:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
স্মৃতি ভদ্র

গল্পকার

উত্তরালয়

উত্তরালয়

হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তটা নিল সুনয়না। সিদ্ধান্তটি নেবার পর থেকেই নিজেকে খুব ভারহীন মনে হওয়া শুরু হয়েছে। যাদের জিনিস, তাদের বুঝিয়ে দেবার সময় এসেছে এবার।

বিকেলের দিকে পশ্চিম বারান্দায় আঁচহীন রোদ। কমলা রংঘেঁষা সেই রং পেয়ারাগাছের ছায়া এনে বারান্দায় নকশা আঁকে। সুনয়না প্রতিদিন নিয়ম করে সেই নকশায় মন ডুবায়। পেয়ারাগাছের সেই ছায়া তার কোলের ওপর ঠায় পড়ে রয়। ঠিক বাধ্য শিশুর মতো। সুনয়না চুপচাপ সেই ছায়া কোলে নিয়ে  বসে থাকে অনেকটা সময়। এর মধ্যে আকাশের রং বদলায়। গনগনে আগুনে হলুদ থেকে কাঠকয়লার লালচে হলুদ। এরপর কালচে লাল। সেই রঙে সুনয়নার ঘিয়ে রঙের ছোট বুটির মাড়হীন শাড়িটাও লাল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ছায়াটা একটু ম্লান আর লম্বা হয়ে বুক ছোঁয়। তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে সুনয়না। ঘরের এক কোণে নিখিলের বসানো ঠাকুরের আসন। চিরকালই নিখিল ঠাকুর দেবতার বড় ভক্ত। নিত্যসেবা নিয়ে নিখিলের আড়ম্বর সব সময় সুনয়নার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। ভক্তি থাকে মনে, তা নিয়ে এত আড়ম্বর আয়োজনে বিশ্বাসী নয় সে। তাই সকাল-সন্ধ্যায় দুহাত কপালে ঠেকিয়েই সন্তুষ্ট থাকত সুনয়না।

কিন্তু গত চার মাসে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। তার মধ্যে অন্যতম হলো নিয়ম করে নিত্যসেবা ঠাকুরের। সকাল-সন্ধ্যা ঠাকুরের আসনের সামনে ঘণ্টাখানেক সময় করে বসে থাকা। আর তারও আগে চন্দনের সুগন্ধি মেশানো সাবানে স্নান করা। গতকাল ঠিক এই সময় বা এর কয়েক মিনিট আগে যখন বাথরুমে জলের কল একঘেয়ে সুর তুলেছিল, হাত পিছলে চন্দন সাবানটা দু-একবার পড়ে গিয়েছিল, বাথরুমের বাতাসে চন্দন সুবাস ম-ম করছিল, তখন সুনয়না সিদ্ধান্তটা নিয়ে খুব ভাবছিল। এমনটা তো হবারই কথা ছিল। তবে তা কি খুব তাড়াতাড়ি হলো, না কি ঠিক সময়েই হলো, তা নিয়েই দ্বন্দ্বটা মনের ভেতর কুটকুট করছিল। এরপর পরই ঠান্ডা জলে গা ধুতে ধুতে সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলে। এখন আর কোনো দ্বন্দ্ব নেই মনে। একবার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে তা ঠিক না ভুল, তা নিয়ে কোনোকালেই ভাবে না সুনয়না। আর ভাবে না বলেই নিখিলকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এককাপড়ে বাবা-মাকে ছেড়ে চলে আসতে পেরেছিল। শুধু চলেই আসেনি, বাবা-মা দ্বারা পরিত্যাজ্য হয়েও নিখিলের সাথে জীবন উপভোগ করে গেছে শতভাগ। ঘরে প্রাচুর্যের কমতি ছিল। কিন্তু সুখের কমতি ছিল না। থাকবে কীভাবে? সুনয়না সব সময় বিশ্বাস করত, সুখ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়; উপহারে পাওয়া যায় না।

