:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
জ্যোতির্ময় বিশ্বাস

কবি, গদ্যকার

আরেকটি ভ্রমণকাহিনী
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

আরেকটি ভ্রমণকাহিনী

১.
ও আমার বন্ধু। আজ আমরা ওর কাছে একটা গল্প শুনবো। ওদের বাড়িতে একটা পাথর ছিল। বড়োসড়ো, দশ-বারো কেজি মতো ওজন ছিল। শ্যামবর্ণ। যেরকম পাথর দিয়ে, দেখেছেন নিশ্চয়, নদীতে জালি-বাঁধ দেওয়া হয়, সেইরকম। বাগানের ছায়ায় নিটোল পড়ে থাকা ছাড়া যার কোনও কাজ ছিল না। ও কখনও দাদু বা বাড়ির কাউকে পাথরটা দিয়ে কোনও কাজ করতে দেখেনি। হ্যাঁ, একদিন সে পাথর কাজে লেগেছিল বটে! সেই দিনটার কথা ও কোনও দিন ভুলবে না। আর সেই কাহিনীই আজ ওর মুখে শোনা যাবে। তবে তার আগে বলি, এটা ভ্রমণকাহিনী কি না বুঝতে পারছি না। কারণ বর্তমান আখ্যানটিতে কোনও বর্ষাকালীন ছুটি-প্ল্যানিং, দু’দিনের নোটিশে টিকেট কাটা, হোটেল-বুকিং, তাড়াহুড়ো করে ট্রেইনে চাপা যেমন নেই, তেমনই গন্তব্যে পৌঁছনো মাত্র বাহারি একটা বিপত্তি, যেমন ধরা যাক, ভয়াবহ বর্ষণে কার্শিয়াংয়ে লোডশেডিং, তবু যারা বৃষ্টিবিলাসী, চোখেমুখে বৃষ্টির ঝাপটা মেখে তারা হোটেলের জানলাটা খুলে রাখবে এবং দূরে, বহু-পরত নীচে সুকনা আর্মি ক্যাম্পের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে চাইবে, একটা উদোম ভেজা সেনানিবাসের বাতিগুলি থেকে লাল ও কমলা আলোর পাখিরা যেন হাওয়ার ডানায় ভর করে উড়তে উড়তে কার্শিয়াংয়ের দিকে চলে আসছে। উহু, এই বিবরণে তেমন আমেজটি নেই। নেই বিরাট জামবাটি ভরতি ছোট ছোট গোল-আলু দিয়ে মুরগির মাংস আর গরম তন্দুরি খেতে খেতে আড্ডাও। আছে কী, না একটা পাথর। তা-ও কোনও পুরোনো বনেদি বাড়ির কোনও গোপন কুঠুরিতে দামি কিছু নীলা-গোমেদ বা ওইসব রত্নপাথর নয়। পাতি একটা বোল্ডার।  চলুন, ঘটনাটা শুনে নিই। ওর বয়ানেই শুনি―

যে সময়ের কথা বলছি তখন এই পাড়ায় ঝোপজঙ্গল ছিল অনেক বেশি। আমার ধারণা, এখন তার অর্ধেক পরিমাণ গাছপালাও অবশিষ্ট নেই। মানুষ এখন গাছই লাগায় না। তখনও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। দিনের বেলাতেই ছায়াছায়া অন্ধকার হয়ে থাকতো পাড়ার অলিগলি। আমাদের বাড়িটাও এখন যেমন দেখছেন, তখন কিন্তু এমন ছিল না। কত গাছগাছালি ছিল তখন! একটা পেল্লায় লিচুগাছ ছিল। আমাদের তো জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস লিচুগাছে চড়েই কাটতো। ইস্কুল ছুটির দিনগুলোতে বলতে গেলে খালি রাতে ঘুমানোর সময় গাছ থেকে নামতাম। প্রকৃতির ছোট ডাকটাও গাছে বসেই সারা যেত। বাঁশবাগান ছিল বাড়ির দক্ষিণে। তার কাছাকাছি একটা বেল গাছ। একফালি জমির ওপর লেবুর ভারে মাটিতে লুটিয়ে থাকা গন্ধরাজ লেবুগাছে সারাদিন মৌমাছি ঘুরঘুর করতো। একটা সেগুন গাছের কথাও মনে পড়ছে। সে-ও কি ছিল? ছিল বুঝি। এইসব নিয়ে, গাছগাছালি, গোরুবাছুর, ধানচাল নিয়ে আমরা থাকতাম। বাবা-মা, দুই কাকা, আমরা তিন ভাই, আর আমাদের ঠাকুরদা-ঠাকুমা। ঠাকুরদাকে দাদু বলতাম। দাদু তখন সত্তরের কোঠায়। প্রথম স্ট্রোক’টা সারভাইভ করে কোনও-ক্রমে বেঁচে বাড়ি ফিরেছেন। সর্বক্ষণ বিছানায় শোয়া। আমার মা ছাড়া কাউকে চিনতে পারেন না। আমি বা ভাই যদিও বা কখনও তাঁর বিছানার ধারেকাছে যেতাম, পরমুহুর্তে রুগ্ন মানুষটির মধ্যে দাদুকে খুঁজে না পেয়ে গুটগুটিয়ে সরে আসতাম। একমাস, দু’মাস, তিনমাস যায়—দাদু সেরে উঠছেন বোঝা যায়। বারান্দায় এসে বসছেন। স্মৃতিরা ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসছে একে একে। গায়ে ফিরছে বল। আমরা কাছে গিয়ে এখন আর আগের মতো ফিরে আসি না। বরং দাদুর হাত-পায়ের চামড়া যখন খসতে শুরু করল, আমি টেনে টেনে সেই মৃত চামড়া তুলে তুলে দিই। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করি। মাঝে মধ্যে আগের মতো গপ্পের রানিমা তারপর হাত-কাটা শয়তানকে কেন সাজা না দিয়ে ছেড়ে দিল সেই বিষয়ে ভাবগম্ভীর আলোচনাও করি। অমনই এক বিকেলে, ঘরে কেউ নেই, আমরা দু’জন বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ ‘আছেএএএ লোয়া-বাঙ্গা টিন-বাঙ্গা কাইচের বোতোল-বাঙ্গা…’ হাঁক শোনা যায়। চেনা হাঁক। কাঁধে ভাঙাড়ি বোঝাই বাঁক নিয়ে একজন ভাঙাড়িওয়ালা বাড়ির ভিতর ঢুকছেন। লোকটা রোগাপাতলা, কত বয়েস হবে আন্দাজ করতে পারিনি। ময়লা মার্কিন কাপড় কোমরে প্যাচানো, পাতলা হলদে ফতুয়া গায়ে। পুরোনো বইখাতা, লোহার অকেজো যন্ত্রপাতি, ভাঙা শিশি-বোতল নিয়ে পয়সা দেন। পয়সার বদলে আমরা চানাচুরও নিতাম। এই লোকটিকে নতুন দেখছি। দাদু বেড়া’য় পিঠ দিয়ে ঝিমোচ্ছিলেন, আওয়াজ পেয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। বসতে ইশারা করে বললেন, বসো বসন্ত।

আছেন কেমুন অ্যাহন? কাঁধ থেকে ভারি বাঁকটা উঠোনে নামিয়ে বারান্দায় মাটির ’পরে বসতে বসতে বসন্ত ভাঙাড়িওয়ালা দাদুকে জিজ্ঞেস করলেন।

যেরকম রাখছে মালিক। দাদুর স্বভাবসিদ্ধ জবাব।

এইভাবে এক-কথায় দু’কথায় তাঁদের গল্প এগোয়। কথা বিনিময় শুনে মনে হল পরস্পর চেনা। আমি উঠে গেছি, উঠে এদিক ওদিক কি জানি কী করছি হঠাৎ বারান্দার দিক থেকে দাদুর উত্তেজিত গলার আওয়াজ পেয়ে, কী হল! দৌড়ে গিয়ে দেখি দাদু ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়িয়েছে! বারান্দা থেকে নেমে, টলছে অথচ দৃপ্ত পদক্ষেপে লম্বা পা ফেলে বড়ো ঘরের পাশ দিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেলেন। যেদিকটায় জঙ্গল। কিছুই বুঝতে পারছি না কী হয়েছে! দাদু কি এই লোকটির কোনও কথায় রেগে গেছেন? লোকটিও উঠে দাঁড়িয়েছেন। আরে দ্যাহো দেহি, আমি খালি কইছি আপ্নের বয়সে গিয়া আমি– কোনও তুশ্চু হালকা বস্তু চোখের নিমেষে এক হাতে তুলে ফেলার ভঙ্গি করে তিনি বলেন– আধামণ পাথর এইভাবে কান্ধে তুইলা পাঁচ মাইল দৌড়াইয়া আসতে পারুম! এইতেই খেপছে!

বসন্ত, মানুষ যে এত ভুখা এত নাঙ্গা এত অসৎ এত সৎ এত অসহায় এত সাহসী এত মানবিক এবং এতটাই অমানবিক হইতে পারে, ওই পনেরো দিনের যাত্রাপথে আমি জীবনের মতন বুইঝা গেছিলাম। নিয়া আসার মতন কিছুই ছিল না আমার ভাণ্ডারে। যা ছিল তা আনতে পারিনাই। জমি, পুকুর, নারিকেল গাছ, সুপারি গাছ, বেল গাছ, এইসব তো আর লোহার ট্রাংকে ভরা যায় না বসন্ত।

আরও কিছু বলছিলেন, তার আগেই দেখি দু’হাতের থাবায় ভারি একটা পাথর পাকড়ে ধরে ঘরের পেছন থেকে এদিকে আসছেন। শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এসে লোকটিকে বলছেন, হাত পাতো বসন্ত, দেখি, এইটার ওজন দশ-বারো কেজির বেশি হইবো না, পাতো পাতো হাত পাতো, কান্ধে তোলো, দৌড়াইতে হইব না, তুমি আধা-মাইল নতুন বউয়ের মতন আলগোছে পা ফেইলা হাইটা আসো!

আরে না কাকা না… লোকটি চূড়ান্ত অপ্রস্তুত হয়ে দাদুর হাত থেকে পাথরটা কেড়ে নিয়ে উঠোনে নামিয়ে রেখে দাদুকে ধরে বারান্দায় পাতা পাটিতে বসিয়ে দেন। পাশে পড়ে থাকা তালপাতার পাখাটা নিয়ে বাতাস করতে করতে বলেন, কাকা আমি তো আপনেরে কথাডা ওইভাবে বলিনাই কাকা। ঠান্ডা হয়া বসেন এইখানে।

আমি এইবার খানিকটা ভয়ই পেয়ে গেলাম। চিনি না জানি না, কী ব’লে অসুস্থ দাদুকে রাগিয়ে দিল, এদিকে বাড়িতেও কেউ নেই। মা-ঠাকুমা ভাইকে নিয়ে আশেপাশে কার বাড়িতে গেছে ঢেঁকিতে চাল কুটে গুড়ি করতে। বড়দা, কাকারা কে কোথায় জানি না। বাবা তাঁর কাজের জায়গায়। সকলেরই ফিরতে মোটামুটি দেরিই হবে।

কাকা যাও তো এক গেলাস জল নিয়া আসো, বাড়িতে আর কেউ নাই, না? এই কাকাটি যে আমি, তা বুঝতে পেরে জল আনতে পাশেই রান্নাঘরের দিকে যাব, দাদু আমায় ঈশারায় বোঝালেন জল লাগবে না। তারপর বারান্দায় উঠে একটু এগিয়ে বেড়ায় হেলান দিয়ে কয়েকবার জোরে জোরে বুকভরে বাতাস নিলেন। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বসে অতি ধীরে শান্ত কণ্ঠে যেভাবে আধোঘুমন্ত মানুষ কথা বলে সেইভাবে যে কথাগুলো বলেছিলেন, আমি সেইদিন সে কথার নিবিড়ে প্রবেশ করতে পারিনি। এখন পারি। এখন হয়ত কিছুটা পারি।

বসন্ত, একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে দাদু বলে যান, আমার বয়সে আইসা বিশ কেজি ওজন কাঁধে নিয়া তুমি যাতে সত্যই দৌড় দিতে পার, উপরওয়ালার কাছে এই প্রার্থনাই করি। তবে আমি কিন্তু যহন তোমার বয়সে ছিলাম তহন এই পাথরটা কাঁধে নিয়া একবার মাইলের পর মাইল সত্যই হাঁটছিলাম। গল্পটা শুনবা?

বসন্ত ভাঙাড়িওয়ালা কিছু বলেন না। খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। একজন অসুস্থ মানুষকে তার বয়সজনিত দুর্বলতার কথা বলে বেয়াদবি হয়ে গেছে। তিনি সম্ভবত লজ্জিত। দাদু তাঁর গল্প বলা শুরু করেছেন–

সারাটা ফাল্গুন মাস ঢাকায় মিটিং-মিছিল-কারফিউ-হরতাল। শুনলাম ইউনিভার্সিটি-হলঘর আর কলেজের ছাত্রেরা সকলেই রাস্তায়। শেখ সাহেবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার দফায় দফায় বৈঠক। কাজ হয় না। ফাল্গুনের ২৩ তারিখ শেখ সাহেব রেসকোর্সে আর তার দুইদিনের দিন পল্টনে মাওলানা সভা করলেন। সে কী বিরাট জমায়েত। আমি যাই নাই। আমার যাওনের যো ছিল না। সকলে বলে, শুনি। সাতদিন থিকা তোমার কাকির জ্বর, যায় আসে যায় আসে…। দাদু আমাকে দেখিয়ে বললেন, অর বাপে তহন প্যাটে। পাঁচ মাস। পাড়ার সকলে গেল, তাগো কাছে শুনি। তারাই খবর আনলো, বড় ধরনের সংগ্রামের ডাক দিছেন শেখ সাহেব। ‘তোমাদের যার যা আছে তা-ই নিয়া প্রস্তুত থাকো’। আশেপাশে দুই-চাইর বাড়ির মইধ্যে রেডিও ছিল না, মুখে মুখে মুখস্ত মন্ত্রের মতন বাতাসে ভাইসা বেড়ায় ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমরা তো তত জানতাম না। যা হওনের হইতো ঢাকায়। পচাত্তর মাইল পূবে ফরিদপুরের গাঁয়ে বইসা আমরা তো খুব বেশিকিছু জানতে পারতাম না। তা হইলেও, বাতাসের ভাও বুজতাম ঠিকই। পূব পাকিস্তানে চাউলের দাম যহন সেড় প্রতি দেড় টাকা, পশ্চিম পাকিস্তান তহন ওই একই চাউল ষাইট পয়সায় খায়– এইটা বুজতাম। এই হাতেই তো পোস্টার লাগাইছি ‘সোনার বাংলা শ্মশান ক্যান’।

টানা কথা বলে দাদু ক্লান্ত হন। কথায় বিরাম পড়ে। এদিকে দাদুর মুখে কত গল্প শুনেছি, কিন্তু এই গল্পটা আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। কথা হচ্ছিল দাদুর সঙ্গে ভাঙাড়িওয়ালার। বসন্তই ছিলেন শ্রোতা। বড়োদের কথাবার্তা না বুঝলেও শিশুরা যেমন কৌতূহল ভরে বড়োদের কথা শুনে যায়, আমি সেইভাবে বসে থাকি। আসলে এই গল্পের সবটা হুবহু সিনেমার মতো করে দাদুই আমায় পরে শুনিয়েছিলেন। ওইদিনের পর দাদু আরও নয় বছর মতো বেঁচে ছিলেন। একই বস্তু একাধিকবার খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে দাদুকে অতিষ্ঠ করে তোলা ছিল আমার প্রিয় একটি কাজ।

চৈত্র মাস, দাদু আবার বলতে শুরু করেন, বুজলা বসন্ত, সেইডা ছিল ডাকাতিয়া চৈত্র মাস। ১৩ তারিখ সকালে আমরা আগের রাত্রে ঢাকার গোলাগুলির খবর পাইলাম। শুনলাম এইবারের গন্ডগোল বড়ো ধরনের। মিলিটারিরা এক রাত্রের ভিতরে হাজার হাজার মানুষ মাইরা ফালাইছে। আমরা কিন্তু তহনও বুঝিনাই যে এ জিনিস সহজে থামবার না।

দাদু বলেন, আর তো কেউ ছিল না, তোমার কাকিরে নিয়া, সামান্য যা চাষের মাটি ছিল, তা-ই নাইড়াচাইড়া খাইতাম। ঘরে-বাইরে দুই জনেরই যুবক বয়স। কাছে-দূরের আত্মীয়স্বজন ছিল কয়েক ঘর। কিছু ফরিদপুরেই, তোমার কাকির বাপের বাড়ি ছিল পাবনায়। শ্বশুর-শাশুড়ি ছিলেন না, আমার একমাত্র সম্বন্ধি ধীরেনদা ৬৯-এই এইপাশে চইলা আসছিলেন। যাইহোক, দিনের আলো যত তাড়াতাড়ি ফুরায়, রাইতের আন্ধার যেন ততই ফাত্রা আঠার মতন লাইগা থাকে প্রতিটা বাড়ির চৌকাঠে। এইদিকে, গন্ডগোলটা হিন্দু-মুসলমান হইতে সময় লাগল না। এলাকায় বাহাত্তর ঘর হিন্দু। মুসলমান আরও বেশি। ও, এর কিছুদিন আগে চটের বস্তার দরদাম নিয়া একটা ঝামেলায় এই হিন্দুয়ানি-মুসলমানি টাইনা আইনা একদল মুসলমান যুবক-ছাওয়াল, তাগো মইধ্যে আমার বন্ধু মতন একজনও ছিল, বাণীবহ বাজারের পরেশ বসাকের গালামালের দোকানে আগুন দেয়, দোকান পুইড়া গেলে পরে দ্বিতীয় দফায় তারা পরেশ বসাকের দুই ঠোটের উপরে ব্লেড রাইখা লম্বালম্বি একটা পোঁচও মারছিল। যাইহোক, দাদু বলেন, পাথরের গল্পটা বলি। মানুষ তো দোষে-গুণে। তা না হইলে চৈত্রের শ্যাষ তারিখ বিকালে যহন উড়া খবর পাওয়া গেল গাঁয়ের মাইলখানিকের মইধ্যে মিলিটারি-বোঝাই গাড়ি আইসা থামছে, পলাইয়া তো মুসলমান বাগু চৌধুরীর বাড়িতেই উঠলাম। আর ভুয়া খবর রটাইয়া সারা পাড়ার সবকয়টা ঘর খালি করল যারা তারাও মুসলমানই ছিল। বাগু চৌধুরীর পাঁচিল ঘেরা দালান বাড়ির ভিতরে বাহাত্তর ঘর হিন্দু। খাস দরোয়ান রসুরে ডাইকা চৌধুরী বলছিলেন, আমার যা আছে অর্ধেক তরে দিমু, তুই এই মানুষগুলি বাঁচা রসু। লোহার গেট আগলাইয়া সারারাইত বন্দুক হাতে পাহারা দিছিল রসু মোল্লা। মিলিটারি আসছিল, পরের দিন সন্ধ্যায়। আর দুপুরের তেজ থাকতে থাকতে পয়লা বৈশাখ ১৩৭৮ সন, আমরা ভিটা ছাড়লাম। বাপ-ঠাকুরদা, মা-ঠাকুমার ভিটা। জনমের মতন ছাড়তাছি তা তো বুঝিনাই, গন্ডগোল মিটলে ফিরবো, কেউ কেউ এই আশাও তো করছিল। কেউ পারছে, কেউ পারেনাই। আমি চাইনাই। লাখ মানুষের ঢেউ, আশাহীন মানুষের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে একদিন দেখি পায়ের তলায় তিস্তার বালি। হলদিবাড়ি। ইন্ডিয়া।

মিলিটারি আসছিল, পরের দিন সন্ধ্যায়। আর দুপুরের তেজ থাকতে থাকতে পয়লা বৈশাখ ১৩৭৮ সন, আমরা ভিটা ছাড়লাম। বাপ-ঠাকুরদা, মা-ঠাকুমার ভিটা। জনমের মতন ছাড়তাছি তা তো বুঝিনাই, গন্ডগোল মিটলে ফিরবো, কেউ কেউ এই আশাও তো করছিল। কেউ পারছে, কেউ পারেনাই। আমি চাইনাই। লাখ মানুষের ঢেউ, আশাহীন মানুষের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে একদিন দেখি পায়ের তলায় তিস্তার বালি। হলদিবাড়ি। ইন্ডিয়া।

কথা বলতে বলতে দাদু লোকটির কাঁধে একটা হাত রাখলেন। চোখের পাতায় জল। লোকটি তাকিয়ে থাকেন। অবাক হয়ে দেখেন, তাঁর সামনে বসে একজন সত্তরোর্দ্ধ বৃদ্ধ কীভাবে তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে কথা বলে যাচ্ছেন। বসন্ত, মানুষ যে এত ভুখা এত নাঙ্গা এত অসৎ এত সৎ এত অসহায় এত সাহসী এত মানবিক এবং এতটাই অমানবিক হইতে পারে, ওই পনেরো দিনের যাত্রাপথে আমি জীবনের মতন বুইঝা গেছিলাম। নিয়া আসার মতন কিছুই ছিল না আমার ভাণ্ডারে। যা ছিল তা আনতে পারিনাই। জমি, পুকুর, নারিকেল গাছ, সুপারি গাছ, বেল গাছ, এইসব তো আর লোহার ট্রাংকে ভরা যায় না বসন্ত। আবার ট্রাংকে যা আনা যায় তেমন কিছুও ছিল না। মোটা তফিল ছিল না, তোমার কাকির গয়না ছিল না। পেটে বাচ্চা ছিল, সাত মাস। আর আসার সময় তো ভাবার সময় নাই, বাইর হইতে হইবো, এই তোমার মতনই একটা বাঁক ছিল, জমিতে গোবর উবাইতাম। সেই বাঁকের এক পাশে এক-কাপড়ে তোমার কাকিরে তুললাম। আরেক পাশে কাঠের ছোট বাক্সটা দিছি। কাপড়চোপড়, গুড়-চিড়া-কলা যা ছিল দিলাম, কিন্তু তাতেও হয় না। আরও কিছু তো দিতে হইবো, না হইলে দুই পাশের ভার মিলবো কেমনে; ওই বাঁক আমি কান্ধে তুলবো কেমনে!

২.
ওপরের গল্পটা ও আমায় ওইটুকুই বলেছে। একটা বাঁকের একদিকে নিজের তরুণী সন্তাসম্ভবা স্ত্রী আর অন্যদিকে একটা পাথর রেখে, ওজনের সমতা এনে এক যুবকের বিপুল অজানায় পারি দেওয়ার গল্প, দেশান্তরি হওয়ার কাহিনী। এবং, কাহিনীর বাংলা তারিখগুলোর ইংরেজিটাও নিশ্চয় ধরে ফেলা গিয়েছে। ১৯৭১ সাল, ফাল্গুনের ২৩ তারিখ মানে ৭ মার্চ মানে শেখ মুজিবর রহমানের সেই ঐতিহাসিক সভা, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাক মিলিটারি কর্তৃক নৃশংস গণহত্যার দুইদিন পরের তারিখ চৈত্রের ১৩ তারিখ।

আরেকটা গল্প বলে শেষ করি। তেসরা সেপ্টেম্বর ১৯৭১, ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটা বাড়ি। ‘দেশপ্রেমিক’ জনগণের কাছে খবর পেয়ে দিনচারেক আগে সে বাড়ির বড়ো ছেলেকে ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে। ছেলেটার নাম রুমী। শাফী ইমাম রুমী। তাঁর ‘অপরাধ’ সে ‘মুক্তি’ ছিল। ‘বিচ্ছু’ ছিল। মিলিটারিরা ওঁর বাবা আর ভাইকেও নিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ ও মারধরের পর তাঁদের ছেড়ে দিয়েছে। রুমিকে ছাড়েনি। এ’কদিন ঘটনার আকস্মিকতায় রুমির ওপর কতখানি অত্যাচার হয়েছে রুমির মা সেই খবরটা নিতেই ভুলে গিয়েছিলেন। ওঁর বাবা, ভাই দু’জনেই চেপে গিয়েছিল। আজ তেসরা সেপ্টেম্বর, আজ তিনি ছোট ছেলের কাছ থেকে কথা আদায় করেছেন। আর জানতে পেরেছেন, মিলিটারিরা অন্যত্র নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালানোর পরে যখন শেষবারের মতো রুমিকে এমপিএ হোস্টেলের বন্দীশালায় এনেছিল, তখন রুমি ওর ছোটভাই জামিকে একান্তে ডেকে বলেছিল, ‘ওরা আমাকে খুব মেরেছে, আরও অনেকের নাম বলার জন্য। কিন্তু তুই তো জানিস, আমি কত টাফ। আমি শুধু বদি ছাড়া কারুর নাম নিইনি। ওরা আমাকে এমন মেরেছে যে বাইরে কোথাও কাটেনি, ভাঙেনি, কিন্তু ভিতরটা যেন চুরচুর হয়ে গেছে। আম্মাকে কিন্তু বলিস না।’

কিন্তু আম্মা শুনে ফেলল! শুনে চলে গেল দোতলায় রুমির ঘরে। সেই ঘর যে ঘরে আর কোনওদিন ফিরে আসেনি রুমি। আম্মা তাঁর ছেলের বইয়ের আলমারি থেকে বের করলেন সেই বইটা, যেটা  একদিন তাঁকে পড়তে দিয়ে ছেলে বলেছিল, ‘আম্মা, যার ওপর অত্যাচার হয় কিছুক্ষণ পর সে কিন্তু আর কিছুই ফিল করতে পারে না। পরে যারা শোনে তারাই বেশি ভয় পায়।’ বইটা ছিল হেনরি এলেগের ‘জিজ্ঞাসা’। ও শুনিয়েছিল শত্রুর হাতে ধরা পড়ার পরে কি কি পন্থায় তাদের অত্যাচারগুলি সহ্য করা যায়।

বইটা হাতে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত মা অস্ফুটে বলে ওঠেন, রুমি, ধরা পড়বার পর তুমি কি সেই সেই পন্থায় পাক সেনাদের অত্যাচার অনেক কম ব্যথা গ্রহণ করে সহ্য করতে পারছো?

রুমি ফিরে আসেনি আজও। হতে পারে পাক মিলিটারির জিজ্ঞাসাবাদ এখনও চলছে।

আমিও ভাবি, মানুষেরও তো এমন কিছু স্মৃতি থাকে দখলদারি মিলিটারির মতো জীবনভর যাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হয় না। আমি আমার বন্ধুটির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর ঠাকুরদার যখন দেশের কথা মনে পড়তো, সেই পাথরটার দিকে তাকালে ব্যথা খানিকটা কম করে বুকে লাগতো কি না, এই প্রশ্ন সে কি কখনও তার দাদুর কাছে রেখেছিল? ও আমায় বলেছে, ‘দাদুকে বহু প্রশ্ন করেছিলাম, তার ভিতর এটা ছিল কি না আমার মনে নেই। তবে কারুর সঙ্গে প্রথমবার পরিচয় হলে, দেখেছি, আলোচনা দু’মিনিট অতিক্রান্ত হতেই দাদু তাকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনার দ্যাশের বাড়ি কোথায় ছিল? দাদু বুঝি ভাবতেন তাঁর মতো সবারই দেশ এখানে নয়, অন্য কোথাও, দূরে কোথাও, চিরকালের জন্যে ফেলে আসা, ফুরিয়ে আসা, হারিয়ে আসা, পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা পূর্ব একটা দিক…। আবার এমনও হতে পারে, দেশ হয়তো এমন একটা বিশ্বাস যারা কখনও সেটা হারাবার মতো ভয়াবহ সংকট ও সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়ায়নি, দাঁড়াতে হয়নি, তারা তা বুঝতেই পারবে না।’ ও আরও বলেছে, পাথরটা সেইদিন বসন্ত ভাঙাড়িওয়ালা তাঁর বাঁকে করে অন্যান্য ফেলে দেওয়া জিনিসপত্রের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। দাদু তাঁকে বলেছিলেন, পাথরটা তিস্তার জলে ফেলে দিতে। প্রিয় পাঠক, তিস্তার জল তার স্রোতে ভাসিয়ে পাথরটিকে তার আপন দেশে ফিরিয়ে দিতে পেরেছে কি না তা আমার জানা নেই।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.