অকেজো
কার্তিক মাসের শেষে আমন ধানের শিষ পেকে হিল হিল করছে মাঠ, এদিকে বউয়ের চোখে ঘুম নেই। অঘ্রানে নতুন ফসল খামারে উঠতেই খুশিতে ডগমগ বউ। ধানঝাড়া হলে আহ্লাদী বউ খামার থেকে বাছাই করে ‘লিছড়া’ ধান প্রয়োজনমতো রোদে খটখটে করে শুকিয়ে হাঁড়িতে ভরে রাখবে। সেই ধান হাস্কিং মেশিনে ভানিয়ে হবে আলোচাল। দুধসাদা রঙের এই চাল রোদে মেলে রাখলে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় হাজার মণিমাণিক্য সব একসাথে জ্বলজ্বল করছে। এমনই তার জ্যোতি!
গায়ে কাঁপন ধরিয়ে হিড়হিড় করে ‘জাড়’ পড়তেই ঘরের ছোট ছেলেরা আবদার করে কেঁদে ওঠে, ‘মা পিঠে খাব, পিঠে করে দে।’
পিঠে খাব বললেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে পিঠে হয়ে যায় না। তার জন্য আলোচাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে এক রাত। পরদিন পানি ঝরিয়ে ঢেঁকিতে কুটোতে হবে। যাদের ঘরে ঢেঁকি নেই, তাদের জন্য আছে ঢেঁকিশাল। গাঁয়ে তো একটাই ঢেঁকিশাল, সেটা হলো মকছেদ চাচার ঢেঁকিশাল। চাচা ‘গড়ে’ চাল ঢালে, আর দুলেহার চাচি গোদা পায়ে ‘পাড়’ দেয়, ঢপাক ঢপ, ঢপাক ঢপ, ঢপাক ঢপ…। গাঁ’টাকে মাত করে রাখে!
এ বছর অঘ্রান পেরিয়ে পৌষ মাস পড়তে গেল, এখনো মকছেদ চাচার ঢেঁকিশাল থেকে কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না। এক-একটা ঋতুর এক-একটা সুর আছে। শীতকালে ঢেঁকির শব্দ না উঠলে গাঁ’টা কেমন বোবা বোবা লাগে! কী হলো গাঁয়ের মানুষগুলোর? এ বছর কি পৌষপার্বণ করবে না কেউ? ঢেঁকিশাল বন্ধ কেন? মনটা উসখুস করতে লাগল।
স্কুল থেকে ফিরতেই রেহেনা বলল, ‘কাল সকালে তুমি কুথাও বেরোবে?’
‘কাল তো রবিবার, ঘরেই থাকব। কেন বলো তো?’
‘তাইলে আলোচালগুলো ভিজতে দিচ্ছি, তাহেরের দুকানে কুটিয়ে আনবে?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহেরের দোকানে কুটোব মানে? নতুন ঢেঁকিশাল খুলেছে নাকি ওরা?’
‘তুমি কী মরদ গো? গাঁয়ের কুনু খবরই রাখো না দেখছি। ওরা নতুন মেশিন বসাইচে গো, চাল কুটার মেশিন। আলোচালগুলো ভিজিয়ে পানি ঝরিয়ে একটু ঝরঝরে করে নিলেই হলো। সঙ্গে সঙ্গে কুটে দিবেক, খরচও কম।’
তাই তো বলি গাঁ’টা এমন বোবা বোবা কেন! তাহের সেখের মাথায় হঠাৎ কী ঝোঁক চাপল? যে মেশিন বসিয়ে দিল, আর গাঁয়ের মানুষগুলো সব উজিয়ে উজিয়ে ওখানেই হাজির হচ্ছে!
