:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আসাদুল ইসলাম

কবি ও নাট্যকার

জননী সাহসিকা : অনন্তকালের লড়াইয়ে টিকে থাকা মানবতার শেষ পরিচয়দাত্রী
ছবি: ফেসবুক থেকে নেয়া

জননী সাহসিকা : অনন্তকালের লড়াইয়ে টিকে থাকা মানবতার শেষ পরিচয়দাত্রী

যুদ্ধের প্রধান উপহার মৃত্যু। মানুষের মৃত্যু। এই হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিক ইতিহাস চলছে দেশে দেশে। প্রতিদিন মানুষের রক্তে ভিজে যাচ্ছে পৃথিবীর মাটি। স্বজন হারানোর দীর্ঘশ্বাসে বিদ্ধ হচ্ছে বাতাসের প্রতি বর্গইঞ্চি। ইতিহাস এই রক্ত আর দীর্ঘশ্বাসের কর্কটরোগ বয়ে বেড়াচ্ছে, মানুষের জাত্যভিমান জাগ্রত হওয়ার পর থেকে। মনে হয় যেন ইতিহাসের পাতায় রক্তপাতের বাইরে একটি অক্ষরও লিখিত হয়নি। ইতিহাস পাঠ মানেই যেন রক্তের লাইন আর অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে অতীত ভ্রমণ। তেমন একটি ভ্রমণ কাহিনি ‘জননী সাহসিকা’, একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকার নাটক। ১৬২৪ সালের বসন্তকাল থেকে ১৬৩৬ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এই নাটকের কালপর্ব, যার পটভূমিতে আছে একটি ধর্মযুদ্ধ। প্রটেস্ট্যান্টদের সাথে ক্যাথলিকদের যুদ্ধ। যুদ্ধের সহিংস অস্থিরতার মধ্যে বের্টোল্ট ব্রেখটের কল্পিত জার্মান নারী অসম সাহসিকতার সাথে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার প্রাণপণ লড়াই জারি রাখে। যুদ্ধ তাকে সম্পূর্ণরূপে সর্বস্বান্ত করে দিলেও যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে না। আর সে নারীও তার লড়াই থেকে পিছু হটে না। যেন অনন্তকালের লড়াইয়ের সাথে অনন্তকাল ধরে টিকে থাকা মানবতার শেষ পরিচয়টুকু ধরে রেখেছে এক নারী, সে শুধু নারীই নয়, সে জননী, সে সাহসিনী, সে জননী সাহসিকা।

জননী সাহসিকা, সে কার জননী, আর কতটুকুই বা সাহস তার।

অ্যানা ফিয়ালিং, তিন সন্তানের জননী। এলিফ নয়োকি, বড় ছেলে। সুইস পনীর, ছোট ছেলে। কাট্রিন হপ্ট, একমাত্র কন্যা। বড় ছেলে ফরাসি, ছোট ছেলে সুইস আর মেয়ে হাফ জার্মান। তার সন্তানদের জন্মদানের মধ্য দিয়েই তার সাহসের সূত্রপাত। সাহসিকা নামটি এসেছে রিগার যুদ্ধে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের মধ্যে সে নারী অমিত সাহস দেখিয়ে তার ঠেলাগাড়িতে পঞ্চাশটি রুটি নিয়ে পালাতে পেরেছিল বলে। জননী সাহসিকা ভ্রাম্যমাণ ক্যান্টিনের মালিক, তার খাবার গাড়িটি নিরন্তর চলমান। পোলান্ড, মোরভিয়া, বেভেরিয়া, ইতালি আবার বেভেরিয়া। ডান পায়ে সে খুঁড়িয়ে হাঁটে। যুদ্ধের মধ্যেও বেঁচে থাকার তাগিদে, তিন সন্তানকে নিয়ে সে নারী রাস্তায় নামে তার ঠেলাগাড়িতে মালপত্র বোঝাই করে। যেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে গাড়ি ভর্তি করে একসঙ্গে গোটা দুনিয়া দেখতে বেরিয়েছে। তবে তার লক্ষ্য একটাই, ছেলেমেয়েসহ গাড়িটা নিয়ে দুর্যোগের কালটা কাটিয়ে দেয়া। রাস্তায় তারা মুখোমুখি হয় সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনীকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করে জননী সাহসিকা। অফিসাররা লাইসেন্স দেখতে চাইলে সাহসিকার সাহসী উচ্চারণ শোনা যায়, দ্বিতীয় প্রোটেস্ট্যান্ট সেনাশিবিরে আমার লাইসেন্স হলো আমার নিষ্পাপ মুখশ্রী। সাহিসিকার জোরালো কণ্ঠের সামনে দুই অফিসারকে ম্রিয়মান ও ন্যুব্জ দেখায়। তবু চতুর অফিসাররা প্রলোভন দেখিয়ে বড় ছেলে এলিফকে সেনাবাহিনীতে নিয়ে যায়, সেখানে এলিফ বীরত্ব দেখিয়ে নিজেকে জাহির করতে পারলেও, শেষরক্ষা হয় না। খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে এলিফকে একদিন মেরে ফেলা হয়, কিন্তু তার মা জানতে পারে না। মায়ের অগোচরে এক ছেলে বিদায় নিল পৃথিবী থেকে।

যুদ্ধ তার প্রতিটি সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে। এর চেয়ে তীব্র শোকের, তীব্র ব্যথার আর কী হতে পারে। তবু যুদ্ধ থামে না, চলতে থাকে সদর্পে। শোক আর ব্যথায় নুয়ে পড়া জননী, কোমর সোজা করে দাঁড়ায়। যুদ্ধের কাছে সে হার মানে না। তার ঠেলাগাড়িকে সে একাই টেনে নিতে থাকে। যুদ্ধ তাকে সাহসী করেছে, সংগ্রামী করেছে, সর্বহারা করেছে। সব হারিয়েও সে জীবনের কাছে পরাজিত হয়নি। একাকী লড়াইয়ের ময়দানে টিকে আছে জননী সাহসিকা।

জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত দুঃখ ও দুর্যোগের মধ্য দিয়েই জননী সাহসিকার পথ চলা। দুই ছেলে আগে গাড়ি টানত। বড় ছেলে সেনাবাহিনীতে চলে যাওয়ায়, মেয়েকে গাড়ি টানার কাজে সম্পৃক্ত করে। তার মেয়ে কাট্রিন হপ্ট, চুপচাপ, বোবা। বোবা মেয়েকে নিয়েও মায়ের রয়েছে আরেক টানাপড়েন। মেয়েকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে, তোমার কপাল ভালো যে তুমি বোবা। উল্টাপাল্টা কথা তোমাকে কোনো দিন বলতে হবে না। অসময়ে বা বেজায়গায় কথা বলার জন্য মাথা কুটে অনুশোচনা করতে হবে না তোমাকে কোনো দিন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ এই বোবাত্ব। যুদ্ধের সময় সৈনিকদের হাত থেকে সোমত্ত মেয়েকে রক্ষা করার জন্য কন্যার মুখে ছাই মেখে দিতে দিতে জননী সাহসিকা বলে, কোনো সৈনিক যদি একটা সুন্দর পরিষ্কার মুখ দেখে, ব্যস, দুনিয়ায় তাহলে আরেকটি বেশ্যার সংখ্যা বাড়ল। কোনো দিন কি তাকে বিয়ে দিতে পারবে, এ নিয়েও আছে জননীর দুঃশ্চিন্তা।

ছোট ছেলেও একদিন মাকে ছেড়ে চলে যায়, রেজিমেন্টের ক্যাশিয়ার পদে চাকরি নিয়ে। যুদ্ধের মধ্যে ক্যাথলিকদের আক্রমণে, ভয়ে দিশেহারা হয়ে রেজিমেন্টের ক্যাশ বাক্স সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে চলে আসে সুইস পনীর। এই অপরাধে এগারোটা বুলেট ঝাঁজরা করে দেয় তাকে। সুইস পনীরের লাশ সনাক্ত করার জন্য জননী সাহসিকার সামনে আনা হলে, সাহসিকা কন্যাকে জড়িয়ে ধরে শুধু না সূচক মাথা নাড়ে। সন্তানের লাশ চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে ভাগাড়ে, আর মা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছে। এর আর কোনো বিকল্প ছিল না মায়ের, কারণ মাতৃত্ব সুলভ অনুকম্পা দেখিয়ে যদি সৈন্যদের সামনে স্বীকার করত তার সম্পর্ক আছে লাশের সাথে, তাহলে মায়ের পরিণতি হতো সন্তানের মতোই। জীবনযুদ্ধের টিকে থাকার লড়াইকে বাঁচিয়ে রাখতেই মা হয়ে সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়। মানসিক দৃঢ়তা আর দুর্দান্ত সাহস ছাড়া কোনো মায়ের পক্ষে এতটা কঠোর হওয়া সম্ভব না। জননী সাহসিকার সাহসের চূড়ান্ত নিদর্শন সন্তানের লাশ সনাক্তকরণে অস্বীকৃতির দৃশ্যটি।

