কোথায় নদী, কোথায় জল
আমার বাড়ির পাশে কোনো নদী নেই। নেই সবুজ মাঠ। ফলের বাগান। সরষেখেত। মাটির কোমল রাস্তা কিংবা এক পুকুর মাছ। নেই গোয়ালঘর। বিচলির গাদা। গোবরলেপা উঠোন। আম-কলার বাগান পেরিয়ে সুপারিগাছের সারি। মৌমাছির চাক। বাড়ি ফেরার ধানি জমির আল ধরা রাস্তা। শিমুলগাছ। আমার বাড়িটা যেখানে, সেখানে নেই কোনো জোয়ার-ভাটা। উজান-স্রোত। নেই কোনো বাঁশের চার। নদী পারাপারের মাঝি। নেই দিন-রাতের ফারাক !
তবু সকাল হয়। তবু প্রতিদিনের মতোই জেগে উঠি। জেগে ওঠে আমার শরীর। যখন ঘুম ভাঙে, সোজা বিছানা ছেড়ে চলে যাই জানালার কাছে। কাচের জানালা পেরিয়ে চোখ রাখি হাইওয়ের দিকে। আমার বাড়ির পাশে মস্ত একটা হাইওয়ে। যার দৈর্ঘ-প্রস্থ আমার জানা নেই। শুধু জানি, হাইওয়েটা চব্বিশ ঘণ্টাই দৌড়াচ্ছে। এ মাথা থেকে ও মাথা। ক্লান্তিহীন, অনবরত। কোথায় যাচ্ছে, কোথায় ফিরছে- ভাবতে গিয়ে মাঝেমধ্যে শরীরটা গুলিয়ে আসে আমার। বমি পায়। বাথরুমে গিয়ে ভেতর থেকে সবটা বের করে দিই। শরীরের সমস্ত কষ্ট যেন বেরিয়ে যায়। প্রবল কষ্টের পর কিছুটা স্বস্তি অপেক্ষা করে। আমি শান্ত হই। আবার ফিরে আসি বিছানায়। শরীরটা বিশ্রামের জন্য আবদার করে।
আমি কী সুখে আছি ?
আমার এই ঘরজুড়ে এখন তো সবকিছুই আছে ! চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ। এসি। পানীয় জল। টেলিফোন ও ইন্টারনেট। বিপদে-আপদে সিকিউরিটি। সিসিটিভির নজরদারি। ওপর-নিচ ওঠা-নামার লিফট। আর হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাওয়ার জন্য চার চাকার আধুনিক যান।
আমি মাঝেমধ্যেই ইচ্ছে-অনিচ্ছায় ছুটে বেড়াই। কখনো কখনো আবার কে যেন আমায় ছোটায়। গাড়ি থামাতে বলি। শক্ত পায়ে ব্রেক কষে ড্রাইভার। ফিরে আসি বিছানার দিকে। গেটে দারোয়ান স্যালুট ঠোকে। গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আমার শরীর লিফট বেয়ে নিচ থেকে ওপরে ওঠে। সবচেয়ে ওপরের তলায় গিয়ে থামে। কলাপসিবল গেট, তারপর আরও দুটো দরজা পেরিয়ে আমি ঢুকে যাই বিছানার কাছাকাছি। বিছানার সঙ্গে আমার শরীরের গোপন প্রেম হয়।
এই আমিকে আপনারা যেমন দেখছেন, আদতে আমি এমনটা ছিলাম না। নিউটাউনের এই বহুতল আবাসনে আসবার আগপর্যন্ত আমার জগৎ ছিল অন্য। আমার প্রেমও ছিল আলাদা।
তবু সকাল হয়। তবু প্রতিদিনের মতোই জেগে উঠি। জেগে ওঠে আমার শরীর। যখন ঘুম ভাঙে, সোজা বিছানা ছেড়ে চলে যাই জানালার কাছে। কাচের জানালা পেরিয়ে চোখ রাখি হাইওয়ের দিকে। আমার বাড়ির পাশে মস্ত একটা হাইওয়ে। যার দৈর্ঘ-প্রস্থ আমার জানা নেই। শুধু জানি, হাইওয়েটা চব্বিশ ঘণ্টাই দৌড়াচ্ছে। এ মাথা থেকে ও মাথা। ক্লান্তিহীন, অনবরত। কোথায় যাচ্ছে, কোথায় ফিরছে- ভাবতে গিয়ে মাঝেমধ্যে শরীরটা গুলিয়ে আসে আমার। বমি পায়।
তখন আমার বাড়ির পাশে একটা নদী ছিল। ছিল একটা ঘাট। বিকেলবেলা ঘাটের পাশে বসে নদীর চলাফেরা দেখতাম। দেখতাম, অনবরত নদীর জলে কীভাবে বাতাস মিশে যায়। আছড়ে পড়ে ঘাটে। ধাক্কা দেয়। জল-বাতাস মিশে নদী বয়ে যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম। সেই জলে কত কিছু ভেসে যায়। ভেসে যায় কত জীবন। মাঝেমধ্যে নদীর জল বাড়লে পাড় ভাঙতে শুরু করে। তখন সন্ধের মুখে, ঝুপ করে দিনের আলো নিভে গেলে, কান পেতে শুনতে থাকি নদীর সেই পাড় ভাঙার শব্দ।
সেই নদীর ওপাশে ছিল সরষেখেত। পাশে খেজুরগাছ আর সুপারির সারি। তার মধ্যে দিয়েই দুটো তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। আমি মস্ত শিমুলগাছটা পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকতাম। বাপ-ঠাকুরদার আমলের ওই গাছটাই তো আমাদের ডালপালা ছড়িয়ে বুকে আগলে রেখেছিল। আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকে ছিল গোয়ালঘর, পাশেই বিচলির গাদা। একপাশে পুকুরজুড়ে হাঁসের দল সকাল-সন্ধ্যা প্যাঁকপ্যাঁক শব্দে খেলা করত। কেউ কেউ সেই জলে জাল ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করত। আমাদের গোবরলেপা উঠোন পেরিয়ে গঞ্জে যাওয়ার রাস্তাটায় উঠতে হতো। রাস্তা বলতে মাঠ, সুপারিবাগান আর খালের পাড় ধরে সাত মাইল দূরের গঞ্জ। বর্ষায় একহাঁটু কাদা-জল ভাঙা ছিল নিয়মিত অভ্যেস।
সেই কাদা-জলের মানুষ আমি। আমার শৈশব-কৈশোর সবকিছু সেই কাদা-মাটি-জল আর নদীতেই মাখা ছিল। নিউটাউনের হাইওয়ে তখনো আবিষ্কার হয়নি। তৈরি হয়নি আমার ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ির নকশা। ধু ধু মাঠটা তখন শুধুই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষার তারা গুনছিল।
এক মধ্যদুপুরে সেই নদীর ঘাটে হঠাৎ করেই তিনি নামলেন। মাঝবয়সী চেহারা। মুখে উষ্কখুষ্ক দাড়ি। পরনে লুঙ্গি আর খদ্দরের জামা। হাতে একটা টিনের বাক্স। এত দিন যাদের নদীর ঘাটে নামতে দেখেছি, তাদের থেকে এই মানুষটির চেহারা একটু আলাদা। কেমন যেন জৌলুশহীন। শুধু চোখ দুটো ছিল উজ্জ্বল।
নৌকা থেকে নেমে লোকটি সোজা আমার দিকেই এগিয়ে আসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, জীবন মাস্টারের বাড়ি চেনো হে খোকা ? জীবন মাস্টার ?
