হারিয়ে যাবার আগে
১.
ছেলেবেলায় সবাই বলত আমি কোনো দিন হারিয়ে গেলে আমার জন্মদাগ দেখেই আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আমার বয়স বিশ বছর, আমি এখনো হারাইনি। আমার আর হারানোর আশঙ্কাও নেই। তবু আমার খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এ কিন্তু বাড়ি থেকে পালানো না, একেবারে হারিয়ে যাওয়া। যেভাবে হারালে আমাকে কেউ কোনো দিন খুঁজে পাবে না।
আমাকে খোঁজার জন্য রিকশায় চড়ে আমার বড় ভাই রোকন কাঁপা কাঁপা গলায় পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করবে, ‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, জামতলা নিবাসী আবদুর গফুর সাহেবের নাতি, আবদুর রাজ্জাক সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র শাফিনুর রহমান ছোটন গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আটটায় বন্ধু ফিরোজের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে হারিয়ে গেছে। ছেলেটির পরনে একটি সবুজ রঙের থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর জাম রঙের হাফহাতা গেঞ্জি ছিল। ছেলেটির গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, বয়স বিশ বছর। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি ছেলেটির খোঁজ পেলে তাকে ০১৯১১… নম্বরে ফোন করার জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’ মাইকিং করে খোঁজার সাথে সাথে স্থানীয় দৈনিক কল্লোল, দৈনিক জাগ্রত নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠার প্রথম কলামে হারানো বিজ্ঞপিও প্রকাশিত হবে। ছেলে হারানোর শোকে উন্মাদপ্রায় মা পত্রিকার সেই পৃষ্ঠা বুকে জড়িয়ে রাখবে, আমার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে আর কাঁদবে বিরতিহীন।
আমি হারিয়ে গেলে মনিকা আপাও দিশেহারা হয়ে যাবে। ইনবক্স ভরিয়ে তুলবে মিনতিভরা অসংখ্য মেসেজে। আলুথালু বেশে সকাল-বিকাল আমাদের বাড়িতে দৌড়ে যাবে, ‘চাচি, ছোটনকে পাওয়া গেছে?’ মনিকা আপার অবিন্যস্ত চুল পিঠে লুটোপুটি খাবে, তার শরীরে থাকবে একসমুদ্র নুনের ঘ্রাণ। চোখের কোটরে কালো দাগ বসে যাবে, কদিনের অনিয়মে গলার কাছের হাড়ও সুন্দরের বিপুল সুষমা নিয়ে ভেসে উঠবে। আপাকে দেখে বোঝা যাবে-আমাকে বুঝতে না দিলেও আমাকে পাওয়ার কী তীব্র ইচ্ছে এত দিন বন্দী ছিল তার বুকসিন্দুকে।
কিন্তু আমার হারানোর ইচ্ছে আজও পূরণ হয়নি, মনিকা আপাও আমার অনুপস্থিতিজনিত কারণে উতলা হয়নি। তবে আমি উতল বাতাসে ভাসতে ভাসতে নিজের ভেতরে হারিয়ে যাই। না, কোনো মেঘের দেশ, ফুলের দেশ বা স্বপ্নের দেশে না। এই হারিয়ে যাওয়ার প্রান্তর খুব অদ্ভুত, অকল্পনীয়। যেখানে শুধু দুজন মানুষ মুখোমুখি নিশ্চুপ বসে থাকে। ছায়াহীন, কায়াহীন। তাদের চোখজুড়ে থাকে শুধু প্রিয় সময়ের স্মারক।
এই পর্যন্ত শুনেই খুব অদ্ভুত লাগছে, তাই না? এই যে মিনিট পনেরো আগে আমার ঘরে এসে উঁকি দিয়ে আমাকে খুঁজে না পেয়ে রোকনেরও এমন অদ্ভুত লেগেছে। ও বারবার ডেকেছে, ‘ছোটন, ছোটন…? কলেজে যাবি না? এ্যাই তুই কানে শুনোছ না…কী হইল? কই ডুব মারছস?’
আমি হারিয়ে গেলে মনিকা আপাও দিশেহারা হয়ে যাবে। ইনবক্স ভরিয়ে তুলবে মিনতিভরা অসংখ্য মেসেজে। আলুথালু বেশে সকাল-বিকাল আমাদের বাড়িতে দৌড়ে যাবে, ‘চাচি, ছোটনকে পাওয়া গেছে?’ মনিকা আপার অবিন্যস্ত চুল পিঠে লুটোপুটি খাবে, তার শরীরে থাকবে একসমুদ্র নুনের ঘ্রাণ। চোখের কোটরে কালো দাগ বসে যাবে, কদিনের অনিয়মে গলার কাছের হাড়ও সুন্দরের বিপুল সুষমা নিয়ে ভেসে উঠবে। আপাকে দেখে বোঝা যাবে-আমাকে বুঝতে না দিলেও আমাকে পাওয়ার কী তীব্র ইচ্ছে এত দিন বন্দী ছিল তার বুকসিন্দুকে।
আমি রোকনের কথা শুনব কী করে, আমি তো হারিয়ে গেছি। এই বাড়ির সবাই জানে আমার এই হারিয়ে যাবার স্বভাবের কথা, তবু এরা আমাকে খুঁজতে এসে হয়রান হয়ে ফিরে যায়। বাবা সারাক্ষণ নানান ধান্দায় ব্যস্ত থাকে বলে আমাকে খুঁজতে আসে না। আমার সঙ্গে কলেজে যাবে বলে ডাকতে এসে রোকন বিরক্ত হয়ে একাই চলে যায়, মা টেবিলে ভাত দিয়ে আমাকে ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।
