:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মশিউল আলম

কথাসাহিত্যিক

পানপর্ব ১৯৯১
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

পানপর্ব ১৯৯১

যে দেশে তাপমাত্রা শূন্যের ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নেমে যায়, সেই দেশে আজ তা উঠেছে শূন্যের ৩০ ডিগ্রি উপরে। সারা দুপুর বোতলের পর বোতল ঠান্ডা বিয়ার খেয়ে এখন প্রায় বেহুঁশ। খালি বোতলগুলো সারা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
কতগুলো? গুনে শেষ করতে পারছি না। মনে হচ্ছে আটটা, তারপর মনে হচ্ছে ষোলোটা, তারপর মনে হচ্ছে বত্রিশটা। ফ্রিজটা খালি হয়ে গেছে। অনিমেষ কী উপলক্ষে অতগুলো বিয়ারের বোতল কিনে এনে ফ্রিজে সাজিয়ে রেখেছিল আমি জানি না। কিন্তু জানি, ফিরে এসে ও যখন দেখতে পাবে সব বোতল খালি হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তখন ঠোঁট চেপে হাসবে। কারণ, এইভাবে আমার নীতিভ্রষ্ট হওয়ার, আমার পতনের, আমার পাপের, আমার ভণ্ডামির দৃষ্টান্ত দিন দিন বাড়তে দেখে ওর নিজেকে বিজয়ী-বিজয়ী মনে হবে। ও মনে করার সুযোগ পাবে যে আমরা নীতিবাগীশ কমরেডরা নীতিহীন স্পেকুলান্তদের কাছে শুধু হেরেই যাইনি, অনেকটা বেঁচেও আছি ওদের অনুগ্রহেই। ওরা আমাদের অঢেল অনুগ্রহ দেখাতে পারছে খুবই সস্তায়: এখানে এখন চব্বিশ বোতল বিয়ারের দাম শ খানেক রুবল হলে তিন মার্কিন ডলারও হয় না।
অনিমেষদের সব হিসাব-নিকাশ এখন মার্কিন ডলারে।

সুতরাং আমার দরদি রুমমেট তার ফ্রিজ খালি করার দোষে আমার প্রতি একটুও বিরূপ হবে না। বরং উল্টা, আমি যদি ওকে বলি বিয়ারগুলো মনে হয় ভেজাল ছিল, এক বোতল ভোদকা নিয়ে এসো, গলা পর্যন্ত খেয়ে আজ মাতাল হই, তাহলে ও হেসে বলবে, ‘এখন থাক, সন্ধ্যাবেলা খাইয়েন।’
সন্ধ্যায় সে হাফ লিটারের হলেও এক বোতল স্মিরনোফ অবশ্যই আনবে। রুশিদের তৈরি স্তালিচনায়া কিংবা মস্কোফ্স্কায়া ভোদকা নয়। এই সব দেশি মাল অনিমেষরা এখন আর ছোঁয় না। যা কিছু সোভিয়েত, তাতেই ওরা এখন নাক সিটকায়। যা কিছু বিলাতি বা আমেরিকান, যা কিছু ইউরোপীয়, তাতেই ওদের আকর্ষণ, তাতেই প্রেস্টিজ।
সুতরাং অনিমেষ আমার জন্য ব্রিটিশ ভোদকা স্মিরনোফ আনবে। সিগারেট চাইলে ওভারকোটের পকেট থেকে বের করে দেবে রথম্যানস, ডানহিল, মার্লবরোর প্যাকেট।

আমি যখন যা চাই, অনিমেষ তাই এনে দেয়। কিন্তু আমি জানি, ওর এই উদারতা সরল নয়। বরং এটা ওর একটা কৌশল। আসলে আঘাত। এইভাবে ছদ্মমধুর আঘাত হানতে হানতে সে আমাকে ভুল আর নিজেকে সঠিক প্রমাণ করছে বলে মনে মনে সুখ পায়।
নইলে আমি যখন ওকে বলি এসব চোরাকারবারি আর কোরো না, অন্তত ডলার কেনাবেচার মতো মর্যাদাহানিকর ও বিপজ্জনক ব্যবসাটা বন্ধ করো, তখন আমার কথা গায়ে না মেখে কেন নীরবে শুধু হাসবে?
যখন আমি খেপে যাব, যখন আমার কথাবার্তা সে একদমই আমলে নিচ্ছে না দেখতে পেয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করব, তখন সে ব্যাখ্যা করে আমাকে বোঝাতে চাইবে যে গর্বাচভের নড়বড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে, ইয়েলৎসিনের স্বপ্নচারী রাশিয়ায় কোনো ব্যবসাই এখন আর চোরাকারবারি নয়। আসলে চোরাকারবারি বলে কিছু নাই, সব ধরনের আর্থিক কারবারই হলো ব্যবসা। সে আমাকে বলবে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আমাকে মানুষ হওয়ার জন্য মস্কো পড়তে পাঠানোর সময় যেসব সদুপদেশ আমার অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন, এখন সেগুলো মুছে ফেলা দরকার। কারণ, ওই নেতাদের ছেলেমেয়েরাই এ দেশে এসে সব সদুপদেশ ভুলে গেছে। নেতারা নিজেরাও যখন এ দেশে অতিথি হয়ে এসেছেন, গোপনে ডলার ভাঙিয়েছেন চোরাবাজারে; সোভিয়েত আইনে কী লেখা আছে তাতে তাঁদের কিচ্ছু যায় আসেনি।

অনিমেষ অসতর্ক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মার্ক্স ও লেনিনের নাম উচ্চারণ করে আমাকে বলবে বাস্তব জীবনে তাঁদের ইউটোপিয়ার কানাকড়ি দাম নাই। বলবে, তত্ত্বকথায় যে জীবন চলে না এটা সবাই বোঝে, বুঝি না শুধু আমি। একপর্যায়ে সে এমন কথাও বলে বসবে, ‘আপনি মন দিয়ে লেখাপড়া করে দেশে ফিরে গিয়ে হবেন নীতিনিষ্ঠ সাহসী সাংবাদিক, আর আমি দেশে ফিরব নীতি-নিরপেক্ষ রুপার্ট মারডক হয়ে।’
এ রকম সাংঘাতিক কথা বলতে বলতে সে হাসবে; তার হাসি দেখে আমার পিত্তি জ্বলে যাবে এবং আমার চোখমুখ দেখে সেটা সে বুঝতে পারবে। তখন সে আমাকে আরও উত্তেজিত করার মতলবে আরও প্রসারিত হাসি হেসে বলবে, ‘আমার নিউজপেপারেই আপনি চাকরি করবেন। আমি আপনাকে সম্পাদক বানাব।’
ওই মুহূর্তে আমার ওকে মারতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু তা তো করা যায় না, তাই আমি ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেব। ওর মুখের দিকে আর তাকাবই না। এভাবে হয়তো চলবে টানা তিন দিন, কিংবা পুরা এক সপ্তাহ। সেও আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করবে না; শুধু মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে দেখবে, আমাকে আমার ক্ষোভ ও ক্রোধ উপভোগ করার সুযোগ দেবে।
এই অবস্থা যদি এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তাহলে এক সন্ধ্যায় সে ভালো কিছু খাবারদাবারের আয়োজন করবে। হয়তো পোলাও রাঁধবে, কোরমা বানাবে, গরুর মাংস ভুনা করবে, কুবানের স্টার্জন মাছ ফ্রাই করবে, আর কিনে আনবে ককেশাসের সুস্বাদু রেড ওয়াইন কাগোর, ব্রিটিশ ভোদকা। একাই সব কাটাকুটি করবে, পেঁয়াজ-রসুন ছুলবে, ধোয়াধোয়ি করবে। আমাকে কিছুই করতে বলবে না, যেন আমি তার ঘরে এসেছি অতিথি হয়ে।
রান্না শেষ হতে হতে দু-চারজন বন্ধুবান্ধব এসে জুটবে; স্বদেশি বন্ধু, সিনিয়র বা জুনিয়র ভাই। অনিমেষ হয়তো তাদের আগেই বলে রাখবে। কিন্তু ভোজের উপলক্ষটা কী তা সে তাদের বলবে না, আমাকেও বুঝতে দেবে না যে তার এই আয়োজনের মতলব আসলে আমার মান ভাঙানো।
অন্যরা এলে আমি তাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কুশল বিনিময় ও গল্পগুজব শুরু করব; ওরা বুঝতেই পারবে না যে অনিমেষ আর আমার মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ আছে। স্বাভাবিকভাবেই অনিমেষও আমাদের গল্পে যোগ দেবে এবং একসময় ওর সঙ্গে আমার কথা বলা আবার শুরু হবে। আমি যে ইচ্ছা করেই আগের কয়েক দিন ওর সঙ্গে কথা বলিনি, তা অন্য কেউ বুঝতে পারবে না।
তারপর আমাদের খাওয়াদাওয়া শুরু হবে, চলবে মদ্যপান। একটার পর একটা ওয়াইনের বোতল শূন্য হতে থাকবে; কোত্থেকে ভোদকা, কনিয়াক, হুইস্কির বোতল বের হতে থাকবে আমি বুঝতেই পারব না। কখন যে সব হাঁড়ি-পাতিল উজাড় হয়ে যাবে, আমরা টেরই পাব না। আমাদের মুখে কথার তুবড়ি ছুটবে, কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে যাবে। এসবের মধ্যে হয়তো হঠাৎ আবিষ্কার করব, আমাদের মধ্যে কেউ একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিন্তু আমরা তাকে গুরুত্ব দেব না। প্রতিটা মদের আসরেই এ রকম ঘটে: দু-একজন গোপন দুঃখে কান্নাকাটি করে, জীবনে কিছুই হলো না বলে আফসোসে বুক চাপড়ায়।

তারপর আমাদের খাওয়াদাওয়া শুরু হবে, চলবে মদ্যপান। একটার পর একটা ওয়াইনের বোতল শূন্য হতে থাকবে; কোত্থেকে ভোদকা, কনিয়াক, হুইস্কির বোতল বের হতে থাকবে আমি বুঝতেই পারব না। কখন যে সব হাঁড়ি-পাতিল উজাড় হয়ে যাবে, আমরা টেরই পাব না। আমাদের মুখে কথার তুবড়ি ছুটবে, কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে যাবে। এসবের মধ্যে হয়তো হঠাৎ আবিষ্কার করব, আমাদের মধ্যে কেউ একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিন্তু আমরা তাকে গুরুত্ব দেব না।

সুতরাং কেউ কান্নাকাটি করলে আমরা ভ্রুক্ষেপ করব না। টাকাপয়সার গল্প শুরু হবে। আমি বিরক্ত হয়ে বলব, এই দেশে আমরা এসেছি টাকা বানাতে নয়। টাকার পেছনে ছোটা আমাদের জন্য লজ্জার ব্যাপার।
যারা এই দেশে পড়াশোনা করতে এসে টাকার পেছনে ছুটত, এক সময় তাদের সঙ্গে আমরা অনেক ঝগড়া করেছি, আমরা তাদের ঘৃণা করেছি। বিশেষ করে সিপিবির কোটায় বৃত্তি নিয়ে এসে যারা গোপনে ব্যবসার পথে পা বাড়াত, আমরা তাদের বেইমানি সইতেই পারতাম না। আমরা তাদের শত্রু ঘোষণা করতাম। তাদের অনেককেই আমরা পিটিয়েছি।
অধ্যাপক সাহেবের ন্যাপের কোটায় বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসে যারা এসব করত, আমরা তাদের ঘৃণা করতাম, কিন্তু বেশি কষ্ট পেতাম না। কারণ, ওরা কী করবে না করবে তাতে তো সিপিবির কোনো দায় নেই। আমরা ভাবতাম, ওরা তো আমাদের নয়। আমরা মনেপ্রাণে চেয়েছি, যে শয়তানগুলা এভাবে টাকার পেছনে ছোটে, তাদের যেন এই দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়।
কিন্তু কে তাদের বের করে দেবে? এখানে আমাদের চেয়ে বরং ওদের কদরই বেশি। অবাক ব্যাপার, এই দেশে এসে দেখতে পেলাম, ভোগ-লালসার ব্যাপারে পুঁজিবাদী সমাজের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক সমাজের কোনো পার্থক্য নাই। টাকার কদর দুই সমাজেই সমান। বরং সমাজতান্ত্রিক সমাজে নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর জৌলুশ এতই কম যে একটা চামড়ার জ্যাকেটের জন্য, একটা জিন্স প্যান্টের জন্য এখানকার ছেলেমেয়েগুলো কী নির্লজ্জ রকম লালায়িত!

