রায়চৌধুরীর জমিদারি
আমার দাদাজানের বেহাত হয়ে যাওয়া সম্পত্তি অবশেষে জলের দামে পুনরায় আমি কিনে নিতে পারলাম। আমার পূর্বপুরুষের আদি ভিটেভূমি কিনতে পেরে আমি মনের গভীরে দারুণ আত্মতৃপ্তি অনুভব করতে লাগলাম, মনে হলো; কিছুটা যেন রক্তের ঋণ শোধ করতে পেরেছি। আমার স্ত্রী বলল, এসব তোমার সিনেমাটিক ভাবনা; পূর্বপুরুষের সঙ্গে আবার রক্তের ঋণ শোধ বোধের কী আছে!
হয়তো তাই। আমি আমার বাপকে দেখেছি. দাদাজানের বেহাত হয়ে যাওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করতে না পারার ক্ষোভে তড়পাতে। বাপ তাঁর বাপকে কথা দিয়েছিল, সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করবে কিন্তু ঘরজামাই থেকে হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষকের পক্ষে কতটা আর রোজগার করা সম্ভব পাঁচ সন্তানের সংসার সামাল দিয়ে অজপাড়াগাঁয়ে মূল্যহীন জমি শুধু বাপকে দেওয়া কথা রাখার জন্য কিনতে পারে! বাপকে দেওয়া কথা রাখতে না পারার তীব্র মানসিক যন্ত্রণা তিনি ভোগ করেছিলেন পিজি হাসপাতালের বেডে শুয়ে যা তাঁর কাছে মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও অসহনীয় ছিল। বাপের সে অসহনীয় যন্ত্রণা আমার ভেতরে করাতের মতো কেটে বসেছিল, কেটে বসা ক্ষত আমাকেও কুটকুট করে কামড়াতে শুরু করে, বারবার মনে হয় মৃত্যুর সময় আমিও কি তড়পাতে থাকব?
আমি আমার বাপের মতো কোনো স্কুলশিক্ষক নই, ঢাকা শহরে রিয়েলে এস্টেট বিজনেস করে কিছু টাকা (মোটা অঙ্কের বলা চলে) ব্যাংকে জমাতে পেরেছি, তাই স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিজের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি কেনার ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখলাম, যতটা টাকা খরচ হবে ভেবেছিলাম, তেমনটা লাগছে না। খুব কম দামে নিজেদের ভিটেমাটি পুনরুদ্ধার করা যাবে। রায় চৌধুরীদের বংশধররা আমেরিকা-কানাডায় নিজেদের নতুন আবাস গড়েছে। দেশে সম্পত্তি বলতে রায়চৌধুরীর আদি জমিদারবাড়ি আর তার পাশে আমার পূর্বপুরুষের ভিটা ছাড়া অন্য যাবতীয় চাষের জমি, দিঘি-পুকুর সবই বিক্রি করে দিয়েছে। এটুকুও বিক্রি করতে চায়, তবে কেনার মতো কোনো খদ্দের পাওয়া যাচ্ছে না। আমি যোগাযোগ করে নিজেদের ভিটেভূমি কিনতে চাইলে ওরা বলল, কম দামে ছেড়ে দেব, জমিদারবাড়িটিসহ কিনে নিন।
বিশাল এক জমিদারবাড়ি কেনার কথা শুনে আমার ব্যবসায়ী মনে লোভ জেগে ওঠে, রিয়েল এস্টেট বিজনেস করে এমন মানসিকতা তৈরি হয়েছে, কম দামে জমির কথা শুনলে তা নিজের করে নিতে মন চায়। আমার জেগে ওঠা লোভে আমার স্ত্রী বাগড়া দেয়, বেশি লোভ কোরো না। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি উদ্ধার করতে চাও, করো কিন্তু ওই অজপাড়াগাঁয়ে তো আমরা কেউ যেয়ে থাকব না। আর অমন ভাঙাচোরা জমিদারবাড়ি দিয়ে আমরা কী করব! হ্যারিটেজ করা যেত, কিন্তু অত দূর গিয়ে ওই ভাঙাচোরা বাড়ি দেখার পাবলিক কই পাবে?
