:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সানোয়ার রাসেল

কবি ও গল্পকার

ডাকাত

ডাকাতেরা ধান কেটে নিয়ে যায় রাতের আঁধারে। কলিম মুন্সি নিরাপদ দূরত্বে থেকে জিজ্ঞেস করে-
‘কিগো মিয়ার পো, রাইতের বেলা ক্ষেতো কি কর?’
‘কিছু না জ্যাডা, বাতাস খাই। যে গরম পড়ছে!’

২.
ভিজিডি’র চাল বিতরণ চলছে। বস্তার ধুলায় অঞ্চল অন্ধকার। অফিসারের পক্ষে বসে থাকা দায়। ধুলাবালিতে তার এলার্জি। সে সরে আসতে চায় একটু দূরে। গরীবেরা তাকে ঘিরে ধরে।
‘আপনে যাইয়েন না গো স্যার। আপনে গ্যালেগা এরা চাইল অর্ধেক কম দিব। আপনে চাইল না দিয়া যাইয়েন না।’

অফিসারের বিবমিষা হতে থাকে। এদের গা থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ আসে। সে দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারে না। এর চেয়ে ধুলার মধ্যে গিয়ে বসে থাকা ভালো। অফিসার মাস্ক মুখে দিয়ে পুনরায় বস্তার ধুলার মাঝে গিয়ে বসে থাকে।

৩.
গ্রামের জোয়ান ছেলে সুরাপ। পেশা গিরস্থালি। নিজের জমি নাই। চেয়ারম্যানের জমি বর্গা নিয়ে চষে। নতুন বিয়ে করেছে। সুরাপ গরীব চাষী হলেও তার বিচার বিবেচনা ভাল। সে বিচার বিবেচনা করে দেখেছে, তার যা চেহারা সেই তুলনায় তার বউয়ের চেহারা আগুন। তার মত গরীবের কপালে আল্লা এমন পরীর মতো বউ দেওয়ায় সে আল্লার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। আর সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই সে ধর্মে-কর্মে মন দেওয়ার চেষ্টা করে ইদানীং। তাদের বাড়ির কাছের নামাযখানায় জুম্মা হয় না, শুধু পাঞ্জেগানা জামাত হয়। সেখানেই প্রতিদিন বাদমাগরেব সে সময় দেয়, ইমাম সাবের বয়ান শোনে। ইমাম সাব তারে স্নেহের সুরে ধমকায়। কেন সে পাঁচ ওয়াক্তের নামায মসজিদে এসে আদায় করে না? কিভাবে আসবে সুরাপ? সে কি সারাদিন ফুরসত পায় একটুও? পরের জমিতে বর্গা দেয়। জমিনরে একটু অবহেলা করেছো তো জমিনও তোমার কপালে লাত্থি দিবে। ফসল কম উঠলে চেয়ারম্যানের লাত্থি। জমিন বর্গা নেওয়ার লোকের অভাব আছে কি? তার উপর বিভিন্ন সময়ে চেয়ারম্যানের এই কাম সেই কামেও হাত লাগাতে হয়। এত সব ঝামেলা শেষ করে সে যে মাগরেবের ওয়াক্তে মসজিদে হাজিরা দিতে পারে এটাই বা কম কি? ইমাম সাব কি দিন-দুনিয়ার কোনও খোঁজ রাখে? ইমাম সাব রাগ করেন না। অবুঝ বাচ্চারে বোঝানোর মতন করে সুরা পড়ে বোঝান। এই যে জমিন, ঐ যে আসমান, এই সবের মালিক কে? সব কিছুর মালিক আল্লা। তুমি আল্লার সামনে সেজদা দিতে আসলে কি জমিনের বাপের সাধ্য আছে তোমারে ফসল কম দেওয়ার? বরং আল্লার ইবাদত বন্দেগি কইরা তাঁর নাম নিয়া জমিনের পিছনে যখন সময় দিবা জমিন থেইকা ততই বরকত হইবো। মালিকরে খুশি না করে যে মালিকের অধীনস্তরে খুশি করতে সময় নষ্ট করে সে বোকা না তো কি? ইমাম সাবের কথা শুনে সুরাপের অনুতাপ হয়। আসলেই তো সে বোকা। সে পাঁচওয়াক্ত মসজিদে আসার ওয়াদা করে ইমাম সাবের কাছে। পরদিন কাজ-কামের ধান্ধায় আবার ভুলে যায়। আবার মাগরেবের ওয়াক্তের পর শর্মিন্দা হয়ে ইমাম সাবের বয়ান শুনতে বসে। ইমাম সাব হেসে বলেন-
‘কি সুরাপ মিয়া। আইজও পারলা না?’

কেউ কেউ ফিসফাস করে বলতে চায় যে আজ চেয়ারম্যানের ক্ষেতে ডাকাতি হলো বলেই এদের শাস্তি হচ্ছে। কিন্তু চেয়ারম্যান যে গরীবের চাইল ডাকাতি করে তার বেলা? অফিসার, প্রশাসন, এমপি, মন্ত্রী- যারা ডাকাতি করে জনগণের হক, তার বেলা? কিন্তু সেই সব ফিসফাস ‘আওয়াজ’ হয়ে বের হয় না। বিজ্ঞরা এইসব অর্বাচীনদের মুখে চাপা দিয়ে ফিসফাস বন্ধ করে।

সুরাপ মিয়া উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে রাখে। ইমাম সাব টিমটিমে কুপির আলোয় বসে বসে উপস্থিত দুই-তিনজনকে হেদায়েতের উদ্দেশ্যে জান্নাতের নাজ-নেয়ামতের বর্ণনা দিতে থাকে। জান্নাতের নাজ-নেয়ামত প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে হুরদের বর্ণনা চলে আসে। আহা! সে কী তাদের রূপের ছটা! হুরদের বর্ণনা শুনতে শুনতে সুরাপের নতুন বউটার চেহারা মনে আসে। তখন তার এক মন ছটফট করতে শুরু করে বাড়ি যাওয়ার জন্য; অন্য মন পাটিপেতে বসে থাকে হুরদের শারীরের বর্ণনা শোনার আকর্ষণে। ইমাম সাব বলেন, যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে জান্নাতি হয়, তাহলে জান্নাতে তাদের আবার বিবাহ দেওয়া হবে। আর জান্নাতি সেই স্ত্রী হবে সকল হুরের রাণি! আর যদি স্বামী জাহান্নামি হয়? সুরাপরা ভাবনায় পড়ে যায়। ইমাম সাব সেই ভাবনাও দূর করে দেন। স্বামী জাহান্নামি হলে অন্য কোন জান্নাতি পুরুষের সাথে সেই জান্নাতি রমণীর বিবাহ দেওয়া হবে। তারপর সেখানে তারা অনন্তকাল সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকবে।

অদেখা সেই সুখভরা জিন্দেগানির গুঞ্জন মগজে গোঁজে সুরাপ বাড়ির পথ ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে একটা কথা মনে পড়ে তার গতি শ্লথ হয়ে যায়। এই যে জান্নাতি রমণীকে অন্য এক জান্নাতি পুরুষ বিয়ে করবে, সেই রমণীর মনে কি একটি বারের জন্যও তার পৃথিবীর স্বামীটির কথা মনে পড়বে না? জান্নাতি পুরুষের বুকে মুখ ঘসতে ঘসতে তার কি কখনও দোজখের আগুনে পুড়তে থাকা তার সাবেক স্বামীর কথা মনে হলে মন খারাপ হবে? দোজখি স্বামীর জন্য সুরাপের মনটা কেমন কেমন করে। সে দ্রুত পা চালায় তার ঘরের দিকে, যেই ঘরে তার পরীর মতো নতুন বউটা একলা একা ঘরকন্যা করছে।

৪.
‘স্যারের এই ধুলাবালির মইধ্যে খুব কষ্ট হইতাছে।’
‘আরে নাহ! এটা তো আমার দায়িত্ব। গরীবেরা যেন চাল কম না পায় সেটা এনশিউর করার জন্যই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।’
‘স্যারের মতো যদি সবাই হইতো তাইলে গরীবের দুঃখ দূর হইতো। আমাদের চেয়ারম্যানও আপনার মতই গরীব-বান্ধব। কিন্তু সবাই তো আর আপনের মতো হয় না! এই তো, সরকারি গোডাউন থেইকা চাইলের বস্তাগুলি আনার সময় মাইপ্যা দেখলাম বস্তাপ্রতি এক-দেড় কেজি কম। চেয়ারম্যানও খুব চোটপাট করলো ফুড ইনস্পেক্টরের সাথে। তাতে কি লাভ? এই মালই তো সই-সাবুদ কইরা বুইঝা আনতে হইলো। তার উপরে মনে করেন আছে ক্যারিং কস্ট, আছে লুকাল নেতাগো কিছু কার্ড, তার উপর… (বাকিটা চোখ টিপ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হলো)।
‘না, না। তা তো ঠিকই আছে। গুদাম থেকে কম দিলে আপনারা আর কি করবেন। সেইটুকু এডজাস্টমেন্ট আমি কনসিডার করবো। তবে দেখবেন, কেলেঙ্কারি যেন না হয় কোনও।
‘কী যে কন স্যার। আপনার সম্মান মানে আমাগো সম্মান। এহন চলেন স্যার, এই ধুলাবালির মধ্যে বইসা না থাইকা চেয়ারম্যানের রুমে চলেন। উনি আপনারে চা খাওয়ার দাওয়াত দিছেন।’

অফিসার লোকটির পিছু পিছু চেয়ারম্যানের রুমের দিকে তারা পা বাড়ায়। তারপর তারা তাদের গায়ের দুর্গন্ধ নিয়ে হতাশ চোখে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তবে কেউ বিহ্বল হয় না। এ দৃশ্য তারা নিত্য দেখে অভ্যস্ত। বরং লাইনের মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি ব্যস্ততা শুরু হয়। কি জানি, লাইনের শেষে থাকতেই যদি চাল শেষ হয়ে যায়!

সুরাপ জান্নাতে যাওয়ার আশা ত্যাগ করেছে। তার পরীর মতো সুন্দরি নতুন বউ বেশিদিন তার ঘর করতে পারে নাই। কোনও এক রাতের আন্ধাইরে সে তার পুরাতন প্রেমিকের হাত ধরে ভেগে গেছে। অবশ্য পুরাতন প্রেমিকের সাথেই ভেগে গেছে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা কেউ তাকে ভেগে যাওয়ার সময় দেখেনি। তবে যেই রাতে সুরাপের বউ নিরুদ্দেশ হয়, সেই রাতে অনেকেই গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় অচেনা এক যুবককে ঘুরঘুর করতে দেখেছে।

৫.
সুরাপ জান্নাতে যাওয়ার আশা ত্যাগ করেছে। তার পরীর মতো সুন্দরি নতুন বউ বেশিদিন তার ঘর করতে পারে নাই। কোনও এক রাতের আন্ধাইরে সে তার পুরাতন প্রেমিকের হাত ধরে ভেগে গেছে। অবশ্য পুরাতন প্রেমিকের সাথেই ভেগে গেছে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা কেউ তাকে ভেগে যাওয়ার সময় দেখেনি। তবে যেই রাতে সুরাপের বউ নিরুদ্দেশ হয়, সেই রাতে অনেকেই গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় অচেনা এক যুবককে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। কাজেই গ্রামের লোকেরা অনুমান করে নিতে দেরি করে না। সুরাপ মনে মনে ভাবে, আহা, সে যখন বউটার সাথে শুইতো, তখন বউটা নিশ্চয় মনে মনে তার পুরাতন প্রেমিকের কথা মনে করে কাঁদতো! অথচ সেই কান্দন সুরাপ কেন কোনওদিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি? সুরাপের মুখে চুনকালি মেখে বউটা যেই গুনাহ করেছে, নিশ্চয়ই সে জান্নাতে যেতে পারবে না। কাজেই সুরাপও জান্নাতের প্রতি আকর্ষণ হারায়। তাকে আর বাদমাগরেব মসজিদে দেখা যায় না। দেখা যায় না কাকডাকা ভোরে জমিনের যত্ন নিতেও। উদভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করে সুরাপ। গ্রামে অচেনা কোন যুবক দেখলেই তার সন্দেহ হয়। মানুষজনের উপর না-হক খেঁকিয়ে ওঠে। লোকে সন্দেহ করে, সুরাপ বোধহয় পাগল হতে চলেছে।

৬.
চেয়ারম্যান-বাড়িতে ডাকাত ধরা পড়েছে। দুইজন যুবকবয়সী ডাকাত। চারজন ছিল। দুজন পালিয়েছে। এরা রাতের অন্ধকারে চেয়ারম্যানের ক্ষেতের ধান কাটছিল। কেউ একজন দেখে হাঁকডাক করে লোক জড়ো করে। লোকের ধাওয়ায় দু’জন ধরা পড়ে। তাদের প্রাথমিক মারধোর করে সুপারিগাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোর-ডাকাত সচরাচর ধরা পড়ে না। কাজেই এরা দর্শনযোগ্য। গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই ভেঙে পড়েছে ডাকাত দেখার জন্য। ভিড়ের মধ্যে বিশেষ খাতির পাচ্ছে কলিম মুন্সি। কেননা, সে দাবি করেছে এক রাতে সে এই ডাকাতদেরই শরাফত মণ্ডলের ক্ষেতের ধানও কাটতে দেখেছিল। কিন্তু নিতান্ত একা থাকায় সে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। ধর্মের কল বাতাসে নড়েছে, আজকে সেই ডাকাতগুলোই ধরা পড়েছে। কাজেই পূর্বকৃত ডাকাতির সাক্ষী হিসাবে সে আজ সমবেত জনগণের বিশেষ খাতির পেতেই পারে। এত কিছু থাকতে ডাকাতেরা ক্ষেত থেকে ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে কেন এই নিয়েও কেউ কেউ ফিসফাস করে। আরেকজন হিসাব বোঝায়, কেন ধান ডাকাতি করবে না? বাজারে চাউলের দাম তো সোনার লাহান! এমন সোনা যদি ক্ষেতে পড়ে থাকে, আর পেট যদি থাকে ভুখা, তাহলে মানুষজন করবে না ধান ডাকাতি? কেউ কেউ ফিসফাস করে বলতে চায় যে আজ চেয়ারম্যানের ক্ষেতে ডাকাতি হলো বলেই এদের শাস্তি হচ্ছে। কিন্তু চেয়ারম্যান যে গরীবের চাইল ডাকাতি করে তার বেলা? অফিসার, প্রশাসন, এমপি, মন্ত্রী- যারা ডাকাতি করে জনগণের হক, তার বেলা? কিন্তু সেই সব ফিসফাস ‘আওয়াজ’ হয়ে বের হয় না। বিজ্ঞরা এইসব অর্বাচীনদের মুখে চাপা দিয়ে ফিসফাস বন্ধ করে। এখন ডাকাত ধরা পড়ছে, এখন এই সব বলার সময় নয়। কে জানে, বেশি উচ্চবাচ্য করলে হয়তো অর্বাচীনদেরকেও ডাকাতি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হতে পারে! তবুও হয়তো অর্বাচীনরা ফিসফিসানি বন্ধ করতো না। কিন্তু কোত্থেকে যেন সুরাপ পাগলা লাঠি হাতে হাঁক মেরে লাফাতে লাফাতে উপস্থিত হয়। ‘শালা ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইত! ধান লুট করস? মাইনসের সম্পদ দেখলেই তগো জিরবা লকলক করে? এত খিদা? নে, মাইর খা, মাইর খা’ বলতে বলতে পিছমোড়া করে বাঁধা ডাকাতদের সাপ পেটান পেটাতে থাকে। বাদবাকি সমস্ত ফিসফিসানি এই নতুন তামাশার নিচে চাপা পড়ে যায়। সবাই সুরাপ পাগলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রঙ্গ দেখে। আর সুরাপ পাগলা ডাকাতদের মুখে কী দেখে? তার পরীর মতন বউটাকে নিয়ে ভেগে যাওয়া অচেনা লুটেরা যুবকের মুখ? সেই বৃত্তান্ত আর কারও জানা হয় না। না হোক, লুটেরার দেশে পাগলের বৃত্তান্ত জেনে কাজই বা কি?

 


অলংকরণ : রাজিব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.