:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
দেবদ্যুতি রায়

গল্পকার

ঝরোকা
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

ঝরোকা

এক.
নতুন অফিসটা আমার পছন্দ হয়েছে খুব। অফিস পছন্দ হবার প্রথম শর্ত টিম পছন্দ হওয়া। অন্যান্য সবকিছু আজকালকার ভালো অফিসগুলোতে এমনিই থাকে- ঝা চকচকে ভবন, চমৎকার লিফট, সার্বক্ষণিক এসি, প্রচুর স্টাফ, সর্বোপরি ভালো কাজের পরিবেশ। এখানে এসবের সাথে বাড়তি পাওনা চমৎকার মনের মতো টিম। এক ঝাঁক তরুণ ছেলেমেয়ের সাথে ফোকাল পার্সন হিসেবে কাজ করতে পারা কম সৌভাগ্যের না। এর আগের কোনো অফিসেই এতগুলো চমৎকার মানুষের সাথে কাজ করতে পারিনি আমি।

এই অফিসে আমাদের টিমের কাজ বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর কনটেন্ট তৈরি করা। এসব বিষয়ে বই, ভিডিও ইত্যাদি তৈরির দায়িত্ব আমাদের। সেগুলো পরে চলে যাবে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে, তার জন্য আলাদা টিম আছে। এদেশে বয়ঃসন্ধিকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও প্রতিটা মানুষের জীবনে এই সময়টা আসলেই খুব অন্যরকম সময়। এ সময়ে মানুষের শরীর আর মনের যত্ন দরকার অনেক বেশি।

ইন্টারনেট ঘাঁটলে এসব বিষয়ে প্রচুর তথ্য খুব সহজেই মেলে। তবে সত্যিকারের ভালো তথ্য বা আইডিয়ার জন্য অনেক বেশি খাটতে হয়। আমি এর আগেও কনটেন্টের কাজ করেছি। তবে এই কাজের তুলনায় সেগুলো কিছুই না। এই কাজটা অল্প কদিনেই তাই ভালবেসে ফেলেছি।

এই টিমে কাজ করার আনন্দ আছে। জয়িতা, স্বণন, রূপম, আফসানরা সবাই নিজের নিজের কাজে এত ভালো যে আমার তেমন মাথা খাটাতে হয় না। ওদের কাজগুলোর একটা ফিনিশিং টাচ দেয়ার পাশাপাশি আমি আসলে নেটে ঘুরে ঘুরে আইডিয়া ডেভেলপ করি। প্রায় প্রতিদিনই একটা মিটিং থাকে পুরো টিমের সাথে। তাতে এই আইডিয়াগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয় যাতে ওরা সেগুলো নিয়ে সহজেই কাজ করতে পারে। ওয়েবসাইটের লিংকগুলোও ওদের দিয়ে দিই। হেডফোনে গান শুনতে শুনতে ওরা নিজেদের কাজ করে। সবার কাজগুলো নিয়ে আমি প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদের প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর শামস-ই-আরাফাতের সাথে বসি। এই টিমের খুব কম কাজেই আবার নতুন করে হাত দিতে হয়, বেশিরভাগগুলোই একবারে ঠিকঠাক থাকে। অন্তত ডিরেক্টর তাই বলেন।

বাহ্! বেলজিয়ামের এই ওয়েবসাইটটা দারুণ তো! অনেক স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওরা চমৎকার কাজ করেছে পিউবার্টির স্বাস্থ্যসমস্যা বিষয়ে। আমি একটা একটা করে ওদের ছবিগুলো দেখতে থাকি, ছবির নিচের ক্যাপশন পড়লেই মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে যায় তাদের কাজ সম্পর্কে। তারপরও ছবিগুলো দেখা শেষে আর্টিকেলগুলো পড়ব। মেসেঞ্জারে সবাইকে লিংক পাঠিয়ে দিই। কাজটা করতে করতেই মনে হয় আপাতত এক কাপ চা খাওয়া দরকার।

এই অফিসে চায়ের ব্যবস্থাটা চমৎকার। প্রতিটা টিম রুমের বাইরে ব্যালকনিতে চায়ের সরঞ্জাম রাখা থাকে। ওখান থেকে বানিয়ে খেতে হবে। কেউ চাইলে তার নিজের পছন্দের ফ্লেভার নিয়ে আসতে পারে। এই মুহূর্তে আমি আমার প্রিয় আর্ল গ্রে দিয়ে কড়া এক কাপ কড়া চা খেতে চাই। এ ঘরের সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে ডেস্কটপে। আমি একা উঠে ব্যালকনিতে যাই, টি মেকারে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে ডেস্কে ফিরে আসি।

সারাদিনের অফিস করার পর অনেক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে এলাম মাত্রই শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে। এখন মায়ের কথা মনে করার সময় নয়। মায়ের কথা ভাবলেই আমার ভীষণ কান্না পায়, একা ফ্ল্যাটের নরম ম্যাট্রেসের বিছানার সফেদ চাদর আর তুলো বালিশ ভিজে যায় চোখের জলে। অসময়ে ছবি হয়ে যাওয়া ছবির মতো সুন্দর কাজরী মজুমদারের কথা মনে পড়লে এ পৃথিবী আমার আর ভালো লাগে না। বিষে নীল হয়ে যাওয়া মায়ের অপূর্ব শরীরটার কথা আমি কোনো সময়ের জন্য ভুলতে পারি না।

হেই, ঝরোকা, কী খবর- কেবল চায়ে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় ঘাড়ের পেছনে এমন কথা শুনে ফিরে তাকাই। এইচ আরের রিফাত, ঝকঝকে স্মার্ট আর সুদর্শন।

আরে, আপনি? কেমন আছেন- রিফাতের দিকে তাকিয়ে হেসে বলি- চা খাবেন?

রিফাত হ্যাঁ বলে মিষ্টি হেসে, রাজি না হবার কোনো কারণই নেই তার। ব্যালকনি থেকে নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে এসে সোফায় বসে। এ অফিসের অন্য সব ঘরের চেয়ে এ ঘরের ডেকোরেশন আলাদা। ঘরের চার দিকের দেয়াল ঘিরে সবার বসার জায়গা। আয়তাকার ঘরটার মাঝখানটা ফাঁকা ছিল আগে। আমি জয়েন করার পর তিন সিটের এ সোফাটা আনিয়েছি রিকুইজিশন দিয়ে। আমার সিটের একটু পেছনেই সোফাটা রাখা। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে ঘরের মাঝখানে বসে একটু গা এলিয়ে দেয়া যায়। কয়েকজন মিলে গল্পও করা যায়, আড্ডা দেয়া যায়। সোফাটার জন্য ঘরের সৌন্দর্যও বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।

নিজের রোলিং চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে রিফাতের সাথে গল্প করতে থাকি, সাথে চায়ে ছোট ছোট চুমুক দিই। এটা ওটা তুচ্ছ গল্প। আসলে এই মুহূর্তে রিফাতের সাথে গল্প করার কিছু নেই আমার। ওর আছে অনেক গল্প, আমি জানি কিন্তু ও সংকোচে কিছু বলতে পারে না। রিফাত প্রায়ই আসে এ ঘরে, সবার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলে, চলে যায়। স্বণন সেদিন মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলেছিল- রিফাত ভাই ইদানিং খুব আসছে, আপু। বুঝতে পারছ?

স্বণনের কথা শুনে আমি নিরুত্তর একটু হেসেছি শুধু। রিফাত আজকাল কেন প্রায়ই আসে এ রুমে এটা বুঝতে হলে রকেট বিজ্ঞানী হতে হয় না। নিজের রূপ গুণের প্রশংসা শুনে শুনেই আমি বড় হয়েছি। অনেকেই আগ বাড়িয়ে বলেছে- আরে! সুন্দরী মেয়েরা যে এত স্মার্ট, বুদ্ধিমতী হয় আর এত ভালো কাজও করে, এমনটা দেখিনি কিন্তু। খামতি একটা না একটা থাকেই সবার। তুমি ব্যতিক্রম।

তাদের কথায় আমি স্বলজ্জ হেসে বলি- কী যে বলেন না! আমি আর এমন কী?

