:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নিবেদিতা আইচ

গল্পকার

জেগে থাকে ঘুণপোকা

জেগে থাকে ঘুণপোকা

মাঝেমাঝে মালতীকে এঁটেল মাটির পুতুল মনে হয় সতীশের। শরীরের প্রতিটা বাঁকে যেন কাদামাটির প্রলেপ দিয়েছে কেউ। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে যখন তখন। মালতী সারি সারি মাটির হাঁড়ির মাঝখানে বসে আপন মনে তুলির আঁচড় দিয়ে যায়। অন্যমনস্কতায় ডুরে শাড়ির এদিক ওদিক রঙ লেগে যায় ওর। একটানা কাজ করে মাথা ধরে মালতীর। কিছু কাজ অসমাপ্ত রেখে উঠে পড়ে সে। ঘরের দাওয়া থেকে ধোয়া শাড়ি আর গামছা নিয়ে স্নান করবে বলে বেরিয়ে পড়ে।

সতীশের চোখজোড়া ওর পিছু নেয়। সে জানে মালতী এখন ঠাকুরবাড়ির পুকুরের দিকে যাচ্ছে। সুগন্ধি সাবানে শরীর ঘষে ঘষে স্নান করবে মালতী। নিজের বৌকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার মধ্যেও যে গোপন একটা আনন্দ আছে এটা জানতোই না সতীশ। দেখে দেখে চোখের আশ মেটে না ওর। গাল বেয়ে কানের লতি ছুঁয়ে জল চুইয়ে পড়ে মালতীর ঘাড়ে, বুকে, সমস্ত শরীরে।

নির্জন পুকুরের ঘাটে বসে একটু বুঝি অসতর্ক হয়ে যায় মেয়েটা। বাবলা গাছের আড়াল থেকে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে রাখে সতীশ! বাম হাঁটুর খানিকটা নিচে বড় তিলটাও ঠিক দেখতে পায় সে। পোড়ামাটিরঙের ভেজা শরীরটা রোদে ঝিকিয়ে ওঠে যার সমস্ত খুঁটিনাটিই ওর জানা!

ভরদুপুরে এঁটো থালাবাসন নিয়ে অন্য বাড়ির বৌ-ঝি’রা আসতে শুরু করে। সতীশ কখনো ওদের সামনে পড়ে যায়। ওকে দেখে মাথায় কাপড় টেনে কেউ মুখ টিপে হাসে, কেউ আবার আদিখ্যেতা দেখে বিরক্ত হয়। সতীশের টকটকে ফর্সা গালে রক্তিম আভা দেখা দেয়। দ্রুত পা চালিয়ে উধাও হয়ে যায় মানুষটা।

মালতী ফেরে আরো অনেকটা সময় পর। অপেক্ষা করতে করতে সতীশের ঝিমুনি এসে যায়। স্নান সেরে আহ্নিক করে তারপর দু’টো মুখে দেয় সে। থালাবাসন ধুয়ে রেখে শাশুড়ির ঘরে গিয়ে পান সাজায়, দু’জন গল্পও করে খানিকটা সময়। সতীশের অভিমান বাড়তে থাকে। বৌটার এই অবহেলা মেনে নিতে কষ্ট হয় ওর। সেই সাত সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় শেষ ওকে ছুঁয়েছে। দুপুর গড়িয়ে যায় তবু মালতীর ওকে মনে পড়ে না? সতীশও তো কত কাজে ব্যস্ত থাকে। সেই সকাল বেলা দুটো নাকে মুখে গুঁজে হাঁড়িকুড়ি নিয়ে বাজারে যায় লোকটা, তারপর সারাদিন সেসব বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়দিনই বেলা ফুরিয়ে যায়। এক দু’দিন আগে ফিরে এলে কিংবা এই আজকের মতো ছুটির দিনে তারও মন চায় নতুন বৌটাকে কাছে পেতে। সেসব বোঝার মন নেই মালতীর? মিষ্টি মুখটার ভেতরে মনটা এত নির্দয় কেন ওর? রাগ করে ঘুমিয়ে পড়ে সতীশ।

