:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সেলিম মোরশেদ

কথাসাহিত্যিক

শিলা, অনন্তে
শিল্পকর্ম: মোশারফ খোকন

শিলা, অনন্তে

বাড়িটা দু’বিঘার ওপর।
সামনে মিউনিসিপ্যালিটির সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে গেছে রেল স্টেশনের দিকে। রাস্তার গা ঘেঁষে বাড়িটার উল্টোদিকে সিএনবি গোডাউন-এর টানা প্রাচীর। উচ্চতা আট-নয় ফুট। সামনের বিস্তৃতিটুকু আবদ্ধ মনে হলেও নিরাপত্তার স্থাপত্য রাখে।
মহব্বত আলি নীরবতা পছন্দ করেন। তার জন্যে এই এলাকাটা অনুপযুক্ত হয়নি। বাড়িটার পেছনে বাঁধানো পুকুরসহ অরণ্য নিয়ে সাত কাঠা।
হাজারো ফুল আর ফলের গাছ। পরিচর্যায় এহেন গাছ নেই যা রোপণ করা হয়নি।
হরেকরকম গাছের চারা! মনোযোগ দিয়ে সেগুলো রোপণও করেছেন। চেষ্টা শেষপর্যায়ে এসেছে!
বস্তুত এ-মাটির দেমাগ তুঙ্গে! মনে হয় আবারো প্রক্রিয়া জানতে হবে; জেদী মন বলে উপযুক্ত পৌরুষ দিয়ে ইচ্ছেমতো ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে সব ছলনাটুকু—! এতো গাছগাছাড়ি যদি নিয়ত গজিয়ে উঠতে পারে তাহলে কার অভিশাপে মৌ মৌ ফুল আর মিষ্টি ফলের মুখ আজ দীর্ঘদিন এমন অনুক্ত থেকে যাবে।
এ-মাটি উর্বর—বেশ উর্বর! গ্রহণ করেছে সব নিবেদন!
অথচ কেন জানি কোনো সুফল দেবে না বলে পণ করেছে।
তিন কাঠা পুকুরের চারদিকে বড়ো গাছের ছড়াছড়ি! ঝোপঝাড় অংশত! কাঁটাগুল্ম আর বুনো শ্যাওড়ার উষ্ণ আধিপত্য! সঙ্গে গজিয়ে ওঠা বহুরঙা পাতাবাহারের সপ্রতিভ যৌবন!
অদূরবর্তী কাম্য ফলের গাছগুলো ঘন আর দীর্ঘ।
আম-জাম-লিচু-কলা ইত্যাদি প্রচুর! উপচে-পড়া গোলাপ-টগর-জুঁই-চন্দ্রমল্লিকাসহ অসংখ্য উপযোগী গাছ!
মহব্বত আলি এই বৃক্ষদৃশ্যে তৃপ্ত নন—আর দশজনের মতো ফুল আর ফল চান। চারাগুলো প্রমাণ প্রদত্ত দেখে বুঝে কেনা হয়েছিলো—পুরো আঁটকুড়ে মনে হয়নি। মিষ্টি আম খেয়ে আঁটি নিজে পুঁতেছিলেন। গাছটি সিঁদুরে টক ফল দান করে। জাম কিংবা লিচু কখনও হয় না। অধিকাংশ গাছ নিশ্চয় জটিল ও গোঁয়ার।—মহব্বত আলি ভাবেন।
যদি-বা দু-একটি সফেদা বড়ো হয়, তারপর তা কখনও বাড়ে না। অন্তত বিশ বছর ধরে তেমন কিছু বাড়েনি, পাকেনি।
চার বছর আগে বড়ো মামাশ্বশুর আজিবুর রহমান দোয়া দিয়েছিলেন বলে সেই সুবাদে সারা অরণ্য মাতিয়ে শিউলি এসেছিলো। কী ফুল! সুবাস! সহ্য হয় কি লোকের। পরের বছরে এমনই সুতোবাণে মারা পড়লো যে, ডালপালা শুকিয়ে একেবারে কুড়কুড়ে কাঠ! এইরকম কষ্টই এই জমি থেকে তিনি পেয়েছেন!
মানুষের প্রাণ আছে—এ-কথা ঠিক! প্রতিটি জীবের প্রাণ আছে: ঠিক।
উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে—জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন।
কচু—প্রাণ থাকলে নিশ্চয় এরা মহব্বত আলিকে বুঝতো।
এ-মাটি রেজিস্ট্রি হয় বত্রিশ বছর আগে। প্রতি কাঠা শস্তা।… পূর্বসঞ্চিত অর্থ এবং বিয়ের সময় পাওয়া দামি ক্যামেরাটা—স্ত্রী রিজিয়া সুলতানার এক চাচা শিক্ষিত জামাই বলে দিয়েছিলেন—বিক্রি করে মহব্বত আলি জায়গাটা কিনে রাখেন। সূত্রপাত সে-সময় থেকে। কাঁড়ি কাঁড়ি মাটি ঢালা সত্ত্বেও বর্ষার ধাক্কা ও ধেড়ে ইঁদুরের উপদ্রবে বারবার পুকুরের পাড় ভাঙে! পারিপার্শ্বিক দুর্বলতায় মাছেরা চলে যায়। এখানে বরকত নেই; কোনো লাভ নেই।
এমত ক্ষেত্রে জীবন সম্পর্কে মহব্বত আলির অনুভবে নানা বিষয়াদি আসে।
জীবনটা প্রতিমুহূর্তে চিত্রিত হয়ে চোখে ভাসে: অঙ্কুরে অর্থকষ্ট, পরবর্তী পর্যায়ে শহর এবং মেসজীবন, উচ্চতর শিক্ষা, চাকরির পরিবর্তন, নানাভাবে প্রতিষ্ঠা, বিয়ে—যে-সমস্ত গুণাবলী… যা সফলতার প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়ে এতোকাল তুষ্টি লাভ করে এসেছেন, মূল্য কতোটুকু! ভালোবাসা প্রাপ্তি—তার ভাগ্যে অঢেল এসেছে!
আত্মা দিয়ে প্রচুর দিয়েছেন; বিনিময়ে প্রকৃতি তার সম্বল ছেলেটাকে আকাশে শুকতারা বানিয়ে রেখেছে।
এই-যে অশোক কড়াই কাঠমালতী, কে তাকে মূল্য দেয়!
মানুষ দাবি করে প্রকৃতিকে জয় করেছে—এ-কথায় মহব্বত আলির বিশ্বাস নেই। তার অনুমান: মানুষ প্রকৃতিকে শনাক্ত করেছে; আপন করে নিয়েছে ঐশ্বর্য। সম্পর্কটা মিথ্যোপযোগিতার!
বাইরে থেকে বোঝা যায়, বাড়িটা এল প্যাটার্নের।
ঈষাণ-পূর্ব মিলে চারটা চারটা আটটা, পশ্চিমে আরও দুটো বড়ো—এই দশটা ঘর নিচের তলায়। বিশেষত পরিচ্ছন্ন চুনকাম, দেয়ালের ভেতর ইলেকট্রিক তার বসিয়ে বাতি জ্বালানো হয়। ভারি ছাদ! দোতলার জন্য এক-তৃতীয়াংশ লিনটেল পর্যন্ত গাঁথা।
নির্মাণ-পর্ব এখনও নিষ্পন্ন হয়নি।
বেশ জায়গা নেয়া উঠোনটা প্রশস্ত ও কারুকার্যে ভরা। দুই পাশে মোজাইক করা টানা চওড়া সোফার মতো ঠ্যাস-আসন! আসন দুটোর বিপরীতে কালচে রঙা কাচের অ্যাকুরিয়াম। রঙিন খলসে মাছ সরু পাতাগুলোকে কখন যে কুচকুচ করে খেয়ে নেয়—দুষ্কর। উঠোনের চার কোণায় একফুট উঁচু পিলারের মাথায় সিমেন্টের ক্ষুদ্র ক্যারামবোর্ড, পাশা ও লুডুর ঘর কাটা। এককোণে রান্নাঘরের সামনে তাজা মেহেদি গাছ; জ্যোৎস্নার আলো জালি-কাটা নকশায় এক্কাদোক্কা খেলার ঘর বানিয়ে বিমর্ষ। একটি পয়েনসেনটেয়ার-এর থোকা-থোকা লম্বাটে গাঢ় ফুল এবং একটা করমচা—বিশেষত এ-দুটি গাছ—আচমকা এ-বাড়ির সমস্ত নিয়ম লংঘন করে একটি বিশেষ ঘরের বামপাশে স্থির হয়ে বেড়ে উঠছে।
সবাই সেটা লক্ষ করছে।
বারান্দার তিনধারে আবদ্ধের কোনো চেষ্টা নেই; শুধু দক্ষিণ-পূর্ব কোণের কিছুটা জায়গা জুড়ে শাদা রঙ-করা লোহার বেড়-দেয়া গ্রিল। নামাজ পড়ার জন্যে নির্মিত খাটো চৌকি; অগ্রভাগে পালিশ-করা খাঁজকাটা তক্তা খাড়াভাবে লাগানো।
খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখার জন্যে এক বিশেষ ড্রেসিং টেবিল; কাচহীন!… প্রতি বৃহস্পতিবার দিনগত গভীর রাতে রিজিয়া সুলতানা এখানে মোরাকাবায় বসেন। আশ্বিনে এর রূপ আরও প্রখর!…
আশ্বিন মাসের আট তারিখে এ-বাড়ি ভিজিয়ে এক পশলা বৃষ্টি আসে! সেদিন সকাল থেকে রাত অবধি রান্নায় কোনো আমিষের আশ্রয় থাকে না! এ-আইনের ব্যত্যয় নেই; যেখানে যে-অবস্থায় তারা থাকুক—মেনে নেয়, মেনে নিতে বাধ্য!
বিশেষ করে, রিজিয়া সুলতানা-দ্বারা বাড়িতে যখন কোনো আইন প্রণীত হয়, মহব্বত আলি মেনে নেবার চেষ্টায় থাকেন।