না, ভুল বললাম। একসময় সবাই ওরকম ছিল না। বরং পোশাক-পরিচ্ছদে যারা নিরাভরণ, জীবনযাপনে যারা মিতাচারী, তাদের সবাই সম্মানের চোখে দেখত। পোশাকের জাঁক যারা দেখাত তাদের ব্যাপারে সন্দেহ ছিল। ফুটানির কোনো মূল্য ছিল না।
কিন্তু দেখতে দেখতে সব বদলে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, এমনকি অধ্যাপকদের কাছেও এখন অনিমেষদের কদরই বেশি। যার টাকা আছে, সেই আসলে ক্ষমতাধর। এই সমাজতান্ত্রিক দেশেও।
শুধু এখনকার কথা নয়, আমার বিশ্বাস, পিরিস্ত্রোইকা শুরুর আগেই, কঠোর সমাজতন্ত্রের দিনেও ভেতরে ভেতরে এই নিয়মই চালু ছিল। তাই বুঝি মণি সিংহ এ দেশ সফরে এসে সোভিয়েতদের আচার-ব্যবহারে হতাশ হয়েছিলেন। তিনি বিলাসী খাবার পছন্দ করতেন না। ক্যাভিয়ার পছন্দ করতেন না। স্বাদ ভালো লাগত না বলে নয়, দামি খাবার বলে। আলিশান কারবার তাঁর পছন্দ ছিল না। সোভিয়েত কমিউনিস্ট আমলাদের মধ্যে মণি সিংহ উন্নত মানবসত্তার পরিচয় পাননি। আক্ষরিক অর্থেই এরা বস্তুবাদী, বস্তুর পূজারি।
অনেক সময় ভেবেছি, জমিদারপুত্র মণি সিংহ সমস্ত আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে কঠিন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন কেন? শুধুই মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা সমাধান করার জন্য? সব ভুখা-নাঙ্গা মানুষের জন্য খাদ্য আর বস্ত্রের বন্দোবস্ত করার জন্য? না, এইটা চূড়ান্ত স্বপ্ন নয়। বস্তুগত প্রাচুর্য সৃষ্টি করা আর সেই প্রাচুর্যের সমবণ্টন সমাজতন্ত্রের শেষ লক্ষ্য নয়। মনের দিক থেকে মানুষ আরও উন্নত হবে, দেহ আর রিপুসর্বস্ব প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে উঠবে আত্মাবান জীব। ভালোবাসবে, চিন্তাশীল হবে। মানুষ সুন্দর হবে। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন হওয়া উচিত ছিল এ রকম…।

কিন্তু এভাবে অকারণে একা একা মদ খাওয়া কি ভালো? আমি কি তবে অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছি? আগে তো উপলক্ষ ছাড়া মদ খেতাম না। কারও জন্মদিনে, কারও থিসিস ডিফেন্ড করার দিনে খাওয়াদাওয়ার আসরে হাজির হলে মদ খেতে হতো। ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। লুকিয়ে লুকিয়ে কত মদ ফুলের টবে আর জানালার বাইরে ফেলে দিয়েছি। অত খাওয়া যায় নাকি? যে পানীয়র গন্ধ নির্ভেজাল স্পিরিটের মতো, যা খেতে মোটেই স্বাদু নয়, সেই ভোদকা দশ-বারো মিনিট পরপর ৫০ মিলিগ্রাম করে নির্জলাই গলায় ঢেলে দিতে হবে, এর চেয়ে বড় অত্যাচার আর হয় নাকি?
যে বস্ত্ত নিষিদ্ধ নয়, হাত বাড়ালেই যা পাওয়া যায়, দামও যার বড়ই কম, তার প্রতি আকর্ষণ থাকে না। তা ছাড়া বন্ধুদের চাপে পড়ে যে পদার্থ মাত্রাতিরিক্ত পান করার ফলে মরার দশা হয়, মনে হয় যে এবারের মতো বেঁচে গেলে আর জীবনে ছুঁয়েও দেখব না, যে পানীয় পান করার ফলে পরদিন সকালে জগৎ বিস্বাদ মনে হয়, দিনটাই মাটি মাটি লাগে, তা মোটেও লোভনীয় পানীয় নয়।
কিন্তু এখন আমি একা একা মদ খাই কেন?

বাইরে সুন্দর বিকেল। বার্চবনে হাওয়া বইছে। পাতার মর্মর শোনা যাচ্ছে। এখন তো প্রফুল্ল দেহমনে বেড়াতে যেতে পারতাম। সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না। এখন আমার একা থাকতেই বেশি ভালো লাগে। কারও সঙ্গে কথা বলে আরাম পাই না। আসলে কথা কিছু নাই। সব কথা শেষ হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে সব সম্পর্ক। অনিমেষের সঙ্গেও আমার সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন সে আমাকে পরিহাস করে আর আমার মনে তার জন্য কাজ করে গোপন ঘৃণা। কিন্তু ঘৃণাটাও বড় অদ্ভুত। সময় পেলে এখনো সে আমাকে রেঁধে-বেড়ে খাওয়ায়। আমিও খাই আগের মতোই। আমি তার পালতোর পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুঠোভর্তি রুবল বের করে আনি, অথচ জানি এই রুবল ডার্টি ফিল্দ, এ স্পর্শ করা আমার উচিত নয়। কিন্তু ওই রুবলে আমি মদ সিগারেট কিনে খাই। ঘৃণা কাজ করে ভেতরে ভেতরে, তবু আমি অনিমেষের এক ঘরে থাকি। সে হয়তো এখনো আমাকে ভালোবাসে, যতই ভাবুক আমার নৈতিকতা অর্থহীন ঠুনকো জিনিস।

২.
দরজায় টোকা। খুলে দেখি, শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের অ্যাসিসট্যান্ট ডিন কনস্তান্তিন কাভালিওভ। সম্ভাষণ জানিয়ে সসম্মানে ভেতরে ডাকলাম। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে মেঝেতে ছড়ানো বিয়ারের খালি বোতলগুলো দেখে ভুরু কোঁচকালেন, তারপর প্রশ্নবোধক চোখে তাকালেন আমার মুখের দিকে। আমি হেসে তাঁকে বোঝাতে চাইলাম যে আমি ঠিকঠাক আছি। তিনি অনিমেষের ডিভানে বসলেন। রুশিরা জানে, শুধু বিয়ার খেয়ে মাতাল হওয়া যায় না।
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি চা খাবেন কি না। তাঁর শুকনো মুখে উৎসাহের অভাব দেখা গেল। বুঝলাম, বেচারা খাদ্য চায়।
কিন্তু আমার ঘরে এখন খাবার বলতে তেমন কিছু নেই। ফ্রিজ খুলে দুটো আপেল বের করলাম। তা দেখে ভদ্রলোকের ক্ষুধার্ত চোখমুখে কোনো উৎসাহের সাড়া জাগল না। তিনি নিশ্চয়ই রুটি-মাখন-সজেস প্রত্যাশা করছেন। কিন্তু ওসবের কিছুই নেই। কে কিনবে? অনিমেষ তিন দিন ধরে লাপাত্তা। আমার খাওয়াদাওয়া চলছে ক্যানটিনে।
একখণ্ড রুটি আছে ফ্রিজের মাথায়। তিন দিন আগে কেনা হয়েছিল, খাওয়া হয়নি। এখন ওটা শুকিয়ে কাঠ, দেয়ালে পেরেক পোঁতার কাজে ব্যবহার করা যাবে।
আপেল কেটে দিলাম, কেটলিতে পানি বসালাম। কাভালিওভ এক টুকরো আপেল তুলে নিয়ে কামড় দিয়ে জানতে চাইলেন বিয়ার অবশিষ্ট আছে কি না। আমি নিশ্চিত নই। ফ্রিজ খুললাম, দেখি একটাও নাই। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটা ভোদকার বোতল আছে! স্মিরনোফ। ব্রিটিশ ভোদকা। অনিমেষের কেনা। ওরা এখন আর সোভিয়েত মদ-সিগারেট খায় না। একদিন দেখলাম নতুন খোলা আইরিশ ফুডের দোকান থেকে সসেজ আর মেয়োনেজ কিনে এনেছে। মস্কোর আনাচকানাচে অনেক পশ্চিমা দেশের দোকানপাট খোলা হয়েছে। মাখন, পনির, সসেজ, মেয়োনেজ ইত্যাদি বিক্রি করছে তারা। কিন্তু আমার মোটা জিব ওগুলোতে কোনো স্বাদ পায়নি। সোভিয়েত মেয়োনেজের মতো মেয়োনেজ আর হয়ই না। সসেজও সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরিগুলোই সবচেয়ে উপাদেয়।

ঝুলিটা হাতড়ে নিয়ে কাঁধে ফেলে উঠে পড়লেন। এমনভাবে টলে উঠলেন, যেন তাঁর পায়ের তলার মাটি নড়ছে। অবশ্য পরক্ষণেই সামলে নিয়ে মলিন হেসে বললেন, ‘ভালো ছেলে তুমি। অনিমেষও ভালো ছেলে। মেঝিনস্কিও ভালো মানুষ। আমি যে তোমার ঘরে এসেছিলাম, ওকে বলো না কিন্তু। তোমরা সবাই ভালো। শুধু আমিই খারাপ। আমিই শুধু নষ্ট হয়ে গেছি। কোনো আদর্শ আর নাই, কোনো স্বপ্ন আর নাই। আমি মরে যাব। শিগগিরই আমি মরে যাব। দাসবিদানিয়া।’

স্মিরনোফের বোতল কাভালিওভের নজর পড়ল। চকচক করে উঠল তাঁর দুই চোখ। আপেলে বড় একটা কামড় বসিয়ে কসমস শব্দে চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘ভোদকা দে। আরও আপেল বের কর।’
কিন্তু ফ্রিজে আর আপেল নাই। আমি টেবিল থেকে একটা পানি খাওয়ার গ্লাস টেনে নিলাম। একটুখানি মদ ঢাললাম। রুশ দেশে মদ খাওয়ার কোনো মাপজোখ নাই। পেগ বলে কিছু জানে না এরা। ইচ্ছামতো পরিমাণে ঢেলে নেয়। খায় এক ঢোঁকে। গলায় দেওয়ার আগে শিৎ শব্দ করে শ্বাস নেয়। তারপর ঢক করে পুরোটাই গলায় ঢেলে দেয়। তারপর কাঁচা আপেল, ভিনেগারে চোবানো টক শসা, নোনতা মাছ, এসব জাকুস্কা চিবায়। এমনি করে এক লিটারের পুরো একটা বোতল এক বৈঠকে শেষ করে ফেলতে পারে দুজনেই।
কাভালিওভ ভদ্রতা করে জানতে চাইলেন, মদ্যপানে আমি তাঁকে সঙ্গ দেব কি না। আমি বললাম সারা দুপুর ধরে অনেক বিয়ার খেয়েছি, এখন আর ভোদকা খাব না। কিন্তু তিনি নাছোড়। মদ খাওয়ার সময় সব রুশিই এ রকম। খাওয়াদাওয়ার বেলায় আরব আর আফগানরা যেমন। কোনো আরব, কোনো আফগান কারোর সামনে একা খাবার খেতে পারে না। প্রস্তুতি অনুষদে আমার তিন রুমমেটের একজন ছিল মোহাম্মদ হার্ব, লেবাননের ছেলে। ঘরে যখনই সে খেতে বসত, আমাকেও তার সঙ্গে খেতে হতো। আর এখানে পাশের ঘরের আফগানিস্তানের আজিজ মোহাম্মদ তো প্রায়ই রান্না শেষ করে খেতে বসার আগে আমার দরজায় টোকা মারত। অবশ্য এখন আর ডাকে না, দুর্দিন চলছে।