সন্ধ্যা আরতি শেষ করে আজ খুব একটা সময় ঠাকুরের সামনে বসে রইল না সুনয়না। অকশন থেকে কয়েক বছর আগে নিখিলের কেনা বনেদি ঘড়িটা ঢং ঢং শব্দে জানিয়ে দিল শুভর আসার সময় হয়ে গেছে। নিচের রান্নাঘর আর বসার ঘরের মাঝে অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল। সে জায়গাতে চারপাশে গ্রিল দিয়ে ঘিরে খাবারের জায়গা করে নিয়েছিল সুনয়না। সেখানে তূর্য ঘ্যানঘ্যান করছে মায়ের সাথে। প্রতিদিনের মতো আজও হোমওয়ার্ক করতে চাইছে না। নিজের ঘরে ডিম বাতি জ্বালিয়ে নিচে নেমে আসে সুনয়না। তূর্য একবার তাকিয়ে তাকে দেখে আবার সেই একই সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে।

‘শুভ এসেছে?’ সুনয়নার প্রশ্নে তনু মুখ ফিরিয়ে একবার তাকায়। এরপর ছোট্ট করে ‘না’ বলে আবার ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

‘তূর্য, গ্লাসের দুধটুকু তাড়াতাড়ি শেষ করো। পড়তে বসতে হবে। আজ অনেক হোমওয়ার্ক আছে।” তনুর গলার স্বরে মেকী ব্যস্ততা। তা সুনয়না জানে। সেই শুরু থেকেই তনু এড়িয়ে যায় তাকে।

‘তূর্য, মা যা বলছে শোনো।” ব্যস  সুনয়নার এটুকু কথাতেই তূর্য  সুড়সুড় করে দুধের গ্লাসের কাছে চলে যায়। সুনয়নার এই ব্যক্তিত্বটাই তনুকে আড়ষ্ট করে রাখে সব সময়। একটা অদৃশ্য দেয়াল দেখতে পায় দুজনের মাঝে। সে দেয়াল অতিক্রম করে কখনো তনু সুনয়ার কাছে যেতে পারে না। তাই ওদের সম্পর্কে কোনো উষ্ণতাও আসে না।

সদ্য ষাটে পা দেওয়া সুনয়না জীবনভর ছেড়ে এসেছে অনেক কিছু। সেই শৈশবে ছেড়েছে প্রিয় গোলাপি ফ্রক ছোট বোনের জন্য। এরপর সেই ছোট বোনসহ বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছে নিখিলকে ভালোবেসে। কোনো এক শ্রাবণের রাতে ঘুমন্ত সুনয়নাকে চিরতরে ছাড়তে হয়েছে নিখিলকে। কিন্তু আজ পেয়ারাগাছের ছায়াটুকু ছাড়তে কেন কষ্ট হচ্ছে সুনয়নার? নাকি এই ছায়া ঘিরে থাকা অজস্র স্মৃতি আগলে দিচ্ছে সুনয়নার পথ আজ।

বসার ঘরে গিয়ে সুনয়না ল্যান্ড ফোনটা তুলে কানে ধরতেই বুঝতে পারে ওটা ডেড। হবেই বা না কেন? ল্যান্ড ফোন তো এ সময় ঘরে সাজিয়ে রাখা শোপিস। সবার হাতেই এখন মোবাইল ফোন। কেউ আর ল্যান্ড ফোনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তবে সুনয়না বেশ প্রাচীনপন্থী। নতুন কিছু আপন করে নিতে অনেক সময় লাগে। ঝুমকি অনেকবার বলেছিল একটা মোবাইল ফোন নিতে। তাহলে অন্তত প্রতিদিন মায়ের সাথে কথা বলতে পারত। সুনয়না রাজি হয়নি। আর দরকারই বা কী প্রতিদিন কথা বলার? যেকোনো সম্পর্কেই কিছুটা দূরত্ব রাখা ভালো। এখন ঝুমকির সাথে কথা বলতেই ফোনের কাছে এসেছিল। অর্পণকে বলে দিবে ঝুমকিকে ফোন করতে। অর্পণের ঘরের দিকে তাকায় সুনয়না। ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে টিভির মৃদূ আওয়াজ ভেসে আসছে। ঋতুও ফিরেছে মনে হয়। ওদের ঘরে এখন যাওয়া ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারে না। ঋতু অবশ্য খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। একই সাথে রূপবতী। ছোট ছেলে অর্পণের জন্য সুনয়না নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছে ঋতুকে। তবে সুনয়নার সেই যে গুটিয়ে রাখা স্বভাবটা, যা ঋতুকেও বেশ দূরে সরিয়ে রাখে। তবে তনুর মতো শীতল নয় ঋতু। অন্তত দেখলে ‘মামণি’ বলে এগিয়ে আসে।

