‘রসপুরাণ’ : শাস্ত্রীয় সুধায় মধুরেণ সমাপয়েৎ
শিকাগো শহরের একটা পরিবারের ছবি মানুষের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ঘটনা। বাড়ির বাইরের সিঁড়িতে চারজন শিশুকে নিয়ে এক মা অপেক্ষারত। তাদের সামনের রাস্তায় একটা স্ট্যান্ডে লেখা ‘ফোর চিলড্রেন ফর সেল’। ছেলেমেয়েদের বিক্রির জন্য মা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্রেতার অপেক্ষায়। এমন করুণতর দৃশ্যের ছবি দেখলে মন ভিজে ওঠে, চোখ খরখর করে, ইচ্ছে করে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। রসপুরাণ নাটকে এর চেয়ে নিদারুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে খুবই সন্তর্পণে, হাস্যরসের অন্তরালে হওয়ায় ঘটনাটি বলতে গেলে চোখেই পড়ে না এবং এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবলতর। দৃশ্যটি এমন, জুয়ার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার জোয়ারে ডুবে যাওয়া নিঃস্ব জুয়াড়ি শেষ পর্যন্ত জুয়ার টাকা শোধ করতে নিজেকে রাস্তায় নামিয়েছে বিক্রির জন্য, এবং ঘোষণা দিচ্ছে, আসুন, আমাকে ক্রয় করিয়া বাধিত করুন, দাম মোটে দশ টাকা। তবু বিক্রি হয় না জুয়াড়ি। অভিনেতাদের শারীরিক নমনীয়তার সাথে রসঘন সংলাপ, দৃশ্যকে হাসির কড়াইয়ে ভেজে মচমচে রাখে। নিজেকে ঘোষণা দিয়ে বিক্রি করার অন্তরালে যে সকরুণ ও মর্মভেদী রক্তক্ষরণ থাকে, হাস্যরসের প্রলেপে সে ক্ষত কিন্তু উধাও হয়ে যায় না, কোনো না কোনো ভাবে রয়ে যায়, কেউ না কেউ এর দাগ বহন করে চলে। দাস প্রথার ঐতিহাসিক বিবর্তনে মানুষ আজও নিজেকে সজীব রেখে বিক্রি করে চলেছে, কায়িক শ্রমে বা মেধায় বা শরীরে। রসপুরাণ নাটকে রসের ভেতর বিরস বিষয়ের পরোক্ষ উপাদান, রসকে রাজনৈতিক রসায়নে জারিত করেছে শুধু, রসের ঘাটতি ঘটায়নি কিছু।
এই নাটকে ছায়ার খেলা আছে, ছায়াকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ছায়াগুলো চরিত্রের নিকটতম আত্মীয় হয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়েছে। সাদা ব্যাক ড্রপের উপর অভিনেতাদের বৃহৎ এবং সচল ছায়া চরিত্রের অচলায়তন ভেঙে চরিত্রকে বিচিত্র ব্যঞ্জনায় বিশিষ্ট করে তুলেছে। আলোর ভেতর দিয়ে ছায়ার সম্প্রসারণ দৃশ্যের শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
হাস্যরসের বাইরে বাকি রসগুলো যা নাট্যশাস্ত্রসম্মত, তার উপস্থিতি অনবদ্য। নাটকে বাদ্য বেজেছে, কখনো যুদ্ধের, কখনো প্রেমের। নাটকের প্রারম্ভিকা সঙ্গীত দিয়ে। সঙ্গীত মানেই তো গীত বাদ্য আর নৃত্যের সমন্বয়। ধ্রুপদী তালের সাথে ধ্রুপদী ঢংয়ের নৃত্য, এবং তা দলীয়। দলীয় হলেও এর মধ্যে ভাঙচুর আছে, ভিন্নতা আছে। নাচতে নাচতেই পাত্রপাত্রীরা নিজেদের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন ঘটাচ্ছিল দর্শকের সম্মুখে। নৃত্যের পরেই কাহিনির শুরু। পুরো নাটক জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনির দৃশ্যপট, সবগুলো দৃশ্যকে রসের সুতো দিয়ে গেঁথে একটা মালা বানিয়েছে অভিনেতাদের দল। মঞ্চে বীরদের আগমন ঘটে। বীরগণ যে দৈহিক শক্তির অধিকারী সেটা ঘটিয়ে দেখানো হয়েছে মঞ্চে। এক বীর আরেক বীরকে বধ করতে তাকে কাঁধে নিয়ে মঞ্চে ঢুকেছে। এবং এক পর্যায়ে কাঁধ থেকে অনায়াসে দূরে ছুড়ে ফেলেছে। এটা উভয়েরই দৈহিক সামর্থ্যের পরিচায়ক, চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দেহের