রিজিয়া সুলতানা সম্পর্কে আলোকপাত করা সরল ও শাদামাটা কাজ: সুন্দরী; জোয়ার্দার বংশের মেয়ে। মহব্বত আলির পরিবারের মতোন তারা ততোটা শিক্ষিত নন। রিজিয়া সুলতানার বাবা দু’বছরের ব্যবধানে দুটো বিয়ে করেন। সুলতানার বাবা ছিলেন দাম্ভিক মোড়ল এবং সুদের কারবারী।
বাবার প্রথম পক্ষের মেয়ে তিনি! সুন্দর মুখশ্রীর সঙ্গে নারীত্বের গুণগুলো টুকটুক করে পূর্ণযৌবনে জড়ো হয়েছিলো! নানা ছিলেন ইসলামি শিক্ষার একজন জ্ঞানী পুরুষ। তিনি তার কাছ থেকে নানাবিধ বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। নানাই মহব্বত আলির সঙ্গে রিজিয়া সুলতানাকে বেঁধে দিলেন।
… নানা জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো: প্রতিবার মোরাকাবায় বসার পূর্বে প্রথমত এই কথা মনে আসে! একরাশ দুঃখ নিয়ে ভাবেন। ভাবতে ভাবতে রাত হয়, ঠাণ্ডা লাগে! আশ্বিনে বাতাস ভেজা থাকে। রিজিয়া সুলতানা অ্যাজমার পেসেন্ট।
মহব্বত আলির মাফলারটা নাকেমুখে জড়িয়ে নেন।…বিয়ের পর থেকে আজ অবধি টুকরো টুকরো যেসব মধুর স্মৃতি-অনুভূতি মনের ভেতর আজও সঞ্চরণশীল—জাগরিত, সংসার-জীবনের নানা দুঃখ-কষ্ট-ঘাত-প্রতিঘাত-আপদ-বিপদে যা নিজস্ব অবলম্বন, সে-বোধটুকু সামান্য হলেও তাকে প্রশস্তি দেয়। নতুবা তার নিজস্ব কথাপুঞ্জ দারুণ মর্মমূলস্পর্শী! এক চতুর অপহারক তার বহুবিধ গুণের অনিবার্য প্রকাশের নিয়ত প্রতিবন্ধক। কারণ: তার বিশেষ প্রত্যাশা দীর্ঘদিন যাবৎ প্রত্যাখ্যাত হয়।
… পঁচিশ বছর ধরে মাখনের মুখটা একবার দেখতে চেয়েছেন।
করুণাময়ের কাছে রাতকে রাত ধরে জানতে চান—তাকে পুরুষ-সন্তান থেকে কিসের ভিত্তিতে বঞ্চিত করা হলো! কতোদিন আর নানার ওপর গাজী খাঁর ফলিত আক্রোশ তিনি বহন করে যাবেন। … এতোগুলো বছর পার হলেও কোনো প্রত্যুত্তর এখনো পাননি। স্বভাবত আকাশভরা নক্ষত্রতারা অথবা নিকষ অমাবস্যা দুটোই যে অথর্ব; এককাতারে অবস্থানরত।
এই বৃষ্টিপ্রাপ্ত মাটি, পাখির কলরব, প্রকৃতির সকল সুসম্পদ মূলত অপরিণত—রিজিয়া সুলতানার ধারণা এরকম!
ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছিলো রিজিয়া সুলতানার বিয়ের দু’বছর পূর্বের এক অগ্রহায়ণে।
তখন সুলতানার নানা মেজবাহউদ্দিন সে-তল্লাটের স্বীকৃত একজন পির। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ মসিবত কাটাতে ছুটে আসতো! সুনাম আর বৈভবে থরথরে অবস্থা: তিনি ছিলেন ভেতর ও বাইরে সৎ। মেজবাহউদ্দিন গভীর অধ্যাত্মঅনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছিলেন। ঘটনাক্রমে অন্য তল্লাটে—দশ মাইল দূরে—গাজী খাঁ নামে এরকম একজনের অবস্থান ছিলো। গুণের কদর কিছু অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত! প্রমাণিত : এস্মে আজমে গাজী খাঁর জুড়ি মেলা ভার। দুজনের ভেতর কোনো প্রতিযোগিতা ছিলো না।… একদিন গাজী খাঁ ছেলের আকিকায় শিস্যসাগরেদসহ মেজবাহউদ্দিনকে নেমন্তন্ন দিলো। এতো বছর পর গাজী খাঁর সন্তান হওয়ায়—তা-ও আবার ছেলে—ঘটা করে সাজিয়েছিলো! খরচও করেছিলো।
যথারীতি সঙ্গীসাথীসহ, সন্ধেবেলায়, সোনার বাজুবন্ধ নিয়ে মেজবাহউদ্দিন নেমন্তন্নে গেলেন। গাজী খাঁ খুশি হয়েছিলো। উষ্ণ আতিথেয়তা নিয়ে বড়োই আনন্দিতচিত্তে মেজবাহউদ্দিন ফিরে আসেন।
দুদিন পর অজ্ঞাত কারণে গাজী খাঁর ছেলে—দিব্যি সুস্থ—হঠাৎ মারা গেলো। প্রাথমিকভাবে ঘটনাটা অনেকে দৈবদুর্বিপাক বলে ধারণা করেছিলো।
কিন্তু সংঘর্ষ তো হতে পারে, নইলে এক নক্ষত্র থেকে অপর নক্ষত্র এতো দূরে দূরে কেন? কারা রটালো : মনে পড়ছে না—মোরাকাবায় বসে এ-ভাবনা অনুচিতও—শত্রুরা রটিয়ে দিলো, গাজী খাঁ তার পিরত্ব নিশ্চিত ছেলেকে প্রদান করতে পারে—এই সংশয়ে নিজ ছেলের সুবিধার্থে মেজবাহউদ্দিন এই কেরামতি দেখিয়ে গেলো!
বিষয়টি নিয়ে শত্রুদের মাথাব্যথা; শত্রুরা বিষয়টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাবিধ মুখ বের করে গাজী খাঁকে বোঝালো, এর সদুত্তর দিতে হবে! ইজ্জত আর ক্ষমতার প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে! নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে মেজবাহউদ্দিনের বংশ।

শোনা যায়; কদর্য একটি কাকের পেট চিরে একটানে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের একটি বিশেষ অধ্যায় উল্টো করে লিখে, ঢুকিয়ে, সেলাই করা হয়। তারপর সেই কাক নোংরা জায়গায় পুড়িয়ে, তওবা, ভস্ম করে, মেজবাহউদ্দিনের সমস্ত বংশ আর স্বজনদের উদ্দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

গাজী খাঁ সে-সময় পুত্রশোকে কাতর! এমতক্ষেত্রে শত্রুরা নিয়ত ক্ষতিকর হিসেবে তাদের কাছে শনাক্তকারী মেজবাহউদ্দিন সংক্রান্ত বিষয়াদির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলো। শেষে স্থির বিশ্বাস গেঁথে গেলো গাজী খাঁর বুক জুড়ে। তল্লাটদ্বয়ের গোপন প্রস্তুতি দেখে বিশ্বাসীরা সতর্ক হয়ে বললো: জালালি আর জামালি! দুই তরিকার খেল! আগুন না পানি: কে বড়ো? পানি বড়ো হলে আগুন ছাড়ে নাকি?… পানিতেও আগুন ধরে…স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এক বৃদ্ধ নিজে একদা চোখে দেখেছে বলে জানালো!
কয়েকদিনের ভেতর তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটে আচমকা মেজবাহউদ্দিনের দুই ছেলে আলিম ও হালিমের মৃত্যুতে! আলিম ট্রেনে কাটা গেলো, বিকেল তিনটায়, জুম্মার দিনে।—দূর থেকে প্রত্যক্ষদর্শী—যারা ঘটনাটা না বুঝে দেখেছিলো, তাদের বিবরণ: বারবার ট্রেন হুইসেল দেয়া সত্ত্বেও আলিম স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আলিমের মৃত্যুর সাতদিন পর হালিম: তার মৃত্যু হলো, একটি আকাশ-সমান ডাব গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলো; … দড়াম করে জোড়াডাব ব্রহ্মতালুর ওপর পড়ে। প্রথমদিকে মেজবাহউদ্দিন কিছুদিন এই আক্রোশ প্রতিহত করেন! পরবর্তী সময়ে মেজবাহউদ্দিনও নাকি প্রতিশোধস্পৃহায় প্রবৃত্ত হন।
গাজী খাঁর দুটো বড়ো বড়ো ধানের গোলা বস্তুগত কারণবিহীন দিনের বেলা পুড়ে যায়! নির্ভরতা-ভরা যুবতী স্ত্রী মরিয়ম গাজী খাঁকে ছেড়ে মেজবাহউদ্দিনের বাড়িতে কাজ নেয়।
জ্ঞান হারিয়ে গাজী খাঁ তখন পিশাচ! ইহকাল, নয় পরকাল। শুরু করে কুফরি কালাম!
শোনা যায়; কদর্য একটি কাকের পেট চিরে একটানে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের একটি বিশেষ অধ্যায় উল্টো করে লিখে, ঢুকিয়ে, সেলাই করা হয়। তারপর সেই কাক নোংরা জায়গায় পুড়িয়ে, তওবা, ভস্ম করে, মেজবাহউদ্দিনের সমস্ত বংশ আর স্বজনদের উদ্দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
এই মারাত্মক অবস্থার ভেতর রিজিয়া সুলতানার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। দ্রুত কাজটা সেরে ফেলেন মেজবাহউদ্দিন। রিজিয়ার বিয়ের দিনও কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছিলেন। বোঝা যাচ্ছিলো কিছু ভাবছেন!
বরেরা গাড়ি রেখে এসেছে ব্রিজের কাছে! পালকিতে চড়ে আধঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে!
দেনমোহর ধার্য হলো। ভালোভাবে সবকিছু হলো। হঠাৎ বেঁকে বসলো বরযাত্রীরা! তারা যে-শহরে থাকে, নদী নেই সেখানে; নতুন বউ নিয়ে তারা নদীপথে ব্রিজের মাথায় গিয়ে উঠবে। প্রমাদ গুনলেন মেজবাহউদ্দিন! নদীপথে যেতে পথিমধ্যে গাজী খাঁর আস্তানা পড়ে! এদিকে খোলাখুলি বলাও যায় না।… ইজ্জৎ ও ক্ষমতার প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়।
চেষ্টা করেও বরযাত্রীদেরকে বোঝানো গেলো না। মেজবাহউদ্দিনের উপরোধ তারা না মেনে—অদূরবর্তী নৌকাঘাটে—নৌকা ঠিক করতে লোক পাঠালো।
সম্প্রদান-মুহূর্তে মেজবাহউদ্দিন সুলতানার উদ্দেশে বললেন, নদীপথে গাজী খাঁর আস্তানার আগে দক্ষিণপাশের মাঠের দিকে তাকিয়ে, এই শব্দ দুটো পড়ে নিও—বলে… শব্দ দুটো জানিয়ে দিলেন।
আশ্চর্য! ছয়টি নৌকার আনন্দমুখর সোরগোল ও চেঁচামেচিতে ভুলে গেলেন তিনি। আকস্মিক একটি কাক, আকাশের আলোয় দেখা গেলো, কোথা থেকে উড়ে এসে মুহূর্তে সুলতানার ঘোমটা ছুঁয়ে বিদ্যুৎ-বেগে উপরে উঠে যাচ্ছে!
খেয়াল করলেন অনেক পরে!
তখন গাজী খাঁর আস্তানা পার হয়ে গিয়েছে। নানার বলে-দেয়া চিহ্নিত সীমানা অনেক পেছনে ফেলে এসেছেন।

