:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নিবেদিতা আইচ

গল্পকার

কাঁচফুল
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

কাঁচফুল

এক.
মল্লিকাকে আমি আগের মতো ভালোবাসি না। প্রথম প্রেমের সেই আমেজটা আর নেই। আমাদের মিলন চূড়ান্ত সুখের হলেও বুকের চোরাকুঠুরিতে আমার একটা অতৃপ্তি থেকে গেছে বরাবরই। এতে অবশ্য ওকে দোষ দেয়া যায় না। এমন না যে ওর কোনো খুঁত আছে বা ছিল। তীব্র প্রেমের মুহুর্তে ওর চেষ্টার খামতি ছিল না কখনো। আজও নেই।

মল্লিকা যখন তীব্র আশ্লেষে ওর মুখটা আমার ঘাড়ে গুঁজে দেয় আমি তখন আর দশটা পুরুষলোকের মতো ওর শরীরের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দেখি না। স্নানের পর ওর মরালীর মতো গ্রীবায় শিশিরবিন্দু ছুঁয়ে দিতে নাটক সিনেমার নায়কের মতো কখনো হামলে পড়ি না আমি। এই নিয়ে ওর আক্ষেপ থাকতে পারে। কিন্তু মল্লিকাকে আমি ভালোবাসি হিসেব করে, সময় বুঝে, যেমন সঙ্গমের আগে। রাগমোচনের পর আমার পক্ষে ওকে সহ্য করা কঠিন হয়। এ কারণে কেউ আমাকে চরিত্রহীন, মানসিক বিকারগ্রস্ত ইত্যাদি ভাবতে পারে। তা চরিত্রের দোষ আমার কিছু আছে বৈকি। কিন্তু মানসিক বিকারের ব্যাপারটা আমার কাছেও অস্পষ্ট। হয়তো গল্পের শেষটায় আমার, এমনকি পাঠকেরও এই নিয়ে দ্বিধাটা কেটে যেতে পারে।

সেসব আদ্যোপান্ত বলতে বসার আগে মল্লিকাকে পাঠকের কল্পনায় এঁকে নেয়া উচিত বলে মনে করি। আপাতদৃষ্টিতে রাশভারী বলে মনে হলেও মল্লিকা ভেতরে ভেতরে চঞ্চল, বন্য। সেটা জানতে অবশ্য অল্প কিছু সময় লেগেছে আমার।

আমাদের পরিচয়ের শুরুর দিকের দিনগুলি থেকেই ওকে আমি বেশ সমীহ করে চলেছি। আঁটোসাটো করে বাঁধা লম্বা বেনী, কাঁধ ঢেকে রাখা শাড়ির আঁচল আর মাপা হাসির মেয়েটা আমাকে মুগ্ধ করেছে প্রথম থেকে। কাজের স্বার্থে আমাদের দীর্ঘক্ষণ আলাপ হতো, একসাথে বসতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। এমন ব্যস্ত আর কর্মময় দুপুরগুলোতে আমার অফিসঘরের টেবিলে কতদিন একসাথে খেয়ে নিয়েছি দু’জন। মল্লিকার হটপট থেকে মাঝেমাঝে কিছু অমৃত বের হতো। প্রশংসা পেয়ে চিরাচরিত বাঙ্গালি মেয়ের মতো এক আধবার জোর করে পাতে তুলে দিতো সেই প্রসাদ।

আমার চোখের তারায় হয়তো ঝিকিয়ে উঠতো কিছু জোনাক পোকা। এমন মুহূর্তগুলোতে খুব কায়দা করে আমাদের মাঝের লক্ষণরেখাটা মনে করিয়ে দিত সে। মল্লিকা খুব বুদ্ধিমতী। ওর ব্যবহারে অভদ্রতা কিংবা রূঢ়তার লেশ থাকতো না। আমিও অপমানিত বোধ করতাম না, এমনকি আহত হবার মতো যুক্তিসঙ্গত কারণও খুঁজে পেতাম না। কিন্তু আহত হতাম ঠিকই। কারণ এড্রেনালিন রাশ আমাকে ততদিনে আপাদমস্তক কবজা করে নিয়েছে। রিমলেস চশমার কাঁচের ভেতর ওর চোখ দুটো আমাকে বিবশ করে রাখতো সারা দিন। তখনো কিন্তু আমাদের পুরোপুরি পরিচয় হয়নি। আধেক চেনার ফাঁকটুকু পূর্ব পরিচয়ের অনুমান দিয়ে আমি পূরণ করে নিয়েছিলাম।

