:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আসাদুল ইসলাম

কবি ও নাট্যকার

সৈয়দ জামিল আহমেদ ও অরাজনৈতিক পরাবাস্তবতা

সৈয়দ জামিল আহমেদ ও অরাজনৈতিক পরাবাস্তবতা

পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যাবার ফলে যে ঘটনার সূত্রপাত তার সাথে নাটকের বাসিন্দারাও জড়িয়ে পড়ে। উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনে ঘটে যাওয়া এই আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত এসে বাঁক নেয় বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মঞ্চে। যে মঞ্চটি আধুনিকায়নের আগে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অসামান্য দুটি প্রযোজনা চাকাবিষাদ সিন্ধু নাটকের ইতিহাসকে বুক চিতিয়ে ধারণ করে আছে, অধুনা সেই মঞ্চে এসে উপবিষ্ঠ হলেন এসময়ের আধুনিক মানুষ ‘জামিল আহমেদ’, যিনি শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসকে সম্প্রতি নাট্য প্রযোজনার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটিয়ে প্রবাদপ্রতিম কাণ্ডের দ্বারা সমাজকে বেশ একটা ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হন। এবং নাটকের বাসিন্দারা বুঝতে পারে এখনই সেই মহার্ঘ সময়, এই উছিলায় যদি তার সাথে মত বিনিময় সম্ভব হয়। এবং এগিয়ে আসে বটতলা, ‘বটতলার আলাপ ৪’ শিরোনামে তারা সুচারুরূপে সম্পন্ন করে আয়োজন। সঞ্চালনার দায়িত্বটি পড়ে তারই এক সময়কার ছাত্র এবং বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী শাহমান মৈশানের উপর।

নাটকের বাসিন্দারা নানা ধরনের প্রশ্ন নিয়ে, মূলত ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাস ও নাটককে ঘিরে যেখানে ১৯৭১ সালের দুর্যোগ কবলিত আকাশে কাকেরা উড়ে বেড়াত মানুষের মাংসে উদরপূর্তির আয়েশে। মিলিত হন সেই মিলনায়তনে যার বর্তমান পরিচয় ড. নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তন, যার প্রতিটি আসন দর্শনীর বিনিময়ে সেদিন পূর্ণ হয়ে যায়, যদিও সেদিনটা ছিল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে দুই হাজার উনিশ সনের কোনো এক শুক্রবার। বাইরের আবহাওয়ায় ছিল টানটান ব্যথার পারদ। বঙ্গোপোসাগর বা তৎসংলগ্ন অস্থিরতায় চঞ্চল মেঘেরা ফণী নামক প্রাকৃতিক সংহারের ভয়ে উড়িষ্যার উপকূল থেকে উড়ে আসা বাতাসে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছিল। নাটকের বাসিন্দারা সেদিন মেঘলা শুক্রবারের সকালে বেইলি রোডে একত্রিত হবার পর তাদের মনে পড়ে ১৯৭১ সালে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ২৬শে মার্চ তারিখে, সেদিনটাও ছিল শুক্রবার এবং জামিল আহমেদের স্মৃতিচারণে তারা জানতে পারে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শান্ত শিষ্ট জামিলের পকেটে থাকত ভয়াবহ গ্রেনেড, যে গ্রেনেডের পিন বা ক্লিপ খোলাই থাকত, এবং খোলা ক্লিপের উপর আঙুল চেপে রাখতে হতো কারণ আঙুল সরে গেলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেনেড বিষ্ফোরিত হবার সম্ভাবনা ছিল। এমন একটা ঝুঁকি নিয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, এবং তিনি ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। যুদ্ধের ময়দানে তার সাথে বাচ্চু ভাইয়ের সখ্য। নাসির উদ্দীন ইউসুফ, যিনি ছিলেন রণাঙ্গনের যোদ্ধা এবং যুদ্ধের অব্যবহিত পর স্বাধীন দেশে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই নাসির উদ্দীন ইউসুফের নেতৃত্বে জামিল আহমেদ গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন, এবং আরও পরিচয় হয় সেলিম আল দীনের সাথে।