এরপর রিজিয়া সুলতানার সংসার: সাজালেন।
সংসারকে সাজানো যায় না, গোছানো সম্পন্ন হয় না; নিত্যনতুন প্রসাধন ও উপকরণ ওর রক্তে আর মজ্জায় লাগে : তারপরও সেখানে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। মহব্বত আলি সংসারী পুরুষ। বলে দেবার আগে নিজে থেকে বুঝে নেন! তবু কোথায় যেন পণ্ড, সব ভ্রান্ত, ইদানিং মনে হচ্ছে, বারবার এসব কথা মনে হচ্ছে।
সাত বছরে তিনটি সন্তানের মৃত্যু একইভাবে হবে—কেমন কথা? প্রতিবার প্রত্যেকেরই নুনু দিয়ে রক্ত উঠে নিভে যায়; কষ্ট পেয়েও মেনে নেন। প্রত্যাশার হাত বাড়ান। সাত বছর বাঁচিয়ে রেখে মাখনকে নেয়া কতো বড়ো নিষ্ঠুরতা—করুণাময় কি সেটুকু বোঝেননি?
মহব্বত আলি সে-সময় নড়াইলে খাদ্য বিভাগে চাকরিরত। খেয়াঘাটের ঠিক পাশে, অফিসের কে যেন, বাসা ঠিক করে দিয়েছিলো। নিচে স্রোতস্বিনী চিত্রা।
মাখনের বয়স সাত। সকালবেলা মাখন ভারি হাসছিল। বাড়িতে ভালোভাবে রান্না করা হয়েছিলো। সারাদিন মাখন মায়ের পাশাপাশি ঘুটুরঘুটুর করছিলো। তারপর দুপুরবেলা মা বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন।…
মাখন বাইরে এসে ঘাটের কোণে চুপিচুপি দাঁড়ায়—‘ও কুণ্ডু বুড়ি, পানিতে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কী বলো’… শুনেছিলো চিত্রা; ভরা যৌবনে প্রতিবছর মরদ লাগে তার।—‘আমিও করি তো দেখি, ও সূর্য’… কখন যে চিত্রার পাঁকে পড়লো।
লাশটা পেলেও মনকে প্রবোধ দেয়া যায়।
মা হিসেবে এ-সংসারে তিনি অনেককিছু দেখে চমকে উঠেছেন। সব এলোমেলো হওয়াতে কেমন যেন বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো।
সারা বাড়ির চেহারাটা এরকম।
যার জন্যে এতো কথা—এতো চরিত্র এলো, ও এ-বাড়ির একমাত্র জীবিত সন্তান, বাবা-মার সকল বৈপরীত্য নিয়ে সেই রানী উইল হেলমিনা অথবা শিলা ১৯৬৪ সালের ২৮শে এপ্রিল এ-বাড়িতে জন্ম নিয়ে একান্ত স্বাধীনতায় বেড়ে উঠেছে।
ও প্রচুর কথা বলে।
সন্ধ্যা আসন্ন। ভ্রাম্যমাণ বাতাস মেঘমালা উড়িয়ে শাদা কাঞ্চনে টোকা দিলো।
বড়ো মেহগনির পাতায় জোড়া টুনটুনি ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে গভীর কম্পনে নিস্তরঙ্গ।
পাতা কাঁপে না। সম্ভ্রমে নিজেকে মেলে; নিশ্চুপ বাতাস পর্যবেক্ষণরত।
পুকুরঘাটের আড়াআড়ি বুনোট গাছগাছালির মধ্যে পরগাছার জঙ্গলের ওপর বেড়ে ওঠা একটা ধূসর মাকড়শা, শেষবারের মতো পৃথিবীর চারপাশ দেখে নিয়ে, মুহূর্তে, নিজেকে উৎসর্গ করে প্রজন্মের প্রশ্নে।
‘উলোটকমল কিন্তু অদ্ভুত গাছ’—জলছাদের ওপর থেকে নিচে তাকিয়ে আবার মোশতাকের ওপরে চোখ রাখে শিলা।…‘অনেক উপকারী, আধিক্য দেখিয়ে কিছু চেয়ো, পাবে না। ছাল-চামড়া শেকড়-বাকড় নিয়ে শুধু কাড়াকাড়ি। প্রতিদান নেয় না।’
‘তা ঠিক’—মোশতাক বলে, ‘ওর প্রতিদান দেয়া যায় না।’
‘পাতাবাহার অন্যরকম—ফুল নেই, ফল নেই বলে ওর স্বপ্ন মরে—ঠিক না।’
শিলা যেভাবে বলে, যেন মোশতাক বিপরীত কিছু ভেবেছে।
‘ওর পাতায় মায়ের স্বপ্ন থাকে। ফুলের সঙ্গে ওকে বেঁধে দিলে কেমন আগলে রাখে দেখবে। কবে থেকে জেনেছি, কাঁঠাল আছে না…ছোটোবেলায় দেখলাম বড়ো হয়ে যখন পাকে তখন নরম হয়, আর ডালিম, নিজেকে ফাটিয়ে দাঁত বের করে হাসে।’
পুকুরপাড়ে অন্ধকার ঘনায়মান; ঝিমঝিমে নির্জনতার পাখা সারা অরণ্যে বাতাস ছড়ায়; নিকটবর্তী মসজিদ থেকে আজানের সুর আসে।
থোপার ঝোপের পাশাপাশি দৃষ্টিশোভন নাগকেশর। নাগকেশরের নিচে আত্মবিশ্বাসী বেজি বন্য হিংস্রতায় চক্কর দেয়। মোশতাক লক্ষ করলে শিলা বলে, ‘এটা ও যুদ্ধ করার জন্যে করছে না। অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এরা শুধু যুদ্ধ করে তা না। এদের অনেক গল্প আমি জানি।’
‘বলো।’
‘রাজবিল্লার নাম শুনেছো?—চন্দ্রঘোনা থেকে দশ মাইল দূর—সেখানে মাইনিমুখ; হাতি ধরার খেদা ছিলো। খেদা চেনো? খেদা হলো ফাঁদ। একটা পোষা হাতি থাকে; তাকে দিয়ে অন্য হাতিদের নিয়ে এসে ধরে। এক পোষা হাতির নাম ছিলো লালবাহাদুর। আমরা তখন মাইনিমুখে। রেজাশাহ পাহলবী তখন প্রিন্স। বাবার মুখে শুনেছি, এলএইচ নিবলেট তখন কমিশনার। একদিন এই নিবলেট পোষা হাতিটার পিঠে ছিলো মাহুতের সাথে। সেইদিন একটা হাতি কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। হাতিটার ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে গিয়ে নিবলেট গুলি করলো। লালবাহাদুর চুপচাপই ছিলো। যেই না নিবলেট ফায়ার করেছে, দলদলে চেনো? দলদলে হলো কাদাজল। লালবাহাদুর পিঠের থেকে নিবলেটকে সেখানে ফেলে পাড়িয়ে পাড়িয়ে মারে।’ শিলা থামে, তারপরে বলে, ‘এই হলো একটা, দ্বিতীয়টা ঝিনেদায়…ঝিনেদার ঘটনাটা না-বোঝার ভুল। একজনের একটা গোরু ছিলো। মালিক ছিলো পরহেজগার আর বুদ্ধিমান। একদিন বিকেলবেলা মাঠ থেকে গোরু আনার পথে মালিক দেখলো গোরুর মুখে বাদশাহী কারুকার্যের বাটের আধহাত লম্বা আধা-চকচকে ছুরি। বারবার মালিকের সামনে দাঁতে ছুরিটা নিয়ে গোরুটা ঘাড় এদিক-ওদিক করে।—কেন? মালিক সারা পথ ভাবলো। তারপর বাড়ি ফিরে এসে মুরুব্বিদের পরামর্শ নিলো। তারপরের দিন সকালে সেই ছুরিটা দিয়ে মালিক গোরুটাকে জবাই করে মাংস-ভুঁড়ি-পা-মাথা এলাকা ধরে বিলিয়ে দিলো। আচ্ছা মোশতাক, গোরুটা ছুরি কেন এনেছিলো? দেখি কেমন টিউশনি করো?’
মোশতাক চুপ থাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায় সঠিক উত্তর দেবে এ-রকমভাবে।
অথচ মোশতাক কিছু বলতে পারে না। শিলা ছাদ থেকে তার সঙ্গে নেমে আসে। আর মোশতাক রাস্তায় নেমে এসে সিএনবি গোডাউনের প্রাচীরের সামনে চোখ রেখে স্টেশনের দিকে হাঁটে।

মাগুরা থেকে মহব্বত আলিকে গুরুতর অফিসিয়াল প্রয়োজনে ফুড ইনস্পেকটর হিসেবে বদলি করা হলো খুলনা জেলায়। শিলাকে হাইস্কুলে ভর্তি করা হলো বিজ্ঞানে। শিলা যেদিন বিজ্ঞানে ভর্তি হলো ওইদিনে মহব্বত আলির গল্লামারির অফিসের এলডি ক্লার্ক যুবক সন্তোষ পাল জানালো, মাখনের আত্মা তার মায়ের প্রশান্তির জন্যে বাড়িতে এসে দেখা দিতে পারে।—তারা যদি চায়—সন্তোষ পাল ব্যবস্থা করবে। সন্তোষ পাল অফিসে জাদু দেখিয়েছে। অ্যাকাউন্টেন্ট সাহেবের বেতনের টাকা পহেলা তারিখে সন্তোষ পালের বুকপকেটে। সাইকেলসহ সন্তোষ পাল ঘরের ভেতর, দরোজা বাইরে থেকে তালা দেয়া। সন্তোষ পাল সাইকেলসহ বেরিয়ে যাবে ঘর হতে। শর্ত: উঁকি দেয়া যাবে না। দশ মিনিট পর দেখা যায় সন্তোষ সাইকেলসহ বেরিয়ে এসেছে। তালা ও দরোজার কড়া আগের মতো। রিজিয়া সুলতানার অনুরোধে মহব্বত আলি সন্তোষ পালকে বাড়ি এনে এই আধিভৌতিক কাজের সুযোগ দেন।—তো একদিনের ব্যাপার। কৃষ্ণপক্ষের একাদশীতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে মাখনের আত্মা শেষরাতে সন্তোষের কাছে এসে সে কেমন আছে কথাটা বলে যাবে। তবে সন্তোষ ছাড়া রাতে কেউ জেগে থাকতে পারবে না।
সন্তোষ পালের কথামতো সে রাতে বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়লেও শিলা জেগে থাকে। এসব সত্যি? ভেতরে টানাপড়েন হয়। অবশেষে কৌত‚হলী মন ওকে টেনে নিয়ে যায় সন্তোষ পালের ঘরটির সামনে।
সারা ঘরে ধূপধুনার উগ্র গন্ধ। মোমবাতি জ্বালিয়ে যোগাসনে বসে আছে সন্তোষ। দরোজা আধা-ভেজানো। শিলার মন উঁকি দেয়: সেই সময় তিন আঙুল দিয়ে ডাক দিয়েছিলো সন্তোষ। মধ্যরাতে তন্ত্রসাধকের সামনে সে যে একা বাড়ন্ত মেয়ে ভুলে গিয়েছিলো শিলা। কী এতো ভয়; উঁকি দেবার অপরাধে নিশ্চয় এই তান্ত্রিক দু-একটি কথা শুনিয়ে দেবে। অথচ সন্তোষ যখন সরাসরি শিলার দিকে তাকালো: মূর্তির মতো স্থির হয়ে গিয়েছিলো শিলা। মানুষের চোখ আর অভিব্যক্তি এরকম আলাদা হয়ে উঠতে পারে দেখে থ’ হয়ে ছিলো। সকল অনভ‚তি হারিয়ে ফেলেছিলো।
‘সবাই ঘুমিয়ে?’
মাথা কাত করেছিলো শিলা।
‘মাখনের আত্মা এখন এ-ঘরে। ক্ষমা চাইতে হবে। যা বলবো করলে ক্ষতি হবে না।’
শিলা মাথা নাড়লো।
একটু চঞ্চল হলো সন্তোষ; কিছু ভাবলো, ‘—তোমার সতীদ্বারে আমার আঙুল রাখো—অন্যথায় সর্বনাশ হবে।’
শিলা সহজাত প্রতিরক্ষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।…শেষমুহূর্তে অনুভূতির একটি পরমাণু প্রশ্ন তোলে—সতীদ্বার কী? সন্তোষ পাল হাসছিলো? সর্বনাশ বলতে কি বাবা-মার কথা বললো সন্তোষ! এরপর যা কিছু হয়েছিলো জানেনি স্বাভাবিকভাবে। ভোর হওয়ার পূর্বাহ্নে ঘরে ফিরে এসেছিলো। নিজের শরীর ও মন ভারী ও বাড়ন্ত আর সমন্বয়হীন মনে হয়েছিলো। এর পরপর দুটি দিন ঘুমিয়ে থাকে শিলা। ওর আচরণে বাবা-মাকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা প্রদর্শিত হতে থাকে মহব্বত আলি আর রিজিয়া সুলাতানার দৃষ্টিযুগলে। এরই পাঁচ মাসের মাথায় রিজিয়া সুলতানাকে মাসদুয়েকের জন্যে গ্রামে যেতে হলো স্বামীহীনা নিঃসন্তান বড়ো ননদকে বাড়িতে রেখে। বড়ো ফুপু শিলাকে ভালোবাসতেন। ফুপুর সঙ্গমুগ্ধ শিলা মাঝে মাঝে উৎফুল্ল হতো। মহব্বত আলি সেই সকালে বের হন, রাতে ফেরেন দেরিতে। সদা বিনম্র। অফিসে উপঢৌকন গ্রহণ করেন। তিনি অভিজ্ঞ: ভালোবাসার আদান-প্রদান এক কঠিন কাজ—জানেন। বাঁচতে হলে যোগ-বিয়োগ করে সমাজে থাকতে হয়। অফিসে সবাই চলে যাবার পর রাত অবধি কাজ সেরে ফেরেন। নীতিবোধও কাজ করে। জীবন গতিমালায় তার ভারসাম্য দেখা দেয়। আলোর মুখোমুখি অন্ধকার আসে। বাবা আর বড়ো ফুপুর অগোচরে শিলা পুড়ে যায় অন্যত্র। জীবনের, শিলা ভাবে, মূল্য কী? গুপ্ত মন বলে, ইচ্ছাপূরণ। সে ইচ্ছার ভিত্তিমূল শিলাকে ভাবায়। এই বেদনা ওকে তাড়া করে; অব্যাহতি চায় না, অর্থ চায়। না পেলে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে অপলক। অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করে শুকনো মাটিতে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। গন্ধটা শিলাকে সম্মোহন করে। মধ্যরাতে শিলা অপেক্ষা করে বৃষ্টির। তাতানো মাটির ওপর বৃষ্টির গন্ধ অন্তস্পর্শী। প্রবণতায়… শুকনো মাটির ঢেলায় ফোঁটা ফোঁটা জল দিয়ে উন্মত্ত হওয়া। কী ক্ষতি? এই স্বাদু মাটি গালে দিলে। মৃত্তিকা মানুষের অধিকার। অনেক দিন অতিবাহিত হয়। বসন্তে শিলা ভাবে, এমনকি কোনো হৃদয় আছে সভ্যতা যাকে ঈর্ষা থেকে বিরত রেখেছে? যে কখনো আঘাত পায়নি কিংবা দেয়নি। পক্ষকাল শিলা বিষয়টা নিয়ে ভাবে। একদিন ভরা চোখের জল পড়েছিলো কণ্ঠার হাড়ের ওপর। নানাভাবে কেঁদেছিলো। এক মেঘলা দিন : কান্নার ভারে কী যেন ছিঁড়ে গেলো। মৃত্তিকায় কম্পন এলো। তক্ষুণি পলেপলে শিলার তলপেট মুচড়ে ওঠে।
তারপর আচমকা দুঃস্বপ্নের রঙে লজ্জা ও ভয়ের আদর্শ নিয়ে এক মানব ফুল ও ফল সতীদ্বার থেকে প্রদর্শিত হয়। চমকে উঠে শিলা অনেক সময় নিয়ে তাকে দেখলো। জানলো। তারপর আত্মজার স্পন্দন ক্রূরতায় রুদ্ধ করে দিয়ে কাঁদলো জলবিহীন। সময় নিয়ে ঘরের পেছনে গর্ত খুঁজে নিলো। ইট আর আকন্দের ডালপালায় চাপা দিয়েছিলো গর্তের মুখ। ফিরে কতোটা সময় জ্ঞান হারিয়েছিলো জানে না। পরদিন সবকিছু অন্যান্য দিনের মতো ছিলো। নতুন আবহাওয়া ছিলো না। কড়া রোদ ছিলো না। শিলা ঘুমিয়ে কাটালো।