কাভালিওভের সঙ্গে যোগ না দিয়ে পারা গেল না। স্রেফ সঙ্গ দিতে আর একটা গ্লাসে একটুখানি ভোদকা ঢেলে নিলাম। কিন্তু চুমুক দিতেই বড় বিশ্রী লাগল। গা-মাথা গুলিয়ে উঠল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
বছর তিনেক আগে এ রকম ব্যাপার কল্পনাই করা যেত না। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিন মহাশয় সন্ধ্যাবেলা ছাত্রের ঘরে এসে মদ খাচ্ছেন? কী শাস্তি হতো তাঁর?
‘কনস্তান্তিন কনস্তান্তিনোভিচ, আগে কি আপনি কোনো ছাত্রের ঘরে গিয়ে এভাবে মদ খেতে পারতেন?’ আমি নিঃসংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম।
সহকারী ডিন সাহেব কিছু বললেন না। এমন ভঙ্গিতে হাসলেন যে তা দেখে আমার মনে হলো, ভদ্রলোকের সব ব্যক্তিত্ব ধুলায় মিশে গেছে। তিনি ভুলে গেছেন যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মস্কো সিটি কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তা না হলে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগের ডিন হতে পারতেন না।

নিজেই গ্লাসে মদ ঢেলে নিলেন। গ্লাসের প্রায় অর্ধেকটা ভরে উঠল ভোদকায়। ঢক ঢক করে তিন ঢোঁকে গিলে ফেললেন পুরোটা, তারপর গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘তোমার রুমমেট কোথায়?’
আমি জানি, ভদ্রলোক আসলে টোকা দিয়েছিলেন অনিমেষের দরজায়। অনিমেষ তাঁকে মদ খাওয়ায়, হয়তো কিছু উপহার-টুপহারও দেয়। নইলে তিনজনের ঘরে আমরা দুজন বাস করার অনুমতি পেলাম কী করে।
হঠাৎ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কনস্তান্তিন কনস্তান্তিনোভিচ, আপনি আমার ঘরে বসে মদ খাচ্ছেন, কতৃর্পক্ষ জানতে পেলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না তো?’
তিনি হেসে বললেন, ‘কে তোমার ক্ষতি করতে আসবে? তাকেও মদ খাইয়ে দিয়ো গলা পর্যন্ত।’
আবার গ্লাসে মদ ঢেলে নিলেন। ফ্রিজের মাথায় শুকনো রুটির দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘ওটা নিয়ে এসো, খাওয়ার চেষ্টা করে দেখা যাক।’
আমি কাঠের মতো শক্ত পাউরুটির খণ্ডটা নিয়ে করাতের মতো রুটি কাটা ছুরি দিয়ে কাটার চেষ্টা করতে লাগলাম। কড়মড় শব্দ উঠল, ধুলার মতো রুটির চূর্ণ ঝরে পড়ল ছুরির দুই পাশ দিয়ে। রুটির স্লাইস না হোক, দুটো টোস্ট বিস্কিট দেওয়া গেল তাঁকে। তিনি কড়মড় করে চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘গরিব হয়ে গেলাম, তোমাদের ঘরে এসে একটু খানাপিনা করলে কি মহাপাপ হয়ে যাবে আমার?’
রক্ষা করো আল্লাহ! পাত্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্টোরি-ফিলোলজি ফ্যাকাল্টির একজন সহকারী ডিন, একজন অধ্যাপক, এই কথা বলছেন তৃতীয় বিশ্বের এক গরিব দেশ থেকে বৃত্তি নিয়ে আসা এক ছাত্রের ঘরে এসে।
‘পিরিস্ত্রোইকা শেষ হতে হতে আমরা মরে যাব। সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন আমেরিকার মতো প্রাচুর্য আসবে, তত দিনে আমাদের কবরে ঘাস গজিয়ে যাবে। যে কটা দিন বেঁচে আছি, তোমাদের ঘরে এলে একটু খেতে-টেতে দিও।’
টোস্ট বিস্কিটে রূপান্তরিত রুটির টুকরো চিবুতে চিবুতে পরিহাসের মলিন হাসি ফুটে উঠল কাভালিওভের মুখে। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। ক্যাম্পাসের ক্যানটিন বন্ধ হতে আরও আধঘণ্টা বাকি।
‘আমার ঘরে তো এখন আর কিছু নাই। চলুন, ক্যানটিনে যাই।’
‘স্পাসিবা দারাগোই। ক্যানটিনে খাওয়ার পয়সা আমার আছে। কিন্তু তোমার মদ শেষ করে ফেলছি না তো?’
বোতলের দিকে চেয়ে দেখলাম, প্রায় অর্ধেকটা খালি হয়ে গেছে। আধা লিটার ভোদকা এরই মধ্যে গিলে ফেলেছেন ভদ্রলোক। খালি পেটে আর খাবেন না, স্যার—আমি বলতে চাই। কিন্তু বলি না। আমি আরও বলতে চাই, বোতলটা সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু তা-ও বলতে পারি না। যদি লোভ ধরে যায়? যদি প্রতি সন্ধ্যায় এসে হানা দিতে আরম্ভ করেন?

‘ধন্যবাদ, কী যেন নাম তোমার? অনেক ধন্যবাদ। এখন যেতে হয়। ঘর অনেক দূর। ভালো থেকো। বেশি মদ খেয়ো না। পড়াশোনা ভালোভাবে করো।’
ঝুলিটা হাতড়ে নিয়ে কাঁধে ফেলে উঠে পড়লেন। এমনভাবে টলে উঠলেন, যেন তাঁর পায়ের তলার মাটি নড়ছে। অবশ্য পরক্ষণেই সামলে নিয়ে মলিন হেসে বললেন, ‘ভালো ছেলে তুমি। অনিমেষও ভালো ছেলে। মেঝিনস্কিও ভালো মানুষ। আমি যে তোমার ঘরে এসেছিলাম, ওকে বলো না কিন্তু। তোমরা সবাই ভালো। শুধু আমিই খারাপ। আমিই শুধু নষ্ট হয়ে গেছি। কোনো আদর্শ আর নাই, কোনো স্বপ্ন আর নাই। আমি মরে যাব। শিগগিরই আমি মরে যাব। দাসবিদানিয়া।’
মেঝেতে ছড়ানো খালি বোতলগুলো তাঁর পায়ের আঘাতে টুং টাং শব্দ করে গড়াগড়ি আরম্ভ করল। টলোমলো পায়ে বেরিয়ে গেলেন কনস্তান্তিন কনস্তান্তিনোভিচ কাভালিওভ। আমার ঘরজুড়ে এক গভীর বিষণ্নতা নেমে এল। স্মিরনোফের অর্ধেক খালি বোতলটা টেবিলের মাঝখানে নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল।

৩.
দরজাটা বন্ধ করা হয়নি। কাভালিওভ বেরিয়ে যাবার সময় টেনে দিয়ে গেছেন, এখন সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। ওই ফাঁক দিয়ে কেউ একজন উঁকি মারল। উঠে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা রুশ লোক। চেনা চেনা লাগল, মনে মনে একটু হাতড়াতেই চিনে ফেললাম। গালভাঙা ছোটখাটো আমলার মতো চেহারার এই লোকটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো পাশের দরজিখানার কাটার মাস্টার ছিল।
সে কোনো সম্ভাষণ না করে আমার ঘরের মেঝেতে ছড়ানো শূন্য বোতলগুলোর দিকে চেয়ে আছে।
‘কী ব্যাপার?’ আমি বললাম।
‘ওগুলো নিতে পারি?’
‘কেন?’
‘বিক্রি করব।’
‘কেন? আপনার দরজিগিরির কী হলো?’
‘বেতন কম। কী রকম ইনফ্লেশান হয়ে গেছে দেখছেন না?’
আমার মনের মধ্যে একটা নিষ্ঠুর মতলব জেগে উঠল। আমি তাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে অনিমেষের ডিভানে বসালাম। তার মুখভঙ্গি লক্ষ করে দেখতে লাগলাম। সে হয়তো ভাবছে আমি তাকে চা সাধব, রুটিমাখন খেতে দেব। কিন্তু না, আমি তাকে পেয়ে বসেছি। বছর তিনেক পর।
‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘না তো!’
‘মনে করার চেষ্টা করুন। বছর তিনেক আগে আপনি আমাকে আপনার দরজিখানা থেকে বের করে দিয়েছিলেন।’
‘হতেই পারে না। কেন আমি আপনাকে বের করে দেব?’
‘কারণ, তখন সমাজতন্ত্র ছিল, শ্রমিকরাজ ছিল।’
‘বুঝলাম না, কী বলছেন এসব?’
‘আমি আপনার কাছে একটা প্যান্ট বানিয়ে নিতে গিয়েছিলাম। তখন ছিল শীতকাল। আমার পরনে ছিল আন্ডারগার্মেন্ট, শার্ট, তার ওপর মোটা সোয়েটার ইন করে পরে তার ওপর পরেছিলাম ওভারকোট। আপনি যখন আমার প্যান্টের মাপ নিচ্ছিলেন, তখন আমি শুধু আপনাকে বলেছিলাম, মোটা কাপড়চোপড় পরে আছি, মাপটা একটু টাইট করে নেবেন। আর ব্যস, তাতেই আপনার ইজ্জতে লেগে গেল। আপনি আমাকে বললেন, তুই আমাকে দরজিগিরি শেখাতে এসেছিস? আপনি আমার অর্ডারটা আর নিলেনই না। আমি সরি বললাম, আপনার হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করলাম, কিন্তু আপনি আমাকে বের করে দিলেন। কারণটা প্রথমে বুঝিনি। পরে বুঝেছি, আপনি চাকরি করেন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের, দিনে একটা প্যান্ট সেলাই করলে মাস শেষে যা বেতন পাবেন, দশটা করলেও তাই পাবেন। তাহলে দশটা প্যান্ট সেলাই করার দরকার কী? তাই না?’
লোকটা চুপ করে রইল।
আমি বললাম, ‘এই আপনার মতো লোকেরাই সমাজতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। এখন খালি বোতল কুড়িয়ে বেড়াতে খুব সুখ লাগছে, তাই না?’
লোকটার মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। সে বেশ দরকারি ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন বোতলগুলা কি আমি নিতে পারি?’
আমি জেদি সুরে বললাম, ‘না। আপনাকে দেব না। সেদিনের ঘটনার জন্য আপনি একবার সরিও বললেন না।’
এবার সে তড়বড় করে বলতে লাগল, ‘দুঃখিত, দুঃখিত। ওই দিন হয়তো কোনো কারণে আমার মেজাজটা ভালো ছিল না। হয়তো আগের রাতে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। আমার বউটা ছিল খুবই খারাপ। জীবনটা আমার একদম শেষ করে দিয়েছে। মাগি মরেছে, আমার আর এখন মেজাজ খারাপ হয় না। আসবেন, একটা কেন, দশটা প্যান্ট বানিয়ে দেব।’
‘ঠিক আছে, নিয়ে যান।’
বলামাত্র লোকটা উঠে বোতলগুলো কুড়োতে আরম্ভ করে দিল। একটা করে বোতল ঝুলিতে ভরতে ভরতে টেবিলে স্মিরনোফের বোতলটার দিকে আড়চোখে তাকাতে লাগল। তা দেখে আমার হাসি পেল।
সব বোতল ব্যাগে পুরে নেওয়ার পর লোকটা কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে হাসিমুখ দেখাল।
মনে মনে বললাম, এমন নির্লজ্জ সুরাপায়ী জাত কি পৃথিবীতে আর আছে? এরা বিপ্লব করেছিল কীভাবে?

