্ডলেস টয়েল,
হোয়েন অ্যাট আ স্নাচ, অবলিভিয়ন এন্ডস্ দ্য কয়েল?— !!

আবার ৪৪৩ পৃষ্ঠায় হুবহু ইংরেজি লাইনগুলোই তুলে দিয়েছেন!!!

[গ] 888 পৃষ্ঠায় তিনি Thomas Hardy-র দীর্ঘ কবিতা Transformations-এর কোনো বাংলা অনুবাদই করেননি। করেননি এই পৃষ্ঠায় ও এর পূর্ববর্তী পৃষ্ঠায় Goethe-র Faust-এর তিনটি সুপরিসর উদ্ধৃতির বঙ্গানুবাদ।

[ঘ] She knew her mother know that sophie knew her mother wouldn’t believe it either [Page 217]

এর বঙ্গানুবাদ করেছেন—

সোফি এ-ও জানে যে তার মা জানেন যে সোফি জানে তার মা তা বিশ্বাস করবে না। [পৃ.২৩৬]

উদ্ধৃতি আরো প্রচুর বাড়ানো যায়, তবে আমরা বিরত থাকলাম। অনুবাদ-কর্মটির পরিভাষা নির্বাচন ও ব্যবহারে দুর্বলতা ও ব্যর্থতা লক্ষণীয়। যেমন, বাংলা পরিভাষা হিসেবে Entity-র ‘সত্তা’, Cognition-এর ‘বোধ’ Cognitive-এর ‘জ্ঞানমূলক’, World Sprit-’র ‘বিশ্বচিদাত্মা’ তেমন গ্রহণীয় নয়।

তাছাড়া Textটিতে মুদ্রণপ্রমাদের সহনীয় মাত্রা বেশ বাজেভাবে অতিক্রম করেছে। শুধুমাত্র ‘রোমান্টিসিজম’ অধ্যায়ের ১৭টি পৃষ্ঠাতেই কমপক্ষে পনেরটি মুদ্রণপ্রমাদ বিদ্যমান। মুদ্রণপ্রমাদের এই হার Textটিতে কমবেশি সর্বত্রই বিরাজিত। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে Textটিতে দুই জায়গায় দুই রকম বিক্রয়মূল্যের উল্লেখ আছে।

৬.
উপস্থাপনগত এই সকল ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও Textটিতে যা (যে বক্তব্য) উপস্থাপিত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় আবেগপ্রবণ, কর্মকুণ্ঠ, জীবনবিমুখ ও পরলোকমুখী বাঙালির দর্শন চর্চার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা ও যুক্তিনিষ্ঠার প্রয়োজন—গভীর অভিনিবেশসহ পাঠ সেই ক্ষেত্রে ধনাত্মক ভূমিকা পালন করবে।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.