অর্পণের ঘর থেকে টিভির মৃদু আওয়াজে সুনয়না বোঝে ক্রিকেট খেলা চলছে। একটা সময় ছিল। যখন বাইরে থেকে ফিরে এই বসার ঘরেই সবাই আসর বসাত। আর ক্রিকেট খেলা থাকলে তো নিখিলের বন্ধুরাও এসে হাজির হতো। হাই ভলিউমে টিভি চালিয়ে নিখিল সবাইকে নিয়ে তুমুল আড্ডা দিত। কখনো কখনো খেলার সাথে রাজনীতি মিশিয়ে আড্ডা হয়ে উঠত উত্তপ্ত। আজ সেই বসার ঘর একটি বছর পাঁচেক পুরোনো টিউব লাইটের আলোয় ধুঁকছে। আর টিভিটা প্রায় দুই মাস হলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।

কপালের বাম পাশটা চিনচিন করে উঠতেই সুনয়নার খেয়াল হলো সন্ধ্যার চা-টা খায়নি। রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল সুনয়না। তনু ওখান থেকে বেরিয়ে এল। একসময় তনু চা করে দিতে চাইত। কিন্তু রাজি হতো না সুনয়না। এতটুকু কাজ সুনয়না নিজেই করতে চায়। কিন্তু তনুর মনে হয় ইচ্ছা করেই এটা করে সুনয়না। ভাবে ওকে দূরে রাখার এটা একটা কৌশল।

তনু বের হয়ে যেতেই সুনয়না তাড়াহুড়ো শুরু করে। অল্প জল আঁচে বসায়। তাড়াতাড়ি হবার জন্য। বেশিক্ষণ রান্নাঘর আটকে রাখতে চায় না সুনয়না। তনু বা ঋতুর এ সময় অনেক কাজ থাকে রান্নাঘরে। ঋতু তো সারা দিন পর এই সময়ই রান্না করতে আসে। ওকে দেখলে আসবে না। সুনয়না বিরক্ত হবে এই ভেবে। আর রান্না করতে দেরি হলে সব সেরে ঘুমাতেও ওদের দেরি হয়ে যাবে। অর্পণের অফিস বেশ দূর। সকালে উঠতে হয়। ওদের কোনো সমস্যা হোক নিজের জন্য কখনো চায় না সুনয়না। চা বানিয়ে ওপরে যাবার সিঁড়ির কাছে আসতেই সুনয়না শুভকে ঢুকতে দেখে।

‘বাবু ফিরলি?’

‘হ্যাঁ’ হালকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে শুভ বলে।

‘রাতে একবার আসিস আমার ঘরে। কথা আছে।’