মল্লিকা যখন তীব্র আশ্লেষে ওর মুখটা আমার ঘাড়ে গুঁজে দেয় আমি তখন আর দশটা পুরুষলোকের মতো ওর শরীরের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দেখি না। স্নানের পর ওর মরালীর মতো গ্রীবায় শিশিরবিন্দু ছুঁয়ে দিতে নাটক সিনেমার নায়কের মতো কখনো হামলে পড়ি না আমি। এই নিয়ে ওর আক্ষেপ থাকতে পারে। কিন্তু মল্লিকাকে আমি ভালোবাসি হিসেব করে, সময় বুঝে, যেমন সঙ্গমের আগে। রাগমোচনের পর আমার পক্ষে ওকে সহ্য করা কঠিন হয়।

সত্যি বলতে অফিসে নতুন মুখ ‘কস্তুরী দস্তিদার’ নামটা শোনার পর থেকে ওকে জানার আগ্রহটা সময়ের সাথে সমানুপাতিক হারে বেড়ে যাচ্ছিলো। একজোড়া কৌতূহলী চোখ আর কান অবচেতনে অপেক্ষা করতো ওর জন্য। সে গল্পটা অন্য। মল্লিকা সেটা জানেনি কখনো, জানতে দেইনি আমি। শুধু গল্পটা ওর মুখেই শুনতে চাই বলে অপেক্ষা করে আছি গত একটা বছর ধরে। এক বছর? নাকি একযুগ, অসীম? নিজেকে প্রশ্ন করেই বিব্রত হই। নিজের কাছে তো সত্য গোপন করা চলে না।

সবাই যাকে কস্তুরী বলে চেনে তাকে আমি মল্লিকা বলে ডাকি। আমার মুখে ‘মল্লিকা’ নামটা শুনলে প্রতিবারই নাকি ওর বুকে রক্ত ছলকে ওঠে। কেন মল্লিকা? ওকে পাঁজাকোলা করে বুকে নিতে নিতে কিংবা ঈষৎ বাদামী রঙের চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে অসংখ্যবার এই প্রশ্নটা করেছি আমি।

শুধু আবেগের কথা নয় ওটা। আমি বিশ্বাস করি, মল্লিকা সত্যি বলছে। এই নামটার মাঝে একটা কিছু জাদু আছে। কিংবা ওর বুকের কুঠুরিতেও থাকতে পারে স্মৃতি নামের কোনো গোপন মণিমুক্তো!

দুই.
আমাদের নামহীন সম্পর্কের এগারো মাসের মাথায় একদিন হুট করে মল্লিকা নিজেই লক্ষণরেখা অতিক্রম করে ফেললো। আমি হাত বাড়িয়েই রেখেছিলাম। কিন্তু সেই আহবানে ছলনা ছিল না। মল্লিকা এসে ছুঁয়ে দিলো আমাকে। অপেক্ষার অবসান হলেও আমার ভেতরের কাঁচফুলটা চুরচুর করে ভেঙ্গে পড়লো সেদিনই।

ওর বাঁ কানের পেছনে ছোট্ট তিলটা সাক্ষ্য দিয়েছিল আমায়। শরীরের আনাচে কানাচে ওর প্রিয় সুগন্ধী ‘অ্যামোর’ আমায় বলে যাচ্ছিল এই সেই মল্লিকা! আর আমি ওকে বুকের ভেতর পিষে ফেলতে ফেলতে আমার ভেতর বাজতে থাকা বিষণ্ণ সরোদটাকে সামলে নিচ্ছিলাম।

