লিলিবনে গলিত জোছনা
‘ডিয়ার ডায়েরি, ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে। এখনো গা কাঁপছে।’
এই টেক্স্ট ভোর ছয়টা পঁয়তাল্লিশে শ্রীমতির কাছে পাঠিয়েছি আমি। তাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখলে আমি তাকে টেক্স্ট করি। ফোন দিই না। কারণ ফোনে আমার কিছু বলার থাকে না, তারওপর গলা কাঁপে। অবশ্য আমার টেক্স্ট পাওয়ার পর যদি তার কখনো মনে হয় সে ফোন দেয়, জানতে চায় কী স্বপ্ন দেখেছি। একবার সে বাসে বাড়ি যেতে যেতে ফোন দিলো, জানতে চাইলো কী স্বপ্ন দেখেছি। বললাম, ‘স্বপ্নে দেখলাম, তোমার সঙ্গে বাসে করে কোথাও যাচ্ছি।’ শুনে সে হাসলো। তারপর বললো, ‘বাসে যাচ্ছি স্বপ্নে দেখলে কেনো? প্লেনে করে কোথাও যাচ্ছি এমন স্বপ্ন দেখলেই পারতে।’ আমার গলা শুকিয়ে গেলো, ‘বললাম, এমন আর হবে না।’ এই টুকুই কথা।
আজ সকালে শ্রীমতি আমাকে ফোন দিয়েছিলো। সে বললো, ‘দুঃস্বপ্ন দেখলে তোমার সারাদিন খারাপ যায়, তাই ফোন দিলাম।’ সে কী দুঃস্বপ্ন দেখেছি জানতে চাইলো। আমি বললাম, ‘মুখে বলতে পারবো না, তোমাকে লিখে জানাবো।’ তার জন্যেই আসলে এই লেখা।
পর পর দুইটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি ভোর রাতে। ভোর রাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। কিন্তু আমার স্বপ্ন সত্যি হবার নয়। দুঃস্বপ্নের যা বিষয়, তা সাধারণত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে ঘটতে পারে। এখন ভাবছি এই জাতীয় দুঃস্বপ্ন কেনো দেখলাম। কালকে আমার অফিসের কলিগ তুষারভাই জানতে চাইছিলো মানুষ স্বপ্ন কেনো দেখে। আমি বললাম, মানুষের অদমিত বাসনা, ইচ্ছা ইত্যাদি মানুষ যখন ঘুম যায় তখন অচেতনে জেগে থাকে সেটাই আমাদের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় এই যা।
তো আমার দুঃস্বপ্নের দুইটা কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ বিরিয়ানি। গতরাতে বিরিয়ানি খেয়েছি। সাউথ ইন্ডিয়ান একটা সিনেমায় দেখেছি এক প্লেট বিরিয়ানি খাওয়ার পর থেকে নায়ক কেমন করে একের পর এক বিপদ ও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। রেণু অফিসের কাজে পুরান ঢাকা গিয়েছিলো, ফেরার পথে কাচ্চি বিরিয়ানি কিনে এনেছিলো। সেটা খেতে গিয়ে তার সঙ্গে মজাও করলাম। বললাম, ‘পুরান ঢাকার কাচ্চিতে ছাগলের মাংসের সঙ্গে কুকুরের মাংসও মেশানো থাকে, ধরো দুইটা ছাগলে সঙ্গে একটা কুকুর মিশিয়ে দিলো। দেখো না, ঢাকা শহরে এখন কুকুর তেমন দেখা যায় না।’ ইত্যাদি।
দ্বিতীয় কারণ হতে পারে কালকে নতুন করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু বিষয় পড়তে গিয়ে শ্রোডিঞ্জার সাহেবের বিড়ালের বিষয়টা আবারও পড়লাম। এইবারও বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না। বিজ্ঞানের ছাত্র না হলে যা হয় আর কি। প্রথমে একটা বিড়ালকে একটা বাক্সের ভিতর রাখা হয়, একই সঙ্গে রাখা হয় এক শিশি বিষাক্ত গ্যাস। শিশির ওপর এমন শর্ত আরোপ করে দেয়া হয় যে কিছু তেজস্ক্রিয় পরমাণুর ক্ষয় হলেই শুধু এই শিশি থেকে বিষাক্ত গ্যাস বের হবে! এখানে এমন এক অবস্থা যে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর ক্ষয় নিয়ন্ত্রিত হয় কোয়ান্টাম সুপারপজিশন নীতির দ্বারা— হয় তেজস্ক্রিয় পরমাণুটির ক্ষয় ঘটেছে, নয় ঘটেনি। তার মানে বিড়ালটিও পরোক্ষভাবে সুপারপজিশন অবস্থাতে আছে। যতক্ষণ আমরা বাক্সের ভেতর উকি না দেই ততক্ষণ বিড়ালটি জীবিত অথবা মৃত— এই দুই অবস্থার ভিতর থাকে! যখন কেউ বাক্সের ভেতর উকি মারার চেষ্টা করবে তখন সে বিড়ালটিকে সম্ভাব্য দুটি অবস্থার যেকোনো একটির দিকে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ কেউ বাক্সের ভেতর দেখার চেষ্টা না করলে বিড়ালটি চিরদিন জীবিত অথবা মৃত থেকে যায়। তো যায় হোক, আমি এতো বকবক না করে দুঃস্বপ্নের কাহিনি বর্ণনার দিকে যাই।