সতীশের চোখজোড়া ওর পিছু নেয়। সে জানে মালতী এখন ঠাকুরবাড়ির পুকুরের দিকে যাচ্ছে। সুগন্ধি সাবানে শরীর ঘষে ঘষে স্নান করবে মালতী। নিজের বৌকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার মধ্যেও যে গোপন একটা আনন্দ আছে এটা জানতোই না সতীশ। দেখে দেখে চোখের আশ মেটে না ওর। গাল বেয়ে কানের লতি ছুঁয়ে জল চুইয়ে পড়ে মালতীর ঘাড়ে, বুকে, সমস্ত শরীরে।

সতীশের প্রায়ই মনে হয় মালতীকে সে আগেও কোথাও দেখেছে। কবে বা কোথায় সেটা মনে করতে পারে না। পূর্বজন্মের কথা মনে থাকার কথা নয়। এমনিই মাথা মোটা লোক সে, দু’দিন আগের কথাই মনে থাকে না তার। কিন্তু হতেও তো পারে আগের জন্মে এই মালতীই ওর ঘরনী ছিল আর সে কারণেই ওকে এমন চেনা চেনা লাগে! কথাটা কতবার মালতীকে বলতে চেয়েছে, বলতে গেলেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে  মেয়েটা।

গতজন্মে তুমি সাধু আছিলা গো.. আমারে তো পাইছো এই জন্মে..

নিশুতি রাতের নীরবতাকে চুরমার করে দিয়ে আজও খিলখিল করে হেসে ওঠে মালতী৷ সতীশ ওর মুখে হাত চেপে ধরে। পাশের ঘরে মা একলা শোয়, লজ্জায় মরে যায় সতীশ।

বউ, তোমার মাথার দোষ আছে..এমন কইরা হাসে কেউ?

হাসি চেপে রাখতে গিয়ে মালতীর চোখে জল এসে যায়। সতীশের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে মজা লাগে ওর। অনেক অনুনয় করেও ওকে থামাতে পারে না সতীশ। শেষমেশ শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরে ওকে। প্রবল সোহাগে পিষে ফেলতে চায় মাটির গন্ধমাখা মালতীর শরীরটা। মালতীর সে হাসি তখন কোথায় যে হারিয়ে যায়! হঠাৎ থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে সে। এতসব জানা নেই সতীশের, হয়তো সুখের আবেশে কাঁপুনি ওঠে; এত অতল অনুভূতি খুঁজে বেড়ানোর সময় নেই তার। নেই বলেই মালতীর চোখের কোণের জলরাশি দেখতেই পায় না সে। বরং হঠাৎ পাথর হয়ে যাওয়া মালতীর অনিচ্ছুক শরীরটাকে জাগাতে গিয়ে ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে ওঠে বুভুক্ষু নেকড়ের মতো। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তোলে গহীনে ডুব দেয়া মালতীর জলজ শরীরটাকে। এক ভয়ার্ত হরিণীর মতো সতীশের লোমশ বুকের আড়ালে মুখ লুকিয়ে তার কাছ থেকে যেন মুহূর্তে পালাতে চায় মালতী!

তবু শেষমেশ ধরা দিতে হয় গভীর আশ্লেষের কাছে। যত দেরি হয় তার চেয়ে ঢের গুণ বেশি শুষে নেয় সতীশ। পরাভূত হরিণীর মতো ঢলে পড়ে মালতী, স্তিমিত হয়ে আসে ভেতরের নিনাদ গান।

ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে সতীশ নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়লে মালতী ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে নামে। দু’হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠে তার উনিশ বছরের শরীরটা। দেয়ালে মাথা উঁচু করে চেয়ে থাকা সরীসৃপটাকে তক্ষক বলে বিভ্রম হয়। পা টিপে টিপে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে মালতী।