ইয়োসেফ ভিসসারিওনোভিচ, আপনি ঠিকই বলেছিলেন: মানুষকে নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক কাজে বাধ্য করা যায় কেবল বল প্রয়োগের মাধ্যমে, যেমন প্রতিটা পশুকে তৃণভূমিতে নিয়ে যেতে হয় ঠেঙিয়ে। গর্ধবরা সোনা চায় না, খড় চায়।
মিখাইল সের্গেইভিচ, আপনি জানেন না অধিকাংশ মানুষই গর্ধব। আপনি ওদের ছেড়ে দিন, একেবারে মুক্ত করে দিন, দেখবেন ওরা নিজেদের জন্য খড়ের বন্দোবস্তও করতে জানে না।

তবু দয়া হলো। স্তো গ্রাম ঢেলে দিই। ঢক করে গলায় চালান করে দেয়। তারপর হাতের চেটোয় মুখ মুছে ধন্যবাদ বলে বোতলভরা ঝুলিটি কাঁধে ফেলে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। বেরোবার আগমুহূর্তে আমার মুখের দিকে ফিরে বলে, ‘আসবেন কিন্তু প্যান্ট বানাতে।’
তাতে সমাজতন্ত্র আর উদ্ধার হবে না। তোমাদের ওই দরজিখানা চলে যাবে ব্যক্তিমালিকানায়। ওটা নিয়ে নেবে কোনো দুর্নীতিবাজ কমিউনিস্ট আমলা। তার মর্জি হলে তোমাকে রাখবে, না হলে পাছায় লাথি মেরে দেবে তাড়িয়ে। তখন তোমার একমাত্র জীবিকা হবে ঘুরে ঘুরে খালি বোতল কুড়ানো। উৎপাদনের উপায় উৎপাদকের হাতে থাকতে নেই। তার মালিক হতে হবে অন্য কাউকে, তার হাতে থাকবে চাবুক। তবেই কেবল উৎপাদক কাজ করবে। এই হচ্ছে মানুষের স্বভাব। কার্ল মার্ক্স জানতেন না, সব সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র মানে আসলে কোনো মালিক নেই। আমরা দেখেছি, খোলা আকাশের নিচে বাঁধাকপি, আলু, বেগুন, টমেটো, শসা আর লাউয়ের স্তূপ পাহাড়ের মতো, সব পচে যাচ্ছে। ফেদিয়া, সাশ্কা, আন্দ্রেইউশকা, লিয়েন্কা, কাতিউসা, ভের্কা—সব হারামজাদা-হারামজাদিরা মদ খেয়ে গ্যাঁজাচ্ছে। বিকেল পাঁচটা বাজলেই ছুটবে ঘরের দিকে। মাস শেষে কেউ বেতনের এক পয়সাও কম পাবে না। ওগুলো পচে গেলে ওদের কিছু যায়-আসে না। উক্রাইনে বছরে যে পরিমাণ আলু আবাদ হয়, তার চল্লিশ পার্সেন্ট পচে যায় জমিতেই। কারণ, আলু তোলার জন্য পর্যাপ্ত লোক নেই। তারপর যে চল্লিশ পার্সেন্ট তোলা হয়, সেই দোকানের তাক পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে নষ্ট হয়ে যায় ৮৮ পার্সেন্ট। এই হিসাব দিয়েছেন স্বয়ং গেনসেক গর্বাচভ। তাঁর এই কথা আমাদের অবিশ্বাস হয় না।
ইয়োসেফ ভিসসারিওনোভিচ, আপনি ঠিকই বলেছিলেন: মানুষকে নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক কাজে বাধ্য করা যায় কেবল বল প্রয়োগের মাধ্যমে, যেমন প্রতিটা পশুকে তৃণভূমিতে নিয়ে যেতে হয় ঠেঙিয়ে। গর্ধবরা সোনা চায় না, খড় চায়।
মিখাইল সের্গেইভিচ, আপনি জানেন না অধিকাংশ মানুষই গর্ধব। আপনি ওদের ছেড়ে দিন, একেবারে মুক্ত করে দিন, দেখবেন ওরা নিজেদের জন্য খড়ের বন্দোবস্তও করতে জানে না।

৪.
নেভা নদী যে জায়গা থেকে ফিন উপসাগরের দিকে যাত্রা করেছে, সেখানে লাদোগা হ্রদের বুকে পাথরের এক দুর্গ বানিয়েছিলেন পিওতর ভিলিকি। নাম শ্লিসেলবুর্গ। মে মাসের ৫ তারিখ ভোর ছয়টার দিকে ছোট্ট একটি স্টিমার এসে ভিড়ল দুর্গের ঘাটে। নামানো হলো পাঁচজন কয়েদিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতে-পায়ে লোহার ডান্ডাবেড়ি। অতি সতর্কতার সঙ্গে তাদের একে একে নিয়ে যাওয়া হলো পাঁচটি আলাদা প্রকোষ্ঠে। দশ ফুট বাই দশ ফুট একেকটা প্রকোষ্ঠ, দেয়াল বরফের মতো সাদা। প্রতিটা দেয়াল তিন ফুটের বেশি পুরু। মেঝেতে পাথর। বাইরের কোনো শব্দ ভেতরে ঢুকতে পারে না।

৮ মে ভোর চারটায় পাঁচ তরুণের ফাঁসি। প্রথমজন ভাসিলি দ্মিত্রি গেনেরালভ, বয়স ২০ বছর, সাংকৎ পিতেরবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দ্বিতীয় জন দ্মিত্রি আন্দ্রেইউশকিন পাখোমি, বয়স ২১, কুবানের এক কৃষক পরিবারের সন্তান, পিতেরবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত-পদার্থবিদ্যা অনুষদের ছাত্র। ভাসিলি ওসিপানভ, ২৬, পিতেরবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ছাত্র। আলেকসান্দর উলিয়ানভ, ২১, স্কুল ইন্সপেক্টরের পুত্র, পিতেরবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পিওতর শেভিরেইয়েভ, ২৩, খারকভের এক ধনী বণিকের পুত্র, পিতেরবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
জার দ্বিতীয় আলেকসান্দরের আদেশ, এই পাঁচ তরুণকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে একই সময়ে। কিন্তু ফাঁসির মঞ্চ মাত্র তিনটা।
উলিয়ানভ আর শেভিরেয়েভ, অপেক্ষা করো।
পুরোহিত এগিয়ে এলেন, অন্তিম লেপন করবেন। তিন তরুণ একসঙ্গে মাথা ঝাঁকিয়ে খারিজ করে দিল পুরোহিতকে। গেনেরালভ আর আন্দ্রেইউশকিন একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘নারোদনায়া ভোলিয়া জিন্দাবাদ!’ ওসিপানভও ওদের সঙ্গে গলা মেলাতে চাইল, কিন্তু মাঝপথে জল্লাদের হাতের কালো মুখোশ ঝপ্ করে নেমে এল।
দুই কমরেডের চোখের সামনে ঝুলতে থাকল তিন সহযোদ্ধার প্রাণহীন দেহ। তারপর বাকি দুজনকে তোলা হলো ফাঁসির মঞ্চে। উলিয়ানভ ক্রুশে চুম্বন করল। শেরিভেয়েভ পুরোহিতকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। মুহূর্ত পরে দুটি প্রাণহীন দেহ ফাঁসিকাঠে ঝুলতে লাগল।
মে মাসের ভোরের নরম সূর্যের প্রথম কিরণরশ্মি বিদ্ধ করল তাদের দেহ।
২১ বছর বয়সী আলেকসান্দর উলিয়ানভের প্রাণহীন ঝুলন্ত দেহটির দিকে চেয়ে আমি লেনিনকে বললাম, ‘ভ্লাদিমির ইলিচ, এর প্রতিকার কী?’
লেনিন শান্ত স্বরে বললেন, ‘বিপ্লব!’

দরজা খুলে দেখি বিপ্লব দাঁড়িয়ে আছে। পিঠের রুকস্যাক খুলে হাতে নিয়ে বলল, ‘অনিমেষ কই?’
অনিমেষের বন্ধু এসেছে অনিমেষের কাছে, আমার কী? অনিমেষ কোথায় গেছে সে খবর আমাকে রাখতে হবে কেন? আমি তার সেক্রেটারি নাকি? আজ কিয়েভ থেকে, কাল খারকভ থেকে, পরশু রোস্তভ থেকে অনিমেষের বন্ধুরা এসে জুটছে। ব্যবসার খ্যাপ মারতে তারা যাওয়া-আসা করছে সিঙ্গাপুর, দুবাই, সারজা, ইস্তাম্বুল। আমাদের ঘরটাকে বানিয়েছে একটা হোটেল।
‘চিনতে পারেননি? আমি বিপ্লব, খারকভের!’
বাপ নাম রেখেছিল বিপ্লব, নিশ্চয় কম্যুনিস্ট বাপ। এখন সেই বিপ্লব হয়ে গেছে স্পেকুলান্ত। সিঙ্গাপুর যাচ্ছে, সওদাপাতি এনে এখানে বিক্রি করছে, ডলার বানাচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি। এরা কী করে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়ার জন্য বৃত্তি পেয়েছিল? মৈত্রী সমিতির হর্তাকর্তাদের টাকা দিয়ে? পার্টির ফান্ডে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে? সেই চাঁদার টাকা কে খেয়েছে কেউ জানে না, যে খেয়েছে শুধু সে ছাড়া।
ওই শালারা আমাদের ২৫ ডলারের বেশি একটা সেন্টও বেশি আনতে দেয়নি। বলেছে, ওদেশে তোমরা ডলার দিয়ে কী করবে? মাসে মাসে যে রুবল বৃত্তি পাবে সারা মাস পেট পুরে খেয়ে, ঘুরে বেড়িয়েও ফুরোবে না। পাঁচ কোপেকে গোটা মস্কো শহর ঘুরে বেড়ানো যায়, এক কেজি আঙুরের দাম মাত্র ২৫ কোপেক।
ঠিক, সত্যি কথা। ২৫ ডলার এনেছিলাম, সেই ডলার কোথায় রাখব, কী করব তাই ভেবে ভেবে হয়রান হয়েছি তিন বছর ধরে। কত জনে কেনার জন্য ফুসলিয়েছে। ব্যাংকে এক ডলার দিলে ৬৭ কোপেক দেবে আর বাইরে এক ডলারে তিন রুবল। ২৫ ডলার মানে ৭৫ রুবল, তা দিয়ে একটা জেনিথ ক্যামেরা কেনা যায়। কিন্তু সাহস পাইনি চোরাবাজারে ডলার ভাঙানোর। অথচ তখনই পার্টির নেতারা এ দেশ সফরে এসে আমাদের নেতা আখতারুর রহমানকে দিয়ে চোরাবাজারে ডলার ভাঙাত। ন্যাপের দুষ্ট ছেলেরা সে কথা আমাদের বলত, আমরা বিশ্বাস করতাম না, উল্টো ওদের মারতে যেতাম।

‘ঘরে চা আছে, হাবিব ভাই?’
‘চা নাই। ভোদকা আছে।’
‘খাওয়ার কিছু নাই?’
‘ফ্রিজে মাছ আছে। রান্না করতে হবে।’
‘দ্যান, এক ঢোঁক ভোদকাই খাই। ম্যাগডোনাল্ডসে এখন ভিড় ক্যামন? যাইবেন নাকি?’
‘আমি এখন একটু বের হব। তুমি কি থাকবে?’
‘অনিমেষ কই গেছে?’
‘জানি না। তুমি যদি থাক, দরজাটা বন্ধ করো। আজকাল হোস্টেলে হোস্টেলে ডাকাতি হচ্ছে।’
‘তাই নাকি?’ আঁতকে উঠল বিপ্লব। ভয় পেয়েছে। নিশ্চয়ই ওর কাছে অনেক ডলার আছে।
আমি ওকে আরও ভয় দেখানোর জন্য বললাম, ‘সাত নম্বর ব্লকে কাল সন্ধ্যাবেলা পিস্তল ধরে পাঁচ হাজার ডলার নিয়ে গেছে।’
‘বাঙালির কাছ থেকে?’
‘পাঁচ হাজার ডলার বাঙালি ছাড়া আর কার ঘরে থাকতে পারে?’
‘কিন্তু হাবিব ভাই, আমার কাছে যে কিছু ডলার ছিল!’
‘অনিমেষের আলমারিতে এক বস্তা রুবল আছে। আমি গেলাম। সব দায়দায়িত্ব তোমার। অবাঙালি কেউ নক করলে দরজা খুলবে না।’
‘মস্কোর অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গেছে?’