আজ সকালে শ্রীমতি আমাকে ফোন দিয়েছিলো। সে বললো, ‘দুঃস্বপ্ন দেখলে তোমার সারাদিন খারাপ যায়, তাই ফোন দিলাম।’ সে কী দুঃস্বপ্ন দেখেছি জানতে চাইলো। আমি বললাম, ‘মুখে বলতে পারবো না, তোমাকে লিখে জানাবো।’ তার জন্যেই আসলে এই লেখা।
পর পর দুইটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি ভোর রাতে। ভোর রাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। কিন্তু আমার স্বপ্ন সত্যি হবার নয়। দুঃস্বপ্নের যা বিষয়, তা সাধারণত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে ঘটতে পারে। এখন ভাবছি এই জাতীয় দুঃস্বপ্ন কেনো দেখলাম।
খিজির নামে হাই ইশকুলে আমার এক বন্ধু ছিলো। হেডস্যারের ছেলে। একটু টিংটিঙে লম্বা, সামনের দুইটা দাঁত উচা; তবে খুবই রূপবান।স্যাররা মধ্যে মধ্যে তাকে খোয়াজ খিজির ডাকতো। প্রথম দুঃস্বপ্নটা আমি তাকে নিয়েই দেখলাম। দেখলাম, আমাদের শহরের নিউ মার্কেটের সিঁড়িতে খিজিরের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেলো সহসা সন্ধ্যায়। ধরা যাক কুড়ি বছর পর। সেটাও সমস্যা না, নামধাম চেহারা সবই ঠিক আছে, কেবল বাস্তবে আমার ইশকুলের বন্ধু খিজির ছিলো একটা ছেলে, আর স্বপ্নের ভিতর যার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো সে হচ্ছে একটা মেয়ে, খুবই রূপবতী। আমাকে দেখেই আমার শার্টের আস্তিন ধরে টান দিলো, ‘অ্যাই, তুমি নয়ন না?’
‘হুঁ।’
‘খবর-টবর নাই। কুড়িবছর তো হলো, তাই না?’
খিজির যে একটা ছেলে ছিলো তা স্বপ্নের ভিতর আমার মনে পড়লো না।আমি বললাম, ‘তাই তো! কুড়ি বছর তো হবেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে গত কালকেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।’
‘না তো! আমাদের গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার…।’
জীবনদাশের কবিতার লাইনটা বলে খিজির থামলো। তারপর বললো, ‘কই যাও, নয়ন?’
‘দোতলায়, রজনীগন্ধা রেস্তোরাঁয়।’
‘আমিও তো, চলো তবে এক সঙ্গেই যাই।’
‘চলো যাই।’
আমি আর খিজির রেস্তোরাঁর কোনার একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম।বসার আগে খেয়াল করিনি যে টেবিলটাকে পর্দা টেনে আড়াল করা যায়। তো, কথা বলতে বলতে খিজির একসময় পর্দা টেনে দিলো, আর সে আমার গা ঘেঁষে বসলো। আমার কেমন যেনো অস্বস্তি হতে লাগলো। খিজির তার বামহাতের মুঠোর মধ্যে আমার ডান হাতটা নিলো। বললো, আমি যে তোমাকে ভালোবাসতাম, ‘তা কি তুমি জানতে?’
আমি কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সে উড়না সরিয়ে আমার ডান হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। আমি চমকে উঠলাম, একী! তার বুক স্তনহীন। সে বুঝতে পারলো আমার চমকে ওঠার বিষয়টা। সে বললো, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে যে এক তুমুল যুদ্ধ হলো, ওরা পরমাণু বোমা ফেললো। তার তেজস্ক্রিয়তায় এখানকার অনেক মানুষ শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যকৃৎ, কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস হারিয়েছে। আমারও একই অবস্থা…’
‘মানে?’