দু’পা ফেললেই উঠোনের সাথে লাগোয়া টিউবওয়েলের কাছে পৌঁছে যায় সে। একটু দূরে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে কেউ। সেই সাথে ভেসে আসছে মিহি সুরের কান্না। হয়তো তিন ঘর পরের মাতাল গগন পাল কচি বৌটাকে পেটাচ্ছে৷ বৌটাও কেমন মার খেতে খেতে ভোঁতা স্বভাবের হয়ে গেছে। কেঁদেই যায় একটানা, থামাথামির লক্ষণ নেই।

মালতীর অবশ্য এসবে কিছু এসে যায় না। সে বালতিতে ধরে রাখা জল মগে তুলে নিয়ে শরীরের বিষটাকে ধুয়ে নেয় দ্রুত হাতে। সেই কবেকার পুরনো কোনো স্নানের কথা মনে পড়ে যায় ওর। ফুল তোলা ফ্রকের বোতামগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিলো সেদিন। কয়েকটা অনভ্যস্ত ত্রস্ত হাত ভীষণ তাড়াহুড়োয় ওর নরম শরীরটাকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছিলো। হিংস্র মুখগুলো মনে করতে চায় না মালতী, অত অল্প বয়সের কথা ঠিকঠাক মনে পড়েও না ওর। তবু সেদিনকার ছোট মেয়েটা ঠিক বুঝতে পেরেছিলো যে করেই হোক পালাতে হবে ওকে, প্রাণপণে ছুটে পালিয়ে মায়ের কাছে যেতেই হবে ওকে। দৈবক্রমে পালিয়েও ছিলো সে। রাধা-বল্লভের ভাঙা মন্দিরের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে মালতী সেদিন ক্ষেতের আলপথ ধরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিয়েছিলো বাড়ির দিকে।

মা বেশি কিছু জানতে চায় নি, শুধু স্নান করাতে নিয়ে গিয়ে বারবার মেয়ের সারা শরীর হাতড়ে দেখেছে। মায়ের চোখে জলের ধারা মালতীর শরীরটাকে ধুয়ে দিচ্ছিল যেন এক সমুদ্র জল! মা সেদিন ঠাকুরের দিব্যি দিয়েছে; বলেছে, এ কথা যেন সে কখনোই উচ্চারণ না করে, এমনকি তার কাছেও নয়। মালতী ঘাড় নেড়ে তার বুকে মুখটা লুকিয়ে রেখেছিলো।

অনেক অনুনয় করেও ওকে থামাতে পারে না সতীশ। শেষমেশ শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরে ওকে। প্রবল সোহাগে পিষে ফেলতে চায় মাটির গন্ধমাখা মালতীর শরীরটা। মালতীর সে হাসি তখন কোথায় যে হারিয়ে যায়! হঠাৎ থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে সে। এতসব জানা নেই সতীশের, হয়তো সুখের আবেশে কাঁপুনি ওঠে; এত অতল অনুভূতি খুঁজে বেড়ানোর সময় নেই তার। নেই বলেই মালতীর চোখের কোণের জলরাশি দেখতেই পায় না সে। বরং হঠাৎ পাথর হয়ে যাওয়া মালতীর অনিচ্ছুক শরীরটাকে জাগাতে গিয়ে ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে ওঠে বুভুক্ষু নেকড়ের মতো।

এত বছর পর এই দূর পাড়াগাঁয়ে ঘুটঘুটে অব্ধকার রাতে মায়ের বুক কোথায় পাবে সে? গামছায় ভেজা শরীরটা মুছে আলগোছে ঘরে ফিরতে হয় তাই। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে। তারপর আরো বহুক্ষণ জেগে থাকে। সতীশের নাক ডাকা আয়েশী ঘুম নয়, মালতীকে জাগিয়ে রাখে অন্য কিছু। আলপথ ধরে ছুটে চলা সাত আট বছরের ভীত সন্ত্রস্ত এক বালিকা, যার স্মৃতি সে মুছে ফেলতে চেয়েও কখনোই মুছতে পারে না ।

