পাখিরা
ডিসেম্বরের তিন তারিখ সকালে কোশকিনের ফোন: ‘বন্ধু, শীতের পাখিরা এসে পড়েছে, তুমি আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলো।’
এই কোশকিন ঢাকার রুশ দূতাবাসে কর্মরত তরুণ কূটনীতিক আন্দ্রেই পাভলোভিচ কোশকিন, আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু। আমি এক কালে উচ্চশিক্ষার্থে মস্কো বাস করতাম, ওখানেই কোশকিনের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব। বছর পাঁচেক হলো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে স্বদেশে ফিরেছি। ওর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। গত বছর ঢাকায় এক বহুজাতিক সম্মেলনে ওর সঙ্গে হঠাৎ দেখা। বলল, মাস তিনেক আগে দিল্লি থেকে বদলি হয়ে ঢাকা এসেছে।
আমাদের পুরোনো বন্ধুত্বের গায়ে যে শ্যাওলা জমে উঠেছিল, বিশুদ্ধ রুশি ভোদকা দিয়ে সাফ করা হলো। এখন প্রায় প্রতি মাসেই দেখা-সাক্ষাৎ হয়, ফোনেও আলাপ হয়। সে ছুটি-ছাটায় দেশে বেড়াতে গেলে ফেরার সময় আমার জন্যে ভোদকা আনে। আমরা মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে যাই।
কোশকিন, যাকে আমি অন্তরঙ্গতা প্রকাশের রুশি কেতায় শুধু আন্দ্রেই বলে ডাকি, সে সৌখিন ফটোগ্রাফার। সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায় আর পশুপাখির ছবি তোলে। পাখির ছবি তোলার জন্য মাইলের পর মাইল বনে জঙ্গলে হেঁটে বেড়ায়। শীতকালে গভীর সাইবেরিয়ার বনের পশুদের ছবি তোলার জন্য সে একবার দুই সপ্তাহ ধরে ঘুরে বেড়িয়েছিল সাইবেরিয়ার এমন এক অঞ্চলে যেখানে তখন তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল শূন্যের ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে।
তো সেদিন সকালে ফোন করে ও আমাকে বলল, ওকে অতিথি পাখি দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমি ওকে নিয়ে যাব কী, ওই আমাকে নিয়ে চলল। শনিবার সকালে ও নিজে গাড়ি চালিয়ে গুলশান থেকে পূর্ব রাজাবাজার এসে আমাকে আমার বাসা থেকে তুলে নিল। ওর এয়ার কন্ডিশন্ড গাড়ির ভিতরে মস্কোর শরৎকাল, আলা পুগাচভার গান। ও আমাকে হ্যানিকেন বিয়ার খেতে দিল।
বিশাল লম্বা লেন্স লাগানো ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ক্লিক ক্লিক শব্দে সাটার টিপতে টিপতে সে পাখিদের উদ্দেশে মাতৃভাষায় চিৎকার করছে: ‘সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে কত দূরের দেশে চলে এসেছিস তোরা! দাবাইতে! ইগ্রাইতে!’ সে আনন্দে নাচতে নাচতে পাখিদের ছবি তুলছে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে, কখনো হাঁটু ভাঁজ করে আধ-বসা হয়ে।
বিয়ার খেতে খেতে, আলুর চিপস চিবুতে চিবুতে, আলা পুগাচভার গান শুনতে শুনতে, মস্কোর গল্প করতে করতে আমরা সাভার এলাকার রাস্তার পাশে একটা ফাঁকা চরায় এসে দাঁড়ালাম। চরার শেষে বিস্তীর্ণ জলাভূমি, নদী না বিল ঠাহর হলো না। আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার, হালকা কুয়াশার চাদর অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। জলাভূমির শেষে ধোঁয়াশার ভিতরে কালো কালো গ্রামের রেখা। ঝকমকিয়ে সূর্য উঠেছে। বিস্তীর্ণ চরায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে লাল রোদ।
আমি বললাম, ‘কই? এখানে পাখি কোথায়?’
