:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ফাহ্‌মিদা বারী

গল্পকার

ফাঙ্গাস

ফাঙ্গাস

এক.
‘ঐ মিয়া কীয়ের বালছাল মার্কা গাড়ি চালাও, এ্যা? গাড়ির সিটের গায়ে ফাঙ্গাসের ভিটাবাড়ি হইছে…দ্যাখবার পাও না?’
যাত্রীর বিরক্তিভরা কথা শুনে গাড়ি চালাতে চালাতেই মাথা ঘুরিয়ে দেখল ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়া।
হাইওয়েতে গাড়ি ছুটছে। এখন বেশি উত্তেজিত হলে চলবে না। তাই মাথাটাকে শান্ত রেখেই যাত্রীর কথার জবাব দিল সে।
‘কী কন মিয়াভাই? কীয়ের ফাঙ্গাস? ফাস্টকেলাস গাড়ি আমার! কুনোহানে এক ইঞ্চি ময়লা খুঁইজা পাইবেন না…আর আপনি কন ফাঙ্গাস বসত গাড়ছে?’
‘ঐ মিয়া, গাড়ি থামাইয়া আইসা দেইখা যাও! মিছা কতা কইতাছি আমি?’

আর চ্যালেঞ্জ ছোড়াছুড়ি করা উচিত বোধ করল না ইদ্রিস মিয়া। বহুদিন যাবৎ সে নিজে গাড়ির তদারকি করে না। কাজেই ছত্রাক-ফাঙ্গাসের উপস্থিতির খবর জানা নেই তার। বহুদিন ধরেই সে গাড়ির ভার হেলপার বজলুর কাঁধে তুলে দিয়েছে। সব দেখাশোনা এখন বজলুই করে।
আড়চোখে একবার বজলুর দিকে তাকায় ইদ্রিস মিয়া।
ব্যাটা নিশ্চিন্ত মনে খোলা দরজার হাতল ধরে বাইরের বাতাস খাচ্ছে। এখানে যে বাসের ইজ্জতের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে, সেই ব্যাপারে তার কোনো হুঁশই নেই! গুনগুন করে আবার কিসের যেন সুরও ভাঁজছে। রাগে অস্থিমজ্জাসমেত জ্বলে গেল ইদ্রিস মিয়ার। ইদানীং বজলুর রংঢং যেন একটু বেশিই বেড়েছে। গায়ে প্রতিদিন ফুলেল প্রিন্টের হাফশার্ট…সেটার কলারটা আবার উঁচু করে তুলে রাখে সে। কিছুদিন যাবৎ গলায় বেশ কায়দা করে একটা রুমালও প্যাঁচাচ্ছে। মাথার চুলে স্পাইক না ফাইক কী যেন বলে, সেটাও করছে।

দেখে দেখে তাজ্জব হয়ে যায় ইদ্রিস মিয়া। এই দুদিন আগেও যার দুইবেলা খাওয়া জুটত না, তার স্টাইলের এ কী বাহার! ইদ্রিস মিয়াই একদিন পথের পাশ থেকে কুড়িয়ে এনেছিল তাকে। ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করত। চুরি-রাহাজানি-ছিনতাই কিছুই বাদ ছিল না।
একদিন রাস্তার ধারে বাইশ-তেইশ বছরের একটি ছেলেকে পাবলিক গণপিটুনি দিচ্ছে দেখে সে-ও এগিয়ে যায়।
ইচ্ছে ছিল স্যান্ডেল খুলে নিজেও দু-চার ঘা লাগিয়ে দেবে। এই দেশে এটাই এক মজা। কে অপরাধী, কিসের অপরাধী, এত কিছু বিচার করার দরকার পড়ে না। অন্যরা মারছে দেখে নিজেরও মারার লাইসেন্স হাতে চলে আসে।
কিন্তু কাছে গিয়ে স্যান্ডেলটা তুলে নিয়েও আবার নামিয়ে নেয় ইদ্রিস মিয়া। কেন যে মায়া ধরে যায় ছেলেটাকে দেখে!
ইস্পাতকঠিন মুখে সেদিন ভয়ের চেয়ে জেদ দেখেছিল বেশি। যেন ভাঙবে তবু মচকাবে না। শুধু চোখ দুটো যেন তার নিজের সাথেই প্রতারণা করে বসেছিল। মুখ যা বলতে চায়নি, চোখ দুটো অকপটে সে কথাই বলে দিয়েছিল।

