:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
রবিউল আলম নবী

কবি, গল্পকার

ভোর

যামিনীর মধ্যযাম

প্রস্ফুটিত এক সকালের অপেক্ষায় আছি সারা রাত। একা নই, আরও দুজন। একজন সামান্য পরিচিতা, অন্যজন একেবারেই অপরিচিতা। সামান্য পরিচিতার নাম তৃষ্ণা, একেবারেই অপরিচিতার নাম রতি।

রতি আমাদের সঙ্গে মধ্যরাতে যোগ দিয়েছে। আমরা মেঘনার পাড়ে একটা খুপরির ভেতর মিলন করছিলাম তখন। তৃষ্ণার মাংসের ভেতর আমার মাংস, আমার চামড়ায় তৃষ্ণার দাঁতের দাগ, লালার আঠা। তৃষ্ণার ধারালো নখ আমার পিঠে রক্ত তুলে ডুবে গেছে। কেননা, সে অসহ্য আরামে মরে যাচ্ছিল। আমি সুখ-ব্যথা, ব্যথা-সুখে শীৎকার করছি, তৃষ্ণা সুখে ও সুখে চিৎকার আর শীৎকারে মেঘনার জলে জোয়ার এনে দিয়েছে। হঠাৎ ঢেউয়ের মতো রতি এল। এল তো এল- শাড়ি তুলে তৃষ্ণাকে সরিয়ে নিজের ভেতর আমাকে ডুবিয়ে দিতে এল। তৃষ্ণা বাধা দিল না। বাকি সুখ রতিকে ঢেলে ক্লান্ত আমি চিত হয়ে শুয়ে পড়ি। তারপর সকালের অপেক্ষা।

রাত্রির অন্ধকার যতক্ষণ শাসনকার্য চালায়, ততক্ষণ ভোরের কী সাধ্য ফুটে ওঠে আলোর স্ফিত কোলাহল নিয়ে? ভোর তাই ঢের বাকি। ভোর মানে তো রাত্রির ফেনা। কালের কিনারায় উপচে পড়া অন্ধকারের সাদা তরঙ্গ। রক্তে ও মনে যদি মিশে থাকে লোহিতাভ শ্রোণির উদ্বাহু আহ্বান, রাত্রির (অন্ধকারের) নিষ্ক্রমণ কে চায়? তাই- না আমি, না তৃষ্ণা, না রতি- কেউ রতিকলার সুখদৃশ্যচ্যুত হতে চাইছিলাম না। অথচ ভোরের প্রত্যাশা করছে সমগ্র পৃথিবীটাই।

বলে রাখি, তৃষ্ণার বোন রতি। বোন মানে সহোদরা। কনিষ্ঠা। তৃষ্ণার সাথে আমার পরিচয় রেলস্টেশনের একটা পরিত্যক্ত বগির ভেতর। একা একা স্বমেহনের অ-সুখযন্ত্রণায় সে যখন মারা যাচ্ছিল আগের দিন রাতে, আমি তাকে বাঁচিয়ে তুলি এক ঘণ্টার কায়িক পরিশ্রমে। বেঁচে গিয়ে সে হয়তো রতিকে এক ঘণ্টার একনিষ্ঠ কায়িক শ্রমের গল্পটা বলে থাকতে পারে। আজ রাতে এই খুপরির ভেতর থাকব বলে দিনে একটা পরিকল্পনা ছিল আমাদের। এটাও তৃষ্ণা রতিকে বলে থাকতে পারে। স্বমেহনযন্ত্রণা সইতে না পেরে সে হয়তো চলে আসে এখানে, এটা অবশ্য আমার অনুমান; কেননা, এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়নি কোনো, তার জন্যই তৃষ্ণা রতিকে বাধা দেয়নি কিংবা বলতেও পারেনি কোনো কিছু, আর যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে রতি কি আমাদের মাঝে আগের দিনই রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত বগির ভেতরে ঢুকে পড়েনি? এক মিলনে দ্বিত্বদেহ সম্ভোগসুখলাভ আমিই বা ছাড়ব কেন? একাধিক দেহকে তৃপ্তরসে সিক্ত রেখে নিজে অতৃপ্ত থাকা বীর্যবানদের মধ্যে তো আমিও একজন হতে পারি।

তৃষ্ণার মাংসের ভেতর আমার মাংস, আমার চামড়ায় তৃষ্ণার দাঁতের দাগ, লালার আঠা। তৃষ্ণার ধারালো নখ আমার পিঠে রক্ত তুলে ডুবে গেছে। কেননা, সে অসহ্য আরামে মরে যাচ্ছিল। আমি সুখ-ব্যথা, ব্যথা-সুখে শীৎকার করছি, তৃষ্ণা সুখে ও সুখে চিৎকার আর শীৎকারে মেঘনার জলে জোয়ার এনে দিয়েছে।