‘মানে অপারেশনের পর আমার বুকে আর স্তন গজায়নি।আসল কিডনি, ফুসফুস সব ফেলে দিয়ে আর্টিফিশিয়াল সব বসানো হয়েছে। কেবল কেমন করে যেনো হৃৎপিণ্ডটা বেঁচে গেছে, ওই হৃৎপিণ্ডের ভিতর যে হৃদয়, ওইখানে তোমার জন্যে ভালোবাসা এখনো আছে।’
আমি কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সে উড়না সরিয়ে আমার ডান হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। আমি চমকে উঠলাম, একী! তার বুক স্তনহীন। সে বুঝতে পারলো আমার চমকে ওঠার বিষয়টা। সে বললো, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে যে এক তুমুল যুদ্ধ হলো, ওরা পরমাণু বোমা ফেললো। তার তেজস্ক্রিয়তায় এখানকার অনেক মানুষ শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যকৃৎ, কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস হারিয়েছে। আমারও একই অবস্থা…’
খিজির আমার বাম হাতটা টেনে নিয়ে এইবার তার উরুতে রাখলো। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং হলো।সমস্ত অন্ধকার। খিজির আমার কোলে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আমার গা গোলাচ্ছিলো কেনো বুঝতে পারছিলাম না, আর নিঃসাড় লাগছিলো। আমি চোখ বন্ধ করলাম। খানিকপর বুঝতে পারলাম পেছন থেকে কেউ আমার কাঁধ ধরে ঝাকাচ্ছে, আর সমানে তারস্বরে চিৎকার করছে। কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখ মেলে দেখলাম বিদ্যুৎ চলে এসেছে। খিজির তখনো আমার কোলে বসে গলা জড়িয়ে আছে, মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আমার ঘাড় ধরে ঝাকাচ্ছে আমার বড়ভাইয়ের শাশুড়ি, সঙ্গে তার বেশ কটা ছেলে মেয়ে, মেয়ের জামাই। মেয়ের জামাই আবার ছাগলের মতো দাঁড়ি রেখেছে। সবাই মিলে আমাকে সমানে শাসাচ্ছিলো, ঘরে ওমন লক্ষ্মী বউ থাকতে এইসব কী বেলাল্লাপনা ইত্যাদি।
এক সময় সিনেমার জাম্পকাটের মতো আরেকটা দৃশ্যের ভিতর চলে গেলাম। সেই দৃশ্যে আমি আমার অফিস কলিগদের সঙ্গে অফিসের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি। এক একজন আমাকে আপডেট জানাচ্ছে কোন খবরের কাগজে, কোন নিউজপোর্টালে আমার সম্পর্কে রজনীগন্ধা রেস্তারাঁয় গতকালের ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে কে কী লিখেছে। আমার মতো একজন অভাজনকে নিয়ে এতো মিথ্যা, অমিথ্যা, অর্ধমিথ্যা এতো জায়গায় লেখালেখি হবে আজকের আগে আমি ভাবতেই পারি নাই। আইটির মন্টি এসে আমার হাতে একটা কুড়াল ধরিয়ে দিলো। বললো, ‘নয়নভাই যান, একটা ভাস্কর্য বানিয়ে আসেন।’
সে আমাকে একটা মরা গাছের গুড়ি দেখিয়ে দিলো। কী অদ্ভুত! আমি গাছের গুড়িটার দিকে এগিয়ে যেতে আমার স্বপ্ন ভেঙে গেলো। আমি পাশ ফিরতে গিয়ে খাট থেকে পড়ে গেলাম। আমার গা কাঁপছিলো। আর প্রবল তৃষ্ণা হচ্ছিলো। উঠে লেবু দিয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। তখন রাত তিনটা চল্লিশ। রেণুরও ঘুম ভেঙে গেলো। সে বললো, ‘কী হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘কিছু না। ঘুম যাও।’
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে গেলাম আবার। আর দ্বিতীয় দুঃস্বপ্নটা যেনো আমার রক্তজুড়ে এলো। এই দুঃস্বপ্নটা শ্রীমতিকে নিয়ে। এই স্বপ্নটা ভয়ানক। আমার এখনো গা কাঁপছে। সকালে শ্রীমতি ফোনে বললাম, ‘দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পর আমার গা কাঁপছিলো।মাথা ঘুরছিলো, মনে হয় মাইল্ড স্ট্রোক টাইপের কিছু একটা হয়ে গেছে।’
শ্রীমতি আমাকে অবশ্যই অবশ্যই কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বললো। আমি বললাম, ‘আচ্ছা।’
সে আমাকে একজন নিউরোসার্জনের নামও বললো। নামটা মনে করতে পারছি না। ওই সার্জনের কাছে সে তার হাসব্যান্ডকে নিয়ে গিয়েছিলো কোনোদিন। যাই হোক, দুঃস্বপ্নের কথা বলছিলাম। তো তার জন্যেই আসলে এই লেখা। ভুলে যাওয়ার আগেই লিখে ফেলতে হবে সব।
