:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
দেবদ্যুতি রায়

গল্পকার

কোথাও একটা ফুল থেকে যায়

কোথাও একটা ফুল থেকে যায়

১.
না, একটুও ভুল হয়নি সাহেদার, একদম ঠিকই শুনেছে সে। আজও শব্দটা ওই ঘর থেকেই আসছে, যেমন আসছিল গত কয় রাত। সাহেদা যদি শব্দটার উৎপত্তি না জানত, তাহলে এই রাতদুপুরে ওই খিলখিল হাসির শব্দটাকে নির্ঘাত পেতনির হাসি মনে করে ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেত ওর। প্রথম রাতে এই শব্দে সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছিল সাহেদা, পরদিন আন্দাজে ঢিল ছুড়ে রোজিনাকে জিজ্ঞেস করলে ও আবার হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘হয় বু। তোমার দেওর এমন হাসির কতা কইল হাইসতে হাইসতে মোর মাতা খারাপ হয়া গেছিলো কাইল।’ কী এমন হাসির কথা মনোয়ার রোজিনাকে বলেছে তা আর জানতে চায়নি ও। কিন্তু তার পর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই এমন খিলখিল হাসি লেগেই আছে ও ঘরে।

‘মাগি, সোহাগ দেইকলে গাও জ্বলি যায় একেবারে! পুতিদিন এই মাজা আইতোত হাসি আসির নাকচে উয়ার!’ মনে মনে রোজিনাকে ইচ্ছেমতো গালি দিয়ে ঘুমন্ত দেলোয়ারের দিকে আরেকবার তাকায় সাহেদা। ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করে দেলোয়ারের। সৌরবিদ্যুতের টিমটিমে আলোয় দেলোয়ারের বুকের ‍ওঠানামা স্পষ্ট চোখে পড়ে এখন, রাত যত বাড়ে, বাতির উজ্জ্বলতা তত বাড়ে কি না, তা অবশ্য জানা নেই সাহেদার। তবু এই মাঝরাতে বাতির আলোটা যেন একটু বেশিই ঝকঝকে মনে হয় ওর। এ ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়, অনেক দিন আগেই রাতেঘুম ভেঙে ঘর অন্ধকার দেখে দু-একবার চেঁচিয়ে উঠেছিল দেলোয়ার, তখন থেকেই আলো জ্বালিয়ে রাখতে ভুল করে না সাহেদা। অসুখটা হওয়ার পর থেকে মানুষটা অন্ধকার ভয় পায়। এখন অল্প পাওয়ারের বাতির আলোয় বুকের সশব্দ ওঠানামার সাথে ভয়ংকর নাকডাকার আওয়াজ নিয়ে দেলোয়ার বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে।

সাহেদার ঘুম জন্ম থেকেই পাতলা, অল্প কোনো আওয়াজ বা নড়াচড়ার শব্দে গভীর ঘুমও ভেঙে যায় ওর। আর এই কয় বছরে তো চোখ থেকে ঘুম নেই হয়ে গেছে প্রায়। আর সেটা কেবল দেলোয়ারের নাকডাকার ভয়ংকর শব্দের জন্য নয়। এককালের সুস্থ-সবল দেলোয়ার দেখতে দেখতে সাহেদার চোখের সামনে কেমন আগাগোড়া বদলে গেল পাঁচ-সাত বছরেই! প্রথমে শুরু হয়েছিল চোখে দেখতে না পাওয়া থেকে। চোখে ঠিকমতো দেখতে না পাওয়ার কথাটা প্রথম প্রথম দেলোয়ার স্বীকার করত না কিছুতেই। কিন্তু রাতের বেলায় চলতে-ফিরতে হঠাৎ হঠাৎ ধুপধাপ পড়ে যাওয়াটা অন্ধকারের অজুহাতে কোনো রকমে অস্বীকার করতে পারলেও ‍যখন দিনদুপুরেও এর সাথে ওর সাথে ধাক্কা লাগা আর মাঝেমধ্যে পড়ে যাওয়া শুরু হলো, তখন আর মাথা ঘুরে যাওয়ার অজুহাত বেশি দিন টিকল না। তারপর এক রাতে সাহেদার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠেছিল দেলোয়ার। ‍সেই রাতটা সাহেদা এই জীবনেও ভুলবে না। তখন সাহেদার বিয়ের দ্বিতীয় বছর। দুই বছরের পরিচিত হাসিখুশি মানুষটা সেদিন কেমন শিশুর মতো কেঁদেছিল। যে ভয়ংকর সত্যটার কাছে হার মানতে চায়নি দেলোয়ার, লুকিয়ে লুকিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে একা, সেই সত্যটা এমন নগ্নভাবে সবার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা, হতাশা আর নিজের সম্ভাব্য পরিস্থিতির অসহায়তা সেদিন দেলোয়ারের বুকভাঙা কান্না হয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