৫.
‘মস্কোর অবস্থা খারাপ,’ হোস্টেলের গেটকিপার বলে, লবিতে এক দঙ্গল আফ্রিকান ছেলের দিকে চেয়ে, ‘এই শালা বাঁদরগুলা এসে জুটল কোত্থেকে! একজন আবার কিনা বলে, সে সোমালিয়ার প্রেসিডেন্টের ভাই। বাঁদরগুলা হাগতেও জানে না, হোস্টেলের ল্যাট্রিনগুলা সব নষ্ট করে ফেলল। বুড়া ফেদকা তো ক্লিন করার ভয়ে ভেগেছে।’
ফেদকা আসলে সুইপার নয়। মস্কোর শহরতলির এক কারখানায় শ্রমিক ছিল। ব্রেজনেভের আমলে অবসর নিয়েছে। তারপর থেকে আমাদের হোস্টেলের গেটে অ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ করত। আগে ওকে সবাই স্বাভাবিক শ্রদ্ধার চোখেই দেখত। কিন্তু মদ খেতে খেতে সব ব্যক্তিত্ব খোয়ানোর পর ওকে হোস্টেলের করিডোরগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। টয়লেট-ল্যাট্রিনের দায়িত্ব তার নয়—সে আমাকে নিজ মুখে বলেছে। কিন্তু তাকে এখন ঠিকমতো মাইনে দেওয়া হয় না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে টয়লেটগুলো পরিষ্কার করে না।

পুরোহিত এগিয়ে এলেন, অন্তিম লেপন করবেন। তিন তরুণ একসঙ্গে মাথা ঝাঁকিয়ে খারিজ করে দিল পুরোহিতকে। গেনেরালভ আর আন্দ্রেইউশকিন একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘নারোদনায়া ভোলিয়া জিন্দাবাদ!’ ওসিপানভও ওদের সঙ্গে গলা মেলাতে চাইল, কিন্তু মাঝপথে জল্লাদের হাতের কালো মুখোশ ঝপ্ করে নেমে এল।

কে বলে ভেগেছে? ওই তো ফেদকা! ৬৫ বছরের বৃদ্ধকে সবাই এখন ছোকরার মতো ফেদকা বলে ডাকে। সমাজতন্ত্রের আমলে ওকে ডাকা হতো ফিওদর মিখাইলোভিচ বলে। ফিওদর মিখাইলোভিচ! এ তো দস্তইফেস্কির নাম ও পিতৃনাম! পদবিটা কী?
‘সাবাচ্কিন! কেন গসপাদিন?’
ফেদকা আমাকে গসপাদিন বলে। গসপাদিন মানে মিস্টার। মানী লোকদের সম্মান করে ডাকা হয় এভাবে।
সাবাকা মানে তো কুকুর। ফেদকা সাবাচ্কিন?
‘কুকুরের মতো জীবন হয়ে গেছে আপনার? জুতসই পদবি বটে। কিন্তু কবে থেকে? পিরিস্ত্রোইকার আগেও কি আপনি সাবাচ্কিনই ছিলেন?’
‘পদবি কি বদলায়, দ্রুঝক?’ এবার সে আমাকে বন্ধু ডাকে।
‘কিন্তু সাবাচকিন আবার কী ধরনের পদবি?’
‘কোশকিন যেমন! কোশকা মানে বিড়াল, জানো না?’
তারপরেই আবার বলে, ‘গসপাদিন, পাঁচটা রুবল হবে? বেতন দেয়নি। শালারা মেথর বানিয়েছে আমাকে! কিন্তু আমি কি মেথর ছিলাম কখনো? গু-মুত সাফ করা আমার কাজ?’
‘কেন? অসুবিধা কী? শ্রমের আবার অমর্যাদা আছে নাকি?’
‘আছে না? খুব আছে। মেথরের কাজ আমি করতে পারব না। শালাদের বলে দিয়ো। গসপাদিন, আজ একটা মেয়ে আসবে। আপনার জন্যই আসতে বলেছি ওকে! বকনা একটা, জব্বর মাল।’
‘বেশ্যার দালাল বনে গেছেন?’
থুতু ছিটিয়ে খিক খিক করে হেসে ওঠে বুড়ো ফেদকা, ‘দশটা রুবল দ্যান না আমাকে!’
‘রুটি কিনবেন, না মদ?’
‘রুটি কিনব, খোদার কসম!’
আমি দশ রুবলের একটা নোট এগিয়ে ধরি। ফেদকা বিশ্বাস করতে পারে না। সাহস পায় না হাত বাড়িয়ে নেওয়ার।
আমার হাতে নোটটা দোলে, ‘রুটি কিনবেন কিন্তু, মদ নয়!’
খপ্ করে নোটটা নিয়ে বালকের মতো নাচতে নাচতে চলে যায় বুড়ো ফেদকা।

৬.
তর্জনীতে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে তুলতুলে কেডস পায়ে এগিয়ে আসছে এক তরুণ। গাঢ় নীল জিনস প্যান্টের সঙ্গে কমলা রঙের টি-শার্ট পরনে ওকে দেখাচ্ছে হলিউডি ফিল্মের রোমান্টিক নায়কের মতো। মুখোমুখি ধাক্কা লাগার উপক্রম হলে সে থমকে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল।
‘পাভেল!’ আমি উল্লসিত সুরে ওর নাম ধরে ডেকে উঠলাম।
‘খাবিব!’
আমি উচ্ছ্বসিত, কিন্তু সে ভদ্রলোকের মতো সংযত। আমি ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম, সে তর্জনীর চাবির রিংটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমি বেশ চেপে হ্যান্ডশেক করতে করতে আবেগাপ্লুত স্বরে বললাম, ‘কত দিন পরে দেখা, বন্ধু!’
কিন্তু পাভেল সংযত, তার মুখে পরিমিত ভদ্রতার হাসি। ‘ভালো আছ?’
‘আমি ভালো! তুমি? পড়াশোনা করছ তো?’ খুব আপনজনের মতো বললাম আমি।
‘কেন নয়? এক্সেলেন্ট রেজাল্ট আমার।’
‘হোস্টেলে থাকো না মনে হয়?’
পাভেল না-সূচক মাথা নাড়ল, কথা বলল না। অনেক বদলে গেছে। এমন রাশভারী কখনো ছিল না। নিশ্চয়ই ধনী হয়ে গেছে। যারা ধনী হয়েছে তারা সবাই এ রকম দুর্বোধ্য হয়ে গেছে।
‘শহরে থাকো, বিয়ে করেছ নাকি?’
এবারও কথা বলল না, শুধু ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল বিয়ে করেনি।

মেডিসিনের ছাত্রদের হোস্টেলের গেটের পাশে আপেলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘন নীল রঙের বিএমডব্লিউ। পাভেল সেটার দিকে এগিয়ে গেল।
রুশি কোনো ছাত্র ব্যবসা করে দেড়-দুই বছরে একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে ফেলেছে এমন ঘটনা বিরল। ব্যবসা করছে বিদেশি ছেলেরা। রুশি ছেলেরা তাদের ফরমাশ খেটে কিছু কামাচ্ছে আর মেয়েরা দেহ বিক্রি করছে। পাভেল তাহলে আসলেই একটা জিনিয়াস! কিন্তু কিসের ব্যবসা করে সে? ভিডিও প্লেয়ার, ভিডিও ক্যামেরা, কম্পিউটার, জুতা, চামড়ার জ্যাকেট, ব্রা-প্যান্টি-টাইট্স, জামাকাপড় এসব জিনিস দুবাই-সিঙ্গাপুর-ইস্তাম্বুল থেকে কিনে এনে মস্কোর বাজারে বিক্রি করে মাত্র দুই বছরে বিএমডব্লিউ গাড়ির মালিক হওয়া অসম্ভব। পাভেল হয় ড্রাগ, নয় অস্ত্রের ব্যবসা ধরেছে।

এই পাভেলই একদিন আমাকে বলেছিল, ডাক্তার হয়ে সে বাংলাদেশে যাবে। কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে শিশুদের জন্য একটা হাসপাতাল খুলবে। সোভিয়েত সরকার সেই হাসপাতালের জন্য ওষুধ, চিকিৎসার সরঞ্জাম সবকিছু দেবে। তত দিনে বাংলাদেশে আমরাও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করে ফেলব।
আমি ওকে আদর করে ডেকে বললাম, ‘পাশা, আমার ঘরে এসো একদিন। তোমার কথা খুব মনে পড়ে।’
পাভেল, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল আমার দিকে। স্মিত হেসে বলল, ‘আসব।’
সঙ্গে সঙ্গে আমার মন বলে উঠল: না না, এসো না। তুমি তো বুর্জোয়া বনে গেছ। বুড়ো ফেদকা ভিক্ষা করছে আর তুমি বিএমডব্লিউ গাড়ি হাঁকাচ্ছ। আমেরিকার চেয়েও বেশি বৈষম্য হয়ে গেছে এই দেশে। কিন্তু তুমি আমাকে সাম্যের কথা শুনিয়েছিলে একদিন। তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে: আমি আমি করতে হয় না। আমি বলে কিছু নাই, আমরা। আমার বলে কিছু নাই। বলেছিলে, আমাদের। কিন্তু তুমি নিজেই যে এসব কথা বিশ্বাস করতে না আমি তা বুঝতে পারিনি। কী বোকা ছিলাম! কী নির্বোধই না ছিলাম! আখতারুর রহমান আর তুমি এক জাত। তোমরা কোনো দিন কমিউনিস্ট ছিলে না। কিন্তু নেতা হয়েছিলে তোমরাই। আখতারুর রহমান আমাদের তুমি, তুমি কমসোমলের। এখনো তোমরা নেতা। স্পেকুলান্তদের! লিডারশিপ কোয়ালিটি!
ঘন নীল বিএমডব্লিউ আমার বাঁ পাশ দিয়ে শাঁ করে চলে গেল।

৭.
রাস্তার পাশে গোলাপের ঝাড় কেঁপে উঠল; গতায়ু পাপড়িগুলো খসে খসে উড়ে যাচ্ছে আগস্টের বৈকালি হাওয়ায়।
‘খাবিব!’
‘নাতাশা!’
প্রিভিয়েত!’
‘প্রিভিয়েত! এমন শুকিয়ে গেছ কেন?’
এই রে! কী ভুল বুঝি করে ফেললাম। প্রস্ত্ততি অনুষদে পড়ার সময় এক রুশি মেয়েকে, তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সবে দানা বাঁধছিল, কথায় কথায় বলেছিলাম, তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছ। তারপর এই চার বছরে সেই মেয়ে আর এক দিনও আমার সঙ্গে কথা বলেনি।
আমি দ্রুত ক্ষতিপূরণ করার আশায় বললাম, ‘কিন্তু বেশ সুন্দর লাগছে তোমাকে!’
নাতাশা হাসল। কিন্তু হাসিটা মলিন। মাস কয়েক আগে ওর পেট উঁচু দেখেছিলাম। এখন ঝাড়া পেট।
‘মা হয়ে গেছ?’
নাতাশা সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।
‘ছেলে হয়েছে না মেয়ে?’
‘ছেলে।’
‘ওকে কার কাছে রেখে রাস্তায় বেরিয়েছ?’
হঠাৎ ওর মুখটা বেঁকেচুরে গেল, যেন কেঁদে ফেলবে। আর কিছু জিগ্যেস করার সাহস পেলাম না। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নাতাশা নিজেই বলল, ‘আমার বাবু এখন পনেরো শ কিলোমিটার দূরে।’
‘মানে?’
‘আমার মায়ের কাছে রেখে এসেছি। এখানে হোস্টেলের ঘরে কী করে আমি ওকে দেখেশুনে রাখব? কী খাওয়াব? কার কাছে রেখে ক্লাসে যাব?’
‘কেন, ওর বাবা?’
নাতাশা গড়গড় করে বলতে শুরু করল ওর দুঃখের কাহিনি। যে ছেলের সঙ্গে ওর সম্পর্ক, সে বাচ্চা নিতে চায়নি। নাতাশার গর্ভসঞ্চার হলে ছেলেটা বাচ্চা নষ্ট করতে বলেছিল, খুব চাপ দিয়েছিল, কিন্তু নাতাশা বাচ্চা নষ্ট করেনি। এই টানাপোড়েনে ওদের সর্ম্পকটাই ছিঁড়ে গেছে। বাবা তার সন্তানকে একবার দেখতেও আসেনি।
‘ও এতিমখানায় বড় হয়েছে,’ নাতাশা তার প্রেমিক সম্পর্কে বলল, ‘নিজেই নিজের বাবা-মাকে দেখেনি কোনো দিন। বাবা-মা কী সে ধারণাই ওর নাই। ও তো বলবেই বাচ্চা নষ্ট করতে। কিন্তু ওর অজুহাত কী ছিল জানো? দেশে এখন অভাব, দুর্ভিক্ষ লেগে যাবে শিগগিরই, বাচ্চা হলে তাকে আমরা খাওয়াব কী?’
‘ছেলে বড় হলে তো বাবার কথা জানতে চাইবে। তখন তুমি ওকে কী বলবে?’
‘সব কথা বলে দেব। আমার কী দোষ?’

