:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নিবেদিতা আইচ

গল্পকার

ব্যবচ্ছেদ ক্লাস

ব্যবচ্ছেদ ক্লাস

চায়ের গ্লাসের ভেতর জমে থাকা বিস্কুটের ভগ্নাংশগুলো খুব ধৈর্য ধরে বের করে মুখে পুরে দেয় মনসুর। বাড়ি থেকে বেরিয়েছে এক প্লেট মোটা চালের ভাত, বেগুনভর্তা আর ডাল দিয়ে। সেসব কখন হজম হয়ে গেছে! ভেতর থেকে কেউ ‘জ্বালানি চাই’ বলে চেঁচায় অনবরত। এগারোটার দিকে আরেকবার কিছু পেটে দিতে হয় ওর। খিদে পুষে রাখলে মাথায় কাজ করে না মোটেও।

প্রায় প্রতিদিনই একবার করে এই অদ্ভুত চাকরিটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় মনসুরের। ছেড়ে দিলে বাড়ির কেউ কিছু বলবেও না তাকে। বরং খুশিই হবে! কিন্তু না, একটু পরেই মত বদলায় মনসুর মিয়া। এত বছরের অভ্যাসটা ছেড়ে থাকতে পারবে না সে। চাকরি ছাড়তে ইচ্ছে হয় রাগের মাথায়। এই যে এখন একটু আয়েশ করে চায়ের ভেতর গলে পড়া নাবিস্কো বিস্কুট খাচ্ছে, হয়তো এখনই ডাক পড়বে ওর। ছাত্ররা এসে বলবে, মামা, আসেন একটু সারফেস মার্কিং করি কিংবা বলবে, হার্ট এনে দেন, কিডনি বের করে দেন। শান্তিতে জিরোতেই দেয় না কেউ তাকে।

এই যে দিনভর এত ব্যস্ততা ওপর, তা নিয়ে যত বিরক্তিই দেখাক মনে মনে আসলে এটাতেই তৃপ্তি পায় মনসুর। ছাত্ররা তাকে বেশ সমীহ করে। এনাটমি বিভাগের সেও একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাই মনে মনে একটা গর্ব আছে তার। এই যে সারফেস মার্কিং করার সময় ছাত্ররা চক দিয়ে শরীরে ধমনি, শিরা-উপশিরার গতিপথ আঁকে, লিভার বা কিডনির সঠিক অবস্থান শিখে নেয়, মনসুর না থাকলে কী করে হতো? তার হাড়-জিরজিরে শরীরই যে শুধু ওদের কাজে আসে, তা তো নয়, শেখার সময় ওদের ভুলগুলো শুধরে কে দেয়? এই মনসুর মিয়াই এ ব্যাপারে সবচেয় অভিজ্ঞ। তাই গর্ব করাটা তার কাছে জায়েজ বলেই মনে হয়।

মনসুর শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের গ্লাসটা রেখে উঠে পড়ে। আবার কাজে লেগে যেতে হবে। দশ মিনিটের এই বিশ্রাম বড্ড দরকার ছিল। ডিসেকশন হলে যেতে হবে এখন। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও অনেক কাজ রয়ে গেছে। ভিসেরাগুলো গুছিয়ে রাখতেই সারা দিন চলে যাবে ওর।

একটু পর মুজিব স্যারকে দেখতে পেয়ে মনসুর মিয়া হাত ধুয়ে দ্রুত বের হয়ে এল ডিসেকশন ক্লাস থেকে। স্যারের পেছন পেছন হাঁটে সে।

মনসুর মিয়া।

জি স্যার।

মিউজিয়াম থেকে ভিসেরাগুলো সরাও নাই কেন কালকে? সরায়ে ফেলো এখন।
জি স্যার…

আর নতুন ভিসেরাগুলো রাখছ ঠিকমতো?

রাখতেছি। স্যার।

না না…রাখতেছি মানে? সব তো ছড়ানো-ছিটানো…আজকে কাজ নাই, এখনিই সব তুলে রাখো।

মাঝে মাঝে ডিসেকশন হলে নতুন বডি আসে। টেবিলে রাখা হয় বডিটাকে। এই তো দুদিন আগে এক ডাক্তার তার বাবার বডি রেখে গেছেন এখানকার হিমঘরে। মারা যাবার সময় নাকি তার নাকি শেষ ইচ্ছে ছিল নিজের বডিটা এখানে দান করে যাবেন। মনসুর শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে ডাক্তার ছেলের মুখটা দেখছিল। কেমন লাগে প্রিয় মানুষটাকে এভাবে রেখে যেতে? ছেলেটা কি জানে চোখের সামনে এমন কারও লাশ ব্যবচ্ছেদ হতে দেখলে বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে?