বাড়িতে যতক্ষণ থাকি, আমার কোনো কাজ থাকে না। এই বছর এইচএসসি পরীক্ষায় ড্রপ দিলাম, তাই রুটিনমাফিক পড়ালেখাও নেই। প্রি-টেস্টে দুই বিষয়ে ফেল করার পর কলেজ থেকে জানিয়ে দিয়েছে, আমাকে বোর্ড পরীক্ষায় বসতে দেবে না। আমি প্রথমে বাসায় জানাইনি। আমি আহামরি কোনো ছাত্র না, আবার ফেল করার মতো ছাত্রও না। ফিজিকস আর ম্যাথে কয়েক নম্বরের জন্য বসে গেছি। কী করতাম আমি? আমার প্রি-টেস্ট পরীক্ষার সময়ে মনিকা আপার চিকেন পক্স হলো। মনিকা আপার কষ্ট হচ্ছে ভেবে কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারিনি। দিনে কয়বার করে তাকে দেখতে গিয়েছি, ঘরের দরজায় দাঁড়ানো মাত্রই আমাকে ভাগিয়ে দিয়েছে।
যা, যা, ভাগ। একদম ঘরের ভেতর ঢুকবি না। পরীক্ষার ভেতরে তোর পক্স উঠলে মহা সর্বনাশ।
মনিকা আপা জানে না, এত দিনে আমার যা সর্বনাশ হবার, তা হয়ে গেছে। আমি মনিকা আপাকে বোঝাতে যাইনি। পরীক্ষায় ফেল করেছি, তা বাসার কাউকে জানাতেও যাইনি। চুপচাপ ছিলাম। কলেজে অভিভাবক সমাবেশ ডাকাতেই বিপত্তি হলো। এমনিতে সারা বছর বাবার কাছে আমাদের দুই ভাইয়ের কোনো খবর পাওয়া যাবে না, সেদিন কলেজ থেকে স্যার বাবাকে ফোন করতেই বাবা আমাকে না জানিয়ে দুই চোখে সুরমা লাগিয়ে ইস্তিরিভাঙা কাপড় পরে সুড়সুড় করে কলেজে চলে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে বাবার সেই কী লাফালাফি আর ডাক-চিৎকার। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি, আমি আস্তে করে আমার ঘরে ঢুকে দরজার কপাট লাগিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে সময়মতো ফিরে এসেছি।
আমি যেন প্রাইভেটে এইচএসসি পরীক্ষা দিই, তা নিয়ে মা অনেক অনুনয় করেছে, কোনো লাভ হয়নি। মনিকা আপাও আমাকে বুঝিয়েছে, ‘দ্যাখ ছোটন, পরীক্ষা দিয়া দে, ঠিক পাস কইরা যাবি। ইয়ার লস দিছস তো মরছস, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের গঞ্জনা শুনতে শুনতে তোর মন চাইব এই পৃথিবী থেইকা পালাইয়া যাই।’
মনিকা আপা জানে না, আমার পালিয়ে যেতে মন চায় না। আমার খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
২.
বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে, এর ঘূর্ণি দেখে মনে হচ্ছে এখনই সিলিং থেকে ছিটকে পড়বে। ফ্যানের বাতাসের একরত্তিও আমার শরীরে লাগছে না। একটু আগে গোসল করেছি, তবু ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছি। ঘাড়ের আশপাশে কুটকুট করছে। ফিরোজ ফোন করে বের হতে বলেছিল, আমি না করেছি। খুব অবসন্ন লাগছে।
মনিকা আপা বলে, যখন তার বিষণ্ন লাগে, তখন সে ঘর অন্ধকার করে বালিশের ভেতর মাথা গুঁজে এমন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। আমি বুঝতে পারছি, আমার বিষণ্ন লাগছে। শরীরের চেয়ে মনের ওজন বেশি এখন। কিছুই ভালো লাগছে না।
জন্মদাগটা আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। গতকাল এই দাগের চারদিকে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে গাঢ় করে দাগ দিয়েছি। এমন না যে এই দাগটা গাঢ় না। আড়াই ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের কালচে এই দাগ ডিম্বাকৃতির। আমার মনে আছে, একদিন মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলেছিল, ‘ভাগ্যিস, দাগটা মুখে হয় নাই।’ মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাবা সেদিন বলেছিল, ‘মুখে হইলেই কী হইতো? মাইয়া মাইনষের বেহুদা কথা। পুরুষমানুষের একটু-আধটু দাগ থাকলে কিছুই আসে যায় না।’
আমি তখন ছোট থাকায় বাবার কথার গভীরতা ধরতে পারিনি। বড় হয়ে দেখলাম, পুরুষমানুষের একটু-আধটু দাগ থাকলে কিছুই আসে যায় না; হোক সে শরীরে, নয় চরিত্রে।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে মনিকা আপার শরীরে কোনো জন্মদাগ আছে কি না। এটা জানার জন্য আমি মনিকা আপার দিকে মাঝে মাঝে খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাই, কোনো লাভ হয় না। এখন পর্যন্ত মনিকা আপার মুখ-হাতের যতটুকু অংশ অনাবৃত দেখেছি, তাতে কোনো জন্মদাগ চোখে পড়েনি। আপার শরীরের অন্য কোথাও কোনো জন্মদাগ আছে কি? তাবৎ পৃথিবীকে ফাঁকি দিয়ে মনের ভেতরে এই প্রশ্ন উঁকি দিলেই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে, হাত-পা ঝিমঝিম করে। মনিকা আপা যদি আমার মনের এই উথালপাতাল অবস্থা দেখতে পেত, সে কি আমাকে ঘেন্না করত? নাকি রক্তিম মুখে লোকচক্ষু আড়াল করে আমাকে তার জন্মদাগ দেখাত?
