সব আলো নিভে গেলে
সন্ধ্যার নদীর অন্যরকম এক ভাষা আছে। আছে জলের ঐকতানে অলৌকিক সুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় সাদা লঞ্চ। জাহাজবাতি আর খালাসির ডাকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকা অগণিত উৎসুক চোখ। সেইসব চোখ আর দৃশ্য আড়াল করে পাটাতনে জলে পা ডুবিয়ে আমরা সূর্যাস্ত দেখছি। কত দ্রুত অস্ত যায়! কত দ্রুত নীরার চুল হয় অন্ধকার। আবছা আলো অন্ধকারে ওকে কতটা অপার্থিব মনে হয়। যেন নীরা এখন অতীতের ঘড়ির কাঁটায় আটকে থাকা প্রিয় কোন দুঃস্বপ্ন। কুয়াশার রেশ কেটে গেলেই ঘর পালানো যন্ত্রণার মতো স্বপ্নে কড়া নাড়বে, বয়ে যাবে ধীরে, বুকের পাশে বয়ে যাওয়া শীতল নদীটার মতো। তবু কী ভেবে আজ হঠাৎ জ্বলে ওঠা লাইট হাউজের মতো সব দুঃস্বপ্ন পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো।
নদীর দিকে তাকিয়ে নীরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে দু’একটা গাঙচিলের অদ্ভুত ওড়াউড়ি।
: জানো প্রতিটা চিলই প্রকৃত নিঃসঙ্গ।
: হুম্মম
: একা, তবু দেখো কী অদ্ভুত কোলাহল।
: তাদেরও গন্তব্য থাকে। তাদের ডানাও ভর করে এক ঝাঁক বুনো সন্ধ্যা।
এটুক বলে নীরার চোখে চিল দেখি। দেখি তার চোখের দূরবর্তী নৌকোয় ভেসে ওঠা ওপারে কুয়াশার স্রোত। আমাদের ঘিরে একঝাঁক সন্ধ্যা হল্লা করে অপূর্ব কোলাহলে। জলে নীরার পায়ের ছলাৎ ছলাৎ, নদীর কল্লোল, চুমুর শব্দ, আর সন্ধ্যার কোলাহল ভেদ করে থেকে বেজে উঠছে লঞ্চের ভেঁপু। একটু পর লঞ্চ ছাড়বে। এবার আমাদেরও উঠতে হবে। দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকাই। একটু একটু করে উঁকি দিয়ে বেড়ে উঠছে চাঁদ। একই চাঁদের আলোয় অগণিত চোখে বাড়ছে গন্তব্যে ফেরার ব্যাকুলতা…
লঞ্চে ফিরে কেবিনের ঘরটাকে খুব ছোট মনে হয়। এত ছোট ঘর নিজেরই অস্বস্তি লাগছে। ইচ্ছে করছে নীরাকে ডেকে বলি— চলো বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখবো।
: না, আকাশ নয়। এই ঘরটাই হোক আমাদের ব্যক্তিগত পৃথিবী। এখানেও আকাশ আছে, নদী আছে…
নীরা কোলে মাথা রেখে তাকায় সম্মোহনের চোখে। আমার ভেতর শুরু হয় প্রচণ্ড অস্থিরতা, ঘোর জাগা চোখে জাগে নদীতে নারী আবিষ্কারের নেশা।
: উউহু! এখন নয়… ঠিক মাঝ নদীতে আবিষ্কার করো নারী!
নীরা কোল ছেড়ে এবার শুয়ে পড়লো বালিশে। ওর দুহাত আমায় টানছে, চোখ ডাকছে জলের নেশায়। জামা খুলে রাখলো বিছানার একপাশে—আসো!
