:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মারুফ ইসলাম

গল্পকার, প্রাবন্ধিক

হা জীবন!
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

হা জীবন!

কুকুরুককুউউউ….।
মোরগ ডাকে ভোরবেলা। শরীরের কাঁথাটা মাথা অব্দি টেনে দিতে দিতে হতচ্ছাড়া মোরগটাকে দুটো বিশ্রি গালি দেয় বিল্লাল— ‘চু… মোরগ, তোর গুষ্টি চু…! পত্তেক দিন পরভাতে তোর ডাকাডাকি করা লাগে ক্যারে ভাই! ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব তোক্ কে দিছে?’ বিল্লালের মনে পড়ে যায়, টিয়াখোলা বাজারে রতনের সেলুনের টিভিতে একদিন দেখেছিল—নাটক নাকি সিনেমা মনে নেই; সেখানে তার বয়সী এক বালকের ঘুম ভাঙাত ক্রিং ক্রিং শব্দ করা ছোট্ট একটা ঘড়ি। বিল্লালেরও যদি ওরকম একটা ঘড়ি থাকত! সিথানের কাছে নিয়ে ঘুমাত সে। তা না, চু… এক মোরগ পত্তেকদিন পরভাতে চিল্লাফাল্লা কর‌্যা ঘুম ভাঙায়।

কুকুরুককুউউউ…। আবারও গলা ছাড়ে মোরগটা। বিল্লাল কাঁথাটাকে পুনরায় টেনে নিয়ে কান-মাথা দস্তুর মতো মুড়ি দিয়ে একটা মোচড় দিয়ে অন্যপাশে শোয়।

‘অ্যাই ছোঁড়া, ক্যাঁথা টানিচ্ছু ক্যারে! হামি যে পুরাই উদান হয়্যা গেনু!’ পাশে নিদ্রামগ্ন বিল্লালের বুড়ো দাদা মোতাবেল মিয়া সদ্য নিদভাঙা গলায় খ্যাক খ্যাক করে ওঠে। ‘ওই বিল্লাল, ওঠ ওঠ। সেই কখন পরভাত হছে। ওঠ ভাই ওঠ। আর কত নিন পারবু রে।’

বিল্লালের সাড়া না পেয়ে এবার ধইঞ্চাকাঠির মতো শীর্ণ হাতে বিল্লালের পিঠ-পাঁজরে গুতো দেয় বুড়ো। ‘বিল্লাল…ও বিল্লাল!’

খানিক আগে মোরগের উদ্দেশে দেয়া বিশ্রি গালিটা এবার বুড়ো মোতালেবের নামে উৎসর্গ করে বিল্লাল। গজগজ করতে করতে বলে, ‘মরার বুড়া মরেও না। ঘাঁটাও ছাড়ে না।’