আর দাঁড়ায় না করে সুনয়না। ওপরে চলে যায়।

কেন রাতে শুভকে ঘরে ডাকল, তার কিছুটা আন্দাজ করতে পারে শুভ। তবে আন্দাজ যে ভুল হবার সম্ভাবনা নেই, তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। মাকে খুব বেশি বুঝতে পারে না শুভ। তার চিন্তাভাবনা সব সময়ই বেশ ব্যতিক্রম। এই বয়সী সবাই যখন শুধুই নিজের সংসার আর ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত, তখন সুনয়না ঘরে সাহিত্য আসর বসায়। সারা দুপুর বই পড়ে। আর সবচেয়ে অস্বস্তি হয় যখন দীপেন পাল নামে বাবার বন্ধুর সাথে মা হুটহাট বেরিয়ে যায়। এ নিয়ে বাড়ির সবাই কানাঘুঁষো করে। কিন্তু সুনয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবে সে সাহস নেই কারও।

আজ নিউজ আর টক শো দেখার জন্য বরাদ্দ সময়টুকু বিসর্জন দেয় শুভ। তূর্যর হোমওয়ার্ক তাড়াতাড়ি চেক করে নেয়। রুটি আর এক বাটি সবজি খুঁটিয়ে খাবার পরিবর্তে গপাগপ খায়। সিগারেট জ্বালিয়ে শানবাঁধানো উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ঘার উঁচিয়ে ওপরের ঘরের দিকে দেখে। ডিম আলো জ্বলছে। রবীন্দ্রসংগীতের মৃদু সুর ভেসে আসছে। কান খাড়া করে গানটা বোঝার চেষ্টা করে।

‘আমারে তুমি অশেষ করেছ

এমনি লীলা তবো…’

গানটা ঝুমকি খুব ভালো গাইত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবা বারান্দার ইজিচেয়ারে বসত। ঝুমকি মাদুর পেড়ে বসে দরাজ গলায় এই গানটা গাইত। সবাই বলত ঝুমকি একদিন খুব বড় গায়িকা হবে। কিন্তু হলো কই? ঝুমকি এখন বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায়। শুধু স্কুলে নয়, বাড়িতেও ব্যাচ করে পড়ায়। ও চাইলে ব্যাচ করে গান শেখাতেও পারত। কিন্তু তা করেনি। আর কেন করেনি, সে উত্তর শুভরা জানে না।

এ বাড়ির সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল মেয়ে ঝুমকি। কিন্তু এখন খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। পাশের পাড়ার নবর সাথে যেদিন পালিয়ে গেল ঝুমকি, সেদিনই বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হলো। মা অনেক চেষ্টা আর সেবা দিয়ে বাবাকে সেবার সুস্থ করে তুলল। বছরখানেক ঝুমকি এ বাড়িতে আসেনি। বাবা কোনো এক পূজায় নিজে গিয়ে ঝুমকি আর নবকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। তবে মা আর কখনোই ঝুমকির সাথে খুব স্বাভাবিক হতে পারেনি। শুভ যখন এসব ভাবছে, তখন এ বাড়ি থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে দুই কামরার একটি পুরোনো ফ্ল্যাটে ঝুমকি রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত।

‘ঝুমকি, ঝুমকি।’

এত আস্তে ডাকায় কাজ হয় না। এবার গলা ফাটিয়ে ডাকে নবীন ওরফে নব।

‘এ্যাই ঝুমকি, ডেকে ডেকে গলা শুকিয়ে ফেললাম। তোমার বুদ্ধি কম জানতাম। এখন দেখছি কানেও খাটো। প্রতিবন্ধী একটা।’

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো হজম করে ঝুমকি। এই হজম করাটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। জীবনে চরম ব্যর্থ এই নব নামের লোকটি। তার সমস্ত না পারার ক্ষোভ উগরানোর জায়গা হলো এই ঝুমকি।

‘ও বাড়ির খবর কী?’ নব কিসের খবর জানতে চায়, তা বুঝেই খুব বিরক্ত হয় ঝুমকি।

‘আমি কোনো খবর জানি না।’

ঝুমকির নির্লিপ্ততা দেখে আরও রাগ হয় নবর।

‘তা জানবে কেন…’