ঠিক। কী দোষ? সারা সোভিয়েত ইউনিয়নে কনডমের বড্ড আকাল। তাই গর্ভপাতেরও ছড়াছড়ি। অভাব বাড়ছে, ছেলেমেয়েরা বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে। যারা বিয়ে করছে, তারা বাচ্চা নিচ্ছে না, বাচ্চা নিলে খাওয়াবে কী? আমাদের স্বদেশি বন্ধুরা এখন কনডমের ব্যবসাও করছে। একজন তো ছুটিতে দেশে গিয়ে ফেরার সময় আর কিছু না এনে এক সুটকেস ভর্তি করে শুধু কনডমই এনেছিল।
ক্যানটিনে এক টেবিলে মুখোমুখি বসে খেতে খেতে নাতাশা বলল, ‘হাতে সময় থাকলে তুমি আমার ঘরে আসতে পারো।’
নাতাশা আমার ক্লাসমেট নয়। একই ফ্যাকাল্টিতে পড়ি। ওর সঙ্গে আমার খুব যে ঘনিষ্ঠতা তা-ও নয়। ওর ঘরে আমি কখনো যাইনি।
রাজি হলাম। কিন্তু একটু পরেই দ্বিধা জাগল। বললাম, ‘তোমার রুমমেটের অসুবিধা হবে না?’
‘রুমমেট ছুটি কাটাতে দেশে গেছে।’
ক্যানটিনে নাতাশার খাবারের দাম শোধ করলাম আমি। বাঙালি ছেলেমেয়েদের জন্য এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। একসঙ্গে কজন বাঙালি ক্যানটিনের লাইনে দাঁড়ালে শেষের জনই সবার বিল দিয়ে দেয়। কিন্তু কোনো রুশ ছেলে বা মেয়ের কাছে এই আকালের সময়ে নিশ্চয় এটা অনেক বড় একটা বদান্যতার ব্যাপার। নাতাশা বুঝি সে কারণেই আমার প্রতি এত কৃতজ্ঞ, এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো কথা বলছে। সে হয়তো আরও নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চাইছে আমার সঙ্গে।
আমি ওর দিকে ভালো করে তাকালাম। অধিকাংশ রুশ মেয়ের মতো লম্বা নয়, আমার চেয়ে ইঞ্চিখানেক খাটোও হতে পারে। মোটাসোটা গোলগালও নয়। মুখটা বরং একটু লম্বাটে, কিন্তু নাক পুরোপুরি টিকোল নয়। চুল বাদামি-কালো। কপালটা বড়, ভুরু থেকে উঠে গেছে সামান্য বাঁক নিয়ে। চোখের মণি ঘন খয়েরি, ঠোঁট দুটি পাতলা। সব মিলিয়ে নাতাশা সুন্দরী কি না বলা কঠিন।

টেলিভিশনের পর্দায় ঘোষিকা মুখ ব্যাদান করে বিজ্ঞপ্তি পড়ছে, ‘…জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। মিখাইল গর্বাচভ অসুস্থ, কিন্তু দেশ সুরক্ষিত রয়েছে। আপনারা অকারণে রাস্তায় বেরিয়ে জটলা করবেন না, কোনো প্ররোচনায় অংশ নেবেন না। যা করা হচ্ছে, আপনাদের এবং দেশের মঙ্গলের জন্যই করা হচ্ছে।…’

একসঙ্গে ক্যানটিন থেকে বেরিয়ে অকারণে ক্যাম্পাসের উল্টো পাশের দোকানটাতে ঢুকলাম। নতুন জিনিসপত্তর কি এল, কিসের কিসের দাম কতটা বাড়ল এসব কৌতূহল থেকে এ রকম প্রায়ই করি আমি। অনেকে আবার শুধুই এক চক্কর ঘুরে দেখার জন্য দোকানে ঢোকে। এই দেশের লোকজনের কাছে দোকান বড়ই আগ্রহের জায়গা। দরকার নাই, তবু তারা পথের পাশের দোকানে ঢুঁ মারবে।
নাতাশা কিছু বলল না। সেও জানে, স্রেফ কৌতূহলবশে আমরা ঢুঁ মারতে এসেছি, কিছু কিনতে নয়। সে ঘুরে ঘুরে এটা সেটা দেখতে লাগল। ইংল্যান্ডের লাক্স সাবান বিক্রি হচ্ছে, ফিদার ব্লেড বিক্রি হচ্ছে। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেছে অনেক মানুষ।
‘তুমি কিছু কিনবে?’ আমি নাতাশাকে বললাম।
নাতাশা মলিনভাবে মাথা নেড়ে জানাল, না। দরকারি-অদরকারি অনেক কিছুই হয়তো ওর কিনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পয়সা নাই। এক কোণে বাচ্চাদের খেলনার দিকে সে দুঃখী-দরিদ্র চোখে চেয়ে রইল। হঠাৎ দেখি, ক্যাশিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বুড়ো ফেদকা, ওর হাতে চার-পাঁচটা ওডিকোলনের বোতল। ওরে শয়তান বুড়া। আমার কাছ থেকে দশ রুবল নিয়ে সে লাফাতে লাফাতে চলে এসেছে এই বস্তু কিনতে! ফেদকা একবার আমার আফটার শেভ লোশন খেয়ে ফেলেছিল। মদ কিনতে পারে না, ওডিকোলন খায়। ভোদকার দাম বেড়ে হয়েছে পনেরো রুবল। আর ওডিকোলনের এই বড় বড় বোতলগুলোর দাম এখনো দুই রুবলই রয়ে গেছে। হয়তো দাম বাড়ানোর আদেশ জারি হতে আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব হচ্ছে। নইলে এগুলোর একেকটার দামই এখন হয়ে যেত দশ রুবল।
নাতাশার ঘরে পৌঁছার পর সে আমাকে চা খেতে দিল। কোন দেশি চা কে জানে, বড় বিচ্ছিরি স্বাদ। তবু আমি তৃপ্তির ভান করে চুমুক দিতে লাগলাম।
‘জানো, আমার বুকে এখন প্রচুর দুধ। দিনরাতে কতবার যে ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে।’ নাতাশা আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল।
ওর বুকের দিকে আমার চোখ গেল। বেশ ভরাট। আমি সংকোচে চোখ সরিয়ে নিলাম।
‘আমার বুকে যখন দুধের বান ডাকে তখন বাচ্চাটার কথা খুব মনে পড়ে। ঘরের দরজা বন্ধ করে তখন চিৎকার করে কাঁদি।’
আমি কথা খুঁজে পেলাম না। নাতাশার মুখের দিকে তাকাতেও পারছি না। কিন্তু নাতাশা আমার চোখের দিকে চেয়েই কথা বলে চলল।
‘খাবিব, বন্ধু, তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছ? কিন্তু আমি কী করব, বলো? আমার দুঃখের কথা শোনার যে কেউ নাই।’
নাতাশা ফোঁপাতে আরম্ভ করল। তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল। নড়েচড়ে বসল। ছটফট করতে, মটমট শব্দে আঙুল মটকাল। আমার হাতে প্রায় খালি হয়ে আসা চায়ের গ্লাসের দিকে তাকাল, তারপর কেটলিটা টেনে নিয়ে গ্লাসটাতে একটু গরম পানি ঢেলে দিল।
‘কাল রাতে,’ কেটলি রেখে ডিভানে বসে বলল, ‘কাল রাতে কী হয়েছিল জানো? জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে গেছিলাম। দুই চোখ বন্ধ করে যিশুর নাম নিয়ে ঝাঁপ দেব, এমন সময় বনের দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল আমার খোকার কান্না। আচ্ছা, তুমিই বলো, কাজটা করতে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছিল?’
আমি প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাতে লাগলাম: ‘না না না! কক্ষনো এসব চিন্তা মাথায় আনবে না। তোমার বাচ্চার জন্যই এখন তোমাকে…।’
‘জানি জানি।’ মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে নাতাশা বলল, ‘তোমার চেয়ে ভালো করে জানি। আমার এখন আর মরার উপায় নাই। কিন্তু কী করব, বলো তো? বাবুকে মানুষ করতে টাকাপয়সা লাগবে না?’
আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম, কী বলা যায়। হঠাৎ নাতাশা উঠে এসে আমার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসল। আমার হাঁটুতে থুতি ঠেকিয়ে করুণ স্বরে বলল, ‘খাবিব, তুমি আমাকে নেবে?’
নাতাশার দৃষ্টি এখন অস্বাভাবিক, চোখের মণি দুটো অদ্ভুতভাবে ঘুরছে, ‘আমার দাম কত? কয় ডলারে আমি বিক্রি হব? বলো, কত ডলারে, আঁ?’
‘সরি, নাতাশা, আমাকে এখন যেতে হবে! একটা জরুরি কাজ আছে।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। নাতাশা পাগলের মতো উদ্ভ্রান্ত চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ খামচে ধরল আমার জামার কলার, ‘অনেক টাকার মালিক তোরা, না? কিন্তু কী করে? কী করে এত টাকা হলো তোদের, আঁ? আমার কেন টাকা নাই? আমি কেন নিঃস্ব? আমাকে কেন আমার বাচ্চাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হলো?’
আমার কলার ছেড়ে দিয়ে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে আরম্ভ করল। আমি আর কিছু না বলে নিজ হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম। পেছন থেকে নাতাশা চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘মাফ করে দিস ভাই, আমার মাথার ঠিক নাই। আমি মরে যাব। আজ রাতেই আমি মরে যাব…।’