ওর ক্লান্ত ঘুমন্ত মুখটাকে সেদিন আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। এই সেই মল্লিকা, কস্তুরী মল্লিকা, একটা সময় দিনরাত যার চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম আমি। অফিসের ফাইলে ওর মুক্তো দানার মতো হাতের লেখা দেখেও আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। ভাবিনি প্রায় একযুগ পর পত্রমিতালীর সেই মানুষটাকে এভাবে ফিরে পাবো। জীবন কখনো কখনো নাটক সিনেমাকেও হার মানায়, নির্মম কাকতাল ঘটায় খেয়ালের বশে। আমরা অবিশ্বাসীর মতো তাকে যতই এড়াতে চাই সে মুচকি হেসে নতুন কিছুর আয়োজন করে।

আজকাল প্রায় প্রতিটা ছুটির দিন একসাথে কাটে আমাদের। সারাদিন আমার একাবোকা সংসারে ঘরকন্না খেলে সূর্য ডোবার আগে ও লক্ষীমেয়ের মতো বাড়ি ফেরে। রাতে নিজের বিছানা ছাড়া ওর নাকি ঘুম হয় না। আমার বিছানা বালিশে নিজের সুঘ্রাণ ফেলে রেখে যায় মল্লিকা। ও জানে না সেই সুঘ্রাণ আমাকেও ঘুমোতে দেয় না। তাকে অনুভব করতে করতে আমি ছায়ার সাথে মিলিত হই, যেমন হতাম প্রায় একযুগ আগে। তখন এই ঘ্রাণ ছিল না, ছিল চৌকো খামে ভরা শুকনো ফুলের পাঁপড়ি আর গোটা গোটা হরফে লেখা কারো প্রতিদিনের টুকরো টুকরো কথা। এই ছায়াসঙ্গম আমার আর মল্লিকার মাঝে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে রেখেছে। শুধু আমি একে জানি।

আমার এখান থেকে বাড়ি ফিরেই মল্লিকা ডুব দেয়। রাতে আমিই অভ্যাসবশত ওকে ফোন করি, সহজে সাড়া পাই না। ওই সময়টায় অসুস্থ বরের যত্ন আত্তিতে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে। কোথাও একটা অপরাধবোধ আছে ওর মধ্যে। মল্লিকা স্বীকার করে না কিন্তু আমি ঠিক টের পাই।

আমাদের নামহীন সম্পর্কের এগারো মাসের মাথায় একদিন হুট করে মল্লিকা নিজেই লক্ষণরেখা অতিক্রম করে ফেললো। আমি হাত বাড়িয়েই রেখেছিলাম। কিন্তু সেই আহবানে ছলনা ছিল না। মল্লিকা এসে ছুঁয়ে দিলো আমাকে। অপেক্ষার অবসান হলেও আমার ভেতরের কাঁচফুলটা চুরচুর করে ভেঙ্গে পড়লো সেদিনই।

বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে ভদ্রলোকের কোমরে পিঠে ক্ষত হয়ে গেছে। তাকে দেখাশোনার জন্য মল্লিকা নার্স রেখেছে। সন্ধ্যায় ও বাড়ি ফিরলেই নার্সের ছুটি হয়ে যায়। এরপর ঘুমোতে যাওয়া অব্দি পতিব্রতা মল্লিকা নিজ হাতে বরের শুশ্রূষা করে। কাপড় বদলে দিয়ে ক্ষত স্থানে মলম লাগায়। চুল আঁচড়ে গায়ে হাতে পায়ে লোশন মাখিয়ে দেয়। তারপর মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।

শুনেছি ভদ্রলোক বেশ অভিমানী। মল্লিকাকে অনেক আগেই মুক্ত হতে বলেছেন তিনি। কারো অনুগ্রহ নিয়ে তিনি নাকি বাঁচতে চান না। মল্লিকা স্বাধীন, ঘরের বাইরে ওর পদচারণায় কোনোরকম নিষেধ কিংবা নজরদারি নেই। এই ছাড়টুকু দিয়ে মল্লিকার বর ওর চোখে অনেক উঁচু মনের মানুষ হয়ে গেছেন।

রাতে এক বিছানায় ঘুমোয় না ওরা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যে সহজাত সম্পর্ক সেটা ওদের মধ্যে নেই। এসব মল্লিকাই আমাকে বলেছে কিন্তু এর কারণটা কখনো বলেনি। আমিও আগ বাড়িয়ে ওকে প্রশ্ন করিনি। কিন্তু আমি জানি লোকটার অসুস্থতা নয় এর চেয়ে ঘোরতর কোনো এক কারণ ছিল, আছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো মল্লিকা নিজেই সবটুকু জানতো না। হয়তো আজও জানে না!

তিন.
‘অসীম,

আমার বর শয্যাশায়ী। গত সপ্তায় ছাদ থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়ে লোকটা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। হয়তো কখনো উঠে দাঁড়াতেও পারবে না। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

আমাকে মুক্তি দিয়েছে লোকটা। আমি বড্ড স্বার্থপর, শুধু প্রেম প্রেম করে এতদিন হন্যে হয়ে বেড়িয়েছি। কখনো ওর দিকে মন দিইনি। বুঝিনি এই নিরীহ, মুখচোরা লোকটাকে একবার ডাকার মতো ডাকতে পারলে হয়তো উপচে পড়া সুখে ভেসে যেতে পারতাম আমি। কিন্তু সে ভাগ্য করে আসিনি যে! পাপের ফল পেলাম এবার। আর এটা আমায় তাড়া করবে আজীবন।

কিন্তু অসীম, তুমি অন্তত আমাকে ক্ষমা কোরো। ভুলে যেও এই মল্লিকাকে, আমি কাউকে সুখী করতে পারার মেয়ে নই।

ইতি
কস্তুরী ’

বারো বছর আগের সেই দুর্ঘটনার পর মল্লিকা ওর পত্রমিতাকে এই শেষ চিঠিটা লিখেছিল। পড়ে পড়ে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে কবেই! কিন্তু উত্তর দেয়া হয় নি। কেন সেটা বলছি একটু পর।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমি এখনো নিয়ম করে লিখতে বসি। কিন্তু মল্লিকাকে লেখা চিঠিগুলো এখন আর ওর ঠিকানায় পৌঁছে না। শুধু আমার ডায়েরিতে ওদের ঠাঁই। মল্লিকা বাসায় এলে আমি তক্কে তক্কে থাকি। কারণ ঘরের সবকিছুতে আজকাল ওর ছোঁয়া লাগছে। শোবার ঘরের দেরাজ থেকে রান্নাঘরের মসলার বয়াম পর্যন্ত ওর নজরদারি। আমি ইতস্ততবোধ করি মাঝে মাঝে।

এত গোছানো আমার পোষায় না গো..

চঞ্চল চোখের তারা দু’টো দপ করে নিভে যায়। আনমনে গুনগুনটাও থেমে যায়। মল্লিকা চুপচাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ের মগ নিয়ে পাশে এসে বসে। ভয়ে ভয়ে কথা চালিয়ে যাই আমি।

অমনি রাগ হলো?

হুম!

চিরকাল এভাবে গুছিয়ে দেবে? স্বভাবটা বিগড়ে দিচ্ছো না?

চাপাহাসির অর্থটা বুঝতে পারি পরদিন। অফিসের টেবিলে এটা ওটা খুঁজে না পেলে কেউ এগিয়ে দেয় না। এভাবে শোধ নেয় মল্লিকা। হাল ছেড়ে দিই আমি। ওকে ছাড়া আমার চলেনি, চলবে না।

মল্লিকা সুখী নয়, বিয়ের পর থেকে অভিনয় করে চলছে সে। ওকে তাই মুক্ত করে দিয়ে যাচ্ছি আজ! ওর নিটোল মুখটা ভাবতে ভাবতে আমার শরীর ভেজা হাওয়ায় তুলোর মতো ভাসতে থাকে। ভেসে যেতে যেতে ওর ডাকটা শুনতে পাই। অ-সী-ম…

