:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
অথ রাধাবিরহ
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

অথ রাধাবিরহ

১.
‘সজনি আজ দুরদিন ভেল’
.                 —রায় শেখর

নীল আকাশের নিচে নদী যখন মেলে ধরে নিজেকে, তার স্রোত, জলস্তর, ঘোলা রঙের জল কিরকম উজ্জ্বল হয়ে উঠে চকচক করে, নদী তখন কিশোরী। আর যখন তার আঁকাবাকা গড়নে নদী উছলায়, ঠমক-চমকে মোহিত করে, সে তখন এক পূর্ণ যুবতী।
শ্রীময়ীকে এক ঝটকায় দেখে তেমনিই মনে হচ্ছিল মাধব-এর। কে জানত আত্মীয়বাড়ি এসে ফিরতি পথে দেখা হয়ে যাবে। চেনার অবকাশ মুহূর্তে তাঁর এরূপ মনে হোল যে, কতদিন পর দেখা হোল। এত পুরাতন চেনাজানা, তবু প্রথম দেখাতেই চিনতে পারেননি। দৌড়ে এসে প্রায় গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জানতে চাইলেন, কেমন আছ?
কে?
এখনও ঠিকঠাক চিনলে না আমায়?

তখন ভাল করে দেখল মাধব। বেতস লতার মত একই রকম ছিপছিপে রয়ে গেছেন শ্রীময়ী। নীল শাড়ির পাকে পাকে সর্বত্র ফুটে আছে শরীর। ঝুলপি থেকে এক ফোঁটা ঘাম ধীর গতিতে নামছে কানের পাশ দিয়ে। নাকের ডগা ও কপালে আলগোছে পড়ে থাকা নরম চুলের গুচ্ছের ফাঁকে বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁকে আরও লোভনীয় করে তুলেছে। মাধব বললেন, আঃ, শ্রীময়ী।

ওঃ—। নিজের উচ্চারিত এই ধ্বনিতে, যেন নিজেই আহত হলেন, এমনি করে মুখ ঘুরিয়ে নেন। তখনি মাধবের মনে হয়, এই নামে তিনি তো কখনও ডাকেননি। তাহলে কেন ভুল হল? তবে কি এতদিন, পুরাতন সময়ের ফাঁকেই পড়ে ছিল সে। নতুন সময়ের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে যাবার ফুরসত পাননি।

মোরাম রাস্তার ধারে বেগুন গাছগুলিতে জল দিচ্ছে রোগা, কালো, শ্রীহীন, বছর বারোর এক মেয়ে। কাজের ফাঁকে সে তাঁদের দেখছে আর ফিকফিক হাসছে। শ্রীময়ী ঝেঁঝেঁ উঠলেন, কেন রে পোড়ামুখি? শুনে ক্ষীণাঙ্গী মেয়েটা দাঁত ছড়িয়ে হেসে ফেলে। তাতে আরও রেগে ওঠেন শ্রীময়ী। সরে যান কদম গাছের ছায়ায়। আগে সেটি খুব সুদৃশ্য গাছ ছিল। প্রতি বর্ষায় ঝেঁপে ফুল আসত। আয়লায় দুটি ডাল ভেঙ্গে সেই সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রীময়ী নিঃশ্বাস ছাড়ে। সঙ্গিনী মেয়েটি চন্দ্রা দাস। চোখের ইশারায় মাধবকে বলে, যাও। মাধব ইতস্তত করে।
আরে যাও। মান করেছে মানিনী বুঝতে পারছ না?

শ্রীময়ীর মুখে এক বিরক্তি ভাব। কিন্তু দীর্ঘ অর্দশনের পর যে মাধবের সঙ্গে মিলনের জন্য তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন, বাইরে তার প্রকাশ নেই। প্রবল বাতাসে যেমন আকাশের নিচু মেঘ দূর হয়ে যায়, তেমনি তাঁর মনের কোনে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা পুঞ্জিভূত বিরহভাব দূর হয়ে গেল। কিন্তু মুখের ভাব প্রকাশে বিরক্তিকে ধরে রাখলেন। মাধব সেটা বুঝতে পারলেন না। চন্দ্রা চুপিচুপি তাঁকে বললে, যাও। ক্ষমা চাও। পায়ে ধরে ক্ষমা চাও।
মাধব অবাক। বলল, পায়ে ধরে?
অবশ্যি। নইলে মান ভাঙ্গবে কেন? কেউ দেখবে না। এখানে কেউ নেই।

মাধব এক পা এক পা করে এগোতে থাকেন সেই কদমের দিকে। এক সুশীতল রৌদ্রছায়া বিরাজ করছে যেমত শান্তি বিরাজ করে মানুষের আঙ্গিনায়, ঘর-গেরস্থালির ভেতর। গাছটা বনের কিনারে। রাস্তার অপর দিকে কিছু লোকের বাস। পর্ণ কুটীর। একত্র নয়, বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কুটীরগুলি অবস্থিত। পুরুষেরা কাজে বেরিয়েছে। মহিলারা এই পড়ন্ত দুপুরে ঘুমিয়ে আছে।

গাছের আলোছায়ায় শ্রীময়ী বসে। মাথায় টেনেছেন ঘোমটা। কাঁদছে? পিছন থেকে মাধব বুঝতে পারেন না। তিনি সামনে দাঁড়াতে শ্রীময়ী চকিত হরিণীর ন্যায় কটাক্ষ হানলেন, ঘোমটা খসে পূর্ণ চাঁদের মত মুখশ্রী উদ্ভাসিত হল। তিলফুলের ন্যায় নাসিকা। অধরের রক্তিমায় বিম্বফল। নয়নদ্বয় যেন যুগল খঞ্জন। তাঁর কন্ঠ শঙ্খ সদৃশ, স্তনদ্বয় যেন চক্রবাকযুগল। মৃণালের মত বাহু এবং রক্তপদ্মের মত দু’টি কর। দেহের রঙ সেই তেমনি আছে, কনক চাঁপার মত। সে রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন মাধব। দীর্ঘ এক যুগ পর দেখা। একদা যাঁর চোখের নাচনে মাধবের হৃদয় নেচে উঠত, যিনি একবার নিঃশ্বাস ফেললে তাঁর প্রাণ কেঁপে উঠত, এখন এমনি আকুল হয়ে বসে আছেন।