কিন্তু তাদের কথা যে সত্যি তা আমি জানি। নিজের রূপের পাশাপাশি কাজেও যে আমার দারুণ দক্ষতা, এটা আমার জানা কথা। আমি আর সবার চেয়ে ব্যতিক্রম, আমি জানি। আমার মনে মনে হাসি পায় যখন মনে পড়ে আমি ঠিক কতটা ব্যতিক্রম সেটা এ পৃথিবীর অন্য কারও বোঝার সাধ্য নেই।

রিফাতের সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল এ রুমেই। নিজের পরিচয় দেয়ার সময় আমি বলেছিলাম- ঝরোকা, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ওয়াও! ঝরোকা! আপনার মতোই আপনার নামও নিখুঁত সুন্দর- রিফাতের মন্তব্য শুনে আমি হেসে ফেলেছিলাম। ও যে কথাবার্তায় দারুণ চটপটে আমার জানা হয়ে গিয়েছিল সেদিনই।

চা শেষ করে আরও দু’চারটা গুরুত্বহীন কথা বলে রিফাত চলে যায়। রিফাত সম্পর্কে বলা স্বণনের কথাটা মনে পড়ে। আমি স্বণনের ডেস্কের দিকে তাকাই। না, এদিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। বেশ চুপচাপ ও কাজ করে যাচ্ছে এক মনে। বেচারা স্বণন! ও জানে না, স্মার্ট সুদর্শন ছেলেদের সাথে এত সহজে আমি বন্ধুত্ব করি না। তাদের সাথে এমন খোলামেলা বন্ধুত্বে আমার ঘোরতর আপত্তি, নিজের স্বার্থেই।

দুই.
অফিস থেকে ফিরে রোজ উষ্ণ জলে স্নান করি আমি। তিন কামরার বড়সড় এই ফ্ল্যাটটায় রাজ্যের শান্তি বিরাজ করে আমার জন্য। এ আমার একার মন খুলে চোখ খুলে থাকার জায়গা। স্নানের পর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বাথরুমের বড় আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা আমার অনেক বছরের অভ্যেস। এ কাজে আমার কখনোই ক্লান্তি আসে না। যে কোনো নিখুঁত দেহবল্লরীই চোখের আরাম এনে দেয়। আর তা যদি নিজের হয় তবে আরামের সাথে সাথে অহংও চলে আসে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, চমৎকার বড় বড় চোখ, পাতলা সুন্দর ঠোঁট, কোঁকড়ানো কালো কুচকুচে চুল, ফুলের মতো মসৃণ হাত পা দেখতে দেখতে আমি সেই অহংটুকু ভীষণ উপভোগ করি।

রোজ রান্না করা হয় না আজকাল। অন্য সবার মতো রোজ রোজ ভাত, রুটি খেতে ভালোও লাগে না আমার। আজ রাতে পাস্তা খাবো ঠিক করে ফেলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পায়ে লোশন লাগাতে লাগাতে। আহ্! কী অপূর্ব সুন্দর এই পা জোড়া! আর কী মোলায়েম! পায়ে দামি বিদেশি লোশন মাখতে মাখতে আমি আবার নার্সিসিজমে ভুগি।

আমার মায়ের পা ঠিক এই রকমই ছিল। এরকমই লম্বাটে, চিকন, মখমলি আঙ্গুল ছিল তার। কিংবা সেই পা জোড়া ছিল আরও সুন্দর। যে কেউ তাকে দেখলেই বুঝত মা ছিল পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। আমি মায়ের কাছে কিছুই নই। হেলেন কিংবা ক্লিওপেট্রাকে খুব স্বভাবতই দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। মা নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে নিচের কাতারে পড়ত না সৌন্দর্যের সংজ্ঞায়। না, না। সারাদিনের অফিস করার পর অনেক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে এলাম মাত্রই শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে। এখন মায়ের কথা মনে করার সময় নয়। মায়ের কথা ভাবলেই আমার ভীষণ কান্না পায়, একা ফ্ল্যাটের নরম ম্যাট্রেসের বিছানার সফেদ চাদর আর তুলো বালিশ ভিজে যায় চোখের জলে। অসময়ে ছবি হয়ে যাওয়া ছবির মতো সুন্দর কাজরী মজুমদারের কথা মনে পড়লে এ পৃথিবী আমার আর ভালো লাগে না। বিষে নীল হয়ে যাওয়া মায়ের অপূর্ব শরীরটার কথা আমি কোনো সময়ের জন্য ভুলতে পারি না। তবু এই মুহূর্তে মায়ের কথা ভাবা বাদ দিয়ে আমি উঠে আসি।

