:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মাহমুদ আলম সৈকত

লেখক, অনুবাদক

শাকিল বাদায়ূনি
ব্যবহৃত শিল্পকর্ম: এ জেড শিমুল

প্রেমের সব গোপন অলিন্দের আমি পাহারাদার

শাকিল বাদায়ূনি

পুট্টুন দাদি ছিলেন শৈশবের অপার বিস্ময়। শৈশব কারো নাম নয়। মাঝখানে কি একটা চল এসেছিলো, লোকজন খুব পোয়েটিক হয়ে বাচ্চাবাচ্চার নাম রাখতো শৈশব, গহীন, অরণ্য, প্রকৃতি… এইরকম। তো তিপ্পান্ন বছরে গিয়ে শৈশবকে কেউ আর ‘শৈশব’ নামে ডাকতো না, ডাকতো ধরুন ‘মহসীন চৌধুরী’। গহীনের জীবনে ডেপথ্ বলে কিছু নাই, অরণ্য জীবনেও বন-বাদাড়ের কাছে ঘেঁষলো না, প্রকৃতির কথা বাদই দিলাম। এনিওয়ে। সুতরাং এটা আমার শৈশব মানে ছোটবেলার কথা বলছি। বিস্ময় এইজন্য যে, পুট্টুন দাদি যখন পান খেতেন তখন তার গাল-গলার রঙ বদলে যেত, হালকা লাল আভা, এতোই ফর্সা ছিলেন। আরেকটা বিস্ময় ছিলো, দাদি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ঠিকঠাক সুর লাগিয়ে টানা গাইতে পারতেন। বইজু বাওরা’র ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে’, মুঘল-এ-আজম এর ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’, দুলারি’র ‘সুহানি রাত ঢল চুকি’… এরকম অসংখ্য গান শোনাতেন। এমতন বিস্ময় মাসে অন্তত একবার জুটতো। তখন তো শুক্রবারে শুক্রবারে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হতো। তো শাকতলা পেরুলেই মনটা আনন্দে নেচে উঠতো… আরেকটু পরই নোয়াগাঁও। নোয়াগাঁও মানেই পুট্টুন দাদি। দাদির আসল নাম ন্যায়না বেগম, মানে বাংলার আঁখি বেগম, আব্বার ফুপু। খুব ছোটবেলায় মুর্শিদাবাদ থেকে বিক্রমপুর হয়ে কুমিল্লায় থিতু হন দাদি। ফলে জন্মসূত্রেই হিন্দি-উর্দুটা মোটামোটি লফজ্ ছিলো। তো, দাদির টানে-দাদির কাছেই শুনতাম কতো কতো গান যার বেশিরভাগই বুঝতে পারতাম না। অনেক পরে, নিজে যখন পছন্দ করে গান শুনতে শুরু করি, তখন ফাঁকেফুকে দাদির গানগুলোও শোনা হতো, ক্যাসেট-সিডি-টিভিতে। সেরকমই একদিন শাকিল বাদায়ূনি’র সঙ্গে পরিচয়, বাবুল দা’র সুর-সাগরে।

এইদেশে শাকিল বাদায়ূনি তেমন নাম, যার কীর্তির স্বাক্ষী হিন্দি গানের সকল শ্রোতাই কিন্তু কীর্তমানের নামটাই যে অধিকাংশ মানুষ জানতেন না! হিন্দি চলচ্চিত্রে তার গীতিকার হিশেবে শুরুয়াত দর্দ (১৯৪৭)-এর জন্য গান লিখে। উমা দেবী (টুনটুন নামে সমধিক পরিচিত)-র গাওয়া এই সিনেমার ‘আফসানা লিখ রাহি হু দিল-এ বেকার কা’ যে ঝড় তোলে তা সুরকার নওশাদের সঙ্গে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের গাঁটছড়া গড়ে তোলে। তারা দু’জনে মিলে এতো এতো হিট গান উপহার দিয়েছিলেন… দুলারি (১৯৪৯), দিদার (১৯৫১), বইজু বাওরা (১৯৫১), শাবাব (১৯৫৪), মাদার ইণ্ডিয়া (১৯৫৭), মোগল-ই-আজম (১৯৬০), গঙ্গা যমুনা (১৯৬১), কোহিনূর-এর মতো সিনেমাগুলোয় বাদায়ূনি যেন নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। রোমান্টিকতায় চুর হয়ে থাকে, বুঁদ হয়ে ওঠে তার গীতগুলো। জীবদ্দশায় তিনটি ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার এবং কয়েক হাজার হিট গানের সংখ্যা! কয়টির কথা লেখা যাবে এখানে! ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে’, ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’, ‘সুহানি রাত ঢল চুকি’, ‘কাহি দ্বীপ জ্বলে কাহি দিল’, ‘চৌদভি কা চান্দ হো ইয়া আফতাব হো’, ‘হুসেনওয়ালে তেরা জওয়াব নেহি’ ‘দিল লাগাকার হম ইয়ে সমঝে’, ‘বেকারার করকে হামে’… এরকম, বেশুমার!