৮.
হোস্টেলের লবিতে নাতাশা নাতাশা বলে চিৎকার করছিল বুড়ো ফেদকা। আমাকে দেখেই হন্তদন্ত ছুটে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘নিয়ে এসেছি, গসপাদিন! এখনই ঘরে নিয়ে যান। নইলে আফ্রিকানগুলা নিয়ে যাবে।’
ওডিকোলনের গন্ধ ছুটছে বুড়োর মুখ থেকে। আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘বুড়া, আমার দশ রুবল ফেরত দাও!’
ফেদকা মশকরা ভেবে হাসল, ‘কেন তাভারিশ? কী হয়েছে?’
‘চুপ! তাভারিশ বলবেন না! আমি আপনাকে টাকা দিয়েছিলাম রুটি কেনার জন্য।’
বুড়া চট করে সরে পড়ল।
ঘরে অনিমেষ আর বিপ্লব কাগজকলম নিয়ে টাকাপয়সার হিসাব করছে। অনিমেষ আমাকে দেখে হাসল।
বিপ্লব বলল, ‘আপনার জন্য ম্যাকডোনাল্ডস্ থেকে বিগম্যাক নিয়াস্ছি। ওই যে ফ্রিজের মাথার উপ্রে আছে, খান।’
অনিমেষ বলল, ‘বিয়ার সব শেষ?’
আমি কিছু বললাম না।
অনিমেষ বলল, ‘আমরা পরশু দিন সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। আপনিও যাবেন নাকি?’
অনেক দিন ধরেই অনিমেষ আমাকে এভাবে ফুসলাচ্ছে। ওর সঙ্গে ওর খরচে সিঙ্গাপুর যাব, ঘুরেফিরে দেখব, জামাকাপড় কিনব, ফেরার সময় ওর কিছু সওদাপাতি সঙ্গে নিয়ে আসব। সেগুলো এখানে বিক্রি করে যা লাভ হবে তার অর্ধেকটা আমি পাব, অন্তত শ পাঁচেক ডলার। মাত্র এক শ ডলারে এখনো এরোফ্লতের মস্কো-ঢাকা-মস্কো টিকিট কিনতে পাওয়া যায়।
‘চলেন, এইবার চলেন,’ অনিমেষ সিগারেট ধরাতে ধরাতে আবার বলল।
আমি ওর সামনে রাখা রথম্যানের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাতে ধরাতে বললাম, ‘টাকাপয়সা আর আলমারির মধ্যে এভাবে রেখো না, অনিমেষ। কোনো দিন ঘরে ডাকাত পড়বে।’
অনিমেষ হাসল, ‘অত চিন্তা করেন ক্যান? ফ্রিজে এক বোতল ভোদকা আছিল না? বার করেন, একটু খাই।’
‘তোমার কাভালিওভ এসে পুরাটাই খেয়ে গেছে।’
বিপ্লব উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে স্মিরনোফের বোতলটা বের করল, ‘এই তো অনেকখানি আছে।’
সে গ্লাসে ভোদকা ঢালতে শুরু করল।
আমার পেটে ক্ষুধা। সন্ধ্যায় ক্যানটিনে যা খেয়েছি সব হজম হয়ে গেছে। ফ্রিজের মাথা থেকে ম্যাকডোনাল্ডসের বিগম্যাকটা নিয়ে কামড় বসালাম।
অনিমেষ আমাকে বলল, ‘ফ্রিজে আপেলও আছে।’
দরজায় টোকা পড়ে। বিপ্লব খুলে দিল। দাঁত বের করে হাসছে অলক আর বাবর। অলকের দুই বগলে স্মিরনোফ ভোদকার দুটি বোতল।
বাবর দরজা থেকেই অনিমেষকে বলে, ‘কমরেড, ঘরে খাওয়ার কিছু আছে?’
‘কাঁচামাল আছে, পাকাইতে হইব।’ হেসে বলল অনিমেষ।
‘চাউল আছে? ভাত রান্দুম।’
নোয়াখাইল্যা বাবরের কথায় জামালপুরের অনিমেষ আবার হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, ‘সব আছে, কোনো কিছুর অভাব নাই। অভাব খালি কাজের লোকের। দেশ থেকে একটা বাবুর্চি নিয়া আসব কি না ভাবতাছি।’
‘লাটসায়েবগিরি কইরো না। উঠো, ফ্রিজে আর কী কী আছে বাইর করো। অলক, খাইতে চাইলে বোতল রাইখ্যা পিঁয়াজ কাট্বার লাগ্।’
অনিমেষ বলল, ‘অলকবাবুর বগলে বোতল ক্যান? আগস্ট মাসে তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বার্ষিকী উদ্যাপন করা যাইব না।’
‘শালার কমরেড, টিটকারি মারবি না! বোতল তোর মাথায় ভাঙ্গুম,’ বলতে বলতে অলক একটা বোতল রেখে অন্যটার ছিপি খুলতে লাগল।
ওর মাথার পেছনে মৃদু একটা চাপড় মেরে বাবর বলল, ‘তোর সব বোতল জানলা দিয়া ফালাই দিমু রে। খিদায় নাড়িভুঁড়ি হজম হই গেল, হালার ফুত্!’
তারপর মাংস কাটা, চাল ধোয়া, পেঁয়াজ ছোলা, আলু কাটা এবং এই সব কথাবার্তা:
‘আখতারুর রহমানের খবর কী?’
‘ওই শালার মায়েরে বাপ!’
‘ক্যান? সে যা করতাছে, তুমি তা করো না?’
‘তাও শালার মায়েরে বাপ!’
‘আখতারুর রহমান সবচে বড় ভণ্ড।’
‘বিপ্লব, তুমি তো ন্যাপের বৃত্তি নিয়া আসছ। তুমি কথা কও ক্যান?’
‘বিপ্লব, প্রফেসর সায়েবরে কত টাকা দিছিলা?’
‘প্রফেসর সাহেব সিপিবির নেতাদের মতন ডিজোনেস্ট না।’
‘বাবর, এই পোলা সিপিবির নেতাগো নিন্দা করতেছে। ওর মাথায় বোতলডা ভাঙ।’
‘সিপিবি-ন্যাপ সব হালারা চ্যাঙ্গের দক্ষিণ দুয়ার হই যাও।’
হা হা হি হি।
‘আছিলাম বোকা, হইলাম বুদ্ধিমান। গর্বাচভ জিন্দাবাদ! ইয়েলৎসিন আরও জিন্দাবাদ।’
‘গর্বাচভ-ইয়েলৎসিন মারাইতে হইব না। খিদা লাগছে, হালার ফুতেরা তাড়াতাড়ি হাত চালাও!’
হাত চলে। হাতগুলো ভাত মাংস মদ খায়। পেটগুলো ফুলে ওঠে, তরমুজের মতো শক্ত হয়। ঢেকুর ওঠে ঔ ঔ।
মানুষ শুধু খেতে জানে, পান করতে জানে, ঢেকুর তুলতে জানে।

৯.
টেলিভিশনের পর্দায় ঘোষিকা মুখ ব্যাদান করে বিজ্ঞপ্তি পড়ছে, ‘…জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। মিখাইল গর্বাচভ অসুস্থ, কিন্তু দেশ সুরক্ষিত রয়েছে। আপনারা অকারণে রাস্তায় বেরিয়ে জটলা করবেন না, কোনো প্ররোচনায় অংশ নেবেন না। যা করা হচ্ছে, আপনাদের এবং দেশের মঙ্গলের জন্যই করা হচ্ছে। দেশের এই সংকটজনক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছিল অপরিহার্য। আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে…’
‘অনিমেষ, তোমার রুবলের বস্তা লুকাও। ডলার-টলার যা আছে লুকিয়ে ফ্যালো। আয়রন ফিস্ট উঠে এসেছে।’
‘গর্বাচভরে কি মাইরা ফেলছে? অসুস্থ মানে কী? শালারা তো মিছা কওয়ার ঘাগু।’
‘চলো যাই, দেখে আসি।’
‘মাথা খারাপ হইছে আপনার?’
‘তুমি যাবে কি না বলো? এত বড় সুযোগ আর জীবনেও আসবে না।’
‘পাগলামি কইরেন না। ওদিকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে কি না কে জানে। হলে তো শালারা টিভিতে সেই খবরটা প্রচারও করবে না।’
‘আমি গেলাম।’
রাস্তায় সবকিছু বরাবরের মতো ঠিকঠাক। তবে বাসস্ট্যান্ডে লোকজন নীরব, সবার মুখচোখ গম্ভীর। শঙ্কা না আতঙ্ক বোঝা যাচ্ছে না।
বাসের ভেতরেও কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু মাঝে মাঝে গম্ভীর মুখে এ ওর দিকে তাকাচ্ছে।
মেট্রো স্টেশনে শুধু ট্রেনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। শত শত মানুষের ভিড়ে একটু শব্দও নাই। হঠাৎ সব মানুষ যেন বোবা হয়ে গেছে।
নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। খুশি হলে এমন চুপ করে থাকত না। ক্ষুব্ধ হলেও নয়। শুধু ভয় পেলেই মানুষ এমন নির্বাক হয়ে যেতে পারে।
কয়েক মাস ধরেই আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, একটা কিছু হতে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেভার্দনাদজে পদত্যাগ করার সময় বলেছিলেন, একটা ডিকটেটরশিপ আসছে, আমি পরিপূর্ণ দায়িত্বসহকারে আপনাদের বলছি।
কেউ জানে না সেই ডিকটেটরশিপ কেমন হবে, কী ধরনের ডিকটেটর ক্ষমতায় আসবে, কী ধরনের ব্যবস্থা সে কায়েম করবে।
মাত্র তিন দিন আগে গর্বাচভের পুরোনো বন্ধু, যাকে গ্লাসনস্তের আর্কিটেক্ট বলা হয়, সেই ইয়াকভলেভ দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আগেই পদত্যাগ করার সময় বলেছেন, পার্টির মধ্যে এবং রাষ্ট্রে একটা ক্যু হতে যাচ্ছে।
পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সারি সারি ট্যাংক। ভবনের ভেতরে নাকি ইয়েলৎসিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আছে। তাকে পাকড়াও করার জন্য অভ্যুত্থানকারীরা ট্যাংক পাঠিয়েছে। কিন্তু ট্যাংকওয়ালারা কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না। গম্ভীর মুখে বসে আছে। বুড়াবুড়িরা ট্যাংকগুলোর নলের সামনে দিয়ে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক বুড়ি একটা ট্যাঙ্কের একদম সামনে গিয়ে তরুণ সৈনিককে বলল, ‘গুলি ফুটানোর দরকার নাই, বাবা। এই যে, রুটি খা, মুখটা শুকিয়ে গেছে।’
বৃদ্ধা সত্যি সত্যিই ঝুলি থেকে একখণ্ড কালো রুটি বের করে সৈনিকটির দিকে এগিয়ে ধরলেন।
টিভিতে রাত নয়টার সংবাদ:
‘সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গেন্নাদি ইনায়েভ গতকাল একটি ডিক্রি জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, অসুস্থতার কারণে মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচভ সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অপারগ। এই অবস্থায় সোভিয়েত সংবিধানের ১২৭ (৭) ধারা অনুসারে আজ ১৯ আগস্ট ১৯৯১ থেকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন গেন্নাদি ইনায়েভ।
‘সোভিয়েত জনজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমস্যার সমাধান, দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোর তৎপরতা নস্যাৎ করা, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো, বিভ্রান্তি দূর করে সমাজজীবনে সংহতি ফিরিয়ে আনা, বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির অবসান, দেশব্যাপী অশান্তি ও ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধকালীন পরিবেশ থেকে দেশকে মুক্ত করা—এই উদ্দেশ্যগুলো যথাযথভাবে সাধনের লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থাকালীন কমিটি (গসুদার্স্তভেন্নি কমিতিয়েৎ পা চ্রজ্ভিচাইনামু পালাঝেনিয়ু—গেকাচেপে) গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ১ নম্বর প্রজ্ঞাপন দ্বারা ঘোষণা করেছে: সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল প্রশাসনিক কাঠামো, প্রজাতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত এলাকা, শহর, গ্রামসহ যাবতীয় জনবসতিকে এতদ্দ্বারা জানানো যাচ্ছে যে, তারা যেন জরুরি অবস্থাকালীন শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থাকালীন কমিটি ‘আইনসম্মত জরুরি অবস্থাকালীন শাসনপ্রণালির ভিত্তিতে এই প্রজ্ঞাপন জারি করছে। যদি কেউ এই আদেশ অমান্য করে, তাহলে গেকাচেপে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে…
‘পাবলিক প্রসিকিউটরের দপ্তর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কেজিবি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে যথাযথভাবে রক্ষা করার জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ১৬টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বিশেষত শিশুদের ব্যবহার্য জিনিসের দাম অবিলম্বে কমানো, নাগরিকদের মাসিক বেতন ও পেনশনের হার বাড়ানো, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে…সোভিয়েত ইউনিয়নে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে দৈনিক ও সাময়িক পত্রপত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ত্রুদ, রাবোচায়া গাজিয়েতা, ইজভেস্তিয়া, প্রাভদা, ক্রাসনায়া জ্ভেজ্দা, সাভিয়েৎস্কায়া রাসিয়া, মাস্কোভ্স্কায়া প্রাভদা, লেনিনস্কায়া জ্নামিয়া ও সেলস্কায়া ঝিজ্ন ছাড়া বাকি সব সংবাদপত্র ও পত্রিকা প্রকাশের ওপর গেকাচেপে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নতুন নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।’