নাটকের বাসিন্দারা সেদিন মেঘলা শুক্রবারের সকালে বেইলি রোডে একত্রিত হবার পর তাদের মনে পড়ে ১৯৭১ সালে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ২৬শে মার্চ তারিখে, সেদিনটাও ছিল শুক্রবার এবং জামিল আহমেদের স্মৃতিচারণে তারা জানতে পারে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শান্ত শিষ্ট জামিলের পকেটে থাকত ভয়াবহ গ্রেনেড, যে গ্রেনেডের পিন বা ক্লিপ খোলাই থাকত, এবং খোলা ক্লিপের উপর আঙুল চেপে রাখতে হতো কারণ আঙুল সরে গেলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেনেড বিষ্ফোরিত হবার সম্ভাবনা ছিল।

তিনি জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ৬৩ বছরে এসে উপনীত হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি অনেকবার হতাশ হয়েছেন। হতাশ হয়ে দুইবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে তার ডিভোর্স হয়েছে, কিন্তু তিনি কখনো পড়ালেখা ছাড়েননি, থিয়েটার ছাড়েননি। থিয়েটার কেন করেন এ বিষয়ে তার ধারণা পুরোপুরি স্বচ্ছ। তার মতে, আমি থিয়েটারটা করছি কারণ থিয়েটার না করে আমি পারি না, আমি থিয়েটার না করে খেতে পারি না। এই প্রত্যয়ের প্রসঙ্গে তার মনে পড়ে যায় বাদল সরকারের কথা, যিনি আর্বান আর্কিটেক্ট ছিলেন এবং সব ছেড়ে দিয়ে যিনি থিয়েটার শুরু করেন। বাদল সরকার বলেছিলেন, ‘এই কাজ ছাড়া তার আর উপায় নেই’, তখন তিনি পরিস্কারভাবে কথাটার অর্থ ধরতে পেরেছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি থিয়েটারের সাথে যুক্ত হবার ইচ্ছা থেকে ঢাকা থিয়েটারে যোগদান করেন। তার মনে হচ্ছিল যে থিয়েটার একটা মাধ্যম যেখানে নিজের কথা বলা যায়। যেখানে কেউ বলে দেবে সেটা বলতে হবে না। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ইংরেজি বিভাগের। ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়া নিয়ে তিনি তার বাবার সাথে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। বাবা চেয়েছিলেন ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হন তিনি, কারণ এইচএসসিতে তার রেজাল্ট ভালো হয়েছিল। যদিও উপস্থিত নাটকের বাসিন্দারা পরে জানতে পারে তার এই ভালো রেজাল্টের পিছনে ছিল তার একজন মৃত বন্ধুর ভূমিকা। জামিল আহমেদ সেদিন পিতার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে নয়, নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজি বিভাগকে বেছে নেন। ক্লাসে তিনি প্রশ্ন করতে দ্বিধা করতেন না, শিক্ষকদের কাছে যা বুঝতেন না, জানতে চাইতেন। তার মনে পড়ে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা তাকে ধীরে ধীরে জীবন বুঝতে শিখিয়েছিল।

ব্রেটল্ট ব্রেখট, যিনি খ্রিস্টপূর্ব অ্যারিস্টটলীয় নাট্যভাবনার বিপরীতে নতুন নাট্যরীতির জনক হিসেবেই শুধু নয়, সারাবিশ্বের শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে একজন বিপ্লবী নাট্যতাত্ত্বিক হিসাবেও পরিচিত, তার কাছ থেকে জামিল আহমেদ মার্কসিজম বোঝা শুরু করেছিলেন, সমাজ বোঝা শুরু করেছিলেন। সমাজের প্রতি তার রয়েছে অশেষ দায়ভার। এই সমাজকে তিনি ঝাঁকুনি দিতে চান, নাড়া দিতে চান। সমাজকে নাড়া দেবার প্রধান অস্ত্র তার কাছে নাটক। আমাদের সমাজে ভালো নাটকের জন্য হাপিত্যেশ করতে দেখা যায়। কিন্তু জামিল আহমেদ বোঝাতে চান, নাটক ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে এমন সমীকরণ দিয়ে নাটককে পরিমাপ করা যায় না। বীভৎস রসের নাটক ভালো লাগবে না। কিন্তু সেটা যদি দর্শককে নাড়িয়ে দিতে পারে তবেই সেটা নাটকের সার্থকতা। তবে নন্দনতাত্ত্বিকভাবে নাড়াতে হবে বা ধাক্কা দিতে হবে বা দাগ ফেলতে হবে। তার মতে মুকুন্দ দাস শেকসপিয়ার সার্থক। তারা এমন কিছু উপস্থাপন করেছিলেন যা ঐ সময়ের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে জনপ্রিয় ভাষায় উপস্থাপন করতে পারলে দর্শকের ভেতর দাগ কাটতে পারবে। মুকুন্দ দাস সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তা পেরেছিলেন। আর শেকসপিয়ার সবসময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক কারণ তার নাটকের সংলাপের অর্থ এখনো নির্ধারণ হয়নি। তিনি বলেন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাটকটি কিছু মানুষকে এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে ভালো মন্দ কিছু না কিছু তারা বলতে বাধ্য হচ্ছে।

‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাটকের একটি দৃশ্য।

তিনি ২টি নাট্য প্রযোজনার জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়েছিলেন। এই সহায়তা খুব সহজে ধরা দেয়নি, এর জন্য তাকে ষাট বছর বয়স অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং প্রমাণ করতে হয়েছে তিনি জামিল আহমেদ। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই তার জীবনে সত্য। যদিও তার কাছে চিরস্থায়ী সত্য বলে কিছু নেই। তিনি নিয়ম ভাঙার মানুষ। তবে তিনি মনে করেন নিয়ম ভাঙার জন্যই নিয়মটা ভালোভাবে জানতে হবে। সোশিওলোজি তার পছন্দের বিষয়। সোশিওলোজি তাকে শিখিয়েছে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু তথ্যের দরকার হয়, ধারণা দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা হয় না। নাটকের ছাত্রদেরকে তিনি সোশিওলোজি পাঠে উৎসাহিত করেন এবং তার ডিপার্টমেন্টে স্টুডেন্টদের সোশিওলোজি পড়ানো হয় বলে জানা গেছে। নাটক এমন একটি মাধ্যমে যেখানে প্রায় সব ধরনের শিক্ষাকে আত্মীকরণ বা অন্তর্ভূক্ত করা যায়। সাধারণভাবে মনে করা হয় নাটকের দ্বন্দ্বটাই আসল। কিন্ত জামিল আহমেদ স্মরণ করিয়ে দিলেন নাটকের জন্য দ্বন্দ্ব অপরিহার্য নয়, অপরিহার্য হলো ঘটনা, যে ঘটনা মঞ্চে এমন কিছু ঘটাবে যা নতুন প্রশ্ন তুলবে। জামিল আহমেদ কোনো ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পান না। প্রশ্নের উত্তরে তো-তো করেন না। যেটা জানেন সেটা স্পষ্টভাবে নিঃসংশয়ে প্রকাশ করেন। নাটক প্রসঙ্গে তিনি বলেন ইউরোপ আমাদের ফর্মটা শিখিয়েছে, ফর্ম ভেঙে খেলতে পারলে সেটা কিছু করা হলো। ইউ প্লে উইথ ফর্ম। জাতীয় নাট্য অঙ্গিক নির্মাণের প্রেক্ষিত তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে তিনি আর ব্রতী নন।

আর অভিনয় প্রসঙ্গে বলেন- অভিনয় করার সময় ভান করলে চলবে না, অভিনয় করতে হবে মন দিয়ে। আমরা জানতে পারি অভিনয় ক্রিয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপদেশ দেয়া হয় চরিত্রকে ধারণ করতে, আর জাহাঙ্গীরনগর থেকে বলা হয় ডুব দিতে। তিনি এদুটোর কোনোটাই বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন, অভিনেতার কাজ হলো ট্রায়েল এ্যান্ড এরোর পদ্ধতিতে এগিয়ে যাওয়া, টেক্সটের অর্থ দর্শককে বুঝিয়ে দেয়া। এখানে সতর্ক থাকতে হবে পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে যেন শুকিয়ে না যায়। ভান করলে অভিনয় হবে না। অভিনেতাকে কাল্পনিক ভুবনের ঘটনার সাথে মিশে সে জগতের সত্যটাকে বুঝতে হবে এবং সেই সত্যটাকে মঞ্চে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি জর্জি গ্রটস্কি প্রণীত অভিনয় তত্ত্ব Conjunctio Oppositorum বা বিপরীতের যুগপৎ সমন্বয় প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে এসে তিনি বুঝলেন, ‘থিয়েটার আমাকে জীবনটাকে উপলব্ধি করতে দেয়, যদি উপলব্ধি করতে দেয় তাহলে আমি কেন উত্তেজিত হব না, কেন আমাকে সংবাদ পাঠকের মতো আপনাকে বলতে হবে। আমি কখনো এরকম শিক্ষক ছিলাম না, আমি কখনো এরকম পরিচালক হতে চাই না, আমি কখনো এরকম নাট্যকর্মী হতে চাই না। আমি যতই উত্তেজিত হই না কেন, আমি চাই আপনি আমার যুক্তিটা শোনেন’।

‘থিয়েটার আমাকে জীবনটাকে উপলব্ধি করতে দেয়, যদি উপলব্ধি করতে দেয় তাহলে আমি কেন উত্তেজিত হব না, কেন আমাকে সংবাদ পাঠকের মতো আপনাকে বলতে হবে। আমি কখনো এরকম শিক্ষক ছিলাম না, আমি কখনো এরকম পরিচালক হতে চাই না, আমি কখনো এরকম নাট্যকর্মী হতে চাই না। আমি যতই উত্তেজিত হই না কেন, আমি চাই আপনি আমার যুক্তিটা শোনেন’।

সেদিন জমায়েত নাটকের বাসিন্দারা জানতে পারে যে সৈয়দ জামিল আহমেদ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। যে কলেজকে তিনি খুব ভালোবাসতেন, তার কাছে কলেজটাকে মনে হতো অসাধারণ জায়গা। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে পড়াশুনা অসমাপ্ত রেখে সেই ক্যাডেট কলেজ থেকে তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল, যা ছিল তার জন্য অত্যন্ত বেদনার। তিনি একা হয়ে পড়েন, কারও সঙ্গ তার ভালো লাগত না, কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হতো না, মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েন, একা একা তিনি তলিয়ে যেতে থাকেন, জীবনে এমন এক সন্ধিক্ষণে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় শামীম মাজহার, যে কিছু দিন হলো ঝিলের জলে ডুবে মারা গেছে, তার এক মৃত বন্ধু। তার যাপিত জীবনের তরঙ্গে, পরাবাস্তবতার ঢেউ এসে জমাট বাঁধে। একটি বিষাদাত্মক প্রস্থান, কয়েকটি নিঃসঙ্গ রাত ও একজন মৃত বন্ধু, তার জীবনে আচমকা নতুন একটা বাঁক নিয়ে আসে। একাকী বিচ্ছিন্ন বিপর্যস্ত জীবনের দিনগুলোতে তার সঙ্গে বাস করতে থাকে তার মৃত বন্ধু মাজহার, শামীম মাজহার।

লেখাপড়ায় তখন জামিল আহমেদের খুব একটা গা ছিল না। তিনি বাংলা লিখতে পারতেন না, ইংরেজি লিখতে পারতেন না, অংক বুঝতেন না, জ্যামিতি ভালো লাগত না, বীজগণিত বুঝতে পারতেন না। মৃত মাজহার তাকে অংক ইংরেজি বাংলা জ্যামিতি শেখাত, তিনি জ্যামিতির সূত্রগুলো ভালোভাবে বুঝতে শুরু করেন, ভালো বাংলা ও ইংরেজি লিখতে শুরু করেন, অনেক অনেক রাত, অ্যালজেবরা জ্যামিতি তার কাছে ভালো লাগতে শুরু করে। সে সময় তাকে শাহীন কলেজে ভর্তি করানো হয় এবং তার রেজাল্ট খুব ভালো হতে শুরু করে। তার রেজাল্ট ভালো হবার পিছনে তিনি জানতেন যে মাজহারের অবদান আছে, যে মাজহারের সাথে তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে একসাথে পড়তেন। ধরে নেয়া হয় যে মাজহারকে তিনিই খুন করেছেন। একদিন দুই বন্ধু মিলে কলেজের পিছনের পাহাড়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে যায় এবং তিনি একা ফিরে আসেন, তার বন্ধু ঝিলের জলে ডুবে মারা যায়। মাজহারের মৃত্যুর পর সবাই মনে করতে থাকল মাজহারকে হয়তো জামিলই মেরেছে। তিনি তখন বিপর্যস্ত বোধ করতে থাকেন, বিপন্ন বোধ করতেন, এরকম অসহায়ত্বের দিনে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল কিচ্ছু হবে না জামিল। তখন তিনি বুঝতে পেরেছিল হিউম্যান কনট্যাক্ট কি, মানুষ মানুষকে জড়িয়ে ধরার মানে কি, পাশে দাঁড়ানোর মানে কি। তার পর থেকে তিনি জানেন হাত রাখাটা মানে কি, ধরাটা মানে কি।

