কমলা রঙের মৃত্যু
এয়ারপোর্টের এই রেস্তোরাঁর মাফিনের দারুণ সুনাম। ব্লুরেরি মাফিনকে বলা হয় শহরের সেরা মাফিন। চকলেট, দারুচিনি, কফি স্বাদের মাফিন- ওগুলোও বেশ তবে রুপোর মেডেলের কাতারে। আবার শীত যখন একটু একটু করে নামতে শুরু করে, তখন আসে মিষ্টিকুমড়োর মাফিন, সাথে মিষ্টিকুমড়োর কেক, বিস্কুট, লাটে, বেগেল, ক্রিম চিজ। জমে একেবারে কুমড়োর ক্ষীর তখন। শীতে পুরো এয়ারপোর্ট ম-ম করে মিষ্টিকুমড়োর ঘ্রাণে। এমনও লোক আছে, যারা অপেক্ষায় থাকে এই মিষ্টিকুমড়োর মৌসুমের। আর আমরা যারা কুয়াশাডুবানো শীত নিয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভুগি, হাহুতাশ করি ভাপা-চিতইয়ের জন্য, কুমড়োর মাফিন হয়ে ওঠে সান্ত্বনা আমাদের।
এই রেস্তোরাঁর পেটানো শরীরের বুড়ো আলবার্তোকেও লোকে চেনে। বিমানবন্দরের ক্লিনিং সেকশন থেকে শুরু করে রেন্টাল কার, এয়ারলাইনস, সিকিউরিটি, ফিঙ্গার প্রিন্টস, অ্যাডমিন অফিস, রেস্তোরাঁ-দোকানপাটের লোকদের কাছে মাফিনের মতোই আলবার্তো এক পরিচিত নাম। ভিয়েতনামের যুদ্ধে সেই যে নেভিতে যোগ দিয়েছিল, একটানা এগারো বছর কাজ করেছে রান্নাঘরের ডেজার্ট সেকশনে। ও বলে, ‘নেভিতে গিয়ে দুটো জিনিস শিখেছি। এক হলো ইংরেজি গালি আর দুই এই ডেজার্ট বানানো। এত রকম মিষ্টি বানিয়েছি আর খেয়েছি। তখনকার আমাকে দেখলে চিনতেই পারবে না।’
রাত দুটোয় এসে রেস্তোরাঁর কাজ শুরু করে আলবার্তো। রাতে ওঠার অভ্যাস ওর ছেলেবেলা থেকেই। কত অগুনতি মাঝরাত কেটেছে তার খেতের কাদামাটি, ফসলে। বাবা ছিল না। কী করে ছোট্ট ছেলেটা পাঁচ ভাইবোনের বাবা হয়ে উঠেছিল, মাঝেসাঝে সেই সব গল্প করে ও। সফল মানুষের পেছনের ব্যর্থতার গল্প শুনতে আমাদের ভালো লাগে। কষ্টভোগের একটা মহৎ মানে ভেবে নিয়ে আমরা প্রেরণা খুঁজি, বাঁচিয়ে রাখি প্যান্ডোরার বাক্সের একরত্তি আশাটাকে।
দেবদূতের পাখা পড়ে গেলে, গভীর বিষাদে শয়তান কুড়িয়ে নিয়েছিল তার পালক। আজও নাকি শয়তান কোথাও পালক ছড়িয়ে দিলে, সেই পালক থেকে উঠে আসে শয়তানসদৃশ মানুষ। তাই একে একে আমরাও মাফিন কিনতে এসে ভাবি, এত দাম! এই মাফিন তো ফ্রিতেই সকালে হাতে হাতে ঘোরে। এভাবেই আমাদের বুড়ো আলবার্তো হয়ে উঠে মাফিন চোর।
জীবনে এতটা জুঝেছে বলেই বুঝি ও একরোখা। একরোখা তার ভালোবাসা আর ঘৃণা। আলবার্তোর উদারতার ভাগ পেয়েছে এয়ারপোর্টের কম-বেশি সবাই। এই যেমন বৃহস্পতিবার আলবার্তোর ছুটির দিন। গরমের সময়টায় বউকে নিয়ে ও মাছ ধরতে যায়। ভালো মাছ পেলে, পঁয়তাল্লিশ মিনিট ড্রাইভ করে হলেও রেস্তোরাঁয় এসে অ্যাসিস্ট্যান্ট আন্দমানকে দিয়ে যায় বরফে ডুবানো তাজা মাছ। ওর ভালোবাসায় কাতর হয়েছি আমিও! পাজলের টুকরোর মতো মিলে গেছে একদিকে আমার বাবা না থাকা, অন্যদিকে ওর মেয়ে না হওয়া।
বুড়ো মানুষটাকে আর সবার মতো নাম ধরে ডাকতে পারিনি কখনো, স্যার বলি। এইটুকু সম্মানেই ও ভালোবাসায় নুয়ে গেছে বারবার। ভোররাতে হেঁটে কাজে আসি বলে কত যে ভাবনা ওর। প্রায়ই বলে, রাতের এক হাজার চোখ থাকে। আমি চাইলেই
নিশ্চিত ও ঘুরপথে জেনেও আমাকে নিয়ে আসত। অযাচিত উপকার নেওয়া সম্পর্ককে নষ্ট করে। এই ভেবে আমার আর হ্যাঁ বলা হয় না। তবু যখন গর্ভবতী হলাম, পাঁচ রকম ফল বাটিতে করে সকালে দিয়ে যেত। হাসপাতালে দেখতেও এসেছিল কত কিছু নিয়ে। রূপসীর বয়স যেদিন এক শ দিন, আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল ওর দেওয়া লাল রং করা সেদ্ধ ডিম আর লাল জামা নিয়ে। লাল হলো সৌভাগ্যের চিহ্ন। চীনে নাকি ও রকম এক শ দিন উদ্যাপিত হয়।
আলবার্তোর এই উদারতাই একদিন উবে যায় সংকীর্ণতায়। রেস্তোরাঁর কুড়ি পাউন্ড চিনির প্যাকেট চুরি করে ধরা পড়ে আন্দমান। ম্যানেজার জিউস তাকে তক্ষুনি ছাঁটাই করে। আলবার্তো মানতে পারেনি। রেস্তোরাঁর প্রথম দিন থেকেই আন্দমান কাজ করেছে, এখনো ওকে মেয়ে আর নাতির দেখভাল করতে হয়, চাকরির নীতির থেকে ওর কাছে বড় হয়ে যায় আন্দমানের অসহায়ত্ব। এত বছর কাজ করেছে, ওর তো একটা সেকেন্ড চান্স পাওয়ার কথা ছিল, এই ক্ষোভেই তড়পায় আলবার্তো।
তবু আলবার্তো অপেক্ষা করে একদিন সে ঠিক ধরা পড়ে যাবে। আর সেদিনই সে খুন করবে মাদার ফাকার জিউসকে। সেদিন অমৃতপম ব্লুবেরি মাফিনের মতো এয়ারপোর্ট ভরে উঠবে লাশের ঘ্রাণে। হয়তো সেই মুখরোচক ভাবনাতে তড়পাতে থাকে ওর লকারে লুকিয়ে থাকা নিয়তির ছুরিটাও।
আমার তখন সন্দেহ হতো, হয়তো এই চুরির পেছনে আলবার্তোর সায় ছিল। ওর এই মেনে না নেওয়া, ক্ষোভ সেই অপরাধবোধ থেকেই। ডক্টর মারফুর বলে, ‘বুদ্ধির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সন্দেহ করা, প্রশ্ন করা, যাচাই করা।’ হয়তো এ আমার বুদ্ধিমান হওয়ার চেষ্টা নয়, এ আমার একান্তই প্রসূতি-পরবর্তী হতাশা। আমরা তো জানি, আলবার্তোর স্বভাবে বরাবরই থেকে গেছে এক ছেলেমানুষি। হয়তো সেই ছেলেমানুষি থেকেই আলবার্তো আমাকে বলেছিল এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির বাইরে পেলেই ও খুন করবে ওই মাদার ফাকার জিউসকে। তবু একটা শিরশিরে ভয় নামে বুক বরাবর। আমার মনে পড়ে আলবার্তোর লকারে একবার একটা ছুরি আর ছুরি ধার দেওয়ার পাথর দেখেছিলাম। মাথায় গুনগুন করে ওঠে হেডলাইনস, মহামারি আকার ধারণ করেছে নাইফ ক্রাইম, গড়েছে রেকর্ড, বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ, দুই সপ্তাহে বারোটি খুন…
না, ও বোকামি আলবার্তো এখনো করেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় মাংস কষানোর মতোই আলবার্তো একটু একটু করে তাড়িয়ে নিচ্ছে তার রাগ। যেদিন কুড়িটা মাফিন বানালেও চলে, সেদিনও আলবার্তো বানাবে চল্লিশটা। তারপর ম্যানেজার আসার আগেই প্যাকেটে প্যাকেটে গুছিয়ে, বিলিয়ে দেবে পুরো এয়ারপোর্টে। রেস্তোরাঁর ক্ষতি করে এভাবেই ও উদার হয়।
দেবদূতের পাখা পড়ে গেলে, গভীর বিষাদে শয়তান কুড়িয়ে নিয়েছিল তার পালক। আজও নাকি শয়তান কোথাও পালক ছড়িয়ে দিলে, সেই পালক থেকে উঠে আসে শয়তানসদৃশ মানুষ। তাই একে একে আমরাও মাফিন কিনতে এসে ভাবি, এত দাম! এই মাফিন তো ফ্রিতেই সকালে হাতে হাতে ঘোরে। এভাবেই আমাদের বুড়ো আলবার্তো হয়ে উঠে মাফিন চোর। নিজেদের স্বার্থপরতা নিয়ে আমরা আলবার্তোকে চোর বানাই প্রতিটা নতুন সকালে। মনে মনে সান্ত্বনা পাই, তা না হলে আলবার্তোকে খুন করতে হতো।
তবু আলবার্তো অপেক্ষা করে একদিন সে ঠিক ধরা পড়ে যাবে। আর সেদিনই সে খুন করবে মাদার ফাকার জিউসকে। সেদিন অমৃতপম ব্লুবেরি মাফিনের মতো এয়ারপোর্ট ভরে উঠবে লাশের ঘ্রাণে। হয়তো সেই মুখরোচক ভাবনাতে তড়পাতে থাকে ওর লকারে লুকিয়ে থাকা নিয়তির ছুরিটাও।
একদিন উড়ো খবর পাই, রেস্তোরাঁটা বন্ধ হতে যাচ্ছে। আসবে এবার শহরের জমজমাট রেস্তোরাঁ চিক-ফিল-এ। মিষ্টিকুমড়ো নয়, মরা ভাজা মুরগির ঘ্রাণে ভরে উঠবে এবারের শীত।