নব গজরাতে থাকে। ঝুমকি তা প্রায় অবহেলা করেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এসব নিত্যদিনের কাজ নবর। আরেকটু পরই ছাত্ররা পড়তে চলে আসবে। রান্নাঘরের কাজ শেষ হয়নি এখনো। এখন ও বাড়ির কথা ভাবার সময় নেই। আর শেষ কয়েক মাস ও বাড়ির প্রতি সব আগ্রহও হারিয়ে গেছে। মা কখনো ওদের বিয়েটা মন থেকে মেনে নেয়নি। বাবা মারা যাবার পর ঝুমকি চেষ্টা করেছিল মায়ের কাছাকাছি যাবার। ফোনে প্রতিদিন কথাও বলতে চাইত। কিন্তু সুনয়নার সেই গুটিয়ে রাখা অভ্যাসটা সব সময় মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে। বা বলা যায় সুনয়না ইচ্ছে করেই গুটিয়ে থেকেছে। ঝুমকির জীবনের সিদ্ধান্ত যতই অপছন্দ হোক সুনয়নার তবু চেয়েছে তার ভার ঝুমকি একাই বহন করুক। যেমনটা সুনয়না নিজে করেছে। সেই একুশ বছরে মা-বাবাকে ছেড়ে আসার পর আর কখনো দেখতে পায়নি। বা বলা যায় সেভাবে সুনয়না চেষ্টাও করেনি। সুনয়না বিশ্বাস করে, যেকোনো সিদ্ধান্তের দায়ভারের পুরোটা তার কর্তাকেই বহন করতে হয়। তাই ঝুমকির বিয়ে নিয়েও সব সময় শীতল থেকেছে সুনয়না।

নব গজরাতে থাকে। ঝুমকি তা প্রায় অবহেলা করেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এসব নিত্যদিনের কাজ নবর। আরেকটু পরই ছাত্ররা পড়তে চলে আসবে। রান্নাঘরের কাজ শেষ হয়নি এখনো। এখন ও বাড়ির কথা ভাবার সময় নেই। আর শেষ কয়েক মাস ও বাড়ির প্রতি সব আগ্রহও হারিয়ে গেছে। মা কখনো ওদের বিয়েটা মন থেকে মেনে নেয়নি। বাবা মারা যাবার পর ঝুমকি চেষ্টা করেছিল মায়ের কাছাকাছি যাবার। ফোনে প্রতিদিন কথাও বলতে চাইত। কিন্তু সুনয়নার সেই গুটিয়ে রাখা অভ্যাসটা সব সময় মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে।

নিজের প্রতি মাকে এমন শীতল দেখে ঝুমকির খুব অস্বস্তি লাগে। ও বাড়ির সব ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে পারে না। তবে নবর খুব সম্প্রতি ও বাড়ির প্রতি যে আগ্রহ, তা শুধুই বাবা মারা যাওয়াতে তৈরি হয়েছে, তা খুব ভালো করে বোঝে ঝুমকি।

সিগারেট শেষ করে ওপরে আসে শুভ। সুনয়নার ঘরের ভেজানো দরজার ওপাশে এসে দাঁড়ায়। পায়ের আওয়াজে বুঝে যায় সুনয়না।

‘আয়।’

শুভ যখন ভেতরে আসে, তখনো ডিম বাতি জ্বালানো।

‘বড় বাতিটা জ্বালিয়ে দে বাবু।’

বেশ আগের ঘোলা হয়ে আসা টিউব বাতির আলোতেও ঘরটা উজ্জ্বল লাগে। নিখিল আর সুনয়না সব সময় ঘর সাজানোয় শৌখিন ছিল। ঘরের মাঝখানে কাঠের একটি বড় খাট। বেডসাইড টেবিলে দুজনের একটি যুগল ছবির স্ট্যান্ড। ঘরের অনেকটা জুড়ে বইয়ের আলমারি। একটি ইজিচেয়ার। সেই চেয়ারেই আধশোয়া হয়ে আছে সুনয়না।

‘কেন আসতে বললে?’

‘ঝুমকিকে খবর পাঠিয়ে দিস বাবু। নবীনকে নিয়ে কাল দুপুরে আসতে বলিস। অর্পণ আর তুইও কাল দুপুরে বাড়িতে থাকিস। তনু আর ঋতুও থাকবে। কথা বলব।’

কী ব্যাপারে কথা বলবে, তা জানার চেষ্টা করা এখন বৃথা। তবু দুরু দুরু বুকে প্রশ্ন করে শুভ,

‘সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তো?’

‘হুম।’

আর কিছু বলে না সুনয়না। উঠে গিয়ে বুকশেলফের কাছে দাঁড়ায়। বইগুলোর ওপর হাত বোলায়। শুভ বুঝতে পারে মায়ের কথা শেষ হয়েছে।

‘তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো,’ বলে শুভ বেরিয়ে যায়।

শুভ জানে না কাল কী হবে? কোন সিদ্ধান্ত আসবে? ওদের জীবনে ঠিক কেমন প্রভাব ফেলবে সেই সিদ্ধান্ত? তবে একটি অস্বস্তি মনের মধ্যে কুটকুট করে।

আর পাঁচটি দিনের মতোই এ বাড়ির আরেকটি দিন শুরু হয়। শুধু সুনয়না আজ অনেকগুলো নৈমিত্তিক কাজ করে না। ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে যায় না। লেবু মেশানো জল খায় না। শুধু স্নান সেরে ঠাকুরের সামনে আজ বসে থাকে অনেকটা সময়।

নিচে বেশ তাড়াহুড়ো চলছে। ঋতু আজ অফিসে যায়নি। সকাল থেকে তনুর সাথে মিলে দুপুরবেলার রান্না শেষ করছে। ব্যাপারটি এ বাড়ির প্রায় নিয়মের মতো হয়ে গিয়েছে। ঝুমকি আর নব এলে এ বাড়ির সবার ভিন্ন ভিন্ন হেঁশেল এক হয়ে যায়। তবে সুনয়নার আলাদা অংশটা বেশ কিছুদিন আর এক হয় না।

ঝুমকিরা দুপুরের আগেই চলে এল। আর তারও বেশ খানিক আগে এল দীপেন পাল। এসেই সোজা গিয়ে বসলেন ওপরের বারান্দায়। দুটো গ্লাসে লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে সুনয়না গিয়ে বসল পাশে। নিচু গলায় বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো তাদের। এরপর সুনয়না ডেকে নিল নিচ থেকে সবাইকে।

এ বাড়ির সবাই বেশ উৎকণ্ঠা নিয়েই এল। দীপেন পালকে দেখে নব কিছু বলতে চাইছিল। হাত চেপে ধরে ঝুমকি থামিয়ে দেয়।

সুনয়না খুব ধীরস্থিরভাবে কথা শুরু করে।

‘তোমাদের খুব বেশি সময় নিব না। আজ আমি যা বলব, সেই সিদ্ধান্ত নিতে আমার বেশ সময় লাগছিল। ভাবছিলাম তাড়াহুড়ো হয়ে যায় কি না। তবে এটা সত্যি, আমি যখনই সিদ্ধান্তটা নিতাম, তখনই আমার কাছে তাড়াহুড়োই মনে হতো। নিখিলের খুব ভালো বন্ধু দীপেন। বলতে গেলে আমারও। আজকের সিদ্ধান্ত নিতে দীপেন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।”

এবার বাড়ির প্রায় সবাই নিঃশব্দে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। এত দিন যা ধারণা ছিল, এবার তা সত্যি বলে মনে হয়। শুধু নব ভ্রু কুঁচকে বাকিটা শোনার অপেক্ষায় সুনয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।

একটু দম নিয়ে সুনয়না আবার শুরু করে।

‘তোমরা সবাই আমাকে খুব সমীহ করো। অনেক কিছু সরাসরি বলো না। তবে আমি সব বুঝতে পারি।’

তনু এবার মুখটা নামিয়ে নেয়। দীপেন পালের যখন-তখন আসা নিয়ে এ বাড়িতে ও সবার প্রথমে আপত্তি করেছিল।

সুনয়না বলে চলেছে।

‘আমি সবদিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে সবার ভালোই হবে। যদিও নিখিলের ইচ্ছাকেই আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।”

শুভকে উসখুস করতে দেখে সুনয়না একটু থামে। শুভকে কথা বলার সুযোগ দেয়।

‘বাবাও এমন চাইত? তুমি আগে থেকেই জানতে?’