স্ত্রীর কথা সত্য, তাই শুধু আমার পূর্বপুরুষের ভিটাটুকুই কিনে নিলাম।
বিষয়টি খুলে বলি না কেন, তাহলে সবার বুঝতে সহজ হবে। আমার দাদাজান ছিলেন তাঁর বাপের একমাত্র সন্তান। সারা জীবন পরিবার-পরিজন নিয়ে পূর্বপুরুষের আদি ভিটাতে বসবাস করেছেন প্রত্যন্ত এক গ্রামে। প্রত্যন্ত বলতে যে সে প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, দিনদুপুরে শিয়াল উঠানে এসে মোরগ ধরে নিয়ে যায়, এমন গ্রাম। কিছু ফসলি জমি আর বাজারে মুদিদোকান ছিল দাদাজানের আয়ের উৎস, ফলের ছোট একটি বাগান আর ছোট পুকুরসহ নিজেদের বসতভিটা, নিজের অবস্থান নিয়ে দাদাজান তৃপ্ত গৃহস্থ মানুষ। দাদাজানের বসতভিটার লাগোয়া রায়চৌধুরীর বিশাল বাগানঘেরা দোতলা জমিদারবাড়ি। রায়চৌধুরী ইংরেজ আমলে জমিদার উপাধি পাওয়া শেষের দিকের জমিদার, নিজের উপাধিকে যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। ব্রিটিশ আমলের জমিদারির সে চাকচিক্য না থাকলেও উপাধির প্রতি রায়চৌধুরীর ছিল সর্বগ্রাসী বুভুক্ষ ভালোবাসা, নির্জীব হয়ে আসা জমিদারির আয়তন বাড়ানোর প্রতি তীব্র আগ্রাসী ক্ষুধা।
সময়টা রায়টের পরপর, পুরো উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক-অর্থনৈতিক সব রকম অবস্থা নাজুক আর অস্থির, রায়চৌধুরীর সন্তানরা সবাই গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে, তারা চাইছিল; রায়চৌধুরীও যেন সম্পত্তির একটা বন্দোবস্ত করে ওদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে থাকে কিন্তু তিনি কিছুতে তার জমিদারি ছেড়ে যাবেন না উপরিউক্ত যারা দেশান্তরি হচ্ছিল, সস্তায় তাদের সম্পত্তি কিনে নিজের তালুক বৃদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। রায়চৌধুরীর স্বপ্ন দেখতেন, আবার জমিদারির জৌলুশ ফিরে আসবে, তাঁর জমিদারির সীমানা গ্রাম ছাড়িয়ে, মহকুমা ছাড়িয়ে জেলা ছাড়িয়ে যাবে।
সময়টা রায়টের পরপর, পুরো উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক-অর্থনৈতিক সব রকম অবস্থা নাজুক আর অস্থির, রায়চৌধুরীর সন্তানরা সবাই গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে, তারা চাইছিল; রায়চৌধুরীও যেন সম্পত্তির একটা বন্দোবস্ত করে ওদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে থাকে কিন্তু তিনি কিছুতে তার জমিদারি ছেড়ে যাবেন না উপরিউক্ত যারা দেশান্তরি হচ্ছিল, সস্তায় তাদের সম্পত্তি কিনে নিজের তালুক বৃদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। রায়চৌধুরীর স্বপ্ন দেখতেন, আবার জমিদারির জৌলুশ ফিরে আসবে, তাঁর জমিদারির সীমানা গ্রাম ছাড়িয়ে, মহকুমা ছাড়িয়ে জেলা ছাড়িয়ে যাবে। অদ্ভুত এক নেশা জমির নেশা, রিয়েল এস্টেট বিজনস করি বলে আমি তার নেশার টানটা বর্তমানে কিছুটা হলেও ধরতে পারি।
রায়টের দাঙায় দাদাজানের বাজারে মনোহারীর দোকানটি লুট হয়ে যায়, লুট শেষে লুটেরারা গোটা বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। আবার ব্যবসা শুরু করার জন্য তেমন পুঁজি না থাকায় দাদাজান ঋণের আশায় রায়চৌধুরীর কাছে গেলে তিনি বলেন, তোমার বসতবাটি বন্ধক রাখো, টাকা নিয়ে যাও।
বসতবাটি কেন, জমি বন্ধক রাখেন তার চাইতে, সরলভাবে দাদাজান বলে।
রায়চৌধুরীর মাথায় তখন নিজের জমিদারবাড়ির চৌহদ্দি বাড়ানোর ধুরন্ধর চিন্তা। তিনি বলেন, বসতবাটির জন্য যে পরিমাণ টাকা পাবে, জমির জন্য তত পাবে না। তা ছাড়া এত ভয়ের কী আছে! তুমি যুবক বেটা, পরিশ্রম করে, ব্যবসা করে উপার্জন করে তোমার ভিটা ছাড়িয়ে নেবে। বন্ধকি শুধু নিরাপত্তাব্যবস্থা, আর কিছু না।
তরুণ দাদাজান বৃদ্ধ জমিদার রায়চৌধুরীর ধুরন্ধর দুরভিসন্ধি বুঝতে পারেননি, খুব সামান্য টাকার বিনিময়ে বসতবাড়ি বন্ধক রাখেন তিনি। সেই টাকায় দোকানের মালসামান কেনার জন্য তিনি শহরে যান। দাদাজান গ্রামে না থাকার কোনো এক রাতে রায়চৌধুরীর জমিদারবাড়িতে ডাকাত পড়ে আর ডাকাতের হাতে রায়চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী দুজনে প্রাণ হারান। রায়চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রীর শেষকৃত্যে কলকাতা থেকে দুই ছেলে তড়িঘড়ি এসে দুই দিনের মধ্যে বিষয়-সম্পত্তির যতটুকু গোছগাছ করা সম্ভব করে চলে যান। আর দাদাজান যখন সাম্পান বোঝাই করে ব্যবসার মালসামান নিয়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসেন, তখন জমিদারবাড়িতে কোনো মানুষ নেই। যার কাছ থেকে তিনি তার ভিটার দলিল উদ্ধার করতে পারেন। এরপর যত দিন দাদাজান বেঁচে ছিলেন, চেষ্টা করেও জমিদারবাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। মৃত্যুর আগে দাদাজান তার একমাত্র সন্তানের হাত ধরে বলেছিলেন, জমিদারের বংশধরদের খুঁজে ন্যায্য দাম দিয়ে নিজেদের ভিটেমাটির দলিলটা ফেরত নিয়ো বাপ।
আমার বাপ তাঁর বাপের হাত ধরে কথা দিলেও সে কথা রাখতে পারেননি বলে মৃত্যুশয্যায় তিনিও তাঁর একমাত্র পুত্র, আমার কাছে সে দাবি রেখে যান। আর আমিও কেমন করে যেন জমিদারের বংশধরদের খোঁজ পেয়ে গেলাম, তারা কানাডার নাগরিক এখন; আর কোনো দিনও দেশে ফেরার আগ্রহ নেই, দেশে সহায়-সম্পত্তি যা আছে, বিক্রি করে হাত ধুয়ে নিতে পারলে বাঁচে। তাই খুব সহজে আমি নিজের পূর্বপুরুষের ভিটা উদ্ধার করতে পারলাম। এই হলো ঘটনা…
পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি উদ্ধারের পর আমার স্ত্রীকে বললাম, চলো একবার আমার আদি ভিটা দেখে আসি।
স্ত্রী বলল, তথাস্তু। কিন্তু থাকব কোথায়? ওখানে তো থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমিও চিন্তায় পড়লাম, হ্যাঁ; ওখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রামের সঙ্গে আমার বাপের যৌবনকাল থেকে কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমার বাপ ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন, তাই গ্রামে কারও বাড়িতে গিয়ে ওঠার মতো স্বজন আমাদের নাই। ওই অজপাড়াগাঁয়ে কড়া মিঠা গরুর দুধের চা আর শিঙাড়া-ডালপুরি আর গুড়ের জিলাপির বাবুল মিয়ার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট আছে কিন্তু তা থাকার হোটেল নয়, সেখানে গিয়ে থাকাটা সত্যি মুশকিলের। এবারও স্ত্রী পরামর্শদাতার ভূমিকায় উতরে যায়, তুমি না বলেছিলে তোমার দাদাজানের ইটের দালানটি এখনো আছে?
ধুর! ওটাতে থাকা যাবে নাকি? ভাঙাচোরা, সাপে-নেউলে চোর-পুলিশ খেলে সারাবেলা।
কন্ট্রাক্টর সাহেব মাথা খোলো… তোমার দুজন কর্মচারী পাঠিয়ে দাও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে, ওরা ওই পুরোনো বাড়িটাকে মেরামত করে নেবে। তাহলে আমরা মাঝেমধ্যে তোমার আদি ভিটাতে গিয়ে থাকতে পারব।
আমার স্ত্রীকে মাঝেমধ্যে আমার গুগলের হেড বস বলে ধারণা হয়! সবকিছুর তাৎক্ষণিক সমাধান ওর ভান্ডারে কেমন করে যেন মজুত থাকে!
রায়টের দাঙায় দাদাজানের বাজারে মনোহারীর দোকানটি লুট হয়ে যায়, লুট শেষে লুটেরারা গোটা বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। আবার ব্যবসা শুরু করার জন্য তেমন পুঁজি না থাকায় দাদাজান ঋণের আশায় রায়চৌধুরীর কাছে গেলে তিনি বলেন, তোমার বসতবাটি বন্ধক রাখো, টাকা নিয়ে যাও।
স্ত্রীর কথামতো সাইট থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর মালসামান নিয়ে একটি পিকআপ ভ্যান চলে যায় আমার পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা মেরামত করতে। কাজ শেষে কর্মীদল পনেরো দিনের মাথায় ফিরে আসে, দলপতি ছেলেটি ওর হলদে দাঁত কেলিয়ে বলে, স্যার, আপনের ঢাকার বাসায় যেমুন আরামে টয়লেট করেন, গ্রামের বাড়িত গিয়াও সেইম বেন্ডের কমোড…। সে আর কথা না বল হে হে করে হাসতে থাকে। আমি বুঝতে পারি, ভালো কাজ করেছে ওরা, দক্ষ কর্মী হিসেবে ওদের সুনাম আছে।
ফাগুনের এক সকালে আমি আর আমার স্ত্রী নিজেদের গাড়ি করে পূর্বপুরুষের ভিটার উদ্দেশে রওনা হলাম, আমার টিনএজার কন্যা দুজন পড়ার দোহাই দিয়ে কিছুতে আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলো না। আমার স্ত্রীও বলল, এবার ওরা না চলুক। আমরা গাঁয়ের হাবভাব, গ্রামবাসীর মনোযোগ আগে বুঝে আসি।
কন্যা দুজনকে আমার শাশুড়ির জিম্মায় রেখে আসতে হলো। যাত্রা মন্দ লাগছে না, ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে, পেছনের সিটে আমরা দুজন ফুরফুরে মেজাজে বসে আছি, মনের ভেতর ‘বাড়ি যাই বাড়ি যাই’ অনুভূতি। মনে মনে বললাম, নাড়ির টান বলে কথা, জোরে বললাম না; পাছে স্ত্রী আমার বাড়তি আবেগ নিয়ে হাসে।
গাড়ি গ্রামের বাজারে ড্রাইভারের জিম্মায় রেখে ভ্যানগাড়ি করে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হতে হলো, একবিংশ শতাব্দীতে উন্নয়নের জোয়ারে সারা দেশ ভাসলেও আমাদের গ্রাম পর্যন্ত কোনো পাকা সড়ক এখনো নির্মিত হয়নি। বর্ষাকালে নৌকা করে লোকজন চলাফেরা করে কিন্তু শীত বা শুষ্ক মৌসুমে দু-একটি রিকশা বা ভ্যানগাড়ি এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা দিয়ে লোকজন আনা-নেওয়া করলেও অধিকাংশ গ্রামবাসী পায়ে হেঁটে চলাচল করতে পছন্দ করে।
আমরা পড়ন্ত দুপুরে নিজেদের ভিটায় পৌঁছালে দেখলাম দু-একজন গ্রামের মানুষ আমাদের আগমন উপলক্ষে আগে থেকে জড়ো হয়েছে। নিজেদের যতটা নিঃসঙ্গ ভেবে এসেছিলাম, দেখলাম ততটা নিঃসঙ্গ আমরা নই। আমার কর্মী বাহিনী সংসারের খুঁটিনাটি কাজ করার জন্য এক হিন্দু বিধবা নারীকে ঠিক করে গিয়েছিল, মাসি যথেষ্ট করিতকর্মা; আমার স্ত্রীর সঙ্গে ভাব হতে সময় নিল না। গ্রামের একজন মুরব্বির বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার এল, ডালভাতের নামে বেশ জবরদস্ত খানা; আমরা রীতিমতো আপ্লুত।
বিকাল নাগাদ দুপুরের খাওয়া শেষ করলে লোকজন একে একে বিদায় নিলে। বিকালে এলেন গ্রামের হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক, যুবক বয়স; দেশের অন্য প্রান্তের জেলা সদরে বাড়ি, প্রথম চাকরিতে এখানে পোস্টিং পেয়ে এসেছে এক বছর আগে। কথাবার্তায় এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি আর শিল্প-সংস্কৃতির ধোঁয়া উঠছে, বোঝাই যায় এখানে মন টিকে না, জোর করে পড়ে রয়েছে। পরিচয়পর্ব সেরে বললাম, চলেন খানিক বাহিরটা ঘোরাঘুরি করে দেখি।
অন্ধকার তো হয়ে এল, এখন আর বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
আশপাশটাই দেখব। কাল দূরে যাওয়া যাবে।
কত দিন থাকবেন?
দেখি কয় দিন থাকা যায়।
ঘর থেকে বেরোলে আমার চোখে এক সাগর মায়া এসে ভর করে, নতুন চুনকাম করা পূর্বপুরুষের বসতবাড়ি, ঝকঝকে পরিষ্কার নিকানো শূন্য উঠান, উঠান পেরিয়ে কিছুদূরে ভাঙা ঘাটলাসহ শেওলায় ঢাকা সবুজ পানির পুকুর, দেখে মনে হয় না ব্যবহৃত হয়; বাড়ির চারধারঘেরা সীমান্তপ্রাচীরের মতো গাছগাছালি। বাড়ির পেছনটাতে বাগানমতো জঙ্গলের পরই রায়চৌধুরীর জমিদারবাড়ির সীমানা শুরু।
আমাদের বাড়ির সীমান্ত ঘেঁষে ঘন জঙলে ঘেরা রায়চৌধুরীর বাড়ির সীমান্তের শুরু, হাঁটতে হাঁটতে আমরা যে জায়গায় এসে দাঁড়াই, অনুমান করি, একসময় এখানে জমিদারবাড়ির সিংহদ্বার ছিল, সময়ের বিবর্তনে হা হা শূন্যতা ছাড়া সিংহদ্বারের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, লতাপাতার ঝোপঝাড়ে ছাওয়া টানা পথ চলে গেছে জঙ্গলের গভীরে, গাছের ফাঁকফোকর গলে চোখ গিয়ে পড়ে পাষাণের মতো নিকষ কালো ছায়া ছায়া জমিদারবাড়ির ওপর। দূর থেকে তার বিশালত্ব অনুমান করা যায়, বাড়িটিকে জ্যান্ত বলে ভ্রম হয়, সন্ধ্যার বয়ে যাওয়া দমকা বাতাসকে জমিদারবাড়ির দীর্ঘশ্বাসের মনে হয়; হয়তো এগিয়ে গেলে দেখা যাবে রায়চৌধুরী বারান্দায় আরামকেদারায় শুয়ে গড়গড়ি টানছেন!
চারদিকে যত ফসলি জমি দেখছেন, সবই রায়চৌধুরীর। আমার সঙ্গী যুবক শিক্ষক বলে।
শুনেছি তার বংশধররা সব জমি বিক্রি করে দিয়েছেন।
নাহ্। জমি একবার হাতছাড়া হলে কি ফেরত পাওয়া যায়! যে যার মতো করে দখল নিয়ে নিয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এখনো অনেক জমি রায়চৌধুরীর নামে। আপনি শুধু টাকা দিয়ে রায়চৌধুরীর কাছ থেকে জমি ফিরিয়ে নিলেন।
জমিজমার বিষয়ে আমি স্বচ্ছ থাকতে পছন্দ করি। ঝোপঝাড়ে ঢাকা টানা পথের ওপর পায়ে হাঁটা নতুন আর একটি সূক্ষ্ম পথ তৈরি হয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে আমি জানতে চাই, ভেতরে যাওয়া যায় না?
যায়। তবে এখন অন্ধকার হয়ে গেছে, কিছু দেখা যাবে না। পুরোনো ভিটা, সাপখোপ আছে।
কেউ থাকে না?
কে থাকবে? শুনেছি রায়চৌধুরীর ছেলেরা যুদ্ধের পরপর দু-একবার এসেছিল। তারপর গ্রাম্য পলিটিকসের ভয়ে কেউ আর আসেনি।
জমিজমা দখল হয়ে গেল। এত বিশাল জমিদারবাড়ির কেউ দখল নিল না!
জানেন তো এ রকম জমিদারবাড়ি নিয়ে নানা রকম কল্পগল্প মিশিয়ে কেমন মিথ প্রচলিত থাকে। অনেকে বলে, এখনো নাকি রায়চৌধুরী বারান্দায় বসে কর্পূর মেশানো জলের হুঁকো টানে! সে রকম কিছু গল্পের কারণে এই বাড়িটি এখনো দখলমুক্ত আছে। যুবক শিক্ষক হাসে।
সেসব গল্প আপনি বিশ্বাস করেন? আমি জানতে চাই।
যুবক শিক্ষক হাসতে হাসতে বলে, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না, তবে ভয় পাই। অশরীরি কিছু একটা আছে এ রকম গা-ছমছম ধারণা করে ভয় পেতে ভালো লাগে।
আমরা অনেক রাত করে ঘুমাতে যাই। নতুন জায়গায় সাধারণত ঘুম ভালো হয় না কিন্তু সকালে তরতাজা অনুভূতি নিয়ে আমার যখন ঘুম ভাঙে, তখন আমার স্ত্রী বিছানা ছেড়েছে, ঘরের দরজা খোলা; বাইরের তেরচা সূর্যের আলো মেঝেতে বিছানো পাটির মতো প্রশান্তি নিয়ে পড়ে রয়েছে। আমি বিছানায় আড়মোড়া ভাঙার আমেজ শেষ করার আগে আমার স্ত্রী খোলা দরজা দিয়ে ঘর ঢুকে সে পাটিতে দাঁড়ায়, ওর চোখেমুখে আতঙ্ক চিনেজোঁকের মতো সেঁটে আছে, সে অস্ফুট ভীত কণ্ঠে কিছু বলে; আমি বুঝতে পারি না।
যুবক শিক্ষক বিদায় নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলে আমি একা নিজেদের উঠানে এসে দাঁড়াই। প্রাচীন ভিটার দিকে তাকাই, দীর্ঘদিনের বিরান ভিটায় আবার প্রাণের সঞ্চার, পূর্বপুরুষের আত্মারা কি হাসছে? মাথার কোষে কোষে কিছু স্বপ্ন জোনাকির মতো মৃদু আলোর পাখা ঝাপটায়, নিজেকে শহরফেরত এক যুবক মনে হয়; অনেক বছর আগে বাণিজ্যের সওদা করার জন্য শহরে গিয়েছিল। আজ যুবক ফিরে এসেছে, নদীর ঘাটে পণ্যবোঝাই তার সাম্পান, যুবক এসে দাঁড়িয়েছে নিজ ভিটার উঠানে, ভিটা কারও কাছে বন্ধক দেওয়া নয়! পরিতৃপ্ত যুবক দুচোখ মেলে নিজের আদি ভিটা দেখে।
পল্লী বিদ্যুতে বাড়ি আলোকিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার মতো অন্ধকার আরও ঝেঁকে আছে। আমার স্ত্রী ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে উঠানে আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়, ও মা, তুমি কখন এলে? আর আমি তোমার ফেরার অপেক্ষায় মাসিকে আটকে রেখেছি।
কেন?
সন্ধ্যা হয়ে গেল বলে মাসি থাকতে চাচ্ছে না। ওর বাড়িতে ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে। এদিকে একা থাকতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, নতুন জায়গা।
ভূতের ভয় পাচ্ছ নাকি?
তুমি দেখেছ কখরো আমাকে ভূতের ভয় পেতে? অবশ্য মাসি বলছিল, আমাদের প্রতিবেশী রায়চৌধুরীর বাড়িটা নাকি ভুতুড়ে। এ রকম একেকটা মিথ মনে হয় সব জমিদারবাড়ি নিয়ে থাকে, কী বলো?
তুমি রাজি থাকলে ভুতুড়ে জমিদারবাড়িটা কিনে নিতে পারতাম।
নিজের ভিটেমাটি উদ্ধার করেছ, এটাই যথেষ্ট কন্ট্রাক্টর সাহেব, বেশি লোভ ভালো নয়।
আমার স্ত্রী অনর্গল কথা বলছে, তার মানে এখানে এসে ওর ভালো লাগছে। আমি হেসে বলি, এবার মাসিকে ছেড়ে দাও তবে।
সন্ধ্যারাতে আমি আর আমার স্ত্রী উঠানে এসে বসি। আমাদের উঠান পেরিয়ে ভাঙা ঘাটলার পুকুর, এখন সেখানটাতে অন্ধকার গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘন হয়ে আছে; এরপর আমাদের নিকট অন্য আরেক প্রতিবেশীর উঠানের বাতির আলো এক বিন্দুতে স্থির। আমরা গল্প করতে থাকি, হারিয়ে যাওয়া অথচ স্মৃতির গভীরে ঘাপটি মেরে থাকা বিষয়গুলো আমাদের গল্পে ফিরে আসে, অনবরত নানান বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলি। গল্পের পরের মুহূর্তে এসে আমরা আগের মুহূর্তের করা গল্প ভুলে যাই। আমার কেবলই মনে হয়, আমার খোলস ছাড়ছি, ভেতরের আমরা বদলে যাচ্ছি; অনেক যুগ আগে সওদা করতে যাওয়া শহরফেরত সওদাগর আর তার অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী, যুবকের পকেটে আছে রঙিন পুঁতির মালা, স্ত্রীকে চমকে দেবে বলে!
আমরা অনেক রাত করে ঘুমাতে যাই। নতুন জায়গায় সাধারণত ঘুম ভালো হয় না কিন্তু সকালে তরতাজা অনুভূতি নিয়ে আমার যখন ঘুম ভাঙে, তখন আমার স্ত্রী বিছানা ছেড়েছে, ঘরের দরজা খোলা; বাইরের তেরচা সূর্যের আলো মেঝেতে বিছানো পাটির মতো প্রশান্তি নিয়ে পড়ে রয়েছে। আমি বিছানায় আড়মোড়া ভাঙার আমেজ শেষ করার আগে আমার স্ত্রী খোলা দরজা দিয়ে ঘর ঢুকে সে পাটিতে দাঁড়ায়, ওর চোখেমুখে আতঙ্ক চিনেজোঁকের মতো সেঁটে আছে, সে অস্ফুট ভীত কণ্ঠে কিছু বলে; আমি বুঝতে পারি না।
আমি আমার স্ত্রীর পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে বিষয়টি বুঝতে গিয়ে হকচকিয়ে যাই কিন্তু চোখের সামনের পরিবর্তিত দৃশ্যপট দেখে আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসে, সেই সঙ্গে বুঝে উঠতে পারছিলাম না আসলে কী ঘটেছে আমাদের সঙ্গে! কোথায় আমাদের উঠান? কোথায় উঠানের পর ভাঙা ঘাটলার সবুজ জলের পুকুর? কোথায় বিন্দু আলোর প্রতিবেশীর বাড়ি? কোথায় বাড়ির সীমানার বৃদ্ধ গাছের সারি? আমাদের ঘরের দরজার সামনে ঘন জঙ্গল, জঙ্গলের মাঝে ঝোপঝাড়ে ছাওয়া টানা পথ! আমাদের নতুন চুনকাম করা ছোট দালানের পেছনে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে দানবাকৃতির ছাল-চামড়া ওঠা জমিদারবাড়ি! প্রাচীন গাছের ডালপালায় প্রায় অন্ধকার বারান্দা থেকে কর্পূরের গন্ধ মেশানো ধোঁয়ার রেখা বাতাসে মিশে যাচ্ছে, অকস্মাৎ বয়ে যাওয়া বাতাসের তোড়ে স্পষ্ট শুনতে পাই জমিদারবাড়ির তৃপ্তির ঢেকুর!