:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
শামীম রুনা

গল্পকার

চাঁদে পাওয়া রাতের গল্প

চাঁদে পাওয়া রাতের গল্প

ল্যাপটপে কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলে খানিক চাঙা হওয়ার জন্য কফির কাপ হাতে জানালার ধারে এসে দাঁড়াই। স্বচ্ছ শার্সির ওপাশে আকর্ণ হাসি নিয়ে গোলগাল চাঁদকে আকাশ ঝুলে থাকতে দেখে অযথাই আমার আড়াই যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া পড়শি বউয়ের কথা মনে পড়ে যায়। এই পড়শি বউয়ের নাম কখনো আমার জানা হয়নি, মায়ের মুখে তাকে বউ সম্বোধন করে বলতে শুনতাম। আমি তো ভেবেছিলাম তাকে ভুলে গেছি, কত স্মৃতিই তো আমরা হারিয়ে ফেলি, কিন্তু বউটি এত দিন ধরে আমার স্মৃতির ভান্ডারে এমন ঘাপটি মেরে পড়ে ছিল, তা আমার জানা ছিল না। কী অদ্ভুতভাবে পৃথিবীর কোনো এক কোনায় খুব হেলায়-ফেলায় জীবন কাটানো সাধারণ এক নারীকে পৃথিবীর অপর প্রান্তের আকাশের গোলগাল চাঁদ দেখে আমার মনে হলো!

আমার শৈশব-কৈশোরে, আমরা মফস্বল শহরের যে পাড়ায় থাকতাম, সে পাড়ায় নতুন বউটিও তার স্বামীর সঙ্গে বসবাস করত। ঠিক কবে থেকে বউটিকে প্রথম দেখি বা চিনতাম ধারণা নেই; আমার ধারণা, বউটিকে দেখে দেখেই আমি বুদ্ধিতে বেড়ে উঠছিলাম, যেমন ঢেউটিনের পাল্লাওয়ালা গেটের কাছে ধনুকের মতো বাঁকানো কৃষ্ণচূড়ার গাছটিকে বছর বছর আগুনরঙা ফুলের মুকুট পরে বিস্তৃত হতে দেখে বেড়ে উঠছিলাম, তেমনি। পরে কী করে যেন জেনেছিলাম, টিনশেড আঙিনাওয়ালা বাঁশের তরজা দিয়ে ঘেরা বাড়িটি আমাদের নিজস্ব হলেও সে নতুন বউরা ছিল আমাদের পাড়ার কোনো এক বাড়ির এক রুমের ভাড়াটে। বউটির সঙ্গে আমার মায়ের বেশ খাতির ছিল, তার স্বামী কাজের জন্য সারা দিন বাইরে থাকত আর বউটি গোসল-গা ধুয়ে কুঁচি করে কড়কড়ে মাড় দেওয়া ছাপার সুতি শাড়ি আর স্নো-পাউডারের সুবাস ছড়িয়ে আমাদের বাড়ি আসত। মায়ের গৃহস্থালি কাজের টুকিটাকিতে হাত লাগাত আর লাজুক মুখে পুটুর পুটুর করে গল্প করে যেত, সে আমাদের প্রায় দুপুরের খাবারের নিয়মিত অতিথি হয়ে গিয়েছিল। বউটি যে দিনগুলোতে আসত না, সেসব দিনে মা আমার হাত দিয়ে তার জন্য কিছু না কিছু খাবার পাঠিয়ে দিত, আমি গিয়ে দেখতাম; বউটি স্নো-পাউডারের সুবাস ছড়িয়ে ছোট রেডিওটি কানের কাছে নিয়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনছে নয়তোবা সিনেমার গান শুনতে শুনতে গুনগুন করছে। আমাকে দেখলে সে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত, বারবার বলত; কী কাণ্ড! খালাম্মা কেন আবার এসব পাঠাইতে গেল!

খুব আগ্রহ ভরে সে আমার হাত থেকে বাটিটি নিয়ে ঢাকনা আলগা করে লম্বা শ্বাস টেনে ঘ্রাণ নিত,তারপর আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলত, তুমি কী খাবা বইনা?

