মণিদীপা
মণিদীপা বৃদ্ধা হয়ে গেল। ভাবলে কেমন অদ্ভুত লাগে! চোখ বুজলেই যেন দেখতে পাই, এই তো সেদিন, কটা দিন আগের ঘটনা! মণিদীপা স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে প্রবেশ করল। কী বিপুল জনপ্রিয়তা তখন ওর! ওর চওড়া কাঁধে ঘটিহাতা ব্লাউজ! এখনো চোখে লেগে আছে! সামনে পেছনে ভক্তকুল। আর পোশাক-আশাকেও সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা সাহসী মেয়ে ছিল মণিদীপা। মিনিস্কার্টে ঢাকা নিতম্ব, নিটোল পাযুগল পথচারীদের হৃৎকম্পন বদলে দিতে পারত যেকোনো সময়। পায়ের পায়েল সাথে তাল দিত। সকালবেলায় কলেজ যাবার জন্য যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেত, পুরো পল্লি তখন যেন রথের মেলা! একটা চাপা গর্জন যেন আছড়ে পড়ছে মণিদীপার পদতলে। পল্লির যাবতীয় গাছতলা, শনিমন্দির, মুদির দোকান, চায়ের দোকান সব কেঁপে উঠত। চতুর্দিকে ওর ভক্তকুল। রথের মেলার মতোই। সেই মণিদীপা আজ বৃদ্ধা! দুধের মতো কেশ, নড়বড়ে দাঁত, হাঁটতে গিয়ে বারবার থেমে কোমরে হাত!
মণিদীপা শুড্ডা বনে গেল! কোনো মানে হয়? এই তো সেদিন, কটা দিন আগের কথা। মণিদীপা স্কুল ছেড়ে কলেজে ভিড়ল। কী বাজার তখন ওর! মণিদীপার কাঁধটা চওড়া ছিল, স্লিভলেস পরলে মারকাটারি। সামনে-পেছনে পাড়া-বেপাড়ার চ্যাংড়া বাহিনী। আর ড্রেসও দিত কিছু। খুল্লামখুল্লা। মিনিস্কার্ট ফাটিয়ে পাছার গোলাকৃতি সেপ, নির্লোম লেগপিস দুটো নেমে এসেছে কিং সলোমনস মাইন থেকে। একটা পায়ে চেন। সকালবেলায় কলেজ যাবার জন্য যখন বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেত, পুরো পাড়াটা তখন সল্টলেক স্টেডিয়াম। একটা চাপা গর্জন চারপাশে। যেন ডার্বি ম্যাচের দুটো টিম মাঠে নামছে! ছাদ-বারান্দা-রোয়াক-চায়ের দোকান-ল্যাম্পপোস্টের তলা সব নড়েচড়ে বসত। চার্দ্দিকে ওর আশিকি! সেই মণিদীপাও শালা বুড়ো হয়ে গেল! যেই মণিদীপা বাসে উঠলে লেডিস সিট খালি না থাকলে ছেলে থেকে বুড়ো সক্কলে সিট ছেড়ে দিত! আর এখন? পাবলিক বিরক্ত হয়। বলে, এসব বুড়োহাবড়ার দল কেন যে বেরোয়!… খিকখিক।
মণিদীপা শুড্ডা বনে গেল! কোনো মানে হয়? এই তো সেদিন, কটা দিন আগের কথা। মণিদীপা স্কুল ছেড়ে কলেজে ভিড়ল। কী বাজার তখন ওর! মণিদীপার কাঁধটা চওড়া ছিল, স্লিভলেস পরলে মারকাটারি। সামনে-পেছনে পাড়া-বেপাড়ার চ্যাংড়া বাহিনী। আর ড্রেসও দিত কিছু। খুল্লামখুল্লা। মিনিস্কার্ট ফাটিয়ে পাছার গোলাকৃতি সেপ, নির্লোম লেগপিস দুটো নেমে এসেছে কিং সলোমনস মাইন থেকে।
আমিও ওর বয়সী। সুন্দরী যুবতী দেখলে এখনো আমার তেমন করে, যা বিশ বছর আগেও করত। কিন্তু মণিদীপা কেমন হয়ে গেল! প্রতিদিন প্রভাতে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোয় ও। একদিন দেখা হতে বললাম, আগে তো দেখিনি, হঠাৎ এই বয়সে?
ও বিরস বদনে বলল, সুগার, ডাক্তার বলেছে হাঁটতে।
আমি বিষণ্ন হেসে বলি, সে ডাক্তার আর নতুন কী বলেছে! বরাবরই তো সবাই বলে তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।
মণিদীপার চোখে বিরক্তি, থামো তো, এসব রঙ্গ-রসিকতার কি বয়স আছে আর?
আমি আবার বলি, তখন তোমাকে মিস ক্যালকাটা বলা হতো কলেজে।
মণিদীপা এসব স্মৃতিচারণায় বিরক্ত হয়। ও হনহন করে হাঁটতে থাকে সুগার ছড়াতে ছড়াতে।
আমিও ওর বয়সী। ঝক্কাস মেয়ে দেখলে এখনো আমার তেমন করে, যা বিশ বছর আগেও করত। কিন্তু মণিদীপা কেমন ম্যাদা মেরে গেল! সকালবেলায় রোজ মর্নিং ওয়াকে যায় ও। দেখা হতে একদিন বললাম, আগে তো করতিস না, এখন হঠাৎ পেলেয়ার হচ্চিস কেন?
ও ব্যাজার মুখে বলল, সুগার হয়েচে, ডাক্তার হাঁটতে বলেচে।
ডাক্তার আর নতুন কী বলেচে! তোর তো ফুল বডিটাই সন্দেশ বলা হতো।
মণিদীপা খেপে গেল, থাম তো, বুড়ো বয়েসে ঝাঁটের কথা মারাস না। ওই বয়সে সব মেয়েরই অমন সুগার, হনি হয়।
তবে তুই তো আমাদের মিস ক্যাম্পাস ছিলিস।
মণিদীপা এসব বাতেল্লায় রস পায় না। ও হনহন করে হাঁটতে থাকে সুগার ছড়াতে ছড়াতে।
মণিদীপা হয়তো কোনো দিন বুঝতেও পারেনি যে ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। বোঝার কথাও না। কোনো দিন তো ওর সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করিনি। সত্যি বলতে দুর্বলতা প্রকাশের সুযোগই পাইনি। কেউ না কেউ সব সময়ই তো ওর সাথে জুড়ে থাকত। আমি তাদের নখের যোগ্য ছিলাম না। কলেজের ফার্স্টবয়, কলেজ ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন, এমনকি নতুন আসা বাংলার স্যার অবধি! মণিদীপা যে আমায় বন্ধুর মর্যাদা দিত, তাতেই আমি ধন্য ছিলাম। দূর থেকে ওকে চেয়ে চেয়ে দেখতুম, ওর হাসি, কথা বলা, ঠোঁট ফোলানো, গালে টোল পড়া, ঘাড় ঘোরানো… এসব আরও কত কী।
কলেজ ছুটির পর ও রোজই কারও বাইক বা গাড়িতে করে বাড়ি ফিরত। বাইকে উঠে চালকের কাঁধে হাত রেখে যখন ঘাড় ঘুরিয়ে বলত, ‘চলি রে’, তখন বুকের কোণে একটা ব্যথা অনুভব করতাম। একটা অসহায়তা কাজ করত। হীনম্মন্যতার শিকার হতাম। ঘেন্না হতো নিজেকে।
কলেজ শেষের পর ভেবেছিলাম এবার যদি কিছু হয়। কারণ, তখন যোগাযোগগুলো কমে যেতে থাকে। হচ্ছিলও তাই। আমরা দুজনে একসাথে গোলপার্কে স্পোকেন ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হলাম। একসাথে যেতাম। ফেরার পথে সরোবরে চক্কর। কিন্তু বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা বেশি দিন থাকে নাকি! পার্কের চেয়ারে বসে মণিদীপা জানিয়েছিল ওর বিয়ের খবর। এক বহুজাতিক কম্পানির চাকুরের সাথে। সেদিন রাতে খুব কেঁদেছিলাম। ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম। বরের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ও। রাজপুত্তুর পাত্র। বিয়ের কিছুদিন পর ওরা বিদেশে চলে গেল।
কলেজ ছুটির পর ও রোজই কারও বাইক বা গাড়িতে করে বাড়ি ফিরত। বাইকে উঠে চালকের কাঁধে হাত রেখে যখন ঘাড় ঘুরিয়ে বলত, ‘চলি রে’, তখন বুকের কোণে একটা ব্যথা অনুভব করতাম। একটা অসহায়তা কাজ করত। হীনম্মন্যতার শিকার হতাম। ঘেন্না হতো নিজেকে।
মণিদীপা কোনো দিন আন্দাজ লাগাতেও পারেনি যে আমি ওর ওপর ফিদা হয়ে গেছিলাম। বুঝবেই বা কীভাবে! ওর সামনে তো সেয়ানা মাড়াতাম। তা ছাড়া বোঝানোর কোনো মওকাই পাইনি। সাথে তো সব সময় এক পিস পোস্টার হয়ে থাকত। আর সেসব কি এমনি-ওমনি পোস্টার! এক সে বড়কর এক।
মণিদীপা যে আমায় চামচা কাম দোস্ত ভাব তো, তাতেই আমি উদ্ধার হয়ে গেছিলাম। দূর থেকে ঝাড়ি করতাম ওকে। ওর ছমকছল্লো নখড়া থেকে থ্রিনটথ্রি হাসি- সব ঝাড়ি করতাম।
কলেজ ছুটির পর ও রোজ কোনো না কোনো বাইকওয়ালা আশিক জুটিয়ে নিত। তারপর সেই বাইকওয়ালাকে সাপটে ধরে আমাদের টা টা করে চলে যেত। তখন মনটা পুরো আওয়ারা হয়ে যেত। নিজেকে কেমন ঝাট পাবলিক মনে হতো তখন।
কলেজ খাতা বিদেয় দেবার পর ভাবলাম এবার যদি কিছু হয়। কারণ, কলেজ লাইফের পর সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে পরে, কনট্যাক্টগুলো চুলকে যায়। আর আমি তো ওর এলাকার ছেলে। ওর মাকে আমি মাসিমা বলি। মণিদীপা গোলপার্কে ইংলিশ শেখায় নাম লেখাল। আমিও লেখালাম। একসাথে যাতায়াত। কখনো লেকে চক্কর। এটা-ওটা কথা। ঠিক করলাম, একদিন বলেই দেব আই লাভ ইউ। তখন ও কারোর সাথে জুড়ে নেই, সিট খালি। কিন্তু কপালের নাম কাপালিক, সুযোগ পেলেই খাঁড়ার ঘা। সেদিন বাপের ঝেড়ে ওকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলাম। খেতে খেতে আনমনা মণিদীপা জানাল ওর বিয়ের খবর। এক বহুজাতিক লালুর সাথে। শাল্লা, আইসক্রিমের ইনভেস্টটাই বেকার হয়ে গেল। বিয়েতে গেছিলাম। বরের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ও। ফটাফট ইংলিশ ঝাড়ল মালটা। কিছুদিন পরই ওরা ফরেন চলে গেল। সত্যি! কপাল করে জন্মেছিল মণিদীপা।
মণিদীপার প্রতি আমার দুর্বলতার খবর যেসব বন্ধু জানত, তারা বলত যে আমি একবার বলে দেখলাম না কেন? আসলে আমি ভিতু ও হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। এত বছর ধরে আমি এসব নিয়ে অনেক ভেবেছি। না, আমার নিজেকে কখনই ভিতু বা হীনমনা মনে হয়নি। তখন আমি যেটা করেছি, সেটা ঠিকই ছিল। মণিদীপা যে প্রকৃতির মেয়ে ছিল, তাতে ও কখনোই আমায় গ্রহণ করত না, বরং আমি ওর কাছে উপহাসের পাত্র হতাম। ওর অনুরাগীদের মতো আমি রূপ, গুণ, অর্থ, ক্ষমতা কিছুরই মালিক ছিলাম না। আর মণিদীপা আর ওর পরিবার এসবেরই পূজারি ছিল।
আমি ওকে ভালোবাসতাম। বিয়ে করিনি। সবাই তাতে আমায় গাধা বলতে পারে, বলুক। আমি কী আমি তো জানি।