শাহরিয়ার রচিত উমরাও জান ছবির গজলসমূহ
কবি ও গীতিকার হিসাবে তার কলমি নাম ছিল শাহরিয়ার। আসল নাম আখলাক মোহাম্মদ খান। ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরিলিতে ১৯৩৬ সালে জন্ম তার। পিতা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ছেলেবেলা থেকে শাহরিয়ার ক্রীড়াবিদ হতে চেয়েছিলেন, বাবা চেয়েছেন তার ছেলে পুলিশে যোগ দিক। তাই ১৯৫৫ সালে তিনি বাড়ি থেকে পালালেন। প্রখ্যাত উর্দু কবি ও সমালোচক খালিল-উর রহমান আজমির তত্ত্বাবধানে থাকতেন। তিনি শাহরিয়ারকে সাহিত্যে অনুপ্রাণিত করেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেনির ছাত্র থাকাকালে শাহরিয়ার কবিতা লিখতে শুরু করেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য শাহরিয়ার আলিগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কল্পসাহিত্য বিষয়ে শিক্ষাদান শুরু করেন। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগে প্রফেসরের পদে যোগ দেন ও পরে বিভাগীয় প্রধান হিসাবে ১৯৯৬ সালে রিটায়ার করেন। সাহিত্যপত্রিকা শের-ও-হিকমত-এর তিনি সহসম্পাদক ছিলেন।
শাহরিয়ারের প্রথম কবিতার সংকলন ‘ইসমে আজম’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। এরপর ‘সত্ভান দার’ (১৯৬৯), ‘হিজর কা মউসম’ (১৯৭৮)। তার সবচেয়ে প্রশংসিত কাব্য, ‘খোয়াব কা দর বন্দ হ্যাঁয়’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে, যা তাকে উর্দু সাহিত্যের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এনে দেয়। ২০০৮ সালে তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। এই পুরস্কারপ্রাপ্ত উর্দু সাহিত্যিক হিসাবে তিনি চতুর্থজন। শাহরিয়ারের কালে সাহিত্যিকদের মধ্যে দুইটি দল ছিল : প্রগতিবাদী ও আধুনিকতাবাদী। তিনি এই দুটোর কোনোটারই অন্তর্ভুক্ত হন নাই। নিজের মতো করে কবিতা লিখে যেতেন।
কিছু নির্বাচিত সিনেমার জন্য শাহরিয়ার গান রচনা করেন। মোজাফফর আলি আর শাহরিয়ার ছাত্রজীবন হতে বন্ধু ছিলেন। আলি ছিলেন চিত্রকর। একবার শাহরিয়ার তাকে নিজের লেখা কিছু গজল দেখালেন। পরে মোজাফফর আলি যখন চিত্রপরিচালক হিসাবে কাজ শুরু করলেন তিনি তার ছবি ‘গমন’ (১৯৭৮)-এ শাহরিয়ারের দুটো গজল ব্যবহার করলেন। গানগুলো খুব জনপ্রিয় হলো। এরপর মোজাফফর আলি যখন ‘উমরাও জান’ (১৯৮১) ছবিটা করলেন সেটার জন্যেও পাঁচটি গজল দিলেন শাহরিয়ার। ছবিটা নাম করল, গানগুলো সুপার হিট হলো। এই ছবিতে শাহরিয়ারের লেখা গান গেয়ে আশা ভোঁসলে জাতীয় পুরস্কার পেলেন। এই গানগুলো বলিউডের সিনেমার এ যাবৎকালের সেরা গীতাবলির অন্যতম।
ইয়াশ চোপরার ছবি ‘ফয়সাল’ [Faasle] (১৯৮৫) এর জন্যও তিনি গান লেখেন। এরপর চোপরা তাকে আরও তিনটি ছবির জন্য গান লেখার প্রস্তাব দেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নাই, কারণ তিনি ‘গানের দোকান’ হয়ে উঠতে চান নাই ফরমায়েশি গান লিখে। এরপর যদিও তিনি মোজাফফর আলির ‘আনজুমান’ (১৯৮৬) ছবির জন্য গান লেখেন, তবে আলির অন্য ছবির জন্য আর কাজ করেন নাই।
শাহরিয়ার উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে ২০১২ সালে দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগে মারা যান।
উমরাও জান (১৯৮১) ছবিটা মির্জা হাদি রুসওয়া রচিত ‘উমরাও জান আদা’ নামক উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়। উপন্যাসটি উনিশ শতকের প্রথমার্ধের পটভূমিকায় রচিত। আমিরন একটি মেয়ে কিডন্যাপের শিকার হয়ে লখ্নৌয়ের পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে যায়। সেখানে যার তত্ত্বাবধানে সে থাকে সেই সর্দারনি তাকে একজন নাচ-গান-কবিতায় পারদর্শিনী ‘তওয়ায়েফ’ অর্থাৎ সংস্কৃতিবান নটী হিসেবে গড়ে তোলেন। তার নামকরণ হয় উমরাও জান। এই ছবিতে রেখা সেই চরিত্রে অভিনয় করেন। তার ঠোঁট মিলানো গানগুলো করেন আশা ভোঁসলে। (২০০৬ সালে একই নামে আরেকটি ছবি পুনর্নির্মিত হয়)।
ভূমিকা ও ভাষান্তর: সৈয়দ তারিক
ইয়ে ক্যায়া জাগে হ্যায় দোস্তো
এ কেমন জায়গা, বন্ধু
এ কেমন জগৎ!
দুচোখ যতটা দেখে
ধূলিঝড়, শুধু ধূলিঝড়।
এ কোনখানে আমাকে
জীবন নিয়ে এসেছে!
না আমার নিয়ন্ত্রণ আছে খুশিতে,
না আমার পছন্দ আছে দুঃখে।
আমার বছরগুলোর হিসাব
জীবন জানতে চাইছে,
হৃদয় আমার কী জবাব দেবে?
নিজের কাছেই সে শরম পায়।
কে আমাকে ডাকছে
জাফরির ওপার হতে?
আমার জন্য কেউ কি রয়েছে
অস্থির ও বেদনাবিধুর?
শুনুন- ইয়ে ক্যায়া জাগে হ্যায় দোস্তো
ইন আঁখো কি মাস্তি কে
এই চোখ-দুটোর মাদকতায় আচ্ছন্ন আছে হাজার হাজার
এই চোখ-দুটোর উপাখ্যান আছে হাজার হাজার
কেবল তুমিই যে আমার প্রেমে পড়ে দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছ এমন নয়
এ শহরে তোমার মতো দিওয়ানা আছে হাজার হাজার।
কেবল আমিই আছি, কেবল আমিই,
যে পারি চোখের মদ পরিবেশন করতে,
যদিও বলতে হয়, এই দুনিয়ায়
পানশালা রয়েছে হাজার হাজার।
এই যে উজ্জ্বল দীপ,
তুমি এরে ঝঞ্ঝা দিয়ে ভয় দেখাতে চাইছ,
এই উজ্জ্বল দীপ
মথকে আকর্ষণ করে হাজার হাজার।
শুনুন- ইন আঁখো কি মাস্তি কে
দিল চিজ ক্যায়া হ্যায়, আপ মেরি জান লিজিয়ে
হৃদয় আবার কী! আমার জানটা নিয়ে নাও।
শুধু একবার আমার কথাটাকে মেনে নাও।
এই মাহফিলে তুমি নিশ্চয়ই বারবার আসবে ফিরে,
দেয়াল-দরজা সবকিছু ভালো করে চিনে নাও।
মানছি, বন্ধুরা সবসময় বন্ধুত্বপরায়ণ হয় না,
তাই বলে অচেনা লোকের অনুগ্রহ কি তুমি নাও?
তুমি চাইলে আকাশকে নামিয়ে আনব পৃথিবীতে,
কিছুই কঠিন নয়, যদি তুমি ইচ্ছাটা প্রগাঢ় করে নাও।
শুনুন- দিল চিজ ক্যায়া হ্যায়, আপ মেরি জান লিজিয়ে
জিন্দেগি জব ভি তেরি
জীবন যখন আমাকে তোমার সান্নিধ্যে নিয়ে আসে,
পৃথিবীকে চাঁদের চেয়েও মনোহর মনে হয়।
হৃদয়ের পথগুলো রক্তিম পুষ্পের সুরভিতে ভরে ওঠে,
দিবস ফুরিয়ে এলে তোমার কণ্ঠস্বর আমারে ডাকে।
তোমার স্মৃতি কখনও সজোরে কখনও ফিসফিস করে
আমাকে জাগিয়ে রাখে গভীর রজনীতে।
প্রতিটা মিলন কেন বিচ্ছেদে পরিণত হয়,
এই ভাবনাই সারাক্ষণ জ্বালায় আমাকে।
শুনুন- জিন্দেগি জব ভি তেরি
জুসতুজু জিসকি থি উসকো তো না পায়া হামনে
চেয়েছি যাকে তারে তো পাইনি আমি,
তারই সন্ধানে তবু দেখে নিয়েছি পুরো দুনিয়াকে আমি।
তোমাকে আঘাত দেই নাই, নিজেকেও শরম দেই নাই,
প্রেমের রীতিকে এভাবেই মান্য করেছি আমি।
কখন মিলেছি আমরা,
কখন আলাদা হয়ে গেছি
আমার তা মনেও নাই;
ও জীবন, তোমাকে দেখেছি শুধু স্বপ্নে আমি।
আমার দশার কথা তোমায় কী আর বলব?
জীবনের দীর্ঘ ভ্রমণ একা-একাই করলাম আমি।
শুনুন- জুসতুজু জিসকি থি উসকো তো না পায়া হামনে
জব ভি মিলতি হ্যাঁয়
যখনই মিলতে আসে, কেন যে অচেনা মনে হয়!
জীবন কেন যে রোজ রং বদলায়!
তোমার সাথে তো হলো ছাড়াছাড়ি, কার সাথে হবে যে মিলন!
দেখ না জীবন আজ কোন রং আমাকে দেখায়!
শুনুন- জব ভি মিলতি হ্যাঁয়