তৃষ্ণা সামনের মেঘনাকে টেনে গুটিয়ে ফেলল একটা কুঁচি দেওয়া শাড়ির মতো। তারপর কয়েক ভাঁজ করে হাতে নিয়ে বলল, নদীটা শিথানে নিয়ে শুয়ে পড়ো। নদী কেবল স্রোতস্বিনী নয়, কেবল প্রবহমান জলরাশি নয়, নদী একটা প্রজ্ঞাপীঠ। শুয়ে পড়ো।
রতি চাঁদের আলোকে মশারির মতো গুটিয়ে এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, নাও, শেষ রাতে বাতাস এলে গায়ে দিয়ো। অনন্ত শূন্যে বিচরণশীল এই সব অস্থির মৃতকণার নাম জ্যোৎস্না নয়, কেবল আলোকরশ্মি নয়, বোধের স্ফুলিঙ্গ। প্রবল বাতাস এলেও নেভে না, জ্বলে ওঠে।
তৃষ্ণা আমার জিহ্বামধু খেলো। প্রজ্ঞাপাঠের স্তব করে।
রতি আমার লিঙ্গমধু খেলো। বোধের স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে জ্বলে।
ওদের দুজনের শ্রোণি ফুটে উঠল নাগলিঙ্গম ফুলের মতো। চৌষট্টি পাপড়ির ভাঁজ খুলে। স্তরে স্তরে।

আমি তৃষ্ণার ভেতর থেকে ফুটে উঠি রতির ভেতর। আমি রতির ভেতর থেকে ফুটে উঠি তৃষ্ণার ভেতর। তৃষ্ণা আমার আবহমান রক্তসিম্ফনি, রতি আমার সেই সিম্ফনির ভেতর গোপন নৃত্যমুদ্রা।

 

যামিনীর শেষভাগ

তৃষ্ণার চুলে হাত দিয়ে বললাম, এটা কী?
সে বলল, এটা নয়, বলো- এগুলো। এগুলো লাশ। ভেতরে যত অন্ধকার মরে আছে, সেসবের লাশ।
রতির মাথায় হাত রাখতেই সে বলল, প্রশ্ন কোরো না। এগুলো চুল। তোমরা- পুরুষেরা আদর করে কেশ বলো। স্পর্শ করে দেখো, গন্ধ নিয়ে দেখো, টের পাবে অদৃশ্য রণন। পুলকিত ও মোহিত না হয়ে পারবে না তুমি।
রতির জিবে জিব ঢুকিয়ে বললাম, এটা কী?
সে বলল, জিব। জিবও একটা লিঙ্গ, রতিকালে ফুঁসে ওঠে পদ্মগোখরোর মতো।

তৃষ্ণা পদ্মগোখরোর মতো সেই জিব আমার আলজিবের গোড়া পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এটা জিব নয়, লোভ। লোভের একটা শারীরিক নাম থাকা দরকার, তাই আমি বলি সমর্পণ। ঢুকিয়ে দিয়েছ মানে ঢুকে গেছ। আমিও ঢুকে গেছি সমর্পণের গলিতে। তুমি শ্রোণিপথে ঢুকো, আমি মুখগহ্বর-পথে- দাঁতের অরণ্য ডিঙিয়ে- নরম মাংসের গরমে।
রতির স্ফীত বুকে আমার হাত। হাতের আঙুল। আঙুলের চাপ। চাপের শক্তি। বললাম, এটা কী?
রতি বলল, স্তন। মাংসপিণ্ড। শিরার গোলক। চামড়ার ধাঁধা।
তৃষ্ণা বলল, আমারটা ধরো। স্তন নয়, মাংস নয়, শিরা নয়, চামড়া নয়, শরীরের ভাষা; স্বরের উদ্যত ভঙ্গিতে, ঈশ্বরের মতো অবয়ব নিয়ে ফুটে আছে বুকের বাগানে। ঘ্রাণ নাও- রক্তগন্ধ; মাংস নয় শুধু- মাংসগন্ধে ভরপুর, দুমুঠো নরম মন।
নাগলিঙ্গম ফুলের মতো টান টান প্রস্ফুটিত দুই পাপড়ির শ্রোণি নিয়ে তৃষ্ণা আমাকে কামনা করছে তখন।
নাগলিঙ্গম ফুলের মতো টান টান প্রস্ফুটিত দুই পাপড়ির শ্রেণি নিয়ে রতি আমাকে কামনা করছে তখন।