মাখনের বয়স সাত। সকালবেলা মাখন ভারি হাসছিল। বাড়িতে ভালোভাবে রান্না করা হয়েছিলো। সারাদিন মাখন মায়ের পাশাপাশি ঘুটুরঘুটুর করছিলো। তারপর দুপুরবেলা মা বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন।…
মাখন বাইরে এসে ঘাটের কোণে চুপিচুপি দাঁড়ায়—‘ও কুণ্ডু বুড়ি, পানিতে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কী বলো’… শুনেছিলো চিত্রা; ভরা যৌবনে প্রতিবছর মরদ লাগে তার।—‘আমিও করি তো দেখি, ও সূর্য’… কখন যে চিত্রার পাঁকে পড়লো।

বছর অতিক্রান্ত। মহব্বত আলি বদলি হলেন। এসে এখানে খুশি হন ভেবে—নিজের জমিতে এখন বাড়ি তুলবেন। নিরলসভাবে সাজিয়ে তুলবেন নিজ সংসার। সড়ক পরিবহনে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় ঘণ্টাদুয়ের ভেতর। বারবার স্বামীর বদলি হবার সঙ্গে গাজী খাঁর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে এমন ধারণা সুলতানার মনে হলেও এলাকার পানির তুলনামূলক গুণে তুষ্ট হন। মহব্বত আলি শ্রম দিয়ে নির্মাণ করেন এই রঙমহল। শিলা চলমান শিক্ষা পরীক্ষার মেধাতালিকা হতে নিজেকে নত করে। সংসারে ওকে কী-বা বলবে! বিজাতীয় এক স্বাভাবিক আচরণ শিলার মধ্যে। যে নিজেই এতো সংহত থাকে তাকে অনুযোগ করা কঠিন। সুলতানা নানাবিধও ভেবেছেন। সিদ্ধান্ত আসেনি। বহুবিধ অনুমান অনিশ্চয়তা আনে। শিলা ইচ্ছেমতো চলে। ঈদুল আযহায় বন্ধুদের সঙ্গে শিলার আচমকা সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সাতদিন আগে ভেবেছিলো রানীকে শাড়ি দেবে, রানীকে শুধু কেন? শিরিনও বন্ধু, শর্মিলাও বন্ধু? বিথি, সে-ও শিলাকে ভালোবাসে। শিলা তালিকা তৈরি করে। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে ও উন্মুক্ত হতে পারেনি। যে বিষয়গুলোতে ওদের কৌতূহল আর স্বপ্ন ছিলো শিলার ঈক্ষণে তা কোনো-না-কোনোভাবে কঠোর বাস্তব বা দুর্ঘটনা। শিলা সাতজনকে বের করে সাতটা উচ্চমূল্যের শাড়ি দিলো। ওরা খুশি হবে। গোপন ভালোবাসাটুকুও পৌঁছে দেবে।
শিলা জানতো: মানুষের কাছে যাওয়া ওর দৈবে নেই। তবে এখানে যা হয়েছিলো তা স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। প্রতিটি বন্ধুই সতর্ক হয়ে গেলো। শিলার উদ্দেশ্য বিষয়ক প্রশ্ন… প্রতিদানের সংকীর্ণ সংশয়…ওরা সবাই অংকে ফেলে দেখলো। শিলার মতো, সম্পর্কের মূল্য এতোখানি, ওরা চায় না। সঙ্গে অভিভাবকদের কথা—শিলার টাকার উৎস। ভেতর থেকে আরেক সত্য বেরিয়ে আসে। কোরবানি দেয়া ও সহ্য করতে পারে না। বাবার আলমারি থেকে টাকাগুলো সরিয়ে ব্যয় করেছে। দীর্ঘদিন অন্তর্কক্ষে খোঁচা দেয়। অকুমারী আর হত্যাকারী। ধর্মে মন রাখা উচিত ছিলো।
শিলা যে-সময় শাড়ি পড়েছে, মাসারাতের সঙ্গে আন্তরিক যখন। মাসারাত একজন মহিলা অথচ তরুণীর মতো। মুখ সুন্দর, মনও। নিয়মিত মঞ্চনাটক দেখতো শিলা—সেখানে পরিচয়। ভালো চলছে। মাসারাতের সঙ্গে শিলার নির্জন মন একাকার। পূর্ণিমা এলো। দিনরাত সমান। চুলে তেল দিলো মাসারাত। ‘শিলা চারপাশে কতো আলো, এখন চুল ছেড়ে দিলে চুলের রঙ খোলে; কোনো ননদ নেই আমার। আসবে। সারাদিন গল্প শুধু।’—বলে জড়িয়ে কান্না। শিলাও কাঁদে। পূর্ণিমার রূপ দুর্দান্ত। দুর্লভ আলো তার।
দু’জন আলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলো, ওরা বন্ধু হবে।
পূর্ণিমার আলো কমে যায়। মাসারাতের স্বামী বলে, ‘শিলা, মাসারাত এখনো ষড়ৈশ্বর্য। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। তাহলে এরকম ভাবনা কেন? মনে হয় সরে গেলে আমি, বোধহয় সুখী হবে মাসারাত।’
‘শিলা!’ তারপর বুকে মাথা রাখা।
চোখে লিপ্সা নেই! মিথ্যা দেখা যায় না!
আশ্রয়-প্রত্যাশী আবেগের এক স্রোত এসেছে কণ্ঠস্বরে।
শিলা নিজেকে সংযুক্ত করে।
লোকটির তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়।
শীত আসে। মটরশুটি আর রসের পিঠে শিলার প্রিয়।
একদিন সকালে সূর্যের আলো কম।
শিলা কড়াইশুটি পুড়িয়েছে বাঁশঝাড়ের পাশে।
মহব্বত আলি বলেন, ‘আগুন যেন বাঁশে না লাগে। পাতায় পাতায় কখন যে আগুন ধরে—দুষ্কর বোঝা।’ শিলা বলে, ‘বাবা, কাঁচা বাঁশে ঘুণ ধরে, আগুন ধরে না।’
উত্তরের চাপ ধোঁয়া—মেঘ ছুটেছে পুবে পেছনে, পাশাপাশি, বড়ো একটা ফাঁক রেখে সামনে একদল। দক্ষিণের মেঘ আবার রীতিমতো পশ্চিমে, ভঙ্গিমাটুকু স্ব-বিশ্বাসে ফুটন্ত। বড়ো অংশটুকু বেরিয়েছে। বিস্ময়ে বলা যেতে পারে, তীরগতিতে ডানপাশে সরে গেলো সে। মুহূর্তের ভেতর উল্টোদিকের সীমানা ডিঙিয়ে ফিরে এলো। উত্তরের প্রথম অংশটুকুকে মনে হচ্ছিলো পুবের দিকে যাচ্ছে, অকস্মাৎ বিজলির মতো জ্বলে উঠে কোণাকুনি গিয়ে পাল্টা ঘুরে এলো সে-ও। স্পর্শিত না হয়ে এতো তড়িৎ ফিরে এলো যে, এ-পক্ষ কিছুটা অবাকই হলো!
শিলা বললো, ‘সুন্দর খেলছে ওরা।’
মোশতাক দূরবর্তী উলুঘাসের দিকে তাকিয়ে বললো : ‘কারা?’
শিলা আনমনা। বললো, ‘হাডুডু।’
মোশতাক ভেতর থেকে সাড়া পাচ্ছিলো না। আর্দ্র স্বরে বললো, ‘কোথায়?’
শিলা বরফ-ঠাণ্ডায় বললো, ‘চলো।’
তুঁতেরঙা শাড়ি ছিলো পরনে, কালোবুটির, সিল্কের, আঁচলে কাজ, পাড় কালো।
সবুজ ব্লাউজ। ছাড়া চুল। তাতে হলুদ ফিতে বাঁধা।
ফর্সা নয় শিলা, অসিত, আর লম্বা-দোহারা।
বোঝা যায়: আবরণের গোপন অভিব্যক্তি। আঁটা; সূক্ষ্ম। মেঠোপথের এক সড়ক কোণে আচমকা কুর্চিফুলের কোনো একটি রঙে ভোরের সত্তায় উদ্ভাস ঘটে।
কাচপুর ব্রিজ ধরে হেঁটে এগুচ্ছে। হাঁটছে এলোপাথাড়ি। পশলা বৃষ্টি। শান্ত শীতলক্ষ্যা এখন লক্ষ্মীছাড়া। শরীরে ভার এসেছে। অঙ্গে বৃত্ত তৈরি করে যৌবন ঠেকিয়ে রাখতে চাচ্ছে, পাশাপাশি প্রকাশের ইচ্ছেও আছে। নিজে নিজে খেলছে, হারছে, জিতছে, হাসছে—কোনো আকাশ তার গা ভিজিয়ে দিলো বলে সূর্যের ওপর ফুঁসছে।
দূরবর্তী কয়েকটি গ্রাম সবুজে টইটম্বুর। তার ভেতর এক তালগাছ।
রাস্তার বামপাশে সবুজ আকীর্ণ জমিটুকু স্পষ্টই দৃষ্টিগোচরীভূত।
বিল পেছনে, পেরুতেই গ্রাম, পাশাপাশি ক্ষুদ্র সকল রিফুজি ঘর।
শিলা বললো, ‘ঘুরপথে গ্রামটা দেখে যাবো।’ মোশতাক বললো, ‘পথে আরেকটি গ্রামও পড়ে—নিমাই কাশারী, চাঁদ মিয়া রোড।’ শিলা বললো, না, আগে সে মুগরাপাড়া যাবে।
সরকারি রাস্তার দু’পাশ জুড়ে নানা প্রকারের গাছ। আশ্বিনে বাবলার নতুন পাতার ঝিকঝিকে আলো। কাঁটাগুলো এখন সূর্য-সূচ। দক্ষিণের বিলে একা একটা বড়ো হিজল। দূর থেকে লালই মনে হলো। পূর্বকোণে এর, থালার ভেতর যেন আধাখালি, সুজির বরফি-হালুয়ার মতো ত্রিকোণ জায়গায় হলুদ ধান। তার পাশে বিশ হাত হবে, সারি সারি সুপারি শেষটার মাঝে ছোটো এক অশোক, বোঝা গেলো, ভিন গোত্রেও শোকহীন।