নীল ব্রায়ে নীরাকে সমুদ্র বলে মনে হয়। যেখানে অগাধ জল ভেদ করে পশ্চিমে হাতছানি দেয় জোড়াদ্বীপ। তীর্থযাত্রীর মতো মাথা ঠেকাই সেই দ্বীপে। যেখানে ব্রায়ের হুক খুলে দিতেই উড়াল দেয় একজোড়া সামুদ্রিক কবুতর। উড়ে উড়ে খেলা করছে শৈশবে হারানো খয়েরী মারবেলের মতো নিপল ঘুরে আসে জ্বিবের ডগায়। নীরা আমার বুক ছোঁয়, পশমের জঙ্গলে এঁকে দেয় আদিম চুমু—অস্থির হওয়া যাবেনা.. আরো ধীরে.. আমার ভেতরে আবার জন্মাও…
নীরার ভেতর মেতে উঠি জন্মের নেশায়। নাভীতে নাক ছোঁয়াই। ওর শরীর মোচড় দিয়ে ওঠে ঘুম ভাঙা সাপের মতো। জোয়ার নামে ত্রিবেণী ঘাটে, নিজের জ্বিব ভিজে যায় নোনা স্বাদে। আহা! জন্ম কী তবে নোনা জলে…
লঞ্চের ভেঁপু বাজে আমাদের নিঃশ্বাসে। বাড়ে রাত ঘাম আর ক্লান্তির নোনা স্রোতে…
নীল ব্রায়ে নীরাকে সমুদ্র বলে মনে হয়। যেখানে অগাধ জল ভেদ করে পশ্চিমে হাতছানি দেয় জোড়াদ্বীপ। তীর্থযাত্রীর মতো মাথা ঠেকাই সেই দ্বীপে। যেখানে ব্রায়ের হুক খুলে দিতেই উড়াল দেয় একজোড়া সামুদ্রিক কবুতর। উড়ে উড়ে খেলা করছে শৈশবে হারানো খয়েরী মারবেলের মতো নিপল ঘুরে আসে জ্বিবের ডগায়। নীরা আমার বুক ছোঁয়, পশমের জঙ্গলে এঁকে দেয় আদিম চুমু—অস্থির হওয়া যাবেনা.. আরো ধীরে.. আমার ভেতরে আবার জন্মাও…
ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ভেংগে গেলো। নীরা তখনো ঘুমাচ্ছে। ওর গালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বললাম— উঠতে হবে না? জীবনানন্দের শহরে আমরা চলে এসেছি!
‘উহু’ বলে ঘুমজড়িত কন্ঠে কী যেন বিড়বিড় করলো কিছুক্ষণ। তারপর হাই তুলে উঠলো। ফ্রেশ হয়ে দাঁড়ালো মুখোমুখি।
: কেমন লাগছে আমাকে?
: নদীর ঢেউয়ের মতো।
: না, নারীর মতো! আজ থেকে আমার ভেতর বেড়ে উঠবে অন্য কেউ।
নীরাকে কোন ব্যাপারেই জোর করিনি। ও মা হতে চাচ্ছে, হোক। আমরা একসাথে থাকছি বেশ কয়েকদিন। একসাথে থাকলে যেন বুড়িগঙ্গার বুকে আজ প্রথম আবিষ্কার করলাম অন্য নদী।
লঞ্চ থেকে নেমে সারাদিন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে পরদিন আবার ফিরে আসলাম ঢাকায়। নীরার অফিস। আমার টুকটাক ব্যাস্ততা, সন্ধেবেলায় একটু-আধটু মদ খাওয়া। এসব নিয়ে নীরার কোন অভিযোগ নেই। লিভটুগেদারের মজাটাই এখানে। তুমি স্বাধীন। আমিও। এভাবেই কাটছে কাটুক আমাদের দিন! মন্দ কী! ইচ্ছে হলে কোন রাতে ঘরে ফিরি। কখনো বাইরে কাটিয়ে দিই সারারাত।
এই অসময়ে নীরার ফোন পেয়ে অবাক হলাম। আমার একান্ত নিজের মুহূর্তগুলোতে ও ফোন করে না।
: তোমার কী আজ ফিরতে দেরি হবে?