আজ খুব সকাল সকাল এসেছে সে। কাল রাতে ফোনে একবার বলেছিলাম শরীরটা ভালো নেই, জ্বর জ্বর ভাব। অমনি ভোরবেলা হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘরে ঢুকেছে। একবাটি গরম গরম স্যুপ খাইয়ে গলা অব্দি কাঁথা টেনে দিয়ে গেছে। এখন রান্নাঘরে ব্যস্ত। টুংটাং শব্দটা বড় মিষ্টি লাগছে। আমি গলা বাড়িয়ে ওর শাড়ির আঁচলটা দেখতে পাই শুধু। শরীর জুড়ে রিমঝিম বৃষ্টি নামে। চোখ দু’টো মেলে রাখতে কষ্ট হয়। মাথার দু’পাশে টনটন করে ওঠে। তেড়েফুঁড়ে জ্বর আসছে। বহুদিন এমন অসুখ করে নি।

আধো ঘুম আর জ্বরের ঘোরে সব তালগোল লেগে যায় আমার। চোখ বুঁজতেই বোগেনভেলিয়া আর মধুমঞ্জরীর ঝাড়টা ভেসে ওঠে। বোধ হয় একটু আগে এখানে ঝুম বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভোরটা ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় কেমন কাঁপুনি দিচ্ছে!

সামনে একটা ভাঙ্গা রেলিং। হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে এগোতে থাকি আমি। আরো এগোই.. আরো দু’পা। তারপর পা ফসকে যায়। পড়ে যেতে যেতে চিঠিটার কথা ভাবি আমি, যেটা মল্লিকার ড্রয়ারের ভেতর পেয়েছি।

মল্লিকা সুখী নয়, বিয়ের পর থেকে অভিনয় করে চলছে সে। ওকে তাই মুক্ত করে দিয়ে যাচ্ছি আজ! ওর নিটোল মুখটা ভাবতে ভাবতে আমার শরীর ভেজা হাওয়ায় তুলোর মতো ভাসতে থাকে। ভেসে যেতে যেতে ওর ডাকটা শুনতে পাই। অ-সী-ম…

গা পুড়ে যাচ্ছে তোমার! মাথা ধুয়ে কাপড়টা বদলে দিই চলো…

মল্লিকা কপালে হাত রাখতেই চমকে জেগে উঠি আমি। উহঃ! কী দুঃস্বপ্ন! আজকাল এই স্বপ্নটা প্রায়ই দেখি।

মল্লিকার বরকে আমি কখনো সামনাসামনি দেখি নি। তাই কি এমন বুক ভার করা স্বপ্নে নিজেকেই দেখি প্রতিবার? কোথাও একটা অপরাধবোধ কি তাহলে আমার মধ্যেও আছে? এসব ভাবতে গেলে মাথার ব্যথাটা জেঁকে বসে আরো। বড় ক্লান্ত লাগে আমার।

মল্লিকার ডাকে উঠে বসি আমি। অভ্যস্ত হাতে একে একে আমার গায়ের কাপড় খুলে নেয় মল্লিকা। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আজ রাতে কি ও থেকে যাবে? নাকি নিজের ঘরে স্বস্তির ঘুমটাকে আজও চুরি হতে দেবে না।

মাথা মুছে দিয়ে গায়ে গেঞ্জিটা পরিয়ে দিতেই ‘অ্যামোর’ এর সুঘ্রাণটা নাকে এলো। আমি মল্লিকার গালে চুমু খেলাম।

আহ! শান্ত হয়ে বোসো তো!

ওর হাতটা ধরে কাছে টানলাম আমি। ভেতরটায় ঝড় শুরু হয়ে গেছে তখন। মল্লিকা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে, সেই সাথে চোখেমুখে প্রশ্ন। কাজের সময় ছেলেমানুষী একদম পছন্দ নয় ওর।

আজ রাতে থেকে যাও, প্লিজ!

আচ্ছা, সে অনেক দেরি..সবে তো এলাম!