ভোরের আলো মরে গিয়ে যখন ঝকঝকে সাত সকাল, মালতীর শাশুড়ির তখন উঠোন ঝাঁট দিয়ে লেপে মুছে স্নান আহ্নিক করা হয়ে গেছে। সতীশের ডাকে ঘুম ভাঙে  মালতীর। একলাফে উঠে বসে হাঁপাতে থাকে সে। ঘোর কাটে না সহজে। একটু আগেই যেন আঁকাবাঁকা মাটির পথ ধরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেড়াচ্ছিলো মালতী। দ্রুত হাতে গায়ের আলুথালু কাপড় সামলে নেয় সে।

ওকে ডেকে দিয়ে সতীশ আবার পাশ ফিরে শোয়। তার আলসি কাটতে আরো সময় লাগবে। বৌয়ের আঁচলটা মুঠোয় পুরে মিটিমিটি হাসি দেয় মানুষটা। মালতী যতই ছাড়াতে চায় ততই আঁকড়ে ধরে রাখে। অনেকটা হাতাহাতি করে তারপর নিস্তার পায়। সতীশ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে চোখ বুঁজে শুয়ে থাকে। কয়েকটা মুহূর্ত অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থেকে ওর মুখাবয়ব দেখে মালতী। গালের কাছের আঁচিলটা, কবজির ক্ষতটা যেন কত কালের চেনা! একটা মানুষ এত অল্পদিনে এত চেনা হয়ে যায় কী করে! ভাবতে গেলেই দিশেহারা লাগে। কিন্তু উঠোনে ধুপধাপ শব্দটাও বাড়ছে, ভাবনাগুলো তুলে রেখে দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে যায় মালতী।

ঘণ্টা দুয়েক পর ভ্যানে করে রঙিন কলসিগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সতীশ। সোমবারে রাণিখালের বাজার একটু আগে আগেই বসে যায়। পাইকারির দোকান খুলে গেছে সেই কখন। আজ সতীশের একটু দেরিই হয়ে গেলো বুঝি।

মালতীর এখন অনেক কাজ। সতীশ আর তার মা আগেরদিন যে হাঁড়িপাতিলগুলি আগুনের আঁচে পুড়িয়ে রেখেছে সেসব রোদে শুকোতে দিতে হবে। একপাশে কিছু মাটির সরা আলাদা করে রাখা আছে, সেগুলো এখন মালতীর হাতে রঙিন হতে প্রস্তুত। কুমোর বাড়ির মেয়ে বলে এসব কাজে মালতী বরাবরই পটু। নির্ভুল ফুল নকশা ফুটিয়ে তুলতে তার জুড়ি নেই৷ আশেপাশে দু’চারটে বাড়িতে এত সুন্দর হাড়ি তৈরি হয় না আজকাল। এ বাড়িতে মালতীর বিয়ে হবার পর সতীশদের বিক্রিবাট্টা বেড়ে গেছে। সতীশের মা মুখে স্বীকার না করলেও আড়ালে ছেলের বৌয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়৷ শরীরে যেমন রুপের ছটা হাতের আঙুলেও তেমনি রঙ খেলাতে জানে মেয়েটা। শুধু কুমোর বাড়িতে জন্ম বলেই ভগবান বুঝি গায়ের রঙটা এমন ময়লা করে দিয়েছেন। সতুটা এমন টুকটুকে গোর ঠাকুর আর তার বউ কিনা এমন শ্যাওলা! আশেপাশের বৌ-ঝি রা আর কিছুতে না পেরে এই এক গায়ের রঙের খোঁটা দেয় সতীশের মাকে।

ও লো দিদি, সতুর বৌ আনতে গিয়া তোমার চক্ষে ঠুলি পরছিলো নি?

কেউ আবার হিংসায় জ্বলে গিয়ে বলে- আগে হইলো দর্শনধারী তার পরে দিয়া গুনবিচারী…মুখখান দেখলেই মনে অয় চুলার মাটি দিয়া গইড়েছে ঠাকুরে!