আমি চোখ খুলেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার চোখের সামনে শ্রীমতির চিরে দুভাগ করা বুক, বুকের ভিতর আলোকিত, উজ্জ্বল আলোতে দেখা যাচ্ছে নকল হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ সব। প্রত্যেকটার গায়ে নাম লেখা, ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট, কোন দেশে বানানো এইসব লেখা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এর আগে দেখা দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো, খিজিরের কথা, যুদ্ধের কথা, পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার কথা ইত্যাদি।
আমার ঘুমের ভিতর, স্বপ্নের ভিতর দুঃস্বপ্নটা এলো। প্রথমে বুঝতে পারিনি এটা দুঃস্বপ্ন। সবুজঘ্রাণে ভরা একটা পাতাবনে হঠাৎ করে আমার শ্রীমতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ছায়া ছায়া সকালবেলা। আমি চাঁপাফুলের ঘ্রাণ পেলাম। শ্রীমতি—সেই হলুদ স্বর্ণ চাঁপার বন, কবেকার অফুরান শ্রীমতি অভিমান। কতো বছর, কতো হাজারবছর পর তার সঙ্গে আমার দেখা হলো জানি না। সে আগের মতোই আকাশ, মাটি আর পাতাল আলো করে হাসলো। আমরা একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম মুখোমুখি। কোথা হতে তার ঘাড়ের ওপর এসে বসলো একটা ডাহুকপাখি, আশেপাশে মনে হয় বিল-ঝিল কিছু আছে। আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ‘ডাকপাখি, ডাকপাখি…।’
সে বললো, ‘ছি! তুমি ডাহুকপাখি চেনো না! এটা তো ডাহুকপাখি, তুমি বলছো ডাকপাখি।’
‘ডাহুকপাখিকেই তো ডাকপাখি বলে।’ আমি হাসলাম।
‘আচ্ছা। তাই?’
‘হয়। ডাকপাখি জানে মাছ তার চোখের পালক কোথাও হারালো…’
‘তারপর?’
আমার মাথা থেকে হুহু করে কবিতার লাইন আসতে লাগলো, ‘মাছের নিষ্পলক চোখে জলের ভাঁজে ঘুম যায়। ডাকপাখি তার ঘুম ভাঙায়। চঞ্চুতে চিরে দেয় ঘুম আর স্বপ্নের মোহর…’
‘আর?’
‘ডাকপাখি আমাদের ভাই। তার হাতে রক্তের দাগ সন্ধ্যাকে কামনা করে। অবিদ্যার ঘরের ভিতর সত্যবতী ছায়া কুয়াশাকে পাহারা দেয়…’
‘আর?’
‘ডাকপাখি তার লিলিবনে গলিত জোছনার ক্লেদ মাখে…’
‘আর?’
‘তার ডানায় লেগে থাকে তিনটা সন্ধ্যাতারা…’
‘আর?’
‘তারার কাঁটা জানে মাছের যন্ত্রণা; জানে অবিদ্যার দ্বীপে দ্বৈপায়নের জন্ম…’
‘আর?’
‘আরো জানে রাত্রির পেটে ক্ষয় হয়ে যাওয়া রতিসন্ধ্যার ধরন…’
শ্রীমতি তন্ময় হয়ে আমার কবিতা শোনে। আমার কবিতা শেষ হয় না। সন্ধ্যা হয়ে আসে। ততক্ষণে ডাকপাখি উড়ে চলে গেছে কোথাও ঝিলের দিকে। শ্রীমতি আমাকে বলে, ‘চোখ বন্ধ করো, নয়ন। তোমাকে একটা জিনিশ দেখাবো।’
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দুচোখ বুজে তার সামনে বেঞ্চির ওপর বাবু হয়ে বসলাম। মিনিটখানেক পর শ্রীমতির কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, সে অস্ফুটে বলে, ‘নয়ন! এইবার চোখ খোলো।’
আমি চোখ খুলেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার চোখের সামনে শ্রীমতির চিরে দুভাগ করা বুক, বুকের ভিতর আলোকিত, উজ্জ্বল আলোতে দেখা যাচ্ছে নকল হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ সব। প্রত্যেকটার গায়ে নাম লেখা, ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট, কোন দেশে বানানো এইসব লেখা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এর আগে দেখা দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো, খিজিরের কথা, যুদ্ধের কথা, পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার কথা ইত্যাদি।
শ্রীমতি বললো, ‘তোমার মনে আছে নয়ন, তুমি অনেক অনেক বছর আগে একদিন আমাকে চিঠিতে লিখেছিলে যে তুমি আমার বুকের ভিতর ঢুকে যেতে চাও…’
আমি বললাম, ‘হুঁ।’
‘আসো, আজকে ঢুকে পড়ো।’
আমার দুচোখ জলে ভরে গেলো। বুক ভেঙে আসছিলো। আমি শুধু অস্ফুটে বলতে পারলাম, ‘না।’