শাকিলের গান আজও দূর কোনও শহরতলীর টিমটিম বাতিজ্বলা দোকানী শুনে চলে। দোকানীর বোঁজা চোখের ভেতর বহুকাল আগের এক প্রেয়সীর আঁচল উড়ে যায়, উদাসী হাওয়ার পাখি ডেকে ডেকে ফিরে যায়, কোনও এক ব্যথাতুর দিনের কথা মনে পড়ে যায় তার। তার গান বেঁচে থাকুক, আরও বহুদিন।

শাকিল যখন কাব্য দুনিয়ায় পা রাখলেন, গত শতকের চল্লিশের দশকে, তখন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রগতিশীল লেখক শিবিরের জয়জয়কার। সাহির লুধিয়ানভি, কাইফী আজমি, জান নিসার আক্তার, মজরুহ সুলতানপুরীরা তখন লিখছেন প্রতিবাদী সব গজল, নজম্। ঠিক এর বিপরীতে রোমান্টিক ধাঁচের কবিতা-গজল-নজম্ লিখে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন তিনি। বস্তুত প্রগতিশীল আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ এবং বোম্বের প্রগতিবাদী শিল্পীদের অবস্থান তার পক্ষে বিশেষ কোন আবেদন রাখেনি। এটা এইজন্য বলছি, শাকিল যেমন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছিলেন, তেমনি তখনকার বেশিরভাগ কবি-সাহিত্যিকই আলিগড় বা অন্য উর্দু-ভাষা কেন্দ্র থেকে এসেছিলেন এবং প্রায় সকলেই প্রগতিশীল আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন, ব্যতিক্রম ছিলেন শাকিল এবং তাঁকে রোমান্টিকতায় (প্রতিক্রিয়াশীল!) পুরোপুরি নিবেদিত হতে দেখা যায় শুরু থেকেই।

তাঁর সমসাময়িক প্রায় সকল আন্দোলন এবং মোর্চাসমূহ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন যেমন জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ইত্যাদি থেকে। বাদায়ূনিও সে-বিষয়ে সজাগ ছিলেন, বলেছেন:

ম্যায় শাকিল দিল কা হু তরজুমা
কে মোহাব্বাতোঁ কা হু রাজদাঁ
মুঝে ফখর্ হ্যায় মেরি শায়েরি
মেরি জিন্দেগি সে জুদা নেহি

(আমি হলাম আপন হৃদয়ের অনুবাদক, প্রেমের সব গোপন অলিন্দের আমি পাহারাদার, নিজের পদ্য নিয়ে আমার গর্ব হয় কেননা তার কিছুই আমার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।)

শাকিল বাদায়ূনির জন্ম এমন একটি ঐতিহাসিক অঞ্চলে যা শত শত বছর ধরে পীর-আউলিয়াদের পীঠস্থান। ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ূন শহরে। বাদায়ূন শহরে যেন নক্ষত্র জন্ম নেয় একের পর এক! ইসমত চুঘতাই, জিলানি বানো, দিলওয়ার ফিগার, আলি আহমদ সুরুর, আ-দা জাফরি, ফানি বাদায়ূনি… এই শহরেরই সন্তান। শাকিলের জন্ম ১৯১৬ সালে। বাবা চাইতেন বড় হয়ে ছেলে মোটা মাইনের আয়-রোজগার করুক। এমনিতে পরিবারে কাব্যচর্চার কোনও বালাই ছিলো না। তবে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় হযরত জিয়া-উল-কাদিরি বাদায়ূনি ধর্মীয় হামদ্-নাত লিখতেন। তবে কি সেটার প্রভাবেই শাকিল কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন! উনিশশ ছত্রিশে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। জুটে যায় অবাধ স্বাধীনতা। রোজ রোজ মুশায়রায় যোগ দিতে লাগলেন, নিজেও লিখতে শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দিল্লি যেতে হলো সাপ্লাই অফিসারের পদ নিয়ে। কিন্তু সেখানেও মুশায়রার মৌতাত! আলীগড়ে তো নাম কামিয়েছিলেনই, এবার দিল্লি মাতালেন কবিতা দিয়ে। ধীরে ধীরে কবিতাকেই ‘এক এবং একমাত্র’ করে নিলেন। উনিশশ চুয়াল্লিশে পাড়ি জমালেন বোম্বে শহরে, গীত লিখবেন সিনেমার জন্য। সহসাই ভাগ্য খুললো না। তবে যখন খুললো তখন আর পিছে ফিরে তাকাতে হলোনা তাকে। সাতচল্লিশ থেকে আটষট্টি… শাকিলের গানে বুঁদ ছিলো হিন্দি চলচ্চিত্রের ভূবন। সুরকার নওশাদ ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন রবি শর্মা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মন, সি রামাচন্দ্রনদের মতো গ্রেট মিউজিশিয়ানদের সাথে। তার গজল কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন অনেক শিল্পীই। তবে বেগম আখতার তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘এ্যয় মুহব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া’, ‘মেরে হামনাফাস মেরে হামনাওয়া’, ‘খুশ হু কে মেরা হুস্ন-এ-তলাব কাম তো আয়া’, ‘জিন্দেগি কা দর্দ লেকার, ‘ইস দর্জা বদগুমাঁ হ্যায়’-এর মতো বিখ্যাত সব গজল বেগম আখতার গেয়েছেন। এই গুণী কবি ও গীতিকারকে ভারত সরকার ‘গীতকার-এ-আজম’ সম্মাননায়ও ভূষিত করেছে। উনিনশ সত্তর সালের বিশে এপ্রিল মাত্র তিপান্ন বছর বয়সে ডায়াবেটিস জটিলতায় ভুগে পরলোকগমন করে শাকিল।

শাকিলের গান আজও দূর কোনও শহরতলীর টিমটিম বাতিজ্বলা দোকানী শুনে চলে। দোকানীর বোঁজা চোখের ভেতর বহুকাল আগের এক প্রেয়সীর আঁচল উড়ে যায়, উদাসী হাওয়ার পাখি ডেকে ডেকে ফিরে যায়, কোনও এক ব্যথাতুর দিনের কথা মনে পড়ে যায় তার। তার গান বেঁচে থাকুক, আরও বহুদিন। এ বেলা চলুন তার কিছু দ্বিপদী’র স্বাদ নিই।

Shakeel Badayuni. Image Source: thehindu.com

ক.
উনহে আপনে দিল কি খবরেঁ মেরে দিল সে মিল র্যতহি হ্যায়
ম্যায় যো উনসে রুঠ যাউ তো পায়াম তক্ না পহুঁচে

তার কাছে ঠিকই পৌছে যায় আমার মনের সব খবরাখবর
কখনও আমি যদি রুষ্ঠ হই, তো এক লহমারও খবর মেলে না।

 

খ.
কাভি ইয়াক-বা ইয়াক তাবাজ্জুহ কাভি দাফ্ফাতান তাগাফুল
মুঝে আজমা রহা হ্যায় কো-ই রুখ বদল বদল কর

হঠাৎ কখনও খুব প্রেমময়, আবার কখনও চরম অবহেলা
কেউ আমায় বাজিয়ে দেখছে ভোল পাল্টে পাল্টে।

 

গ.
মেরে আজম ইতনা বুলন্দ হ্যায় কে পরায়ে শোলোঁ কা ডর নেহি
মুঝে খওফ আতিশ-এ-গুল সে হ্যায় ইয়ে কাহি চমন কো জ্বালা না দে

আমার বিশ্বাস এতই দৃঢ় যে কোনও অনাম্নি স্ফুলিঙ্গে আমার ভয় নেই
আমার ভয় ফুলের অগ্নি-রূপে, যদি সে গোটা বাগিচাকেই পুড়িয়ে দেয়!

 

ঘ.
মুঝে ছোড় দে মেরে হাল পর তুঝে ক্যায়া ভরোঁসা হ্যায় চারাহগার
ইয়ে তেরি নওয়াজিশ-এ-মুখতাসার মেরা দর্দ অউর বাড়না না দে

ওহে সেবায়েত, তোমার উপর কোনও ভরসা নাই, আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও
তোমার ওই ক্ষণিকের অনুরোধ মেনে আমার কষ্টকে আর না বাড়াই।

 

ঙ.
পি শওক সে বাইজ আরে ক্যায়া বাত হ্যায় ডর কি
দোযখ তেরে কব্জে মে হ্যায় জান্নাত তেরি ঘর কি

আরে! মন খুলে পান করো হে ভয়ের কী আছে
নরক তোমার মুঠির ভেতর স্বর্গ লুটায় ঘরে

 

চ.
দুনিয়া কি রিবায়াৎ সে বেগানা নেহি হু
ছেড়ো না মুঝে ম্যায় কো-ই দিওয়ানা নেহি হু

জগতের নিয়মকানুন ঢের জানা আছে আমার
আমায় ক্ষেপিও না, পথের ধারের কোনও পাগল নই

 

ছ.
জিন্দেগি আ তুঝে কাতিল কে হাওয়ালে কর দু
মুঝ সে আব খুঁ-এ-তামান্না দেখা নেহি যা-তা

এসো হে জীবন, তোমায় হন্তারকের হাতে তুলে দিই
একে একে ইচ্ছেদের মরণ দেখা আমার আর সয় না।

 

জ.
মেরে তেজ-গামিও সে নেহি বর্ক কো ভি নিসবৎ
কাহি খো না যা-য়ে দুনিয়া মেরে সাথ সাথ চল কর

আমার দ্রুতবেগে ছুটে চলার সাথে বজ্রের কোনও সম্পর্ক নেই
এই পৃথিবীও বুঝি তাল হারাবে আমার সাথে সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে

 

শুনুন- ‘আফসানা লিখ রাহি হু দিল-এ বেকার কা’

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.