আমি সহজ সরল এক গ্রাম্য নারী। শহুরে মেয়ের মত ছলাকলা জানি না। রূপের গরবে গরবিনী হতে পারি না। বুকের ওড়না ফেলে সব দেখিয়ে ঠমক-দমক পায়ে হাঁটতে পারি না। কটাক্ষে কখনো কোন পুরুষকে ঘায়েল করিনি। তুমি ওইসব চাও। যার স্তনে পদ্মের বদলে স্বেদগন্ধ মেলে, সে নারী কখনও প্রেমিকা হতে পারে না। সে চিরকাল এক কামুক নারী হয়ে রয়ে যায়।

কড়া গলায় শ্রীময়ী বললেন, এখানে এসেছ কেন? অন্য নারীর কাছে এতদিন কাটিয়ে এখন মিথ্যে কেন আমাকে কাঁদাতে এসেছ? যে নারী তোমার হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তার চরণ সেবা করগে যাও।
কী-সব বলছ তুমি।
দড়ি-কলসী জুটল না তোমার?
তোমার এই পীনপয়োধরাকে কলসি করে আমি তোমাতেই ডুবে মরতে চাই।
আমি সহজ সরল এক গ্রাম্য নারী। শহুরে মেয়ের মত ছলাকলা জানি না। রূপের গরবে গরবিনী হতে পারি না। বুকের ওড়না ফেলে সব দেখিয়ে ঠমক-দমক পায়ে হাঁটতে পারি না। কটাক্ষে কখনো কোন পুরুষকে ঘায়েল করিনি। তুমি ওইসব চাও। যার স্তনে পদ্মের বদলে স্বেদগন্ধ মেলে, সে নারী কখনও প্রেমিকা হতে পারে না। সে চিরকাল এক কামুক নারী হয়ে রয়ে যায়। যখন যে পুরুষ সে সামনে পায়, তাকেই সে টেনে নেয়। সে হল পুরুষ-শিকারী। ওই তোমার পক্ষে ঠিক ছিল। তুমি নিজে যেমন কুটিল, সেও তেমনি। তার সঙ্গে মিলন ঠিক আছে তোমার?
কে বললে তোমার মিলন লাগি আমি এসেছি? আমি কি জানি তুমি এখানে থাক? এখানের মাঠেঘাটে তোমার গৃহপালিত পশুরা আপনমনে চরে বেড়ায়। আর তুমি আশ্রম কন্যা শকুন্তলার মত তাদের পরিচর্যা কর। সেখানে যদি দেখা হয়ে যায়, তাহলে আমি কী করতে পারি।
এই হরিণঘাটায় তোমার যে এক আত্মীয়ের বাড়ি— আগে তো বলনি কোনদিন।
নতুন কুটুম। একটা অনুষ্ঠান ছিল, নেমত্তন্ন রক্ষা করতে এসেছিলাম। ফিরতি ট্রেকার মিস, আবার কে একঘন্টা অপেক্ষা করে, তাই এই মোরাম রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে যতটা এগোন যায়, যাচ্ছিলাম। বিশেষত আসার সময় এক নদীকে দেখেছি। লোকমুখে শুনলাম সে হল ঘিয়া নদী।
তাই নদীর কাছে যাচ্ছিলে। পথে বৃষ্টি নামলে?
ওর পুলের ধারে বটগাছ আছে, সেখানে আশ্রয় নিতাম।
ছাতা আননি?
মনে থাকে না।
সে গুছিয়ে দেয় না?
ভুলে গেছি আনতে।
তুমি জানতে নদীর ধারে আমার বাড়ি। তবে কি কোথাও গেলে নদী অবধি হাঁটতে থাক?
আমি নদীর পাড় খুঁজি। নদীকে খুঁজি। সেখানের মানুষদের দেখি।
আমাকে খুঁজেছ কোনদিন?
তোমার গ্রামের নাম মনে আছে। কিন্তু সেটা যে এটাই, তা বুঝতে পারিনি।
তুমি আমাকে আর কত পরীক্ষা করে দেখবে বলতে পার।
কদমের কান্ডে কত ধুলোবালি রয়েছে। তোমার শ্রীঅঙ্গে কালি লাগবে।
গ্রামের মেয়ের এসব নিয়েই সংসার সাজাতে হয়।

বৃষ্টি ঝেঁপে আসছে।
মদনের শরে যে অহর্নিশি জ্বলেপুড়ে মরছে, এই ধুলোবালি-বৃষ্টিধারা তার কি করতে পারে।
এতদিন পর যদিও দেখা হল,শূন্য হাতে ফিরতে হবে? তাহলে তাঁর দশদিক শূন্য হয়ে যাবে। এই ভেবে মাধব স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃষ্টি এখন দু’চারটি ফোঁটা করে পড়ছে। শ্রীময়ীর নীল শাড়িতে সে ফোঁটা পড়ে শাড়ির রঙ আরও মনমোহিনী করে তুলছে। এবার বৃষ্টি বাড়ছে। দু’জনে এখন ভিজতে থাকলেন। কদমের তল থেকে শ্রীময়ী একটু এগিয়ে গেলেন। সর্বাঙ্গ সিক্ত। তাঁর এই এগিয়ে যাওয়া দেখে মাধবের মনে হয়, ‘চলে নীল শাড়ি নিঙ্গারি নিঙ্গারি পরাণ সহিত মোর।’ তাঁর এই মুগ্ধ ভাব দেখে দূর থেকে ঈশারা করল হলুদ চুরিদার পরিহিত চন্দ্রা, কি করছ কি; ক্ষমা চাও।

আজ এই প্রথম মাধব আগের মত ডাকলেন, শ্রী—

২.
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর’
                 —বিদ্যাপতি

শ্রীমতী-মাধব বিষয়ক এই কাহিনি যাঁরা পাঠ করছেন তাঁদের কিছু বিষয় জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। দুই চরিত্রের কাউকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। চন্দ্রা দাস আমার পরিচিত। একদা সে যেখানে টিউশন নিতে যেত, তার পাশেই আমার বাড়ি। তাঁদের প্রেমের কাহিনি শুনেছি। সেখানে অনেক গল্প ভেসে আসে। তৈরী হয় মিথ। সে সব বিস্তারিতভাবে জানতে চাই। তখন চন্দ্রার সঙ্গে যোগাযোগ করি। শ্রীময়ী-মাধবের প্রেমের যাবতীয় ঘটনার সাক্ষী এই মেয়েটিই। যখন ওঁদের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করি, সে জানতে চায়, তামাদি হয়ে যাওয়া এই প্রেম কাহিনির প্রতি আমার এত আগ্রহ কেন? এর উত্তর আমার কাছেও নেই। বলি, সে একসময় বলা যাবে। কিন্তু সে সব খুলে বলুক।