আমি নীরবে মাথা নেড়ে না জানালে বউটি শুনত না, সে আমার পলকা শরীরটাকে দুহাতে তুলে একটি মোড়ায় বসিয়ে দিয়ে বলত, এখানে চুপ করে বসে রেডিওতে গান  শোনো, আমি তোমার জন্য মিষ্টি বরইয়ের আচাড় রাখছি, দিতেছি। এই বলে বউটি মিটসেফের তালা খুলে রঙিন কাগজে মোড়ানো দুটি আচাড়ের প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিত। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আচাড়ের প্যাকেট খুলতে খুলতে দেখতাম বউটি আবার প্রবল আলস্যে উপুড় হয়ে বিছানায় নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী…’ গুনগুন করে গাইছে, বউটির লাস্যময় অলসতা দেখতে আমার ভালো লাগত। বউটিকে দেখতে দেখতে আমার ভেতরে একটা গোপন সুখ তিরতির করে নাচত।

বহুদূর থেকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বউটির স্বপ্নিল কণ্ঠ আমার কানে ফিসফিস করে বলত, জানো, কাল রাইতে নাইট শো সিনেমা দেখতে গেছিলাম তুমার ভাইজানের সাথে। কবুরী আর বুলবুলের সিনেমা। সিনেমাটা দুঃখের, দেখতে দেখতে আমি কানছি বলে তুমার ভাইজান কত হাসল। তুমার ভাইজান খালি রং করে আমার সাথে। তুমার ভাইজানের মনে অনেক রং। ভালো মানুষ তো।

বউটি নাক-মুখ-ঠোঁট ছুঁয়ে সারা শরীরজুড়ে সুখ ছলকে ছলকে ওঠে, মনে হয় এইমাত্র যেন সে এক সুখ পুকুরে ডুব দিয়ে উঠল, তার সারা শরীর সুখ বিলি কাটছে। সাপের মুখের সামনে বাইদানি যেমন নিচু কণ্ঠে শ্লোক আওড়ায়, তেমনি ফিসফিসিয়ে বউটি বলে; অন্ধকার সিনেমা হলে মানুষটা আমার হাত এমন পাকড়াইয়া ধইরা রাখছিল, আমি বুঝি কই পলাই যাইতেছি।…আবার আমার মনে খুব সুখ সুখও লাগতেসিল। বউটি বাঁ হাতে নিজের ডান হাতের কবজিতে হাত বোলাতে বোলাতে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়, তুমি এখন এসব বুঝবা না, বইনা। একদিন এমন সুখ তুমার জীবনেও আসপে।

বউটি নাক-মুখ-ঠোঁট ছুঁয়ে সারা শরীরজুড়ে সুখ ছলকে ছলকে ওঠে, মনে হয় এইমাত্র যেন সে এক সুখ পুকুরে ডুব দিয়ে উঠল, তার সারা শরীর সুখ বিলি কাটছে। সাপের মুখের সামনে বাইদানি যেমন নিচু কণ্ঠে শ্লোক আওড়ায়, তেমনি ফিসফিসিয়ে বউটি বলে; অন্ধকার সিনেমা হলে মানুষটা আমার হাত এমন পাকড়াইয়া ধইরা রাখছিল, আমি বুঝি কই পলাই যাইতেছি।…আবার আমার মনে খুব সুখ সুখও লাগতেসিল। বউটি বাঁ হাতে নিজের ডান হাতের কবজিতে হাত বোলাতে বোলাতে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়, তুমি এখন এসব বুঝবা না, বইনা। একদিন এমন সুখ তুমার জীবনেও আসপে। জানো, ইন্টারবেলে সে আমারে  ফান্টা খাওয়াইল, হট পেটিস আর আচাড় খাওয়াইল। দুইটা আচাড় আমি তুমার জন্য রাইখা দিছি। বউটি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে, আমি আচাড়ের টক চাটতে চাটতে তার হাসি দেখি।

আজকে আমাদের বাড়ি যাবেন না? আমি জানতে চাই।

না গো বইনা। তুমার ভাইজান দুফুরে আসপে বলছে। বউটি আবার হাসে, তার কথায় ঘরজুড়ে প্রজাপতি ওড়াউড়ি করে।

বউটির মুখে ভাইজানের কথা বারবার শুনলেও তাকে কখনো দেখা হয়নি, তাই না দেখা ভাইজানের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার অস্বস্তিতে আমি তাড়াতাড়ি চলে আসি।

