নিম গাছ
আমাদের গল্প কাকে শোনাবো? শ্রোতার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। এ কানের সমস্যা নয়, এ মনের সমস্যা। আমরা জলতরঙ্গ আর শুনি না। এই জলতরঙ্গের নাম এমনিই মনে এলো। অন্য যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই হতে পারত জলতরঙ্গের জায়গায়।
গতকাল সৌমেন এসেছিল।
সে আমাকে তার জীবনের গল্প শোনাতে চায়। কিন্তু আমি কেন?
সে বলল, আমি স্কুলজীবন থেকেই দেখেছি তুই খুব ভালো শ্রোতা। ইন্টারাপ্ট না করেই তুই সবার কথা শুনতে পারিস।
এ সর্বৈব সত্য কথা।
কিন্তু কী এমন ঘটেছে যে সাত সকালে সৌমেন আমার বাড়ি এসে হাজির। সে কী এমন শোনাতে চায়? যদিও যে কোনো বিষয়ই আমি এক নাগাড়ে শুনতে পারি। আমার সমস্যা হয় না। আমি সব কিছুর মধ্যে শিক্ষণীয় কিছু খুঁজে পাই।
সৌমেন, চা খাবি?
দুধ চা?
তুই কী চা খাবি বল, লিকার চা ও আছে।
আমাকে লিকার চা-ই দে। আমার আবার দুধ চা সহ্য হয় না। গ্যাস হয়ে যায়।
ঠিক আছে।
রুটি খাবি নাকি বিস্কুট?
আমি সকালে রুটি, বিস্কুট খাই না রে।
তবে কী খাস?
আসলে আমার বাড়িতে রুটি, বিস্কুট দিয়ে সুন্দর করে চা করে দেওয়ার লোক নেই তো, দোকানে গেলে হয়, কিন্তু ব্রাশ করেই দোকানে ছুটতে ভালো লাগে না।
তাহলে কী খাবি?
মুড়ি থাকলে একমুঠো মুড়ি দে। চা আর মুড়ি ভালো হবে।
সে ভাষাটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি, তবে একটা আহ্বান আমি টের পাই। সে যেন আমাকে বলছে, আমার খাওয়ার সময় হল, তুমি কোথায়, আমি এখন ঘুমবো, আমার কাছে এসে বসবে না? আচ্ছা, গাছেরা কি ঘুমোয়?
সৌমেন ভালো ছাত্র ছিল। এক থেকে দশের মধ্যে হত। শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র। ভালো অঙ্ক পারত। বিশেষ করে ত্রিকোণোমিতি। ইতিহাসেও তার ব্যুৎপত্তি ছিল। সুলতানি, মুঘল যুগ ছবির মতো বলতে পারত। ঔরঙ্গজেব তার প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র। সে তাকে হিন্দু-বিদ্বেষী ভাবত না।
আমি অপেক্ষা করছিলাম সৌমেন কখন তার গল্প শুরু করে। নিজে থেকে তাকে জোর করে গল্প বলতে বলা মানে তাকে শিগগির উঠে যেতেও বলা। মানে তোমার গল্প শেষ করো আর শিগগির কেটে পড়ো। তা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
চা হাতে নিয়ে আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কারো মুখ দেখতেও আমার মন্দ লাগে না। মুখই তো এক একটা গল্প। আমি তাই বলে গল্পখোর নই, ভুল বুঝবেন না।
সৌমেন যেভাবে গল্পটা বলেছিল সেভাবে আমি এখানে তুলে দিলাম।
আমি একা মানুষ। মা বাবা বেশ কয়েক বছর হল গত হয়েছে। বিয়ে করিনি। আমার ছোট একটা বাড়ি আছে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। বাড়ির সামনে একটা বাগান আছে। বাগানের দিকে আমার তেমন কোনো নজর ছিল না। ঘাস গজিয়ে গেছে। তবে ওই সবুজ বাগান আমার বেশ ভালো লাগতে শুরু করে।
একদিন করলাম কী, একটা নিম গাছের চারা বসালাম বাগানটায়। রোজ জল দিই। অল্প কয়েকদিন পরে গাছটার প্রতি আমার বেশ ভালোবাসা জন্মালো। রাতে মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাড়িতে থেকে যেতাম প্রায়শই। কিন্তু এখন আর থাকতে পারি না। ওই গাছটার টানেই বাড়ি ফিরে আসি সে যত রাতই হোক। এসে জল দিই। সেও যেন আমার অপেক্ষা করে। আমি এলে পাতাগুলি ঝাঁকিয়ে আমাকে স্বাগত জানায়। বাড়িতে দুটি প্রাণী—আমি আর নিমগাছ।
গল্প থামিয়ে সে আমাকে একটা প্রশ্ন করল, গাছেদেরও ছেলে মেয়ে হয়, তা কি তুই জানিস?
