সম্মুখে কৃষ্ণপক্ষ
একটি শীর্ণকায় নদী। নদীর পাড়ে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে একটি প্রাচীন বটগাছ। তার ঠিক লাগোয়া মাটির রাস্তাটি গিয়ে ঠেকেছে একটা স্কুলঘরের সাথে। নাম ‘কিরণ বালা প্রাথমিক বিদ্যালয়’। পুরাতন এই স্কুলটা ঠিক কত পুরাতন তা আন্দাজ করা যায় গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকটির এই স্কুলে পড়া নিয়ে স্মৃতিচারণ শুনে। আরও বোঝা যায় পলেস্তারা খসে পড়া স্কুলঘরের ইটগুলো দেখে। শোনা যায় এই গ্রামের এক ধনী আর সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলেন কিরণ বালা। তার দান করে যাওয়া আবাস পরবর্তীতে স্কুলে রূপান্তরিত হয়েছে। লোক মুখে তাই প্রচলিত।
স্কুলের পাশেই একটি বদ্ধ পুকুর। স্কুলের মাঠ আস্তে আস্তে খেয়ে ফেলছে এক সময়ের ঘাট বাঁধানো বড় এই পুকুরটি। পুকুরের ওপাশেই রাধাদের পাড়া, ঋষি পাড়া। তবে তাকে ঠিক গালভরে পাড়া ডাকতে মন সায় দেয় না। বরং বলা যায় দু’চারটি জীর্ণ ঘরে বাস রাধা আর ওর শরিকদের। এরা সবাই প্রতিদিন নদীর ওপারে বাজারে গিয়ে বসে জুতা সেলাই করতে। প্রতিদিন রাধার বাবা যাবার আগে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার লাগি কি আনুম মা?’ রাধার সেই এক উত্তর একটা সোনা রঙের জুতা। আশ্বিন মাসের বড় পুজা হোক বা অগ্রহায়ণের হরিবাসর রাধা সেই এক আবদারেই অটল থাকে। হাজার রঙের জুতার কারিগর শিবু রোহিদাস তার মেয়ের জন্য এখন পর্যন্ত সোনারঙের জুতা গড়তে পারেন নি।
তবে তা নিয়ে খুব বেশী আক্ষেপ নেই রাধার। শরতে বড় পুজা আসার আগেই যখন ওদের শিউলি গাছটা ফুলে ভরে ওঠে তখন সেই জুতার কথা রাধার মন থেকে হারিয়ে যায়। আবার অগ্রহায়ণে ব্রজহরি সম্প্রদায়ের লীলা কীর্তন করতে করতে আকুল কান্না দেখেও সেই জুতার কথা ভুলে যায় রাধা। তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে সেই সুর।
“কেন গেলাম জল ভরিবারে
যাইতে যমুনা ঘাটে
সেখানে ভুলিলো বাটে
আঁধার গরাসিলো মোরে”
গুনগুন করে গাইতে গাইতে যখন রাধা বাবার পিছে পিছে বাড়ি যায় তখন পুর্ণিমার মতো আলো ছড়ায় রাধা। সে আলোয় অনেকেই অবগাহন করতে চায়। কত কত শুঁয়োপোকা সেই আলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর পাখাবিহীন সেই পোকাগুলো রাঁধার আলোর তেজে পুড়তে থাকে। দূর থেকে সেই শুঁয়োপোকাদের পুড়তে দেখে একটি দু’টি ছায়া গাছের সাথে লেপ্টে যায়। শিবু রোহিদাস একটু পর পর মেয়েকে তাড়া দেয়,’পা চালাতি হবি মা।’ রাধা তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে ফেলে। আর ঠিক তখনি ওর মনে পড়ে সেই সোনারঙের জুতার কথা।
গুনগুন করে গাইতে গাইতে যখন রাধা বাবার পিছে পিছে বাড়ি যায় তখন পুর্ণিমার মতো আলো ছড়ায় রাধা। সে আলোয় অনেকেই অবগাহন করতে চায়। কত কত শুঁয়োপোকা সেই আলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর পাখাবিহীন সেই পোকাগুলো রাঁধার আলোর তেজে পুড়তে থাকে। দূর থেকে সেই শুঁয়োপোকাদের পুড়তে দেখে একটি দু’টি ছায়া গাছের সাথে লেপ্টে যায়। শিবু রোহিদাস একটু পর পর মেয়েকে তাড়া দেয়,’পা চালাতি হবি মা।’ রাধা তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে ফেলে। আর ঠিক তখনি ওর মনে পড়ে সেই সোনারঙের জুতার কথা।
রাধাদের ঘর ঘেঁষা পুকুরটার ওপাশেই স্কুল ঘরটা। স্কুল ঘরের মাঠ আর কিছুদিন পরেই রাধাদের উঠান ছুঁয়ে ফেলবে। এত কাছে স্কুল হলেও রাধা কোনদিন স্কুলে যায়নি। ওদের বাড়ির কেউই স্কুলে যায় না। স্কুল ছুটির পর শুনশান হয়ে যায় জায়গাটা। রাধা তখন গিয়ে মাঠের নাগলিঙ্গম গাছটার নিচে দাঁড়ায়। একটু পরেই তক্ষক ডেকে ওঠে গাছের কোঠর থেকে। রাধা হেসে ওঠে। রাঁধার কোঁচড় থেকে শিউলি ফুলের সুবাস ছড়ায়। দিনের আলো নিভে যায়। জোনাক পোকা আলোর মালা জড়িয়ে দেয় রাধার চুলে। স্কুলের খালি মাঠময় রাঁধা ছুটে বেড়ায়, আলো ছড়ায়। আবার সেই অচেনা ছায়াগুলি মিশে যায় স্কুলঘরের দেয়ালে। রাধার পায়ে এক টুকরো কাঁচ বিঁধে যায়। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। আবার সেই সোনারঙের জুতোর জন্য মন কেমন করে ওঠে রাধার।
এবার বর্ষা আসার আগেই গ্রামের কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হবে। গ্রামের স্কুলটির সরকারিকরণ অনেকদূর এগিয়েছে। স্কুলের পরিসর বড় করতে হবে। এবার স্কুলের মাঠ চলে যাবে রাধার ঘরের ভিতর। সে বড় আনন্দের কথা। কিন্তু রাধার মনে আনন্দ আসে না। শিবু রোহিদাস, লক্ষণ রোহিদাসেরা প্রতিদিন হাতে মেপে আসে স্কুল ঘরের মাঠ আর কতদূর। রাধা ওর সোনারঙের জুতোর কথা ভূলে যায়। সেই তক্ষকের কথা ভুলে যায়। কিন্তু নিয়ম করে আলো ছড়াতে ভোলে না। জোনাকের আলো চুলে জড়াতে ভোলে না।
এরপর একদিন সেই স্কুলের মাঠ পুকুর পেরিয়ে রাধাদের উঠোনে চলে এলো। শিবু রোহিদাস বারবার অনুনয় করে সেই মাঠকে ফিরে যেতে। তার বাড়ির উঠোনে যে তুলসীতলায় তখনো সন্ধ্যা পড়েনি। কিন্তু সে মাঠ বড় জেদি। এক চুলও সে পিছোতে নারাজ। এবার শিবুরাম অনন্যোপায় হয়ে তার উঠোনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালো। আগলে দিলো মাঠের পথ। স্কুলের মাঠ অপমানে আর রাগে শাপশাপান্ত করতে করতে সেই শিউলিতলায় ফিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
ছায়ারা নিজেদের সাথে রাধা কে নিয়ে আবার মিশে যায় স্কুলঘরের দেয়ালে। রাধার রঙ একটু একটু করে ছায়ারা নিয়ে নিতে থাকে। আর ওদিকে স্কুলঘরের মাঠ রাগে উপড়ে ফেলতে থাকে শিউলি গাছটাকে। শিউলি গাছ আর্তনাদ করে কিন্তু শিবুরাম শোনে রাধার আর্তনাদ। সে বড় অদ্ভুত সময়! শিবুরাম শিউলি গাছটা আঁকড়ে ধরে রাখে যেন স্কুলের মাঠ তা উপড়ে ফেলতে না পারে। শিবুরাম সব শক্তি দিয়ে ধরে রাখে গাছ টা,” রাধা তোর কিছু হইবো না রে মা,ভয় পাইস না।”
তুলসীতলায় বাতি দেখিয়ে রাধা শিউলি গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। এই গাছটার জন্য ওর খুব মায়া। এর কাছ থেকেই তো সুবাস নিয়ে কোঁচড়ে ভরে ও। নাগলিঙ্গমের কোঠরে সেই তক্ষক আবার ডেকে ওঠে। রাঁধার আলো ছড়াতে মন চায়। চারপাশ পূর্ণিমার আলোয় ভরে ওঠে। মাঠময় আলো ছড়াতে ছড়াতে প্রজাপতি হয়ে ওঠে রাধা। পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে রঙ ছড়ানোও শিখে ফেলে। সে রঙের নেশায় আকুল হয়ে স্কুলঘরের দেয়াল থেকে তিনটি ছায়া বেরিয়ে আসে। ছড়িয়ে থাকা রঙ মাখতে মাখতে ভাবে রঙসহ আধারটাও ওদের প্রয়োজন।
ছায়ারা নিজেদের সাথে রাধা কে নিয়ে আবার মিশে যায় স্কুলঘরের দেয়ালে। রাধার রঙ একটু একটু করে ছায়ারা নিয়ে নিতে থাকে। আর ওদিকে স্কুলঘরের মাঠ রাগে উপড়ে ফেলতে থাকে শিউলি গাছটাকে। শিউলি গাছ আর্তনাদ করে কিন্তু শিবুরাম শোনে রাধার আর্তনাদ। সে বড় অদ্ভুত সময়! শিবুরাম শিউলি গাছটা আঁকড়ে ধরে রাখে যেন স্কুলের মাঠ তা উপড়ে ফেলতে না পারে। শিবুরাম সব শক্তি দিয়ে ধরে রাখে গাছটা, ”রাধা তোর কিছু হইবো না রে মা, ভয় পাইস না।” শিবুরামের কথা শুনে স্কুল মাঠ অট্টহাসিতে বাতাস কাঁপিয়ে দ্বিগুণ শক্তি দিয়ে গাছটা উপড়াতে থাকে। শিউলি গাছের আর্তনাদে অস্থির হয়ে ওঠে শিবুরাম। ”রাধা মা, রাধা মা” বলে চিৎকার করতে থাকে।
পারে না, শিবুরাম রোহিদাস শিউলি গাছটা বাঁচাতে পারে না। শিকড় উপড়ে গাছটা মাটিতে আছাড় খায়। ব্যর্থ শিবুরাম অসহায়ের মতো পালিয়ে যায়, হারিয়ে যায় সেখান থেকে। এরপর সেই স্কুল মাঠ শিবুরামের উঠান পেরিয়ে রাঁধার ঘরের ভিতর চলে যায়।
সে রাতের পর রাধা সেই গ্রামে আর কখনো পূর্ণিমার আলো ছড়াতে ফিরে আসে না। নাগলিঙ্গমের কোঠর থেকে তক্ষকও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
পাঁচগ্রামের ভিতর সবচেয়ে বড় সেই স্কুলঘরের নাম এখন “আহম্মদ শাহ্ প্রাথমিক বিদ্যালয়”।
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়