চোখ ডলতে ডলতে উঠে পড়ে বিল্লাল।

করিৎকর্মা আছে ছেলেটা। বয়স সাকূল্যে সাড়ে নয়। তা হলে হবে কী, এরমধ্যেই দিন দুনিয়ার নানা কসরত দেখে ফেলেছে সে। বাপ ছিল টিয়াখোলা রেলস্টেশনের কুলি। কাউয়াতলা আর বকপট্টি গ্রামের মধ্যে যেবার ধুন্ধুমার মারামারি বেঁধেছিল সেবার কাউয়াখোলাকে মুক্ত করতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে বেচারা। সে অনেককাল আগের কথা। দাদা বলে, ‘তোর বাপ শহীদ হছে, বুঝলু। গাঁও স্বাধীন করবা যায়্যা শহীদ হছে।’ বিল্লাল অবশ্য এতসব বোঝে না। কীসের স্বাধীন, কীসের শহীদ! তারপরও প্রায় প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় নাতির চুলের ভিতর বিলি কাটতে কাটতে বুড়ো মোতালেব হেমন্তের বাতাসের মতো ধীরলয়ে বলে যায়, ‘হামাকেরে এই কাউয়াতলা একসময় পরাধীন আছলো, বুঝলু ভাই। পরাধীন মানে হচ্ছে অন্যরা মাতব্বরি ফলাচ্ছিলো। অন্যরা আবার কে? ওই যে বকপট্টির খাঁ বাড়ির লোকজনেরা। ভীষণ অত্যাচার করিচে হামাকেরে উপর, বুঝলু। তো একসময় অত্যাচার সবার না পার‌্যা প্রুতিবাদের ডাক দিলো হামাকেরে সরদার বাড়ির বাবর সরদার। গাঁয়ের বেবাকক ডাক্যা কলো, ইংকা কর‌্যা পড়্যা পড়্যা আর কদ্দিন অত্যাচার সহ্য করবিন? চলেন, বেবাকে মিল্যা পরতিবাদ করি। এইবার হামাকেরে পাঁতারত্ ধান কাটপা আলে খাঁ বাড়ির একজনকেও কাউয়াতলা ঢুকপার দিমো না। কী কচ্চিন তোমরা? বেবাকে তখন চিগরা কলো, হয় হয়। তারপর ভাই বুঝলু, এই মিটিংয়ের খবর তো পৌঁছা গেল বকপট্টিত। পরের দিনই বকপট্টি গাঁওসুদ্ধ্যা মানুষ লাঠিসোটা লিয়া চল্যা আলো হামাকেরে গাঁওত। হামরা কি আর বস্যা থাকমো? লাঠিসোটা লিয়া ঝাঁপ্যা পড়নু। সে কি মারামারি। এরমদ্দ্যে তোর বাপের মাথাত কারবা লাঠির বাড়ি আস্যা লাগল। সাথে সাথে মাথ্যা ফাট্যা গলগল করা অক্ত বার হবার লাগল। তোর বাপ মাটিত্ লুট্যা পড়লো রে ভাই…। ও ভাই, বিল্লাল। ভাইধন হামার। নিন আসিছু ভাই?’

গভীর ঘুমে ততক্ষণে তলিয়ে পড়েছে বালক বিল্লাল।

বাপ মরার বছর তিনেক পর ‘যাই, উত্তুর পাড়া থ্যাকা ত্যাল লিয়া আসি’ বলে এক সন্ধ্যেবেলা মোতালেব বুড়ার বাতের তেল আনার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি বিল্লালের মা। পরে শোনা গেল, উত্তর পাড়ার কুদ্দুসও উধাও। দাদা বলল, ‘মাগি ওই নাঙ্গের সাথে পলাছে রে।’ বিল্লালের বয়স তখন সাত। ওই সাত বছর বয়সেই বাপ-মা দুজনকেই খুইয়ে দাদার ঘাড়ে পড়ে সে। তারপর বছর দুয়ের ঘুরতে না ঘুরতেই সেই দাদাই এখন তার ঘাড়ে। হাহ! জীবন!! আরো কত সার্কাস দেখানোর জন্য যে তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছে কে জানে!

বাপ মরার বছর তিনেক পর ‘যাই, উত্তুর পাড়া থ্যাকা ত্যাল লিয়া আসি’ বলে এক সন্ধ্যেবেলা মোতালেব বুড়ার বাতের তেল আনার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি বিল্লালের মা। পরে শোনা গেল, উত্তর পাড়ার কুদ্দুসও উধাও। দাদা বলল, ‘মাগি ওই নাঙ্গের সাথে পলাছে রে।’ বিল্লালের বয়স তখন সাত। ওই সাত বছর বয়সেই বাপ-মা দুজনকেই খুইয়ে দাদার ঘাড়ে পড়ে সে। তারপর বছর দুয়ের ঘুরতে না ঘুরতেই সেই দাদাই এখন তার ঘাড়ে। হাহ! জীবন!!

ঘুম ঘুম চোখে বিল্লাল মিয়া খোঁয়ার খুলে দেয়। ডানা ঝাপটিয়ে ফুরুত করে হাতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় লাল মোরগটা। তার পেছনে পেছনে পাঁচ ছয়টা ছানাসমেত বের হয়ে আসে একটা কালো মুরগী। তারপর বেরিয়ে আসে কয়েকটা হাঁস। খোঁয়ারের ভিতর উঁকি দিয়ে বিল্লাল দেখতে পায় সাদা চান্দের লাকান তিনটা ডিম পড়ে আছে মেঝেতে। খুশিতে ঝলমল করে ওঠে বালকের মুখ।