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে মনিকা আপার শরীরে কোনো জন্মদাগ আছে কি না। এটা জানার জন্য আমি মনিকা আপার দিকে মাঝে মাঝে খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাই, কোনো লাভ হয় না। এখন পর্যন্ত মনিকা আপার মুখ-হাতের যতটুকু অংশ অনাবৃত দেখেছি, তাতে কোনো জন্মদাগ চোখে পড়েনি। আপার শরীরের অন্য কোথাও কোনো জন্মদাগ আছে কি? তাবৎ পৃথিবীকে ফাঁকি দিয়ে মনের ভেতরে এই প্রশ্ন উঁকি দিলেই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে।
প্রথম দিন আমার জন্মদাগ দেখে মনিকা আপা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, ‘এটা কী ছোটন? তোর জন্মদাগ? ভীষণ অদ্ভুত তো! খুব সুন্দর।’ একটা দাগও যে সুন্দর হতে পারে, সে কথা একমাত্র মনিকা আপার মাথাতেই আসা সম্ভব। মনিকা আপা কখনোই অন্যদের মতো আমার জন্মদাগ দেখে মন্তব্য করেনি যে আমি হারিয়ে গেলে এই জন্মদাগ দেখেই আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আমার হাত ছুঁয়ে আপা যখন আমার জন্মদাগটি দেখছিল, আমার ঠোঁটের কাছে ‘তোমার কি এমন কোনো দাগ আছে? দেখি?’ এই প্রশ্নটা এসে আটকে গিয়েছিল।
অনেক দিন হলো মনিকা আপার সামনে গেলে আমার সব কথা আটকে যায়। অর্ধেক কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলি। হঠাৎ যখন আপা আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে কোনো কথা বলে, তখন আমি আরও কথা খুঁজে পাই না। আমার দম আটকে আসে, মনে হয় আমার আশপাশে এক ফোঁটা বাতাস নেই। আপার হাতের স্পর্শ পেয়ে বাতাসশূন্য পৃথিবীতে আমি ছটফটাই। মনিকা আপা আমাকে ছোট ভাই, ছোট ভাই করলে আবার উল্টো অনুভূতি হয়।
এই তো এই রোববারে মনিকা আপা আমাকে বলল, ‘ছোটন, ফিরোজদের বাগান থেইকা কয়টা লটকন আইনা দে না…খুব খাইতে ইচ্ছা করতাছে। তোর মনিকা আপার জন্য এতটুকু করতে পারবি না! লক্ষ্মী ভাই আমার। যা।’ মনিকা আপার তুই-তোকারি আর সাথে ভাই ডাক আমার কানের ভেতরে গরম কিছু ঢেলে দিয়েছিল। লটকন কেন? আপা বললে আমি ফিরোজদের বাগানের সব লটকন গাছ উপড়ে নিয়ে আসব কিন্তু তাই বলে মনিকা আপা কথায় কথায় আমাকে তুই-তোকারি করবে, ভাই বলে সম্বোধন করবে! আমি ওর কোনকালের ভাই লাগি!
সেদিন মনিকা আপাকে এসব কথা বলব বলব ভেবেও বলতে পারিনি। এখন তো বলতে আরও দেরি হবে। মনিকা আপা টুটুল ভাইয়ের বাড়িতে গেছে। শিখা ভাবির বাচ্চা হবে। আজ সকালে যখন ওই বাড়িতে গিয়েছি, তখন চাচির কাছে শুনলাম আপা বাসায় নেই। ‘চাচি, মনিকা আপা বাসায় নেই?’ এই প্রশ্ন করতে গিয়ে আমার বুকের ভেতর থরথর করে কাঁপছিল, গলা শুকিয়ে আসছিল। মনিকা আপাকে সবার সামনে আপা বলতে আজকাল আমার জিহবার কোথায় যেন বাধে।
এই যে দিন নেই, রাত নেই, ভীষণ গোপনে আমি মনিকা আপার সাথে দারুণ একটা যুগল জীবন যাপন করি, সেখানে মনিকা আপাকে আমি মনিকাই ডাকি। গোপন নিভৃত সেই জগতে অজস্র কথার বুদ্বুদে আমাদের দুজনের বয়সের ব্যবধান, পারস্পরিক সম্বোধন সব ভেসে যায়। মনিকা আপা কি তা জানে?
শিশু-অভিমানে আমার বুক ভেঙে যায়। সেই ভাঙনে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মেজাজ ভীষণভাবে তেতে ওঠে। অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে নিষ্ফল ক্রোধের স্রোত এসে আমাকে নাস্তানাবুদ করে তোলে। যাবার আগে একটু বলে যেতে পারল না মনিকা, আমি কি কিছুই না ওর কাছে? ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটা মেসেজও তো করতে পারত। মিন্টু দরজির কাছ থেকে কাপড়, কালীবাজার থেকে ম্যাচিং লেইস-সুতা, সবুজ-কমলা ললি আইসক্রিম, মরু-গোলাপ বা হলুদ জবার চারা এনে দেবার ফিরিস্তি তো ও ইনবক্সে ঠিকই দিতে পারে। আর এখন!
আমি মনিকা আপার ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকি। তন্নতন্ন করে খুঁজি প্রত্যেকটা নোটিফিকেশন, দেখি মনিকা আপা কারও টাইমলাইনে রেসপন্স করেছে কি না। আপার প্রোফাইল পিকচারে বড় ভাগনি বুবলির ছবি দেওয়া। মনিকা আপা কখনোই নিজের কোনো ছবি ফেসবুকে দেয় না। সেদিন আপাদের বাড়ির সামনে মোসেন্ডা গাছের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় আপার একটা ছবি তুলে দিয়ে বলেছিলাম, ‘প্রোফাইল পিকচার দিয়ো।’ ক্রিমরঙা মোসেন্ডা ফুলের ভাঁজখোলা অসংখ্য পাপড়ির মাঝখানে বেরিয়ে থাকা পাঁচ পাপড়ির হলুদ জ্বলজ্বলে ফুলগুলোর সৌন্দর্য ম্লান করে হলুদরঙা জামা পরা মনিকা আপা হেসে বলেছিল, ‘না রে ছোটন, ফেসবুকে ছবি দিলেই গাদিগাদি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে, আমার এসব একেবারে অসহ্য লাগে।’ মনিকা আপার কথা শুনে আমার ভীষণ নির্ভার লেগেছিল, ভেবেছি, তাই তো! আমি ছাড়া এত বন্ধু কেন থাকবে আপার!
আমার অস্থির লাগছে। বুকের ভেতর হাজার পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। কত দিন মনিকাকে দেখতে পাব না! কত দিন! ফোন করব নাকি? নাহ্। তীব্র মন খারাপের নদীতে ডুবতে ডুবতে আমি এই প্রথমবার আমার শরীর-মনজুড়ে বিষণ্নতার নির্মমতা অনুভব করি। বিশ বছরের জীবনে প্রথমবারের মতো আমি আবিষ্কার করি, বিষণ্নতা মানুষকে মেরেও ফেলতে পারে। এই যেমন, ঠিক এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছে আমি বাড়ির ছাদে চলে যাই, তারপর ঝাঁপ দিই ডানাবিহীন।
ছটফট করতে করতে আমি আবার মোবাইল হাতে নিই। মনিকা আফরোজ নামের পাশের সবুজ গোল আলো জ্বলছে না। মেসেঞ্জারের নীল বাক্সর ওপরে, মনিকা আফরোজ অ্যাকটিভ ফাইভ মিনিটস অ্যাগো দেখাচ্ছে। তার মানে মনিকা আপা অনলাইনে আসার পরও আমার খোঁজ করেনি, একবারও জানতে চায়নি, ‘ছোটন, তুমি কেমন আছ?’
আমি তাহলে কিছু না ওর কাছে, কিছুই না? টের পাই, আমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছে, হু হু করে জ্বর বাড়ছে। জ্বরের উত্তপ্ততায় আমার শরীরের চামড়ার সাথে মনের সবচেয়ে শক্ত জায়গাটাও পুড়ে খাক হয়ে যায়। শরীর-মন দহনের এই তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে আমি কাঁদতে শুরু করি, জলের উত্তাপে আমার চোখ পুড়ে যায়, ক্লান্তিহীন সেই জলের দাগে আমার মুখে, গলায় গভীর ক্ষতরেখা তৈরি হয়। তবু আমি কাঁদি, কাঁদতেই থাকি।
৩.
দাদা ঘরে ঢুকেছে। দাদার শরীরে বিড়ির কড়া গন্ধ। আমার দাদা আবদুর গফুর ভীষণ কিপটে। বুড়ো আঙুল পুড়িয়ে বিড়ির শেষটুকুও খেয়ে ফেলে। আমার বুড়োকে খেপাই।
দাদা, এক শ টাকা দাও।
বুড়ো খেপে যায়। গর্জে উঠে আমাকে ফালি ফালি করে কাটে।
যা, ফকিরের বাচ্চা। দুই পয়সা কামাইয়ের মুরোদ নাই।
পয়সা দিয়া কী করমু দাদা, টাকা দাও।
এহ, আইছে। সব কয়টা আছে খালি আমার পয়সা লুটার তালে। আমি দুই চোখ বুজলেই বারোভূতে আইসা আমার বাড়িঘর লুইটা খাইব। এই যে এহনো আমার বাড়িত বিনা ভাড়ায় থাকস।
কবে চোখ বুজবা? দিনক্ষণ ঠিক হইছে?
মর শয়তান, বাপটার মতো পিছামারা হইছে।
এই চিমসে বুড়ো মরেও না, হারায়ও না। এত কিপটে বুড়ো, নিজের ছেলের কাছ থেকে বাড়ির ভাড়া চায়। আমার বাবা দাদার নাম রেখেছে। অনেক দিন আগেই বাবা এই বাড়িটা নিজের নামে লিখে নেবে বলে দলিল তৈরি করে রেখেছে। বুড়ো একদিন ঝিমালে চাচাকে ঠকিয়ে বাবা বুড়োর টিপসই মেরে নেবে। বাবা জানে না, আমি জানি; দাদার টিপসইয়ে কোনো কাজ হবে না। দাদার বুড়ো আর তর্জনী আঙুলের কোনোটাতেই রেখা নেই।
এই চিমসে বুড়ো মরেও না, হারায়ও না। এত কিপটে বুড়ো, নিজের ছেলের কাছ থেকে বাড়ির ভাড়া চায়। আমার বাবা দাদার নাম রেখেছে। অনেক দিন আগেই বাবা এই বাড়িটা নিজের নামে লিখে নেবে বলে দলিল তৈরি করে রেখেছে। বুড়ো একদিন ঝিমালে চাচাকে ঠকিয়ে বাবা বুড়োর টিপসই মেরে নেবে। বাবা জানে না, আমি জানি; দাদার টিপসইয়ে কোনো কাজ হবে না। দাদার বুড়ো আর তর্জনী আঙুলের কোনোটাতেই রেখা নেই। সরকার থেকে সিম রেজিস্ট্রেশনের দিন বেঁধে দেওয়ার পর আমি দাদাকে সাথে নিয়ে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে গিয়েছিলাম। বুড়োর সব কয়টা আঙুল মেশিনে ঠেসে ঠেসে বসানোর পরও কোনো লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমার নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করে বাড়ি ফিরেছিলাম।
দাদা, ঘরে আইসা কেউ আমারে খুঁইজা পায় না। তুমি পাও কেমনে।
দাদা হাসে। হাসলে বুড়োকে ভালোই দেখায়। দাদার বয়সী শরীর কচি বাঁশের মতো বিনা বাতাসে দোলে।
তুই কত বিটলা। তোর চেয়ে বেশি বিটলা আমি। আমি জানি আমারে দেখলে তোর ট্যাকার কথা মনে পড়ব আর তুই ফিরা আইবি।
দাদার সাথে এবার আমিও হাসি। হাসতে হাসতে আমার মনে পড়ে যায় মনিকা আপা আজ বাড়ি ফিরবে। গতকাল রাতে আপা আমাকে মেসেজ করেছে, ‘কেমন আছিস রে ছোটন? টুটুলের মেয়ে দেখতে দারুণ মিষ্টি হয়েছে। আমার ওকে রেখে আসতেই ইচ্ছে করছে না।’ ইনবক্সে নিজের ছবিও দিয়েছে মনিকা আপা, একটা পুঁটলি মতো ছোট বাচ্চার গালে গাল লাগিয়ে তোলা। এক সপ্তাহ পর মনিকা আপাকে দেখে অভিমান ভুলে আমি কাঁপতে কাঁপতে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কবে ফিরছ?’
আমার বুকের ভেতর শুকনো পাতার মর্মর। মনিকা আজ ফিরছে। আমার অপ্রিয়তম প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে আজ। মনিকা ফিরছে, দেখা হচ্ছে আমার সাথে। রাতে প্রবল উত্তেজনায় আমি ঘুমাতে পারিনি, বরাবরের মতো হারিয়ে যেতেও পারিনি।
কী রে কী ভাবতাছস? ট্যাকা লাগব না?
দাদার হাত থেকে ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই।
আমাদের বাড়ি থেকে একটা বাড়ি পরই মনিকা আপার বাড়ি। বছর ছয়েক আগে মনিকা আপার বাবা রেফাত চাচা এই বাড়িটা কিনেছে। এই বাড়ির পূর্বমালিক ছিল আমার ছোট চাচা সামাদ। চাচা সিঙ্গাপুরে যাবার সময় টাকার প্রয়োজন হওয়ায় বাড়িটা বিক্রি করেছেন। আমার বাবার খুব লোভ ছিল এই জায়গার ওপরে, কিন্তু চাচা গোপনে বিক্রি করায় তখন কিনতে পারেনি। বাবা এই বাড়ি নিয়ে অগ্রক্রয়ের মামলা করেছিল, পরে পাঁচ মাসের মাথায় আপসে মামলা তুলে নিয়েছে। এ নিয়ে রেফাত চাচা কম ভোগেননি। আমার ধারণা, মামলা উত্তোলন বাবদ বাবা মনিকা আপার বাবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছে, টাকা ছাড়া এই বান্দার এক পা-ও পিছু হটার কথা না।
আমার বাবার খুব জায়গা কেনার ঝোঁক, স্বভাবে দাদার মতোই হাড়কিপটা। সদর সাবরেজিস্ট্রারের অফিসের ক্লার্ক হিসেবে বাবা জায়গাজমির কাগজপত্রও ভালো বোঝে। এরই মধ্যে শহরে দুটো জায়গা কিনেছে। দাদার বাড়িতে থেকে চাচাকে ঠকিয়ে এই বাড়িটাও কবজা করার ধান্দাতে আছে। আমি জানি রেফাত চাচার বাড়ির ওপর থেকে বাবার আকর্ষণ এখনো যায়নি। রেফাত চাচাকে দেখলে এখন বাবা মাখনের মতো গলে যায়, চাচার অসুখ-বিসুখে, বিপদে-আপদে এগিয়ে যায়। বাবাকে তখন তার প্রকৃত চরিত্রের সাথে আমি মেলাতে পারি না।
মনিকা আপার বাড়ির সামনে চলে এসেছি। আমাদের দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে আগে এই বাড়ি পুরোপুরি দেখা যেত। তবু সকালে কলেজে যাবার আগে বা বিকালে রোদ পড়লে আমি ছাদে চলে যেতাম, পর্দার নীল ঢেউ সরিয়ে মনিকা আপা জানালার সামনে এসে দাঁড়াত। আপা আমাকে দেখতে পেয়ে মাঝে মাঝে হাত নাড়ত, কখনোবা আনমনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পর্দা টেনে চলে যেত। গত এক বছরের মধ্যে আমাদের দুই বাড়ির মাঝখানে ধাইধাই করে একটা তিনতলা বিল্ডিং উঠে যাওয়ায় আমি আর যখন-তখন মনিকা আপাকে দেখতে পাই না।
গেটের দুই পাশের মধুমঞ্জুরির ঝাড় ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে, গতকালও এরা বিমর্ষ ছিল। এই বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের চারদিকে অনেক গাছ আছে, বেশির ভাগই আগের মালিক সামাদ চাচার লাগানো। ফলদ গাছই বেশি। আম, জাম, চালতা, পেয়ারা, মেহগনিগাছের ছায়াঘেরা একতলা বাড়িটা খুব সুন্দর। মনিকা আপা আসার পর অনেক ফুলের গাছও লাগিয়েছে। এসব গাছের বেশির ভাগই আমি জোগাড় করে এনে দিয়েছি। আমি ঘোর লাগা চোখে দেখি আজ এই বাগানে সাদা-লাল-গোলাপি গোলাপ, দোলনচাঁপা, কলাবতী, অলকানন্দা, মোসেন্ডা ফুলের উৎসব বসেছে। সেসব ফুলের মাঝে সবচেয়ে রঙিন ফুল হয়ে মনিকা আপা দাঁড়িয়ে আছে, আমি পা ফেলতে ভুলে যাই। পৃথিবীর সবচেয়ে মনোরম স্থিরচিত্রটি আমি দেখছি, আশপাশের কিছু দেখতে পাচ্ছি না, কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
ছোটন আয়। কেমন আছস?
মনিকা আপাকে নয়ন, শোয়েব, তাহের, প্রত্যয়, মিলনসহ পাড়ার বারো-চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলের দল ঘিরে রেখেছে। মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে মনিকা আপা গম্ভীর মুখে ওদের কথা শুনছে। আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। সারাক্ষণ এদের এত কী এই বাড়িতে? আর মনিকা আপাও কেমন! এত বড় হয়েছে, এখনো এসব ছেলেমানুষি যায় না, পাড়ার ছেলে-ছোকরা নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন, লাইব্রেরি তৈরি, ঈদ, শবে বরাতে ফুলঝুরির আয়োজন…এখনো এসব করতে হবে? আপা বোঝে না, এখনকার ছেলেপেলেরা আমাদের মতো না? বুড়ো ধাড়ি, শয়তানের পাঝাড়া একেকটা। দিনরাত মনিকা আপার সামনে ন্যাবলা বাবু সেজে ঘুরে বেড়াবে আর বন্ধুদের আড্ডায় মনিকা আপাকে নিয়ে আদি-রসাত্মক জোকস বানাবে, গুগোল করে পর্ন ভিডিও দেখবে। রাগে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে, ইচ্ছে করে সব কয়টাকে ধরে বনচটকানা লাগাই।
ছোটন ভাই, ডিসিশন ফাইনাল। এইবার তুমি আমাদের আম্পায়ার।
মিলনের নাক-বরাবর একটা ঘুষি মারলে বেশ হতো। সবকিছুতেই ওর মাতব্বরি।
আমি পারমু না। আমার পরীক্ষা আছে।
হে হে হে, তোমার আবার কিসের পরীক্ষা? তুমি তো ফেলটু মিয়া।
আমি মনিকা আপার দিকে তাকাই। মিলনের কথা শুনে আপার ঠোঁটের কোণে হাসির সূক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠেছে কি? অন্ধক্রোধে আমি মিলনের দিকে ছুটে যাই। পিঠে কয়েক ঘা লাগিয়ে আমি মিলনের ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিতে থাকি, দিতেই থাকি। ইচ্ছে করে ওকে ছিঁড়ে মাটির ভেতর পুঁতে ফেলি।
কী বললি? কী বললি শয়তান, আবার বল। আবার বল।
মনিকা আপা পাখি হয়ে উড়ে এসে আমার হাত থেকে মিলনকে ছাড়িয়ে নেয়।
আরে ওকে ছেড়ে দে ছোটন। ছোট মানুষ। আর মিলন, বাড়াবাড়ি তুই আগে করছস। বড় ভাইদের সাথে এমন কইরা কথা কইলে তোরে টিমে রাখমুই না আর কথাই বলমু না তোর সাথে। যা ভাগ, ভাগ…সবাই আজ বাড়ি যা।
মনিকা আপার কোনো কথা আমার কানে ঢোকে না। আপার হাতের পালকস্পর্শ আমার হাতে লেগে আছে, আমার জন্মদাগে লেগে আছে। এবার আমি পাখি হয়ে উড়ে যাই, ভেসে যাই। অস্তাচলের আলোর ঢেউয়ের সাথে দূর আকাশে ভাসতে ভাসতে মিলনকে ক্ষমা করে দিই।
৪.
মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় আমার। তখন ইচ্ছে করে মনিকা আপার বালখিল্যতাকে কর্কশ কণ্ঠে উপহাস করি, চিৎকার করে বলে উঠি, অনেক হয়েছে, এবার ন্যাকামি ছাড়ো। ইচ্ছে করে ওকে ছিঁড়ে ফেলি ওর বাগানের ফুলের মতো, তারপর ওকে করতলে ফেলে দলে-মুচড়ে-নিঙড়ে দিই, ওর নগ্ন শরীরের ভাঁজ খুলে খুঁজে ফিরি ওর জন্মদাগ, ওকে আপাদমস্তক নষ্ট করে দিই; যেন ও সবার কাছে অস্পৃশ্য হয়ে যায়, সেই সাথে অনিবার্যভাবে আমারও হয়।
আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। শরীরের গোপন কুঠরির পাপের তাড়নায় পুড়তে পুড়তে আমার সমস্ত শরীর জ্বালা করে। টের পাই, আজ আমার জ্বর আসবে। মনিকা আপা জানে না, প্রতিবার তার উপেক্ষায় আমার শরীর-মনে জ্বর এসে যায়। যেই ডুবোজ্বরে থই হারাই আমি, যমদূতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকি। দৈত্যাকার যমদূত তারই আকৃতির এক পানসি নিয়ে আমাকে নেওয়ার জন্য আমার সাথে ধস্তাধস্তি করে। আমি কোনোক্রমে পালিয়ে বাঁচি।
পরীক্ষা শেষে বাড়িতে পা দিতেই টের পাই কিছু একটা হয়েছে। রেফাত চাচা-চাচি, মনিকাসহ প্রতিবেশীরা অনেকেই এসেছে। অসময়ে বাবাও বাড়িতে, বাবা বিলাপ করে কাঁদছে। দাদার খাটের সামনে মেঝেতে বসে বাবার কাঁদার মেকি দৃশ্যটি দেখে আমার বুঝতে দেরি হয় না যে দাদা মারা গেছে। আমি কাঁদতে পারছি না। আমার চোখের পানি ফুসমন্তরে শুকিয়ে গেছে। আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, ‘দলিল সাইন করাইছ?’
মনিকা আপার মনোযোগ এখন সোফায় বসা লোকটার দিকে। লোকটা কোলাব্যাঙের মতো শরীর ফুলিয়ে বসে আছে। একে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। চাচি সেদিন আমাকে ফিসফিস করে বলেছে, এই কোলাব্যাঙ ঢাকায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। টুটুল ভাইয়ের বন্ধু।
আমি তীক্ষ্ণ চোখে লোকটাকে দেখি। চৈত্র মাসের এই গরমে কালো রঙের ব্লেজার পরে আছে, গোলাপি শার্ট উপচে তার থলথলে পেট দেখা যাচ্ছে। লোকটার আমার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, ভ্যাবলাটা মনিকা আপাকে পলকহীন দেখছে। আমার ইচ্ছে করে একটা কাঁটাচামচ এনে খাটাশটার চোখ দুটো উপড়ে ফেলি।
কিরে, কী হইছে তোর?
আমার দিকে তাকিয়ে মনিকা আপা হাসিতে ভেঙে পড়ে। আমাকে দেখে এত হাসির কী হলো, আমি বুঝতে পারছি না। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে শার্টের ইন ঠিক করতে করতে মনিকা আপাকে বলি, আপা, তুমি হাসতাছ কেন? আমারে দেখতে কি জোকারের মতো লাগতাছে?
আরে না, মনে হইতাছে পরীক্ষা না তুই চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাইতাছস, তোরে বেশ সাহেব সাহেব লাগতাছে। মনে পইড়া গেল, এই মহল্লায় যখন আসি, তখন তুই এতটুকুন ছিলি, দিন দিন চোখের সামনে ব্যাটা হইয়া গেলি।
মোটেও না। তুমি যখন এই পাড়ায় আসলা, তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম। আমি বড়ই ছিলাম। এমন কোনো ছোট ছিলাম না।
তুই এখনো ছোটই আছস। সারাক্ষণ আপার পেছনে ঘুরঘুর করছ। কোনো বন্ধুবান্ধব নাই তোর?
মনিকা আপা কাছে এসে আমার কপালের উড়ো চুল সরিয়ে দেয়। ঠিক এই মুহূর্তে আমি আয়নায় নিজেকে দেখতে না পেলেও বুঝতে পারি, আমার চোখ-নাক-কান আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে লাল হয়ে গেছে। আমাকে যেতে হবে। আজ আমার প্রথম পরীক্ষা। শেষ পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছি, কলেজ পাল্টে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিচ্ছি। একটা বছর নষ্ট করার কোনো মানে নেই। এমনিতে সময়ের রেসে আমি মনিকা আপার চেয়ে পিছিয়ে আছি।
চাচি ঘরে ঢুকেছে। চাচির হাতে শরবত, নির্ঘাত ওই বদ লোকটার জন্য এনেছে। কায়দা করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব নাকি?
