:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
লতিফুল ইসলাম শিবলী

লেখক, গীতিকার

চেনা মুখ চেনা ভাষা, অচেনা সুর আন্তর্জাতিক অভিব্যক্তি
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

চেনা মুখ চেনা ভাষা, অচেনা সুর আন্তর্জাতিক অভিব্যক্তি

২৫ অক্টোবর, ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ। ঢাকার বনানী আর্মি স্টেডিয়াম। ক্যামোফ্লেজধারী অত্যাধুনিক কারবাইন হাতে সমস্ত স্টেডিয়ামটি ঘেরাও করে রেখেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রাইভেট সিকিউরিটি ফোর্স তাদের মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে এবং বাংলাদেশ আর্মি মাইন অনুসন্ধানের যন্ত্রপাতি নিয়ে স্টেডিয়ামের প্রতিটি প্রবেশ পথে যাদের দেহ তল্লাশি চালিয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে, তাদের সবার বয়স ১৩ থেকে ৩০-এর মধ্যে। এই সময়ের টগবগে তারুণ্য। ধীরে ধীরে ভরে উঠেছে স্টেডিয়াম। ঠিক এমন সময় সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো একটা পটকা। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানো হলো ভিড়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই তরুণকে; এ এক অন্যরকম চরিত্র। যে চরিত্রের নাম তারুণ্য। নিয়মের মাঝে থেকে নিয়ম ভাঙার উল্লাস কিংবা নিয়ম মেনেই নিয়ম ভাঙার আনন্দ, যুগ যুগ ধরে এই হচ্ছে তারুণ্যের চিরচেনা চরিত্র।

ততক্ষণে সূর্য ঢলে গেছে পশ্চিম আআকাশে। গ্যালারির সবচেয়ে উঁচু ধাপে গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী ফৌজদের ছায়া যখন দীর্ঘ হতে হতে তার গাম্ভীর্যকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে, যখন ১৫ হাজার তরুণ বুল ফাইটের ষাঁড়ের মতো সামনের বাঁধাকে সরিয়ে দিতে উনুনের পাত্রের জলের মতো টগবগ করে ফুটতে আরম্ভ করছে, ঠিক তখন ২০ হাজার ওয়াটের সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে উঠল গিটারের বুকফাটা ডিসটর্টেড চিৎকার। মুহূর্তে আগুন হয়ে জ্বলে উঠল, ১৫ হাজার মিলিত কণ্ঠস্বরে গেয়ে উঠল- ‘ওগো সোনার মেয়ে’। যেন একটি দেহে ১৫ হাজার আত্মা কিংবা ১৫ হাজার আত্মা মিলে একটি দেহ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে এ সময়ের দুর্দান্ত অভিব্যক্তি।

আমাদের গানে ব্যান্ড সংগীতের আগমনকে সুন্দরভাবে স্বাগত জানানো হয়নি, এ কথা সর্বজন বিদিত। আজকের ব্যান্ড সংগীত আমাদের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেওয়ার জন্যে যেভাবে এগুচ্ছে অথবা যারা এই সংগীতের ধারক-বাহক হয়ে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তারা তাদের এই সংগ্রামকে ‘আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করতে চায়। তাদের এই আন্দোলন কতটা সফল হবে তার বিচারের দায়িত্ব সময়ের।

যুগযন্ত্রণায় কাতর এই তারুণ্যের প্রতিটি রক্তকণিকা হাহাকার তুলে অচেনা সুরে চেনা ভাষায় আন্তর্জাতিক অভিব্যক্তিতে অচেনা আর্তনাদ তুলে বলছে, দেখে যাও ‘কত কষ্টে আছি’। নাটোরের গ্রামীণ তেবাড়িয়া হাটের সেই পোড়খাওয়া মানুষটির আবেগ নিজ হৃদয়ে ধারণ করে এই নাগরিক বাউলেরা ক্ষতের উপশম খুঁজে নেয়- ‘মান্নান মিয়ার তিতাস মলম’ থেকে। সমবেত কণ্ঠ হয়ে উঠল সমবেত শক্তি, সমবেত শক্তি দিল সমবেত সাহসী উচ্চারণ আর তাই নির্দ্বিধায় ঘোষিত হলো- ‘সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্যের’ এক নির্মম চিত্রকল্প। এ তারুণ্য নগরকে ঘেরাও করে ফেলতে চায় সবুজ গ্রাম দিয়ে। তাই দিকে দিকে তাদের লোকজ আহ্বান- ‘মেলায় যাইরে’।