চন্দ্রা পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে। এইট অবধি পড়েছিল। এখন বাড়িতেই থাকে, মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করে। তার বিবাহের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। তাই সে বাড়িতে শাড়ি পরে। সে এখন আর রসিকা কিশোরী নেই, এক পরিপূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছে। গাত্রবর্ণ কালো হলেও রূপোল্লাস বেড়েছে। তার শ্রীফলের ন্যায় স্তনযুগল দেখে নির্লজ্জ হতে ইচ্ছে হয়। তার প্রথম যৌবন এক রুদ্ধদ্বার ভান্ডার। দুপুরে একাকী কোকিলের ডাক শোনে। হুতাশনে কেটে যায় যৌবন তাহার। চন্দ্রালোকিত আলোয় সে চকোর পাখি খুঁজে বেড়ায়। দেহে যাতে রোমাঞ্চ দেখা দেয় তার জন্য তার কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। সে যত শ্রীময়ী-মাধবের প্রেমের কথা ভাবে তত শিহরিত হয়। তার যৌবনের ডাকে সে যে কাতর, তা বুঝে বাড়ির লোক যত তর্জন-গর্জন করে, সে লুকিয়ে হাসে। তার কথায় যাবার আগে শ্রীময়ী-মাধবের অতীতকথা বলে নিই কাহিনির স্বার্থে। তারপর আবার আমরা বর্তমান সময়ে ফিরব। চন্দ্রার মাধ্যমেই আগের এপিসোডের মতই জানব মান ও কলহান্তরিতা অংশ শেষ হলে তাঁরা কী করলেন।

প্রাচীন ঘিয়া নদীর পাড় বরাবর এলোমেলো ভাবে কিছু মানুষ বাস করত। একদা তাদের সকলেই ধীবর। পরবর্তীতে নানা জীবিকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমনই এক পরিবারের মেয়ে শ্রীমতী। তাঁর বাবার ছিল খাপলা জাল। মায়ের তিনটি গরু। তাই দিয়েই সংসার চালানোর পাশাপাশি তারা শ্রীময়ীকে উচ্চ-মাধ্যমিক অবধি পড়িয়েছিল। ফলত; উপযুক্ত পাত্রের অভাবে তাঁর বিবাহে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বহু চেষ্টা চরিত্র করে যদিও বিবাহ হয়, সে বিবাহিত জীবনে অসুখী। সেই পুরুষের লিঙ্গ অতি ক্ষুদ্র। কবিরেজি, লিঙ্গ বর্ধক যন্ত্র ও তেল ইত্যাদি ব্যবহারেও তা কোনরূপ বৃদ্ধি পায় না। স্বামী ছেড়ে শ্রীমতী পিতার গৃহে ফিরে আসেন। হন্য হয়ে চাকরির চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর বাবা-মা ভাবেন, গরীব ও নিচু জাতের মেয়েদের বেশি পড়াতে নেই। কারণ উপযুক্ত বর মেলে না।

পরিচিত এক ব্যক্তি মারফত নিজ গৃহ থেকে অনেকটাই দূরে শ্রীময়ী চাকরি পেলেন এক এনজিও তে। সেখানে কিছু অসহায় মেয়ে-বউ থাকে, সংসারে যাদের কেউ দেখার নেই, তাদের সুপারভাইজ করাই কাজ। মাধব সেখানের হিসেব রক্ষক। তাঁরা একে অপরের রূপে মুগ্ধ হলেন। ক্রমে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থাকলেন। এনজিও’র কর্মীরা জানত ওঁরা বিয়ে করে সংসারী হবেন।

আমাকে যদি তুমি পরীক্ষা নিতে চাও, তাহলে এই আমার সামনে দাঁড়াও, আমি তোমার সুমুখেই প্রাণত্যাগ করব। তোমার মিলনের লাগি অন্ধকার রাস্তায় একাকী হাঁটা অভ্যেস করেছি। বর্ষার দিনে যদি তুমি অভিসারে ডাক, তাই উঠোনে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে আঙ্গুল চেপে, নুপূরের শব্দ লুকিয়ে চলা প্র্যাকটিস করেছি। এখন এ অভাগিনীর প্রতি এ তোমার কেমন বিবেচনা?

কিন্তু তেমনটি ঘটল না। এদের প্রেম পূর্বরাগ-অনুরাগ-রূপানুরাগ পর্ব পেরিয়ে যখন ঘিয়ার জলে ধাক্কা খেতে খেতে আক্ষেপানুরাগ-প্রেমবৈচিত্রের দিকে চালিত হচ্ছে, ব্রজ’র আগমন। বৈজয়ন্তী বা সংক্ষেপে ব্রজ। ব্রজ কাজে যোগ দিল চলতি মহিলাদের নিয়ে প্রকল্পের হেড হিসাবে। এখানের সমস্ত কর্মীদের চেয়ে সে বেশি শিক্ষিত। তার বাড়ি কলকাতা শহরে। তার চাল-চলন, কথার কায়দা আলাদা। তার উপর অতিমাত্রায় সুন্দরী। যা জুটল তাই পোশাক পরে না। চুরিদার বা শাড়ির কায়দায় তার শরীরের সব ভাঁজ ফুটে ওঠে। সে জানে এই অফিসে তার মত রূপসী কেউ নেই। সকাল-সন্ধ্যা সবাই কেবল তাকেই দেখে যায়।

সে একমাত্র মাধবের সঙ্গেই কথা বলত, এমন ভাব করত যেন এখানে মাধব ছাড়া আর কোন স্মার্ট পুরুষ মানুষ নেই। এই নিয়ে মাধব-শ্রীময়ীর ঝগড়াও হয়েছে। এনজিও’র কর্মীদের মুখে গুঞ্জন, মাধব তাকে ছেড়ে বাহারি রূপসী ব্রজ’র কাছে চলে যাবে।
শ্রীময়ী ভেবে পান না এটা কিরূপে সম্ভব। এই মাধব তাঁকে একদিন নিভৃতে বলেছিলেন, তুমিই আমার বাঁচার শক্তি। সেই লোক কি করে তাঁকে ছেড়ে দিতে পারে। তাঁর এই হৃদয় মন্দিরে মাধব বিরাজ করছেন। যতক্ষণ না তিনি সে হৃদয় পিঞ্জর উন্মক্ত করছেন, মাধবের সাধ্য কি তাঁকে ছেড়ে যান।

‘কাল অফিস ছুটি। ওরা সিনেমায় যাবে—’ এক সহকর্মীর মুখে এ কথা শুনে তিনি হতবাক। ব্রজ’র সঙ্গে মাধব যে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলছেন, শ্রীময়ীর বহু তিরস্কারেও সে কথা কখনও স্বীকার করেননি। এখন সিনেমার কথা শুনে তিনি যেন হীনবল হয়ে পড়েন। কি করে তিনি শ্রীময়ীকে বিস্মৃত হলেন, শ্রীময়ী ভেবে পান না। পূর্বজন্মে ভুলক্রমে বিধাতা ভাগ্যে যা লিখে দিয়েছিলেন, তাই হোল? অথবা বিধির সব বিধান উলটে গেছে। তাই এমন সৃষ্টিছাড়া কান্ড ঘটছে। মনে হয় তাঁর হৃদয় মন্দির শূন্য, দুঃখে বুক ফেটে মৃত্যু ঘটবে এখনই।

একাকিনী শ্রীময়ী ভাবেন, তবে কি আমার ভুল? স্বার্থপূর্ণ সংকীর্ণ প্রেমে অন্ধ আমি তাঁর প্রতি অন্যায় সন্দেহ করছি। একাকী তাঁকে আমার কেন্দ্রে আটকে রাখা কি ঠিক? মাধব সর্বদা তাঁর অনুভবের বিষয় হয়ে আছেন। কিন্তু তবু মাধবের স্পর্শ স্পর্শমণির মত তাঁর কাছে দুর্লভ হয়ে উঠেছেন। তিনি নিজেকে বললেন, হে মাধব, তুমি আমার গর্ব বাড়িয়ে দিয়েছ। আমি এক কুলশীলমাণহীন নারী। জাতে নিচু। স্বামী ত্যাগীনী। তুমি উচ্চ-বংশজাত। তবু তুমি আমায় ভালবেসেছ। কিন্তু এখন এ তোমার কেমন ব্যাভার। আমার সম্মুখেই তুমি পরনারী গমন কর। আমাকে যদি তুমি পরীক্ষা নিতে চাও, তাহলে এই আমার সামনে দাঁড়াও, আমি তোমার সুমুখেই প্রাণত্যাগ করব। তোমার মিলনের লাগি অন্ধকার রাস্তায় একাকী হাঁটা অভ্যেস করেছি। বর্ষার দিনে যদি তুমি অভিসারে ডাক, তাই উঠোনে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে আঙ্গুল চেপে, নুপূরের শব্দ লুকিয়ে চলা প্র্যাকটিস করেছি। এখন এ অভাগিনীর প্রতি এ তোমার কেমন বিবেচনা?
মাধব বলেন, শোন শ্রী—
খবরদার। ঐ নামে তুমি আর ডাকবে না আমায়।

৩.
‘ছাড়িয়া পুরুষ-দেহ কবে বা প্রকৃতি হব’
                 —নরোত্তম দাস

পাঠক-পাঠিকারা, আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, কোন পাড়ায় বা বৃহৎ মহল্লায়, কিংবা কোন দূরবর্তী গ্রামে এমন হয় যে, কোন এক যুগলের প্রেম সেই এলাকায় অমর হয়ে যায়, আমাদের এই কাহিনির দুই পাত্রপাত্রী সে ভাবেই হরিণঘাটায় গল্পের স্রোত হয়ে বয়ে যায়। যাদের প্রেম পূর্ণতা পায়, তাদের নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে মানুষ। তারাই আলোচনার জন্য মুখে মুখে ফেরে যারা মিলতে পারে না এ সংসারে, যারা হাহাকারের মধ্যে কাটিয়ে দেয় জীবন। কিন্তু রয়ে যায় তাদের প্রেমালাপের রেশ। আমাদের এই কাহিনির মাধব-শ্রীময়ী’র প্রেম তেমনি হয়ে উঠতে থাকে। হরিণঘাটায় চলে আসি। সেই পর্ণকুটীর, যেখানে একদা শ্রীময়ী-মাধবের মিলন হয়েছিল, এখন পরিত্যক্ত, যাকে ক্রমশঃ ঘিরে নিচ্ছে লতাপাতাশ্রেণী। সেখানে ঢুকে দেখি আসবাব কিছু নেই। সব চুরি গেছে। মাটির মেঝেতে ধুলোর আঁচড়। এককোণে পড়ে আছে দু’তিনটে ব্যবহৃত কনডম।

আমি সেই আদি ও অকৃত্রিম ঘিয়া নদীর পাড়ে চুপ করে বসে থাকি। এখানের জলে ঢেউ ওঠে, মানুষের স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা স্রোতে ভেসে যায়। মানুষেরা যে কথা কেবল নদীকেই বলে, সেই সব কথারা জলের ফেনা হয়ে নদীর পাড়ে জমা হতে থাকে। পাখি ডাকে। ওপারের মাটিতে শিয়াল নিঃশব্দে জল খায়। এসবের ভেতর আমি খুঁজে চলি নিজেকে।

নিজেকে খোঁজার কথা আমাকে প্রথম বলে চন্দ্রা। নদীর ধারে বসে সে বলে, মানভঞ্জনের সময় মাধব তাঁর মাথা নিচু করে মস্তকের ছায়া শ্রীময়ীর পদযুগলের উপর ফেললেন, তিনি আঁচল দিয়ে পা ঢাকলেন। তখন মেঘ পাকিয়ে উঠল, হু হু বাতাস, বৃষ্টি শুরু হোল অঝোর ধারায়। শ্রীময়ী তাঁকে বললেন, চল, আমার ঘরে। ঘিয়া নদীর পাড়েই আমার পর্ণকুটীর। তোমার হয়ত অসুবিধে হবে, কোটাবাড়ির লোক। আর ভয় নেই, আমার অশীতিপর ঠাকুমা বড়াই রয়েছে ঘরে। জল থামলে চলে যেও।

বাইরে অঝোর বরিষণ। কুটিরে তাঁরা সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভেতর মিলিত হলেন। নিভৃত কুঞ্জে মাধবকে নিজ বাহুবন্ধনে পেয়েও শ্রীময়ী দারুণ বিরহে কাতর হয়ে মাধবের নাম ধরে কেঁদে অস্থির হতেন। এখন বুঝি সব হারিয়েও শ্রীময়ী কেন, কিসের জোরে বেঁচে থাকত। আর সে কি ঝগড়া দু’জনের তা যদি দেখতে। একদিন শ্রীময়ী বলে দিল, পরের জন্মে আমি তুমি, তুমি আমি হয়ে জন্মাব। তুমি যেমন এই জন্মে আমায় কাঁদিয়েছ, আমিও তেমনি করে পরজন্মে তোমায় কাঁদাব। এই ভাবে প্রতিশোধ নিয়ে আমি মনের ঝাল মেটাব।