সকালে রেহেনার ঠেলা খেয়ে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। ঘুম কি আর কাঁচা আছে! কখন সকাল হয়ে চালে চালে রোদ উঠে গেছে। সপ্তাহের একটা ছুটির দিন, বেলা করেই উঠি।
‘টপ টপ যাও, নাইলে লাইন পড়ি যাবেক।’
তাহের সেখ কী এমন মেশিন বসাল যে তার এত কদর! দেখেই আসি একবার।
খোয়াই বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে গেলে নামোপাড়ার শেষে ছাত্তার সেখের পুকুর পেরিয়েই তাহেরের দোকান। দোকান বলতে মুদিখানা। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত খদ্দেরের ভিড়। দুই বাপ-বেটায় খাওয়ারও ফুরসত পায় না। গাঁয়ে আরও দুটি দোকান আছে। মোল্লাপাড়ায় হাকিকত মোল্লার দোকান, মল্লিকপাড়ায় ঝোড়ো মল্লিকের দোকান। ওগুলো তেমন চালু নেই। তাহের সেখের দোকান থেকে ভিনগাঁয়ের লোকেরাও বাজার করে নিয়ে যায়।
কাছাকাছি পৌঁছাতেই শব্দটা কানে এল। গ্যাঁক গ্যাঁক, গ্যাঁক গ্যাঁক, গ্যাঁক গ্যাঁক…। এ নির্ঘাত তাহের সেখের মেশিনের শব্দ। তা ছাড়া এমন করে গোঁঙাবে কে?
দোকান খুলে ঝাঁট দিয়ে জল ছিটাচ্ছিল তাহের সেখ। আমাকে দেখেই মৃদু হেসে, ‘মাস্টের ছায়েব যে, থলিতে কী ওগুলো? চাল কুটোবে নাকি?’
‘হ্যাঁ চাচা, মেশিন বসাইছ শুনলাম।’
‘না বসিয়ে উপায় ছিলনি বাপ। গাঁয়ের মানুষগুলোর কি লল্লাট বলোদিনি। জাড়কাল পড়লেই চাল কুটোবার চিন্তা। তাই মেশিন নিয়ে চলে এলাম একটা। এখন কত সুবিধে! যাও বাপ, ঘর দিকে পেরিয়ে যাও। ছেলেটা চালাচ্ছে দেখোগা।’
প্রাচীরের দরজাটা খোলায় ছিল। ভেতরে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া! সকাল থেকেই লাইন পড়ে গেছে! আমাকে দেখেই তাহের সেখের ছেলে জিয়ারুল ঘাড় ঘুরাল। একসময় আমার ছাত্র ছিল।
‘কী রে, মেশিন বসালি তাহলে?’
‘হ্যাঁ স্যার, সাত-আট দিন আনা হয়ি গেল। কই, থলিটা দেখি, চালগুলো উজন করি লিই।’
মকছেদ চাচার ঢেঁকিটা মনে পড়ল। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমি। তখন আমরা এক গেরস্তে। দাদি বেঁচে ছিল। পৌষ মাস পড়লেই চাল কুটোনো হতো। দাদির সঙ্গে আমিও যেতাম। দুলেহার চাচি সদ্য গাঁয়ের বউ হয়ে এসেছে। তখন ঢেঁকিতে পাড় দিত মকছেদ চাচার মা সামসুরা দাদি। আমাকে এক ‘খাবলা’ ভিজে আলোচাল দিয়ে বসিয়ে দিত চটের বস্তার ওপর। আমি কচমচ করে চিবুতাম। দাদি চালুনি দিয়ে আটা চালছে, আর পাড় দিচ্ছে সামসুরা দাদি। ঢপাক ঢপ, ঢপাক ঢপ…।
রান্নাশালের ভেতরটা পরিষ্কার করে বসিয়েছে মেশিনটা। দূর থেকে যা ভেবেছিলাম, সে রকম বড় নয়। চার-পাঁচ ফুট লম্বা, চওড়ায় আড়াই ফুট হবে। ফ্রিজের মতো দেখতে চারকোনা মেশিনটি। ওপরের দিকে ধানকলের হোলারের মতো দেখতে একটা ফাঁকা অংশ। ওখানে চাল ঢেলে দিয়ে সুইচ টিপলেই গ্যাঁক গ্যাঁক করে চাল খাচ্ছে দানবটা। আর নিচ দিয়ে মলত্যাগ করছে। দোলা দোলা চালের গুঁড়ো। সাদা আটা।
‘ঘণ্টায় কত কেজি করে চাল কুটেরে মেশিনটা?’