এখন শুধু তাদের জ্বালাধরা চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলে জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। কিছু পরেই আকাশে হঠাৎ করে উঠে এল সেই প্রাগৈতিহাসিক চাঁদ, শুরু হলো লেজার লাইটের জাদুকরী চমক। আশাহত বঞ্চিত রাগী তারুণ্যের আবেগমাখা দৃষ্টি তখন ঘাড় উঁচু করে আঙুল উঁচিয়ে পৌঁছে গেছে মহানীলাকাশের অনন্ত অম্বরে। তার সমস্ত অভাব-অভিযোগ নতজানু না হয়ে আর কাউকে না জানিয়ে মহিমান্বিত চাঁদকেই শুধু বলছে- ‘মধ্যরাতে মাথার উপর চাঁদকে একা পাই/চাঁদ ছাড়া যে আমার আর কোনো মামা নাই, জুতার তলা ক্ষয়ে গেছে, ছিড়ে গেছে জামা, একটা চাকরি হবে মামা, আরে ও চাঁদ মামা’। সুরে সুরে দুলছে ১৫ হাজার তরুণের ৩০ হাজার হাত। বঞ্চিত এই প্রাণেরা লুকিয়ে রাখে তার একান্ত কষ্টটি। অভিমানী বোবা আর্তিতে তারা জানায়- ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো-অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো, শুধু দেখনা কেউ হাসি শেষের নীরবতা’।

সুরে সুরে দুলছে ১৫ হাজার তরুণের ৩০ হাজার হাত।

তারপর ওদের বুকের সমস্ত জমাট অভিযোগ-অভিমান, হাসি-কান্না সব কিছু ইথারে ইথারে ছড়িয়ে দিয়ে বুকটা খালি করে দিয়ে ওরা বাড়ি ফিরে যাবে। এভাবেই শেষ হয় বর্তমান তারুণ্যের মিলনমেলা- ‘কনসার্ট’।

কনসার্ট শব্দটি আমাদের সমাজে নতুন হলেও এর আবেদন এখন তুঙ্গস্পর্শী। বিশেষ করে এতক্ষণ যাদের কথা বলা হলো, সেই তরুণ সমাজের কাছে ‘কনসার্ট’ এখন ক্রেজ। ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তি সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধন করেছে, তার প্রত্যক্ষ ফল হলো- ব্যান্ডসংগীত। হাজার রকমের বাদ্যযন্ত্রের সুর ধারণ করতে পারে একটা কিবোর্ড। বিভিন্ন মেজাজের ইফেক্ট সংবলিত ইলেকট্রিক লিড ও বেজ গীটার এবং ড্রামস মিলে ভিন্ন সুরে, কথায় ও গায়কীতে সাধারণভাবে সংগীতের এই গ্রুপ পারফরমেন্সের নাম- ‘ব্যান্ডমিউজিক’। ইনডোর অথবা ওপেন এয়ারে শক্তিশালী সাউন্ড সিস্টেম এবং অত্যাধুনিক লাইটিংস-এর মাধ্যমে মনোজ্ঞ উপস্থাপনের নাম কনসার্ট।

পাশ্চাত্য গানের বিভিন্ন ধারা যেমন জ্যাজ, ব্লুজ, পপ, কান্ট্রি, রক এ্যান্ড রোল, মেটাল, হেভি মেটাল ইত্যাদি গানের ফর্ম ঠিক রেখে অথবা ইমপ্রোভাইস করে- বাংলা গানের এই নব এবং আধুনিক রূপটি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যে লুফে নিয়েছে তার প্রমাণ এই সময়ের কনসার্টগুলো লক্ষ করলেই বোঝা যায়। আমাদের দেশে এই ব্যান্ড মিউজিকের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর মাত্র। একটি নতুন ধারার সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেওয়ার জন্য যদিও এত অল্প সময় কিছুই নয়, তবুও আমাদের এই স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য সময়টা কমও নয়। আমাদের গানে ব্যান্ড সংগীতের আগমনকে সুন্দরভাবে স্বাগত জানানো হয়নি, এ কথা সর্বজন বিদিত। আজকের ব্যান্ড সংগীত আমাদের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেওয়ার জন্যে যেভাবে এগুচ্ছে অথবা যারা এই সংগীতের ধারক-বাহক হয়ে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তারা তাদের এই সংগ্রামকে ‘আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করতে চায়। তাদের এই আন্দোলন কতটা সফল হবে তার বিচারের দায়িত্ব সময়ের। আমাদের মনে রাখা উচিত, সামনে এগুতে হলে মাঝে মাঝে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। পেছনের শিক্ষা মানুষকে সামনে এগুনোর অনুপ্রেরণা যোগায়। ব্যান্ড সংগীত নিয়ে উন্মুক্ত আজকের তারুণ্যের বেশিরভাগই জানেনা আমাদের বাংলা গানের অতীত ইতিহাস কতটা সমৃদ্ধ। কতটা পথপরিক্রমায় আমাদের বাংলা গান এসে পৌঁছেছে সশস্ত্র প্রহরী বেষ্টিত বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামের এই কনসার্টে।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.