সোহান খুন হয়ে গিয়েছিল আজকের রাতে। দেখতে দেখতে কেমন এক বছর হয়ে গেল! অথচ মনে হয় এই সেদিনের কথা। জলে ডুবে মরেছিল সোহান। সাঁতার না জানা সোহানের নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছিল জলে ডুবে যেতে যেতে। অনেকেই বলে সোহান আত্মহত্যা করেছিল কিন্তু আমি জানি সোহানের মৃত্যু একটা নিশ্চিত হত্যাকাণ্ড। জীবনকে অমন করে ভালবাসতে পারা সোহান নিজে নিজে কিছুতেই মরে যেতে পারে না।

সংবাদপত্র সকালে পড়ার সময় হয় না। ওটা আমি রাতেই পড়ি। চাইলে অনলাইনেই পড়ে ফেলা যায়। তবু আমার কাছে কাগজের আবেদন সবসময়ই অনেক বেশি। প্রতিদিন রাতের খাবার শেষে এক মগ কফি হাতে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আমি পত্রিকা পড়ি। আজ খেলার পাতা, দেশের খবরসহ পুরো পত্রিকা পড়ে কাগজটা মুড়িয়ে রাখি। দেয়ালে চল্লিশ ইঞ্চির ব্রাভিয়া টাঙানো থাকলেও টিভি দেখি কালেভদ্রে। আজও টিভি দেখতে ইচ্ছে করছে না।

মায়ের কথা আজ কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আবছা নীল আলোয় এই ঘর কেমন মায়াময় লাগে এখন। এমন মায়াময় ঘরে আমার আবারও মনে পড়ে জগতের সবচেয়ে মায়াময় মুখটার কথা। সে মুখে এক পৃথিব স্নেহ ঝরে পড়ত আমার জন্য। মাকে যখন তার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল বিষে নীল অবস্থায়, আমি তখন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সতের বছরের জীবনটা হঠাৎ থমকে গিয়েছিল এক অন্ধকার গহ্বরের মুখে।

মা আত্মহত্যাই করেছিল। বিষের শিশিটা মা নিজেই খালি করে ঢেলে দিয়েছিল মুখে, এতে আমারও কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এটা আমি নিশ্চিত জানতাম আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ কোনোমতেই মা নিজে নয়। মা কিছুতেই তার একমাত্র মেয়েকে এই পৃথিবীতে একা করে রেখে মরে যেতে পারে না নিজের খামখেয়ালিতে। আমার ঝরোকা নামটা মায়ের দেয়া। ততদিনে আমার বয়স সতের, স্কুল কলেজের সমস্ত কাগজে নাম উঠে গেছে, না হলে আমি আজীবনের জন্য ঝরোকা হোসেন না হয়ে ঝরোকা মজুমদার হয়ে থাকতাম।

ইমতিয়াজ হোসেন নামের জঘন্য যে লোকটা আমার বাবা, সেই লোকটাই আমার মায়ের হত্যাকারী। হ্যাঁ, মায়ের আত্মহত্যাকে আমি পরিকল্পিত হত্যাই বলি। দিনের পর দিন অসংখ্য নারীর সাথে বাবার স্বেচ্ছাচারী মেলামেশার জন্য রোজ রোজ সংসারে অশান্তি, শেষের দিকে গায়ে হাত তোলা মায়ের সহ্যসীমার বাইরে চলে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। আমার মা, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী কাজরী মজুমদার এক জঘন্য নরপশুর সাথে দিনের পর দিন থাকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিল ছোট্ট শিশির নীল ওষুধে।

ইমতিয়াজ হোসেনকে বিয়ে করে বিক্রমপুরের ললিত মজুমদারের মেয়ে তার শিক্ষাজীবনের সাথে সাথে ত্যাগ করেছিল নিজের আত্মীয় পরিজনকেও। দিনের পর দিন এসব অত্যাচার মেনে নিতে সে বাধ্য হয়েছিল। তার না ছিল চাকুরি, না ছিল বাপের বাড়িতে একটুখানি জায়গা, না ছিল বন্ধুবান্ধব। মায়ের পায়ের নিচে মাটি বলতে কিছু ছিল না তখন। মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো তার সামনে ছিলাম আমি। নিজের গর্ভজাত মেয়েকে রেখে সে তখন যাবেই বা কোথায়? আমার জন্যই মাকে আরও বেশি করে বাবার অত্যাচার মেনে নিতে হতো। তবু কী আশ্চর্য, এ নিয়ে মার কোনো আক্ষেপ ছিল না। আমাকে আদর করতে করতে মা প্রায়ই বলত- তুই আমার সেরা বাচ্চা, ঝরোকা। পৃথিবীতে আর কারও এত সুন্দর, এত মেধাবী বাচ্চা নেই, জানিস!

আমার জন্য মা কোনো ছোট নাম রাখেনি, আমাকে কোনো ছোট নামে ডাকেনি কোনোদিন। মায়ের কাছে আমি শুধু ঝরোকা। এ জীবনে আমার কাছে সবচেয়ে মিষ্টি শব্দ, ঝরোকা। আমার মা এ শব্দটা যতবার উচ্চারণ করেছে, বেঁচে থাকতে আর কোনো শব্দই ততবার উচ্চারণ করেনি আমি জানি। আজও আমার চুলে আমি মায়ের স্পর্শ পাই। আমি চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে থাকলে আজও মনে হয় মা আমার গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। কী মিষ্টি একটা গন্ধ ছিল মায়ের গায়ে। সত্যি সত্যি আজও কোনো কোনো মাঝরাতে সে গন্ধ আমাকে সাহস যোগায় বেঁচে থাকতে।

ঐ জঘন্য মানুষটার জন্য আমার মা আমাকে ছেড়ে কোন সুদূরের তারা হয়ে গেছে। আমার এক জীবনের সমস্ত ঘেন্না তাই ইমাতয়াজ হোসেন নামের ঐ মানুষটার জন্য বরাদ্দ। মা মরে যাবার অল্পদিন পরেই যদি স্ট্রোক করে মরে না যেত, ইমতিয়াজ হোসেনকে মরতে হতো আমার হাতেই। হ্যাঁ, ইমতিয়াজ হোসেন ছিল দারুণ সুদর্শন আর আকর্ষণীয়। মা মরে যাবার দিন থেকে আমি পৃথিবীর সমস্ত সুদর্শন আর স্মার্ট পুরুষকে ঘেন্না করি।

মায়ের মৃত্যুনীল শরীরটা দেখার পর আমি মনে মনে মরে গিয়েছিলাম। একরাশ ঘেন্না আর আকাশসমান কষ্ট নিয়ে একটা সতের বছরের মেয়ে ধীরে ধীরে একটা শক্ত খোলসের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। কেবল দাদির প্রাণপণ চেষ্টায় আমি বছর দুয়েক পরে আবার একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। আমার দাদি মেহেরুন্নিসা হোসেন ইমতিয়াজ হোসেনের মা হলেও আমাকে, মাকে ভালবাসতেন খুব। মায়ের সাথে বাবার অশান্তি আমার মতোই তাঁকেই পীড়া দিত আমি জানি। মায়ের  মৃত্যুও তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। তারপরও মা হারানো আর বাবার ওপর প্রচ- ক্ষোভ থাকা একটা বাচ্চাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দাদির প্রাণপণ চেষ্টা ছিল। দাদির সে চেষ্টা সফল হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে আমার মনোজগতে, আমার জীবনে একটা আগাগোড়া বদল ঘটে গিয়েছিল, কেউ জানে না- দাদিও না।

এই মাঝরাতে নীলচে আলোয় নরম সাদা বিছানায় শুয়ে মায়ের কথা মনে করি। সাদা ছিল মায়ের প্রিয় রঙ। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সাদা আমারও প্রথম পছন্দ। আমার ঘরের দেয়াল, পর্দা, বিছানার চাদর, টেবিলক্লথ সব সাদা। আমার সব জামা কাপড়েও কিছু না কিছু সাদার ছোপ থাকবেই। বছরের একটা নির্দিষ্ট রাতে শুধু আমি কালো শাড়ি পরি এখন।

তিন.
মা আমাকে বলত, আমার সারা গায়ে নাকি মাধবী ফুলের গন্ধ। মা মরে যাবার পর থেকে এ কথা আমিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। এই আটাশ বছরের মাধবী শরীর আমি আজ পর্যন্ত কোনো পুরুষকে ছুঁতে দিইনি। অথচ একটু মিষ্টি করে হাসলেই কত পুরুষ পতঙ্গের মতো পুড়ে যেতে রাজি হয় চোখ বন্ধ করে।

আজ ছুটির দিন। আগামি কাল রোববার, সাতাশ অক্টোবর, আমার জন্মদিন। আজকের দিনটা একদমই অলস কাটিয়েছি আমি। মাঝে মাঝে এমন অলস সময় কাটাতে ভালো লাগে। বিকেল চারটা বাজে, দুপুরে এক প্যাকেট নুডলস রান্না করেছিলাম বেশি করে সবজি দিয়ে। ব্রোকলি, বরবটি, শসা আর টমেটো দিয়ে চমৎকার নুডলস করি আমি। এই বাসায় দাদি আর খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কেউ আসে না কখনও, কাউকে আসতে দিই না আমি। ওরা এই নুডলস খেতে খুব পছন্দ করে, এলেই রাঁধতে হয়। আজ কেউ আসেনি। জন্মদিনের আগের দিন আমি কাউকে ডাকি না। এদিন আমার নিজের কাজ থাকে। সমস্তটা দিন একলা কাটিয়ে সন্ধ্যেবেলা আমি কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাই, তারপর সেখান থেকে সোজা চলে যাই দাদির কাছে।

এই অলস বিকেলে আমার লম্বাটে সুন্দর নখে নতুন করে নেইল পলিশ লাগাতে লাগাতে সোহানের কথা মনে পড়ে। ভীষণ স্মার্ট, দেখতে দারুণ সোহান আমার আগের অফিসের কলিগ ছিল। এক অফিস হলেও আলাদা টিমে কাজ করতাম আমরা। কী মিশুক ছিল সোহান! না, না, সোহানের সাথে তেমন ভালো বন্ধুত্ব ছিল না আমার। আগেই বলেছি, স্মার্ট, সুদর্শন ছেলেদের সাথে খোলামেলা বন্ধুত্বে বিশ্বাস করি না আমি।

কাল আমার জন্মদিন। কালও নিশ্চয়ই এমন একটা খবর আসবে পত্রিকায়। তবে আশ্চর্য কিন্তু। আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরি জাতি এইসব খুনের তারিখের মিলটা মাথায় রাখেনি। রাখলে হয়ত একটা ভালো তদন্ত হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু একটার সাথে আরেকটা ঘটনার যোগসূত্র আছে এমনটা কারুর মাথায়ও আসেনি। আসেনি যে, সেটাও স্বাভাবিক, পানিতে ডুবে এমন মৃত্যু এদেশে অহরহই ঘটে।

সোহান খুন হয়ে গিয়েছিল আজকের রাতে। দেখতে দেখতে কেমন এক বছর হয়ে গেল! অথচ মনে হয় এই সেদিনের কথা। জলে ডুবে মরেছিল সোহান। সাঁতার না জানা সোহানের নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছিল জলে ডুবে যেতে যেতে। অনেকেই বলে সোহান আত্মহত্যা করেছিল কিন্তু আমি জানি সোহানের মৃত্যু একটা নিশ্চিত হত্যাকাণ্ড। জীবনকে অমন করে ভালবাসতে পারা সোহান নিজে নিজে কিছুতেই মরে যেতে পারে না। বরং বুড়িগঙ্গার জলে পড়ে যেতে যেতে ও  প্রচণ্ড অবিশ্বাসে তাকিয়েছিল নিখুঁত সুন্দর একটা হাসিতে ভরে ওঠা মুখের দিকে। ও যে এভাবে মরে যাচ্ছে তা ও যেন কল্পনাও করতে পারেনি সে সময়।

পরদিন সকালে সোহানের লাশ ভেসে উঠেছিল বুড়িগঙ্গাতেই, ঘটনাস্থল থেকে পাঁচশো গজের মধ্যে। ফুলে বিভৎস হয়ে গিয়েছিল সুদর্শন সোহানের মৃত শরীর। সোহানের মৃত্যুতে আমি এত বিচলিত হয়েছিলাম যে জন্মদিনের কেকও কাটতে পারিনি। বন্ধুরা সন্ধ্যেবেলা ঢাকা ক্লাবে জন্মদিনের আয়োজন করেছিল, বাতিল করে দিয়েছি। যতই বন্ধুত্বের সম্পর্ক না থাকুক, মরে যাবার আগ মুহূর্তে সোহানের করুণ যে চোখের কথা আমি কল্পনা করেছিলাম, তা ভেবেই আনন্দের রেশ মুছে গিয়েছিল মন থেকে।

আহা সোহান! বেচারা! সোহানের কথায় একে একে মনে পড়ে প্রীতম, পলাশ, বিভাস, রোকন, উপল, মুস্তাফিজ, মাহবুব আর সুব্রতর কথা। এরা সবাই আমার সহপাঠী বা সহকর্মী ছিল। এদের কারও সাথেই খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক কোনোদিন ছিল না আমার। সোহানের কথায় এদের কথা মনে পড়বার যথেষ্ট কারণ আছে। এদের কারওর কোনোদিন পারস্পরিক কোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল না, অল্পকিছু চেনাশোনা কারও কারও মধ্যে ছিল বটে। তবু কিছু কিছু বিষয়ে এদের মধ্যে একটা আশ্চর্য মিল আছে।

সোহানের মতোই এরা সবাই একটা নির্দিষ্ট দিনে মারা গেছে, ছাব্বিশে অক্টোবর। সবাই এক সাথে নয় কিন্তু। নামের ক্রমানুসারে প্রতি বছর একজন করে। এদের মারা যাবার ধরনটাও একদম একই। সোহানসহ এই নয়জনের সবাই ছিল দারুণ সুদর্শন আর আকর্ষণীয়! আরও আশ্চর্য বিষয় এই যে, এই ছেলেগুলোর কারুরই প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী ছিল না।

এরা সবাই মরে গেছে আমার জন্মদিনের ঠিক আগের রাতে। প্রত্যেকজন মরেছে কোনো না কোনো নির্জন জলাশয়ে, এই ঢাকা শহরেরই আশেপাশে। পরের দিন সকালবেলা এদের প্রত্যেকের লাশ ভেসে উঠেছে, আমার জন্মদিনের সকালে। পরিচিত মানুষগুলোর এমন করুণ মৃত্যুতে আমি ঠিকমতো জন্মদিন পালন করতে পারি না আজ বহু বছর।

কাল আমার জন্মদিন। কালও নিশ্চয়ই এমন একটা খবর আসবে পত্রিকায়। তবে আশ্চর্য কিন্তু। আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরি জাতি এইসব খুনের তারিখের মিলটা মাথায় রাখেনি। রাখলে হয়ত একটা ভালো তদন্ত হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু একটার সাথে আরেকটা ঘটনার যোগসূত্র আছে এমনটা কারুর মাথায়ও আসেনি। আসেনি যে, সেটাও স্বাভাবিক, পানিতে ডুবে এমন মৃত্যু এদেশে অহরহই ঘটে। সুতরাং এই মৃত্যুগুলো যে আত্মহত্যা নয়, নিশ্চিত খুন এটা ভাবা আর প্রমাণ করাও প্রায় অসম্ভেরই মতো। আর এই মৃতেরা প্রত্যেকেই আমার সহপাঠী বা সহকর্মী হলেও একটা অপমৃত্যুর মামলায়ও আমাকে সাক্ষ্য দিতে হয়নি। হয়নি যে, সেটা ভালোই হয়েছে। এদের নিয়ে কিছু বলতে ভালো লাগত না আমার।

কফি রঙের নেইল পলিশে আমার সুন্দর করে কাটা পায়ের নখ আরও সুন্দর দেখায়। আমি ব্র্যান্ডেড নেইল পলিশের সুগন্ধি শিশি তুলে রাখি। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে প্রায়। এখন রেডি হতে হবে। রাতে আজ এ বাসায় আর ফিরব না বলে কোনোকিছুর ঝামেলা নেই। আলমারি খুলে একদম নতুন কালো সেলফ ওয়ার্কের গর্জিয়াস জামদানিটা বের করি। মিলিয়ে কালো একরঙা কাতান ব্লাউজ আর শাটিনের পেটিকোট।

শাড়ি পরে প্রসাধন শেষ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াই। কালোতে কী অপূর্ব লাগছে আমাকে! নিজেকেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে হয়। না না। অত সময় নেই এখন। গাড়ি নিয়ে বেরোব। রিফাতকে অপেক্ষা করতে বলেছি জসীমউদ্দিন রোডের সামনে। আমরা যাব দিয়াবাড়ি। সেখানে সাদা কাশবনের মোহিনী সৌন্দর্য রাতের বেলা আরও খুলবে নিশ্চিত। চাঁদের আলোতে ভেসে যাবে চরাচর, কাশবনের দু’পাশের জল কেমন ঝিকিয়ে উঠবে! ভাবতেই ভালো লাগছে আমার ভীষণ। এই জোৎস্নায় আমার তো এখনই ইচ্ছে করছে সাঁতার কাটব সেই জোৎস্নাস্নাত জলে। কিন্তু রিফাত জলে নামতে রাজি হবে না মনে হয়। ও তো সাঁতার জানে না, সোহানের মতো, প্রীতম, মুস্তাফিজদের মতোই।

জন্মদিনের আগের রাতটা আমার ভীষণ প্রিয়। নয় বছর ধরে এই রাতে আমি নিয়মিত বেড়াতে যাই। আমার বেড়ানোর পছন্দের জায়গায় কিছু সবুজ কিছু জল থাকবে। কোনো কারণে যদি সবুজ নাও থাকে, জল থাকতেই হবে। জল আমার ভীষণ পছন্দের। অন্যান্য বছরের মতো এবারও ওখান থেকে সরাসরি চলে যাব দাদির কাছে। গত নয় বছর ধরে এই একটিমাত্র রাতেই আমি কালো রঙের শাড়ি পরি।

গাড়িতে বাজছে অর্ণবের গান। সন্ধ্যের পর এই প্রথম রাতে ঢাকার রাস্তা শুনশান। এমন রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে আরাম। গত বছর এ রাতে আমার সঙ্গী ছিল সোহান। কালো ঝলমলে কাতানে আমাকে দেখে সোহান চোখ ফেরাতে পারছিল  না, মুগ্ধতায়। আমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না বুড়িগঙ্গার জলে যখন ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম তখনও, অবিশ্বাসে। কেউ পারেনি তার আগের বছরগুলোতে। আমি জানি, আজ রিফাতও এমনটাই করবে। মুগ্ধতা, অবিশ্বাস, মৃত্যুভয় সব মিলিয়ে দারুণ সুপুরুষদের কেমন দেখায় মরে যাবার সময়টায়- তা আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সময়টায় বাঁচার জন্য ব্যাকুল পুরুষদের করুণ মুখচ্ছবি আমি ভীষণ উপভোগ করি।

রাস্তা বেশ ফাঁকা এখন, ড্রাইভ করতে ভালো লাগছে খুব। গাড়ি চালাতে চালাতে বিভোর হয়ে আমি রিফাতের কথা ভাবছি। রিফাতকে বলে দিয়েছি আমাদের এই গোপন অভিসারের কথা ও যেন কাউকে না বলে। বলবে না জানি- ঝরোকার সাথে ওর জন্মদিনের আগের রাতে এমন খুব গোপনে বেড়াতে যাবার কথা আজ পর্যন্ত কেউ জানায়নি অন্য কাউকেই।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.