জননী সাহসিকা
নাটক: বের্টোল্ট ব্রেখট । অনুবাদ: কবীর চৌধুরী
নির্দেশনা: সঞ্জীব কুমার দে । নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: কামালুদ্দিন কবির

মায়ের সাহস কন্যার মধ্যে ভর করে। মায়ের অনুপস্থিতিতে এক রাতে সৈন্যরা সবাইকে বন্দি করতে শুরু করলে, কাট্রিন হপ্ট ঢোল পিটিয়ে অন্যদের সতর্ক করে দেয়। এই অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মা ফিরে এসে দেখে কন্যার লাশ পড়ে আছে। নির্বাক মা লাশের কপালে চুম্বন এঁকে দেয়। এখন সে একা। যুদ্ধ তার প্রতিটি সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে। এর চেয়ে তীব্র শোকের, তীব্র ব্যথার আর কী হতে পারে। তবু যুদ্ধ থামে না, চলতে থাকে সদর্পে। শোক আর ব্যথায় নুয়ে পড়া জননী, কোমর সোজা করে দাঁড়ায়। যুদ্ধের কাছে সে হার মানে না। তার ঠেলাগাড়িকে সে একাই টেনে নিতে থাকে। যুদ্ধ তাকে সাহসী করেছে, সংগ্রামী করেছে, সর্বহারা করেছে। সব হারিয়েও সে জীবনের কাছে পরাজিত হয়নি। একাকী লড়াইয়ের ময়দানে টিকে আছে জননী সাহসিকা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সাহসী প্রযোজনা জননী সাহসিকা। জননী সাহসিকা চরিত্রটি মঞ্চে সাহসের স্ফুলিংগ জ্বালিয়েছে। তার সন্তানদের আগলে রেখেছে। সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করছে। মদের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ সৈনিকের পশমী কোট ছিনিয়ে নিয়েছে। পাদ্রীর প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করেছে, নিজের ব্যক্তিগত জীবন শুরু করার তার কোনো ইচ্ছা নেই বলে। সুইস পনীরের লাশ সনাক্তকরণ দৃশ্যে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তাকে উন্মোচন করেছে। মঞ্চে সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তার কণ্ঠ থেকে ঝরেছে প্রত্যয় দীপ্ত স্বর, ‘উপর তলার মানুষের হারজিত মানেই সবসময় নিচের তলার মানুষের হারজিত নয়। আদপেই নয়। অনেক সময় উপর তলার মানুষের হার মানে নিচের তলার মানুষের জিত।’ কন্যার লাশকে সামনে নিয়ে সে ব্যথায় মুষড়ে পড়েছে, তখন সে ব্যথিত জননী। নাটকের আদ্যপান্ত যুদ্ধ। মঞ্চে সারাক্ষণ যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করেছে। সৈনিকরা আসছে, যাচ্ছে, পালাচ্ছে, মদ খাচ্ছে, ভাঙচুর করছে, গুলি করছে, মেরে ফেলেছে, লাশ টানছে। যুদ্ধ আর যুদ্ধ। যুদ্ধের আবার দুই অনুষঙ্গ ক্ষুধা এবং পতিতাবৃত্তি। সে দুটোও আছে নাটকে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের উত্তেজনায় ঠাসা সারা মঞ্চ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পুরান ঢাকা থেকে নতুন ঢাকায় এসে সদলবলে জানিয়ে গেল তাদের সৃজনশীল সাহসী এবং স্বপ্নবৎ আগমনী বার্তা, এ যাত্রায় তাদের সঙ্গী ছিল জননী সাহসিকা। তাদের আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছি। আগামীর প্রতিটি যাত্রায় তারা সফলকাম হোক, এই কামনা।

২০.০৫.২০১৯

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.