:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সেলিম মোরশেদ

কথাসাহিত্যিক

নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো
শিল্পকর্ম: রাজীব দত্ত

নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো

যে-কথাগুলো বলবো তা এক পুরনো শহরের গল্প।
সভ্যতা ও কৃষ্টিতে ভরা। জগৎজোড়া স্বীকৃতি।
শহরের সকল অধিবাসীরাই ভাবতো তারা সৎ আর জানতো তারা বিবেকসম্পন্ন।
পাশাপাশি তারা ছিলো ভয়ানক বিদ্যাদর্পী।

একদিন এই শহরে একজন যুবক আসে। ভীষণ আত্মবিশ্বাস তার।
সে কোথা থেকে এসেছিলো তা কেউ জানে না। এমনকি কেউ জানতে পারেনি তার আসল উদ্দেশ্য।

যুবকটি শহরের সবাইকে জানালো, শহর-অধিবাসীদেরকে সে তিনভাবে দেখেছে: তারা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তাদের শিল্পকর্মে এবং যখন তারা দুর্বলের মুখোমুখি হয়। দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে যুবকের কাছে প্রমাণিত হয়েছে, তারা এক সূক্ষ্ম মিথ্যার পারিপাট্যে নিজেদেরকে স্থাপন করে রেখেছে। মূলত তারা অসহায়, বিভ্রান্ত ও বর্বর। উপরন্তু উপরিকাঠামোর পরিপোষক।

যুবকটি বলে, শহর-অধিবাসীরা খুবই ভীতু। তাছাড়া অন্তরিত ক্লেদে জর্জরিত।

তাকে বিস্মিত করেছে এমন কোনো গুণাবলি শহর-অধিবাসীদের ভেতর দেখেনি। এর প্রমাণ সে এখনই হাতেনাতে দিতে পারে।

শহর-অধিবাসীরা যুবকটির কাছে প্রমাণ চায় শিথিল তাচ্ছিল্যে।
যুবকটি বলে, তোমাদের এই সূক্ষ্ম পারিপাট্য— যদি কাচ হিসেবে এগুলোকে ধরা হয়— তাহলে তা হবে এতোই নিচুমানের— যে তোমাদের সন্তানরা— যারা আজ ঘুড়ি ওড়ায়— তাদের সুতোর মানজা দেবার জন্যেও এগুলো অপারগ।

শহর-অধিবাসীরা এই কথায় প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা যুবকটির তৎক্ষণাৎ শাস্তি নির্ধারণ করে। সেই রাতে তারা যুবকটিকে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে।
মৃত্যুর পূর্বে যুবকটি প্রকৃতই বিস্মিত হয়েছিলো তাকে হত্যা করা হচ্ছে এই ভেবে।
সে মৃত্যুর পূর্বে বলে, এই শহরের সত্বর বিলুপ্তি হবে।
শহরের পবিত্র উপাসনাকেন্দ্রে তাকে হত্যা করা হয় গভীর রাতে।
তার মৃত্যুর সময় আচমকা বৃষ্টি পড়ে এবং সকলে সিদ্ধান্ত নেয় লাশটি আপাতত ফেলে রেখে যাবার— সকালবেলা তারা এসে সেটি কবরস্থ করবে।

নীল চুলের একটি মেয়ে— এতো নীল তার চুল যে দূর থেকে কালো বলে মনে হয়— পরদিন সকালে এসে ছুটতে ছুটতে সবাইকে জানায়— যুবকটির লাশ কবর দিতে গিয়েছিলো ভোরবেলা, সেখানে গিয়ে সেই লাশটি তারা কেউ দেখেনি— কেবল তাজা রক্তের একটি দীর্ঘ ধারা এগিয়ে গিয়েছে বহুদূর পর্যন্ত; তারা এর কোনো কারণ শনাক্ত করতে না পেরে ফিরে এসেছে।