দেলোয়ার আজকাল আর কাঁদে না। এই কয় বছরে রংপুর শহর, সৈয়দপুর, ঢাকা- কত জায়গায় যে ডাক্তার দেখিয়ে এল। না, সবাই এক রকম জবাব দিয়ে দিয়েছে। অত ডাক্তারি ভাষা সাহেদা, দেলোয়ার, ‍ওর শ্বশুর-শাশুড়ি বা মনোয়ার কেউ বোঝে না। ওরা অত পড়ালেখা করা মানুষ নয়। ইংলিশে লেখা রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন দেখে কিছুই বোঝেনি তারা। তবে ‍ডাক্তার আর ওষুধের দোকানদারদের ‍কথায় একটা কথা বুঝেছে যে দেলোয়ারের চোখের কী কী যেন শুকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। শুধু চোখ গেলে না হয় হতো, দেলোয়ারের সারা শরীরটাই সেই তখন থেকে শুকাতে শুকাতে কেমন কাঠির মতো হয়ে গেল। পেটে কোনো খাবারও হজম হয় না আজকাল। ওকে খাওয়াতেই কেমন ভয় লাগে সাহেদার। রোগা শরীরে বারবার ল্যাট্রিনে যাওয়া-আসাটাও দেলোয়ারের জন্য বিশাল ধকল। অথচ মানুষটা খেতে কত ভালোবাসত!

বিছানায় সাহেদার পাশে তখন কেবলই পড়ে থাকে দেলোয়ারের প্রকট পাঁজরের অনবরত ওঠানামা আর রুগ্ণ নাকের অবিরাম গর্জন। তবু সাহেদার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে কোনো কোনো রাতে ওর শরীর জেগে ওঠে প্রজননকালের প্রচণ্ড বাঘিনীর মতো। সেই সব রাতে সাহেদা আরও দ্বিগুণ চেষ্টায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। সত্যি কথা বলতে সেই সব সময়ে দেলোয়ারের প্রতি সাহেদার প্রচণ্ড রাগ হয়, অভিমান হয়, সাহেদা বুঝতে পারে না শারীরিক অক্ষমতার জন্য দেলোয়ারের ওপর ওর একটু-আধটু ঘেন্নাও হয় কি না।

দেলোয়ারের অসুখটা নিয়ে ডাক্তারদের মুখ থেকে নানা রকম কথা শুনেছে সাহেদা। কেউ বলেছে, চোখের সমস্যার কারণে দেলোয়ার নাকি আশা ছেড়ে দিয়েছিল সবকিছুর, হতাশ হয়ে গিয়েছিল, সেই হতাশা থেকে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করার জন্য শরীরের অন্য সমস্যাগুলোর জন্ম। আবার পাশের গ্রামের রমেশের ডাক্তার মেয়েটা বলেছিল, হয়তো ওর নার্ভের সমস্যা, চোখ থেকে শুরু হয়েছিল, পরে অন্য উপসর্গগুলো যোগ হয়েছে। অনেকেই ওদের বলেছে দেলোয়ারকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনতে কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা করানোর ঝামেলায় তা করা হয়নি। আর তা ছাড়া সাহেদার মনে হয়েছে, তার শ্বশুর এক ছেলের চিকিৎসায় অত টাকা পয়সা খরচ করতে আসলে রাজি নন। সাহেদা শ্বশুরের দোষও দিতে পারে না। ঠিকই তো, সাকল্যে এ বাড়ির বিঘা তিনেক জমির ওপর যদি হাত দিতে হয়, তাহলে মনোয়ারের জন্য আর কিছু থাকে না। শ্বশুরকে তাই বেশি কিছু বলতে পারেনি সাহেদা। মোদ্দা কথাটা হলো, দেলোয়ারের চোখের বা শরীরের ঠিকমতো চিকিৎসা করানো হয়নি আর। কিন্তু আজও একেকটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাহেদার মনে হয়, কে জানে! হয়তো ইন্ডিয়ায় নিয়ে গেলে দেলোয়ার সুস্থ হয়ে উঠতেও পারত!

দেলোয়ারের বুকের ওঠানামা দেখতে দেখতে আর ক্রমাগত নাকডাকার শব্দ শুনতে শুনতে সাহেদা আবারও কান পাতে। রোজিনার কি সত্যিই শরম-ধরম নাই নাকি? হাসির ক্ষীণ আওয়াজ এখনো পাওয়া যাচ্ছে পাশের ঘর থেকে। এই মেয়ে এত হাসে ক্যান? সাহেদা মানে, সুস্থ-সবল স্বামীর সোহাগ পাবার একটা অন্য রকম আনন্দ আছে, শরীরের সুখ পূর্ণ হওয়ার একটা আলাদা উচ্ছ্বাস আছে। তাই বলে মাঝরাতে হাসি? এখন না হয় দেলোয়ার অথর্ব, শক্তিহীন কিন্তু রোজিনার মতো এমন সুখের রাত কি তার জীবনে আসেনি? দেলোয়ার বরং মনোয়ারের চেয়ে শরীরে-স্বাস্থ্যে আরও ভালো ছিল। সেই চওড়া শক্ত-সমর্থ শরীরের মধ্যে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দেওয়ার শান্তি কি সাহেদা কম পেয়েছে এককালে? বাবা তো কেবল শ্বশুরের জমিটুকুর জন্যই সাহেদাকে এখানে বিয়ে দেয়নি, জামাইয়ের শক্ত-সমর্থ চেহারাও এ বিয়ের অন্যতম কারণ ছিল। বিয়ের পর দেলোয়ার সুস্থ থাকার সময়, সেই পাঁচ-সাত বছর আগে, প্রায় প্রত্যেক রাতে সাহেদা নিজেকে উজাড় করে দিত স্বামীর কাছে। কী যে শান্তি ছিল সেই রাতগুলো! বিয়ের তখন অল্প দিন হয়েছে, সংসারেও এমন শোক-তাপ আর অভাব ঢুকে সকলের শান্তি নষ্ট করেনি। সেই রাতগুলো সাহেদার জীবনে সব থেকে সুখের, শান্তির আর ঐশ্বর্যের রাত। সাহেদার মনে আছে, ও একা একা কয়েক দিন দিঘলটারিতে থেকে আসলে রাতের বেলা দেলোয়ার ওর কোঁকড়ানো চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে আদর করতে করতে বলত, বউ রে, বাপের বাড়ি আর যাইস না তুই। তোক ছাড়া বাড়িটা আন্দার নাগে রে।

সেই সব রাত! সারা দিন বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে ঝিমানো দেলোয়ার আজকাল সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়ে। বিছানায় সাহেদার পাশে তখন কেবলই পড়ে থাকে দেলোয়ারের প্রকট পাঁজরের অনবরত ওঠানামা আর রুগ্ণ নাকের অবিরাম গর্জন। তবু সাহেদার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে কোনো কোনো রাতে ওর শরীর জেগে ওঠে প্রজননকালের প্রচণ্ড বাঘিনীর মতো। সেই সব রাতে সাহেদা আরও দ্বিগুণ চেষ্টায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। সত্যি কথা বলতে সেই সব সময়ে দেলোয়ারের প্রতি সাহেদার প্রচণ্ড রাগ হয়, অভিমান হয়, সাহেদা বুঝতে পারে না শারীরিক অক্ষমতার জন্য দেলোয়ারের ওপর ওর একটু-আধটু ঘেন্নাও হয় কি না। আর নিজের জীবনের অপূরণীয় ইচ্ছেটা, মা হবার সুতীব্র বাসনাটা যে আর সারা জীবনে পূরণ হবে না, তার জন্য এক বোবাকান্নায় ছেয়ে যায় ওর মন।

আজ রাতে কান পেতে শোনা রোজিনার ক্ষীণ কিন্তু একটানা হাসির শব্দ সাহেদাকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয় ভালোবাসা কিংবা করুণা কিংবা কেবল সমাজের ভয়ে অসুস্থ, শারীরিক সক্ষমতাহীন দেলোয়ারের সাথে থেকে গেলেও শরীর আর শরীরের চাহিদা সাহেদাকে ছেড়ে যায়নি এত দিনেও। এ বাড়িতে রোজিনা আর মনোয়ার ছাড়া কেবল সাহেদা আর দেলোয়ারই নয়, বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়িও আছে। সবার উপস্থিতিতেই রোজিনার এমন নির্লজ্জ হি হি হি হি হাসির শব্দে কিংবা অনেক দিনের ক্ষুধার্ত শরীরের আকস্মিক জ্বলে ওঠায়, সাহেদা জানে না, এই রাতদুপুরে তার সমস্ত অন্তরাত্মা ভীষণভাবে জ্বলতে থাকে।

 

২.
‘ওই ‍চেংড়ি, তোর সমস্যাটা কী ক তো। বাড়ির একখান কামোত তো হাত নাগাইস না। খালি দোপোর নাই, তেপোর নাই, ঠ্যাং ঢুলি বেড়াইস,’ লাল আগুনের তাপে গনগনে চুলার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রোজিনাকে ধমকের সুরে এই কথাটা বলে একটু শান্তি পায় সাহেদা। রাতের রান্নাটা সন্ধ্যার আগে আগেই সেরে রাখে ও। রোজিনা এখন বসে বসে বড় বটিটা দিয়ে তরকারি কাটছে, বড় জায়ের কথার উত্তর দেওয়ার কোনো লক্ষণ, কোনো আগ্রহ ওর মধ্যে দেখা যায় না। আসলে রোজিনা এখন ঠিক তর্ক করার অবস্থায় নেই, এই মুহূর্তে ওর মন ভীষণ খারাপ। সাহেদাই একটু আগে ওকে বলতে গেলে জোর করে উঠিয়ে এনেছে রুবেলদের উঠান থেকে, আর তারপর এই আলু, পটোল আর ডাঁটা আলাদা আলাদা করে কেটে রাখতে বলেছে। দেলোয়ার এখনো সর্ষে দেওয়া ডাঁটা চচ্চড়িটা ভালোবেসে খায়।

এ বাড়িতে আজ রাতের জন্য মাছ বা মাংস কিছু রান্না হবে না। সাহেদা জানে, মাছ-মাংস ছাড়া রোজিনা ভাত খেতে চায় না। ফ্রিজে মাছ, মুরগির মাংস আছে, গত বছর সাহেদা শ্বশুরকে বলে বলে আলু বিক্রির টাকায় ফ্রিজটা কিনিয়েছিল। তবু আজ ইচ্ছে করেই মাছ-মাংস রান্না করবে না সে। রোজিনার এই শাস্তিটা পাওনা হয়েছে। সাহেদার ধারণা, পেট না ভরলে অমন গা-জ্বালানি হাসিও আসবে না নিশ্চিত। আজকাল দেলোয়ারও শুধু নিরামিষ শাকসবজি খেতে চায় না। তবু রোজিনাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য দেলোয়ারের এক বেলা খাওয়ার কষ্ট মেনে নিতে রাজি সাহেদা।

ভাতে বলক এসেছে, ঢাকনাটা নামিয়ে সাহেদা রোজিনার দিকে আড়চোখে তাকায়। না, সে এখন গভীর মনোযোগে পটোলের খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত। আশপাশের কোনো শব্দ ওর এই মনোযোগে ফাটল ধরাতে পারবে বলে মনে হয় না। রোজিনাটা গোঁয়ার আছে, জেদ করেই মুখ গোঁজ করে রাখবে অনেকক্ষণ। মেয়েটার জন্য সাহেদার মনটা একটু নরম হয়ে আসে বুঝি এবার, ‘শোন না, রোজিনা, রুবেলের বাড়িত তোর এত কী? অটেকোনা মাইনষের নামে গিবত গাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু হয়?’

কী যে শান্তি ছিল সেই রাতগুলো! বিয়ের তখন অল্প দিন হয়েছে, সংসারেও এমন শোক-তাপ আর অভাব ঢুকে সকলের শান্তি নষ্ট করেনি। সেই রাতগুলো সাহেদার জীবনে সব থেকে সুখের, শান্তির আর ঐশ্বর্যের রাত। সাহেদার মনে আছে, ও একা একা কয়েক দিন দিঘলটারিতে থেকে আসলে রাতের বেলা দেলোয়ার ওর কোঁকড়ানো চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে আদর করতে করতে বলত, বউ রে, বাপের বাড়ি আর যাইস না তুই। তোক ছাড়া বাড়িটা আন্দার নাগে রে।

রোজিনা এবারও তেমনই নিরুত্তর থাকে, বঁটি থেকে নজর সামান্যও সরায় না। অদ্ভুত! তবু সাহেদা হাল ছাড়তে চায় না, রোজিনা মুখ দিয়ে কিছু একটা বলাবেই সে।‘ সালেহা আর পারুল হইল এই পাড়ার সবার চায়া কুটনি মাইয়া, তোক তো কয়ায় দিছু। আইজ তোর সাথে ভালো খাতির দিবে, কাইলে তোর নামে দুন্নাম দিবে। তাও তুই ওমার সাথে গল্প করির যাইস?’ ভাতের পাতিল নামিয়ে মাড় ঝরানোর গামলার ওপর পাতিলটা কাত করে দিয়ে পেছন ফিরে আবার জিজ্ঞেস করে ও।

এবার রোজিনার হয়তো কিছু একটা হয়। ডান হাতে পটোলটা বঁটির গায়ে ঠেকিয়ে রোজিনা এতক্ষণে মুখ তোলে, ‘এই বাড়িত মোর সাথে কায় কথা কয়, আপা? এই বাড়িত আইজকাল মোর দম বন্ধ হয়া আইসে।’

রোজিনার কথায় সাহেদা কি একটু থমকে যায়? কে জানে। তবে চোখের কোল উপচানো জলকে প্রবল চেষ্টায় আটকে রেখে আবার কাটাকুটিতে মনোযোগ দেওয়া রোজিনার দিকে তাকিয়ে সাহেদার ঠিকই মনে পড়ে এই মেয়েটাকে সে পছন্দই করত একসময়। বিয়ের আগে মনোয়ারের জন্য মেয়ে দেখতে শ্বশুর-শাশুড়ির সাতে সে-ও গিয়েছিল, বলতে গেলে নিজের পছন্দ হয়েছিল বলে বাকি সবাইকে সেই রাজি করিয়েছিল বিয়ের জন্য। নিজের একটা পুতুলের মতো ছোট বোনের যে অভাববোধ ছিল, সেটা রোজিনাকে দিয়েই পূরণ করতে চেয়েছিল সে। সাহেদার মনে পড়ে, গভীর রাতে রোজিনার সুখ আর তৃপ্তির হাসির শব্দ ওকে বিষাদগ্রস্ত করে তুলবার আগেও এই মেয়েটাকে সে ঠিকই আপন ভাবত। কিন্তু তারপরও কী আশ্চর্য! এই মুহূর্তে অভিমানাহত রোজিনার প্রতি তার কোনো দরদ আসে না। বরং সাহেদার আজকালকার অনাদরটুকু যে রোজিনা বুঝতে পেরেছে, বুঝে গেছে যে এ বাড়িতে তার আগের অবস্থানটুকু আর নেই, এই বিষয়টা সাহেদাকে এই হালকা শান্তি দেয়।

 

৩.
কার্তিকের শেষ আসতে না আসতেই এবার কেমন শীত শীত পড়ে গেছে চারদিকে। আজকাল একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠে সাহেদা। সকালের খাবারটাও তাই একটু দেরি করে খেতে হয় সবার। খেয়েই বাজারে ছুটতে হয় মনোয়ারকে, নিপেনের বাজারে মনোয়ারের মনোহারি দোকানটাই আজকাল চলে বেশি, দেরি করে গেলে চলে না ওর। আজ সাহেদার একটু বেশিই বেলা হয়ে গেছে উঠতে, না খেয়েই বাজারে ছুটতে হয়েছে ‍মনোয়ারকে। কোনো একটা অলিখিত নিয়মে সাহেদা ছাড়া আর কেউ এ বাড়িতে রান্না করতে যায় না, সে নিজেই এ কথা সে কথায় সেই নিয়মটা বারবার মনে করিয়ে দেয় সকলকে। শাশুড়ি আর রোজিনা তাই  ও বাড়িতে থাকা অবস্থায় কখনো রাঁধতে যায় না, কাটাবাছা করে দেয় কেবল। সাহেদা জানে, রান্নার প্রতি তার যতটা না ভালোবাসা, ব্যাপারটা তার চেয়েও বেশি অধিকারবোধের। দেলোয়ার অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সাহেদা আর কারও ওপর ভরসা করে উঠতে পারে না। স্বামী খুব বেশি দিন বাঁচবে, এমন আশ্বাস তাকে কোনো ডাক্তার দেয়নি, সে মারা গেলে এ বাড়িতে সাহেদার ‍অবস্থান কী হবে? এই কয় বছরে সাহেদা তাই রান্নাঘরটাকেই পরম যত্নে আঁকড়ে ধরেছে, রান্নাবান্না, ঘরকন্নাকেই সে নিজের পায়ের নিচের মাটি বলে ভাবতে শুরু করেছে। সেই রান্নাঘর অন্য কারও হাতে চলে যাবে, এটা সাহেদা মানতে পারবে না কিছুতেই।

সকালে আজ কোনোরকমে খেয়ে নিতে হবে। রোজিনাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কয় দিন ধরে রোজিনা কী একটা বুনছে কে জানে, রোজই সে এ সময় খেয়েদেয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে কুরুশ কাঁটা আর একগাদা রঙিন সুতা নিয়ে বসে। আজ ঘুম থেকে ওঠেনি, নাকি কোথাও বেড়ানিতে গেছে, আল্লাহ জানে। এখন আর ওকে ডাকার সময় নেই। ভাতের হাঁড়িতে কয়েকটা আলু ফেলে দেয় সাহেদা, কাঁচা পেঁয়াজ আর পোড়ানো শুকনো মরিচ দিয়ে ভর্তা করবে। আর কিছু রান্নার সময় হবে না।

আজ খাওয়ার সময়ও রোজিনা আসে না। কোথায় গেল মেয়েটা? আজকাল রোজিনা যেন কেমন শান্ত নদীর মতো হয়ে গেছে। আগের মতো হই-হুল্লোড় করে বেড়ায় না, রুবেলদের বাড়িতেও পারুলদের সাথে সময়ে-অসময়ে গল্প করতে ছোটে না। সবচেয়ে অবাক লাগে সাহেদার, হঠাৎ করেই রোজিনার ঘর থেকে মাঝরাতে হাসির ফোয়ারা ছোটানো শব্দ আসা থেমে গেছে! সাহেদার দুয়েকবার খুব ইচ্ছে করেছে বিষয়টা জানতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি, না থাক, এটা রোজিনা আর মনোয়ারের ব্যাপার, সে শুনবেই বা কেন? আর তার জানার অধিকারটাই বা কী?

সাহেদার কী যেন হয় এই সংবাদে, রোজিনার ওপর নিজের এত দিনকার পুষে রাখা রাগ গলে জল হয়ে যায়। রোজিনা, এ বাড়ির ছোট বউটা মা হতে চলেছে? এক অজানা খুশিতে সাহেদার ভেতরটা ছেয়ে যায়। যে মা হবার তীব্র বাসনাটা নিজের বুকের ভেতর প্রতিদিন তিলে তিলে পিষে মেরে ফেলতে হয় ওর, সেই মা হতে যাচ্ছে রোজিনা, এ খবরটা যেন সাহেদাকে হঠাৎই সমস্ত হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।

মাদুর পেতে শ্বশুর-শাশুড়িকে খেতে দিয়ে সাহেদা রোজিনার ঘরের দিকে যায়। কে জানে, আহ্লাদি মহারানি এখনো ঘুমাচ্ছেন কি না। দরজার পাল্লা ঠেলে রোজিনার ঘরে ঢুকতেই জানালা দিয়ে আসা আলোয় সে দেখতে পায়, সত্যি সত্যিই রোজিনা বিছানায় শুয়ে আছে। আশ্চর্য তো! কী হলো মেয়েটার? স্বামীর সাথে যদি ঝগড়াঝাঁটিও হয়ে থাকে, এত বেলা করে ঘুমোনো কি ঠিক? বাড়িতে তো আরও মানুষজন আছে, নাকি?

রোজিনার গায়ের ওপর থেকে কাঁথাটা সরিয়ে দেয় সাহেদা। রোজিনা ঘুমিয়ে নেই, চোখ মেলেই সে শুয়ে আছে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। সাহেদার উপস্থিতি টের পেয়ে রোজিনা উঠে বসে, ওর কালো চোখগুলো একটু বসে গেছে, মনে হয় সাহেদার। ঘুমোয়নি নাকি সারা রাত? কেঁদেছে? কে জানে।

‘রোজিনা, কী হইছে রে? উঠবু না নাকি? উঠ, ম্যালা বেলা হইছে।’ রোজিনার খাটে বসতে বসতে বলে সাহেদা।

রোজিনা তেমনি চুপচাপ বসে থাকে। জ্বর নাকি? কপালে হাত ছোঁয়ায় সাহেদা, না তো, ঠান্ডা কপাল। এবার সাহেদার অন্য রকম সন্দেহটা গাঢ় হয়ে ওঠে। ‘রোজি, তোর কী হইছে ক তো? তুই পোয়াতি নাকি?’

‘হ্যাঁ আপা,’ ক্লান্ত দুটি বড় বড় চোখ তুলে বলে রোজিনা। এ খবরটা এখনো কাউকে জানায়নি রোজিনা, আর সাহেদাকে তো জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। আপা আজকাল ওকে দেখতে পারে না, সেটা সে ঠিকই বুঝতে পারে।

সাহেদার কী যেন হয় এই সংবাদে, রোজিনার ওপর নিজের এত দিনকার পুষে রাখা রাগ গলে জল হয়ে যায়। রোজিনা, এ বাড়ির ছোট বউটা মা হতে চলেছে? এক অজানা খুশিতে সাহেদার ভেতরটা ছেয়ে যায়। যে মা হবার তীব্র বাসনাটা নিজের বুকের ভেতর প্রতিদিন তিলে তিলে পিষে মেরে ফেলতে হয় ওর, সেই মা হতে যাচ্ছে রোজিনা, এ খবরটা যেন সাহেদাকে হঠাৎই সমস্ত হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। ওর মনে পড়ে, মনোয়ারের পাত্রী দেখতে গিয়ে রোজিনাকে প্রথম দেখার পর ওর মনে হয়েছিল, এই মেয়েটা যেন ওর নিজের না থাকা ছোট বোন! আজ এই প্রায় দুপুর হয়ে আসা সকালে, রোজিনার মেহগনি কাঠের খাটটায় বসে, সাহেদার মনে হয়, যেন ওর নিজের ছোট বোনই পোয়াতি হয়েছে। যেন ও নিজের চরমতম অপ্রাপ্তিকে পূর্ণ হতে দেখছে নিজের পরম প্রিয়জনের মধ্যে। এক অসীম মমতায় সাহেদা রোজিনার অভিমানী মুখটাকে বুকে টেনে নেয়।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.