একটু পরেই করিডরে মেয়েটির চিৎকার শুরু হলো: ‘সেদিন আর দেরি নাই। তুই আমার পায়ে ধরে কাঁদবি আর মাফ চাইবি। কিন্তু মাফ আমি করব না। গুলি করে মারব। তোর লাশ আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াব।’

মঞ্চে ইনায়েভ, বাকলানোভ, পুগো, স্তারাদুরৎসেভ, তিজ্ইয়াকভ। নয়া প্রেসিডেন্ট ইনায়েভের হাত কাঁপছে। সাংবাদিকদের ভয়েই যে কাঁপছে তা নিশ্চিত বলা যায় না। ইনায়েভ আলকাশ। অ্যালকোহলিক। আলকাশদের হাত-পা অমন কাঁপতেই পারে। বিশেষ করে পৃথিবীর ৬ ভাগের ১ ভাগ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল দেশের দায়িত্ব হাতে নিলে।
‘গর্বাচভ এখন কোথায়?’
‘ক্রিমিয়ায়।’
‘কেন?’
‘চিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য।’
‘কিসের চিকিৎসা?’
‘গত কয়েক বছরে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে তাঁর কিছুটা সময় লাগবে।’
‘তিনি বেঁচে আছেন তো?’
‘আশা করি তিনি খুব শিগগির সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং ফিরে এসে নিজের দায়িত্ব আবার বুঝে নেবেন।’
‘দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য এ মুহূর্তে কি আপনাদের হাতে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে? বাজার অর্থনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যেসব নীতি ইতিপূর্বে নেওয়া হয়েছে সেগুলো কি বলবৎ থাকবে?’
‘পিরিস্ত্রোইকা থেকে যে ফলাফল আশা করা হয়েছিল তা পাওয়া যায়নি। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির অবস্থা আজ ভয়াবহ। উৎপাদনব্যবস্থার মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্রগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এই অবস্থার উন্নতি করতে সচেষ্ট হব। বাজার অর্থনীতির দিকে এগোনোর পথও আমরা বন্ধ করব না।’
‘ফসল বাঁচানোর জন্য সব বন্দোবস্ত করা হবে। আশা করি এ ব্যাপারে আগামীকালের মধ্যেই একটি প্রস্তাব গৃহীত হবে। তা ছাড়া বাসগৃহ নির্মাণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে। সোভিয়েত নাগরিকেরা ভদ্রভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেন।…খাদ্যদ্রব্যের পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হবে। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।’
‘এটা কি ক্যু-দেতা?’
‘আমরা সংবিধানবিরোধী কোনো কাজ করিনি। সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সোভিয়েত সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে।
‘গর্বাচভ সম্পর্কে আপনাদের মনোভাব কী?’
‘গেকাচেপে গর্বাচভের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁর গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই এই শ্রদ্ধার কারণ। আজ আমরা যে গণতন্ত্রের পথের পথিক হয়েছি, এর পটভূমি রচনা করেছেন গর্বাচভ।’
‘ব্রেজনেভ মারা যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরে আপনারা জনগণকে জানিয়েছিলেন যে তিনি মারা গেছেন। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, গর্বাচভ ঠিক কতটা অসুস্থ? কী হয়েছে তাঁর?’
‘গর্বাচভের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত রিপোর্ট অচিরেই প্রকাশ করা হবে।’

‘দেশবাসীগণ!
‘সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকবৃন্দ!
‘দেশের ও দেশবাসীর অত্যন্ত সংকটময় মুহূর্তে আমরা আপনাদের শরণাপন্ন হয়েছি। আমাদের মহান পিতৃভূমির আকাশে আজ বিপদের কালো মেঘের ঘনঘটা। দেশ আজ মরণাপন্ন। মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচভের উদ্যোগে যে সংস্কারমূলক রাজনীতির সূচনা হয়েছিল, একাধিক কারণে আজ তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, যদিও এই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের বহুমুখী বিকাশ ও সমাজজীবনের গণতন্ত্রীকরণ। সংস্কারমূলক এই রাজনীতি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে সর্বজনীন উৎসাহ ও আশার যে জোয়ার দেখা দিয়েছিল, বর্তমানে তার জায়গা দখল করেছে হতাশা, অবিশ্বাস ও অস্থিরতা। সর্বস্তরের ক্ষমতা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। রাজনীতির এই ব্যর্থতার অনিবার্য পরিণতি প্রতিফলিত হয়েছে সমাজজীবনে। দেশের ভাগ্য ও ভালোমন্দ নিয়ে জনসাধারণের মনে দেখা দিয়েছে এক অদ্ভুত ঔদাসীন্য। প্রশাসনিক সংস্থাগুলোও আজ নিজেদের দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের ক্ষেত্রে গাফিলতি করছে। সংক্ষেপে, দেশের অবস্থা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
‘সোভিয়েত জনগণের আত্মসম্মানবোধ ও গৌরব আবার তার আগের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে…’
ব্রাভো! চমৎকার!
কিন্তু গর্বাচভকে বাদ দিয়ে এরা কারা? কেজিবি, পুলিশ, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি, পার্টি আপারৎচিকি, যাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত হেনেছেন গর্বাচভ? যাদের মসনদ টলে উঠেছে?

ইয়েলৎসিন পার্লামেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে এক ট্যাংকের ওপর চড়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। অভ্যুত্থান জুত পায়নি। গেকাচেপের লোকেরা পালানোর সময় ধরা পড়েছে। একজন নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিয়েছে।
‘বুড়া ভামের দল মাল টাইন্যা পাঁড় মাতাল হয়া অভ্যুত্থান করতে গেছিল। এখন সব কয়টারে শুলে চড়াইব।’ অনিমেষ উল্লাসে চিৎকার করছে।
দুই বগলে দুই বোতল নিয়ে ধেই ধেই করে নাচছে অলক দেবনাথ, ‘চল চল, টিটো ভাইয়ের ঘরে আজ সারা রাত আসর চলবে। মদ খাইয়া আজ মারা যামু।’
অলক ইতিমধ্যেই মাতাল।
অনিমেষের চোখেমুখে চকচকে খুশি, ‘হাবিব ভাই, ঘরে তো খাবার নাই। টিটো ভাইয়ের ঘরে রান্না হইতাছে, চলেন।’
‘তোমরা যাও। আমার শরীর ভালো না।’
‘রাতে খাইবেন না?’
‘রুটি আছে, খেয়ে নিব।’
‘আপনার হইলটা কী?’
‘আমি এখন ঘুমাব।’

১০.
দরজা ভেড়ানো ছিল, হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল আর ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ল উদ্ভ্রান্ত চেহারার এক মেয়ে।
‘তোর ঘরে রুটি আছে?’ বলতে বলতে সে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। ফ্রিজ খোলার আগেই ওর নজরে পড়ল ফ্রিজের মাথায় রাখা শুকিয়ে যাওয়া রুটিখণ্ডের দিকে, যেটার কিছু অংশ কাভালিওভ খেয়ে গেছেন তিন দিন আগে। এখন ওটা আরও শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে। মেয়েটা ওটাই লুফে নিয়ে কড়মড় শব্দে চিবুতে শুরু করে দিল।
ততক্ষণে আমার আতঙ্ক কেটেছে। পরিপূর্ণ চোখ মেলে মেয়েটাকে দেখতে লাগলাম। ছিপছিপে পাতলা এক রুশ তরুণী। গড়পড়তা রুশ মেয়েদের মতো গোলগাল নয়। গাল দুটো ভাঙা, নাক তরবারির মতো খাড়া, গ্রীবা দীর্ঘ, উসখুস চুলগুলো সোনালি আর বড় বড় নীল চোখ দুটিতে উদ্ভ্রান্ত, ঝোড়ো চাহনি। চোখ দুটো বিস্ফারিত করে রুটিখণ্ডটা চিবিয়ে চলেছে।
রুটি শুকনো, তার মুখের ভেতরেও বোধ হয় কোনো রস নেই, ফলে ঢোঁক গিলতে পারছে না, হাঁসফাঁস করছে। লম্বা গ্রীবাটা আরও লম্বা হয়ে যাচ্ছে, গলায় শামুক আটকে যাওয়া রাজহাঁসের মতো দেখাচ্ছে ওকে।
হ্যাঁচকা টানে ফ্রিজের দরজা খুলে ফেলল; ভোদকার বোতল দেখে ফ্যাসফেসে শ্বাসরুদ্ধ গলায় উচ্ছ্বসিত ধ্বনি করে উঠল, ‘আহ্পেয়েছি!’ বোতলটা খপ করে ধরে বের করে এনে ফোঁস করে একটা দম ফেলে অনাবশ্যক জোরে মোচড় দিয়ে ছিপি খুলল; বোতলের মুখেই মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে ভোদকা গিলতে শুরু করল, যেন নির্ভেজাল পানি খাচ্ছে। এক দুই তিন করে পাঁচটা পরিপূর্ণ ঢোঁক গিলে সে মুখ থেকে বোতলটা নামাল, ছিপি লাগাল, আবার ফ্রিজের ভেতরে রেখে দিয়ে দড়াম শব্দে ফ্রিজের দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমার দিকে না তাকিয়েই ‘ধন্যবাদ’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
‘কে তুমি?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
মেয়েটা ঝট্ করে ঘাড় ফিরিয়ে আগুনচোখে আমার মুখের দিকে শুধু একঝলক তাকাল, তারপর হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে সেটা ফের বন্ধ করে দিল।
একটু পরেই করিডরে মেয়েটির চিৎকার শুরু হলো: ‘সেদিন আর দেরি নাই। তুই আমার পায়ে ধরে কাঁদবি আর মাফ চাইবি। কিন্তু মাফ আমি করব না। গুলি করে মারব। তোর লাশ আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াব।’
করিডরে বেরিয়ে দেখি মেয়েটা নাইজেরিয়ার এক ছেলের ঘরের দরজায় এলোপাতাড়ি লাথি মারছে আর চেঁচাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার বাড়িয়ে দিল, ‘সব কটা বিদেশিকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে গ্যাসের চুলায় পুড়িয়ে মারব। কুত্তার বাচ্চারা, কার খাস? কার পরিস? কার বিছানায় ঘুমাস?’
‘কী হয়েছে? রাতদুপুরে এমন চেঁচাচ্ছ কেন?’ আমি বললাম।
মেয়েটা একটা বিচ্ছিরি গালি ছুড়ে দিল। তারপর দরজায় জোরে একটা লাথি মেরে ছুটে এল আমার দিকে। যেন পাগলা কুকুর ছুটে আসছে কামড়াতে। আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিলাম। সে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল, ‘খোল্ খোল্, তোকে নয়। তোকে মারব না। দরজা খোল।’
কিন্তু আমি সাড়া দিলাম না।
মেয়েটি ও বন্ধু ও বন্ধু বলে ডাকতে লাগল।
পাগল হয়ে গেছে। রাশিয়া জারের যুগে ফিরে যাচ্ছে, দস্তইয়েফস্কির ম্যাডহাউসে পরিণত হচ্ছে।
‘খুলবি না? তাহলে তোকেও মারব। কালাশনিকভ দিয়ে গুলি করে সবগুলার খুলি উড়িয়ে দেব।’

একটু পরেই কয়েকটা পুরুষকণ্ঠ, ধস্তাধস্তি এবং মেয়েটার চিল–চিৎকারে আমার কানে তালা লেগে গেল।
হঠাৎ লেনিনকে মনে পড়ল। ফ্রিজ খুলে ভোদকার বোতলটা বের করলাম।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.