‘বটতলার আলাপ ৪’-এ জীবনের গল্প বলছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।

সহপাঠী হত্যার সন্দেহে তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে ফেরত পাঠানো হয়, এটা ছিল তার জীবনের একটা হিউজ শক। তার বাবা তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে ফিরিয়ে আনে। এরপরের দুঃসহ দিনগুলোতে মাজহার ফেরত আসে, এবং তাকে গভীর খাঁদ থেকে টেনে তোলে। তিনি মাজহারকে জিজ্ঞেস করতেন, মাজহার তুমি কি মনে করো আমি তোমাকে হত্যা করেছি, মাজহার বলত, ‘না’। জীবিত মাজহারের চেয়ে মৃত মাজহারকে তার সত্যিকারের বন্ধু মনে হতে থাকল, এবং বন্ধু তাকে লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনল। এবং তিনি পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বোধ করতে শুরু করলেন, যে আগ্রহ তার আজও ফুরায়নি। যত ঝড় ঝাপটাই আসুক না কেন তিনি পড়ালেখার বাইরে একটি দিনও কাটান না। তার জীবনের দোদুল্যমান সময়ে আসে জাতির জীবনের সবচেয়ে প্রার্থিত কিন্তু রক্তপাতে প্লাবিত উনিশ শ একাত্তর সন। তিনি যুদ্ধে যান, এবং বিজয়ী হয়ে ঘরে ফেরেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে তার নতুন একটা সংকট শুরু হয়। তিনি ভাবতে শুরু করলেন, কেন তিনি বেঁচে থাকবেন, শামীম মাজহারকে তিনি যদি হত্যা করে থাকেন তাহলে তার মরে যাওয়া উচিত। তিনি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যান। এই সংকট থেকে উত্তরণে তিনি সৌভাগ্যক্রমে জাঁ পল সাত্রের শরণাপন্ন হন। তিনি সাত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শনের উপর পড়াশুনা শুরু করেন। তিনি উপলব্ধি করা শুরু করেন জীবনটা শূন্য হতে পারে কিন্তু সেই শূন্যতা অর্থপূর্ণ করা যায় কাজের মাধ্যমে। তিনি ভাবতে শুরু করেন থিয়েটার দিয়ে তিনি তার জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে পারবেন। তিনি গান গাইতে না পারলেও, ছবি আঁকতে না পারলেও থিয়েটারটা পারেন। তিনি থিয়েটারকে গানের মতো সুরে ভাসাতে পারেন, তিনি থিয়েটারকে ছবির মতো আঁকতে পারেন। যার নমুনা আমরা সম্প্রতি ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায়’ খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছি।

জীবনে বেঁচে থাকার জন্য তার কাছে থিয়েটারটা সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। জীবনটাকে অর্থপূর্ণ করার জন্য তিনি থিয়েটার করা শুরু করেন। তার নাটক দেখার পর কেউ যখন বলে খুব ভালো লেগেছে বা খারাপ লেগেছে বা নাটক দেখে যখন কেউ তাকে গালি দিয়েছে, তিনি বুঝতে পারেন, মানুষগুলো নাটক দেখে তাড়িত হয়েছে বা দৈনন্দিন জীবন যাপনের ভিতর নাটকটা কোথাও একটা নাড়া দিয়েছে বলেই বলতে বাধ্য হয়েছে। নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষকে বা সমাজকে নাড়া দিতে পারলে তিনি তখন বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজে পান। নতুবা শিশু পাশে থাকত, বা বধু পাশে থাকত, তবু জ্যোৎস্নায় ভূত দেখার জীবন নিয়ে তার বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে উঠত, এবং লাশকাটা ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করতে হতো। জামিল আহমেদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি কারণ তিনি এখনো থিয়েটার করে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এটাই বুঝেছেন যে থিয়েটার না করে তিনি পারেন না।

০৯.০৫.২০১৯

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!