ডিম তিনটে গেঞ্জির কোছায় ভরে তখনই দৌড় দেয় সে টিয়াখোলা বাজারে। বাজারটা বেশি দূরে নয়। পাঁচ-ছয় মিনিটের হাঁটাপথ। পথটুকু এক দৌড়ে পাড়ি দিয়ে কিনামিয়ার দোকানে গিয়ে থামে বিল্লাল। বাজারের সবচেয়ে বড় মুদি দোকান। হাঁপাতে হাঁপাতে দেখে, দোকানের সাটার নামানো। তালা ঝুলছে ইয়া বড় বড়। এখনো খোলেনি দোকান। মাত্রই তো ডিমভাঙা লাল কুসুমের মতো সূর্যটা মাথা তুলেছে আকাশে। আটটার আগে দোকানের তালা খুলবে না কিনা মিয়া।

নিজের নির্বুদ্ধিতায় কিছুটা বিরক্ত হয় বিল্লাল। ডিম তো পরেও বিক্রি করা যেত! এই সাত সকালে দৌড়ে আসার কোনো দরকারই ছিল না।

বিল্লাল ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে টিয়াখোলা রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ওপর এসে দাঁড়ায়। আঁজদাহা পদ্মরাগ ট্রেনটা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে ইঞ্জিন থেকে। আর ইঞ্জিনের চাঁদি থেকে ভকভক করে বের হওয়া কালো ধোঁয়া ঢেকে দিচ্ছে সকালের পবিত্র আকাশ। কুলিরা ব্যস্ত হয়ে মাল ওঠাচ্ছে ট্রেনের বগিতে। মাল বলতে ওই বিভিন্ন পদের সবজির বস্তা। আশপাশের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই কৃষক। তারা জমিতে ধানের পাশাপাশি নানা মৌসুমি সবজি চাষ করে। আলু, পটল, বেগুন, শসা, কাঁচামরিচ, টমেটো, গাঁজর, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি আরো কত কি। এসব বস্তাবন্দি করে ট্রেনে উঠিয়ে ওই দূরের বগ্ড়া শহরত নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।

বস্তাবন্দি করতে গিয়ে কিছু সবজি পরিত্যাক্ত থেকে যায়। পোকায় খাওয়া বেগুন, ভেঙে যাওয়া শসা, দাগধরা ফুলকপি…। প্ল্যাটফর্মের ওপর ইতস্তত পড়ে থাকে এসব। কুলি কিংবা কৃষক কেউই মাথা ঘামায় না এসব পড়ে থাকা সবজি নিয়ে, কারণ ট্রেন চলে গেলে রূপলাল মেথর এসে ঝাড় দিয়ে সব সাফসুতরো করে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয় ভাগাড়ে।

বিল্লাল প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকে এই সময়ের। রূপলাল আসার আগেই সে পরিত্যাক্ত সবজিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যায় বাড়িতে। তারপর ধুয়েমুছে পরিস্কার করে একটা বাঁশের চাঙ্গারিতে তুলে দাদার হাতে ধরিয়ে দেয়। বুড়ো মোতালেব সেসব নিয়ে ওই টিয়াখোলা বাজারেরই এক কোণায় বসে থেকে বিক্রি করে। দু’তিন ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায় সবজিগুলো। তারপর সারাদিন এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষে করে বুড়ো।

বিল্লাল তবে কী করে সারাদিন?

কাউয়াতলার বগলঘেষে এক পাকা রাস্তা বয়ে গেছে অনেকদূরের কাঞ্চনপুর পর্যন্ত। এই রাস্তার এক জায়গায় রয়েছে লোহার ব্রিজ। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে ইরাবতী খাল। রাস্তা থেকে ব্রিজটা এতই উঁচুতে যে ভ্যান-রিকশা যাত্রী কিংবা মাল নিয়ে উঠতে পারে না। তখন হয় যাত্রীদের রিকশা থেকে নামতে হয়, নয়ত রিকশার পেছন থেকে কাউকে ঠেলতে হয়। বিল্লাল সারাদিন এখানে রিকশা ঠেলার কাজ করে। বিনিময়ে রিকশার যাত্রীরা তাকে দুই টাকা করে পারিশ্রমিক দেয়।

দাদা-নাতির সংসার চলে মূলত এমনতর রোজগার দিয়েই।

২.
আজ পদ্মরাগ চলে যাবার পর সবজি কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে না বিল্লাল। সে কোছাভর্তি তিনটি ডিম নিয়ে আবার হাজির হয় কিনামিয়ার দোকানে। ততক্ষণে দোকানের ঝাপ তুলেছে কিনামিয়া। বিল্লাল দোকানের সামনে গিয়ে বলে, ‘ডিম লিবিন? হাঁসের ডিম।’