সারা শহরে— এই সংবাদে— বিস্তর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শহরের অধিবাসীরা তখন উপাসনাকেন্দ্রে গিয়ে দ্যাখে মেয়েটির কথা অবশ্যই সত্য। তারা সদলবলে রক্তের ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে এবং দীর্ঘ কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে এক নির্জন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়— যেখানে রক্তের ধারা থেমে গিয়েছিলো।
প্রথমে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে; এবং অবশেষে সবাই ঠিক করে, যে জায়গায় রক্তবিন্দু স্থির হয়ে গিয়েছে— সেখানেই সদলবলে অবিলম্বে একটি গর্ত খুঁড়বে।
নীল চুলের মেয়েটি এই কাজে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
তারা একটানা মাটি খোঁড়ে দীর্ঘসময়। যতো মাটি খোঁড়ে তাদের ক্লান্তি ততো কমতে থাকে। সন্ধ্যায় মাটির ভেতর হঠাৎ এক বিশাল গুহা তাদের চোখে পড়লে অতঃপর সকলে মিলে কৌতূহলে সেই গুহার অভ্যন্তরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করে ভয়ানক বিস্মিত হয়।

যুবকটি শহরের সবাইকে জানালো, শহর-অধিবাসীদেরকে সে তিনভাবে দেখেছে: তারা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তাদের শিল্পকর্মে এবং যখন তারা দুর্বলের মুখোমুখি হয়। দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে যুবকের কাছে প্রমাণিত হয়েছে, তারা এক সূক্ষ্ম মিথ্যার পারিপাট্যে নিজেদেরকে স্থাপন করে রেখেছে। মূলত তারা অসহায়, বিভ্রান্ত ও বর্বর। উপরন্তু উপরিকাঠামোর পরিপোষক।

গুহার ভেতর থরে থরে সাজানো ছিলো নানাবিধ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবার গোপন মানচিত্র, আমিত্বের আশ্চর্য প্রদীপ আর অমরত্বের মোমবাতি।
তারা জন্তুর মতো সেইসব দুর্লভ বস্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অধিকারী হতে চায়— কিন্তু বিফল হয় বারবার: প্রতিটি বস্তুই স্পর্শিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা সকলেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতোই ছিটকে পড়তে থাকে— কেননা সেগুলোর গায়ে নামকরণের পাশাপাশি আর একটি কথা লেখা ছিলো—‘যে অন্ধ আমি কেবল তার।’
শহর-অধিবাসীদের ভেতর একজনও অন্ধ ছিলো না।
এই বিষয়টি তাদের আচমকা অবাক করে। তারা সবাই যে দৃষ্টিশক্তির অধিকারী তা এভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সকলেই আকস্মিকভাবে একে-অপরের সামনে জটিল হয়ে পড়ে। নিকট সম্পর্কগুলো মুহূর্তের ভেতর ছুটে যায়।

এমনকি মৃত যুবকটির লাশ সম্পর্কেও তাদের আর তখন কোনো কৌতূহল থাকে না।
তারা ঘরে ফিরে আসে দ্রুত এবং তাদের চিন্তার বিষয়বস্তু হয় যশ-মান-বিত্ত-বৈভব ও অস্তিত্ব।
মুহুর্মুহু ভাগ্যকে দোষারোপ করে তাদের আমিত্ব বেঁচে থাকে। সুতরাং গুহার ভেতরের দুর্লভ সম্পদগুলো পাবার জন্যে তারা দিশেহারা হয়।
অতঃপর তারা সবাই তাদের নিজ চোখদুটো উপড়ে ফেলে সেই গুহার দিকে ছোটে।
অন্ধ হয়ে যাবার পর ছোটা কঠিন— অচিরেই তা বুঝতে পারে সবাই।
তারা সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গাটিকে আর শনাক্ত করতে পারে না।

শহর-অধিবাসী প্রতিজনই ভেবেছিলো কাজটি গোপনে কেবল সে-ই করছে, অথচ দেখা যায় একমাত্র নীল চুলের মেয়েটি ছাড়া— নারীপুরুষ নির্বিশেষে— এই কাজটি সকলেই করেছে।
তারা সেইমুহূর্তেই সতর্ক হয় এবং সকলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনায় নিজেদের চোখ খুঁজতে শুরু করে আর সত্বর খুঁজে পাওয়া চোখগুলো কোটরে ভরে।
এরই কিছুদিন পর— নীল চুলের মেয়েটি লক্ষ করে— সারা শহরের পরিস্থিতি সবার প্রতিকূলে— উদ্ভট সব ঘটনা নিত্য ঘটছে— শহর-অধিবাসীরা হঠাৎ যৌথমমত্ব হারিয়ে সকলেই তাদের নিজস্বতার বাইরে ভিন্নভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে চাইছে।
শহর-অধিবাসীদের এই অভিনব পরিবর্তনে নিজেও সে অস্থির।
সে অনুমান করে, অধিবাসীরা নিশ্চয় জানে— কোটরে-ভরা চোখগুলো তাদের নিজের নয়। তারা অবশ্যই জ্ঞাত যে ইতোমধ্যে তাদের চোখগুলো নিজেদের ভেতর বদলাবদলি হয়ে দীপ্ত। সে অমঙ্গলের ইঙ্গিতে বিমর্ষ হয়ে পড়ে এবং লক্ষণীয়ভাবে অধিবাসীদের ভেতর ভাঙন নামে। একে-অপরের চোখ গ্রহণের পর যেসব সমস্যা: স্ত্রী—স্বামীকে দেখে স্তম্ভিত হয়। স্ত্রী দেখতে পায়, তার স্বামীর দীর্ঘদিনের অসত্য বিচরণ। অমানবিকতায় সে উত্তুঙ্গে। স্বামী দেখে, তার স্ত্রী মানসিকভাবে সাংঘাতিক অবিশ্বস্ত আর নির্যাতিত হওয়ার কারণে অসম্ভব চতুর। কিছু সন্তান তাদের পিতার দৃষ্টিতে দেখেছিলো বাবার অভাবনীয় আপোষকামী মনোভাব আর দায়িত্বে অপূর্ণতা। কয়েকজন কেরানি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি পেয়ে দেখলো তাদের কর্তৃপক্ষের ভেতরে রয়েছে পরিমাণবিহীন ফাঁকির প্রবণতা।
অধিবাসীরা নিজেদের ভেতর তীব্র অসহনীয় হয়ে ওঠে।

রাত যায়। দিন আসে।
তারা মারমুখী ভঙ্গিতে একে-অপরকে লক্ষ করে। পাশাপাশি তারা বিশ্লেষণমুখী হয়ে ওঠে। যতো তারা চেষ্টা করে অন্যকে ক্ষমা করে দিতে ততো তারা ক্রোধান্ধ হয়ে অপরকে বধ করতে উদ্যত হয়।
শহরে অগ্নিকাণ্ড, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
শহরের প্রধান ফটকে একটা বিশাল কাঠের ঘোড়া ছিলো। পার্শ্ববর্তী নদী থেকে দমকা হাওয়া ঘোড়াটিকে উড়িয়ে নিয়ে যায় নিজের পেটে।
এই বিশেষ শহরটি যখন ধ্বংসপতনে উস্মুখ, তখন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।

নীল চুলের মেয়েটি দীর্ঘদিন এই দৃশ্য দেখতে দেখতে সহসা একদিন প্রচণ্ড অনুভব করে, সে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং এক নীরব শক্তির তীব্র আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই গুহার দিকে। সে বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ ছোটে।

ছু-ট-তে-ছু-ট-তে সে আসে পুবে। সেখানে মহান সূর্যের দিকে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে: তারপর সে বলে: সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে চায় না, এমনকি কোনো সম্পদের বিনিময়েও।

 

গ্রন্থভূক্ত: কাটা সাপের মুণ্ডু 

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.