আন্দ্রেই হাসল। জলাভূমির দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘ওই তো, কতো পাখি! দেখতে পাচ্ছ না?’
আমি দেখলাম, ঘন কচুরিপানা কিংবা পদ্ম-শাপলার পাতায় পাতায় জলাভূমির পানি পুরোটাই ঢাকা পড়েছে। আন্দ্রেই আবার হেসে বলল, ‘পাখি, ওগুলোই পাখি।’
আমি অবাক, এক সঙ্গে এতো অজস্র পাখি আগে কখনো দেখিনি। পাখির ঝাঁক বসে যে একটা বিস্তীর্ণ জলাভূমির পানি পুরাটাই ঢেকে দিতে পারে তা আমার ধারণায় ছিল না।
আমরা চরায় গাড়ি রেখে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এর মধ্যে একটা-দুটা পাখি ডেকে উঠল, একটা পাখি এক জায়গা থেকে উড়ে গিয়ে আরেক জায়গায় নামল। যেখানে নামল, সেখানে অন্য পাখিদের সঙ্গে সম্ভবত তার বিরোধ ঘটল, পানির উপরে র্ছ র্ছ শব্দ উঠল, একটা পাখি পানির গায়ে ডানা ঝাপটাতে ছাপটাতে এক দিকে দৌড়ে চলে গেল, তার পিছু পিছু ছুটল তিন-চারটা পাখি।
আকাশের এক কোণে সুসজ্জিত নকশায় উড়ছে গোটা বিশেক পাখির একটা ঝাঁক।
জলাভূমির কিনারের খুব কাছে খেলা করছে একটা পানকৌড়ি।
আন্দ্রেই কখন ওর কাজ শুরু করে দিয়েছে আমি খেয়ালই করিনি। ওর কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালাম: ও ছবি তুলতে তুলতে পাখিদের সঙ্গে রুশ ভাষায় কথা বলছে: দাবাইতে রিবিয়াতা! ইগ্রাইতে!
বিশাল লম্বা লেন্স লাগানো ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ক্লিক ক্লিক শব্দে সাটার টিপতে টিপতে সে পাখিদের উদ্দেশে মাতৃভাষায় চিৎকার করছে: ‘সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে কত দূরের দেশে চলে এসেছিস তোরা! দাবাইতে! ইগ্রাইতে!’ সে আনন্দে নাচতে নাচতে পাখিদের ছবি তুলছে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে, কখনো হাঁটু ভাঁজ করে আধ-বসা হয়ে। কখনো চোখ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে পাখিদের উদ্দেশে চিৎকার করছে, উচ্চৈস্বরে কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে: তার পর হাততালি বাজাচ্ছে, হাসছে, চিৎকার করে বলছে: মালাৎসি বিরিয়াতা! মালাৎসি! আখ্, কাক ক্রাসিবা! বাহ্, কী সুন্দর! কী সুন্দর! ওই দ্যাখ, কী সুন্দর ছোট ছোট গ্রাম! ওখানে আকাশ মাটিকে চুমু খাচ্ছে!’
গুড়ুম! হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। চমকে উঠলাম। আন্দ্রেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল,আমিও গুলির শব্দটার উৎস খুঁজতে লাগলাম। দেখতে পেলাম, আমাদের বাম দিকে বেশ কিছুটা দূরে জলাভূমির কিনারে দাঁড়িয়ে একটা লোক উল্লাসে লাফাচ্ছে, তার হাতে বন্দুক।
গুড়ুম! হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। চমকে উঠলাম। আন্দ্রেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল,আমিও গুলির শব্দটার উৎস খুঁজতে লাগলাম। দেখতে পেলাম, আমাদের বাম দিকে বেশ কিছুটা দূরে জলাভূমির কিনারে দাঁড়িয়ে একটা লোক উল্লাসে লাফাচ্ছে, তার হাতে বন্দুক।
আন্দ্রেই ওর ক্যামেরাসুদ্ধ ট্রাইপড কাঁধে তুলে নিল। তার পর লম্বা লম্বা পা ফেলে বন্দুকধারী লোকটার দিকে হেঁটে যেতে শুরু করল। আমিও চললাম ওর পিছু পিছু। কাছে গিয়ে দেখলাম, প্রবীণ এক লোক একটা টু টু বোর রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে জলাশয়ের একদম কিনারে। জলাশয়ের দিকে চেয়ে তর্জনি তাক করে নাচাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘ওই যে! ওই যে!’
পানিতে পাখা ঝাপটাচ্ছে একটি আহত পাখি। বারো-চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে পাখিটার দিকে।
আমি লোকটাকে বললাম, ‘কী ব্যাপার? অতিথি পাখি মারা নিষেধ, আপনি জানেন না?’
লোকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘কার নিষেধ? কেডায় মানা করছে?’
‘কার নিষেধ মানে? আইন-কানুন কিছু জানেন না নাকি? দেশের আইনে অতিথি পাখি শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ।’
‘আমারে আইন দেখাইতে আইছেন? আপনে কেডা?’
‘আমি যে-ই হই, আপনি আইন ভঙ্গ করলেন কেন? অতিথি পাখি মারলেন কেন?’
‘সেই কৈফিয়ত কি আপনারে দিতে হইব? কই থিকা আইছেন আপনে?’
‘আমি সাংবাদিক। আপনার ছবিসহ পেপারে রিপোর্ট ছাপায়ে দিব। আপনার নাম-পরিচয় বলেন।
‘আইনে নিষেধ তা তো আমিও জানি। তাই বলে দুই-চারটা পাখি মানুষ মারে না?’
‘কেন আপনি জেনেশুনে আইন ভঙ্গ করলেন? আপনি তো গরিবও না যে পেটের দায়ে পাখি মেরে পেটের বাজারে বেচতে হবে। বলেন, আপনি অন্যায় করেছেন কি না?
‘শুরু থিকাই আপনে চোটপাট দেখাইতাছেন, সাংবাদিক হইছেন তো হইছেডা কী?’
আন্দ্রেই উঠে দাঁড়াল। ও পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। ওটাকে বুকে নিয়েই সে জলাভূমির কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিদের দিকে ভেজা চোখে তাকাল, তার পর অভিমানমাখা আর্দ্র কণ্ঠে চিৎকার করে বলল : ‘বন্ধুরা, এবার ঘরে ফিরে যাও। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।’
এই সময় ছেলেটা পাখিটা নিয়ে পানি থেকে উঠে চরায় এসে দাঁড়াল। পাখিটা ইতিমধ্যে মরে গেছে। বেশ বড় সড় একটা বালিহাঁস। বুকে পালক রক্তে ভেজা, কিছু রক্ত এখনো চুইয়ে পড়ছে। লম্বা গলাটা নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, চোখের মণিদুটো স্থির।
আন্দ্রেই ছুটে গিয়ে ছেলেটার হাত থেকে পাখিটাকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে মাতৃভাষায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘ওহ্ ঈশ্বর! কী নিষ্ঠুরতা!’
লোকটা চমকে উঠল, সে অবাক চোখে আন্দ্রেইকে দেখতে লাগল।
আন্দ্রেই হঠাৎ পাখিটাকে বুক থেকে নামিয়ে একটা পা চোখের সামনে টেনে নিল। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমিও দেখতে পেলাম, পাখিটার পায়ে প্রায় আধা ইঞ্চি চওড়া প্লাস্টিকের একটা রিং বাঁধা। তাতে রুশ ভাষায় লেখা : মস্কো জু, হাঁস, সিরিজ আর, নং ৩,০০৯।
আন্দ্রেই আবার পাখিটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ল।
আমি লোকটাকে বললাম, ‘দেখেছেন, এটা চিড়িয়াখানার পাখি? আপনি একটা বর্বর, কসাই!’
লোকটা থতমত খেয়ে গেল, বিব্রতভাবে রাইফেলের বাঁট কচলাতে কচলাতে, তোতলাতে শুরু করল, ‘মুখ সামলে কথা বলবেন!’
আমি ঘৃণাভরা চোখে একবার তার চোখের দিকে তাকালাম; তার পর মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
আন্দ্রেই উঠে দাঁড়াল। ও পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। ওটাকে বুকে নিয়েই সে জলাভূমির কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিদের দিকে ভেজা চোখে তাকাল, তার পর অভিমানমাখা আর্দ্র কণ্ঠে চিৎকার করে বলল : ‘বন্ধুরা, এবার ঘরে ফিরে যাও। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।’
জলাভূমিতে ওর কথাগুলোর প্রতিধ্বনি উঠল। সেই প্রতিধ্বনির রেশ চলল অনেকক্ষণ ধরে। তার পর একসময় তা থেমে গেলে অসম্ভব এক নীরবতা নেমে এল। যেন সুইচ অফ করে থামিয়ে দেওয়া হলো পাখিদের কলরব; নড়াচড়া বন্ধ, পানির বুকে তারা একদম স্থির।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল জানি না। হঠাৎ জলাভূমির বুকে ছর ছর ছর শব্দ শুরু হল। পাখিরা পায়ে ও পাখায় ভর করে পানির উপর দিয়ে দৌড়–তে শুরু করল। তার পর ফট্ ফট্ ডানার শব্দ শুরু হলো। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি জলাভূমি থেকে উড়ে উঠল। পাখিতে ছেয়ে গেল আকাশ, ডানার শব্দে আর কিচিরমিচির ধ্বনিতে ডুবে গেল চরাচর।
পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উত্তর আকাশের দিকে উড়ে যেতে শুরু করল। তাদের বিচিত্র কলরবে ও ডানার শাঁই শাঁই শব্দে ভরে উঠল আকাশ। জলের কিনারে দাঁড়িয়ে আন্দ্রেই আকাশের দিকে চেয়ে রইল; তার মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি এমন যেন সে দেখতে চাইছে কোনো পাখি তার নির্দেশ অমান্য করে জলাভূমিতে থেকে যায় কি না।
পাখি এত অজস্র যে তাদের যাওয়া যেন শেষ হচ্ছে না। আকাশের দিকে চেয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার ঘাড় ধরে এল। কিন্তু আন্দ্রেই আগের মতোই অপলক; যেন সে ওভাবেই চেয়ে রইবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার নির্দেশ সম্পূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে।
পাখিদের সর্বশেষ ঝাঁকের সবচেয়ে পেছনের পাখিটি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে গেলে আমরা জলাভূমির দিকে চোখ ফেরালাম। একটা পাখিও অবশিষ্ট নেই, জলাভূমির সাদা ঘোলাটে পানি ডিসেম্বরের সকালের রোদে চকচক করছে।
পরদিন ঢাকার সব খবরের কাগজে খবর বেরুল, সাভার এলাকার সব অতিথি পাখি চলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশে কোনো ভয়াবহ দূষণের ফলে এমনটা ঘটে থাকতে পারে। পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা ওই এলাকার খাল-বিলের পানি, কাদা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান পরীক্ষা করে দেখার জন্য নমূনা সংগ্রহ করছেন।
সপ্তাহ দুই পরে এক রোববার সকালে আন্দ্রেইয়ের টেলিফোন : ‘বন্ধু, আমার বদলির আদেশ এসেছে।’
‘আঁ? বলো কী?’
‘হ্যাঁ, বন্ধু, যেতে হচ্ছে।’
‘কোথায়? এবার পোস্টিং কই?’
‘কলম্বো।’
‘আন্দ্রেই, দ্রুগ মোই, শ্রীলংকার লোকজন কি পাখি মারে না?’
আন্দ্রেই জোরে হেসে উঠল: ‘দা তিশ্তো! কী যে বলো তুমি!’
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়