: নাও ফিরতে পারি নীরা।
নীরা আর কিছু না বলে লাইন কেটে দিলো। বাইরে অসম্ভব কুয়াশা। সারামুখে কুয়াশা মেখে অপেক্ষায় আছি কখন বেজে উঠবে শহরে প্রাচীনতম ঘন্টা, ঘন্টা বাজলেই তখন কাঁটায় কাঁটায় মধ্যরাত। ব্রয়লার মুরগির মতো কুয়াশারা হেঁটে বেড়াচ্ছে চেনা শহরের সব সরু অলিগলি। নীরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। একটা দুটো করে প্রতিদিন বাড়ছে তার ঘুমের ঔষধের পরিমাণ। “শুভরাত্রি আমার বেড়ালছানা” বলে কবে কোন শহরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কোন লেখক অনন্ত নিদ্রায়, সেই শহরে কুয়াশা কী এমন করে হেঁটে বেড়ায়! ব্রয়লার মুরগীর মতো ডানা ঝাপটায়!
এসব নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কথা হয়েছে ঋত্বিকের সাথে। হ্যাঁ, ঋত্বিক কুমার ঘটক! সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অব্দি অনেক মদ খেয়ে হৈ হুল্লোড় করেছি আমরা। কী জানি নতুন একটা সিনেমার গল্প তাকে ভাবাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে আমি আর ঋত্বিক কতোবার যে ট্রাকের নিচে পড়তে যেয়েও উঠে দাঁড়িয়েছি—শালা! মাদার ফাকার!
এই ল্যাম্পপোস্ট মাদার ফাকার! এই শহরের সব কয়টা ট্রাফিক পুলিশ মাদার ফাকার!
: গুড নাইট ঋত্বিক!
: গুড নাইট!
এসব নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কথা হয়েছে ঋত্বিকের সাথে। হ্যাঁ, ঋত্বিক কুমার ঘটক! সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অব্দি অনেক মদ খেয়ে হৈ হুল্লোড় করেছি আমরা। কী জানি নতুন একটা সিনেমার গল্প তাকে ভাবাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে আমি আর ঋত্বিক কতোবার যে ট্রাকের নিচে পড়তে যেয়েও উঠে দাঁড়িয়েছি—শালা! মাদার ফাকার!
টলোমলো পায়ে কলিংবেল চাপতেই নীরা দরজা খুললো। ওর চোখ মুখ ফুলে অসম্ভব লাল হয়ে আছে।
: কী ঘুম হয়নি?
: ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।
আর কথা না বাড়িয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলাম। যতোটুকু দাঁড়িয়ে শব্দ করে পেশাব করলে অভদ্রতার চুড়ান্তে পোঁছা যায়, মনে হলো তার চেয়ে বেশী শব্দ করে পেশাব করছি আর অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে গালি দিচ্ছি—মাদার ফাকার!
নীরা ওয়াশরুমের দরজায় নক করে গামছাটা বাড়িয়ে দিলো। অনেকক্ষণ শাওয়ার নেয়ার পর মনে হলো অতটা অভদ্রতা করা ঠিক হয়নি।
নীরা নাস্তার টেবিলে বসে আসে। আজ শুক্রবার। নীরার অফিস বন্ধ। আগের জবটা ও ছেড়ে দিয়েছে। নতুন অফিসের সহকর্মীরা নাকি অনেক ভালো। এসব ভালো মন্দের হিসেব নিকেশ আমি বুঝি না।
নাস্তার টেবিলে ওর মুখোমুখি বসলাম। নীরা কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন বলতে পারছে না।
: কিছু বলবে নীরা?
: তমাকে তো জানো। আমার ক্লাসমেট। সন্ধ্যায় এখানে আসবে। আজ আমাদের বাসায় থাকতে চায়।
: তাতে কী! আসুক ও।
: মানে বলছিলাম কি! আজ রাতে বাইরে না গেলে হয় না?
বলতে যেয়ে নীরা সংকোচ লুকাতে পারলো না। আমি চাই ও অধিকার খাটাক। আমিতো ওকে ভালোবাসি। শ্রদ্ধা করি। ওকে কিছু না বলে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম আজ আর বাইরে যাব না।
ড্রইং ডাইনিং মিলিয়ে আমাদের মোট তিনটে ঘর। একই ছাদের নিচে থাকলেও আমি আর নীরা আলাদা ঘরে থাকছি বহুদিন। তমা এলে আমার ঘরটাই ছেড়ে দিতে হবে ওকে। রাতটা হয়তো বারান্দায় কাটাতে হবে আমাকে। আপাতত ছোট্ট একটা ঘুম দেয়া দরকার। নিজের ঘরে যেয়ে দেখি অন্যদিনের মতো বেশ গোছালো পরিপাটি বিছানা। দেরি না করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গলো সেই সন্ধ্যায় মসজিদে মাইকের আওয়াজে।
তমা এখনো আসেনি। চটপট বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসলাম। নীরার রুমের পাশেই বারান্দা। বাইরে সন্ধ্যার রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর ক্রমশ। দুই পেগ ভদকায় বাইরের পৃথিবীটাও যেন বারান্দার খুব কাছে এসে স্থির হয়। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে নীরা আর তমার টুকটাক কথার শব্দ। সেইদিকে আমার মন নেই। গাঁজায় রোল করে জয়েন্ট জ্বালাতেই মনে হলো এবার পৃথিবীটা হাসছে। হাসছে বারান্দায় আমাদের দ্বিমুখী জীবন। বেঁচে থাকার নামই কি জীবন? জগৎটা কি আসলেই বাচ্চাদের খেলনা? হিপোক্রেট হিপোক্রেট খেলা! নীরাও কি তাই! হয়তো আমিও!
ঘন্টা বাজলেই তখন কাঁটায় কাঁটায় মধ্যরাত। ব্রয়লার মুরগির মতো কুয়াশারা হেঁটে বেড়াচ্ছে চেনা শহরের সব সরু অলিগলি। নীরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। একটা দুটো করে প্রতিদিন বাড়ছে তার ঘুমের ঔষধের পরিমাণ। “শুভরাত্রি আমার বেড়ালছানা” বলে কবে কোন শহরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কোন লেখক অনন্ত নিদ্রায়, সেই শহরে কুয়াশা কী এমন করে হেঁটে বেড়ায়! ব্রয়লার মুরগীর মতো ডানা ঝাপটায়!
জয়েন্ট শেষ হতেই রাত একেবারে শান্ত হয়ে মুখোমুখি বসে আমার। মাঝে মাঝে জেগে ওঠে ঘুম ভাঙ্গা স্বপ্নের মতো গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া যাবতীয় সব দৃশ্য। নীরার এবরশন, অফিসে সিনিয়রের হাতে ওর রেপ হওয়ার দৃশ্য সব ভেসে উঠছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মতো… নীরার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা, বাথরুম, ওকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি…
তখনো জানতাম না কিছুই। এবরশনের পর ও নিজেই জানালো বেবীটার বাবা আমি নই। সুযোগ বুঝে ওকে ধর্ষণ করেছে ওরই সিনিয়র। পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যখন নিশ্চিত হলো বেবী এসেছে, তখনই আয়োজন করে নদীতে আমাকে দিয়ে আবিষ্কার করালো নারী!
সেদিনও অবাক হইনি। বেবীটারতো কোন অপরাধ নেই। নিজের না হোক, ও তো আমার ভালোবাসার সন্তান ছিলো!
কিন্তু নীরাই পারেনি আমার সাথে স্বাভাবিক হতে। সারাক্ষণ ওকে তাড়া করে বেড়ায় অদ্ভুত এক অপরাধবোধ। তাই বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছি আমরা আলাদা ঘর।
ও অপরাধবোধে ভোগে এটা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। ওর তো কোন দোষ নেই। আবার রাত দুপুরে অনেক মদ খেয়ে যখন ঘরে ফিরি সেটাও ওকে যন্ত্রণা দেয়, বেশ বুঝি।
এখন ঠিক কয়টা বাজছে জানি না। শেষ পেগ গিলে ঝিম হয়ে বসে আছি। ল্যাম্পপোস্টের আলোটা খুব চোখ পোড়াচ্ছে। বারান্দার আলোটাও অসহ্য লাগছে। টলোমলো পায়ে বাতি নিভাতে ইচ্ছে করছে না। পাশের ঘরে নীরা আর তমার কথার শব্দ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বাড়ছে উত্তুরে হাওয়া। এর মধ্যে নীরা কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে রাতে খাবো কিনা জিজ্ঞেস করে গেল। মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম খেতে ইচ্ছে করছে না। নীরা চলে যাওয়ার পর দেয়ালে তখনো বাজছে তার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। পাশের ফ্লাটে শিল্পী বৌদির বাচ্চাটা একটু পর পর কেঁদে উঠছে টিকার যন্ত্রণায়। কী যেন নাম? কী যেন নাম বাচ্চাটার!
প্রতিটা হাতের আলাদা কিছু শব্দ থাকে। বেড রুমের দরজা বন্ধ করার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটাও আমার পরিচিত। অনেকক্ষণ পর্যন্ত ও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। নীরার শরীরের মিষ্টি গন্ধটা বারবার জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্বের। অথচ ঘুরে ফিরে ওর শরীরের গন্ধটা কেবলই মিশে যাচ্ছে মদের গ্লাসে। নীরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছে সব।
: আসো এবার ঘুমাবে। আমি ফ্লোরে শোব।
আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। থাকি না আরো কিছুক্ষণ ঝিম মেরে। নীরা ঠিক একইভাবে তাকিয়ে আছে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো। তার ভেতরেও উঠছে দূরত্বের ঝড়।
: কী হলো? ঘুমাবে না?
: বারান্দার বাতিটা নিভিয়ে দাও না, খুব চোখে লাগছে।
নীরা সুইচড অফ করলো। নেমে আসলো বারান্দায় এক টুকরো অন্ধকার।
“এবার উঠো, ঘুমাবে” বলে নীরা ঘুরে দাঁড়ালো। টলোমলো পায়ে দাঁড়ালাম ও মুখোমুখি।
: নীরা?
নিজের কন্ঠে নিজেই অবাক হলাম বহুদিন পর। ও “হু” বলে একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওর খোলাচুল সারা মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঝড় শেষে এলোমেলো নগরীর মতো। চোখের নিচে ছোট্ট অন্ধকার।
: একটু কাছে আসো না।
নীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে এসে দাঁড়ায়। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুহাতে গালের চুলগুলো সরিয়ে দিই কানের পাশে। নীরা কেঁপে ওঠে ভূমিকম্পের মতো।
: কেন এমন করো! আমি তোমাকে ভালোবাসি নীরা।
এখন আর কোন কথা নয়। নীরা নিজেকে সামলাতে যেয়েও ঠিক সামলাতে পারে না।আমার উস্কোখুস্কো চুল অনেকটা খামচে ধরে টেনে নেয় বুকের কাছে-আমিও যে আর পারছি না!
নীরা এখন কাঁদছে। দূর কোথাও থেকে ভেসে আসা নদীর ঢেউয়ের মতো। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে যাক আমাদের যাবতীয় সব মেঘ, নীরার সব অপরাধ বোধ।
বাইরে কুয়াশা এখন থই থই। কুয়াশার আড়ালে দুজন মানব-মানবী দাঁড়িয়ে আছে খুব কাছাকাছি, যতোটা কাছে দাঁড়ালে ভেসে যায় দূরত্বের যতো ঢেউ।
দূরে হয়তো কোথাও একই কুয়াশায় ভিজে ভিজে শীতের দু’একটা পাতা ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে!