:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
তেঁতুলগাছ
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

তেঁতুলগাছ

আমাদের বাড়িতে একসময় গাদা তেঁতুলগাছ ছিল। বাড়ির ভেতর, বাড়ির বাইরে। এই বড় গাছ যেমন ছিল, তেমনি ছিল এতটুকুন ছোট গাছ, যারা বড় গাছের নিচে ঠিকমতো বাড়তে পারেনি। এতটুকু পরিসরে সেসব গাছ লাগানো ছিল যে তাদের আমরা বেঁটে তেতুলগাছ বলতাম।

গাছ অনেক থাকলে হবে কি, একটা তেঁতুলও মুখে তোলা যেত না। ভেতরে হয় ভোয়া, নয়তো পোকা ধরা। কেঁট কেঁট টাইপের সব তেঁতুল, যদিও বা পাকলে দু-একটি মুখে দেওয়া যেত, তাতে শাঁস কম, বিচি মোটা। খোলাও মোটা। মোট কথা সেই সব গাছে যেমন ফলন কম ছিল, তেঁতুলও কোনো কাজে আসত না। তবু গাছে গাছে কাঠবেড়ালি ঘুরত, পাখিরা উড়ে আসত। ইশকুলের বন্ধুরা বলত, তোদের তো অত গাছ, বাড়িতে একেবারে তেঁতুলগাছের পাহাড় করে রেখে দিয়েছিস, দু-চারটি আনতে পারিস না?

গরমের দিনগুলো সেই তেঁতুলগাছের নিচ যে কী আরামে কাটে, তা আর বলার নয়। তালপাতার বড় বড় কয়েকটি চাটাই পেতে সারা দুপুর চলত আমাদের গুলতানি। পাড়ার যত বুড়ির দল, তাদের নাতি-নাতনির দল, তাদের সঙ্গে আসা কচি ছাগলের বাচ্চা; হাতে লাটিম। সেই ছায়ার ভেতর বুড়িদের গল্পের মাঝে কত যে মারামারির ও ঝগড়ার ইতিহাস লেখা আছে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। একদম ছোটদের কাছে তেঁতুল হওয়া যা আর না হওয়া সমান। তারা কচি পাতা নুনে মেখে খায়, কচি তেঁতুলের ছাল নখে ঘসে খায়। তবে সে তেঁতুল ধরে কিনা বড় ওপরের দিকে, তাই ঢিল বল বা লগা করে বল পাড়তে কষ্ট। একটা-দুটো পড়তে পেল কি না পেল, তাই নিয়ে মারপিট। শেষে বুড়িদের মধ্যস্থতায় একগাঁট করে ভাগ মেলে সব্বার।

হতে পারে আমাদের তেঁতুল কোনো আয় দেয় না, ফল পাকলে ব্যাপারীকে গাছ বেচে দিই না ওদের মতো; কিন্তু যে ছায়া দেয় আমাদের গাছ, তা কম কিসে? ওদের গাছের তলায় কেউ কি চাটাই পেতে বসে? বসে না। বসার মতো অবস্থায় নিচটা বা তার আশপাশে নেই। বরং দেখা যায় মামণির ঠাকুমা, শেফালির ঠাকুমা, মায়ার মা, চাঁদুর মা তাদের সঙ্গে আসা তাদের নাতিপুতিরা আমাদের গাছের নিচে পাতা চাটাইয়ে বসে খেলা করে। লাটিম, কিতকিত, লুডো। আমরা কচি তেঁতুলপাতা নুন মাখিয়ে খাই। কাঠবেড়ালি ও কাক বাচ্চার পিছু পিছু ঘুরঘুর করি।

একদিন আমাদের বাড়ির এই সব তেঁতুলগাছ কেটে ফেলা হলো। আমাদের নতুন ঘর হবে, খালধার থেকে খাটা পায়খানা তুলে দিয়ে পাকা হবে, আলাদা রান্নার ঘর, খাবার ঘর। উঠোনে টিউকল বসবে। রাস্তার কল থেকে আর আমাদের খাওয়ার জল বয়ে আনতে হবে না। আর এসবের জন্য অনেকটা জায়গা দরকার।

তেঁতুলে কী না হয়! বেগুনটোপা, বাতাবিলেবুর পাতায় জড়ানো তেঁতুল। তেঁতুল দিয়ে মাজলে কাঁসা-পিতল ঝকঝক করে। তেঁতুলে কত কিছুই হয়! আমাদের গাছগুলো যেহেতু ফল দিত না, তাদের নিয়ে কারও কোনো মায়ামমতা ছিল না। কবেকার কোন প্রাচীনকালের গাছ, তাই বা কে জানে। ঠাকুমারও মনে নেই। তবে কি ঠাকুমার বিয়ের আগেই এই সব গাছ কেউ বসিয়েছিল? ঠাকুমার এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিছু বললেই মুখ ব্যাদান করে বলবে, কে জানে ভাই! এমনি জাতের তেঁতুল যে সাত জন্মে একটিও মুখে তুলতে পাল্লুম নে। টক করো আর যা-ই বা রাঁধো না কেন, সেই পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে আনতে হয়।

গাছ নিয়ে আমার কোনো মায়া নেই। ওপর দিকে তাকিয়ে গাছ দেখিনি কোনো দিন, ফল খুঁজেছি। মায়া আছে ছায়া নিয়ে। কোথাও যদি সেই ছায়াটা পাওয়া যেত। যদি ছায়াটা রেখে গাছটাকে কাটা যেত। গোল ছায়া, সেই মাটিতে পিঁপড়েদের চলাচল। মাটির নিচে তাদের ঘর। প্রখর রোদ ও বৃষ্টির ঘেরাটোপ থেকে বাঁচতে তারা ছায়ার ঘেরাটোপেই ঘোরাফেরা করে, খাবার খুঁজে নেয়। ছায়ার সেই ভিজে ভিজে নরম মাটির নুনস্বাদ নেয় হলুদ ফড়িং, রংবেরঙের প্রজাপতি।

এমনকি তেঁতুলগাছে বসত না হনুমানের দলও। বরং বলা যায় শেফালিদের, মামণিদের গাছের তেঁতুল সাফ করে, গাছের ডালে ডালে হুড়দাঙ্গা করে আমাদের গাছে তারা ছানাপোনা নিয়ে বিশ্রাম নিত। তারপর একসময় খাল পেরিয়ে চলে যেত কলাবাগানে।

তাই এই সব গাছ কেটে ফেললে কারই বা যায়-আসে? গাছ কেটে বিক্রি হয়ে গেল। ঝটপট ঘর তৈরি হয়ে গেল। পাড়ার লোক বললে, গাছ কেটে এত দিন পর একটা ঠিক কাজ করলে। ফলটল দেয় না, কী কত্তে পুষবে? বেচে কেমন টেকা মিলল, ঘর হলো। এদ্দিন পর তোমাদের বাড়িকে ঠিকঠিক বাড়ির মতো দেখতে লাগছে। নইলে কেবল তেঁতুলগাছের পাহাড় হয়ে ছিল।

আমি দেখি ছায়া নেই। দুপুরের দিকে ঝাঁ ঝাঁ গরম। তেঁতুলতলায় বসলে যে মৃদু বাতাস শীতল অনুভব হতো, তা আর নেই। আর সত্যি বলতে কি, গাছ নেই, তা নিয়ে আমারও কোনো মাথাব্যথা ছিল না অন্যদের মতো। কিন্তু তার ছায়াটাকে আমি ভুলতে পারলাম না। ঠাকুমাকে বললাম, এবার গরম পড়লে দুপুরে কোথায় চাটাই পেতে বসা হবে, ঠাকুমা?

ঠাকুমা বলে, গাছ নেই, ছায়া নেই। কিন্তু ঘর তো হলো। সেই ঘরের ভিতরি বসে থাকবি চাটাই পেতে।

আর বাতাস?

সে ঢুকবে ওই জানালা দিয়ে।

 

পরে গরমকাল এল। আমাদের আড্ডাটা কিন্তু সেই ঘরের ভেতর আর জমল না। ছায়ার নিচে খোলামেলা পরিবেশে যা হয়, টালির চালের নিচে বসে তা হয় না। মায়ার মা, চাঁদুর মা আসে এখনো। নতুন ঘরে, ঘরের দাওয়াতে আডডা চলে। রোবের মা ঠাকুমাকে বলে, এই বেশ হলো দিদি, গরমে বাইরে কি আর গা গতর এইলে বসা যায়? গরমের দিনে গা এইলে বসলে আরাম লাগে। কী দিদি?

মামণির ঠাকুমা বললে, ঘরে-বাইরে এত তেঁতুলগাছ, সব কেটে ভালো ঘর বাইনেছ তোমরা। বাড়ির ভেতর তেঁতুলগাছ কি আর ভালো দেখায়, যত রাজ্যির ভূতের আবাস! এই বেশ আছ, নাও। বাড়িঘর সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন—ঘরের ভেতরও এবার রোদ খেলবে, নাও।

মামণিকে এখন আর এই একছড়া তেঁতুল দিবি বলতে হয় না, সে সেধে সেধেই নিয়ে আসে। শেফালি বলে, তোদের যা গাছ ছিল, বাব্বা; তেঁতুল কুকুরে অবধি খায় না!

গাছ নিয়ে আমার কোনো মায়া নেই। ওপর দিকে তাকিয়ে গাছ দেখিনি কোনো দিন, ফল খুঁজেছি। মায়া আছে ছায়া নিয়ে। কোথাও যদি সেই ছায়াটা পাওয়া যেত। যদি ছায়াটা রেখে গাছটাকে কাটা যেত। গোল ছায়া, সেই মাটিতে পিঁপড়েদের চলাচল। মাটির নিচে তাদের ঘর। প্রখর রোদ ও বৃষ্টির ঘেরাটোপ থেকে বাঁচতে তারা ছায়ার ঘেরাটোপেই ঘোরাফেরা করে, খাবার খুঁজে নেয়। ছায়ার সেই ভিজে ভিজে নরম মাটির নুনস্বাদ নেয় হলুদ ফড়িং, রংবেরঙের প্রজাপতি।

তাই পড়শি ঠাকুমাদের এসব কথা শুনে অবাক হয়ে যাই। এত দিন জোড়া তেঁতুলের ছায়ায় আমরা বসতুম, আরও খানকয় গাছ ছিল, তাদের ছায়ার স্বাদ এরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে গরমের দিনে, সেই ছায়ার কথা তারা বলে না। বরং গাছ কাটা পড়তে তারা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল!

হনুমানের দল যখন হামলা করে, শেফালিদের গাছ থেকে সোজা লাফ দেয় আমাদের নতুন চালে। মটমট করে টালিখোলা ভেঙে যায়। ঠাকুমা চিৎকার করে, এই পোড়ামুখো মিন্সের দল, যা-যা-যা; সব টালিখোলা ভেঙে একাকার করে দিলে গা!

আমি বলি, ওরা গাছ খুঁজছে, ঠাকুমা।

মামণির ঠাকুমা বললে, ঘরে-বাইরে এত তেঁতুলগাছ, সব কেটে ভালো ঘর বাইনেছ তোমরা। বাড়ির ভেতর তেঁতুলগাছ কি আর ভালো দেখায়, যত রাজ্যির ভূতের আবাস! এই বেশ আছ, নাও। বাড়িঘর সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন—ঘরের ভেতরও এবার রোদ খেলবে, নাও।

গাছ? গাছ কোথা পাবে? ওরা মনের সুখে লাফাই-ঝাঁপাই করবে আর তার জন্যি গাছ করে রাখতে হবে নাকি? কেন, দেশে আর গাছ নেই? এই তো মাধানির মায়ের কত বড় তেঁতুলগাছ রয়েছে, যা সেখেনে যা; সেখেনে গিয়ে লাফা না কেন যত পারিস! কেবলই আমাদের পাড়ায় হল্লা! কী মধু আছে রে এখেনে?

মামণির ঠাকুমা বললে, ঘরে-বাইরে এত তেঁতুলগাছ, সব কেটে ভালো ঘর বাইনেছ তোমরা। বাড়ির ভেতর তেঁতুলগাছ কি আর ভালো দেখায়, যত রাজ্যির ভূতের আবাস! এই বেশ আছ, নাও। বাড়িঘর সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন—ঘরের ভেতরও এবার রোদ খেলবে, নাও।

আমার মনে ভেতর জোড়া তেঁতুলের গোল ছায়া। তখন সবচেয়ে আগে সেখানে কুয়াশা জমত, বেলা পড়ে আসত। গরমের দিনে বিকেল থেকেই সেই গাছের মাথা থেকে অজস্র মশার দল উঁচু আকাশের দিকে বের হয়ে আসত। টুকটাক ঝরে পড়ত তেঁতুলফুল, তার পাপড়ি; আর বিভিন্ন ধরনের পিঁপড়েরা সেই সব মুখে করে নিয়ে যেত তাদের বাসায়। তাদের ছানাপোনারা ফুলের বিছানায় শুত। গাছ চলে যাবার পর সেই সব চেনামুখের পিঁপড়ের দলকে আর দেখি না। তারা নিশ্চয় শেফালিদের তেঁতুলগাছের দিকে সরে গেছে।

আমরা তো একটি-দুটি করে তেঁতুলগাছ পুঁততে পারি। খালপাড়ের ধারে ধারে জায়গা এখনো পড়ে আছে। সেখানে গাছ বেড়ে উঠতে পারে। ইশকুলে পড়ায়, একটি গাছ একটি প্রাণ।

ঠাকুমা বলে, তেঁতুলগাছ পোঁতা সে আর কী এমন ব্যাপার। পুঁতলেই হয়। চাঁদুর মা বলে, গেরামদেশে ওসব গাছ আর কি কেউ করে নাকি। এখন বিডিও থেকে নানা সব গাছ দেয়। সব বিদিশি গাছ। বসাও আর বড় হলে বেচে টাকা কর। মীরার মা বলে, পুঁতলেই কি আর হবে নাতি, ছায়া যে তুমি পাবে না। ওধারে আরও গাছ আছে, তারা নিজেরাও ছায়া ফেলে এমন করে দেবে যে, আলাদা করে আর তেঁতুলের ছায়া বলে কিছু থাকবেনে। ঘাটের ধারের দিদি বললে, এটাই হক কথা কইলে মীরার মা। আমাদের গাছগুলান দেখ না, তার কোনো ছায়া নাই। বাঙ্গাল ঠাকুমা বলে, না গো দিদি, ছায়া আছে। ঘাটের ধারের দিদির তেঁতুলগাছ আমি সেই ওপার থেকে আসার পর থেকেই দেকছি। তবে অনেক দিনের গাছ, মাটিতে আর ছায়া দিতে পারে নে। ও ছায়া দেয় জলে।

আমি অবাক হয়ে বলি, জলে! তা সে কেমনে দেয়?

দেবে না কেন নাতি, দেবে। সব ছায়া মানুষেরে দেওয়া শেষ হলে, গাছ তখন ছায়া দেয় জলেরে। মানুষের ছায়ার দরকার না থাকতি পারে, জলের তো আছে। তাই জল সে ছায়া বুক পেতে নেয়। সে এক বিঘত গোল ছায়া!

কবেকার সেই গাছ, হেলে গেছে জলের দিকে, তাই গাছের ছায়া পড়ে জলের ভেতর। আমি তখুনি এই আড্ডাখানা ছেড়ে ছুটে যাই খালপাড়ে। একছুটে পাঁদার দিয়ে গিয়ে শেফালিদের বাড়ির দেল ঘেঁষে হাজির হই সেখানে। হ্যাঁ, গাছ। ওই তো তার ছায়া পড়ে আছে জলে। তেমনি গোল ছায়া। আমি গাছের গায়ে হাত রেখে সেই সম্পূর্ণ ছায়াটিকে দেখি। শেফালি বলে, তুই এত ঢং করিস না, যেন আগে জানতিস না আমাদের তেঁতুলগাছের ছায়া জলেতে পড়ে! মামণি মুখ ঘুরিয়ে বলে, হুঁ, খোকনদাকে ওই জলছায়াতে চাটাই পেতে দে না শেফালিদি, জলের ওপর গিয়ে বসুক না কেন।

আমার আবার চমক লাগে। আরে হ্যাঁ, তাই তো; এমনি করে কেউ তো বলেনি। আমিও ভাবিনি। একটা প্রাচীন তেঁতুলগাছ, সে জলেতে ছায়া পেতে রাখে। সেখানে কি কেউ বসতে পারে? নিশ্চয় পারে, যদি সত্যি সেখানে কেউ চাটাই পেতে দেয়। ছায়ার সাথে জলের সহিত আমিও দুলে দুলে যাই।

তখন আমি সেই পাখিটাকে দেখি। এক ঠ্যাঙ্গের শালিক। আমরা যখন জোড়া তেঁতুলের সেই ছায়াঘেরা প্রখর গ্রীষ্মে বসে থাকতাম, পাখিটা একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের আশপাশে ঘুরঘুর করত। আমাদের কাছ থেকে মুড়ি-বাতাসা খায়। খই। মুড়কি। দুপুরের সাদা, এঁটো-কাঁটা-ভাত। পাখিটা কোথায় বাস করত, তার খবর নিইনি কখনো। তবে সে নিশ্চয় কাছাকাছির কোনো গাছে বা হয়তো কোনো এক তেঁতুলগাছেই বাস করত; নইলে সকালেই সে ঘুমজড়ানো চোখে বাড়ির উঠোনে হাজির হতো কী করে?

কিন্তু সে এখন আমার পিছু পিছু ঘোরে কেন? ও কি তবে অন্য কোনো গাছের সাথে ভাবসাব করে উঠতে পারেনি এখনো? এদিক-ওদিক করে গাছ কাটার পর এতগুলো দিন কাটিয়ে দিল? নাকি ও-ও আমার মতন ছায়া খোঁজে। যে ছায়া ফুটে থাকে কদমফুলের মতন। পাখিটা যে আমাদের মতোই জোড়া তেঁতুলের ছায়া ভালোবাসত, তা এখন বুঝতে পারি। কাক, হাঁড়িচাচা যখন তেঁতুলের ডালে হাঁ করে বসে থাকত; ডালে থম মেরে থাকা কাঠবেড়ালি ও জোড়া পায়রার লোভে গুলতি হাতে পুব খাটতে আসা যে আদিবাসীটি গুঁড়ি মেরে আসে, শালিখ তখন আমাদের কাছাকাছি।

পাখিটা এগাছ-ওগাছ ঘোরে। কিন্তু কেন জানি না, যেন কোনো ছায়াই তার পছন্দ হয় না। এদিকে যতগুলো গাছ আছে, তাদের ছায়াও আছে; কিন্তু তার কোনোটাতেই দৃশ্যসুখ নেই। পাখিদের সহজে চলাফেরা করার মতো জায়গাও নেই। ছায়ার নিচে ভাঙা হাঁড়ি, পুকুর থেকে তুলে রাখা পাঁক, কাঠের উনুনের ছাই, গোবরের তাল। মাছি-মশা নানান পোকারা সেখানে ভনভন করে। এদিক-ওদিক গোবরের সার পেয়ে সতেজ বড় বড় ঘাস, তালআঁটি, খেঁজুরগাছের চারা।

শেফালিদের বলি, এই পাখিটা কোথা থাকে, তুই জানিস? শেফালি বলে, আমি তার কী জানি, পাখিটা জানে, তাকেই জিজ্ঞাসা কর। মামণি গলা চড়িয়ে বলে, পাখিটার সাথে তুমিও উড়তে থাকো না খোকনদা, তাহলে বেশ হবে। নিজেকে তুমি পাখি পাখি বলে ভাবতে পারবে। আর ওই পাখিটার পাশেই একখানা বাসা বানিয়ে নেবে। আমি বলি, ও একটা ছায়া খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না।

আমার মনে ভেতর জোড়া তেঁতুলের গোল ছায়া। তখন সবচেয়ে আগে সেখানে কুয়াশা জমত, বেলা পড়ে আসত। গরমের দিনে বিকেল থেকেই সেই গাছের মাথা থেকে অজস্র মশার দল উঁচু আকাশের দিকে বের হয়ে আসত। টুকটাক ঝরে পড়ত তেঁতুলফুল, তার পাপড়ি; আর বিভিন্ন ধরনের পিঁপড়েরা সেই সব মুখে করে নিয়ে যেত তাদের বাসায়। তাদের ছানাপোনারা ফুলের বিছানায় শুত। গাছ চলে যাবার পর সেই সব চেনামুখের পিঁপড়ের দলকে আর দেখি না। তারা নিশ্চয় শেফালিদের তেঁতুলগাছের দিকে সরে গেছে।

যেহেতু ওর একটা পা নেই, ও মাটিতে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। পোকামাকড় যা ওই মাটি থেকেই তুলে নেওয়া। আমি খেয়াল করে দেখেছি, ও কেঁচো খেতে ভালোবাসে। মানুষের পাশাপাশি থাকে বলে একদম ভয়ডর নেই।

ঠাকুমা বলে, পাখিদের আবার ছায়ার অভাব? চাদ্দিকে কত ছায়া পড়ে আছে, তাদের ঠেয়ে যেতে পারলেই হলো। মায়ার মা বলে, নাতি তুমিও যেমন! হচ্ছিল মানুষের কতা, গাছের কতা—; এর ভিতরি পাখি আসে কোত্থেকে? বাঙ্গাল ঠাকুমা বলে, পাখিটারে টানার দরকারই বা কী? চাঁদুর মা বলে, না গো না, অমনি ভেবুনি। আমাদের লাতিন খুব নরম মনের মানুষ, তাই অমনি করে পাখিদের কথা কয়।

আমি বলি, পাখিটার একটা ছায়া চাই। কিন্তু এদিকে অমনধারা ছায়া একটাও নেই। যা আছে, তা ভেসে যায় ওই জলে। কিন্তু সেখানে গিয়ে কে দাঁড়াতে পারে। জলের ওপর দাঁড়ানো কি চাট্টিখানি ব্যাপার!

অমনি সেই বুড়িদের দল, যারা কথায় কথায় বলে, এবার গেলেই হয়। যারা বলে, আর কত কী দেখাবে ভগবান! যারা বলে, কবে জন্মেছি, তা-ই জানি না, আমাদের থেকে যারা পরে এসেছে, তারা কেমন সকলকে ফাঁকি দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাচ্ছে, অথচ দেখো, মরণ আমাদের ডাকে নে। মরণের দিনক্ষণ আমাদের কপালে লেখা নেই। আমরা কেমন বহাল তবিয়তে বেঁচে রইছি। আমাদের কোনো ছায়া পড়ে না রে নাতি, জানিস তো ভূতেরও কোনো ছায়া নাই। আমরা তবে ভূত, কী বলো? না না, ভূত কেন, আমরা হলুম ভূতেরও বাড়া! হা হা হা — ! ভূত তো আমাদের দেখে ভয়ে এ তল্লাটে আর ঘেঁষে নে। তারা ঝটপট উঠে দাঁড়ায়। বলে, গোল ছায়া?

আমি বলি, হ্যাঁ।

জলের ওপর পড়ে?

হ্যাঁ।

তাতে ফড়িং বসে?

জলফড়িং বসে।

সে কোন জল?

কেন, খালের জল।

চল তো দেখি—এই বলে তারা হাঁটা লাগায় পাঁদার দিয়ে। রোবের মা বলে, তা দিদি ছায়া ছেল তোমাদের তেঁতুলগাছের। ওঃ, অমনটি আর জীবনে দেখলুম নে। চাঁদুর মা বলে, তা যা বলেছ! এই যে জলোদের তেঁতুলগাছটা, রাস্তার ধারেই কেবল নয়, সেখানে এমন ভূতের উৎপাত যে দিনমানেও পেরোতে লোকের গা ছমছম করে। তখন বাঙ্গাল ঠাকুমা বলে, যা বলেছ। আর কোনো তেঁতুলগাছের নিচে এমন আরাম করে বসা যায় না। আমার ঠাকুমা বলে, হ্যাঁ, গাছ একটা করেছিল বটে আমার শাউড়ি। তেঁতুল না হোক, গাছ তো ছিল। সে না হয়, তোমাদের গাছের তেঁতুল সাত-আট বছর ধরে বড় মাটির গামলায় রেখে দাও, কুচো চিংড়ির টক খাও; তাই বলে আমাদের গাছও ফেলনা ছিল নে। চাঁদুর মা আবার বলে, গাছগুলা কেটে দিয়ে আমার ছাগলটা যেন কত একলা হয়ে গেছে। আমি এদিক পানে এলেই তিড়িং তিড়িং করে পিছু পিছু চলে আসত। এখন আর আসে না। স্বপনদের খড়ের গাদার আশপাশেই ঘুরঘুর করে।

বাতাসও খুব মিষ্টি।

যা বলেছ।

বাইরে থেকে কত পাখি আসত রোজ। কত যে তাদের কতা! সব সময় কিচকিচ করেই আছে।

তারা সকলে জলের দিকে হাঁটতে থাকে। কেউ ঝুঁকে, কেউ কুঁজো, কেউ কাত হয়ে, কেউবা পা টেনে। তাদের কারও বয়সের গাছ-পাথর নেই। কারও মুখে পান, দোক্তা বা নিদেনপক্ষে এককুচো সুপুরি। সকলেরই পরনে সরু ইঞ্চিপাড়ের সাদা থানশাড়ি। এপাড়া-ওপাড়ার খবর নিতে নিতে দিতে দিতে তারা হাঁটে। তারা একসময় এই রকম নানা কথা কইতে কইতে খালপাড়ে এসে দাঁড়ায়। ঝুঁকে থাকা তেঁতুলগাছকে গোল হয়ে ঘিরে ফেলে তারা। গাছের মতোই কোমর বাঁকিয়ে ঝুঁকে পড়ে খালের দিকে।

জলের ওপর পড়ে থাকা নিজেদের গোল ছায়া দেখার আশায়।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.