‘তা লয় লয় করে ঘণ্টায় পঞ্চাশ-ষাট কেজি কুটছে।’
মকছেদ চাচার ঢেঁকিটা মনে পড়ল। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমি। তখন আমরা এক গেরস্তে। দাদি বেঁচে ছিল। পৌষ মাস পড়লেই চাল কুটোনো হতো। দাদির সঙ্গে আমিও যেতাম। দুলেহার চাচি সদ্য গাঁয়ের বউ হয়ে এসেছে। তখন ঢেঁকিতে পাড় দিত মকছেদ চাচার মা সামসুরা দাদি। আমাকে এক ‘খাবলা’ ভিজে আলোচাল দিয়ে বসিয়ে দিত চটের বস্তার ওপর। আমি কচমচ করে চিবুতাম। দাদি চালুনি দিয়ে আটা চালছে, আর পাড় দিচ্ছে সামসুরা দাদি। ঢপাক ঢপ, ঢপাক ঢপ…। আট-দশ সের চাল কুটোতে হাফ বেলা কাবার। মনে মনে হিসাব কষলাম। মকছেদ চাচার ঢেঁকিটা কি পারবে তাহের সেখের মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিতে?
চাল কুটে বেরিয়ে তাহের সেখের দোকানে একবার ঢুঁ মারলাম। খদ্দের ছাড়তে ছাড়তেই কথা বলল, ‘দেখলে মাস্টের, কেমন সুবিধে হয়িছে! ঢেঁকিগুলো পুড়াতে হবেক এবার।’ বলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল। এই হাসির আড়ালে বিদ্রূপ লুকিয়ে আছে।
একজন খদ্দের সায় দিল, ‘চাচার জবাব নাই, পারও বটে! যা কিছু উঠছে ঠিক খবর পেয়ে যাও। গাঁয়ের সবার আগে তুমিই লাও সেটা।’
‘চাচা সুবিধে তো সবার হলো, তোমারও ফায়দা হলো। মকছেদ চাচার কী সুবিধে হলো বলো তো?’
আমার এই প্রশ্নে তাহের সেখ পিটপিট করে চাইল মুখ পানে। কোনো সায় দিতে পারল না।
গাঁয়ের মহুলেরা এই সময় মহল থেকে ঘরে ফিরে নতুন খেজুর গুড়ের টিন নিয়ে। তাদের ঘরে ভিড় জমে যায় গুড় কেনার জন্য। পাড়ায় পাড়ায় ব্যাপারীরা সুর করে হাঁক পাড়ে, ‘খেজুর গুড়-র-র, নতুন খেজুর গুড়-র-র।’ সেই ডাক শুনে তড়িঘড়ি বাটি হাতে, মগ হাতে ছুটে আসে ঘরের বউ-ঝিরা। কিনে নেয় বছরের স্বাদের খেজুর গুড়। শীতকালজুড়ে চলবে পিঠে খাওয়ার ধুম। চটুই পিঠে, আসকি পিঠে, কলের জাতা, ধুকি পিঠে, রুটি পিঠে আরও যে কত রকম!
রান্নাশালের ভেতরটা পরিষ্কার করে বসিয়েছে মেশিনটা। দূর থেকে যা ভেবেছিলাম, সে রকম বড় নয়। চার-পাঁচ ফুট লম্বা, চওড়ায় আড়াই ফুট হবে। ফ্রিজের মতো দেখতে চারকোনা মেশিনটি। ওপরের দিকে ধানকলের হোলারের মতো দেখতে একটা ফাঁকা অংশ। ওখানে চাল ঢেলে দিয়ে সুইচ টিপলেই গ্যাঁক গ্যাঁক করে চাল খাচ্ছে দানবটা। আর নিচ দিয়ে মলত্যাগ করছে।
পৌষসংক্রান্তিতে গাঁয়ের পীরপুকুরের পাড়ে মেলা বসে একদিন। রায়পাড়ার মেয়েরা সারা রাত জাগরণ করে তুসুগান গায়। ‘তুসু মুড়ি ভাজতে জানে না, পিঠে করতে জানে না…।’ এই সময় গাঁ-গ্রামের ঘরে ঘরে তিলের পুর, নারকেলের পুর দিয়ে হয় গুঁজা পিঠে। ভালো কথায় পুলিপিঠে। ছেলেমেয়েদের মনে হিড়িক লেগে যাবে না!