জানি এসবের ভেতর থাকতে নেই, শুনতে নেই। কিন্তু তখন আমার কতই বা বয়েস। শ্রীময়ীকে দিদি বলা উচিত। মা কত বকেছে আমায়। শুনিনি। কারণ শ্রীময়ী আমায় বলত, এই ধরাধামে তুই-ই আমার একমাত্র সই। সইকে কেউ দিদি বলে? ওদের বিয়ে নাই হোক, সমাজ ওদের স্বীকার না করুক, আমি করি। অমন প্রেম দেখা যায় না।
মাধব কি ব্রজকে বিয়ে করেছিল?
না। এক্ষেত্রে শ্রীময়ীর কথাই ঠিক। যখন ব্রজ ওখান ছেড়ে অন্য অফিসে কাজে যোগ দিল, আবার নতুন পুরুষবন্ধু নিয়ে আদিম খেলায় মেতে উঠল। বাদ হয়ে গেল মাধব। তারপরই সে শ্রীময়ীর কাছে ফিরে আসে। চাকরি ছেড়ে মাধব এই নদীতে খেয়া পারাপারের কাজ করতেন। এখানেই এক কুটীর বানিয়ে বাস করতেন। শ্রীময়ী তাঁকে বারণ করেছিলেন। খেয়া টেনে কি আর পেট চলে? মাধব লেখাপড়া জানা লোক, ট্যালি জানেন; এমন কাজ করবেন কেন? তার চেয়ে কলকাতায় কোন বহুজাতিক অফিসে কাজ করুক না কেন। বা জাতীয়স্তরের বড় কোন এনজিওতেই বহাল হোন আবার। আর কিছু তিনি চান না। কেবল শ্রীময়ীকে ভালবাসলেই হবে। এখানে থাকলে কেরিয়ারের বারোটা বেজে যাবে। কিন্তু মাধব শোনেননি। উলটে বলেছেন, তোমার কুটিরের পাশেই কুটির বানিয়ে রয়ে যাব, লোকে অকথা-কুকথা বলবে, তাই চলে যেতে বলছ? তুমি কলঙ্কের ভয় পাও শ্রী?

শুনে শ্রীময়ী হাসলেন। বললেন, তোমার জন্য এ কলঙ্ক যদি জীবনে আসে, সে ত আমার সৌভাগ্য গো। হোক না এমন সুখের কলঙ্ক। সে কলঙ্ককে মালা গেঁথে পরব আমি। মাধব বলেন, এতদিন আমি নিজেকে চিনতাম না। এখন আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। আর পেয়েছি বলেই তোমার পাশে থাকব বলে চলে এসেছি। সে থেমে গেলে বলি, তুমি কখনো প্রেম করনি চন্দ্রা? শুনে সে লজ্জা পায়। তারপর মুখ তুলে বলে, আমার রং কালো।
তুমি খুব সুন্দর।
এ তোমার মন রাখা কথা কিষ্টদা।
মন রাখা কথা বলে আমার কি লাভ?
লাভ- লোকসান তুমি জান।
আমি তোমার সখা হতে পারি না?
সে কোন উত্তর করল না। তারপর আবার সে মূল কাহিনিতে ফিরে এলঃ নৌকা এমনই তাতে দুইজন ছাড়া তিনজন যেন বসতে না পারে। একবার এক যাত্রাপালা দেখবার জন্য শ্রীময়ী ঠাকুমাকে নিয়ে ওপারে চললেন। সেই বর্ষনসিক্ত দিনের পর, সেই উদ্দাম মিলনের পর শ্রীময়ী আর কখনও ডাকেননি তাঁকে। তাই মাধব ফিরতি পথে বড়াই ঠাকুমাকে অন্য নৌকায় চাপিয়ে একাকী শ্রীময়ীকে নিয়ে ঘিয়া নদীতে ভাসলেন। নৌকাতেই তাঁদের মিলন সম্পূর্ণ হল।
তাঁরা আর কোথায় কোথায় মিলিত হলেন? আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝে কপট রাগে সে বলে, খুব না?
আচ্ছা বেশ। এবার বাকি কাহিনি বল।
মাধব নৌকার পাশাপাশি একটি এনজিও গড়ে তুলতে থাকলেন। সরকারি আওতাভুক্ত হলেন। প্রকল্প পেলেন বৃক্ষরোপনের। এই যে বন, মাধব তার সীমানা আরও বাড়িয়ে দিলেন বৃক্ষ সৃজন করে। কেবল তাই নয়, এই এলাকায় যত রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখবে, জানবে সেসব তাঁদের হাতেই লাগান। মাধব বলতেন, গাছ ছাড়া মানুষ বাঁচে কই। তাই বৃক্ষরে জীবনে, ধর্মের পথে আনো। ভগবান কেন গাছের নিচে বাঁশি বাজান? যাতে মানুষ ভক্তি সহকারে সেই বৃক্ষ আরও রোপণ করে।

চন্দ্রার মুখে এ কাহিনি, তাঁদের মিলন-বর্ণনা শুনতে শুনতে আমি ক্রমশঃ তার প্রতি কামার্ত হতে থাকি, সে বুঝতে পারে না। আমার চোখের সামনে ক্রমশঃ পরিফুষ্ট হতে থাকে তার জিনি ফুলের মত নাক, কদলীকান্ডসদৃশ্য উরু, আধ ফোঁটা শালুকের কুঁড়ির মত নাভি, এমন ক্ষীন কটিদেশ যা দেখে বনের সিংহ লজ্জা পেয়ে গুহায় ঢোকে। তার অপরূপ যৌবনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। আলগোছে বলি, তারপর কি হোল?

চন্দ্রার মুখে এ কাহিনি, তাঁদের মিলন-বর্ণনা শুনতে শুনতে আমি ক্রমশঃ তার প্রতি কামার্ত হতে থাকি, সে বুঝতে পারে না। আমার চোখের সামনে ক্রমশঃ পরিফুষ্ট হতে থাকে তার জিনি ফুলের মত নাক, কদলীকান্ডসদৃশ্য উরু, আধ ফোঁটা শালুকের কুঁড়ির মত নাভি, এমন ক্ষীন কটিদেশ যা দেখে বনের সিংহ লজ্জা পেয়ে গুহায় ঢোকে। তার অপরূপ যৌবনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। আলগোছে বলি, তারপর কি হোল?

সে আমার চোখের দিকে তাকায় না। আপনমনে বলে, তারপর তাঁরা গাছ হলেন। আমাদের এই নদীর উত্তর পাড়ে যে বন আছে, সেখানে তাঁরা গাছ হয়ে রয়ে গেছেন। পাশাপাশি দুটি গাছ, এক পুরুষ এক নারী, দু’জন দুজনকে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে সেই বনের ভেতর বিরাজ করছেন।
যাওয়া যায় সেখানে?
এখন? বলে সে চারিদিকে তাকায়। বহু দূর অবধি দৃষ্টি দিয়েও কোন মানুষ চোখে পরে না। যে তিনটি গরুকে সে নদীর চরে লম্বা দড়িতে বেঁধে রেখেছে, তারা মহাসুখে ঘাস খেয়ে চলেছে। সে দ্বিধাকন্ঠে বলে, তুমি এক যুবক পুরুষ, আমি সদ্য পাটভাঙ্গা যুবতি। এই গোধূলি বেলায় দু’জনে বনের মধ্যে প্রবেশ করছি…।
সন্ধের আগেই ফিরব। কেউ জানবে না। তবুও যদি কেউ প্রশ্ন করে, তাকে বোলো তোমার প্রিয় গাই মংলা দড়ি ছিঁড়ে বনের ভেতর চলে গেছিল।
নদীর পাড় ধরে অভিসারে যেতে যেতে সে আপনমনে বলে, যদি মাধবের মত কাউকে জীবনে পাই তবে ভালোবাসব।
সেই পুরুষ যদি শ্রীময়ীর মত প্রেমিকা চায়?
শ্রীময়ীর চেয়ে আমি কম কিসে? তার চোখ দু’টি ধ্বক করে জ্বলে ওঠে।
প্রত্যুত্তরে নীরব থাকি। আরও অবাক হই চন্দ্রাকে দেখে। ক্রমশ রূপ-যৌবনের গরবে গরবিনী হয়ে উঠছে সে। এখানে সে যে পরম রূপবতী হয়ে উঠবে তা বুঝব কেমনে। তার পরনে আগুনরঙ্গা শাড়ি। ললাটে অলকাতিলক শোভা পাচ্ছে। তার চোখ যেন নীলপদ্ম। নীলজলদের ন্যায় তার কেশপাশ। বনের মধ্যে তার চলন দেখে মনে হয় পাছে সে ভেঙ্গে পড়ে তাই গতি এমন মন্থর। বিধাতা যেন এক সচল প্রতিমা নির্মাণ করেছেন। এক তীব্র কামভাবে পীড়িত হই। মনে মনে বলি, দেবতা ও অসুরেরা সমুদ্র মন্থন করে তোমাকে পেয়েছেন। তাই এত রূপ তোমার অঙ্গ জুড়ে। কিন্তু তা কোন কাজে লাগবে?

এই সময় যে কোন নারীর জীবনে এক পুরুষ সাথীর দরকার হয়ে পরে যে তার রূপ-গৌরব আরও বাড়াতে সাহায্য করবে। নীরবে তার পাশাপাশি আরও কয়েক কদম হেঁটে বলি, তুমি খুব রূপসী চন্দ্রা। তুমি মাটির যেখানে পা রাখছ, সেখানের মাটি সোনার বরণ হয়ে উঠছে। সে খুশি হয়ে বলে, আজ আমার এত গুণ গাইছ কেন বলত? অনুচ্চ উচ্চারণে সেই পুরান কথা বলি, আমি তোমার সখা হতে চাই।
তোমার তো স্ত্রী-পুত্র-পরিজন আছেন।
শ্রীময়ী কি বিবাহিতা ছিলেন না?
তুমি কি মাধবের মত প্রেমের জন্য কৃচ্ছসাধন করতে পারবে?
তোমার জন্য আমি সব পারি চন্দ্রা।
পারবে নদীর পাড়ে আমার কুটির থেকে একটু দূরে এক পর্ণ-কুটিরে বসবাস করতে?
প্রেমের জন্য লোকে কতকিছু ত্যাগ করে।
পারবে সব ছেড়ে আমাকে আমি করে নিতে?
তাও পারব চন্দ্রা।
আর কী পারবে?
তোমার জন্য চকোর পাখি হতে পারি চন্দ্রা। যে পাখি তোমার পূর্ণ শশীর মত মুখ দেখে পূর্ণচন্দ্র বলে ভুল করবে। আমি হতে পারি চতুর এক খেয়া-মাঝি, তোমার মুখের সুস্বাদু পান-তাম্বুল, তোমার হাতের দর্পণ, মাথার স্বর্ণচাঁপা ফুল, নয়নের অঞ্জন। তোমার জন্য আমি বৃক্ষ হতে পারি চন্দ্রা।
কি চাও আমার কাছে?
পায়ে ধরে মাগি কন্যা তোমার যৌবন।
দড়ি-কলসি নিয়ে ডুবে মর না কেন।
নির্জন এই বনের মাঝে ও সব কোথা পাব চন্দ্রা? তুমি হও গহীন গাং, আমি ডুবে মরি।

গাছদ্বয় এমনভাবে বেড়ে উঠেছে, একে অপরকে ডাল দিয়ে বেষ্টন করে আছে, এমন মধুর দৃশ্য কখনও দেখিনি। ঈশ্বরের গায়ের রঙের মত নীল রঙের আকাশ। দিকে দিকে রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফুটে রাঙ্গিয়ে তুলেছে সারা বন। কিন্তু অবাক হয়ে যাই এই দেখে যে, তার নিচে কেউ বাসরসজ্জার ন্যায় লাল-হলুদ ফুলের পুস্পশয্যা পেতে রেখেছে।
কোথায় চলে যায় সমাজ সংসার। মানুষের জীবন, তাদের কলরব সব মিথ্যা বলে মনে হয়। চারিদিকে পাখিদের কূজন, অপরূপ বনগন্ধ, অদ্ভুত আমেজ, সর্বপরি কনে দেখা আলোতে বিহ্বল হই। কোথা থেকে পদ্মের মিষ্ট সুবাস ভেসে আসে, পূর্ণ রূপে ফুটে ওঠে নাভি-শালুক। আমি চন্দ্রার কাছে আলিঙ্গন প্রার্থনা করি। সে আমাকে ফিরিয়ে দেয় না। বরং মনে হয়, যেন সে এই ডাকেরই অপেক্ষায় ছিল। সে তার পীনপয়োধর দিয়ে অতি কামার্তভাবে ধরে আমার শরীর। মুখচুম্বন করে বলি, আমার সকল তীর্থ, সকল পুণ্যস্থান তোমারই মধ্যে অবস্থিত।
চন্দ্রা বলে, সার বুঝেছি, মদনজ্বালায় তুমি ছটফট করছ। জরুয়ারোগী যেমন অম্বল দেখে লালায়িত হয়, তোমার অবস্থা তেমনই হয়েছে। এসো—
সেই পত্র-পুষ্প-তৃণ রচিত শয্যায় চন্দ্রা আমাকে মিলনের লাগি আহ্বান করে।
ফিরে আসার সময় সন্ধে উতরেছিল। গরুগুলি ভীত। সন্ত্রস্ত। তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে চন্দ্রা বলে, কিছু হয়ে যাবে নাতো?

৪.
‘কাঁদিয়া পরাণ বুলে বিরহ ব্যথায়’
.                  —রবীন্দ্রনাথ

সাধ করে বলেছিলাম, তোমার জন্য বৃক্ষ হতে পারি। চন্দ্রা বলেছিল, আগে নিজেকে চেন।
তুমি নিজেকে খুজে পেয়েছ চন্দ্রা? তাই কি তোমার দেখা নেই। তাঁদের একটি সংকেত স্থান ছিল। সেই ফেলে যাওয়া কুটির বা মিলনক্ষেত্র হিসেবে রচিত কোন মখমল তৃণসজ্জা বা সেই আলিঙ্গনাবদ্ধ বৃক্ষ স্থল। কিন্তু সে আসে না। সে কি এটা জানে না তিল-তুলসী দিয়ে কোন জিনিসদান করলে তা আর ফিরিয়ে নেবার উপায় থাকে না। মিলন শেষে সে আবেগ ভরে বলেছিল, নিজের দেহের উপর আমার দাবী একেবারে ত্যাগ করলাম। এখন তুমি যেভাবে এদেহ চালাবে, সেই ভাবেই চলবে। সবসময় তোমার কথাই ভাববে আমার মন।
এরপরও সে কি করে ভুলে যায় পুরুষকে। তার ঘর-বার-দোর সব এক করে খুঁজে গেছি, কিন্তু কোথায় চন্দ্রা। সারা এলাকা তোলপাড় করে ফেলেছি। তার চিহ্ন মাত্র নেই। কেউ কোনরকম মুখ খোলে না। তাকে কী স্থানান্তরে পাঠান হয়েছে? রাতারাতি তার বিবাহ হয়ে গেল? তবে সে কোথায়? এই সংসার ক্ষণস্থায়ী বলে তবে কি সেও এক বৃক্ষে পরিণত হল? এমন এক সজীব বৃক্ষ, যে সর্বদা, আর এক বৃক্ষের জন্য উন্মুখ, যার সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় সে থেকে যেতে পারে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

আমি ফিরে এসেছি কুটিরে। সেই পর্ণ কুটির এখন নানা পশু-পাখির আবাসস্থল। ঘিয়া নদী তেমনি ভাবে বয়ে যায়। ক্রমে চন্দ্রার বিরহে আমি কাতর হতে থাকি। আকাশ বাতাসকে বলি, কোথায় লুকালে তোমরা চন্দ্রাকে?
কিন্তু কিভাবে বৃক্ষ হওয়া যায়? শ্রীময়ী-মাধব সে উপায় জানতেন। তাঁরা যখন দেখলেন, না এই ভবের হাটে আর একে অপরের কাছে নিত্য গমণ সম্ভব নয়, তাঁরা বৃক্ষ হতে মনস্থির করেন। চন্দ্রাও জানে। কিন্তু আমার শেখা হয়নি। আবার বনমধ্যে ছুটে যাই। দেখি সেই পত্রপুষ্প সজ্জিত বাসরভূমিতে আলিঙ্গনাবদ্ধ বৃক্ষের পাশে নতুন কোন বৃক্ষের আর্বিভাব হয়েছে কিনা। একটা সময় ব্যর্থ হয়ে ভূমিতে নতজানু আমি নীরবে কাঁদতে থাকি। কেন কান্না আসে, অবিরল কেনই বা এই অশ্রুধারা আমাকে ভিজিয়ে তোলে, ভাবতে পারি না। কেবল এইটুকু জানি, কাঁদছি। এরই ভেতর এক সুমধুর নূপুর ধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমস্ত বনভূমি জুড়ে। চন্দ্রার পায়ে নুপুর দেখিনি কখনও। তার কাছেই শুনেছি, শ্রীময়ীর পায়ের নূপুর ছিল জুঁইফুল দিয়ে আঁকা। তিনি যখন হাঁটতেন, নূপুরধ্বনিতে মোহিত হয়ে যেত বনের সমস্ত পশুপাখি। চিৎকার করি, চন্দ্রা… চন্দ্রা…। কিন্তু বাতাসে ধ্বনি ওঠে, শ্রীময়ী…শ্রীময়ী… থামিয়ে দিই নিজেকে। নতুন করে ডাকি। সেই একই ধ্বনি ভেসে আসে।

সকল ভক্তের মাঝে আমার চোখ খুঁজে চলে চন্দ্রাকে। তার বাড়ির লোক নিশ্চয় তাকে স্থানান্তরে পাঠিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করেছিল। সে কি স্বামী-পুত্র নিয়ে কখনও পিতার গৃহে পদার্পণ করে না। তখন নিশ্চয় ‘নদীর পাড়ে এক অপূর্ব সন্ন্যাসী এসেছে, যে মানুষের জন্য কাজ করে’ শুনে সে নিশ্চয় তার সন্তান কোলে একবার না একবার আসবে।

চন্দ্রা বলেছিল, নিজেকে খুঁজতে। সমস্ত মাঠ-ঘাট-অরণ্যানী, শ্রীময়ী-মাধবের মিলনের লাগি যে কুটির, সংকেতস্থান সব খুঁজেও নিজের দেখা পাই না। বনভূমি ত্যাগ করে বাইরে এসে দেখি, এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী। আমাকে দেখে তিনি বলেন, এক বিশেষ কারণে আমি এখানে এসেছি পুত্র। আমি এক অদ্ভুত বৃক্ষের খোঁজ করছি। এক আলিঙ্গনাবদ্ধ বৃক্ষ। তুমি দেখেছ তাঁদের?
সন্ন্যাসীকে আমি সেই বৃক্ষের কাছে নিয়ে যাই। তাঁকে সব ঘটনা খুলে বলি। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, তুমি এক মহান মানুষ, সকলে তাঁদের লীলাখেলা ঘনিষ্ট কার কাছ থেকে শোনার সুযোগ পায় না। তুমি পেয়েছ। তুমি ভাগ্যবান।
কিন্তু চন্দ্রা?
তাকে আর পাবে না বাবা। তিনিও মহান লীলার পর প্রকৃতিতে অঙ্গীভূত হয়েছেন।
খুব কষ্ট পাচ্ছি বাবা। বিরহ জ্বালা—
নিজেকে খুঁজেছ?
খুঁজেছি। পাইনি।
নিজেকে খোঁজাটাই আসল। সেটা সম্পন্ন হলেই তুমি বিরহ জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে।
কিভাবে খুঁজব, একটা পথ বলে দিন।
কিষ্টধন বেলেল। জাতে গয়লা। চন্দ্রা জাতে জেলে। তার সঙ্গেই তোমার মিলন। তবে তুমি চন্দ্রার নাম ধরে ডাকলে শ্রীময়ীর কথা বাতাস বলে কেন। তোমার নূপুরধ্বনি শোনার কথা নয়। তবে কেন তুমি শুনতে পাও?
ভাবিনি ।
আত্মানাং বিদ্ধি—। আগে নিজেকে চেন।

আমি একটি এনজিও স্থাপন করি। সরকারি খাতায় নাম তুলতে তিনবছর সময় লাগে, কিন্তু তার জন্য বসে থাকলে মানুষের জন্য কাজ করব কখন। আমি নিজেই কাজ বেছে নিই নদী প্রকল্পের। ঘিয়া নদীর বুকের ভেতর থেকে পলি তুলে পুরাতন নাব্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করি। পুরাতন মানুষেরা বলতে থাকে ঘিয়ার পুরাতন গরিমার কথা। তাতে মাছের আধিক্য, যা এখন প্রায় বিলুপ্ত ফসলের মাটি ধোয়া বিষে। ইটভাটার যথেচ্ছ জল তোলার মধ্য দিয়ে, নদীকে তার প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে, ‘জীবনের অপর নাম জল’ আপ্তবাক্য ভুলে গিয়ে তাকে বন্দনা না করে। সেই পুরান ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আমি সচেষ্ট হই। নদীতে মাছে ফিরিয়ে আনার জন্য মৎস্য দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করি, জমি জৈব সার ব্যবহারে চাষীদের প্রলুব্ধ করি। দেখি মানুষ আমার পাশে। ফলত কাজ একাকী করতে হয় না। পুরান দিনের মত আবার নদী বয়ে যাবার শব্দ শোনে পৃথিবী। মানুষ আমায় ভালোবাসতে থাকে। আমায় সম্মান করতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে আমি অন্যদের থেকে আলাদা হতে থাকি আমার ব্যবহারে, রুচিতে, আমার গৈরিক বসনে, আমার শ্মশ্রুমন্ডীত মুখমন্ডলের জন্য, কথায়। মানুশ আমায় ঈশ্বরের অবতার হিসেবে দেখতে থাকে। আমি তাদের যা যা উপদেশ দিই, তারা গলবস্ত হয়ে শোনে।
সকল ভক্তের মাঝে আমার চোখ খুঁজে চলে চন্দ্রাকে। তার বাড়ির লোক নিশ্চয় তাকে স্থানান্তরে পাঠিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করেছিল। সে কি স্বামী-পুত্র নিয়ে কখনও পিতার গৃহে পদার্পণ করে না। তখন নিশ্চয় ‘নদীর পাড়ে এক অপূর্ব সন্ন্যাসী এসেছে, যে মানুষের জন্য কাজ করে’ শুনে সে নিশ্চয় তার সন্তান কোলে একবার না একবার আসবে।
আর যতদিন সে না আসে, যে পৃথিবী একদা বিলাপ করত তার হৃত গৌরব নিয়ে, তার সেই বিরহ ব্যাথায় আমি প্রলেপ দিতে থাকি। আর মনে হয় মানুষ কি সত্যিই নিজেকে খুঁজে পায়? প্রতিটি মানুষ ঈশ্বর-প্রকৃতি-প্রেম-মিলন-বিরহ’র ছলে নিজেকে খুঁজে চলে সারাজীবন…
তার পর?
নিজের বাড়ির গোয়ালঘর পরিষ্কার করার সময় একটি মাচা থেকে এক বিবর্ণ ডায়েরি উদ্ধার করেছিলেন হৃদয়কৃষ্ণ, কৌতুহল বশতঃ সেটা পড়তে পড়তে কাহিনির কেন্দ্রে ঢুকে গেছিলেন। ডায়েরি শেষ করে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল, তারপর কী হল?
ডায়েরিটি উল্টেপাল্টে দেখলেন, পিছনের দিকে আরো কিছু পাতা ছিল, কিন্তু উই লেগে সব নষ্ট হয়ে গেছে। তার মানে কাহিনির আরও কিছু বাকি ছিল। খন্ডিত কাহিনিটি কি হতে পারে ভেবে তাঁর মন ছটফট করতে থাকল। এমন এক প্রেম কাহিনি সচরাচর পাওয়া যায় না। কিন্তু এর শেষ জানা হল না বলে আক্ষেপ থেকে গেল মনে।
সামনের দিকেরও পাতা কয়টি ছেঁড়া বা কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কার লেখা বা না লেখা তার কিছুই বোঝা যায় না। একটি আধ খাওয়া পাতায় আলগোছে লেখাঃ অথ রাধাবিরহ। তার নিচে কোন নাম লেখা নেই। এর কাহিনিকার কি তাঁর কোন পূর্বপুরুষ? নাকি অন্য কেউ? এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তিনি গোয়াল ঘর থেকে সরে এলেন। পরে ভালো করে আর একবার পড়া যাবে, এই ভেবে ডায়েরিটি যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিতে যাবেন, একটা চিরকুট খসে পড়ল ডায়েরির ভাঁজ থেকে। তিনি সেটি মেঝে থেকে তুলে নিলেন। আবছা আলোয় পরতে চেষ্টা করলেন চিরকুটের নামটা…

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.