‘সুপারি ফল এতো কঠিন কেন?’—বলে শিলা, ‘গাছটাকে বহুবার মাটি বদলাতে হয়। নইলে ভালো ফল দেবে না। তিনবার আলাদা আলাদা জায়গায় পুঁততে হবে। তবে শক্ত হবে। মাটিরা যে-সময় জড়িয়ে ধরে—সে-সময় সরে যায় বলে মাটি রাগ করে। ফলে গাছটা একহারা আর ফ্যাকাশে। ফলগুলোকে গুলটির গুরোল বানিয়ে ছাড়ে। কাঁঠাল দেখো উল্টো,…’—নাকের ঘাম মুছলো শিলা…. ‘ও তো মোটা। যে-জায়গায় পোঁতা হয় একেবারে গেড়ে বসে। জায়গা পাল্টিয়ে দিলে গোঁয়ারের মতো যে রোয়া দেবে তা ফ্যাসফেসে। বাবা এইসব না দেখে জমির দোষ দেয়। যতো পাকা কৃষকই ধরো—মন না বুঝে যত্ন নিলে হবে না।
দু’মাইল পার হতেই ব্রহ্মপুত্র এলো। কিছু বাদামি রাজহাঁস, খয়েরি, কিছু কচুরিপানা এবং নৌকাঘাটে লোকজন আছে।
‘আশ্বিন-কার্তিকে কাকের রঙ হয়।’ আঙুল দিয়ে শিলা উপবিষ্ট দুটিকে দেখালো। ‘পিঠের ওপরটুকু ময়ূরের পাখার মতো।’
‘মোশতাক বললো : পৌষ পর্যন্ত এই রঙ থাকে।’
‘বলতো, কাক না কোকিল কে ঠকে?’
‘মানে’—শিলা কখন যে কী বলে বোঝা মুশকিল।
‘রাঙামাটির ঘটনাটা বলেছিলাম?’
‘কোনটি।’
‘বাবার হরিণ শিকারের…।’
‘না।’
‘শোনো। অনেকদিন আগের কথা, জন্ম হয়নি আমার। মার সঙ্গে বাবার বিয়েও হয়েছে কিনা জানি না। জানি—বাবা যুবক। শিকারে হাত ছিলো নির্মম। একদিন হরিণ শিকারের শখ হলো। বাবা বেরিয়ে পড়লো। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো একজন লোক। লোকটি উপজাতি-সর্দার। তার ছেলের সাথে বাবার পরিচয়ও হলে। বাবা পরে বলেছিলো ছেলেটি ভালো। রঙিন মাথালি পরে কাজে যাচ্ছিলো। বাবা আর সর্দার হরিণ খুঁজে বেড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে একটা গাছের কাছে একটা হরিণ দেখে। বাবা আর সর্দার পেছনদিক থেকে নিশানা করবে বলে টিলার কাছে গেলো। বাবা বললো, ‘দ্যাখো সর্দার, গাছটার ওপাশে বোধহয় আর একটা হরিণ।’ সর্দার বললো, ‘খুবই ঝাপসা বাবু।’ বাবা বললো, ‘এক কাজ করি, জলার কোণ থেকে সামনে হরিণটাকে লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি করি। যেটা লাগে লাগুক’—বলেই বাবা গুলি করলো। সামান্যর জন্যে বেঁচে গেলো হরিণটা—লাফ দিয়ে পালিয়ে গেলো। আর গুলিটা সাঁ করে বেরিয়ে গেলো গাছ ফুঁড়ে।’
‘আর অন্যটা?’ প্রশ্ন করে মোশতাক।
‘অন্যটা হরিণ ছিলো না। সর্দারেরই ছেলেটা। মাথায় মাথালি দিয়ে ঝুঁকে কাজ করছিলো যে বোঝা যায়নি। গুলির ছররায় ওর কান-চোয়াল ছিঁড়ে একাকার।’
‘ছেলেটা বেঁচেছিলো?’
হ্যাঁ, তবে ‘হরিণটা যে একটু হলে মরতে যাচ্ছিলো, ভাবছিলাম, তাই ভাবছো!’
ঈশা খাঁর সোনারগাঁয়ে ওরা যখন পৌঁছায়, মধ্যাহ্ন প্রায়।
অন্তর্গত-অস্তিত্বে একা থাকে মোশতাক। জানা: শিলার পাশে নীরবতা সঙ্গত। ঘনিষ্ঠ দুইজন একত্রিত হলে একজন অতি নীরব হয়ে যদি যায়, অন্যজন অজ্ঞাত কারণেই অস্বস্তিতে ভোগে। সে তখন কথা শুরু করে। মোশতাকের এই নীরবতা শিলাকে তাই শুধু নিরাপত্তাই দেয়নি, উন্মুক্ত হবার তাগাদা বোধ করিয়েছে।
নিজে অংশত ভবঘুরে। ভবঘুরে মানুষের স্বপ্ন কিংবা মোহ থাকে না।
শিলাকে তার ভালো লেগেছে এই জন্যে, শিলা নিজের গতির আপন-নির্ধারক। শিলাকে প্রথমদিনে এরকম মনে হয়েছিলো:
এক সকালবেলা। শাদা জিন্স-প্যান্টের ওপর করমচা রঙের শার্ট পরনে। শিলা এর একবছর পর বলেছিলো, পোশাকে তাকে সেদিন ভালো লেগেছিলো শিলার। যাই হোক, রাস্তায় যানজট।
মোশতাক রিকশায়।
‘শুনুন এই যে’—নারীকণ্ঠে ঘাড় ফেরালো মোশতাক।
তার রিকশা স্পিড দিয়েছে। পনের/বিশ হাত দূরে অন্য একটি রিকশা থেকে একটি মেয়ে শাদা একটা মাইক্রোবাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছে। মেয়েটি যে-রিকশায়, সে-রিকশাওয়ালা বৃদ্ধ। দুজন ট্রাফিক সার্জেন্ট যানজট ছাড়াতে তৎপর। মাইক্রোবাসটি মোশতাকের রিকশার পাশে গতি কমিয়েছে।
খালি গাড়িটির আরোহী বলতে একজন যুবক—স্টিয়ারিং হাতে। কোনো কোম্পানির কার্যনির্বাহী।
যুবকটি তাকায়—মোশতাক যখন বলে, ‘শুনুন; আপনাকে একজন ডাকছেন’—বলার সঙ্গে মোশতাক পিছনে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে। বুড়ো রিকশাওয়ালা তাড়াতাড়ি টানার চেষ্টা করছে, ইতোমধ্যে যানজট খুলে যাচ্ছে। যুবকটি মাথা নাড়ায়, মোশতাকের মনে হয়, নিশ্চয় টার্নিং পয়েন্ট পার করে গাড়িটাকে আগে পজিশনে নিতে চাচ্ছে। অথচ মুহূর্তের মধ্যে, পরবর্তী সময়ের দুটি বিষয়কে সে উপেক্ষা করতে পারে না। এক: ভুশ করে মাইক্রোবাস অতি দক্ষতার সাথে বাঁয়ে স্পিড নেয়। দুই: মেয়েটার রিকশা ততোক্ষণে মোশতাকের রিকশার পেছনে। বুড়ো রিকশাওয়ালার টাইম হয়ে যাচ্ছে বলে রিকশা ছেড়ে দিতে বলছে।
ধারে-কাছে খালি রিকশা নেই।
মোশতাক রিকশা থেকে নামে।
‘কোথায় যাবেন?’
‘বাস স্ট্যাণ্ডে।’
‘এখন রিকশা পাবেন না।’
‘দেখি।’
‘আমারটা নিতে পারেন।’
‘আপনি?’
‘হেঁটে যেতে পারবো।’
নিজের ভাড়াটা মিটিয়ে দিচ্ছে মোশতাক, এমন সময় সেই কণ্ঠের আহ্বান এলো, ‘এই রিকশায় কিছুদূর যেতে পারেন।’
‘আমি জানিয়েছিলাম আপনি ওকে ডাকছেন।’
‘ব্যস্ত ছিলো হয়তো।’
‘আমার সন্ত্রস্ত মনে হলো।’
‘হয়তো।’
পরে শিলা বলেছিলো। ওই ছেলেটা একটি মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটির সাথে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। যুবকটি ও তার পরিবার শিলাদের পরিচিত। দুটি পরিবারই চায় শিলার সাথে যুবকটির বিয়ে হোক। শিলা বলেছিলো দেখা হলে আমি শুধু এটুকুই বলতাম: ‘সে রাজি না হয়। অথচ নিশ্চয় ভাবলো আমি নিজেই উদ্যোগী।’
বসেছিলো দু’জনে। এক মন্দিরের পায়ে।
কাদা দিয়ে অনেকরকম গড়ন তৈরি করেছিলো কেঁচোরা! শিলা ভাস্কর্য দেখার মতো সেগুলো দেখছে।
মোশতাক গাছগুলো দেখছিলো। হরেকরকম গাছ!
মোশতাক দেখলো সবগুলো গাছই প্রায় সমান উচ্চতা ধারণ করে আছে। সে বললো, ‘শিলা, প্রতিটা গাছের উচ্চতা আর গড়ন একই রকম কেন?’
শিলা কেঁচোর তৈরি শিল্পকাদাগুলো লক্ষ করছে। বললো, ‘বলছি।’
মোশতাক ভাবলো বাংলার মাটিতে বারো ভুঁইয়াদের অসীম সাহসের কথা। শৈশবের পাঠ্যপুস্তকে সে পড়েছিলো দ্বন্দ্বযুদ্ধে মোঘল সেনাপতি মানসিংহের তলোয়ার ভেঙে গেলে ঈশা খাঁ আর একটি তলোয়ার ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। —এ-সময় শিলা তাকে বললো, ‘সবজায়গায় লক্ষ করো কেঁচোদের এই ফর্মগুলো রোদে কখনও শুকিয়ে শক্ত হয় না। দিনে-দিনেই বিলীন হয়ে যায়, রোদে শক্ত হয় তখন তা ঢেলা হয়ে যায়। শিল্প থাকে না—
‘কেন?’—বললো মোশতাক।
‘ওরা অমরত্ব চায় না। আর এই গাছগুলো উদার—অন্যকে অতিক্রম করে বড়ো হতে চায় না।’
উদ্যান ছাড়িয়ে ওরা পানাম বিলে নৌকা নিলো। নৌকার মাঝি বালক। জুলাস।
নারিকেল, হিজল আর কুলগাছের প্রাচুর্য লক্ষ করলো। মাঝে মাঝে পানকৌড়ির চিত্রল গতিরেখা।
শিলা বসলো নৌকার অগ্রমুখে। ছৈয়ের ওপাশে জুলাস। ছৈ সমান লম্বা সে—দাঁড়িয়ে নৌকা ঠেলছে, মোশতাক ভেতরে চাটাইয়ে হেলান দিয়ে শিলার সামনে।
আট হাত পানি হবে। শিলা চোখ ভরে দেখছে।
রোদ কমে আসে। হু হু নির্জনতা।
ছোটো বিলটুকুর ব্যাপ্তি ও ঔদার্য আচমকা গভীর হয়ে উঠতে থাকে। একটা কমলা ফড়িং শিলার কান ছুঁয়ে জুলাসের কাছে চলে গেলো।
স্ফটিক জলের তলে শৈবালের সৌকর্য। দাম আর ফেউলির দুরন্ত আধিপত্য। সঙ্গে মুলারি, ঘেচুর সংহত বিস্তার। শিলা একটা শৈবাল বংশের ক্ষুদ্র উদ্ভিদখণ্ড দেখিয়ে বললো, ‘কানের দুল, না?’—বলে হাতে তুলে নিলো। নীরব জলবেলায় কখনও পানির গভীরতা অতলস্পর্শী, কখনও-বা সারল্যের ছোঁয়া—সেই বৈপরীত্যের ওপর পই-পই করে নৌকা চলেছে।
জলে শাপলা, শালুক আর কাশের সমারোহ। মোশতাক একটা শাপলা পানির ভেতর হাত দিয়ে চেষ্টা করলো তুলতে। ছিঁড়ে এলো অর্ধেকটা ডাঁটাসহ।
শিলা বললো, ‘শাপলা ডুব দিয়ে তুলতে হয়।’
শীতল বাতাস, সঙ্গে মেঘলা দিন! আর স্তব্ধ আমন অঞ্চল—যা প্রয়োজন আর পূর্ণতায় বিরাজমান—সেইমুহূর্তে, নিজেকে অতিক্রম করে মোশতাক জানালো, বিশ্বাসে জানালো যে, শিলাকে সে ভালোবাসে। ওকে অনুভব করে।
শিলা বললো, ‘আমি ভাগ্যবতী।’
তখন বেজোড়া ঘুঘু খুব সতর্কতা নিয়ে নৌকার শব্দে, আকাশ হতে আমন ক্ষেতে চলে গেলো। শিলা বললো, ‘ওকে সতর্ক করেছে শিকারিরা।’
শিলা ও মোশতাক কাছাকাছি এলো। ঘুঘুটা যেদিকে ঢুকে পড়েছিলো—নৌকা বাইতে বাইতে সেদিকে তাকিয়েছিলো জুলাস।
মোশতাকের দেহে কম্পন আসে।
শিলা নিজেকে সমর্পণ করে। জুলাসের উপস্থিতি ওরা ভুলে যায়।
প্রগল্ভতায় পরস্পর একত্রিত হয়। দুটি প্রাণীর যে উদ্যম, তাতে প্রমোদ-চঞ্চল হয়ে ওঠে চারপাশ।
উত্তুঙ্গের মুহূর্তটুকু দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এক উদাসীনতায় আচমকা শিথিল হয়ে যায় মোশতাক। যেন দুঃসহ ক্লান্তি আর যন্ত্রণা তার শিরদাঁড়ায় ছোরা মারে।
শিলার প্রতিক্রিয়া নেই! যা করেছে সময়টুকুর জন্যে।
আনন্দ-উদ্ভাসিত মোশতাক হুপ করে নিভে যায়।
শিলা স্পর্শিত—চোখে প্রণয়স্মিত আনন্দ নেই!
শিলার সূক্ষ্ম এই অভিনয়টুকু মোশতাককে পীড়া দেয়।
তার মন বলে: এ প্রতারণা? যার সুযোগ নিজেই সে দিয়েছে।
তিন-তিনটি বছর পরে নিজেকে আজ এভাবে উন্মুক্ত করেছে। এতোটা দিন শিলাকে মমতায় অনুসন্ধান করেছে। মনে-মনে গর্ব করেছে শিলার জীবনের অন্য প্রাণিকুলের মতো সে নয়, সে বিশ্বাস দিয়ে জানিয়েছে সে শিলাকে ভালোবাসে। শিলা বলেছে, ও ভাগ্যবতী। তাই অনেক আকাঙ্ক্ষায়, স্পৃহায় আজ শিলাকে স্পর্শ করেছে।
নিবেদনটুকুর মূল্যায়ন হওয়া উচিত ছিলো!
কেন তা মরীচির মতো বিভ্রান্ত হবে?
মন বলে, কেমন পুরুষ সে, একটি যুবতীর মন ও শরীরকে নাড়া দিতে পারেনি!
তার সত্তা, ওষ্ঠ, এতোই কদর্য!
তবে কি শিলার হৃদয়-অন্তরালে কোনো অনুরাগ নেই!
শিলা পানিতে কী যেন দেখছিলো, মোশতাকের মুখের দিকে হঠাৎ তাকিয়ে বললো, ‘ভাবছো কিছু! কেমন আনমনা?’
‘না,’—বলে মোশতাক জুলাসকে ঘাটে নৌকা ফিরাতে বললো।
শিলা বললো, ‘মোশতাক।’
মনটা বিষিয়ে উঠেছে মোশতাকের। কোনো প্রতিউত্তর দিলো না।
সারা দিনের সমস্ত আনন্দ আর্তনাদ-পীড়িত এক অনুভবে ঝরে গেলো। বাস বদল করলো।
শিলাকে মোশতাক যখন বাসায় পৌঁছে দিলো তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ।
আকাশে নক্ষত্রবীথি।
সে-তারার মালার দিকে অঙ্গুলি দিয়ে শিলা বললো, ‘ওটি কী?’
মোশতাক বললো, ‘নক্ষত্রদের একটি হবে।’
শিলা বললো, ‘অশ্বিনী—দক্ষিণায়নের!’
মোশতাক বললো, ‘আসি।’
শিলা বললো, ‘কাল আসবে?’
মোশতাক বললো, ‘দেখি।’
শিলা বললো, ‘কেন?’
মোশতাক বললো, ‘আমি সুন্দর ভালোবাসি। সুন্দর আমার আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, উচ্ছল মানসিকতা সন্ধান করি।’
শিলা মোশতাকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয় মোশতাকের। ঘর মানে দালান-বস্তি।
তিনকাঠা জমির ওপর ঘর আটটি—সেখানে ছয়টি সংসার।
দুটি পায়খানা। গোসলখানা একটি। রান্নাঘর একটি। চুলো তিনটি।
একটি গ্যারেজের অর্ধেকের একটু বেশি অংশ-সমান একটি ঘর মোশতাকের।
ওপরে টিন দেয়া। উঠোনের কোণে একটা টিউবওয়েল।
দুটি ঘরে ইলেকট্রিসিটি এখনও অব্যাহত। মোশতাক আর বৃদ্ধ মাতালের ঘরে।
অন্যান্য ঘরগুলো বিল শোধ করতে পারে না বলে আলোর সংযোগ থেকে বিমুক্ত। তবে সুবিধা যে, পাশের দালানগুলোর জানালা-নির্গত আলো এখানে পড়ে।
পথে, রাজপথে, রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে ভাত আর আলুর তরকারি চার টাকায় খেয়ে নিলো। এক প্যাকেট স্টার কিনলো।
ঘরে একটা চৌকি আর একটা টেবিল। পুরনো টেবিল ল্যাম্প।
তার জুড়ে জুড়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ টেবিল থেকে প্লাগপয়েন্ট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মোশতাক লক্ষ করলো, আজ চেচাঁমেচি কম! মাতাল বৃদ্ধটি এখনো ঘরে ফেরেনি। গার্মেন্টসে চাকরি করা মেয়েটি রান্নাঘরে নেই! বাদল মিয়াও সম্ভবত ফেরেনি। শিক্ষিত লোক। মুদিখানার মালিক। রাতে এসে টিউবওয়েল থেকে অবিরাম পানি তুলে ঘণ্টার অধিক সময় নিয়ে গোসল করে।
হাবিব চাচার ঘরে ক’দিন ধরে সাড়াশব্দ কম। বাপ-মেয়ে দুজন থাকে। হাবিব চাচা ঠোঙা বানায়। বিলকিস সে-ঠোঙা দোকানে দোকানে বিক্রি করে।
মোশতাকের ধারণা, বিলকিসের কোনো অসুখ হয়েছে।
ওদের ঘর মোশতাকের ঘরের পাশাপাশি। তিন-চারদিন আগে শুনেছিলো হাবিব মিয়ার চাপা ক্ষোভ। মোশতাক অনুমান করে, বিলকিস যতোগুলো ঠোঙা প্রতিদিন বিক্রি করে তা শুধু ঠোঙার গুণে নয়। সারাদিনের শ্রমের সঙ্গে যৌন আবেদন রাখতে হয়। সম্ভবত আবেদনটুকু এখন নিবেদনের পর্যায়ে চলে এসেছে।
তালা খুললো মোশতাক।
একরাশ ভাবনা তার মাথায় চাপ সৃষ্টি করলো।
হাতেমুখে পানি দিলো না।
সরাসরি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।
আজ শিলাকে নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলো।
তারা একে-অপরের কাছেও গিয়েছিলো—তার সূক্ষ্ম মন তাতে সন্তোষ লাভ করেনি।
শিলার ভেতর যতোটুকু নিবেদন দেখেছিলো ততোটুকু উৎসাহ দেখেনি।
সে কী? মিথ্যে বলবে না মোশতাক; সে প্রেমিক।
শিলার জীবনে যে-দুজন এসেছিলো, তারা প্রেমিকও নয়, সৈনিকও নয়।
তারা ছিলো তুখোড়।
শিকারকে মমি বানিয়ে রেখে গেছে।
মোশতাকের সঙ্গে মহব্বত আলির সম্পর্ক দীপ্ত রসিকতার।
আজও তাই। বলেন, ‘ভাঙাচোরা একজিনিস আর ভারসাম্য একজিনিস, মানলাম। কিন্তু ভাঙতে গিয়ে যদি ভারসাম্য হারিয়ে যায় লাভ কী? পাগল হয়ে যাবে?’
মোশতাক বললো, ‘আমি চাইবো সুস্থ থাকতে।’
মহব্বত আলি বলেন, ‘তুমি আগে হবে।’
মোশতাক উত্তর দিতে যাচ্ছিলো। রিজিয়া সুলতানা এ-সময় আসেন।
বিশেষ প্রয়োজনে এসেছেন—আগমনের ভঙ্গিমায় তা রয়েছে।
স্বামীর দিকে তাকালেন। সরাসরি বসলেন মোশতাকের পাশের চেয়ারে।
সময় নিয়ে কথা বলেন। সবই মোশতাকের জন্যে!
তাঁর কথার সারাৎসার: মা হয়ে শিলাকে বোঝা উচিত ছিলো, যা তিনি পারেননি। শিলা কেন আনমনা থাকতো, কেন প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়েছিলো, তিনি জানেননি। শিলার যখন দশ বছর, রাতে ঘুম থেকে বেরিয়ে বাইরে ঘাসের সাথে গিয়ে কথা বলতো। এ-রকম দু’দিন তিনি দেখেছেন। শিলা একমাত্র জীবিত সন্তান। তিনি তাকে আদর করে উইল হেলমিনা বলে ডাকেন।
শিলার বয়স বেড়েছে। সুলতানা একটি বিষয় লক্ষ করেছেন, মোশতাকের সঙ্গে মেশার পর শিলার স্বাভাবিকতা বেড়েছে।