যে ঘটনা ইদ্রিস মিয়া বলতে চাইছে, সেটা বজলুর ভালোভাবেই মনে আছে। স্টিয়ারিং হাতে পাওয়ার খুশিতে একটু বেশিই বেসামাল হয়ে পড়েছিল সেদিন। যাত্রীবোঝাই এক মিনিবাসকে সাইড দিতে গিয়ে বেমক্কা এক ধাক্কা লাগিয়ে বসেছিল। ইদ্রিস মিয়া এসে তাড়াতাড়ি স্টিয়ারিং না ধরলে সেদিন কী হতো, বলা মুশকিল!

উত্তপ্ত জনতার রোষ থেকে সেদিন ইদ্রিস মিয়াই ছাড়িয়ে নিয়েছিল বজলুকে। জনতা চলে যেতে রাগ রাগ গলায় বলেছিল,
‘কাইজকাম কইরা খাওনের হাউশ আছে, নাকি মারধর খাইয়াই প্যাট ভরে?’
হাতের তালু দিয়ে নিজের রক্তাক্ত ফেটে যাওয়া ঠোঁট মুছতে মুছতে বজলু বলেছিল, ‘কাম দিব ক্যাডা? আমার বাপে?’
‘আমু দিমু…বাপ ডাকোনের দরকার নাই। মন লাগাইয়া কাম করলেই হইবো। মারধর খাইয়া আর প্যাট ভরান লাগবো না!’
সেই থেকে এক রকম অঘোষিত বাপের মতোই বজলুকে ছায়া দিয়ে আসছে ইদ্রিস মিয়া। পাঁচ বছর হতে চলল প্রায়। বজলু তার হেলপার হয়ে ভালোই আছে। মুখে ওস্তাদ বলে ডাকলেও ওস্তাদের ওপরে সুযোগ পেলেই পোদ্দারি ফলায় সে।
হেলপারগিরি করতে করতে মাঝে মাঝে একঘেয়েমি লাগলে ওস্তাদের দিকে সকরুণ মুখে তাকিয়ে বলে, ‘ওস্তাদ…একডাবার দ্যান না! ক্যাঁচাল করুম না…মরা মায়ের কসম খাইলাম!’
স্টিয়ারিংয়ের হুইলটার দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে থাকে বজলু। ড্রাইভিং সিটটার প্রতি ভয়ানক এক সুপ্ত লিপ্সা কাজ করে তার। ইদ্রিস মিয়া সেটার খবর ভালোভাবেই রাখে। গলার সুরে প্রশ্রয়কে ধামাচাপা দিয়ে কপট শাসন দেখিয়ে বলে,
‘হ হেইদিনের লাহান আরেকখান ভুল করি আমি! তরে এনে বসাই আর পাবলিক আইয়া আমারেই পিডায়! মনে নাই, হেইদিন কী হইছিল?’

যে ঘটনা ইদ্রিস মিয়া বলতে চাইছে, সেটা বজলুর ভালোভাবেই মনে আছে। স্টিয়ারিং হাতে পাওয়ার খুশিতে একটু বেশিই বেসামাল হয়ে পড়েছিল সেদিন। যাত্রীবোঝাই এক মিনিবাসকে সাইড দিতে গিয়ে বেমক্কা এক ধাক্কা লাগিয়ে বসেছিল। ইদ্রিস মিয়া এসে তাড়াতাড়ি স্টিয়ারিং না ধরলে সেদিন কী হতো, বলা মুশকিল!
বজলু তবু সেই ঘটনার স্মৃতিকে পাশ কাটিয়ে বলে, ‘এইবার শক্ত কইরা স্টিয়ার ধরুম। এট্টুও ঝামেলা হইবো না…ওস্তাদ, দ্যান না!’
ওস্তাদ-শাগরেদের এসব আহ্লাদমাখা কথাবার্তা শুনে বাসের যাত্রীরা বিশেষ খুশি হয় না। মুরব্বি গোছের দু-একজন চেঁচিয়ে বলে, ‘ঐ মিয়া, হেলপার দিয়া বাস চালাইবা না কইলাম!’
বজলু কটমট করে উক্তিকারীর মুখের দিকে তাকায়। যা একটু সম্ভাবনা ছিল, সেটাকেও হারাতে দেখে সে ভেতরে ভেতরে মরমে মরে যায়।

সুযোগ পেলেই অবশ্য ওস্তাদের কাছ থেকে গাড়ি চালানোর কায়দাকানুন শিখে নেয় সে। সারা জীবন কি হেলপার হয়েই থাকবে নাকি?
এই পাঁচ বছরে বজলুর চেহারায় খোলতাই এসেছে। গায়ে-গতরে গোশত লেগেছে। খাওয়া-পরার নিরাপত্তার সাথে সাথে আচার-আচরণেও বাবুয়ানা এসেছে।
ইদ্রিস মিয়া সামনে রাস্তার দিকে চোখ দিয়ে গলা হাঁকিয়ে বলে, ‘কী রে বজলু…কাইজকামে আর মন লাগে না নাকি রে? আবার পাবলিকের মাইর খাইতে মুন চায়?’
বজলু গুনগুন থামিয়ে এতক্ষণে ওস্তাদের দিকে তাকায়। এই আচমকা আক্রমণের সূত্র বোঝার চেষ্টা করে সে।
‘সিটের নিচে যে ফাঙ্গাস হইছে, চক্ষে দ্যাখছ না? আমি গিয়া দেখাই দিমু? হালা…আকামের বলদ! তর গলার রুমাল দিয়া যদি তরেই ফাঁশ না দিছি, তয় কী কইছি!’

সিটের নিচে আলগোছে একবার তাকায় বজলু। সুচতুর চালু গলায় বলে, ‘এইডা কহন হইলো? আইজই সাইজ কইরা দিমুনে! এক ডলা দিমু…ফাঙ্গাসের বাপে বাপ বাপ কইরা পলাইবো!’
ইদ্রিস মিয়া মুখ ভেটকি দিয়ে বলে, ‘কতা বেইচাই খাওন পারবি, চিন্তা করিছ না! হালার ফাঁকিবাজের কিরা!’

দুই .
সপ্তাহে দুই দিন ছুটি নেয় ইদ্রিস মিয়া।
বয়স হয়েছে। চল্লিশের ঘরে ঢুকে গেছে বয়স। এখন আর আগের মতো জোর পায় না গায়ে। দুই দিনের মধ্যে এক দিন সারা দিন ঘরে শুয়ে শুয়ে ঘুমায়। আর অন্য দিন বন্ধুবান্ধরের সাথে তাস খেলে কাটায়। বউয়ের সাথে ঘরে বসে ফস্টিনস্টিও করে।
আজেবাজে নেশা নেই তার। অন্য ড্রাইভাররা বাংলা গিলে গাড়ি চালায়, খিস্তিখেউর করে। খারাপ মেয়ে মানুষের কাছে যায়। সে এসব দোষ থেকে একেবারে মুক্ত। বাড়িতে সুন্দরী বউ আছে। তার সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটাতেই বেশি ভালো লাগে তার।
‘ও সোহাগী, আমাগো মাইয়া ত বড় হইয়া গ্যালো। ওরে ত বিয়া দিয়া পার কইরা দ্যাওন লাগবো!’
সোহাগী নাকের নথ দুলিয়ে সোহাগ দেখিয়ে বলে, ‘হ, বিয়া ত দেওনই লাগবো। মাইয়ারে হারা জীবন বহাইয়া বহাইয়া খাওয়াইবেন নাকি?’
‘হ্যার পরে আমগো দিন যাইবো ক্যামনে? আও আরেকডারে দুনিয়ায় নিয়া আসনের ব্যাবুস্থা করি! তুমি ত ওহনো জুয়ান আছো!’
‘ইহ্‌! হাউশ কত! দুই দিন পরে শ্বশুর হইবেন…আর রং দ্যাখলে মইরা যাই!’

সোহাগী চড়ুই পাখির মতো তিরতিরিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঘরময়। সুডৌল হাতে তরকারি কুটে, বাসন মাজে। একচিলতে বারান্দায় কুমড়ো বড়ি শুকোতে দেয়। তার শরীরের আঁকেবাঁকে সমুদ্রের গর্জন শোনে ইদ্রিস। ইদ্রিস মিয়ার কাছে এই দিনটি ভারী প্রিয়। সুখ সুখ একটা অনুভূতি লেগে থাকে মনজুড়ে। তার বউ সোহাগীকে দেখে কেউ বলবেই না সখিনার মতো ষোলো বছরের একটা মেয়ে আছে তার। তেত্রিশ বছরের শরীরে এখনো ঢলো ঢলো যৌবন। সেই তুলনায় মেয়েটার ভাবভঙ্গিতেই কেমন একটা খটখটে ভাব ছিল এত দিন। বয়সের আগেই কেমন যেন বেশি বুঝদারের লক্ষণ। তাও সেটা একদিক দিয়ে মন্দ ছিল না। মেয়ের আচরণে অন্তত বেতাল কিছু ছিল না।

কিন্তু ইদানীং মেয়ে সখিনার ভাবসাব ভালো ঠেকছে না ইদ্রিস মিয়ার। মেয়ের মাথায় লেখাপড়ার ভূত আছে। সে বিয়েশাদি করতে নারাজ। এই বছর স্কুল পাস দিয়েছে। এখানেই থেমে গেলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু সে আরও পড়তে চায়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। কী সব ঝামেলার কথা! মেয়ের মাথায় এসব চিন্তা কে ঢুকিয়ে দিচ্ছে কে জানে! কিছুদিন আগে তাকে না জানিয়েই সে ব্র্যাকের স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ নিয়েছে। বাড়ির কাছেই স্কুল, পাশের গলিতেই। তবু এই কথা শুনে রাগে দিশা হারিয়ে ফেলেছিল ইদ্রিস মিয়া। মেয়ে তার অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন দেখেনি। লেখাপড়া শিখে এই উপকার হয়েছে!

সোহাগী চড়ুই পাখির মতো তিরতিরিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঘরময়। সুডৌল হাতে তরকারি কুটে, বাসন মাজে। একচিলতে বারান্দায় কুমড়ো বড়ি শুকোতে দেয়। তার শরীরের আঁকেবাঁকে সমুদ্রের গর্জন শোনে ইদ্রিস। ইদ্রিস মিয়ার কাছে এই দিনটি ভারী প্রিয়। সুখ সুখ একটা অনুভূতি লেগে থাকে মনজুড়ে। তার বউ সোহাগীকে দেখে কেউ বলবেই না সখিনার মতো ষোলো বছরের একটা মেয়ে আছে তার। তেত্রিশ বছরের শরীরে এখনো ঢলো ঢলো যৌবন।

সখিনাকে জিজ্ঞেস করতেই সে মাথা নিচু করে বলেছে, ‘মায়েরে কইছিলাম বাবা। আমি তো খারাপ কিছু করতাছি না!’
তা অবশ্য ঠিক। বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানো তো আর খারাপ কিছু না। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাইরে কাজ করে বেড়ানো মেয়েকে যদি কেউ পরে বিয়ে না করে! সে তো আর মেয়ের কামাই খেতে চাচ্ছে না! তাহলে মেয়ের এই চাকরি কোন ঘোড়ার ডিমের কাজে আসবে? মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জুতসই কিছুও বলতে পারে না সে।
তবে সেই দিন থেকে ভয় ঢুকে গেছে মনে। পড়ানোর নাম করে মেয়ে অন্য কিছু করছে কি না, কে বলতে পারে! এত ফিটফাট হয়ে বাইরে বেরোয়। আগে তো চুলে চিরুনিও দিত না। সেই মেয়ে এখন সেজেগুজে বাইরে যায়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নামে।
ইদ্রিস মিয়া তো রাতবিরেতের আগে বাড়িতে ফিরতে পারে না। তার চাইতে পাড়া-প্রতিবেশীদেরই এখন তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তাভাবনা বেশি। কারও সাথে দেখা হয়ে গেলেই জিজ্ঞেস করে, ‘কী গো ইদ্রিস মিয়া! মাইয়ার বিয়া দিবা না? নাকি ওহনো তুমার মাইয়ার বিয়ার বয়স হয়নি!’
‘ক্যা, আমার মাইয়া কি তুমাগো বাড়া ভাতে ছাই ফ্যালছেনি যে হ্যারে নিয়া চিন্তা লাগছে?’
‘ভালা কতারে খারাপ ভাবো ক্যা মিয়া? সোমত্ত মাইয়া…সন্ধ্যারাইতে বাড়িত ফেরে…দিনকাল কইলাম ভালা না মিয়া!’

এসব শুনে মাথা ঠিক থাকে না ইদ্রিস মিয়ার। বউ সোহাগীর সাথে এ নিয়ে অনেক চিল্লাচিল্লি করেছে সে।
‘দিনরাত ঘরেত বইয়া করোডা কী! মাইয়া ইশকুলের নামে কী কইরা বেড়ায়, খবর রাহো কিছু?’
সোহাগী তার কথা মাটিতে পড়তে দেয় না। খ্যাক করে ওঠে, ‘আপনের মাইয়া আপনে খোঁজ রাহেন গা! আমারে কিছু কয় নাকি আপনের শিক্ষিত মাইয়া?’
‘এইডা কি মায়ের লাহান কতা অইলো?…’
নিজেদের মধ্যে অশান্তিই বেড়েছে শুধু। কাজের কাজ কিছু হয়নি। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে নির্বিকার মুখে ওই একই কথা বলে। সে তো দোষের কিছু করছে না! দরকার হলে তার গতিবিধির দিকে নজর রাখা হোক।
চিন্তায় চিন্তায় ঘুম আসে না ইদ্রিস মিয়ার। শেষকালে মেয়ের জন্য সমাজের কাছে চুনকালি না মাখতে হয়!

তিন.
‘ওস্তাদ, মালিকরে কন না…আপনে যেই দিন ছুটিত থাকবেন, হেই দিন আমি গাড়ি চালামু!’
বজলু আর ইদ্রিস মিয়া ভিন্ন ভিন্ন দিনে ছুটি কাটায়।
তার দেখাদেখি বজলুও সপ্তাহে দুদিন ছুটির আবেদন করেছিল। মালিক রাজি হয়নি। হেলপারকে দুই দিন ছুটি দিলে নাকি তার পোষাবে না। শেষমেশ এক দিনের ছুটি পেয়েছে যদিও, সেটা সপ্তাহের আরেক দিনে। সেই এক দিন অন্য একজন হেলপার নিয়ে গাড়ি চালাতে হয় ইদ্রিস মিয়াকে।
বজলুর কথা শুনে উদাসীন মুখে তার দিকে একবার তাকায় ইদ্রিস মিয়া।

অন্য দিন হলে বজলুর এ ধরনের কথা শুনে সে মুখ ঝাংটানি না মেরে ছাড়ত না। কিন্তু আজ তার মেজাজ ভালো নেই। বজলুর কথা তার কানেই ঢোকে না ঠিকমতো। অন্যমনস্ক চোখে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।
ওস্তাদের এই অন্যমনস্কতা বজলুর নজর এড়ায় না। কৌতূহলী গলায় ভয়ে ভয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘ওস্তাদের কি শইলডা খারাপ?’
ইদ্রিস মিয়ার শরীর ঠিকই আছে। তবে তার মন একেবারেই ঠিক নেই। সে এক শ ভাগ নিশ্চিত, তার মেয়ে সখিনা কারও সাথে ঢলাঢলি করছে। এ জন্যই সে বিয়ের নাম শুনলেই বেঁকে বসে।
একমাত্র মেয়ে বলে চাইলেও মেয়ের ওপরে জোর খাটাতে পারে না ইদ্রিস মিয়া। রাগ করে যদি গলায় ফাঁসটাস কিছু একটা দিয়ে বসে! ওপরে শক্ত ভাব দেখালেও মনের দিক দিয়ে খুব নরম মানুষ সে।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ইদ্রিস মিয়া বজলুর দিকে ফিরে বলে, ‘তুই ছুটির দিনে করছটা কী?’
বজলু অবাক হয়। এই খবরে তার ওস্তাদের কাজ কী! একটু চিন্তাভাবনা করে বলে, ‘ঘুইরা বেড়াই। সিনামা দ্যাহি…ক্যান জিগান, ওস্তাদ?’
‘তরে একটা কাম দিমু। করবার পারবি?’
বজলু আন্তরিকভাবেই বলে, ‘আপনের লাইগা জান কুরবান!’
তরে প্রতি হপ্তাহে পঞ্চাশ ট্যাকা কইরা দিমু। আমার মাইয়ার দিকে চোখ রাখোন লাগবো। হ্যায় সারা দিন কী কাম করে…কই কই যায়…বেবাক খবর আইনা দিবি আমারে। পারবি?’
‘এইডা একডা কাম হইলো, ওস্তাদ? তয় ট্যাকাটা যদি আরেট্টু বাড়াইয়া দিতেন…মানে…ছুটির দিনডা কামে লাগাইয়া দিলেন!’
‘হালা…দিমু এক থাবড়া! বেবাক কিছুর মইধ্যেই লাভ খুঁজোন লাগে, তাই না? আচ্ছা যা, আর কিছু বাড়াইয়া দিমুনে। কিন্তু কাম কইলাম ঠিকমতো হওন চাই!’
‘হেইডা নিয়া কুনো চিন্তা কইরেন না, ওস্তাদ!

এর পরের সপ্তাহ থেকেই বজলু কাজে লেগে গেল। তার সময়টা মন্দ কাটছে না। ওস্তাদের মেয়েকে চোখে চোখে রাখাটা তেমন শক্ত কিছু নয়। বিনিময়ে নগদ টাকাও পাচ্ছে কিছু। পঞ্চাশ টাকা ওস্তাদকে বাড়িয়ে এক শতে নিয়ে এসেছে সে। এক শ টাকার বিনিময়ে মেয়ে মানুষের ওপরে গোয়েন্দাগিরি!
তার রিপোর্টে এখন পর্যন্ত খারাপ কিছু পাওয়া যায়নি। ইদ্রিস মিয়া বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ‘ঠিকমতো দ্যাখোছ তো? নাইলে কইলাম তর খবর আছে!’

বজলু তার বাড়ির কাছাকাছি এসে একটু যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বাড়ির ডান দিকের গলিটাই সখিনার স্কুলের দিকে গেছে। ইদ্রিস মিয়া নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। এই তো, হাঁটা দিয়েছে বজলু। আর দুই কদম গেলেই ডানের গলি।
বজলুকে যেদিন সে ক্রুদ্ধ জনতার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, সেদিন দুটো জুতার বাড়ি সে মারতে গিয়েও মারেনি। আজ তার জুতাটা স্বস্থানে আছে কি না, দেখে নিল একবার। তারপরে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল।

এদিকে ইদ্রিস মিয়ার পাড়া-প্রতিবেশীরা আবার ফিসফাস শুরু করে। ইদ্রিস মিয়ার বাড়ির আশপাশে তার হেলপার কেন ঘুরে বেড়ায়? তারা আবার ইদ্রিস মিয়াকে পাকড়াও করে।
‘কী গো মিয়া…সোমত্ত মাইয়ারে বিয়া না দিয়া ফ্যালাইয়া থুইছো। ওহন দ্যাহো…তুমার হেলপার ব্যাডাই লাইন দিবার লাগছে। হ্যায় তো পেরায়ই তুমার বাড়ির চাইরপাশে ঘুরঘুর করে!’
সখিনার স্কুল তাদের বাড়ির খুব কাছেই। কাজেই বজলুকে সখিনার ওপর নজর রাখতে হলে বাড়ির আশপাশেই চক্কর দিতে হবে। এখন প্রতিবেশীকে এ কথা কীভাবে বোঝায় সে?
ইদ্রিস মিয়া নিস্পৃহ গলায় বলে, ‘আমি হ্যারে আমার বাড়ির চাইরপাশে চক্কর দিবার কইছি। আপনের অসুবিধা আছে?’
প্রতিবেশী মাথা ঝাঁকায়। চোখ নাচিয়ে বলে, ‘পাড়ার একডা ইজ্জত আছে মিয়া। তুমি ত হেই ইজ্জতের ছ্যাবড়া বানাইয়া দিলা!’

দিন গড়িয়ে মাস যেতে থাকে। বজলুর নজরদারি চলতে থাকে। প্রতিবেশীদের ছি-ছিক্কার বাড়তে থাকে। ইদ্রিস মিয়ার মেয়ে সখিনার স্কুলও একইভাবে চলতে থাকে। কোনো কিছুতেই কোনো ছেদ পড়ে না।
ইদ্রিস মিয়া মাঝে মাঝেই বজলুকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিছুই দ্যাহোছ না? হ্যায় কি ইশকুলেই থাকে বেবাক সময়?’
‘হ ওস্তাদ! আর কুনোহানে যায় না!’
‘ঐ তাইলে আর তর কাম কী? তরে মাগনা মাগনা ট্যাকা দিমু ক্যা? সামনের হপ্তাহ থিইকা তর কাম শ্যাষ!’
বজলু উত্তর দেয় না। তবে সে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে যায়। মুখ কালো করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টা ইদ্রিস মিয়ার নজর এড়ায় না।

চার.
‘ও ইদ্রিস, তর হেলপার এইহানে কী করে? খালি তর বাড়ির চাইরপাশে ঘুরঘুর করে!’
ছুটির দিনে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে বাড়ির সামনের দোকানে গিয়ে বসেছিল ইদ্রিস। দোকানি তার বন্ধু মানুষ। মাঝে মাঝেই এখানে এসে গল্পগুজব করে সে। চা-বিস্কিট খায়।
ইদ্রিস মিয়া চায়ে ম্যারি বিস্কিট ডুবিয়ে ডুবিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছিল। দোকানি বন্ধুর কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে তার বিস্কিট চায়ের মধ্যেই ডুবে গেল। সেদিকে তাকিয়ে একটু আফসোস হলো তার। কিন্তু বন্ধুর কথাটিও তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। বজলুর কাজ তো গত মাসেই শেষ হয়ে গেছে। এখনো তাকে চক্কর দিতে দেখা যাবে কেন?
চিন্তিত মুখে বলল, ‘কবে দ্যাখছোস?’
‘এই তো গত সোমবারেই ত দ্যাখলাম। খালি তর বাড়ির দিকে চাইয়া থাহে। ইদিক-উদিক দ্যাহে। সখিনার…’
কথাটা তাকে শেষ করতে দেয় না ইদ্রিস মিয়া। উত্তেজিত গলায় বলে, ‘আইজ উঠি। পরে আমু।’
বলে আর একটি কথাও না বলে হনহনিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় ইদ্রিস মিয়া।

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার মনে হলো, এভাবে চেঁচামেচি করে কিছু হবে না। বজলু আর সখিনাকে তার হাতেনাতে ধরতে হবে। সখিনার সাথে লাইন মারত দেখেই তার সম্পর্কে অভিযোগ করেনি বজলু।
ইশ্! নিজের হাত নিজেরই কামড়াতে ইচ্ছে করছে ইদ্রিস মিয়ার। এই সহজ বিষয়টা সে বুঝতে পারল না!
মেয়ের চালচলন তো তার আগে থেকেই ভালো ঠেকত না। মানুষ যা বুঝতে পারে না, সেটা নিয়েই সন্দেহ করে বেশি। সখিনার কাজ-কারবার কিছুই সে বুঝতে পারে না। সে আর তার বউ তেমন পড়াশোনা করেনি দেখে সখিনা তাদের বোকা বানিয়ে চলে।

মেয়ের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে অনেক আগে থেকেই সন্দেহের বীজ ঢুকে পড়েছিল মনে। ইদানীং মেয়ের সাজগোজ দেখলেই কেমন যেন অন্য রকম মনে হতো। ওসব ইশকুল-ফিস্কুল সব ভুয়া কথা। হয়তো বাইরে কোথাও গিয়ে সময় কাটায়।
কিন্তু শেষকালে বজলুর খপ্পরে পড়ল তার মেয়ে! আর সে নিজেই কিনা এই খাল কেটে কুমির নিয়ে এল!
বউয়ের ওপরে চেঁচিয়েও লাভ হবে না। তার বউয়ের চোখের মাথা নষ্ট। এসবের কিছুই তার চোখে পড়ে না। মেয়ে দিনদুপুরে পালিয়ে গেলেও তার চোখে পড়বে না। যা করার ইদ্রিস মিয়াকেই করতে হবে।

পরদিন তার কাজে যাওয়ার দিন। আর বজলুর ছুটির দিন। ইদ্রিস মিয়া মালিকের কাছে গিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের অসুস্থতার মিথ্যা গল্পগাথা বানিয়ে সেদিনও ছুটি চেয়ে নিল। তারপর বাড়িতে না গিয়ে তক্কে তক্কে থাকল।
আজ বজলুকে সে ছাড়বে না। হাতেনাতে ধরবে। ব্যাটা কালসাপ! দুধ-কলা দিয়ে এতকাল কালসাপ পুষে এসেছে সে!
বাড়ির সামনের দোকানে কাপড় দিয়ে মুখচোখ ঢেকে বসে থাকল ইদ্রিস মিয়া। অপেক্ষার প্রহর আর ফুরোতেই চায় না। দোকানি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘আইজ কামে যাছ নাই? কী হইছে তর?’
কিছু বলেনি ইদ্রিস মিয়া। শুধু চুপচাপ অপেক্ষা করেছে বজলুকে হাতেনাতে ধরার জন্য।

একটু পরই মোড়ের মাথায় বজলুর দেখা পাওয়া গেল।
চট করে নিজের মুখটাকে অন্য দিকে সরিয়ে ফেলল ইদ্রিস মিয়া। তারপরে সরু চোখে বজলুর গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। বজলু তার মেয়ের স্কুলের দিকে যেতে লাগলেই হাঁটা দেবে সে।
ইদ্রিস মিয়া অপেক্ষা করছে।
বজলু তার বাড়ির কাছাকাছি এসে একটু যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বাড়ির ডান দিকের গলিটাই সখিনার স্কুলের দিকে গেছে। ইদ্রিস মিয়া নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। এই তো, হাঁটা দিয়েছে বজলু। আর দুই কদম গেলেই ডানের গলি।
বজলুকে যেদিন সে ক্রুদ্ধ জনতার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, সেদিন দুটো জুতার বাড়ি সে মারতে গিয়েও মারেনি। আজ তার জুতাটা স্বস্থানে আছে কি না, দেখে নিল একবার। তারপরে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল।

বজলু গলির কাছাকাছি যেতেই ইদ্রিস মিয়া হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মুখের ওপরের কাপড়টাকেও সরিয়ে ফেলেছে সে। আর মুখ লুকানোর কিছু নেই।  যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। এই তো…আর কয়েক সেকেন্ডের পথ।
হঠাৎ…কিছু একটা দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি নিজেকে আবার লুকিয়ে ফেলল ইদ্রিস মিয়া।
বজলু ডান দিকের গলিতে না গিয়ে ঢুকে পড়েছে তার বাড়ির মধ্যে। ঘরের দোর আলগাই ছিল। বজলু কাছে যেতেই সেটা হাট করে একেবারে খুলে গেল।
বজ্রাহত দৃষ্টিতে ইদ্রিস মিয়া দেখল…
দরজার পাল্লা ধরে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তারই ঢলো ঢলো যৌবনা স্ত্রী…সোহাগী!

 


প্রচ্ছদ : রাজিব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.