মোল্লাপাড়ার ভেতর দিয়েই আমার স্কুলে যাবার পথ। পাশের গ্রামে কাপাসেবেড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফেরার পথে ঢুকে পড়লাম একদিন মকছেদ চাচার উঠোনে। মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি। কঞ্চির মাচা দিয়ে চালে উঠে গেছে লাউ, পুঁইশাকের লতা। ন্যাড়ামাথা হাঁড়ির কাকতাড়ুয়া খড়ের চালে খিলখিল হাসে। তাতে ইঁদুরের দৌরাত্ম্য কমে। চার খুঁটির চালাঘরে ঢেঁকিশাল। ঢপাক ঢপ, ঢপাক ঢপ…।
বেতের মেচেতে কুঁজো হয়ে বসা মকছেদ চাচা শেষ বিকালের রোদটুকুর উষ্ণতা শুষে নিচ্ছিল। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কিসের যেন হিসাবনিকাষ ঘোরের মধ্যে তলিয়ে আছে।
‘চাচা কেমন আছ গো?’ আচমকা এই ডাক শুনে ‘তিকুড়ে’ উঠল মকছেদ চাচা।
‘আরে মাস্টার! আসো বাপ, বসো বসো।’
‘উঠতে হয় না চাচা, তুমি বসো।’
‘দাঁড়াও বাপ, খাটিয়াটা উঠোনে নামায়।’
মকছেদ চাচা কুঁজো মানুষ। শিরদাঁড়াতে কী এক রোগ হয়েছিল। অপারেশনের পর আর সোজা হতে পারেনি। খাটিয়াটা লিয়াল দড়ি দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করেছে। চাচা টুকিটাকি অনেক হাতের কাজ জানে। নারকেলপাতার কাঠি চেঁছে ঝাঁটা বোনে, শোন দিয়ে ঢেঁড়া ঘুরিয়ে দড়ি পাকায়। ঝুড়িও বুনতে পারে। আর আছে ঢেঁকিশাল। নড়বড় করে সংসার চালায়।
খাটিয়াটা দুজনে ধরে নামলাম। উঠোনের এক পাশে তিনটে নারকেলগাছ, একটা ঝাঁকর-ঝুমর টিয়াঠোঁটে আমগাছ। গোটা আমটা সবুজ, শুধু ঠোঁটটি লাল।
‘চাচিকে দেখছি না, কোথা গেছে?’
‘তোমার চাচি পুকুরঘাট দিকে গেল মুনে হয়।’
চাচা খাটিয়ায় বসে আবার একটা বিড়ি ধরাল। চোখের চাহনিতে করুণ ভাব! বুঝলাম, রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে চাচা খুব চিন্তিত। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মকছেদ চাচা বলল, ‘দিয়ে বাপ, খবর কী এখন? হঠাৎ চাচার সঙ্গে দেখা করতে এলে?’
‘কয়েক দিন ধরেই আসব আসব করছি। আসা হয়নি। ঢেঁকিশালটা এ বছর বন্ধ দেখছি চাচা? চালাওনি কেন?’
মকছেদ চাচার মুখটা ফ্যাঁকাশে হয়ে গেল। আমার কথায় কি আঘাত পেল?
‘মানুষগুলোর এখন সুময় কুথায় বাপ। মেশিনের সঙ্গে আমরা পাল্লা দিতে পারি? আর আসবেক কেনে আমার কাছে! তিনপুরুষ আগের ঢেঁকিশাল। এ বছরই শেষ। এবার উইয়ে, ঘুনে খাবেক।’
বড় আপসোস লাগল। আমিও আসতে পারলাম না চালগুলো নিয়ে! আমারও কি সময় নেই? একা এলে কুটে দিত কি চালগুলো? কে জানে!
দুলেহার চাচি থপ থপ করে হেঁটে আমাদের সামনে দাঁড়াল। মকছেদ চাচা বলল, ‘চা চাপাও একটু।’
‘আর চা করতে হয় না, চাচি।’
‘তা বললে হয় বাপ, এসেই যখন পড়েছ, চাচির হাতে চা এক কাপ খেয়ে যাও।’
‘তোমাদেরও তো কাজ বন্ধ হয়ে গেল, চাচা। বেশ চলছিল…।’
‘সে কথা চিন্তা করি না, বাপ। আল্লা যখন প্যাট দিইচে, না খেতে পেয়ে মরবুনি। এই সিজেনে চাল কুটে যা পয়সাকড়ি হতো, তা দিয়ে তিন মাস হেলেদুলে চলে যেত। এখন একটু কষ্ট হবেক, এই যা!’ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মকছেদ চাচা। ‘উঠে গেল ভালোই হলো। এমনিতেই উঠে যেত। আমার তো ছেলেপুলে নাই, বাপ। থাকলেও এখনকার ছেলেপুলেরা এসবের কদর বুঝে!’
‘এটা খাঁটি কথা। তবে তোমার ছেলে থাকলে তাহের সেখের আগেই মেশিন কিনে নিত।’
আমার কথা শুনে মকছেদ চাচা এবার হাসল। জানি না মন থেকে হাসল, নাকি জোর করে মুখে হাসি আনার চেষ্টা।
‘তবে বাপ, মেশিনে যতই সুবিধে হোক, ঢেঁকিতে কুটা চালের পিঠের মতো স্বাদ আর কুথাও পাবে নাই।’
চাচি চা করে চলে এসেছে। কথাটা বলেই ফেললাম, ‘চাচি, একটা কথা বলছি তুমাকে, বোরোতে জমিগুলো তো লোককেই দিই চাষ করতে, ঠিকঠাক ভাগও দেয় না। যদি পারো বেলতলার মাঠে বিঘে দুই বোরো ধান লাগাও। ঘরগোড়ায় জমি একটু দেখভাল করে যদি পারো…। এইভাবে কী করে চলবেক?’
চাচা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল। ‘দেখো গো, মাস্টার মাস্টারের মতো কথা বলছে। চাষবাস করতে মেয়েমানুষে কি পারে রে বাপ! মোসলমানের মেয়ে মাঠে গেলে গাঁয়েতে ঢিঢি পড়ে যাবেক নাই? একসময় আমি কত চাষ করেছি। এখন আর খাটার শরীর কুথায়!’
সূর্যটা লাল টকটকে হয়ে বিদায় বেলার আলো ছড়াচ্ছে। প্যাঁক প্যাঁক করে দশ-বারোটা হাঁস ছুটে এসে উঠোনে চিল্লাতে লাগল। চাচির পোষা হাঁস। খাবার খাওয়াতে গেল।
আমিও উঠে পড়লাম। পায়ে পায়ে হেঁটে ঢেঁকিশালের ভেতর ঢুকলাম একবার। মেঝেটা ঝকঝকে করে ছুঁই দিয়ে রেখেছিল চাচি। তেঁতুল কাঠের ঢেঁকিটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে ঘরের এক কোণে। চাচা রেগে সরিয়ে দিয়েছে। ঢপাক ঢপ, ঢপাক ঢপ…কোথায় হারিয়ে গেল শব্দটা? এই শব্দে ঢেঁকিশালটা কি আর জেগে উঠবে না? চিরঘুমে ডুব দিয়েছে? চালার দিকে মুখ তুলে দেখলাম ‘শিকলনড়িটা’ পর্যন্ত খুলে দিয়েছে। দুলেহার চাচি যখন পাড় দিত, তখন এক হাতে শিকলনড়িটা ধরে টাল সামলাত নিজের। বুকের ভেতরটা কেমন আনচান করতে লাগল। কয়েক শ বছরের পুরোনো একটা ঢেঁকিশাল একনিমেষেই বন্ধ করে দিল একটা মেশিন! কাঠের ঢেঁকিটা করুণভাবে চেয়ে আছে। মকছেদ চাচার সঙ্গে ঢেঁকিটার কোনো তফাত খুঁজে পেলাম না। দুটোই এখন অকেজো!