মনসুর মিয়া মাথা নেড়ে ভিসেরা আনতে চলে গেল। এনাটমি বিভাগে কাজ করছে সে ছাব্বিশ বছর ধরে। এই সব ভিসেরা, ডিসেকশন হল নামগুলোর মানে শিখতে বেশি দিন লাগেনি তার। মুজিব স্যার কথা বললে হাঁ করে শুনে থাকত মনসুর। ভিসেরা মানে লিভার, কিডনি, হার্ট- শরীরের এই সব অঙ্গপ্রতঙ্গ। ডিসেকশন হলে ফরমালিনে নিমগ্ন থাকে এসব। বছরজুড়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা এগুলোর খুঁটিনাটি পড়ে। এ ছাড়া লাশের ওপর ছুরি-কাঁচি চালিয়েও পড়াশোনা চলে। এভাবে বহু বছর ধরে দেখে আর শুনে শুনে শিখেছে অনেক কিছুই। এত বছরের দেখাশোনার কারণে সে চাইলেই এখন দিব্যি ছাত্র পড়াতে পারে, তার জ্ঞান তো নেহাত কম নয়। কিন্তু তাতে কী! সে তো কোনো পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি করা লোক নয়। তবু ছাত্ররা ভাইভা পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর না পারলে হঠাৎ মনসুর মিয়াকে উত্তর জিজ্ঞেস করেন মুজিব স্যার। বেশির ভাগ সময়েই মনসুর হড়বড় করে বলে ফেলে কিছু না কিছু এবং প্রায় সময়ই নির্ভুল উত্তর দেয় সে। সকৌতুকে তাকিয়ে থাকে সবাই।

কলেজ খুলেছে দুদিন হলো। এমবিবিএস ছাত্ররা ঈদের বন্ধে বাড়ি গিয়ে ফেরেনি এখনো। গতকাল পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা ছিল। মনসুরের ব্যস্ততা ছিল সারা দিন। আজ সে তুলনায় ঝাড়া হাত-পা। সে ভিসেরাগুলো নিয়ে ফরমালিনের বালতিতে ডুবিয়ে রাখছে সযত্নে। নতুন ছাত্ররা ফরমালিনের গন্ধে মুখ বিকৃত করে, হাত ধোয় হাজারবার। আর মনসুর মিয়ার ফরমালিনের গন্ধ না পেলে পেট ভরে না। কলেজ বন্ধ থাকলে তাই অস্থির লাগে। এই নিয়ে বউ দুটো কথা শোনাতে ছাড়ে না। তাতে কী! সে কিছুই গায়ে মাখে না।

মাঝে মাঝে ডিসেকশন হলে নতুন বডি আসে। টেবিলে রাখা হয় বডিটাকে। এই তো দুদিন আগে এক ডাক্তার তার বাবার বডি রেখে গেছেন এখানকার হিমঘরে। মারা যাবার সময় নাকি তার নাকি শেষ ইচ্ছে ছিল নিজের বডিটা এখানে দান করে যাবেন। মনসুর শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে ডাক্তার ছেলের মুখটা দেখছিল। কেমন লাগে প্রিয় মানুষটাকে এভাবে রেখে যেতে? ছেলেটা কি জানে চোখের সামনে এমন কারও লাশ ব্যবচ্ছেদ হতে দেখলে বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে? জানার কথা নয়। মনসুর মিয়া জানে ব্যাপারটা কেমন। নতুন বডি এলে প্রতিবারই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাশগুলো দেখে। চেনা কারও আদল খুঁজে বেড়ায় কয়েকটা দিন। তারপর আবার নিজস্ব ব্যস্ততায় মগ্ন হয়ে পড়ে।

তিন মেয়ে এক ছেলের বাবা মনসুর। মেয়েগুলোর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে সে ছেলেটার কথা বলে না। এমন নয় যে রমজানের কথা সে ভুলে থাকে। কিন্তু ওই নামটা মুখে আনে না। এমন অদ্ভুত মৃত্যু কী করে ভোলা যায়!

মেডিকেল কলেজের মর্গে অজ্ঞাতনামা মানুষের লাশ আসা নতুন কিছু নয়। বছর পাঁচেক আগে একদিন স্যার মনসুর মিয়াকে বললেন, ‘নতুন বডিটা ডিসেকশন টেবিলে তোলো।’
বডিটা তুলতে বেশি বেগ পেতে হয়েছিল। মনসুর চান মিয়াকে বলছিল, কোনো তাগড়া জোয়ান ছেলের শরীর হবে এটা।

দুজন মিলে বডিটা টেবিলে রাখতেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। রমজান! ওরা দেখতে পেল মনসুরের যুবক ছেলেটা নিথর হয়ে শুয়ে আছে। বারবার দেখার পরও সত্যটা সেদিন আর মিথ্যে হলো না।

ভবঘুরে স্বভাবের ছেলে ছিল রমজান। দুটো মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর তার খোঁজ মিলল ডিসেকশন হলে! ছাত্ররা শিখবে রমজানের লিভার, স্টোমাকের, ব্রেইনের এনাটমি। এভাবে ছেলেটার খোঁজ পাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি মনসুর মিয়া। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ফরমালিনের ঘ্রাণমাখা ঘরটায়।

ভবঘুরে স্বভাবের ছেলে ছিল রমজান। দুটো মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর তার খোঁজ মিলল ডিসেকশন হলে! ছাত্ররা শিখবে রমজানের লিভার, স্টোমাকের, ব্রেইনের এনাটমি। এভাবে ছেলেটার খোঁজ পাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি মনসুর মিয়া। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ফরমালিনের ঘ্রাণমাখা ঘরটায়।

মুজিব স্যার হয়তো নিজেকে অপরাধী ভাবতেন। তাঁর হাতে তো কিছুই ছিল না, তবু মনসুর সামনে এলেই দৃষ্টি এড়িয়ে যেতেন। তারপর একদিন চাঁন মিয়া এসে বলল, ‘স্যার আপনারে বাড়ি যাইতেগা বলছে। ডিসেকশন হলের কাজ আপনার আর করা লাগত না।’
মনসুর মিয়া হেসেছিল কথাটা শুনে। তারপর স্যারের রুমে গিয়ে বলে এসেছে, সে এখানেই থাকবে। স্যার খুব রাগারাগি করলেন, তবু মনসুরকে টলাতে পারলেন না।

স্যার, আমি আর কই যাব। আমার রমজানরে এখানে পাইছি। আর কই যাব আমি বলেন?

স্যারের চশমার ভারী কাচে বাষ্প জমে? নইলে স্যার ব্যস্ত হয়ে অন্য দিকে চলে যান কেন? মনসুর মিয়া হাসে। অচেনা যুবকের লাশ দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। রমজানের সাথে মিল খুঁজে বেড়ায়। আপনমনে বিড়বিড় করে, আহা রে! কার ছেলে গো বাবা তুমি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বডিতে হাত বুলিয়ে দেখে কোথায় কী আছে।

প্রতিদিন দুপুরে মনসুর মিয়া করিডরের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। বসে ঝিমোয় ইচ্ছেমতো। আজকাল অবশ্য নতুন উপদ্রব হয়েছে। ঈদের বন্ধের আগে একদিন স্যার এসে বললেন তার অবসরের আর বেশি দেরি নেই, মনসুর মিয়া চাইলে নিজের টাকাপয়সা বুঝে নিতে পারে তার আগে। সব হিসাব স্যার নিজে চাকরিতে থাকা অবস্থায় করে দিয়ে যেতে চান। মনসুরের মন মানে না। বয়স হয়েছে সে ঠিক। কিন্তু প্রতিদিন ছাত্রদের হাতে ভিসেরা তুলে দেওয়া, পরীক্ষার মৌসুমে ছুটোছুটি করে লিভার-কিডনি-ব্রেইন স্যারদের সামনে সাজিয়ে দেওয়া- এসব ছেড়ে ঘরে গিয়ে বসে থাকার মানে আছে?

স্যার, আপনার কেমন লাগবে চাকরি শেষ হয়ে গেলে?