শিলার মুখ সিক্ত হয়ে ওঠে।… ঊর্ধ্বাকাশের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে।…‘আকাশ যতোই মায়া হও, তবু বজ্রপাতের পাশে কে বৃষ্টি দ্যায়? পাহাড়, তুমি কেবলই রাশভারি? শরীর জুড়ে কেন এতো ঘাস আর লতাগুল্ম?

শিলা ছোটোখাটো বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছে। তিনি এখন চান শিলার বিয়ে।
কিন্তু শিলা বিয়ের বিষয়ে রাজি নয়।
মোশতাকের দিকে তাকান রিজিয়া সুলতানা, অনুরোধ করেন—মোশতাক যেন দায়িত্বটুকু নেয়। শিলা যাতে সম্মতি দেয়। তাদের হাতে উপযুক্ত ছেলে রয়েছে।
বুকের ভেতর কাঁপুনি স্থির হয়ে গেছে। ভেতরের কম্পনটুকু গোপন করতে কষ্ট হচ্ছে মোশতাকের। কোনোভাবেই রিজিয়া সুলতানা যেন বুঝতে না পারেন।
অবাক হচ্ছে মোশতাক মহব্বত আলিকে দেখে। তিনি কেন উদাসীন?
পোড়-খাওয়া একজন। তার মুখে ধীর বেদনা?
কার কথা ভাবছেন? স্ত্রীর, কন্যার, নাকি নিজের? রিজিয়া সুলতানা কথা আদায় করে দোতলায় চলে গেলেন।
‘আর কী কী বললো?’
‘ওইটুকুই।’
‘কথা দিয়েছো, তাই কি রাখতে যাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কবে থেকে শুরু করবে?’
‘কী?’
‘তোমার দায়িত্বটুকু?’
‘এখন থেকে!’
‘কী করলে অব্যাহতি পাবে?’
‘তুমি সম্মতি দিলে।’
পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে মোশতাক বলে।
শিলা খবরের কাগজের একটা পোটলা খোলে। সেখান থেকে চিনি বের করে।
চিনির দানাগুলো পুকুরঘাটের ঠ্যাসের পেছনে ছিটিয়ে দেয়।
মোশতাক লক্ষ করে, কিছুক্ষণের ভেতর লাল সারি সারি পিঁপড়ের মুহুর্মুহু সমাগম দেখে শিলা খুশি হচ্ছে।
পুকুরটা ঘিরে অসংখ্য যে লম্বা-চওড়া সব গাছ, তারা, মনে হয় মোশতাকের, শিলাকে চেনে।
উলোটকমল থেকে এক চন্দনা বহুক্ষণ ধরে ডাকছে। একটা বেলের গায়ে কালো কাক সময় নিয়ে নাচলো, বকলো, উড়ে গেলো চিৎকার দিয়ে।
পুকুরের পানিতে কয়েকটি পুঁটিমাছ থির থির করে ওপরমুখে লাফ দেয়। সূর্যের আলোয় ঝিলিক করে উঠেছে গলার লালগুলো। শিলা বললো, ‘এরা এখন ঋতুমতী। মেয়েপুঁটির শরীরে একবার লাল আসে। পুরুষটাকে বেছে নিয়ে আসে স্রোতের কাছে। তারপর ডিম দেয়া শেষ হলে লালটা মিলিয়ে যায়।
‘গোরুটা কেন ছুরি এনেছিলো!’
‘কোন গোরুটা?’
‘ঝিনেদার গোরুটা?’
‘ভাবিনি আর।’
‘আশ্চর্য!’
‘বলো তুমি?’
‘থাক।’
‘না বলো, কেন এনেছিলো, ছুরিটা?’
‘মালিককে দড়িটা কেটে দিতে বলেছিলো।’—শিলা বিরক্তভাবে বললো।
পুকুরের চারধারে সূর্যের আলোর সমবণ্টন আছে। সবখানে রোদ।
তার ওপর পানি, পাখি আর বৃক্ষের প্রাণপ্রাচুর্য। ভালো বোধ করছে না মোশতাক।
দু’জন হাঁটছে। কখনও সে, কখনও শিলা আগে-পরে হচ্ছে। শিলা কাঠঠোকরার বাসা দেখালো।
মোশতাক দেখতে পায় না। শিলা পিছনদিকে হাত ঘুরিয়ে দূরে একটি জায়গা নির্দেশ করে বলে, ‘ওখানে যাবে না?’ মোশতাক বলে, ‘বৃহস্পতিবার।’ শিলা বলে, ‘এতো দেরি?’
পুকুরের চারপাশে তারা প্রদক্ষিণ করে সময় নিয়ে।
বৃক্ষ আর জবুথুবু মাটিসহ সূর্যরশ্মির ও প্রকৃতির আলোকালো প্রবণতার মুখোমুখি অপরাহে ওরা সুখ আর বেদনায় একীভ‚ত; অনেক ভাব আর টুকরো অনুভ‚তি থার্মোমিটারের মতো কার্যকরী এবং পরবর্তী সময়ে শীতলতায় শীর্ণ; তাই, কখনো ঠুংঠাং ভেঙে পড়ার আতঙ্কে দারুণ মুমূর্ষু। সত্যের, হারিয়ে যাওয়ার এ-উৎকণ্ঠা, ভয়, কালক্রমে মনে রেখাপাত—বিযুক্তির: ‘মোশতাক, যদি মারা যাই, কাঁদবে?’
‘হ্যাঁ, তার আগে দায়িত্বটুকু করি।’
শিলা হাসে।
রিজিয়া সুলতানা ডাক দেন। শিলার সাইকেলের বেলবাটিটা বেলের ওপর দেখা যাচ্ছে না। শিলা বলে,
‘মনে থাকে যেন বৃহস্পতিবার সকাল।’
ঘটনাটা উড়ে আসা হাঁসের ঝাঁকের মতো আচমকা। এ-রকমই হোক আর অদৃষ্টের বিস্ময়কর লীলা হোক, তার আবির্ভাব হয় এক বৃহস্পতিবারে। যেহেতু তা শিল্পেরই সত্য, সংলগ্ন রূপকের প্রয়োজনীয়তা, তাই ভরে ওঠে সূর্যের ছটায়, পবিত্র মাটি আর হাওয়ার গন্ধে আর শহর থেকে বিশ মাইল দূরে সাঁওতাল পল্লীর দু’মাইল সম্মুখে এক যৌক্তিকতায়। সুবেহ সাদিক। আকাশে বিশাল এক জ্যোতি দীর্ঘাকার। সূর্যের দিক থেকে নির্গত; মধ্য-আকাশের দিকে উঁচুতে বেপরোয়া উঠে যাচ্ছে। মোশতাক লক্ষ করে: খরার ঝলক। আকাশের নীল যেন ইউক্যালিপটাসের মলিন সবুজ পাতার সাথে মৈত্রীসত্তার এক চিত্রলেখা। স্থির মেঘ। গতিহীন।
এক মাদকতা দীপ্ত মেঘের সূর্যে নিমগ্ন। পুরো চার ঘণ্টা লাগে। চারপাশ শুনশান। শুধু গা-ছমছমে অনুভূতি। ঘন শাল, গজার আর শিমুলের একচ্ছত্র অস্তিত্ব মোশতাকের চিত্তে ভীতিকর অনুভূতি জাগায়। অরণ্যের ভেতর হতে এক সরুপথ দক্ষিণমুখী…সেখানে কয়েক একর জুড়ে বর্ণাঢ্য বিস্তৃত শবজিক্ষেত। পূর্বে, বেশ দূরে, পাহাড়। নির্জনতা ও নীরবতা বিরাজিত। শিলার আত্মতৃপ্তির উদ্বেলতায় চতুর্দিকে প্রশান্তির পরশ। মাঝেমধ্যে লতাগুল্ম; তার ভেতরে আছে ভিজে বালি। পশ্চিমপাশে উঁচুনিচু মাটির স্তূপ! পেছনে সমান্তরাল ছোটো ছোটো খানকয়েক টিলা। তাদের গায়ের ওপর আঁকড়ে আছে সরস ঘাস। ফিকে-নীল কাঁটাঝোপ।
মোশতাক লক্ষ করে, সজীব সতেজতায় ফুটে উঠছে শিলা।
অসামান্য সৌন্দর্যে বিকশিত হচ্ছে!—বিস্ময়ে ও চেয়ে আছে: ঝিরঝিরে হাওয়ার দিকে মুখ করে পুবের ঘাসগুলো শুয়ে পড়েছে যে-সময়।
সে নিজের সৌন্দর্যে থ’! রূপ ও রঙের সম্মিলনে।
দূরে স্তূপীকৃত মাটির সোজা রেখায় খাঁজকাটা টিলার চ‚ড়াগুলো দৃশ্যমান। দক্ষিণ-পশ্চিমে সারি সারি সবুজ। পাশাপাশি সীমাহীন জমির ওপর নিস্তব্ধতার ধোঁয়াটে আভাস। শিলা হাঁটে পাতার উপর শব্দের সাথে।
পিঠের ওপর দুলছে মোটা কালো বেণী।
অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেছে।
বড়ো বড়ো শালপাতা ঝুরঝুর করে চূর্ণ হচ্ছে।
গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো সামঞ্জস্য বজায় রাখে।
জন্তু বলতে কেবল একটা গিরগিটি দেখা গিয়েছে।
শিলা নিপুণভাবে হাঁটে।
সকাল থেকে এ-অবধি।
শিলার মুখ সিক্ত হয়ে ওঠে।… ঊর্ধ্বাকাশের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে।…‘আকাশ যতোই মায়া হও, তবু বজ্রপাতের পাশে কে বৃষ্টি দ্যায়? পাহাড়, তুমি কেবলই রাশভারি? শরীর জুড়ে কেন এতো ঘাস আর লতাগুল্ম?
শিলার দিকে মোশতাক তাকিয়ে। সৌন্দর্যে অভিভ‚ত হতে চায় না।
এই সৌন্দর্য তার অভিসারকে ব্যর্থ করেছে। পাশাপাশি চললেও এখনও শিলার নিকটবর্তী হতে পারেনি। অথচ শিলা স্থিরতাবিহীন এক সঙ্গতিতে অবিরাম চলছে।
শিলার শরীরে হলুদ কামিজ আর বটলগ্রিনের পাজামা।
বুকে কাচ, গুজরাটি নকশায়। ভেলভেটের সবুজ ওড়না। পায়ে কাশ্মিরি স্লিপার। বনের ছায়াঘন রহস্যের মাঝে শিলাকে মনে হয় কৈশোর-উত্তীর্ণ এক বনপরির প্রতিবিম্ব। মুখের একপাশে ছিটকে এসেছে রোদ। একঝলক ঠাণ্ডা খোলা বাতাস শিরশির করে নেমে এলো।
সম্মুখের জায়গাটা পরিচ্ছন্ন। সুদূর পানে সরাসরি শবজিক্ষেত!
শিলা শবজিক্ষেতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।
শিলার বিস্ময়াপ্লুত মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায় মোশতাক। তার মনে হয়, অরণ্যের অভ্যন্তর থেকে এক তীব্র শক্তির নীরব সন্ত্রাস মোশতাকের মুখোমুখি হতে চায়! শিলা সেই শক্তির পক্ষপাতী! তার স্পর্শে শিহরিত স্ফুটনোন্মুখ লজ্জাবতী পাতার মতো সুস্মিত হয়ে যায় শিলার মুখশোভা।
‘শিলা,’—ক্লান্তস্বরে মোশতাক ডাকে।
তখনি সে বেশি বিচলিত হয়। শিলা নিরুত্তর। আনমনা।
বনবীথিকার ভেতর তৃষ্ণার্ত দুই চোখে দূরান্তের শবজিক্ষেতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আকাক্সক্ষার এ-স্বপ্নময় আবেশ কম্পিত করেছে সহসা।
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছে শিলা। যেন কী দেখতে পেয়েছে।
বনপথের থেকে এক রশ্মি শিলার মুখমণ্ডলে ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়।
কয়েক পা এগিয়ে ও থামে। চিন্তা করে। তারপর পা চালায় দ্রæত।
সরু পথটা বড়ো বড়ো শিমুল গাছের ছায়ায় ঢাকা। মাঝে মাঝে তাদের ধূসর-খয়েরি কাণ্ড আর শ্যাওলা-ঢাকা নিচু ডালগুলোর ফাঁক দিয়ে চলমান শিলা অস্থির বল্গাহরিণ।
শিলা পা ফেলে আড়াআড়ি: একঘেয়ে আঁকাবাঁকা পথ। ঝমঝম ঝমঝম নৈঃশব্দ্য!
শিলা গাছ-পাতা-ডাল-লতাগুল্ম অতিক্রম করে।
পেছনে মোশতাক বারবার বাধাপ্রাপ্ত!
তার যাবতীয় দ্রোহচৈতন্য টুকরো টুকরো হয়!
অন্তরের বেদনার ধ্বনি অবিরত জানিয়ে দেয় এতোদিন পর এক শক্তির প্রতি আন্তরিক হয়ে উঠেছে শিলার প্রেম!
ঘনগভীর নিস্তব্ধতায় বাতাসের স্পর্শ হিমশীতল, নিষ্ঠুর। গাছের উপরে উঁচুতে নীল আকাশ। আগের চেয়ে মৃদু স্বচ্ছ। দেখে, মোশতাকের বুকের নিশ্বাস হঠাৎ ভীরুতার বেদনায় দংশিত হয়। তার হৃৎপিণ্ডের অভ্যন্তরে অন্ধকার স্পর্শ করে।
শিলা বন পেরিয়ে উন্মুক্ত মাঠের দিকে।
দিগন্তরেখায় আটকে রয়েছে মেঘের চাপ।
এক চিলের তীক্ষ্ণ আর্তস্বরে হঠাৎ বুকের মধ্যে মোশতাকের ধ্বক করে ওঠে। শিলাকে সে নিজের করে নিতে চেয়েছিলো! তা এখন চূর্ণিত পাতার মতো; হয়তো ভুল করেছে! ভুল করেছে প্রত্যাশা করে। হয়তো তার আহ্বানের ভাষা সঠিক না। হয়তো প্রকাশ-পন্থা জানে না।
শরৎ গিয়ে হেমন্ত এসে পড়েছে!
মাঠভরা নানারঙের লাল শাক। বয়সের সঙ্গে এদের রঙ পরিবর্তিত হচ্ছে।
দূর থেকে কখনো কমলা, গাঢ় লাল কখনো আলতাবর্ণ।
টিলার কোণাকুনি কয়েক একর জুড়ে শিশুর কোঁকড়ানো চুলের মতো ঘন লাল শাক আচ্ছন্নতায় আলোকিত।
শিলার বড়ো বড়ো চোখের তারাদুটোর দীপ্ত দৃষ্টিতে এক নৈসর্গিক স্পন্দন!
শিলা থামে না, আবার পা বাড়ায়।
পালং অঞ্চল পেরিয়ে, লাল শাকের ক্ষেত ছাড়িয়ে, দক্ষিণদিক বরাবর বাঁধাকপির অজস্র বিস্তার। অদ্ভুত ধূসর বাতাসে সেই কলাপাতারঙ ভাসছে কালচে-সবুজে। সঙ্গে রহস্যময়তা বাড়িয়ে দিয়েছে টিলার ঝিকঝিকে মাথাগুলো! শুকনো মুখে যেন জিভ দিয়ে টেনে নিচ্ছে মেঘের ধোঁয়াটে দুধ।
শিলা দণ্ডায়মান আচ্ছন্নের মতো। কখন যে আপনকার ওড়না কাঁধ থেকে নেমে পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করেছিলো খেয়াল নেই।
ভাবছিলো অধীরভাবে। স্পষ্টভাবে এইসময় কানে বাজলো এক শীতল গুঞ্জন!
মমতায় উপলব্ধি করতে চাইলো তা। চারপাশে তাকাতে লাগলো খুঁজতে খুঁজতে। ভেতর আর বাইরের নীরব কথোপকথনে ক্লান্ত হলো। তবু মনটাকে ভাঙতে দিলো না। নিজের গতিকে সচল করে রাখতে ও কৃতসংকল্প।
আকাশ ফিরোজা পাথর হয়ে গেলো! জ্যোতি এলো! সে-আলোয় টিলার ছায়াগুলোর বিস্তৃতি ও গভীরতা বাড়তে লাগলো। শিলা তির্যকভাবে তাকিয়ে রইলো উন্মুক্ত মাঠের দিকে।
শিলা মোশতাকের দিকে তাকালো…ভাবছে মোশতাক…হঠাৎ বেদনায় সজল হয়ে উঠলো চোখ। তারপর সেই আগমনকারীর প্রকাশ: তার রূপ, তার দাপট, তার গতি-প্রকৃতি অবর্ণনীয়! সম্ভবপর স্থাপনায়…
আনমনা ছিলো ওরা। সহসা এক আলোর ঝলকানি এলো। তীব্র।
সে-আলোর সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো অবিশ্বাস্য বিশাল ছায়া। আর একটা নীল কুয়াশা হূর্ণির মতো ছড়িয়ে পড়লো সারা মাঠের ওপর। সম্পূরক ওলোটপালোট করা ঝোড়ো বাতাস ও ধুলো। এলো : পৌরুষে ঢেকে দিলো মেঘের জলভরা ঊরুসন্ধিস্থল!

শিলা জ্বলজ্বল চোখে সামনের দিকেই ছুটছে আশ্চর্য!…শিলা ছুটছে শবজিক্ষেতের দিকে। মোশতাকের সবলে চেপে-ধরা হাত ছাড়েনি! বলে মোশতাক…‘না’… এ-স্বরে এমন আন্তরিকতা ছিলো যে শিলা মুহূর্তে ভেঙে যায়। এমনকি এইসব শব্দাবলী অতীব সূক্ষ্ম জায়গায় কোমল ঘা দিলে অভ্যন্তরে চেপে রাখা মায়াস্রোতটি আলোড়িত হয়ে নাকের বাঁশি আর ওষ্ঠের ওপর কম্পন তোলে…বিড়বিড় করে: ‘কী করবো—কী বলবো…প্রেমিক পিপাসিত জানি।

মাঠের শেষকোণে আনারস-বনের দূরবর্তী খাল থেকে লাফ দিয়ে ওপরে উঠেছে জলস্তম্ভ। সো সো শব্দের জোরালো বাতাস বিরতিহীন—মাঠঘাট গ্রাস করে ঝাঁপিয়ে আসছে উদ্যত ফণায়। পাহাড় দুলিয়ে মাঠের ওপর পাক দিচ্ছে অবিরাম। মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো মেঘ আর নীলচে সবুজ দৃশ্যসমূহ। অলক্ষুণেভাবে অস্থির হয়ে উঠলো বিস্তারিত বাঁধাকপির ক্ষেত-নির্গত কালচে আর সবুজাভ বর্ণ।
মোশতাক আঁকড়ে ধরেছে শিলার হাত। নিরাপদ দূরত্বই এখন বিচার্য: হৃদয়ের গভীর কোণে, ক্ষণে, সে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
শিলা জ্বলজ্বল চোখে সামনের দিকেই ছুটছে আশ্চর্য!…শিলা ছুটছে শবজিক্ষেতের দিকে। মোশতাকের সবলে চেপে-ধরা হাত ছাড়েনি! বলে মোশতাক…‘না’… এ-স্বরে এমন আন্তরিকতা ছিলো যে শিলা মুহূর্তে ভেঙে যায়। এমনকি এইসব শব্দাবলী অতীব সূক্ষ্ম জায়গায় কোমল ঘা দিলে অভ্যন্তরে চেপে রাখা মায়াস্রোতটি আলোড়িত হয়ে নাকের বাঁশি আর ওষ্ঠের ওপর কম্পন তোলে…বিড়বিড় করে: ‘কী করবো—কী বলবো…প্রেমিক পিপাসিত জানি। এ-নারীসত্তায় অপরিহার্য। কী করে তার সহযোগী হই! ত্রস্তলজ্জায় আমি যে হারিয়ে ফেলেছি সকল অনুভ‚তি। আমি তো স্বচ্ছ জলধারা নই। আমি ভালোবাসি সূর্য—রাত ও দিনের যুগপৎ উপস্থিতিতে যে লজ্জিত নয়। ভালোবাসি অরণ্য—কারণ সে আদিম।
বাতাসের বেগ প্রবলতর হয়ে ওঠে। মুখোমুখি কুয়াশার চক্রটা। বারবার সেই কুণ্ডলী ধূসর থেকে বেগুনি, বেগুনি থেকে শাদা—চলমান—কুশলী ভঙ্গিমায়।
মোশতাকের চোখ আটকে যায় ধুলো আর বাতাসে। তারই মধ্যে শিলা দৌড়াচ্ছে মাঠের দিকে।
শিলা পুনরায় বেদনার্ত; প্রকৃতির এই অনুপম সঞ্চরণশীল সারল্যের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্যে এই মন এখন খাড়া। আলিঙ্গন-সমুৎসুক ওর বাহুদুটি বাসনায় বিহ্বল।
তাকে কী করে ও রোধ করে?
মোশতাক চেয়ে আছে…।
তখনি বাতাসের এক প্রবল ঝাপটায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মোশতাকের হাত থেকে ছিটকে যায় শিলা।
আর্তনাদ করে পড়ে গেলো মোশতাক। এক বিষাক্ত নিশ্বাসবায়ু তার দম বন্ধ করে দিচ্ছে। সারা গায়ে ধুলোবালি।
বিপর্যয়ের পূর্ব-মুহূর্তটা পর্যন্ত মোশতাকের অনুভবে ছিলো, শিলা নিশ্চয় গতি রোধ করবে ফিরে আসবে, আবার চার ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে যাবে শহর অভিমুখে। আবার শিলার একটানা শব্দস্রোত…।
চারিধার তখন কুয়াশাচ্ছন্ন। মৃদু মেঘগর্জন। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হলো। প্রকট শব্দে প্রকম্পিত করে কয়েকটি গাছ মড়মড় করে ভাঙলো। আলো কমে আঁধার এলো।
বাতাসের গর্জনে চমকে চমকে উঠছে অরণ্য।
চলতে পারছে না মোশতাক। বারকয়েক হোঁচট খেলো। শিলাকেই ছুঁতে চাচ্ছে সে।
এদিকে ধুলোর ঝড়। বারবার এসবের ঝাপটায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। তারই মধ্যে হঠাৎ দেখলো, কৌশলে কুয়াশাকুণ্ডলী আস্তে আস্তে শিলাকে ঢেকে নিয়ে যাচ্ছে।
শিলার এই দুঃসাহসী উপেক্ষা তাকে বিভ্রান্ত আর হতভম্ব করে। পরক্ষণে অন্ধ এক শক্তিতে সে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে চায়—কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে। কোনোদিকেই যাওয়া সহজসাধ্য হয়ে ওঠে না। এক-একবার এক-এক ধোঁয়াচক্র তার গতিরোধক।…সে হামাগুড়ি দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে কিছু পথ অতিক্রম করে। আবারো সেই ধূসর আবর্ত, বদ্ধ আঁধারের ভেতর সোঁ-সোঁ বাতাসের টানা আওয়াজ…অনুমান করতে পারে : শিলা বেশ দূরে। অল্পক্ষণের ভেতর ওকে ফিরিয়ে না আনতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সমস্যা হচ্ছে ধোঁয়ার মতো চোখজ্বলা বাতাসে।
বাতাস ভেঙে ভেঙে পড়ছে সগর্জনে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চলছে তেজোদ্দীপ্ত গতিরেখায় : আর তাকে ঘিরে রেখেছে সেই নীল কুয়াশাকুণ্ডলী।
এক ভাবনায় বুকটা ধ্বক করে উঠলো। পিঞ্জর ছিঁড়ে সহসা বেরিয়ে যেতে চাইলো হৃৎপিণ্ড।…
হাতিশুঁড়! অবাক—হেমন্তে।
মুহূর্তকাল সে পুরোপুরি অনুভূতিশূন্য: পুনরায় যখন সজ্ঞানে, নিজের ভেতর অসংখ্য ভয়ের স্বর তাকে কোনোক্রমে সচল হতে সাহায্য করে। বিশ-পঁচিশ গজ এগোতেই হালকা হাওয়ার উপস্থিতিতে বিস্মিত হয়। অরণ্য-মাঠ-পাহাড়ের ওপর দিয়ে আচমকা আদিম এক নিস্তব্ধতা—দুর্বার বন্যতাকে কমিয়ে দিয়ে—অসম্ভব অসঙ্গতিতে নেমে আসছে। বাতাসের স্ফুলিঙ্গ, ঝড়ের সেই দাপট, বিল-উৎক্ষিপ্ত জলউত্থান যেমনভাবে এসেছিলো তারো চেয়ে ক্ষিপ্র বেগে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে।
একটা টকটক গন্ধ। আর গম্ভীর আবহাওয়া। আঁধার কাটেনি।
মাঠের ওপর দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে মোশতাক। ঢিবি আর সীমাহীন অসমতল ভূমি।
এক বন্য আলোয় তখনি মুহূর্তের জন্য শিলাকে সে দেখতে পেলো। স্বল্প কুয়াশায়। লাল শবজি ক্ষেতের মাঝে।…
দুঃসহ এক বেদনার আবেগে মোশতাক ছুটতে ছুটতে ডাকে:
দূর থেকে শিলার ঠোঁট নড়ে।…‘এই তো।’
আকাশে আলোর রঙ বদলিয়ে গেলো দৃশ্যপটের মতো, কুয়াশাটুকু গোলাপি, চকিতে লক্ষণীয়: টানটান হয়ে সেখানে ভাসমান হয়ে গেলো শিলা, পলকের মধ্যে ওর সারা শরীর বাম কাঁধ ও পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে শূন্যে বাঁকা হলো: আর আলোর ক্র‚র খেলায় গোলাপি কুয়াশাটুকু ফাঁকা ফাঁকা অথচ ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের জ্যোতি নিয়ে শিলার মুখমণ্ডলে, সোমত্ত দেহে, এঁকে দিলো রামধনুরেখা।
এ কী বিভ্রম! শিউরে ওঠে মোশতাক। সে পুনরায় ডাকে।…
সে ডাক আর্তনাদ হয়। কুয়াশাটুকু মুহূর্তে বুনোট হয়ে ওঠে।
পদে পদে অনন্ত শূন্যতা, তৎসঙ্গে উঁচুনিচু মাটিকর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত পদযুগল…গভীর অবচেতনায়—নিজের এই দীর্ণতায়—নিষ্ক্রিয় মূঢ়তায়—উন্মত্তপ্রায় সে যখন লক্ষ্যস্থলে পৌঁছলো—স্তব্ধ হয়ে রইলো বহুক্ষণ। সূর্যের আলোর আকস্মিক প্রখরতায় মিলিয়ে গেছে নিস্তব্ধ কুয়াশাশরীর। এই হুহু মাঠে, রেখে গেছে তার নিষ্প্রভ ধোঁয়াটে আভা।
মোশতাক তার পা বাড়ায় না আর। বহুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে। বহুদিন।
এলোমেলোভাবে চারপাশে তাকায়। বাতাস ছিমছাম; সূর্যটা ভয়ানক উজ্জ্বল আর লাল।
মাথাটা ঝিমঝিম করে। দৃষ্টিটা শবজিক্ষেতের ওপর থেকে নড়ে না।
মোশতাক একা। তার সান্নিধ্য ছেড়ে এক শক্তির কাছে চলে গেছে শিলা। অনুক্ত কান্নায় সে অনুভবরত: এই টিলা—অরণ্য—এই মাঠ, এরা সবাই দুর্বোধ্য আকারহীন এক অবয়ব: অর্জনের নিমিত্তে অফুরন্ত তৃপ্তির উদ্ভাসে তারা আজ দীপ্ত। মনে হয়: এই নিস্তব্ধতা, তার আর শিলার অনন্ত বিচ্ছেদের মাঝে, তার মানসিক নির্জনতার নিভৃত সঙ্গী। আকাশে ঝরঝরে আলো। হাওয়া বইতে শুরু করেছে পাহাড়ের দিক থেকে: ঝড়হীন, বৃষ্টি নেই। কুয়াশার ছিটেফোঁটা নেই। সবুজভ‚মি রেশমের মতো কোমল ও সহনশীল, যাবতীয় দৃশ্য সব থিতু: ঔদার্যে টইটই।
হাতিশুঁড়ে শিলার রহস্যময় অন্তর্ধানের পর রিজিয়া সুলতানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি গাজী খাঁকে নিয়ত অভিসম্পাত জ্ঞাপন করেন। পরিবারের স্বজনেরা মোশতাককে দায়ী করেছে।
একরের পর একর জমির প্রতিটি ইঞ্চিতে অনুসন্ধান চলেছিলো। বহুদিন।
শিলার সবুজ ওড়নাটা পাওয়া গিয়েছিলো শবজিক্ষেতে।
এই কঠিন আঘাতে মহব্বত আলি এতোটাই পীড়িত হয়েছেন—ঘটনার বিবরণটুকুও জেনে নিতে চাননি।
আর মোশতাক?
ধুধু শূন্যতা ভেদ করে তার দুই চোখ অবিরত ছোটে মাঠের দিকে।
ওই তো শবজিক্ষেত। সেদিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। শিলাকে ওরা গ্রহণ করেছে। সেই ঝঞ্ঝার ক্রুদ্ধ নিস্বন—সেইসব দৃশ্যাবলী তার কাছে অসত্য বলে মনে হয়।
কেউ ছিলো না, কেউ দেখেনি, কোনো সাক্ষী নেই…
সে বিশ্বাস করে না। বুঝি-বা তার কল্পনা—মনের এক নিষ্ঠুর বিভ্রম।
বনপথে পল্লবমর্মরে যখন ভেসে আসে শব্দ—তার বিশ্বাস—শিলার পদস্পন্দন।
কথা রাখে শিলা।
একটানা স্তব্ধতার পর অথবা প্রতি জ্যোৎস্নায় বিষণ্ন মোশতাকের একাকিত্বে, বনবীথিকায় কখনও চলার সময় প্রদোষে, কিংবা কোনো বৈশাখি-সন্ধ্যার তৃতীয় প্রহরে, বা শরৎ-এর পূর্ব ঋতুর অপরাহ্নে কোনো বিলের কাছে গজিয়ে-ওঠা পাথরকুঁচির দিকে তাকিয়ে মোশতাক যদি ডাকে, শিলা বলে: ‘আছি।’
কচুরি ফুলের দিকে তাকিয়ে যখন সে শুধোয়: ‘ও কই।’
‘এই তো…।’
শিলা বৃষ্টিকণায় আসে।

হোসেন হায়দার চৌধুরীকে

 

পত্রিকা: গাণ্ডীব। গ্রন্থভূক্ত: কাটা সাপের মুণ্ডু

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!