আমি গোলপনা চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, বউটি এমন করে মনের গহিনে এত দিন ধরে লুকিয়ে ছিল! তবে কেন এত দিন তার একটি বুদ্‌বুদও আমার সুপ্ত বোধের অজানা ছিল! হঠাৎ আজ বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নার আলোয় বউটির স্মৃতি মহামারির তাণ্ডবের মতো আমাকে আক্রান্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আরও কিছুদিন পর, বউটি আমাদের বাড়ি সন্ধ্যার দিকেও আসতে লাগল বা দিনের বেলায় এলে তার ফিরে যেতে রাত হয়ে যেত। বউটির ছাপার শাড়ির কুঁচি তখন এলোমেলো, সে আর আগের মতো স্নো-পাউডারে সুরভিত হয়ে থাকে না, চোখের নিচে হালকা কালির ছাপ দিন দিন ঘন হয়ে উঠছিল, মায়ের সঙ্গে আগের মতো গুট গুট করে কথা বলে না, কথায় কথায় হাসে না। এখন মা-ই বউটির সঙ্গে বেশি কথা বলে, প্রশ্ন করে; বউটি বড় বড় চোখ মেলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক পর হয়তো নিচু স্বরে একটি উত্তর দিত। মাকে দেখতাম, মাঝে মাঝেই বউয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত, বউ, তোমার বাপ-ভাইদের খবর দেও, তারা আসুক।

বউটি মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না করে আমার মায়ের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘায়িত করত।

জানালার বন্ধ শার্সি খুলে দিলে হাওয়ার তোড় হুড়মুড়িয়ে আমার ওপর স্বরোষে আছড়ে পড়ে, এত সময় একলা ওপাড়ে দাঁড়িয়ে বুঝি খুব রাগ হয়েছে। আমি জানালার খোলা কার্নিশে কফির মগ হাতে জবুথবু হয়ে বসি; যতই ইউরোপে সামার আসুক, তা আমাদের দেশের পৌষের শীতের চেয়ে মোটেও কম ঠান্ডার নয়, আমার ত্বক তা জানান দেয়। এখন চাঁদ আর আমার মাঝে কোনো বিভাজনরেখা নেই, দুজনে মুখোমুখি।

চৈত্রের সে রাতেও আমি আর চাঁদ এমন মুখোমুখি ছিলাম। চাঁদ আর বউটিও মুখোমুখি ছিল।  উঠানে বিছানো পাটিতে শুয়ে মস্ত বড় চাঁদকে চোখ কুঁচকে আমি বিভিন্ন আয়তন দিতেছিলাম। বউটি আমার পাশে বিষণ্ন মনে বসে ছিল। এমন সময় মা এসে পাটিতে বসলে অনেক দিন পর বউটিকে কথায় পায়, নাকি চাঁদে পায়! সে বলে; দেখছেন কেমন চাঁদনি ঝরতেছে! চারিধার রুপার থালির মতো ঝকমক করতেছে।

তারপর কবে, কখন থেকে সে বউটি আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, আমার ঠিক মনে নেই। শেষ পর্যন্ত তার স্বামী কি ফিরে এসেছিল? আড়াই যুগ পরে, দূরদেশে চাঁদের আলোয় বসে আমার ভীষণ রকম উত্তরটি জানতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তা আর জানা সম্ভব নয়। আমার মা মারা গেছেন কয়েক বছর হয়ে গেল, তারও আগে বাবা মারা যান। অন্য ভাইবোনেরা বউটি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে মনে হয় না।

আমার মা মাথা নেড়ে বউটির কথায় সায় দেয়। বউটি আবার বলে, আমার বিয়ের পর পর, তখন আমি শ্বশুরবাড়ি থাকি; এমন চাঁদনি রাতে আপনার ভাগিনা যেন পাগল হয়া যাইত। সবাই কইত, চাঁদনি রাইতে ওরে পরিতে ধরে, তাই এমন আউলাঝাউলা করে। আমার আবার খালাম্মা মানুষটার অমন পাগলামি ভালো লাগত। এমন রাইতে সে আমারে নিয়া গ্রাম ঘুরতে বাইর হইত…।

আমি কান খাড়া করে বউটির কথা শুনি, অনেক রাইতে; সবাই ঘুমায়া পড়লে চুপে চুপে আমারে নিয়া সে বাইর হইত। আমার খুব ভয় করত, শরমও; শ্বশুর-শাশুড়ি জানলে যদি রাগ করে। আবার মানুষটার সাথে এমন করে বাইর হইতেও খুব ভালো লাগত। আমারে নিয়া কখনো ও পুকুরের ঘাটলায় বসত আবার কোনো কোনো সময় মোড়ের চায়ের দোকানে নিয়া যাইত। চায়ের দোকান তখন বন্ধ হয় হয়, দোকানি ছাড়া আর কেউ থাকত না, ও দোকানিরে বলত; মামা, বউ নিয়া আসছি। ডবল টাকা দিমু, আমাদের গরম গরম ডিমভাজা আর চা খাওয়াও। পুরা গ্রামের মানুষ ঘুমায়া তখন, সে দিনগুলাতেও আজকের মতো সমস্ত গ্রামের ওপর মনে হয় ফেরশতারা এমন বালতি বালতি রুপা ঢাইলা দিছিল, চারিধার দুধের মতো ফরসা; আমি আর মানুষটা কাঠের টুলে বইসা বইসা ডিমভাজি আর চা খাইতাম…। খালাম্মা গো, সেসব দিনগুলান আমার স্বপ্নের মতো লাগত। আমার সেসব দিনগুলান হারায়া গেছে গো…।

মা নিচু স্বরে বলে, দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে বউ।

বউটি শব্দ করে শ্বাস ফেলে, খালাম্মা, কেমনে মানুষটা এমন বদলায়া গেল? আমারে ভুইলা আরেক নারীর জন্য দিওয়ানা হয়া গেল কেমনে?

বউটির দীর্ঘশ্বাস চৈত্রের হাওয়ায় মিশে আমের বোলের গন্ধকে কড়া আর আঠালো করে তোলে, আমার দুই চোখের পাতায় সে আঠা লেগে বন্ধ হয়ে আসে। বউটির নিচু স্বরে বলা কথার টানা লয় আমার তন্ত্রীতে সম্মোহন ছড়িয়ে দিত যেন, আমি ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে কোনো এক অলৌকিক জগতে হারিয়ে যেতাম।

তারপর কবে, কখন থেকে সে বউটি আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, আমার ঠিক মনে নেই। শেষ পর্যন্ত তার স্বামী কি ফিরে এসেছিল? আড়াই যুগ পরে, দূরদেশে চাঁদের আলোয় বসে আমার ভীষণ রকম উত্তরটি জানতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তা আর জানা সম্ভব নয়। আমার মা মারা গেছেন কয়েক বছর হয়ে গেল, তারও আগে বাবা মারা যান। অন্য ভাইবোনেরা বউটি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে মনে হয় না। আমি ঝুম হয়ে ভাবার চেষ্টা করি, বউটি যখন এত দিন স্মৃতির কোঠায় ঘাপটি মেরে ছিল, তখন তার আরও কিছু স্মৃতি হয়তো মগজের অলিন্দে অলিন্দে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

নিচের রাস্তা থেকে নারীর হাসির শব্দ ভেসে আসে, কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বাসায় পৌঁছে দিতে এসেছে; এখন বিদায়ী চুমো আর আলিঙ্গন পর্ব চলছে। আমার জানালা থেকে তাদের ছায়া ছায়া আলোকিত শরীর দেখা যায়, মুখচ্ছবি দেখা যায় না; মেয়েটি জলজ জ্যোৎস্নার মতো ছেলেটির দুবাহুর মধ্যে গলে গলে পড়ছে, ওদের ওপর রহস্যময় একটুকরো আলো চাদরের মতো জড়িয়ে রয়েছে, আলোটুকু চাঁদের না স্ট্রিট ল্যাম্পের, বোঝা যায় না। আমি বিড়বিড় করে বলি, আজ ওদের চাঁদে পেয়েছে।

আমরা দুজনে শিক্ষিত, আধুনিক আর প্রাপ্তবয়স্কি, ব্যক্তিস্বাধীনতার যুগে পারস্পরিক ভালো লাগা মন্দ লাগাকে আমরা মূল্যায়ন করি। মার্কুইজের অন্য নারীকে ভালো লেগেছে, সে নারীর সঙ্গে ওর ভালোবাসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ককে মনে হয়েছে, অযথাই টানছে; তাই তো ও যখন ওই টানাটানির সমাপ্তি চাইল, আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম, নিজের আবেগ চেপে। আমি ওকে বলতে পারিনি, আমি এখনো ওকে ভালোবাসি।

মার্কুইজকেও চাঁদ ভীষণ উদ্বেলিত করে করত, ওর কানে কানেও হয়তো শেহেরজাদি রূপকথার অলৌকিক গল্প শুনিয়ে চন্দ্রগ্রস্ত করে তুলত। হিসাব করে করে চাঁদনি রাতগুলোতে হিত্তাতে ছুটি কাটাতে ছুটত। প্রথমবার আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ছুটিতে মার্কুইজের সঙ্গী হয়েছিলাম, এর আগে কখনো জঙ্গলে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। পাহাড়ের ওপর অক কাঠের বানানো কাঠের হিত্তাটি ছিল মার্কুইজের দাদার আমলের, যার পাদদেশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল স্বচ্ছ পানির নদী। শিল্পীর আঁকা ছবির মতো নিসর্গের পরিপাটি বিন্যাস আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহের জন্য জার হাতে মার্কুইজের সঙ্গে পানি আনতে গিয়ে। হিত্তাতে কোনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল না, মোমের আলো আর কাঠের আগুনে ঘরটি আলোকিত আর উষ্ণ করে তুলেছিল মার্কুইজ। ফায়ার প্লেসে বারবার আগুন উসকে দেওয়া বা লাকড়ির আগুনে কফির পানি গরম করা এত ঝক্কির কাজ ইংলিশ মুভি দেখে কখনো আমার ধারণা হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যে মার্কুইজ আমার বিপর্যস্ত অবস্থা বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসতে হাসতে হাত ধরে বলেছিল,তুমি আমার গেস্ট। তোমাকে কিছু করতে হবে না। শুধু দেখো, পরেরবার নিশ্চয় তুমি সব করতে পারবে।

নর্ডিক দেশে শীতের দিনগুলো অতিমাত্রায় খাটো, রিফাইন্ড চিনিগুঁড়োর মতো তুষার মেশানো হাওয়ার দাপটে দিনগুলোয় আলো ফুরিয়ে আসে দ্রুত, দুপুরের পর ঝুপ করে অনাহূত সন্ধ্যা নেমে আসে। হিত্তাকে ফায়ার প্লেসের আগুনটুকু ছাড়া ঘরের অন্য সব আলো নিভিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল মার্কুইজ, বাইরে তখন তুমুল জ্যোৎস্না। সারা দিনের ঝরা স্তূপ তুষারের ওপর পূর্ণ চাঁদের আলোর সেকি দেমাকি নৃত্য! বনবাদাড়ে, গাছের ডালপালায় জড়িয়ে থাকা তুষারের ওপর এত ধবল শুভ্রতা, চোখ অন্ধ হয়ে আসে, তবু অপার মুগ্ধতায় চোখ মেলে সে জ্যোৎস্নায় কেবলই বিহ্বল হওয়া! মুগ্ধতায় আমি স্থির হয়ে গিয়েছিলাম, মার্কুইজ প্রচণ্ড আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, কাঁপা কণ্ঠে বলেছিল, অপার্থিব; তাই না?

তারপর আরও কতবার মার্কুইজ আর আমার যৌথ দিনরাত্রি সে হিত্তাতে কেটেছে। পরের সময়গুলোতে নদী থেকে পানি আনা বা জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ আমার জন্য ভোগান্তির ছিল না। দিনের বেলায় আমরা নদীতে মাছ ধরতাম বা কোনা পশুপাখি শিকার করত মার্কুইজ আর রাতে বিহ্বল মুগ্ধতায় সাকির সুরা পানের মতো দুজনে জ্যোৎস্না গিলতাম।

আমি বিড়বিড় করে বলি, সেসব দিনগুলান আমার স্বপ্নের মতো লাগত। আমার সেসব দিনগুলান হারায়া গেছে গো…।

আজ অফিশিয়ালি মার্কুইজের সঙ্গে আমার ডিভোর্সের শেষ সই হয়ে গেল, আরও  আগে থেকে দুজনের সেপারেশন চলছিল। আমরা দুজনে শিক্ষিত, আধুনিক আর প্রাপ্তবয়স্কি, ব্যক্তিস্বাধীনতার যুগে পারস্পরিক ভালো লাগা মন্দ লাগাকে আমরা মূল্যায়ন করি। মার্কুইজের অন্য নারীকে ভালো লেগেছে, সে নারীর সঙ্গে ওর ভালোবাসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ককে মনে হয়েছে, অযথাই টানছে; তাই তো ও যখন ওই টানাটানির সমাপ্তি চাইল, আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম, নিজের আবেগ চেপে। আমি ওকে বলতে পারিনি, আমি এখনো ওকে ভালোবাসি। ওর সঙ্গে হাজার বছর পথ না হাঁটি কিন্তু আরও হাজার রাত জ্যোৎস্না দেখতে চাই।

আজও প্রবল জ্যোৎস্না চাঁদের আলোয়, মার্কুইজ কি হিত্তার জানালায় বসে কারও হাত ধরে জ্যোৎস্নায় বিহ্বল হচ্ছে?

 


অলংকরণ : রাজীব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.