মনসুর মিয়া ইচ্ছে করেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। রাশভারী মানুষটা নিরুত্তর তাকিয়ে থাকে।

আমি কোনখানে যামু না, স্যার। আপনি থাকতেই দেখবেন একদিন টেবিলে আমার বডিটা দিয়া যাব। সেই বডি দিয়া ছাত্ররা পড়বে।

মনসুর খ্যাপা গলায় কথাগুলো বলে ফেলে।

হুম, তা তোমার মতো বুড়ার শরীর দেখে ওরা শিখবেটা কী? কথা শোনো, অনেক হইছে, এসব ছাড়ো। আর যাও, এখন বাড়ি যাও মিয়া। ক্লাস টাইম শেষ।

মাঝে মাঝে ফেরার আগে ফরমালিনের বোতলটা ভরে সাথে নেয় মনসুর। বাড়িতে নিয়ে যায়। খুব সাবধানে লুকিয়ে রেখে দেয় কোথাও। বউ টের পেলে আবার একটা চেঁচামেচি বাঁধাবে। তাই এত গোপনীয়তা। ছুটির সময় ফরমালিন দিয়ে হাত ধোয় মনসুর। এভাবে রমজান, আত্মজের ঘ্রাণ পায় সে।

সব কটা ক্লাসরুমে তালা ঝোলানো হলে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে কলেজ থেকে বেরোয় মনসুর। চাকরিটা শেষ হয়ে গেলে তার দিন চলবে কী করে? এসব ভেবে আজকাল হুটহাট মন খারাপ হয়ে যায়।

মাঝে মাঝে ফেরার আগে ফরমালিনের বোতলটা ভরে সাথে নেয় মনসুর। বাড়িতে নিয়ে যায়। খুব সাবধানে লুকিয়ে রেখে দেয় কোথাও। বউ টের পেলে আবার একটা চেঁচামেচি বাঁধাবে। তাই এত গোপনীয়তা। ছুটির সময় ফরমালিন দিয়ে হাত ধোয় মনসুর। এভাবে রমজান, আত্মজের ঘ্রাণ পায় সে। আর গত ছাব্বিশ বছরের স্মৃতি রোমন্থন করে।

কোনো নোটিশ ছাড়াই মনসুর মিয়ার কাজে কামাই দিতে হয় আজকাল। বুকে ব্যথা হয়। আর খুসখুসে কাশি, ঘুসঘুসে জ্বর। স্যার প্রতিদিন বলেন, ‘মনসুর, পরীক্ষাগুলো করাও। প্রেসক্রিপশন লিখে দিলাম কি বাদামের ঠোঙা বানাতে?’

মনসুর ভাবে কাল যাবে, নয়তো পরশু। সময় আর হয়ে ওঠে না। ছুটি নিতেও ইচ্ছে হয় না। প্রতিদিন ডিসেকশন হলের দেখাশোনা নিজের হাতে করতে হয় তার। এ কাজে সে ত্রুটি রাখে না একচুল। কলেজ থেকে দুই পা বাড়ালেই হাসপাতাল। তবু গোঁয়ার্তুমি করে সে। রোগটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে নিজের কাছে।

ছাত্ররা ছুটি শেষে ক্লাসে ফেরে। পরীক্ষার রুটিন ঝুলিয়ে দেওয়া হয় নোটিশ বোর্ডে। মনসুর মিয়া সাতসকালে এসে মিউজিয়াম আর ডিসেকশন হলের দরজা খুলে দেয়। একটু পর তার চারপাশে ছাত্ররা ভিড় করে। ওরা বলে, ‘মামা, কিডনিটা একটু দেখান।’ কেউ লিভারটাকে হাতে নিয়ে বলে, ‘এনাটমিক্যাল পজিশনটা কি ঠিক হয়েছে, মনসুর মামা?’

মনসুরের বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন করে। ছাত্রদের প্রশ্নবাণ কিছুক্ষণের জন্য ব্যথা ভুলিয়ে রাখে। তারপর ক্লাসের সময় হয়ে যায়। টিচাররা যার যার ক্লাসে ঢুকে যান। ছাত্ররাও মগ্ন হয় তাদের পরীক্ষাসংক্রান্ত নানান আলোচনায়। মনসুর লঘুপায়ে মিউজিয়ামের কোণে গিয়ে বসে। বুকের ওপর ভারী পাথরটাও জেঁকে বসে তখন। দরদর করে ঘামে মনসুর। ফরমালিনের বালতিটা গড়িয়ে পড়ে। তার পাশে পড়ে থাকে মনসুর মিয়ার শরীর, আধময়লা শার্টটা ভিজে যায় ফরমালিনে।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.