ভাষা অভিনেতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা নাটকে অঙ্গকে ভঙ্গি পর্যন্ত টেনে নিতে পারি, দৈহিক ভাষ্য নির্মাণে দেহের ব্যবহারে আমরা এখনো সাবলীল হতে পারিনি। এই দীনতা আমাদের অভিনেতাদের প্রায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউনিভার্সিটির নাটকে তরুণদের প্রাণশক্তির একটা প্রদর্শনী হয়ে থাকে যা আমার জন্য একটা বাড়তি আকর্ষণ হিসাবে, টনিক হিসাবে কাজ করে। এটা আমি সবসময় উপভোগ করি। রসপুরাণ সেই আকর্ষণকে আরও বাড়িয়েছে। নাটকে বিভিন্ন দৃশ্যের নন্দনতাত্ত্বিক উপস্থাপনাও ছিল দৃষ্টিনন্দন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের জন্য আকাশ থেকে নেমে এল দোলনা, ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঝে আলো আর রঙের ভেতর দিয়ে সেই আকাশযানে চড়ে উঁচুতে উঠে যেতে যেতে যুধিষ্ঠিরের শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার স্মৃতি প্রায় সঙ্গীতের মতো, পুনঃপুন দোলা দিয়ে যায়। অভিমন্যু অভেদ্য চক্রব্যূহ ভেদ করে করে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যেতে যেতে একসময় বধ হলো। নিজের অবিশ্বাস্য প্রস্থানের কালে অভিমন্যু শুধু পিতাকেই স্মরণ করতে পারলেন। দুঃশাসনের হাতে মৃত পুত্রকে জড়িয়ে ধরে ঘন নৈঃশব্দের ভেতর অর্জুনের ‘পুত্র’ বলে সঘন চিৎকার, করুণ হয়ে কানে বাজে। পিতার জন্য করুণা হয়। যুদ্ধ সবকালেই এমনই এক নৈরাজ্য যা পিতাকে সন্তানহারা করে দেয়। রসপুরাণে সেই পুরাতনকেই নতুন করে দেখিয়েছে আর যুদ্ধের বীভৎস ক্ষতকে মনে করিয়ে দিয়েছে। রাক্ষসগণ রামের পত্নী সীতাকে অপহরণে যে ভয়ানক দৃশ্যের অবতারণা করে তা ভয়ংকর, রাক্ষসদের মুখ ও মুখোশের ব্যবহার দৃশ্যকে আরও দৃষ্টিগোচর করে তোলে।
এই নাটকে ছায়ার খেলা আছে, ছায়াকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ছায়াগুলো চরিত্রের নিকটতম আত্মীয় হয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়েছে। সাদা ব্যাক ড্রপের উপর অভিনেতাদের বৃহৎ এবং সচল ছায়া চরিত্রের অচলায়তন ভেঙে চরিত্রকে বিচিত্র ব্যঞ্জনায় বিশিষ্ট করে তুলেছে। আলোর ভেতর দিয়ে ছায়ার সম্প্রসারণ দৃশ্যের শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
নাটকের সবশেষে ছিল রাসনৃত্য। শ্রীকৃষ্ণভক্ত মণিপুরীরা কুমিন ও পেশোয়ান পরিধান করে তাদের ঐতিহ্যগত নৃত্যের ধারায় রাধাকৃষ্ণের লীলা পরিবেশন করে, যাকে বলে রাসলীলা। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মনোরম দৃশ্যে নরম রঙিন আলোর জ্যেৎস্নায় চারদিক থেকে ঝুলে পড়া ফুলের লহরি পুরো মিলনায়তনকে বৃন্দাবন করে তুলল, প্রেমে মোহিত দর্শকরা হয়ে উঠল রাসলীলার অংশ। রস থেকে ‘রাস’ শব্দের উৎপত্তি। ‘রাস’ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তম মধুর রস। এই মধুর রস দিয়েই রসপুরাণের সমাপ্তি ঘটে, বা বলে চলে মধুরেণ সমাপয়েৎ।
নাটক দেখতে এসে শাস্ত্রসম্মত রসের সন্ধান পাওয়া এবং সেই রসে নিমজ্জিত হওয়া, এটি আনন্দে আটখানা হওয়ার মতো একটি ব্যাপার। শৃঙ্গার হাস্য করুণ রৌদ্র বীর ভয়ানক বীভৎস অদ্ভুত, এই সমস্ত নামের সাথে পরিচিত হতে পারাটা কম কথা নয়। নাটকের মধ্য দিয়ে যারা দর্শককে রসসিক্ত ও রসশিক্ষিত করল, তাদের রসবোধ অপরিমেয়। তারা আমাদের নিরস নিরাসক্ত জীবনে রসের আধার, তাদের জীবন রসে টইটম্বুর হোক এই প্রত্যাশা রইল।
০৫.০৫.২০১৯