কিনামিয়া মুখে কিছু বলে না, শুধু মরা গরুর মতো স্থির চোখে তাকায় একবার। বিল্লাল হড়হড় করে বলতে থাকে, ‘চুরি কর‌্যা আনিনি, বিশ্বাস করেন চাচা। হামাকেরে হাঁসে পাড়িছে।’

এবার হাত বাড়িয়ে ডিমগুলো নেয় কিনামিয়া। ক্যাশের ড্রয়ার থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দেয় বিল্লালের দিকে। টাকার নোটটা হাতের মধ্যে নিতে নিতে বিল্লাল শুনতে পায় বাজারে মাইকিং হচ্ছে—‘বিরাট কাঙালি ভোজের আয়োজন! সরদার বাড়িতে বিরাট কাঙালি ভোজের আয়োজন। সকলে আমন্ত্রিত। আপনারা সকলে আমন্ত্রিত।’

আকবর সরদার আবার বলতে শুরু করেন, ‘হামরা ক্ষমতায় আসার পর কাউয়াতলার কত উন্নয়ন হছে, দিখিছিন তোমরা? কাউয়াতলা এখন মধ্যম আয়ের গাঁও। আর বিশ বছরের মধ্যে এডা উন্নত আয়ের গাঁওয়ে পরিণত হবে। তখন কাঙালি ভোজ খিলানোর মতো একডাও মানুষ পাওয়া যাবে না, হামি হলপ কর‌্যা কচ্ছি আজ। হামার কতা যদি সত্যি না হয়, তোমরা হামার কান কাট্যা কুত্তাক খিলাইও সেদিন।’

মাইকিং শুনতে শুনতেই বাড়ি ফেরে বিল্লাল। সবজিবিহীন খালি হাত নিয়ে বাড়ি ফেরা দেখে বিস্ময়ের চোখ তুলে নাতির দিকে তাকায় বুড়ো মোতালেব। দাদার জিজ্ঞাসু চাহুনির উত্তরে বিল্লাল বলে, ‘দাদা, আজ তোক্ সবজি বেঁচা লাগবে না, ভিক্ষাত্ও বাড়ান লাগবে না। সরদার তোক্ দাওয়াত দিছে আজ। দুপুরে হামরা ওটি খামো।’

ফোকলা দাঁতের আড়াল থেকে এক ঝলক হাসি বেরিয়ে আসে বুড়োর। কতদিন ভালোমন্দ কিছু পেটে পড়ে না!

সে নাতিকে উদ্দেশ্য করে শুধায়, কী খাবার দিবে রে বিল্লাল?

-‘পত্তেকবার তো বিরানির প্যাকেট দ্যায়। এবারও তাই দিবে মনে হয়।’

-‘হামার কলে এক প্যাকেট দিয়া হবে না রে, ছোঁড়া। বেশি কর‌্যা প্যাকেট লিবু। আজ হাউশ মিট্যা খামো।’

দুপুর হওয়ার অনেক আগেই সরদার বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণে গিয়ে হাজির হয় দাদা-নাতি। প্রাঙ্গণজুড়ে কেঁচো-কেন্নোর মতো কিলবিল করা শতশত মানুষ দেখে মন মচকায় তাদের। বেশিরভাগই ভুখা নাঙ্গা মানুষ। এত মানুষের ভীড়ে তারা খাবার পাবে তো? প্রাঙ্গণের একপাশে বিশাল এক মঞ্চ। মঞ্চে গলার রগ ফুলিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন সরদার বাড়ির বড় ছেলে আকবর সরদার। ‘আপনেরা জানেন তো, আজ শোকের দিন। এই দিন হামার বাপ বাবর সরদারকে খুন করেছিল এই গাঁয়েরই একদল কুলাঙ্গার। যে বাপ তোমাকরক খাঁ বাড়ির অত্যাচ্যার থাক্যা মুক্তি আন্যা দিছল, সেই মানুষটাক তোমরা মার‌্যা ফেলা দিছিন। এতই নিমকহারাম তোমরা! যাইহোক, হামরা তারপরও দমিনি। হাল ছাড়িনি। এলাকার ক্ষমতা তাই এখনো হামাকেরে হাতে। হামরা ক্ষমতায় থাকাতে কী তোমাকেরে ক্ষতি হছে?

সমস্বরে চিৎকার করে সমবেত জনতা উত্তর দেয়, ‘নাআআআ’।

আকবর সরদার আবার বলতে শুরু করেন, ‘হামরা ক্ষমতায় আসার পর কাউয়াতলার কত উন্নয়ন হছে, দিখিছিন তোমরা? কাউয়াতলা এখন মধ্যম আয়ের গাঁও। আর বিশ বছরের মধ্যে এডা উন্নত আয়ের গাঁওয়ে পরিণত হবে। তখন কাঙালি ভোজ খিলানোর মতো একডাও মানুষ পাওয়া যাবে না, হামি হলপ কর‌্যা কচ্ছি আজ। হামার কতা যদি সত্যি না হয়, তোমরা হামার কান কাট্যা কুত্তাক খিলাইও সেদিন।’

গরম গরম বক্তৃতা শুনতে শুনতে যোহরের আজান পড়ে যায়। মাইক বন্ধ হয়। নামাজ শেষ হলে বিরিয়ানির প্যাকেট বিতরণ শুরু হয়ে যায়। লাইন ধরে মানুষরা দাঁড়িয়ে যায়। বিল্লাল বলে, ‘দাদা তুই এই ভীড়ের মদ্দে খাড়াবার পারবু না। মান্ষের ঠ্যালাঠেলিত্ পড়্যা তুই মরাই যাবু। এই কোণাত্ বস্যা থাক। হামি লাইনত্ খাড়া হচ্চি।’

বিল্লাল লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা প্যাকেট সংগ্রহ করে দাদার কাছে রেখে আবার অন্য লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। এভাবে সেচ্ছাসেবীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে পাঁচ ছয় প্যাকেট বিরিয়ানি সংগ্রহ করে। তারপর দাদার কাছে গিয়ে বলে, ‘খা বুড়া খা। কত খাবু খা।’

প্যাকেটগুলো বাড়িতে এনে প্রাণভরে খায় বুড়ো মোতালেব। তারপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কতদিন দুপুরবেলা সে ঘুমায় না। ভিক্ষে করতে করতে দিন পার হয়ে যায় তার। আজ ভিক্ষেতে যাওয়ার তাড়া নেই। তাই চিন্তাহীন ঘুম ঘুমায় বুড়ো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা উৎরে রাত ঘনায়, তবু ঘুম ভাঙে না বৃদ্ধের। যখন ঘুম ভাঙে তখন মধ্যরাত। পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে বুড়ো মোতালেবের। সে পড়িমরি মরে বিছানা ছেড়ে পায়খানায় ছোটে।

ভোর হতে হতে সে তেইশবার পায়খানায় যায়। বমি করে এগারোবার। তারপর আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায় না। বিছানাতেই কর্ম সারে। উপায়ন্তর না পেয়ে পাশের বাড়ির ভ্যানচালক কুদ্দুসকে ডাকতে যায় বিল্লাল।‘দাদা ক্যাম্বা ক্যাংকা করিচ্চে। অ্যানা হাসপাতালত্ লিয়া যাবিন?’

কুদ্দুস ভ্যান নিয়ে বের হয়ে এসে বুড়ো মেতালেবকে ধরাধরি করে ভ্যানে তুলে উপজেলা হাসপাতালের দিকে ছোটে। বুড়োর মাথা বিল্লালের কোলের ওপর। রাতের আঁধার কেটে একটু একটু আলো ফুঁটছে আকাশে।

হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশ ফর্সা হয়ে যায়। ভোরের পবিত্র আলো এসে খেলা করে বুড়ো মোতালেবের চোখে মুখে। মোতালেব ছানিপড়া চোখ মেলে স্থির হয়ে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। চোখের পলক পড়ে না।

‘দাদা! ও দাদা!’ ডাক পাড়ে বিল্লাল। ‘কথা ক দাদা! ইংকা কর‌্যা চায়্যা আছু ক্যা! দাদারে…।’ ব্যাকুল হয়ে ডাকতে থাকে বিল্লাল।
বুড়ো কোনো সাড়া দেয় না।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.