আমি বললাম, তা তো শুনেছি, যেমন অপুষ্পক-সপুষ্পক উদ্ভিদ। ফুল হলে মেয়ে, ফুল না হলে পুরুষ। এমনকি শুনেছি পুকুরেরও ছেলে-মেয়ে আছে। পুরুষ পুকুরে ভালো মাছ হয় না শুনেছি।
তবে, গাছেরাও বার্তা পাঠায়, এটা শুনেছিস?
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা আবার কেমন কথা। গাছ তো আর মানুষ নয়, তাদের টেলিফোনও নেই, তারা বার্তা পাঠাবে কেমন করে?
আমি বেশ সন্দিগ্ধ স্বরে বললাম, বার্তা পাঠায় মানে?
বললে বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, আমি যেখানেই থাকি কে যেন আমাকে সারাক্ষণ ডাকে। কোনো আওয়াজ নেই, সাড়াশব্দ নেই, হুলস্থুল নেই কিন্তু টের পাই কেউ যেন আমাকে স্মরণ করছে। ডাকছে তার নিজের কাছে।
কী বলে ডাকে?
সে ভাষাটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি, তবে একটা আহ্বান আমি টের পাই। সে যেন আমাকে বলছে, আমার খাওয়ার সময় হল, তুমি কোথায়, আমি এখন ঘুমবো, আমার কাছে এসে বসবে না? আচ্ছা, গাছেরা কি ঘুমোয়?
শুনেছি ঘোড়ারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোয়। মাছেরা চোখের পাতা না ফেলে ঘুমোতে পারে। মানে তাকিয়ে তাকিয়ে। কিন্তু গাছেরা? জগদীশ বসু কী বলেন?
আমি জগদীশচন্দ্র বসুর কিছু বই বই কিনে আনলাম। ‘অব্যক্ত’ পড়লাম। কিন্তু সেখানে গাছের ঘুমের কথা কিছু বলা নেই। তবে ভাবলাম, প্রাণ যদি থাকে তাহলে তার বিশ্রামও থাকবে।
আমি চুপ করে রইলাম।
হ্যাঁ, তবে এই কথাটা যেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। একদিন গাছটা বলল, আমার একটা সঙ্গী চাই। সেই কথা শোনা মাত্র আমি একটা আম গাছের চারা পুঁতলাম নিম গাছটার পাশে। তারপর একদিন গাছটাকে বলতে শুনলাম, আম গাছ আমার ভালো লাগছে না, আমার স্বজাতির গাছ দাও।
সে বলল, একদিন গাছ কী বলল জানিস?
কী?
গাছটা বলল, তার মিউনিসিপ্যালিটির জল ভালো লাগছে না। তাতে ক্লোরিন আছে। তাতে তার কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু তুই তো বললি, গাছের ভাষা তুই বুঝতে পারিস না।
হ্যাঁ, তবে এই কথাটা যেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। একদিন গাছটা বলল, আমার একটা সঙ্গী চাই। সেই কথা শোনা মাত্র আমি একটা আম গাছের চারা পুঁতলাম নিম গাছটার পাশে। তারপর একদিন গাছটাকে বলতে শুনলাম, আম গাছ আমার ভালো লাগছে না, আমার স্বজাতির গাছ দাও।
গাছেদেরও জাতি-গোত্র চেতনা আছে বলছিস?
তা তো আমি জানতাম না রে, তবে যেদিন আম গাছটা তুলে ফেলে আরও একটা নিম গাছের চারা পুঁতলাম তারপর থেকে তার আর কোনো অভিযোগ পাইনি।
সব বুঝলাম কিন্তু সমস্যাটা কী হচ্ছে? আমি জানতে চাই।
হ্যাঁ, সবই ঠিক ছিল কিন্তু এই কয়েকদিন ধরে গাছ আমাকে একটা বার্তা দিচ্ছে। অদ্ভুত সেই বার্তা।
কী?
গাছটা বলছে, আমি আর বাঁচব না। শিগগির আমার মৃত্যু।
আর এটা তুই বিশ্বাসও করছিস?
বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু আমার মনও বলছে গাছটা মিথ্যে বলছে না। গাছেরা কি মিথ্যুক হয়?
এর উত্তরে কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর মনে হল, এটা সৌমেনের কোনো সাইক্রিয়াট্রিক সমস্যা। একা মানুষ। কথা বলার লোকজন তেমন নেই। হয়ত সে বেশি মাত্রায় স্ব-কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। তার সঙ্গী বলতে ওই একটা নিম গাছ। ফলে তার মনের মধ্যে যে কথা চলে সেটাই গাছের নির্দেশ বলে মনে হয়।
আমি বললাম, তুই একজন মনোবিদের সঙ্গে দেখা কর। তিনি নিশ্চয়ই তোর সমস্যার একটা সমাধান দিতে পারবেন। আচ্ছা তোর কি নিজেকে গাছ বলে মনে হয়?
না, সেটা আমার কখনও মনে হয়নি। আমি আবার গাছ হব কী করে?
যদি কিছু মনে না করিস, আমি একদিন তোর বাড়ি যেতে চাই।
সে খুব খুশি হল এই ভেবে যে আমি তার সমস্যাটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছি। পাগলের প্রলাপ ভেবে উড়িয়ে দিইনি।
যে কোনো দিন চলে আয়। তুই আমার বাড়ি এলে আমি খুব খুশি হব।
পরের শনিবার আমি সৌমেনের বাড়ি হাজির হলাম। গিয়ে দেখলাম, খুব সুন্দর ফলফলে একটা নিমগাছ তার বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। ঘন সবুজ পাতা। গুঁড়ি বেশ মোটা। ভালো চেহারা। সেই নিমগাছের পাশে আরও একটা ছোট নিমগাছ। যেন মনে হয় মায়ে-ঝিয়ের সুখের সংসার। তবে বড় নিমগাছটা কেমন জানি একটু থমথমে। পাতা নড়ছে না।
পরের শনিবার আমি সৌমেনের বাড়ি হাজির হলাম। গিয়ে দেখলাম, খুব সুন্দর ফলফলে একটা নিমগাছ তার বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। ঘন সবুজ পাতা। গুঁড়ি বেশ মোটা। ভালো চেহারা। সেই নিমগাছের পাশে আরও একটা ছোট নিমগাছ। যেন মনে হয় মায়ে-ঝিয়ের সুখের সংসার। তবে বড় নিমগাছটা কেমন জানি একটু থমথমে। পাতা নড়ছে না।
সৌমেন বলল, যেদিন থেকে আমার মৃত্যুর খবর দিয়েছে গাছটা সেদিন থেকে তার পাতা নড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কেমন যেন কান্না কান্না ভাব।
আমি বললাম, সৌমেন আমি এমন একটা কাজ করতে আজ তোর বাড়ি এসেছি যেটা তোর পছন্দ হবে না, তবে কাজটা আমাকে তোর জন্যই করতে হবে।
সে অবাক চোখে বলল, কী করতে চাস তুই?
খুব কঠিন কাজ, তুই কি পারবি? তবে আখেরে তোরই ভালো হবে। তুই সুস্থ হয়ে উঠবি।
তোর কি মনে হয় আমি অসুস্থ?
না, তা বলছি না। মানে বলতে চাইছি, তোর সমস্যার একটা নিষ্পত্তি ঘটবে।
তোর কি মনে হচ্ছে আমার মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে?
না, আমি একবারও তা বলতে চাইছি না।
আমি তোর কথা মতো সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছ গিয়েছিলাম।
কী বললেন তিনি?
তিনি বললেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
তাহলে এই চিন্তাগুলো মাথায় আসছে কেন?
এ খুব স্বাভাবিক। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই।
তিনি কি তোকে কোনো ওষুধ দিয়েছেন?
একটা ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। বললেন, একা থাকি, নানা রকম দুশ্চিন্তা, ঘুম একটু কম হচ্ছে। তবে, আমার এমনিতে ঘুম ভালোই হয়, তাই সে ওষুধ খাচ্ছি না। কিন্তু তুই আমাকে কী করতে বলছিস?
আচ্ছা তার আগে বল, ওই চারা গাছটা কি তোকে কোনো বার্তা পাঠায়?
না।
তাহলে এক কাজ কর ভাই, তুই বড় নিম গাছটা কেটে ফেল, তাহলেই সমস্যা থেকে মুক্তি।
আমার প্রস্তাব শুনে সৌমেন কেমন চুপ হয়ে গেল। বেলুনে পিন ফুটিয়ে দিলে যেমন হয় তার মুখের অবস্থা ঠিক তেমনই।
ও বলল, আমি এই বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যেতে পারি কিন্তু গাছটা কাটতে পারব না। তাছাড়া গাছটা কাটলে কি আমার মৃত্যু ঠেকানো যাবে?
আমার তো তাই মনে হয়।
অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজি করালাম আর পর দিন রবিবার বড় নিমগাছটা কেটে ফেলা হল। সৌমেন একবারও তার ঘরের ভেতর থেকে বেরোয়নি। সে যেন কোনো কোলাহল শুনছে এমন উৎকর্ণ হয়ে জানালার ধারের বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে রইল।
বাড়িটা বিক্রিই করে দিল সৌমেন। পাশের পাড়া সুবুদ্ধিপুর। সেখানে সে একটা ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেল।
বেশ কয়েকদিন তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। দুজনেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। সৌমেনের আপিস রয়েছে। আমারও আপিস। তবে আবার দেখা হবে এ আমি জানতাম।
দিন দশেক পর বিদ্যুৎ চমকের মতো খবরটা এলো। অবিশ্বাস্য। শুনলাম, সৌমেন মারা গেছে।
সমস্যা শুরু হল আরও কয়েকদিন পর। আমি একটা চারা নিমগাছের কথা শুনতে পাচ্ছি।
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়