শুরুর দিকে এরকম গা জ্বালানো কথা চুপচাপ হজম করতো সতীশের মা। হজম না করেও উপায় ছিল না। সত্যিই তো, তার সতুর জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছিলো? বোকা ছেলেটাই কেমন ধারা পাগল হয়ে গিয়েছিলো মালতীর জন্য। তার মুখ চেয়ে রাজি হতে হয়েছে। তাছাড়া মালতী আর সতুর মামার বাড়ি একই গ্রামে, সেই মিলটাও বিয়েতে রাজি হবার একটা কারণ ছিল বটে।

মালতী মেয়েটা লক্ষীমন্ত। ওর হাতের কাজের যশ ছড়িয়ে পড়েছে এলাকায়। তাই আজকাল গায়ের রঙের কথা তুললে সতুর মায়ের ঠোঁটের ডগায় উত্তর তৈরি থাকে। কেউ সহজে খোঁচায় না এখন। মালতীর মতো মেয়ে হয়? পড়ন্ত দুপুরে শাশুড়ির পায়ের কাছে বসে সেবা যত্ন করে রোজ। কম বয়সী বউ, বুড়ো মানুষটার কাছে দু’দণ্ড বসে যে থাকে এই তো ঢের! আজকাল এমন মেলা ভার। সতুর মা সত্যি বলতে ছেলের বৌটাকে ভালোবেসে ফেলেছে।

সতীশের কবজিতে ক্ষত দাগটার কারণ জানতে এত ভয় হয় কেন ওর? সেদিন ভাঙা  মন্দিরটার পেছন থেকে পালিয়ে আসার আগে গুলতি দিয়ে যার হাতে সজোরে আঘাত করেছিলো তার গালের আঁচিলটা স্পষ্ট করে মনে পড়ে না আর। তবু একটা বিষছায়া কোনো কোনো দিন অষ্টপ্রহর তাকে তাড়া করে বেড়ায়।

সকালটা দুপুরের কোলে ঢলে পড়তেই দাওয়ায় পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে বসে পান চিবোয় সতুর মা। আর এইসব ভাবে। উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাঁড়িকুড়িগুলো রঙিন হতে থাকে সতুর বৌয়ের তুলির ছোঁয়ায়। হাতের আঙুলে গুণে হিসেব করে দেখে সেই শ্রাবণ মাসে ছেলের বিয়ে দিয়েছে, ছয় মাস হবে এই মাঘে। বৌটা এবার পোয়াতি হলে বড় ভালো হয়। কতকাল হয়ে গেছে এ বাড়িতে ছোট ছোট পায়ে ছুটে বেড়ায় না কেউ!

বড় দুশ্চিন্তা হয় তার। বড় মেয়েটাকে সবাই বাঁজা বলেই ধরে নিয়েছিলো। বিয়ের পর কেটে গেছে চারটি বছর! তারপর, এই ক’দিন আগে না ভালো খবরটা এলো। তাই তো হাজীগঞ্জের ও বাড়িতে ডাক পড়েছে সতীশের মায়ের। মেয়েকে আনতে যেতে হবে। ছানাপোনা যত তাড়াতাড়ি আসে ততই ঘর বাড়ন্ত হয়। সতুকে মা হয়ে কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জা লাগে তার। এবার মেয়ে বাড়ি এলে তাকে দিয়েই বলাবে, দিদি বললে হয়ত সতু কানে তুলবে কথাটা।

সুপুরি কাটতে বসে সতুর মা আরো কত রকম সাংসারিক কথা চিন্তা করে। হাজীগঞ্জে দিনে গিয়ে দিনে ফেরা কঠিন। সতুকে সঙ্গে নিলে নতুন বউটা বাড়িতে একা থাকবে। কাজটা ঠিক হবে না। এদিকে তার নিজের যেতেই হবে, বেয়াইন বলে পাঠিয়েছে। সতুর গিয়ে কাজ নেই, তাকে গাড়িতে তুলে দিলে সে একাই গিয়ে নিয়ে আসবে মেয়েকে।

কতদিন পর ঘর থেকে বের হবে সতুর মা! মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এবার একটা রাত থেকেই আসবে। ছেলে আর বৌটাও একটু নিজেদের মতো থাকুক। মাঝেমাঝে ওদেরকে একটু আধটু আড়াল দেয়া উচিত। সতু একদিন বাজারে না গেলে চলে, কাল থাকুক সারাদিন বৌয়ের সঙ্গে।

রাতে সব গোছগাছ করে আগে আগেই শুয়ে পড়লো সতীশের মা। সতীশও খেয়েদেয়ে ঘরে গেলো। খুব ভোরে মাকে গাড়িতে তুলে দিতে হবে ওর। তবু সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মালতীর অপেক্ষায় জেগে থাকে।

মালতী ভীষণ অন্যমনস্ক আজ। নকশি ফুলের ভেতর সতীশের মুখটাই কেবল ঘুরেফিরে মনে পড়েছে। আর সেই থেকে একটা ঘুণপোকা ওর ভেতরটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। যতই এড়াতে চাক না কেন সেটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে গেছে প্রতিটা মুহূর্তে। অন্ধকারে দাওয়ায় বসে সতীশের ডাক শুনতে পায় সে। পা দুটো ভারি হয়ে আছে ওর, অন্যদিনের মতো ভেতরে যাবার আগ্রহ নেই। যেন ভয়ানক কিছু একটা সেখানে অপেক্ষা করে আছে তার জন্য!

‘ঘরে যা মালতী…এত অলক্ষুইন্যা কথা ভাবিস নি’

কানে কানে কেউ ফিসফিস করে যায়। শরীরে কাঁটা দেয় ওর। দূরের আকাশে আধফালি চাঁদটা ছাড়া এ তল্লাটে আর কেউ জেগে নেই হয়তো। তবে কে কথা বলে? কে তাকে সতর্ক করে দেয়?

‘কে…কে কথা কয়?’

প্রশ্নের উত্তর মেলে না। চারপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে মালতী। মিহি আঁধারের গায়ে পাতলা দুধের সরের মতো জোছনা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না ওর।

‘খবরদার ভুইলা থাক সব…মনে নাই মা কালীর দিব্যি দিছিলো তোর মায়ে।’

হয়তো সেই ঘুণপোকাটা জেগে আছে এখনো। মালতী এবার ফুঁসে ওঠে ভেতরে ভেতরে। ঠাকুরের দিব্যি দেয়া মায়ের ওপর রাগ হয় খুব। কোথায় এখন সেই মানুষটা? মেয়ের বুকের ভেতর পাথর জমতে দিয়ে সব কেমন করে ভুলে আছে! শুধু মালতীর স্বপ্নটা কেন ফিরে আসে বারবার?

সতীশের কবজিতে ক্ষত দাগটার কারণ জানতে এত ভয় হয় কেন ওর? সেদিন ভাঙা  মন্দিরটার পেছন থেকে পালিয়ে আসার আগে গুলতি দিয়ে যার হাতে সজোরে আঘাত করেছিলো তার গালের আঁচিলটা স্পষ্ট করে মনে পড়ে না আর। তবু একটা বিষছায়া কোনো কোনো দিন অষ্টপ্রহর তাকে তাড়া করে বেড়ায়।

সতীশ প্রায়ই সেই পরিত্যক্ত মন্দিরটার গল্প করে, গতকাল যেমন করেছিলো। তার মুখেই মালতী জেনেছে মামা বাড়িতে বেড়াতে গেলে সেখানে ওরা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো। মালতী কখনো জানতে চায়নি ওর বন্ধুদের কথা, পড়ন্ত বিকেলে কেউ গুলতি দিয়ে ওকে আঘাত করেছিলো কিনা এসব কথা কখনো জিজ্ঞেস করেনি মালতী।

শুধু এই রাতের কুহকে একটা অতিকায় ঘুণপোকা সমস্ত চেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। মাথার ভেতরটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যেতে চায় মালতীর। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে গুমড়ে কেঁদে ওঠে সে।

 


অলংকরণ : রাজিব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.