‘তোমাদের বাবা আমাকে সরাসরি কখনো বলেনি। তবে দীপেনকে প্রায়ই বলত নাকি। যা-ই হোক, আমি আর সময় নষ্ট করব না। তোমাদের অনেক কাজ পড়ে আছে। এই বাড়ি তোমাদের তিন ভাইবোনের। আমি সব সময় চেয়েছি তোমরা মিলেমিশে একই ছাদের নিচে থাকো। কিন্তু সময় বদলেছে। জীবন নিয়ে তোমাদের ভাবনাও বদলেছে। তোমাদের সকলের পৃথক পৃথক ক্ষুদ্র গণ্ডি তৈরি হয়েছে বা করেছ। তোমাদের গণ্ডির ক্ষুদ্রতা নিখিল আগেই বুঝতে পেরেছিল। শুধু আমিই বুঝতে চাইতাম না। দিপেন যখন নিখিলের ইচ্ছেটা আমায় বলল, আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।’

‘বাবার ইচ্ছেটা কী?’ অর্পণ মৃদুস্বরে বলে।

‘তোমাদের সকলের নিজস্ব পৃথিবী। সকলের একান্ত আর ছোট পৃথিবী। যেখানে কপাটের আগল তুলে দিলেই তোমরা সবাই স্বতন্ত্র। আমি বৃথায় চেষ্টা করেছি ছাদটা এক রাখতে। যখন সন্ধ্যা হলেই এ বাড়ির প্রতিটা বন্ধ ঘরের দরজার এপাশে টুকরো টুকরো আঁধার জমাট বেঁধে থাকত। তখনই আমার বুঝতে পারা উচিত ছিল। তবে এখন বুঝতে পেরেছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়িটা কোনো প্রমোটারকে দিয়ে দিব। এক ছাদ ভেঙে অনেকগুলো ছাদ বানিয়ে দিব তোমাদের জন্য।’

‘তোমাদের সকলের নিজস্ব পৃথিবী। সকলের একান্ত আর ছোট পৃথিবী। যেখানে কপাটের আগল তুলে দিলেই তোমরা সবাই স্বতন্ত্র। আমি বৃথায় চেষ্টা করেছি ছাদটা এক রাখতে। যখন সন্ধ্যা হলেই এ বাড়ির প্রতিটা বন্ধ ঘরের দরজার এপাশে টুকরো টুকরো আঁধার জমাট বেঁধে থাকত। তখনই আমার বুঝতে পারা উচিত ছিল। তবে এখন বুঝতে পেরেছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়িটা কোনো প্রমোটারকে দিয়ে দিব। এক ছাদ ভেঙে অনেকগুলো ছাদ বানিয়ে দিব তোমাদের জন্য।’

লজ্জায় শুভর মাথা হেট হয়ে আসে। কী ভেবে আসছিল এত দিন! মাকে কীভাবে সবাই মিলে ভুল বুঝল? শুভ আর অর্পণ দুজনে প্রায়ই এ বাড়ি নিয়ে কথা বলত। সবার পরিবার বড় হচ্ছে। সবাই প্রাইভেসি চায়। তাই বাড়িটা প্রমোটারকে দিলে একসাথে মোটা টাকা আর বড় ফ্ল্যাট পাওয়া যেত। ঝুমকির আর্থিক অবস্থা ভালো না।  একসাথে বেশকিছু টাকা আর ফ্ল্যাট পেলে ওদের খুব ভালো হতো। আর বাবা মারা যাবার পরপরই নব এ কথা শুভকে বলেও ছিল।

মা ওদের নিয়েই ভেবেছে এত দিন। কিন্তু একবারের জন্যও ওরা বুঝতে পারেনি মাকে, মায়ের চাওয়াকে। বরং দীপেন পালের এ বাড়িতে আসা বেড়ে যাওয়ায় বিরক্তি বেড়েছিল সবার।

সুনয়না এবার সবাইকে নিজের কাজে যেতে বলে। দীপেনও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

সুনয়না একা এসে বারান্দায় বসে। কোলের ওপর পেয়ারাগাছের ছায়া এসে পড়ে।

খুব অল্প সময়েই প্রমোটার ঠিক করে ফেলে শুভ। সাত কাঠার এই বাড়ির বিনিময়ে এ বাড়ির তিন ছেলেমেয়ে দুটি করে ফ্ল্যাট পাবে আর পাবে বেশ মোটা ক্যাশ। সুনয়নাও পাবে একটি ফ্ল্যাট। খুব একটা ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই সবকিছু সমাধা হয়ে যায়।

এবার কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হবে। শুভ আর অর্পণ মিলে আপাতত থাকার জন্য বাসা ভাড়া করেছে। সুনয়নাকেও যেতে হবে আজ ওদের সাথে। বাড়ির কিছু পুরোনো আর অকেজো আসবাব ফেলে বাকি আসবাব গাড়িতে তোলা হয়েছে।

শুধু ওপরের বারান্দায় এখনো রাখা একটি বেতের চেয়ার। সুনয়না বসে আছে। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। সে আলোয় পেয়ারাগাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে সুনয়নার কোলে। চুপচাপ বসে আছে সুনয়না সেই ছায়া কোলে নিয়ে। শুভ পাশে এসে দাঁড়ায়।

‘মা যেতে হবে এবার।’

তখনো আনমনা সুনয়না। শুভ আবার বলে, ‘মা, চলো।’

শুভর এবারের ডাকটা কাজে দেয়।

‘হুম। আচ্ছা বাবু, ফিরে এসে কি ছায়াটাকে পাব আর?’

সদ্য ষাটে পা দেওয়া সুনয়না জীবনভর ছেড়ে এসেছে অনেক কিছু। সেই শৈশবে ছেড়েছে প্রিয় গোলাপি ফ্রক ছোট বোনের জন্য। এরপর সেই ছোট বোনসহ বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছে নিখিলকে ভালোবেসে। কোনো এক শ্রাবণের রাতে ঘুমন্ত সুনয়নাকে চিরতরে ছাড়তে হয়েছে নিখিলকে। কিন্তু আজ পেয়ারাগাছের ছায়াটুকু ছাড়তে কেন কষ্ট হচ্ছে সুনয়নার? নাকি এই ছায়া ঘিরে থাকা অজস্র স্মৃতি আগলে দিচ্ছে সুনয়নার পথ আজ। এই ছায়াতেই নিখিলের সাথে কবিতার পিঠে কবিতা খেলা। এই ছায়াতেই খেলায় খেলায় বাবুর অ, আ শেখা। আর ঝুমকির সেই আকাশ কাঁপিয়ে গেয়ে ওঠা, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। তাও তো এই ছায়াতেই। সেদিনের তূর্যসোনা। নিখিলকে ঘোড়া বানিয়ে ওর যুদ্ধ জয়, তাও এই ছায়াতেই। এই ছায়া যে এ বাড়ির অন্দরমহলের গল্প জানে। চেনে এ বাড়ির সব আনাচকানাচ। এ বাড়ির শরীরে লেপ্টে থাকা এই ছায়ায় যে বড় মায়া সুনয়নায়।

ম্লান হলুদ রঙের পেয়ারাগাছের ছায়া শরীরে জড়িয়ে মা আর শুভ দাঁড়িয়ে আছে। সময় থমকে গেছে ওদের।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.