আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর চিঠি
এখানে সব কিছু ধসে পড়ছে
জানুয়ারি ১৩, ১৯৮৯
১২/৩ কে এম দাশ লেন
টিকাটুলি, ঢাকা ১২০৩
আখতারের হাতে পাঠানো তোমার কবিতার বই ‘খোয়াবনামা’ এবং সালামাত আলী, শরাফৎ আলী, আমির খান, নাজাকাত আলী, মুনাওয়ার আলী, ফৈয়াজ খান, বড়ে গোলাম আলী, কেশর বাই, করিম খান–এঁদের সঙ্গীতের ক্যাসেটের জন্য অজস্র অজস্র ধন্যবাদ। আমার জন্য একটা রেডিও ক্যাসেট প্লেয়ার (ওয়াকম্যান) নিয়ে এসেছে। এখন আমার লেখা খুব আসছে, ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা থেকে কানে তার লাগিয়ে ঐ প্লেয়ারে মিউজিক শুনতে শুনতে লিখতে বা প্রুফ দেখতে দারুণ ভালো লাগে। তোমরা যে আমাকে মনে রাখো এতে আমি খুব অভিভূত বোধ করি।
‘খোয়াবনামা’ অনেকদিন পর ভালো করে পড়লাম। এবার বেশ মগ্ন হয়ে পড়া গেলো, আগের চেয়ে অনেক ভালো লাগলো। কবিতাগুলো নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। আগে থেকে বলে রাখি, খোয়াবনামা নামে আমি হয়তো একটা উপন্যাস লিখতে পারি, তোমার অনুমতি নিয়ে রাখলাম। ব্যক্তির খোয়াব কেবল তার নিজের একার সাধ কি গ্লানি, ইচ্ছা কি আশাভঙ্গের কথা নাড়া দিয়ে যায় না, তার পূর্বপুরুষ, তার লুপ্ত পূর্বপুরুষের স্মৃতি, তার সম্প্রদায়ের ঝাপসা অতীত বা অসন্তুষ্ট বর্তমান স্বপ্নে উঁকি দিয়ে যায়। অনেক সময় না-দ্যাখা ও না-শোনা সমষ্টির বেদনা ও বঞ্চনা বহু কালের ও বহু প্রজন্মের রক্তের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে অন্ধকার স্রোতের তলা থেকে পলকের জন্যে মাথা তোলে। আশা ও আশাভঙ্গ জানাবার একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হলো স্বপ্নবয়ান, ভালো করে বলতে গেলে খোয়াবনামা।
তোমার জন্য একটি সমার্থ শব্দকোষ পাঠালাম, লেখার সময় বেশ কাজে লাগে। আরো বই পাঠাবার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু বাঙলাদেশের কি পাঠাই কি পাঠাই করতে করতে দিন চলে গেলো। ফেব্রুয়ারিতে যদি আসো তো কিছু নতুন বই পাবে। তুমি নিজে না আসতে পারলে আর কেউ আসে তো আমারে আগেই চিঠি লিখে তার ঠিকানা জানাবে যাতে আমি তার হাতে কিছু বই দিয়ে আসতে পারি।
আমার কর্মস্থল মিউজিক কলেজে (আসল নাম সরকারী সংগীত মহাবিদ্যালয়) কোনোরকম লাইব্রেরি নেই–না বইয়ের না ডিস্কের বা ক্যাসেটের। অনেক কষ্টে গতবার কিছু বই কেনা হয়েছে, একটা মোটামুটি ভালো টেপ-রেকর্ডার কেনা হলো গত মে মাসে, এখন পর্যন্ত সেটা ভালোভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমি যতোদিন থাকি অন্তত বইয়ের সংগ্রহ ভালো করে যেতে চেষ্টা করবো। মুশকিল এই যে আমাদের কলেজের কোনো বাড়ি না থাকায় কোনো কাজই ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো অযোগ্য ও নির্বিকার, ধান্দাবাজ ও টাউট এ্যডমিনিস্ট্রেশন। গত দু’বছর আমি শিক্ষকতা থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর থেকে সোজাসুজি প্রশাসনের ভেতরটা দ্যাখার সুযোগ পাচ্ছি, এখানে সব কিছু ধসে পড়ছে, সরকারের এক নম্বর থেকে শুরু করে একটি আলপিন পর্যন্ত নষ্ট, কোনোরকম সংস্কার করার কোনো উপায় নেই। সম্পূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া এখানে কিচ্ছু করা যাবে না।
তোমার পাঠানো ক্যাসেট শুনতে শুনতে প্রাণ কানায় কানায় ভরে ওঠে, আবার ধন্যবাদ জানাই।
মাঝে মাঝে চিঠি দিও। আমার প্রীতি ও ভালোবাসা জানবে।
ইতি
[আখতারুজ্জামান ইলিয়াস/স্বাক্ষর]
সেজার ভায়্যেহোর কবিতার অনুবাদ পড়লাম। এর বই কি পাঠাতে পারো? অনুবাদ করে পাঠাও তো এখানে ছাপা যায়। ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে কি তার আগেই আমার গল্পের বই বেরুবে, নাম ‘দোজখেরওম’। তোমাকে পাঠাবো, পড়ে মতামত জানাবে। ভালোবাসা।
-ইলিয়াস
আরো পড়ুন- বাস্তবকে তুলে ধরা এদের কাছে অশ্লীলতা