রতি বলল, শ্রোণি বিশ্রামখানা। প্রমোদ-উদ্যান। আরামের স্থান। পুরোটা আয়ুষ্কাল কেটে যায় মানুষের কেবল আরাম, শান্তি আর সুখের অন্বেষণে। তাই মানুষ এ বিশ্রামখানায় শান্তি নিতে আসে। আসে আরাম আর সুখের সন্ধানে। শ্রোণি নত হও এর কাছে। দেখো কী চমৎকার প্রশান্তির সামনে বসে আছ তুমি।

দুই শ্রোণিপুষ্পে আবারও জমেছে মধু। পাপড়ির পেখম মেলে টলমলে মধু বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে পুষ্পগুহার অন্ধকার চিরে। নিজে একলিঙ্গ দেখে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে আমার। আমি বললাম, আহা, ভোর হয়ে এল! দুই পাশে দুইটা বিকশিত নাগলিঙ্গম ফুল। অথচ আমার একটাই লিঙ্গ। কী করি এখন? আমার যে একসঙ্গে দুই শ্রোণি প্রয়োজন।
তৃষ্ণা বলল, জানো আমি কে?
আমি বললাম, হ্যাঁ। তুমি সামান্য পরিচিতা। তুমি তৃষ্ণা।
রতি বলল, আমি কে, জানো?
বললাম, না। তুমি সম্পূর্ণ অপরিচিতা। নাম জানি শুধু- রতি।

তৃষ্ণা তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। রতিও। তাদের চেনা ও না-চেনা দৃষ্টির মাঝখানে আমি বিব্রত, বিধ্বংস। কিন্তু মনে আমার উত্যুঙ্গ কামনা। বললাম, তবু তৃষ্ণা, তুমি কেশ দাও। জিব দাও, স্তন দাও, শ্রোণি দাও। রতিকে বললাম, তবু রতি, তুমি কেশ দাও, জিব দাও, স্তন দাও, শ্রোণি দাও। আচ্ছা, আমি এত করে কেবল শ্রোণিই চাচ্ছি কেন? শ্রোণি কী? মাংসের পাপড়ি? মাংসপুষ্পগুহা?
তৃষ্ণা বলল, শ্রোণি প্রবেশদুয়ার। শ্রোণি প্রস্থানদ্বার। মানুষের তো গতায়াতেই শান্তি। গতায়াতেই বিনাশ। মানুষ বিনাশে শান্তি খুঁজে খুব।
রতি বলল, শ্রোণি বিশ্রামখানা। প্রমোদ-উদ্যান। আরামের স্থান। পুরোটা আয়ুষ্কাল কেটে যায় মানুষের কেবল আরাম, শান্তি আর সুখের অন্বেষণে। তাই মানুষ এ বিশ্রামখানায় শান্তি নিতে আসে। আসে আরাম আর সুখের সন্ধানে। শ্রোণি নত হও এর কাছে। দেখো কী চমৎকার প্রশান্তির সামনে বসে আছ তুমি।

রাত্রির মধ্যযামে আমি প্রবেশ করেছি। প্রস্থান নিয়েছে, বিশ্রাম করেছি, প্রমোদ করেছি। বুঝলাম- একটা জীবনের সমস্ত গতিই মিশে গেছে মাংসপুষ্পগুহার অন্ধকারে, মাংস-পাপড়ির প্রতিটা ভাঁজে আর ভাঁজে। তবু সেই শ্রোণি, কেশ, জিব ও স্তন আমার আরামে থেকেও- ভোরের অপেক্ষায়। আসলে আমরাও রাত কেটে যাবে, ভোর হবে এমন একটা সকালের প্রতীক্ষায়।

 

উপসংহার

তৃষ্ণা বলল, ভোর একটা গন্ধভরা ফুলের নাম। নাগলিঙ্গম ফুলের মতো সুখদ।
রতি বলল, ভোর একটা পরিতৃপ্ত ঢেকুরের নাম। আরাম, শান্তি আর সুখের দৃশ্য আঁকা।
তবে দাও আবারও ফুল ছুঁই, গন্ধ নিই; পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলি একটা।

তারপর ভাঁজ ভেঙে নদীটা দরদর করে ছড়িয়ে পড়ল মেঘনার মৃতরেখায়। তারপর চাঁদের আলো জোনাকপোকার মতো উড়তে লেগে গেল আকাশের অববাহিকায়। তারপর ভোর এলে দুই বোন মিলে গেল একটি শরীরের বুননে। একটি শরীরের শিল্পকলায়। বললাম, কে তুমি?
সে বলল, আঁধারে দুই হলেও আলোতে আমি এক। তৃষ্ণা ও রতির একাকার পায়েস পরিবেশনকারিণী সুজাতা। তুমি কে পুরুষ?

মনে করতে চেষ্টা করলাম, কপিলাবস্তুর রাস্তায় বেরিয়ে পড়া আমি সেই প্রাচীন গৌতম।

 


অলংকরণ: রাজিব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.