আমি মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ, চিনব না কেন ? উনি তো আমার বাবা।’
ও, তুমিই তাহলে বর্ণময়। তুমি আমাকে চিনতে পারছ ? আমি তোমার পরিমল কাকা।’
অবাক হলাম। এ নামের কাউকে তো আমি চিনি না। কোনো দিন তো দেখিনি! কৌতূহলী হলাম। বললাম, আসুন আমার সঙ্গে।’
তখন আমার বাড়ির পাশে একটা নদী ছিল। ছিল একটা ঘাট। বিকেলবেলা ঘাটের পাশে বসে নদীর চলাফেরা দেখতাম। দেখতাম, অনবরত নদীর জলে কীভাবে বাতাস মিশে যায়। আছড়ে পড়ে ঘাটে। ধাক্কা দেয়। জল-বাতাস মিশে নদী বয়ে যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম। সেই জলে কত কিছু ভেসে যায়। ভেসে যায় কত জীবন।
লোকটিকে নিয়ে এলাম আমাদের বাড়িতে। দেখলাম রান্নাঘর থেকে মা দৌড়ে এলেন। বাবাও গোয়ালঘর থেকে ছুটে এলেন। সবাই ওকে চেনে। মা লোকটির পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। বাবা ওর হাতের বাক্সটা নামিয়ে রেখে মাদুর বিছিয়ে বসতে দিলেন।
দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসে ওর মুখে সেই প্রথম শুনলাম, দেশের অবস্থা নাকি ভালো না। চারদিকে গোলমাল শুরু হয়েছে। বাড়ি পুড়ছে, মানুষ পুড়ছে। সবাই নাকি দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সেই প্রথম মায়ের চোখে জল দেখলাম। বাবাও কেমন যেন বিচলিত হয়ে উঠলেন।
খাওয়া শেষে পরিমল কাকাই আমাকে আদর করে ডেকে নিলেন কাছে। টিনের বাক্স থেকে বের করে আনলেন রহস্যে মোড়ানো সেই যন্ত্রটা। নব ঘুরিয়ে সেটা চালু করলেন। তারপর আমার কানের কাছে এনে ধরলেন। এক অলৌকিক ক্ষমতায় ভেতর থেকে ভেসে এল শব্দ। আমি বিস্ময়ভরে শুনলাম কীভাবে সেই যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে শব্দ। ঠিক যেন নদীর জলে বাতাস খেলে যাওয়ার মতো। কী বিস্ময় ! সেই থেকে সারাটা দিন, সারাটা রাত, এমনকি পরিমল কাকা চলে যাবার পরও আমার সে বিস্ময় কাটেনি।
তারপর কত কিছু ঘটে গেল। আমি আমার ছোটবেলার দেশ ছেড়ে কত দূরে চলে এলাম। আমার জানলাজুড়ে এখন খোলা আকাশ, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তার সীমারেখা। যত দূর চোখ যায়, শুধু জমাট বাঁধা মেঘ। আর নিচে এলোমেলো ধু ধু প্রান্তর। যেন জ্যৈষ্ঠের রোদে সব পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমার চারপাশে কোনো জল নেই। কোনো নদী নেই।
মাঝেমধ্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় ছুটে যাই নদীর খোঁজে। জলের খোঁজে। আমার চারচাকা দৌড় লাগায়। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে যাই। কিন্তু কোথায় নদী, কোথায় জল ? ড্রাইভারকে ধমক লাগাই। গাড়িটা কি ভুল রাস্তায় ঢুকিয়েছে সে ? দাঁড়াতে বলি। দরজা খুলে নেমে যাই সামনের দিকে। হাঁটতে শুরু করি।
কিছুটা যেতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দেখি সামনে একটা নদী দাঁড়িয়ে। কিন্তু জল কোথায় ? এত শুকনো, মরা নদী !
পাশ থেকে শব্দটা ভেসে আসে। ভীষণ পরিচিত। সেই আশ্চর্য যন্ত্রটি থেকে বেরিয়ে আসা শব্দের মতো। আমার মনের মধ্যে ঢেউ খেলে যায়। মনে হয়, জল-বাতাস মিশে একটা পাক খেয়ে গেল কোথাও।
দেখি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে সেই পরিমল কাকা। শুধু নদী নেই। জল নেই।