প্যারাফিন লন্ঠন ও অন্ধকার
কিছু কিছু মৌনতার হয়তো কোনো মানেই হয় না।নীরবে মাথা নেড়ে ‘হু’ শব্দটা বের হয়ে আসে মুখ দিয়ে।আঁধারের ওপাশে কেউ হয়তো বুঝতে পারে।কেউ একেবারেই না।তিলোত্তমা কি আজ বুঝতে পেরেছে? ওকে না করলে কি শুনত? আমিই-বা না করার কে?
শুয়েছে তো বরের সাথে শুয়েছে, তাতে কার কী! মনে হয়, এই সব সম্পর্ক যেন একেকটা ধোঁয়াকার ফানুস।অথবা একটা সূক্ষ্ম মাকড়সার জাল।জালে সুতোয় সুতোয় সম্পর্কের কেন্দ্রে যাবতীয় যোগাযোগ, একটা আমার সুতো, একটা তিলোত্তমার, অন্যটা…। যেন একটু অসাবধান হলেই সম্পর্কে টান পড়ে।শুরু হয় অস্থিরতা।যেন একটা নির্দিষ্ট তালে হাঁটছে আর দৌড়াচ্ছে সম্পর্ক আর সম্পর্কের মানুষগুলো।
নীশু সেদিন বলল, ‘তাল ঠিক নেই, সুরঞ্জনাকে আরো ভালোবেসে ডাকো।ভাবো, আমি সুরঞ্জনা।’ সেবার জীবনানন্দ স্মরণে আমার কবিতা পড়া হয়নি। আমি সুরঞ্জনাকে ভালোবাসতে পারিনি। কিন্তু তিলোত্তমাকে তো ডাকতে পারি!
নক্ষত্ররা রয়ে গেছে নদীর ওপারে/ চারদিকে প্রান্তর ও ঘাস…
আবার সেই তালের খেলা। সেলফোন বাজছে একটা সময় পরপর, বাজছে আবার থামছে…। তিলোত্তমার ফোন, জানো, আজ ও বিছানায় দারুণ ছিল, পাক্কা বিশ মিনিট।’ একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু হারামিটা দেখলই না বুকের খয়েরি তিলটা, কী হলো! চুপ কেন?’
হাহাহা…
শব্দগুলো ঘর কাঁপিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে জানালার ওপাশে। মাকড়সার জালে আবার শুরু হলো গন্ডগোল! আমি জানি, তিলোত্তমা এখন লাইন কেটে দেবে। তারপর সেলফোন অফ করবে। ঠিক ভোর হওয়ার আগে আবার ফোন করবে।
পাড়ায় বাঘা গরগর করে জানান দেয় অস্তিত্বের। মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ শব্দে টানা গর্জে ওঠে অনেকক্ষণ। জানালার ভাঙা কাচে ভেসে আসে হালকা যন্ত্রণার শীত।পায়ের পাতা হাঁটু পেঁচিয়ে বুকে ভর করে নিকোটিন কুয়াশা।কুয়াশায় চাপা পড়ে বুকে তিলোত্তমার খয়েরি নিশ্বাস। ভাবায়, আমাকে ভাসায়, হারায়…অন্য সুতা কথা কয়!
নারীরা আসে হারিয়ে যায়, ধীর জগতের সাথে/ জেগে থেকে আমি পেয়েছি বিষয় স্থিরতা…
নীশুকে ভাবতেই সম্পর্কের সুতোয় টান পড়ে। এক পৃথিবী অস্থিরতায় কেঁপে ওঠে মাকড়সার জাল। রাস্তার শেষ মোড়ে কারা হেঁটে যায় অথবা ফিরে আসে। একেকটা প্রিয় নারী হয়ে ওঠে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো। কিন্তু তিলোত্তমাকে ভাবতেই আমি কেমন স্থির হয়ে যাই। প্রতিটা সুতোয় শুরু হয় যাবতীয় যোগাযোগ। যেন এর চেয়ে বড় সত্য এই মুহূর্তে আর কিছু নেই। এখানে শরীর নেই, প্রেম নেই, আছে মোহ। বিস্ময়ের নাম করে রাতদুপুরে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া স্থিরতা এখানে থাকে। এখানে সাঁতরায়। নীশু প্রায়ই বলে, ‘তোমার বুক নদীর মতো, এখানে শুধু আমি সাঁতরাব।’ নীশু এখানে সাঁতার কাটে। স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়। অস্থিরতার ঘামে এঁকে দিয়ে যায় আদিম চুমু।
প্রতিমুহূর্তের নীরবতা রাতকে আরো গভীর করে তোলে। নিকোটিন পৃষ্ঠায় রাতের শরীরে এঁকে যায় কিছু অক্ষর। বাঘার ঘেউ ঘেউ ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে মিলিয়ে যায় কুহু শব্দে। বড় রাস্তায় ঠকঠক শব্দে একটা খালি ভ্যান থামল, কি চলে যাচ্ছে কিছু বোঝা যায় না অন্ধকারে। যেন কেউ ফিরে আসে, অথবা চলে যায়…! নীশুকে আজ ফোন করা হয়নি। জেগে আছে নিশ্চিত। নীশুকে ভাবতেই সম্পর্কের সুতোয় টান পড়ে। এক পৃথিবী অস্থিরতায় কেঁপে ওঠে মাকড়সার জাল। রাস্তার শেষ মোড়ে কারা হেঁটে যায় অথবা ফিরে আসে। একেকটা প্রিয় নারী হয়ে ওঠে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো। কিন্তু তিলোত্তমাকে ভাবতেই আমি কেমন স্থির হয়ে যাই। প্রতিটা সুতোয় শুরু হয় যাবতীয় যোগাযোগ। যেন এর চেয়ে বড় সত্য এই মুহূর্তে আর কিছু নেই। এখানে শরীর নেই, প্রেম নেই, আছে মোহ। বিস্ময়ের নাম করে রাতদুপুরে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া স্থিরতা এখানে থাকে। এখানে সাঁতরায়। নীশু প্রায়ই বলে, ‘তোমার বুক নদীর মতো, এখানে শুধু আমি সাঁতরাব।’ নীশু এখানে সাঁতার কাটে। স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়। অস্থিরতার ঘামে এঁকে দিয়ে যায় আদিম চুমু।
ঘুমাবার নাম করে পড়ে আছে ঢের যাত্রি/ ভান টের ভালো হলে অঘোরে ঘুমাব…
আশ্চর্য! এমন কখনো হয়নি। যেন ঘরের প্রতিটা দেয়ালে ভাসছে নিজের নিশ্বাসের শব্দ। সাথে সময়ের নাম করে ঘড়ির কাঁটার নীরব প্রস্থান। হঠাৎ বিছানায় সাঁতরে উঠি। ফাটলধরা দেয়ালে খুঁজে বেড়াই নিজের অধঃপতনের দাগ। যেন আঁধারে ওপাশে কেউ ডাকে। খুঁজতে গেলেই বাস্তবতার চিলেকোঠা, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ, সম্পর্ক আর সিজোফ্রেনিয়ার হুড়োহুড়ি। তৃষ্ণা পায়, নিকোটিন তৃষ্ণায় জ্বলে ওঠে শিকারি চোখ। এদিক-ওদিক তাকাই। বুকপকেটে দেয়াশলাই কাঠি ঝনঝন করে ওঠে তালে, কারো নাম ধরে ডাকব? অভিমান হয় তিলোত্তমার ওপর। ভেতরে পাপ জন্মায়। নীশুকে অনেক দূরের মনে হয়।অথচ নীশুর হাত ধরেই হেঁটে চলি রাস্তায়।চাঁদের আলোয় হুটখোলা রিকশায় দেখি নীশুর চুলের অবাধ্যতা।ঠোঁটের নিখুঁত ব্যাকরণের মাতাল হই।আবার সেই গল্প শুনাই তিলোত্তমাকে।ও খেপে ওঠে, আবার স্থির হয়।তারপর শোনায় তার হারামিটার গল্প।হয়তো তখন আমিও প্রকৃত হারামির মতো স্থির হই তিলোত্তমার চোখে।না শরীর, না প্রেম, না মিথ্যা, না স্বপ্ন…কিছু নয়! বিস্ময় আমায় ডাকে!
নক্ষত্র এবং নক্ষত্রের অতীব নিস্তব্ধতা…
রাত ক্রমশ ভোর হতে থাকে।আমার ভেতরে হারামিটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে।এখন আর ঈর্ষা হয় না, রাগ হয় না।তিলোত্তমা একনিশ্বাসে বলে যায় তার হারামিটার গল্প।বলতে যেয়ে ওর নিশ্বাস ভারী হয় অথবা দূরে কোথাও চাপা পড়ে তার দীর্ঘশ্বাস।বাইরে আঁধারের রেশ কাটেনি এখনো।আলো-আঁধারের ঘোরে তিলোত্তমার কণ্ঠটাকে অপার্থিব মনে হয়।যেন জাল গোটাচ্ছে অথবা পথ হারিয়ে ফেলেছে হরপ্পার অন্ধকারে।তবু যেন সম্পর্কের সুতোয় কী অদ্ভুত যোগাযোগ।ভাবনায় ছেদ পড়ে।
চুপ কেন?
কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।
তা তো করবে না, আমিই-বা তোমার কে?
সেদিকে আমার মন নেই।আমি ক্রমশ হেঁটে চলছি শেষ নক্ষত্র আলোয়।যেন হরপ্পায় রেখে আসা কুয়াশার ঘোর কাটলেই গলির মোড়ে গত রাতের অস্পষ্ট ভ্যান দৃশ্যমান হবে!
নীশু গত রাতে ঘুমায়নি।ওকে আদর করে ঘুম পাড়াতে হয়।অচেতনে হাত চলে যায় তার চুলের ঢেউয়ে, সাঁতরায় পরিচিত আঙুল।ডুবসাঁতার কাটি নীশুর খোলা চোখে…! সুতোয় সুতোয় অস্থিরতার যে সম্পর্ক দৌড়ায়, তাও মনে হয় স্থিরতা।অস্থিরতা বলে এত দিন যা জেনেছি, মূলত তা নশ্বরতার প্রস্থান।গত রাত অবধি যে রয়ে গেছে আঁধারের ওপাশে, এখন সে হয়ে উঠল অবয়ব।নীশুর ঠোঁটে চুমু ওড়াই।ও শিশু হয়ে ওঠে ভোরের প্রথম চুমুর শব্দে ‘সুরঞ্জনা তোমার হৃদয় আজ ঘাস…’। নীশু হেসে গড়াগড়ি খায়।আমার চোখে ঘোর জাগে।অস্থিরতা বাড়ে, অন্য রকম অস্থিরতা…
এই যে নীশুর গালে চুমু পাখি ওড়াচ্ছি, ডানা মেললেই সব জানালায় এখুনি ভোর নামবে।এমন ভোর একবারই নেমেছিল হরপ্পায়, কোনো এক অন্ধকার রাত শেষে…