না, আজ তুমি থাকবে..

আজ কিন্তু ওসব হবে না.. তোমার শরীর ভালো নেই।

শুধু একটু ওম নিয়ে নিও.. এই দেখো, পুড়ে যাচ্ছি আমি।

অবুঝের মতো কথা বোলো না, অরু।

হাত ছাড়িয়ে নিল মল্লিকা। ওর চোখেমুখে প্রত্যাখ্যান স্পষ্ট। জেদ চেপে গেল আমার, মাথায় রক্ত চড়ে গেল।

অরু! এই অরুণাভকে আজ থেকে কিন্তু অসীম বলে ডাকতে পারো!

কথাটা বলে ফেলেই বুঝতে পারলাম কী অনর্থ ঘটিয়ে ফেলেছি। মল্লিকা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।

অ-সী-ম!

ওর ফ্যাকাসে মুখটা দেখে একটা কুৎসিত রকমের আনন্দ হলো আমার। ভেতর থেকে কেউ যেন পিঠ চাপড়ে দিল। আর কত চলবে এই অভিনয়! পত্রমিতালীর শুরুতেই কেন বলেনি ওর বরের কথা? কেন ওভাবে চিঠি লিখতো? কেন প্রশ্রয় দিয়েছিল আমাকে? রাতদিন ওর লেখা শব্দগুলো ছুঁয়ে দেখতে বাধ্য হতাম আমি। ও কি জানে শুধু ওটুকুতেই সঙ্গমসুখ হতো আমার?

জীবন যখন আমাদের দ্বিতীয়বার কাছাকাছি এনে দিল মল্লিকা তখনও চিনতে পারেনি আমাকে। ওর মুখ থেকেই আমার গল্পটা শুনবো বলে অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে গিয়েছি আমি।

আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যাক। নিজেকে দেখতে না পেলেও আমি জানি এখন আমার চোখেমুখে অপার্থিব এক হাসি খেলা করছে। এসবের কিছুই হয়তো মল্লিকার চোখে পড়ছে না। শুধু একটু একটু করে এগিয়ে আসছে অন্য এক মল্লিকা, রাজ্যের প্রশ্ন আর হতাশা নিয়ে সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

সত্যি? তুমি এতদিন এভাবে আমাকে বোকা বানালে!

মল্লিকা, তুমি সত্যিই বোকা! রোজ কার কাছে ফেরো? জানো? লোকটা সুইসাইড করতে গিয়েছিল, সেখানেও ফেল মেরেছে! আর তুমি ভেবেছো পা ফসকে…

আমার হাসি ফুরোবার আগেই মল্লিকা বের হয়ে গেল ঘর থেকে। চলে যাচ্ছে মল্লিকা। আরেকবার চলে যাচ্ছে সে। বুকে করে একটা ভীষণ ঝড় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ও বাড়িতেও আজ একটা হেস্তনেস্ত হবে।

আজ রাতে দরজা খোলা থাকবে, মল্লিকা চলে এসো তুমি…

ভাঙ্গা গলায় চেঁচাতে গিয়ে বড্ড কর্কশ শোনাচ্ছে কথাগুলো। জ্বরটা বাড়ছে। শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম আবার।

একা ঘরে শুয়ে শুয়ে এক যুগ আগের সেই দিনটাতে ফিরে যাই তারপর। মল্লিকার শেষ চিঠিটা হাতে পাবার আগে সেদিন আরেকটা চিঠি এসেছিল আমার ঠিকানায়। মল্লিকার বর সেই চিঠিতে আমায় বলেছিলেন আমরা যেন সংসারে আবদ্ধ হই। ভদ্রলোক প্রস্থানের আগে আমাদের অনুমতি দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মল্লিকা আসে নি, বারো বছর আগে সেদিন ও হারিয়ে গিয়েছিল। আজ আরেকবার ওকে হারালাম। হয়তো আমাদের সম্পর্কটা এমনই রয়ে যাবে, একটা কাঁচফুলের মতো, ঘ্রাণ নেই তবুও অনাঘ্রাত।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.