:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
রোমেল রহমান

কবি, গল্পকার

পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত

তাদের শান্ত মুখের আভা দেখে কৌতূহল জাগে বলেই খোঁড়াখুঁড়ি হয় এবং সুলুক জানতে পারা যায় যে, এরা হচ্ছে সেই গোত্রের লোক যারা গাছ লাগায় এবং যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম গাছ লাগায় এবং তারা গাছ লাগায়ে আগায়- পিছায়, ছড়ায়ে যায় বা এই কিসিমের বিবিধ তথ্য আমরা জানতে পেরে মূল কাহিনীতে যাবার জন্যে সুরৎহাল করতে করতে জানতে পাই এইসব:

কোন এক পুরাতন থেকে পুরাতনতর জামানায় এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় এক অদ্ভুত সূত্রের উপর যে, তারা বৃক্ষ রোপণ শুরু করে এবং তারা এটারে জীবনের মোক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদের গোষ্ঠীপ্রধান প্রয়োগ করে এক গুহ্য প্রথার যা কিনা এমন যে, তারা গাছ লাগাবে এবং সেই গাছ লাগানোকে কেন্দ্র করেই তাদের বিচরণ এবং ছড়িয়ে পড়া নির্ণীত হবে, এবং কালে কালে সেই প্রথা শক্তিশালী হয়ে আসছে এবং আমরা খুঁজে পাই এমন তথ্য যে; এরা গাছ রোপণ করে এবং সেই গাছকে কেন্দ্র করে তারা গার্হস্থ রচনা করে এবং সেই গাছে ফুল ফুটে বীজ এলে সেই বীজ সংগ্রহ করে এরা পাত্তাড়ি গোটায় এবং আরেকটা নতুন যায়গায় গিয়ে সেই ভূমিতে পূর্বের বৃক্ষ থেকে উৎপন্ন বীজ রোপণ করে এবং আবার সেই বীজ থেকে চারা বের হলে সেই চারাকে কেন্দ্র করে সংসার রচনা করে এবং সেই গাছের প্রথম ফল বা ফুলের অপেক্ষায় থাকে আবার বীজ পাবার আশায়, ফলে পণ্ডিতদের কেউ কেউ এদেরকে যাযাবর শ্রেণীর একটা বিশেষ সম্প্রদায় বলার ব্যর্থ চেষ্টা করে কেউ কেউ পিএইচডি করার ফিকির করলেও এরা এসবের তোয়াক্কা করে না বরং এরা তাদের জীবন সূত্রের ধাপগুলো পাড়ি দিয়ে ঘুরতে থাকে নিজস্ব ছন্দে, আগাতে-পেছাতে থাকে।

তাদের জিজ্ঞাস করলে তারা বলে, ‘…কিচ্ছু না, সব ভকিচকি, সময়রে ডিঙায় যাবার জন্য ভুচকি মারা!’ তারা এইসব বলে, এবং তারা সবাই এই একই বাক্য বলে যখন তাদেরকে জিজ্ঞাস করা হয় তাদের বৃক্ষ রোপণ জীবন প্রণালী বিষয়ে। ফলে আমরা খোঁড়াখুঁড়ি করে আস্তে আস্তে লোকমুখে শুনে শুনে জানতে পাই যে, যখন এই গোত্রের উদ্ভব তখন এদের কাজ ছিল বীজ ছড়াতে ছড়াতে এগোতে থাকা। ফলে তারা কোথাও স্থির ঘর বাঁধত না। তখন পৃথিবীতে বৃক্ষ ছিল বেশি! এখন প্রশ্ন হতেই পারে যখন বৃক্ষ বেশি ছিল তখন এরা রোজ একাধারে গাছ রোপণ করে বা বীজ ছিটিয়ে এসেছে আর এখন অরণ্য কেটে সাফ করে দেয়া হচ্ছে যেই জামানায় তখন কিনা এরা একেকটা গাছের পেছনে এতো বছর সময় দেয়? উত্তরে তারা হয়তো জানিয়েছে, তখন মানুষ ছিল কম! এখন মানুষ বেশি এবং মানুষ গাছ নষ্ট করে তাই রোপিত বীজ ভেঙে বের হওয়া বৃক্ষকে দাড় করিয়ে দিয়ে তবেই তার কাছ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার এই প্রথা কালের বিবর্তনে তারা জন্ম দিয়েছে। তারা আগায় এবং পিছায়। যদি তাদের সংগৃহীত বীজ থেকে চারা না জন্মায় তবে তারা আবার ফিরে আসে পূর্বের বৃক্ষের কাছে সেখানে তারা আবার বীজের জন্য অপেক্ষা করে এবং সেই বীজ তারা সংগ্রহ করে আবার অগ্রে যাত্রা করে। তাদের নিদিষ্ট কোন দিক নেই ফলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে তারা।

যুদ্ধ রাজনীতি রক্তপাতে, দেশ সীমান্ত ইত্যাদিতে ভাগ হয়ে ক্রমে তারা আবিষ্কার করেছে মানুষই মানুষকে আঁটকে ফেলতে চায় কাঁটাতারের মধ্যে, ফলে স্বাধীন বৃক্ষ রোপণ এবং এক যায়গা থেকে অন্য যায়গা যাওয়া ক্রমে একটা সূক্ষ্ম সীমাবদ্ধতার মধ্যে এসে আঁটকা পড়ে এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বৃহৎ নগর থেকে দূরে এবং রাজভবনের নিকটে নয় তবে প্রত্যেক ভূমির নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে তাদের জীবন যাপন অব্যাহত থাকবে কেনোনা সকল দ্বিমতকে তারা স্বীকার করে।

যুদ্ধ রাজনীতি রক্তপাতে, দেশ সীমান্ত ইত্যাদিতে ভাগ হয়ে ক্রমে তারা আবিষ্কার করেছে মানুষই মানুষকে আঁটকে ফেলতে চায় কাঁটাতারের মধ্যে, ফলে স্বাধীন বৃক্ষ রোপণ এবং এক যায়গা থেকে অন্য যায়গা যাওয়া ক্রমে একটা সূক্ষ্ম সীমাবদ্ধতার মধ্যে এসে আঁটকা পড়ে এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বৃহৎ নগর থেকে দূরে এবং রাজভবনের নিকটে নয় তবে প্রত্যেক ভূমির নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে তাদের জীবন যাপন অব্যাহত থাকবে কেনোনা সকল দ্বিমতকে তারা স্বীকার করে। যেমন বিবাহ বা সঙ্গী নির্বাচন প্রথার ক্ষেত্রে তারা স্বীকার করে যে, রোপিত কোন বৃক্ষকে ফুলবতী করার সময়কাল পর্যন্ত ঐ ভূমিতে বসবাস করার সময়ে যদি কোন যুবতী বা যুবক স্থানীয় কোন যুবক বা যুবতীতে আসক্ত হয় তবে বাঁধা নেই গাঁটছড়া বাঁধতে। এবং তাদের সূত্র অনুসারে স্থানীয় পুত্র বা কন্যাটি তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে তাদেরকে সঙ্গে নেয়া হবে না। বরং তাদেরকে দেয়া হবে একটি বীজ যা রোপণ করা হবে যেই গাছটিকে কেন্দ্র করে তারা বসতি স্থাপন করেছে তার থেকে কিছুদূরে। এবং সেই গাছকে বড় করে তোলার মধ্যে দিয়ে নতুন দম্পতি তাদের জীবন সূচনা করবে এবং এই গাছে বীজ আসলে তারা সেই বীজ সংগ্রহ করে অন্য কোন দিকে যাত্রা করবে। তারা ক্রমে দুই থেকে তিন চার পাঁচ হবে বা হবে না। আবার যদি তারা চায় গাঁটছড়া বেঁধে এই বৃক্ষ কেন্দ্রিক জীবন পদ্ধতিতে নাম না লেখাতে সেক্ষেত্রেও বাঁধা নেই। সে ক্ষেত্রে তারা নতুন গাছ লাগাবার বীজ নেবে না এবং যেই গাছকে কেন্দ্র করে এই গোত্রটি অবস্থান করছে সেই গাছটির বুকে একটা পেরেক গেঁথে রেখে যাবে ফলে আগামীতে কোন দল যদি এখান দিয়ে যাত্রা করে তবে তারা জানতে পারবে এখান থেকে একজন বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

ফলে প্রশ্ন হতে পারে যখন নিজেদের মধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয় তখন কি হবে? উত্তরে জানা যায় তখনো একই নিয়ম প্রায়। সেক্ষেত্রে শুধু গাছের বুকে পেরে গেঁথে দেবার সুযোগ নেই এবং তাদেরকে একটা নতুন গাছের বীজ দিয়ে চারা উৎপাদন করে বসিয়ে দেয়া হবে। এবং একদিন তারা নতুন দিকে যাত্রা করবে। ফলে আবার প্রশ্ন হবে যে, তাহলে প্রতিটা গোত্রে শেষতক একজোড়া বা একজন বুড়ো বুড়ি থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে উত্তর হবে, হ্যাঁ! এবং সেই বুড়োবুড়ি যখন অনুভব করবেন তারা বা সে আর এগোতে পারবেন না এবং এটিই তার জীবনের শেষ বৃক্ষ। তখন তিনি ঐ বৃক্ষের চারপাশে আরও কয়েকটা বৃক্ষ লাগাবেন এবং এই কটা বৃক্ষকে চর্চা করে তিনি অন্তিম দিনগুলো কাটাবেন এবং আগামীতে তাদের কেউ এইখান দিয়ে যাবার সময় এতগুলো বৃক্ষকে দেখে বুঝবে এখানে তাদের একজন সমগ্র জীবনের ভার জমা করে গেছেন। দীর্ঘ পরিযানের ক্লান্তি তার এইখানে মজুদ।

তারা নাকি বলে, ‘মায়া হচ্ছে অতীত, বা যার অতীত হবার সক্ষমতা আছে তাই মায়া, আর অতীত হচ্ছে চিহ্ন, আর চিহ্নের কাছে ফেরা যায় না কেননা খাপে খাপ মিলবে না; কারণ তুমি বুড়ো হয়ে গেছো, বেমানান হয়ে গেছো, মায়ার জন্য কাঁদতে হয়, কিংবা মায়া রচিত হয় কাঁদবার জন্য!’

তারা নাকি বলে, ‘মায়া হচ্ছে অতীত, বা যার অতীত হবার সক্ষমতা আছে তাই মায়া, আর অতীত হচ্ছে চিহ্ন, আর চিহ্নের কাছে ফেরা যায় না কেননা খাপে খাপ মিলবে না; কারণ তুমি বুড়ো হয়ে গেছো, বেমানান হয়ে গেছো, মায়ার জন্য কাঁদতে হয়, কিংবা মায়া রচিত হয় কাঁদবার জন্য!’ এদের প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে ছোট্ট কাঠের বাক্স থাকে। যার মধ্যে এরা প্রতি পাতাঝরা ঋতু থেকে একটা করে ঝরাপাতা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে। শিশু জন্মানোর পর তার নামে একটা বাক্স বানানো হয় যেই বাক্সে শিশুটির পিতামাতা তার সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগ পর্যন্ত অর্জিত ঝরাপাতা কালের সাক্ষ্ম হিসেবে একেকটা পাতা সংগ্রহ করে। এই বাক্স প্রত্যেকে সংরক্ষণ করে মৃত্যু পর্যন্ত। প্রচলিত কট্টর সমাজ এবং ধর্ম এদেরকে পছন্দ করে না, তা নিয়ে এদের দুঃখ নেই, কেনোনা তারা তো এদেরকে অপছন্দ করে না এবং এদের রাজ্য দখলের পরিকল্পনা নেই। যদিও কোথাও কোথাও এদের উপর হামলা হয়েছে, এদেরকে নিধন করতে চায় কেউ কেউ। তবু এদের বিকার নেই।

এরা একটা গল্প বলে, একবার এক বিরাট যুদ্ধের সময়ে একদেশে থাকা আমাদের একটা দল বাঁচার জন্য ছুটে পালাতে বাধ্য হল। ফলে তারা যুদ্ধের মধ্যে কোন গাছের বীজ পাচ্ছিল না, তবে তারা পেয়ে গেলো শস্যদানার কিছু বীজ, এবং সেই স্থানীয় শস্যদানা একটা নিদিষ্ট দূরত্বে ছড়াতে ছড়াতে তারা লুকাতে সমর্থ হল। কিছুদিন পর সেই বীজ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা শস্যগাছ গুলো হাওয়ায় দুলতে লাগলো এবং একদিন এক সৈনিকের চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়লো। এবং সে কৌতূহলী হয়ে সেই ধারাবাহিক শস্যচারা অনুসরণ করে যেতে যেতে দলছুট হয়ে একসময় পৌঁছালো এমন এক যায়গায় যেখানে একদল বৃক্ষের মতো মৌন কিন্তু সজীব মানুষ লুকিয়ে ছিল! তাদেরকে দেখে সৈনিকটি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ এবং তার বন্দুকটি ছুঁড়ে ফেলে সকল উর্দি খুলে সে ঐ মানুষদের দলে যুক্ত হল। এবং আমরা জানতে পারি হারিয়ে যাওয়া এই সৈনিকের সন্ধান যুদ্ধ শেষ হবার অনেক বছর পর একদল গবেষক পেয়ে যায়, কেনোনা তারা খুঁজে পায় ছুঁড়ে ফেলা বন্দুকটি এবং তারা বিবৃতি দেয় সম্ভবত এই অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ায় সৈনিকটিকে কোন হিংস্র প্রাণী ভক্ষণ করেছে অথবা মানুষ খেকো কোন বৃক্ষ তাকে হাওয়া করে দিয়েছে! কিন্তু তারা এইসব গল্প নিয়ে হইচই করে না। তারা জানে বেঁচে থাকলেই গল্প জন্মায়। ফলে তারা আগ্রহ দেখায় না সরকারি সাহায্য বা এঞ্জিওর সহযোগিতার দিকে। তারা বলে, ‘সাহায্য নেয়া মানে আত্মা বন্ধক দেয়া।’ তারা আরও বলে, ‘আমরা জানি আমাদের কাজ শুধু গাছ লাগাতে লাগাতে এগিয়ে যাওয়া আর ছড়িয়ে পড়া!’ তাদের কেউ মারা গেলে মৃতের বাক্সটিকে ঠিক সেই যায়গার মাটির নিচে পুঁতে ফেলে, যেই বাক্সর মধ্যে মৃতের সঞ্চিত ঝরাপাতাকালের চিহ্ন পাতারা জমা থাকে। এবং অন্যরা সেদিন বৃক্ষের পাতা ছিঁড়ে এনে বাঁশি বানায়! সেই বাঁশিতে তারা শোকের সুর বাজায়! একজন মানুষ যিনি সমগ্র জীবন বৃক্ষ রোপণ করে এগিয়ে গেছেন, বৃক্ষদের যত্ন করেছেন, এ যেন তার জন্য কিছু পাতা ছেঁড়া কান্না উচ্চারণ! কেনোনা তারা বলে, ‘আমরা একটা স্বপ্নকে বহন করছি; আমাদের স্বপ্ন: আমাদের শেষ মানুষটি গাছ লাগাতে লাগাতে এগিয়ে যাবে- ছড়িয়ে যাবে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত।

১৬ এপ্রিল ২০১৯

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.