তুই কখন আসলি, দাঁড়া, তোরেও এক গ্লাস শরবত আইনা দেই।
লাগব না চাচি। আমার পরীক্ষা, দেরি হইয়া যাইব।
চাচির মুখ ম্লান, কপালে ঘাম। এই বাড়িতে আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে সব সময় মনিকা আপা থাকে বলে অন্য কিছু চোখে পড়ে না আমার। আমি চাচিকে দেখতে দেখতে এই বাড়ির বসার ঘরের চারদিকে তাকাই। একটা দৈন্যতার ছাপ চারপাশে। সেন্টার টেবিলের কভার, সোফার কভারগুলো অনেক দিন পাল্টানো হয় না। কার্পেটের দুই কোনার সুতো খুলে গুটলি পাকিয়ে আছে।
চাচি, আপনার শরীর খারাপ?
নারে, তোরা কেমন আছিস? তোর মা কেমন আছে? অনেক দিন আপা আসে না।
এই তো কদিন আগেও তো আসলো। মা আছে ভালোই। দাদার শরীর বেশি ভালো না, যেই বিড়ি টানে। ফুসফুস পইচা গেছে মনে হয়।
চাচি হাসে। তাকে হাসতে দেখে আমার খুব ভালো লাগে। মনিকা আপাও হাসছে।
তুই মনে হয় বিড়ি-সিগারেট খাস না? আমি কিন্তু ঠিকই গন্ধ পাই।
মনিকা আমার শরীরের গন্ধ নেয়! মনিকা আমার গন্ধ পায়! আমার মাথা আবার এলোমেলো হয়ে যায়। কোলাব্যাঙের থ্যাবড়া মুখটাও সুন্দর লাগে, এই ঘরটাও ঐশ্বর্যভরা মনে হয়। আমি টলতে টলতে মনিকা আপাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, প্রথম সুযোগেই এবার এইচএসসি পাস করে ফেলতে হবে। মনিকা আপা চাকরি পাবার আগেই।
পরীক্ষা শেষে বাড়িতে পা দিতেই টের পাই কিছু একটা হয়েছে। রেফাত চাচা-চাচি, মনিকাসহ প্রতিবেশীরা অনেকেই এসেছে। অসময়ে বাবাও বাড়িতে, বাবা বিলাপ করে কাঁদছে। দাদার খাটের সামনে মেঝেতে বসে বাবার কাঁদার মেকি দৃশ্যটি দেখে আমার বুঝতে দেরি হয় না যে দাদা মারা গেছে। আমি কাঁদতে পারছি না। আমার চোখের পানি ফুসমন্তরে শুকিয়ে গেছে। আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, ‘দলিল সাইন করাইছ?’ আমার কথা শুনে বাবা বসা থেকে তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে আমার গালে প্রচণ্ড বেগে চড় মারে, চড়ের আঘাতে ছিটকে গিয়ে দাদার ঘরের আলমারির সাথে আমি বাড়ি খাই, আলমারির নকশাকাটা লেগে আমার কপাল ফুলে যায়। মনিকা আপা কোথা থেকে উড়ে এসে চিলের মতো ছোঁ মেরে আমাকে আমার ঘরে নিয়ে যায়।
মনিকা আপার স্পর্শ পেয়ে আমার চোখজোড়া সমুদ্র হয়ে যায়। আমার অন্তর্গত সকল বেদনা উসকে ওঠে। নিজের ভেতর-বাহির উজাড় করে আমি কাঁদি।
দাদা আমারে খুব ভালোবাসত মনিকা আপা, খুব ভালোবাসত। এই দুনিয়ার কেউই আমারে ওই কিপটা বুড়ার মতো ভালোবাসে না। কেউ না।
অন্য সবার মতো মনিকা আপা আমাকে সান্ত্বনা দেয় না, আমাকে কাঁদতে দেয়। আপাকে অবলম্বন করে কাঁদতে কাঁদতে আমি তাকে নতুনভাবে ভালোবাসি।
৫.
আমার পরীক্ষার রেজাল্ট হবার আগেই মনিকা আপার চাকরি হয়ে যায়, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার পদে। মনিকা আপার সরকারি চাকরি হয়েছে শুনে মা খুব খুশি। দুপুরে প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে মা আপার গুণকীর্তন করছে।
মাইয়াটার মাথা খুব ভালা। অনার্স পাস কইরা বাইর হইতে না হইতেই চাকরি পাইয়া গেল। রেফাত ভাইয়ের ব্যবসার অবস্থা ভালা না, লোনের মইদ্দে ডুইবা আছে। এই সময় মাইয়া চাকরি পাওয়ায় ভালোই হইছে। এবার মাইয়াটার একটা ভালো বিয়া দিতে পারলেই আপা নিশ্চিন্ত।
মনিকা আপার বিয়া নাকি?
এখনই তো বিয়ার সময়। মাইয়াটা দেখতেও মাশা আল্লাহ সুন্দর। ছাত্রীও ভালা। সব কেলাস এক চান্সে পাস করে। তোরে কতবার কইছি, মাইয়াটা অঙ্কে ভালা, ওর কাছে মাঝেমইদ্দে অঙ্কটা দেখিস, তুই তো শোনোছ না। মাইয়াটা তোরে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসে।
‘মনিকা আমাকে ভালোবাসে’ এই খণ্ডিত বাক্য লক্ষ প্রজাপতি হয়ে আমার চোখমুখ রঙিন করে তোলে, পরক্ষণেই ‘ভাইয়ের মতো’ শব্দচয়নের নির্লজ্জতায় ওরা ডানা গুটিয়ে পালিয়ে যায়। আমি প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় পছন্দের গরুর মাংস-ঝোলে মাখা ভাতের প্লেট ঠেলে টেবিল ছেড়ে উঠে যাই।
আমার বুক ভেঙে কান্না আসছে। দাদা বলে, ‘পুরুষ মানুষ কান্দে না, যেই পুরুষ মানুষ কান্দে, তারে মানুষ দাম দেয় না।’ কেউ জানে না, আমি কত কাঁদি। কতবার কাঁদি। মাঝে মাঝে কাঁদার ভয়ে হারিয়ে যাই। মনিকা আপা কি এ শহর ছেড়ে চলে যাবে? আমার কাছ থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে? তখন আমার কী হবে? ভাবতে ভাবতে আমার হারিয়ে যাবার সাধ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুপুরের চড়া রোদ উপেক্ষা করে উদ্দেশ্যহীনভাবে শহরের পথ ধরে একা একা হাঁটি, হারাই না। রোদ ঢলে পড়ার সাথে সাথে মনের বিক্ষিপ্ততা কমে আসে।
এখন ফিরোজের সাথে ‘মউবন’ পার্কে বসে আছি। এখানে আমরা দুজন প্রায়ই আসি, পার্ক বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আড্ডা দিই। পার্কটা বেশ জমজমাট। শহরে খোলা আকাশের নিচে বিনোদনের জন্য হাতে গোনা কয়েকটা জায়গার মধ্যে একটা এই পার্ক। অপরিচ্ছন্ন পার্কের বিভিন্ন গাছের নিচে বা সিমেন্টের বেঞ্চে ছেলেমেয়ে দল বেঁধে বা বিচ্ছিন্নভাবে বসে আছে। যারা জোড়া বেঁধে বসেছে, তারা অপেক্ষাকৃত দূরের গাছগুলোর আড়ালে বসেছে। এসব যুগল দেখে তীব্র হতাশায় আমার বুকের ভেতরের শেষ বাতাসটুকু ফুটো হওয়া বেলুনের মতো হুস করে বেরিয়ে যায়। কপর্দকহীন আমি ফিরোজকে বলি,
আমার সাথে পার্কে কেউ আসার নাই রে। খুব শখ আছিল মনিকা আপারে নিয়া একবার পার্কে আসুম। দুইজনে নিরিবিলি সময় কাটামু।
রিস্ক নিছ না। আইজকাল পার্কে বইসা প্রেম করলে পুলিশ ধরে, প্রেমিক-প্রেমিকারে চড়-থাপ্পড় মারে। সবার সামনে দুইজনরে দুইজনের কানে ধইরা ওঠবসও করায়। লোকজন এই সব ভিডিও কইরা ফেইসবুকে ছাইড়া দেয়। বাধ্য হইয়া ভদ্র লোকজন বাড়িত বইসা মোবাইলে প্রেম করে, পরকীয়া করে। তার চেয়ে যা করার বাড়িত বইসা কর। খিকখিক।
আমাকে নিশ্চুপ দেখে ফিরোজের উৎসাহ বেড়ে যায়। সিগারেটের ধোঁয়ার রিং বানাতে বানাতে বলে,
এত দিনেও তো কিছু করতে পারলি না। আরে বলদ, একটু-আধটু দাগ দিতে না পারলে মাইয়ারা ফুড়ুৎ কইরা উইড়া যায়। তাই সুযোগমতো মাইয়াগো শরীরে একটু দাগ ফালায় দিতে হয়।
ফালতু কথা বলিস না। মাইর খাবি।
যা বলতাছি, সত্যিই বলতাছি।
প্যাঁচাল থামা। মনিকারে আমি কোন চোখে দেখি তুই জানোস না?
জানি দেইখাই তো বলতাছি। শোন দোস্ত, মনিকা আপা তোরে খুঁটায় বান্ধা ছাগলের মতো নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইতাছে। তার চেয়ে এক কাম করি চল, একটা মাইক্রো ভাড়া কইরা মনিকা আপারে উঠায় নিয়া আসি। তারপর তুই যা করার করবি, জীবনেও আর কারও নাম মুখে নিবো না…
ফিরোজ ওর কুৎসিত কথাগুলো শেষ করতে পারে না। আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়, বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে আমি। ওর নাকেমুখে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে থাকি। ফিরোজ মার খেয়ে মাটিয়ে গড়িয়ে পড়তেই আমি ওর পেটে-বুকে লাথি মারতে থাকি। ওর নাক-মুখে রক্তের ছোপ দেখেও কোনো ভ্রুক্ষেপ হয় না আমার। আমার মার খেয়ে ফিরোজ এত হকচকিয়ে গেছে যে প্রতিরোধ করার কথা ও ভুলে গেছে।
আমি চমকে উঠি। মনে পড়ে যায়, গতকাল রাতে ঠিক এই স্বপ্নটাই দেখেছি আমি। একটা মাইক্রোবাস গন্তব্যহীন ছুটছে, যার ভেতরে মনিকা ওর বিভ্রান্ত পাখি চোখজোড়া মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহলে কেন আমি ফিরোজকে মারছি? আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা আদিম ইচ্ছের এত নিখুঁত বর্ণনা দিল বলেই কি ফিরোজকে সহ্য হচ্ছে না আমার? ফিরোজকে ফেলে রেখে আমি ছুটতে শুরু করি।
শহরের ধুলো-বাতাস ঠেলে আমি ছুটতে থাকি। ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে সাধুপৌলের গির্জায়। ঘণ্টাধ্বনিতে চাপা পড়ে যায় যানবাহনের কোলাহল। নাগরিক মেঘেরা উঁকি দিয়ে মুচকি হাসে। আর আমি ছুটি। ছুটতে ছুটতে আমার পা ভেঙে আসে, গলা শুকিয়ে যায়। আমি সব উপেক্ষা করে ছুটেই চলি। পিছু পিছু ছুটতে থাকে আমার অবিশ্বাসী ছায়া।
আমি ছুটছি হারিয়ে যাবার নেশায়। যেখানে হারালে আমাকে কেউ কখনো খুঁজে পাবে না, তবু আমাকে খোঁজার জন্য রিকশায় চড়ে আমার বড় ভাই রোকন কাঁপা কাঁপা গলায় পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করবে, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি…