চৌকিদার
আমার দাদু ছিল চৌকিদার। মেদিনীপুরের খেজুরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল খড়গপুর। চৌকিদারি করতে। গাঁয়ে থেকে কিছু করতে পারছিল না। চাষবাসের জমিন ছিল না তেমন কিছু। পরে বাবাকেও ডেকে নিয়ে গেল খড়গপুরে। ওখানে ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। আমি, মা, ঠাকুমাও চলে গেলাম তারপর। গাঁয়ের বাড়িতে রইল শুধু দাদা।
খড়গপুরে আমরা থাকতাম স্টেশন থেকে কিছুটা ভেতরে। খাটালের কাছে একটা বস্তিতে। খাটালে মহিষগুলো বাঁধা থাকত। একসঙ্গে অনেক মহিষ। তাদের গায়ের গন্ধ, গোবরের গন্ধ আসত খুব। পাশাপাশি দুটো ঘর নিয়ে থাকতাম আমরা। বেড়ার ঘর, ওপরে খাপরার চাল। একটায় থাকত দাদু-ঠাকুমা, আর একটায় আমি, বাবা-মা। ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। মাঝে মাঝেই ট্রেন যেত। ঝিকঝিক ঝিকঝিক।
দাদু চৌকিদারি করত আর বাবা ঝাঁড়ফুঁক। দাদুর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। যেসব পাড়ায় দাদু রাতে চৌকিদারি করত, দিনের বেলায় সে পাড়ায় নিয়ে যেত আমাকে ঘোরাতে। দাদুর সঙ্গে আমাকে দেখলেই অনেকে জিজ্ঞেস করত, ‘আরে শ্রীহরিবাবু, নাতনি নাকি?’ দাদুর খুব সুনাম ছিল। ফাঁকি দিত না যে কাজে। তাকে সবাই ‘শ্রীহরিবাবু’ বলেই ডাকত। গাছ থেকে পেয়ারা কি জাম কি আতা পেড়ে আমার হাতে দিত অনেকে। যখন যা হতো। কেউ আবার দশ-কুড়ি পয়সার লজেন্স হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলত, ‘নাও খুকি, খাও।’ বাড়ির সবাইকে শ্রীহরি চৌকিদারের বাড়ির লোক বলেই চিনত।
আমাদের ঘরের সামনে দুই বোন থাকত তাদের ঠাকুমার সঙ্গে। একজনকে খাঁদি, অন্যজনকে ভূতি বলে ডাকত সবাই। ওরা দুই বোন রোজ বাজারে যেত সবজি কুড়োতে। ওদের যেতে দেখে আমারও খুব ইচ্ছে হতো। সবজি কুড়োনো না জানি কী ভালো ব্যাপার। আমাদেরও তো একেকদিন ভালো করে রান্না হয় না। ওসব পেলে হবে।
একদিন আমিও গেলাম ওদের সঙ্গে। বেলায় বাজার উঠে যাওয়ার পর। দোকানদাররা পোকায় খাওয়া বেগুন, উচ্ছে, আধপচা পেঁয়াজ, আলু আর কত কী সব ফেলে দিত। গিয়ে দেখি আমরা তিনজন ছাড়াও আরও বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসেছে।
আমি দেখেছিলাম, ভূতির ঠাকুমা ওই সব আনাজ পেয়ে কী খুশিই না হতো। নাতনিরা ফেরামাত্র হাত থেকে নাইলনের ব্যাগ টেনে নিয়ে বলত, ‘দেখি দেখি আজ কী পেলি।’ আমি তাই ফ্রক গুটিয়ে উবু হয়ে বসে আলু, পেঁয়াজের পচা খোসা নখ দিয়ে ছাড়াতে ছাড়াতে ভাবছিলাম,মাকে গিয়ে দেখাব। মা কত খুশি হবে। কত আদর করবে।
বাজার থেকে ফেরার পর মায়ের চোখের সামনে দুহাতে সবজিগুলো তুলে ধরেছিলাম। ‘দ্যাখো মা, আমি কত জিনিস নিয়ে এসেছি।’ কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ঝরঝর করে চোখের জল পড়ছে। সবজিগুলো সরিয়ে রেখে এক হাতে আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল। থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছিল মা। তখন আমি বছর সাত-আটের ছোট মেয়ে। মা যে কাঁদছে কেন, বুঝতে পারিনি।
দাদু যখন চৌকিদারিতে বেরিয়ে যেত, তখন আমি অন্ধকারের মধ্যে শুধু দাদুর মোটা মোটা দুটো হাত আর পায়ের পাতা দেখতে পেতাম। হারিকেনের আলো সঙ্গে নিয়ে আরও অন্ধকারে মিলিয়ে যেত দাদু। রাতে যখন আমি মাটিতে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়তাম, চোখ বুজে আসত, তখন মনে হত দাদুর ডাক শুনতে পাচ্ছি। ‘হুঁশিয়ার— সাবধান— কে জাগে?’ আমি ঘুমের ভেতরেই বিড়বিড় করে বলতাম, ‘লালকমল জাগে আর নীলকমল জাগে—
সন্ধে হলেই দাদু লম্ফ জ্বেলে ডাক দিত আমাকে। ‘তাড়াতাড়ি আয়, কালকের গল্পটা আজ শেষ করব।’ আমি দৌড়ে গিয়ে দাদুর কোলে উঠে যেতাম। কত গল্প বলত দাদু। মহাভারত, রামায়ণ থেকে বলত। রাক্ষস-খোক্কসের গল্প বলত। ডাকাতের গল্প বলত। কাঞ্চনমালা আর কাঁকনমালার গল্পও শোনাত। বলার সময় ঠাকুমা এসে কাছে বসলে দাদু থেমে গিয়ে ঠাকুমার থুতনি নাড়িয়ে দিয়ে বলত, ‘আমার বড় নাতনিও গল্প শুনতে এসে গেছে।’ ঠাকুমা লজ্জায় মুখটা একটু নামিয়ে নিত। ঠাকুমাকে দাদু বড় নাতনি বললে আমি খুব মজা পেতাম। মজাটা তো কাউকে জানাতে হবে। দাদুর কোলে বসেই মাকে ডাক পাড়তাম— ‘মা, দাদু ঠাকুমাকে বড় নাতনি বলছে।’ ঠাকুমা অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার মুখ চেপে ধরে বলত, ‘চুপ কর মুখপুড়ি!’
মায়ের রান্না হয়ে গেলে দাদু রাতের খাওয়া সেরে বাঁ হাতে একটা লম্বা লাঠি আর ডান হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ত। ফিরত সেই রাত ভোরে, যা আমি দেখতে পাইনি কখনো। দাদু যখন চৌকিদারিতে বেরিয়ে যেত, তখন আমি অন্ধকারের মধ্যে শুধু দাদুর মোটা মোটা দুটো হাত আর পায়ের পাতা দেখতে পেতাম। হারিকেনের আলো সঙ্গে নিয়ে আরও অন্ধকারে মিলিয়ে যেত দাদু। রাতে যখন আমি মাটিতে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়তাম, চোখ বুজে আসত, তখন মনে হত দাদুর ডাক শুনতে পাচ্ছি। ‘হুঁশিয়ার— সাবধান— কে জাগে?’ আমি ঘুমের ভেতরেই বিড়বিড় করে বলতাম, ‘লালকমল জাগে আর নীলকমল জাগে—
ঠাকুমা বেশি চলাফেরা করতে পারত না। একটা পা হাঁটুর কাছ থেকে কাটা গিয়েছিল। রেললাইনের ওপারে ঠাকুমা ঝাঁটিগাছ তুলতে যেত। কাঁচা ঝাঁটিগাছ উপড়ে তুলে এনে শুকিয়ে নিলে জ্বালন হয়। রান্না যা-ই হোক, জ্বালন তো লাগবেই। সেদিন ঠাকুমা খেয়াল করেনি। গাছ উপড়াতে উপড়াতে কখন ট্রেন এসে গেছে। তার বাঁশি শুনতে শুনতেই ট্রেন একটা পা নিয়ে চলে যায়। সে যাত্রায় ঠাকুমা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, এই যা।
বাবা সংসারে টাকা দিতে পারত না। যে ঝাঁড়ফুঁক করত তাতে তেমন কিছু টাকার জোগাড় হতো না। কারও দাঁতের গোড়ায় পুঁজ জমে ফুলে গিয়েছে— বাবার কাছে এলে চেপে পুঁজ বের করে দিয়ে ফিসফিস করে কী সব মন্ত্র পড়ে দাঁতের গোড়ায় ফুঁ দিয়ে বলত, ‘রাতে গোটা গোলমরিচ দাঁতে ফেলে আধখানা করে মাড়িতে দিয়ে ওই পাশ চেপে শুয়ে পড়বে। সকালে উঠে দেখবে ব্যথা কমে গেছে।’ কারও আমাশা হলে সে বাবার কাছে এসে শুকনো মুখে বসে থাকত। বলত, ‘কী করি, আমাশা যে মোটে কমে না।’ বাবা তখন ভুসি আর চিনি একসঙ্গে মিশিয়ে ফুঁকে দিত। রুগি জিজ্ঞেস করত, ‘কত দিতে হবে?’ বাবা গম্ভীর হয়ে বলত, ‘আমি আমার বিদ্যে বেচে খাই না। গুরুর নিষেধ আছে। যা পারবে, তাই দাও।’ রুগি পাঁচ সিকে মাটিতে রেখে ওষুধ নিয়ে চলে যেত। ঘরে পাঁচজন মানুষ, ভালো করে খাবার জোটে না, ওদিকে নাকি গুরুর নিষেধ!
হঠাৎ একদিন দাদু মারা গেল। আমি দেখি, ঘরের মধ্যে চাদর-চাপা দিয়ে দাদুকে শোয়ানো। ঠাকুমা দাদুর গায়ের ওপর আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে আর বলছে, ‘এ দাদা রে, তুমি আমাকে একা ফেলে কোথায় গেলি রে!’
মা আমাকে বলেছিল, ‘দাদুকে গড় করে নে।’ আমি দাদুকে প্রণাম করে মাথার কাছে এসে দাদুর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। বুঝতে পারছি না ঠাকুমা, মা কাঁদছে কেন? এত লোকই বা দাদুকে দেখতে আসছে কেন? দাদু তো বাদলা হলেই ঠান্ডায় চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোয়। দুপুরে ঘুমোতে ভালো লাগে না আমার, তাই দাদুর মাথার কাছে বসে খেলতাম, মা তখন আমাকে বকত। আজ তো মা বকছে না। কী হয়েছে আজ?
রেললাইনের ওপারে ঝাঁটিগাছের জঙ্গলে কবর খুঁড়ে ওরা দাদুকে শুইয়ে দিল। দাদুর ধুতি, জামা সব খুলে নিল। শুধু যে লাঠিটা খটখট করে ঠুকে ঠুকে দাদু পাহারা দিত, সেই লাঠিটা বাবা দাদুর পাশে শুইয়ে দিয়েছিল। বাবার হাত থেকে নুন নিয়ে ওরা দাদুর ওপর ছড়িয়ে দিল। তারপর ওপরে মাটি দিয়ে মাথার কাছে একটা তুলসী চারা পুঁতে দিল। কাছেই একটা বড় পুকুর ছিল। সেখানে সবাই স্নান করে ফিরে এল আমাদের বাড়ি। তারপর নিজেদের ওঁচায় শুকনো চিঁড়ে-বাতাসা নিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল।
বাবা আশপাশের কয়েকজনের সঙ্গে কাঠ কাটতে গিয়েছিল। পোড়াতে কাঠ লাগবে তো। ওসব তো বড়দেরই কাজ। সেই কাটতে গিয়ে এক বিপত্তি। কাটা গাছটা রেললাইনের তার ছিঁড়ে নিয়ে লাইনেই পড়ে যায়। ট্রেন বন্ধ। পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। বাবা আর অন্য লোকেরা গাছ ফেলে ভয়ে পালিয়ে এসেছে।
একজন ধমকে উঠে বলেছিল, ‘কান্নাকাটি বন্ধ কর। পুলিশ শুনতে পেলে এসে আমাদেরই ধরবে। এই মড়া পোড়ানো যাবে না। মাটি দিতে হবে।’ বাবাকে বলল, ‘তুমি যাও, দোকান থেকে কিলো তিনেক নুন নিয়ে এসো।’
পাঁচ-ছজন লোক হাতে কোদাল-শাবল নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাবাও গেল দাদুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে, চাদরে মুড়িয়ে। একজন বলেছিল, ‘বলো হরি, হরি বোল—।’ তাকে কেউ থামাল। ‘হরিবোলের দরকার নেই। পুলিশ শুনতে পাবে!’
আমি যে অত ছোট একটা মেয়ে ওদের পেছন পেছন যাচ্ছি, তা বোধ হয় কেউ খেয়াল করেনি। কি দেখলেও কিছু বলেনি। রেললাইনের ওপারে ঝাঁটিগাছের জঙ্গলে কবর খুঁড়ে ওরা দাদুকে শুইয়ে দিল। দাদুর ধুতি, জামা সব খুলে নিল। শুধু যে লাঠিটা খটখট করে ঠুকে ঠুকে দাদু পাহারা দিত, সেই লাঠিটা বাবা দাদুর পাশে শুইয়ে দিয়েছিল। বাবার হাত থেকে নুন নিয়ে ওরা দাদুর ওপর ছড়িয়ে দিল। তারপর ওপরে মাটি দিয়ে মাথার কাছে একটা তুলসী চারা পুঁতে দিল। কাছেই একটা বড় পুকুর ছিল। সেখানে সবাই স্নান করে ফিরে এল আমাদের বাড়ি। তারপর নিজেদের ওঁচায় শুকনো চিঁড়ে-বাতাসা নিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল।
দাদু মারা যাওয়ার পর আমাদের আর খড়গপুরে থাকা হলো না। আমাদের জীবনের চৌকিদারই তো নেই আর। ঠাকুমার একটা পা আর দাদুকে সেই ঝাঁটি জঙ্গলে শুইয়ে রেখে আমরা সবাই আবার চলে এলাম দেশের বাড়ি।
এখন সেই বাড়িতেও আমি আর থাকি না। শ্বশুরবাড়ি হয়েছে। বর, ছেলে, বাড়ির আরও লোকজন সবাই আছে। শুধু এখানে আমার কোনো দাদু নেই। আমার ছেলেরও নেই। সে স্কুলে যায়, খেলে বেড়ায়। শোওয়ার সময় গল্প শুনতে চায় না। এমনি এমনিই ঘুমিয়ে পড়ে। তার পাশে ঘুমিয়ে পড়ি আমিও।
তবু এত বড় হয়ে গিয়েও এখনো কোনো কোনো দিন ঘুমের ঘোরে মনে হয়, দাদু সেই ঝাঁটি জঙ্গলের নিচে কবরের ভেতর থেকে বলছে, ‘হুঁশিয়ার— সাবধান— কে জাগে?’ কিন্তু আমি আর বলতে পারি না— ‘লালকমল জাগে আর নীলকমল জাগে।’ শুধু কোথাও ঝাঁটি জঙ্গল দেখতে পেলে গায়ের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে।